পঞ্চম অধ্যায়
দেশজ শিক্ষাব্যবস্থার অপমৃত্যু – দেশি ধান বনাম বিলিতি ওক
The conquest of India was a conquest of knowledge.
— Bernard S. Cohn, Colonialism and Its Forms of Knowledge: The British in India
দেশ জুড়ে যে সময়ে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা চালু হচ্ছে রমরমিয়ে, তখন ঠিক কিসের বিনিময়ে আমরা এই শিক্ষাকে বরণ করে নিয়েছিলাম বা নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, সেটা দেখে নেওয়া জরুরি। এমন নয় যে দেশে তখন লেখাপড়ার চল ছিল না, কিংবা যেটুকু লেখাপড়া হত তা প্রয়োজনের তুলনায় অল্প ছিল বলেই ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন হয়েছিল। বরং ১৮১৩ সালের নতুন সনদে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয় করার জন্য, কোম্পানির পরিচালকবর্গ তৎকালীন ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সমীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই মোতাবেক ১৮২২-এ মাদ্রাজ ও পরের বছরে বোম্বেতে সমীক্ষার কাজ শুরু হয়।
১৮২৬-এর ১০ মার্চ মাদ্রাজের ছোটলাট টমাস মুনরো (Thomas Munro) বিভিন্ন জেলার কালেক্টরদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানান, তাঁর প্রদেশের জনসংখ্যা ১,২৩,৫০,৯৪১ জন এবং দেশজ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১,৭৫৮টি ও কলেজের সংখ্যা ৭৪০টি। সেখানে শিক্ষাগ্রহণ করে ১,৫৭,৬৬৪ জন ছাত্র ও ৪,০২৩ জন ছাত্রী।১ এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের বাড়িতে শিক্ষাগ্রহণের প্রথা প্রচলিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, মাদ্রাজের কালেক্টর জানাচ্ছেন যে তাঁর জেলায় এমন শিক্ষার্থী ২৬,৯৬৩ জন। মালাবারের কালেক্টর জানান, তাঁর জেলায় গৃহশিক্ষকদের কাছে ১,৫৯৪ জন ছাত্র শিক্ষালাভ করছে ধর্মতত্ব (Theology), আইন, জ্যোতির্বিদ্যা, অধিবিদ্যা (Metaphysics), নীতিবিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্র।২ ১৮২৩-এ বোম্বের গভর্নর এলফিনস্টোন (Mountstuart Elphinstone)-এর তত্ত্বাবধানে, দেশজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সমীক্ষা করা হয়। ১৮২৪ থেকে ১৮২৯ পর্যন্ত বিভিন্ন জেলা কালেক্টররা সমীক্ষা চালিয়ে জেলা জজদের কাছে জমা দেন। রিপোর্ট প্রকাশিত হলে জানা যায়, ১৮২৯ সালে প্রদেশের মোট জনসংখ্যা ৪৬,৮১,৭৩৫ জন এবং ছাত্রসংখ্যা ৩৫,১৫৩ জন।৩
মাদ্রাজ ও বোম্বেতে দেশজ শিক্ষা নিয়ে সমীক্ষার কাজ শেষ হওয়ার অনেক পরে, বাংলাতে সে ব্যাপারে কাজ শুরু হয়। ওই দুটি প্রদেশে গোটা সমীক্ষার দায়িত্বে সেই প্রদেশের গভর্নর ও বিভিন্ন জেলার কালেক্টররা থাকলেও, বাংলার ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটে। সরকারি প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৮৩৫-এর ২০ জানুয়ারি, লর্ড বেন্টিঙ্ক বাংলা ও বিহারের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সমীক্ষা চালানোর জন্য উইলিয়াম অ্যাডামকে অনুমতি দেন। ওই বছরের ১ জুলাই, অ্যাডাম তাঁর প্রথম প্রতিবেদনটি তদানীন্তন শিক্ষা সংসদের সভাপতি মেকলেকে সরকারিভাবে জমা দেন। তিনি তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রতিবেদন জমা দেন, যথাক্রমে ১৮৩৫-এর ২৩ ডিসেম্বর ও ১৮৩৮-এর ২৮ এপ্রিল। মেকলে অবশ্য অ্যাডামের প্রতিবেদনগুলিকে ‘the best sketches on the state of education that had been submitted before the public’৪ বলে প্রশংসা করতে ভোলেননি।
পাশ্চাত্য শিক্ষা পুরোমাত্রায় চালু হওয়ার আগে বাংলার প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা, ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার মতো প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা কেন্দ্রীভূত ছিল না। বরং এখানে চালু ছিল দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারা। প্রথম ধারার অন্তর্ভুক্ত ছিল উচ্চবর্ণ ও উচ্চশ্রেণির জন্য সংস্কৃত ও আরবি-ফারসি শিক্ষা। বাংলার রাজা-জমিদাররা পণ্ডিত-মৌলবিদের যে নিষ্কর লাখেরাজ ও বদদ্-ই-মাশ ভূমি দান করতেন, মূলত তার আয়ের ওপর এই ধারার শিক্ষাব্যবস্থা নির্ভরশীল ছিল। উত্তর ভারতে সংস্কৃত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ‘চতুষ্পাঠী’ হিসেবে গণ্য হত এবং সেখানে বেদবিদ্যা অধ্যয়ন আবশ্যিক ছিল। তবে বাংলার টোলগুলিতে, প্রধানত নব্যন্যায়ের পরাক্রমের কারণেই বেদ পাঠের তেমন প্রচলন ছিল না।
সংস্কৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মতোই, বাংলার ফারসি শিক্ষার বিদ্যালয়গুলোও ঠিক মাদ্রাসার পর্যায়ভুক্ত ছিল না। মূলত রাজভাষা ফারসি শেখার গরজেই এগুলি গড়ে উঠেছিল। মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে, সরকারের উচ্চপদগুলি বাংলার ফারসি জানা হিন্দুদের হাতে আসে। ফলে হিন্দুদের মধ্যেও ফারসি শেখার রেওয়াজ ক্রমশ বাড়তে থাকে। বিপিনচন্দ্র পাল লিখেছেন:
আজিকালি [১৩৩৩ বঙ্গাব্দ] যেমন ইংরেজ সরকারের চাকুরী কিম্বা আদালতে ওকালতি করিয়া জীবিকা উপার্জনের জন্য লোকে ইংরেজী শিখিয়া থাকে সেকালে সেইরূপ যাহাদিগকে সচরাচর ভদ্রলোক বলে তাঁহারা যত্ন করিয়া ফার্সী শিখিতেন। এখন যেমন আইন আদালতের ভাষা হইয়াছে ইংরেজী, নবাবী আমলে সেইরূপ ফার্সী আমাদের দেশের রাজভাষা ছিল। যাঁহাদের রাজসরকারে চাকুরী করিবার লোভ ছিল তাঁহারা ফার্সী শিখিতেন।৫
সমাজের উচ্চশ্রেণির প্রয়োজনের তাগিদে এই বিদ্যালয়গুলি গড়ে ওঠার ফলে, পাঠশালার সঙ্গে এঁদের তেমন একটা সম্পর্ক ছিল না। বলা বাহুল্য, উচ্চ রাজপদ কুক্ষিগত করে রাখার বাসনা থেকেই এই উচ্চবর্ণ ও উচ্চশ্রেণির অভিজাতরা, যুগের চাহিদা বুঝে ফারসির বদলে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার সোচ্চার সমর্থক ছিলেন। লর্ড আমহার্স্টকে লেখা রামমোহন রায়ের চিঠি, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
অন্যদিকে দ্বিতীয় ধারার শিক্ষাব্যবস্থা ছিল, সাধারণ মানুষের অর্থে পরিপুষ্ট ও তাঁদের প্রয়োজনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা, সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষায় লেখা, পড়া আর অঙ্ক শেখার ধারা। প্রথম ধারার শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে এই দ্বিতীয় ধারাটির কোনও পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল না। এখানে লেখাপড়ার জন্য প্রচলিত ছিল পাঠশালা ও মক্তব। তবে মক্তবগুলির শিক্ষাদান পদ্ধতি অনেক বেশি ধর্মীয় প্রভাবাধীন হলেও, পাঠশালার শিক্ষা ছিল প্রায় ধর্মনিরপেক্ষ। শুধু তাই নয়, পাঠশালার শিক্ষা যে পুরোপুরি ব্যবহারিক শিক্ষা ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। কৃষি, কুটিরশিল্প, কারিগরি আর ব্যবসাই ছিল তখন সাধারণ মানুষের প্রধান জীবিকা। চাকরির খুব একটা সুযোগ তাঁদের জন্য ছিল না। কিছু কৃষিজীবী একই সঙ্গে জমিদারি সেরেস্তায় বা মহাজনের খাতা লেখার কাজও করতেন, কারণ সরকারি কাজকর্মে ফারসি ভাষা চালু থাকলেও বাংলায় জমিদারি সেরেস্তায় রাজস্ব ও খাজনার হিসেব বাংলাতে রাখা হত। পাঠশালা শিক্ষা ছিল এই কৃষিজীবী, কারিগর, দোকানদার, জমিদারি সেরেস্তার কর্মচারী ইত্যাদি সাধারণ শ্রেণির মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ এক সাধারণ শিক্ষাধারা।
পাঠশালার ক্ষেত্রে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই শিক্ষাব্যবস্থায় জাতি বা ধর্মের কোনও ভেদাভেদ ছিল না। তাই পাঠশালার ছাত্র এবং শিক্ষক যে কোনও জাত বা ধর্মের হতে পারতেন। সেই নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনও রক্ষণশীল মনোভাব ছিল না। এই কথাকে সমর্থন করে মীর মশার্রাফ হোসেন লিখছেন –
চার বৎসর চার মাস চার দিন পর আমার হাতে তাক্তি (হাতেখড়ি) হইয়াছিল। গ্রাম্য শিক্ষক মুন্সী ভিন্ন পাশ করা মৌলবী আমাদের দেশে কেহ ছিল না। ...তবে কোন কোন গ্রামে গুরু মহাশয়ের পাঠশালা ছিল। মক্তাব মাদ্রাসার নামও কেহ জানিত না। ফারসী আরবি কেহ পড়িত না। অভিভাবকেরাও প্রয়োজন মনে করিতেন না। বাঙ্গলাবিদ্যা গুরু মহাশয়ের পাঠশালায় সীমাবদ্ধ ছিল; ... গ্রামে আরবি ফারসী পড়ার নিয়ম নাই, প্রয়োজনও বেশী নাই। ...আমি নন্দী মহাশয়ের নিকট বাঙ্গালা অক্ষর লেখা শিক্ষা করিতে লাগিলাম। আরবি বর্ণমালা শিক্ষার অগ্রে বাঙ্গালার বর্ণমালা মুখস্থ হইল। তালপাতে অক্ষর লিখিতে শিখিলাম।৬
পাঠশালাগুলিতে সর্বসাধারণের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল, তাতে শেখানো হত দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রাথমিক শিক্ষা যথা – অক্ষর পরিচয়, বানান, নামতা, অঙ্ক, শুভঙ্করী আর্যা ইত্যাদি। এ ছাড়া ছিল জীবিকার জন্য শিক্ষা যেমন – জমি আর শস্যের মাপ, ওজনের হিসেব, দোকানদারির হিসেব, কড়া-গণ্ডা, কাঠা-ছটাক, টাকা-আনা-পাই, পথের মাপ, চিঠি লেখার ধারা প্রভৃতি। এছাড়াও ছিল জমিদারির হিসেব, জমির দলিল, খাজনা দাখিল লেখার কায়দা, গোমস্তার হুকুমনামা, খত ইত্যাদি নানারকমের মুসাবিদা। এমনকি ঘর তৈরি, পুকুর কাটা বা কুয়ো তৈরির মাপজোকও শেখানো হত পাঠশালায়।
শিবনাথ শাস্ত্রী পাঠশালার শিক্ষাপদ্ধতির নিখুঁত বিবরণ দিয়েছেন এই ভাষায় —
পাঠশালে পাঠনার রীতি এই ছিল যে, বালকেরা প্রথমে মাটিতে খড়ি দিয়া বর্ণ পরিচয় করিত; তৎপরে তালপাত্রে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, যুক্তবর্ণ, শটিকা, কড়াকিয়া, বুড়িকিয়া প্রভৃতি লিখিত; তৎপর তালপাত্র হইতে কদলীপত্রে উন্নীত হইত; তখন তেরিজ, জমাখরচ, শুভঙ্করী, কাঠাকালী, বিঘাকালী প্রভৃতি শিখিত; সর্বশেষে কাগজে উন্নীত হইয়া চিঠিপত্র লিখিতে শিখিত। সে সময়ে শিক্ষা-প্রণালীর উৎকর্ষের মধ্যে এইটুকু স্মরণে আছে যে, পাঠশালে শিক্ষিত বালকগণ মানসাঙ্ক বিষয়ে আশ্চর্য পারদর্শিতা দেখাইত; মুখে মুখে কঠিন কঠিন অঙ্ক কষিয়া দিতে পারিত। চক্ষের নিমিষে বড় বড় হিসাব পরিষ্কার করিয়া ফেলিত। এক্ষণে যেমন ভৃত্যের দশ দিনের বেতন দিতে হইলেও ইংরাজী-শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের কাগজ ও পেন্সিল চাই, ত্রৈরাশিকের অঙ্কপাত করিয়া কাগজ ভরিয়া ফেলিতে হয়, তখন সেরূপ ছিল না।৭
পাঠশালাগুলি বসত সাধারণত কোনও চণ্ডীমণ্ডপ বা কারও বৈঠকখানা কিংবা কখনও খোলা মাঠে। গুরুমশাইরা পড়ুয়াদের দেওয়া বেতন ও সিধের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে সরকারি-বেসরকারি বিবরণ ও নথি থেকে বোঝা যায়, এ শিক্ষা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং বাংলা ও বিহারের অধিকাংশ গ্রামে এ ধরনের পাঠশালা ছিল।
অ্যাডাম তাঁর প্রথম প্রতিবেদনটিতে, মূলত বাংলার দেশজ শিক্ষার প্রকৃতি ও সুযোগসুবিধার বিষয়ে পূর্ববর্তী আমলের পাঁচটি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আলোচনা করেন। এই পাঁচটি সুত্র ছিল যথাক্রমে – ১) ফ্রান্সিস বুকানন (Dr. Francis Buchanan)-এর প্রতিবেদন, ২) শিক্ষা সংসদ (General Committee of Public Instruction)-এর বিভিন্ন নথি, ৩) হ্যামিলটন (Walter Hamilton)-এর ইস্ট ইন্ডিয়া গেজেটিয়ার (১৮২৮), ৪) মিশনারিদের স্কুল-কলেজের নথিপত্র ও ৫) ফিশার (Fisher)-এর স্মৃতিকথা (১৮৩২)। এই প্রতিবেদনে দেশজ প্রাথমিক শিক্ষার বিদ্যালয়গুলির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অ্যাডাম লেখেন,
যে সব বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয় এবং যেগুলি দেশীয় লোকের সাহায্যে দেশীয় লোকের দ্বারা স্থাপিত অর্থাৎ যেগুলি কোনও ধর্মীয় সংস্থা বা দাতব্য সংস্থার সাহায্যে গড়ে ওঠেনি, সে সব বিদ্যালয়কে দেশজ প্রাথমিক বিদ্যালয় বলা হচ্ছে।৮
দ্বিতীয় প্রতিবেদনটিতে অ্যাডাম নিজে রাজশাহি জেলার নাটোর থানার মোট ৪৮৫টি গ্রামে সমীক্ষা করে যে তথ্য পান, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেন। এই প্রতিবেদনেই তিনি দেশজ শিক্ষাব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করে জানান:
My recollections of the village schools of Scotland do not enable me to pronounce that the instruction given in them has a more direct bearing upon the daily interests of life than that which I find given, or professed to be given, in the humbler village schools of Bengal.৯
সব মিলিয়ে নাটোরে শিক্ষিতের সংখ্যা ছিল ৬,১২১জন। তার ভিত্তিতে অ্যাডাম নাটোরে শিক্ষিতের হার বলেছেন ‘the proportion of the uninstructed to the instructed male adult population of Nattore is as 1000 to 114.6’ বা ১১.৪৬%।১০
অ্যাডামের তৃতীয় প্রতিবেদনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রতিবেদনে তিনি মুর্শিদাবাদের ৩৭টি থানার মধ্যে ২০টি থানা এবং বাংলার বীরভূম ও বর্ধমান এবং বিহারের দক্ষিণ বিহার ও ত্রিহুতের সমীক্ষার ফলাফল জানান। প্রতিবেদনটির শেষে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও সুপারিশও পেশ করেন। প্রথমে জেলাগুলির প্রত্যেকটি থানাতে তাঁর যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ‘the sudden appearance of a European in a village often inspired terror’১১ বুঝতে পেরে, সেই পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন। অবশেষে প্রতিটি জেলার একটি থানাতে সমীক্ষা চালান অ্যাডাম স্বয়ং এবং বাকি থানাগুলিতে তাঁর নির্দেশ ও তাঁর নির্ধারিত নির্দিষ্ট প্রশ্নমালার ভিত্তিতে, তাঁর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারীরা তথ্য সংগ্রহ করেন। এই দেশজ শিক্ষাব্যস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে চিহ্নিত করে অ্যাডাম বলেছেন –
The Musalman teachers have Hindu as well as Musalman scholars; and the Hindu and Musalman scholars and the different castes of the former assemble in the same school-house, receive the same instructions from the same teacher, and join in the same plays and pastimes.১২
এ ছাড়া মেদিনীপুরের যুগ্ম জেলাশাসক ম্যালেট (O.W. Malet) নিজ উদ্যোগে ১৮৩৬ সালের মার্চ মাসে, সেই জেলার দেশজ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত সমীক্ষা করে অ্যাডামকে জানান।
অ্যাডামের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণগুলিকে ইচ্ছাকৃতভাবে পাশ কাটিয়ে, তাঁর প্রথম প্রতিবেদনে উল্লিখিত বাংলা ও বিহার মিলিয়ে এক লক্ষ দেশজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়টি নিয়ে, ইংরেজি শিক্ষার সমর্থকেরা অকারণ বিতর্ক করে থাকেন। অথচ তাঁর প্রথম প্রতিবেদনটি খুঁটিয়ে পড়লেই স্পষ্ট হবে যে, এ কথা অ্যাডাম তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলেননি, বলেছিলেন সরকারি শিক্ষা সংসদের এক সদস্যের বয়ানের ভিত্তিতে। তিনি প্রতিবেদনে এ বিষয়ে লিখেছেন —
A distinguished member of the General Committee of Public Instruction in a minute on the subject expressed the opinion, that if one rupee per mensem were expanded on each existing village school in the Lower Provinces, the amount would probably fall little short of 12 lakhs of rupees per annum. This supposes that there are 100,000 such schools in Bengal and Behar, and assuming the population of those two Provinces to be 40,000,000, there would be a village school for every 400 persons.১৩
এই পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করে অ্যাডাম জানান:
The estimate of 100,000 such schools in Bengal and Behar is confirmed by a consideration of the number of villages in those two provinces. Their number has been officially estimated at 150,748, of which, not all, but most have each a school. If it be admitted that there is so large a proportion as a third of the villages that have no schools, there will still be 100,000 that have them.১৪
প্রসঙ্গত, এই বিষয়ে অ্যাডামের বহু আগে একই কথা উচ্চারণ করেছিলেন টমাস মুনরো। তিনি বলেছিলেন ‘there is one school to every 1,000 of the population; but as only a very few females are taught in school, we may reckon one school to every 500 of the population’।১৫ এমনকি বোম্বে এডুকেশন কমিটিও ১৮১৯ সালের একটি রিপোর্টে জানায় ‘There is probably as great a proportion of persons in India who can read, write, and keep simple accounts, as are to be found in European countries’। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ‘Schools are frequent among the natives, and abound everywhere’।১৬
অথচ প্রায় সবার নজরের আড়ালে চলে যাওয়া অ্যাডামের তৃতীয় প্রতিবেদনটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে, তদানীন্তন বাংলা ও বিহারে নিম্নশ্রেণির হিন্দু-মুসলমানদের সম্প্রীতি ও সদ্ভাব অনুভব করা সম্ভব। যেমন এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বীরভূমের ১৭টি জেলায় মোট ৪০৭ জন শিক্ষকের মধ্যে ৮৬ জন ব্রাহ্মণ ও ২৫৬ জন কায়স্থ ছাড়াও অন্য বর্ণের শিক্ষক ছিলেন ৬৫ জন, যা মোট শিক্ষকসংখ্যার প্রায় ১৬%। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ১২ জন সদ্গোপ; ৮ জন বৈষ্ণব; ৫ জন করে গন্ধবণিক ও সুবর্ণবণিক; ৪ জন করে ভট্ট, কৈবর্ত ও ময়রা; ৩ জন গোয়ালা; ২ জন করে বৈদ্য, আগুরি, যুগি, তাঁতি, কলু ও শুঁড়ি এবং একজন করে স্বর্ণকার, রাজপুত, নাপিত, বাড়ুই, ছত্রী, ধোপা, মালো ও চণ্ডাল। বর্ধমানের ৬২৭ জন হিন্দু শিক্ষকের মধ্যে ১০৭ জন ব্রাহ্মণ ও ৩৬৯ জন কায়স্থ ছাড়াও অন্য বর্ণের শিক্ষক ছিলেন, মোট শিক্ষকসংখ্যার ২৪% বা ১৫১ জন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ৫০ জন সদ্গোপ; ৩০ জন আগুরি; ১৩ জন বৈষ্ণব; ১০ জন তেলি; ৯ জন ভট্ট; ৬ জন গন্ধবণিক; ৫ জন কৈবর্ত; ৪ জন চণ্ডাল; ৩ জন করে কুমোর ও নাপিত; ২ জন করে সুবর্ণবণিক, গোয়ালা ও বাগদি এবং একজন করে নাগা, তাঁতি, দৈবজ্ঞ, বৈদ্য, যুগি, বাড়ুই, কামার, ময়রা, ধোপা, রাজপুত, কলু ও শুঁড়ি। এ ছাড়াও ছিলেন ৯ জন মুসলমান ও ৩ জন খ্রিস্টান শিক্ষক।
শিক্ষকদের মতো পড়ুয়ারাও ছিল বিভিন্ন ধর্ম বা বর্ণসম্প্রদায়ের। ব্রাহ্মণ-কায়স্থ ছাত্রের সংখ্যা মোট ছাত্রসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি ছিল না। বিহারের দুটি জেলায় এই সংখ্যাটা ছিল আরও কম, ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ। যেমন, বীরভূমে মোট ৬,১২০ জন পড়ুয়ার মধ্যে ১,৮৫৩ জন ব্রাহ্মণ ও ৪৮৭ জন কায়স্থ ছাড়াও অন্যান্য বর্ণের ছাত্র ছিল ৩৭৮০ জন বা প্রায় ৬২%। বর্ধমানের ৬২৯টি পাঠশালার মোট পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল ১৩ হাজারের কিছু বেশি। এদের মধ্যে ৩,৪২৯ জন ব্রাহ্মণ ও ১,৮৪৬ জন কায়স্থ ছাড়া, বাকি সবাই ছিল সমাজের একেবারে নীচের স্তরের বিভিন্ন বর্ণের মানুষ। এ ছাড়াও পাঠশালায় ছিল ৭৬৯ জন মুসলমান ও ১৩ জন খ্রিস্টান ছাত্র। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান, দক্ষিণ বিহার ও ত্রিহুতের আরবি-ফারসি বিদ্যালয়গুলির মোট ৭২৯ জন শিক্ষকের মধ্যে ১৪ জন হিন্দু ছাড়া, বাকিরা ছিলেন মুসলমান। কিন্তু এই বিদ্যালয়গুলির মোট ৩,৬৬৩ জন পড়ুয়ার মধ্যে ২,০৯৬ জন ছিল হিন্দু।
অ্যাডামের প্রতিবেদনের আরও একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি রীতিমতো সারণি সাজিয়ে দেখিয়েছেন (চিত্র-১ দ্রষ্টব্য), বর্ধমানের ১৩টি মিশনারি স্কুলে পড়ত মাত্র একজন চণ্ডাল ও ৩ জন ডোম, অথচ সেখানকার পাঠশালাগুলিতে তাদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬০ ও ৫৮ জন। প্রথমোক্ত স্কুলে যেখানে ১৬টি নিম্নতম বর্ণের – প্রধানত চণ্ডাল, ডোম, বাগদি, মুচি, হাড়ি প্রভৃতি – ছাত্রসংখ্যা ছিল সাকুল্যে ৮৬, সেখানে পাঠশালাগুলিতে তাদের সংখ্যা ছিল ৬৭৪।১৭ কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও আর্থিক সাহায্য না পেয়েও সাধারণ মানুষ তাঁদের নিজেদের উদ্যমে, কেবল মাতৃভাষায় শিক্ষাচর্চা অব্যাহত রেখে যে ঐতিহ্যগত সম্প্রীতির নিদর্শন হাজির করেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য এবং প্রায় অকল্পনীয়।
https://i.postimg.cc/52PnpRGK/Burdwan-Chandals.jpg
তৎকালীন বাংলার উচ্চশিক্ষার চরিত্র সম্পর্কে অ্যাডাম তাঁর প্রথম প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ১৮১৮ সালে ওয়ার্ড (Mr. Ward) কলকাতায় ২৮টি সংস্কৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা বলেন, যেখানে শিক্ষাগ্রহণ করত ১৭৩ জন (গড়ে ৬ জন)। নবদ্বীপে ছিল ৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্র ছিল ৭৪৭ জন (গড়ে ২৪ জন)। ১৮৩০-এ উইলসন (H.H. Wilson) ব্যক্তিগত সমীক্ষার ভিত্তিতে জানিয়েছেন নবদ্বীপের ২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা, যেখানে পড়ত প্রায় ৬০০ জন পড়ুয়া।১৮ অ্যাডাম জানিয়েছেন, বাংলায় সংস্কৃত শিক্ষার তিন রকমের প্রতিষ্ঠান ছিল – এক ধরনের প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হত মূলত ব্যাকরণ, কাব্য ও অলঙ্কার এবং মাঝেমধ্যে পৌরাণিক কাব্য ও স্মৃতিশাস্ত্র; দ্বিতীয় ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধানত স্মৃতিশাস্ত্র ও কদাচিৎ পৌরাণিক কাব্য এবং তৃতীয় ধরণের প্রতিষ্ঠানে মূল পাঠ্যবিষয় ছিল ন্যায়শাস্ত্র।১৯
তাঁর সমীক্ষা করা জেলাগুলির ভিত্তিতে অ্যাডাম সংস্কৃত শিক্ষা সম্পর্কে যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তা সংক্ষেপে এইরকম — এই ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ৩৫৩ টি, সর্বোচ্চ বর্ধমানে ১৯০টি (১,৩৫৮ জন শিক্ষার্থী) এবং সর্বনিম্ন মুর্শিদাবাদে ২৪টি (১৫৩ জন)। ৩৫৫ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ৫ জন বৈদ্যকে বাদ দিলে বাকি সকলেই ছিলেন ব্রাহ্মণ। এখানে ছাত্ররা পড়ত – ব্যাকরণ (১,৪২৪ জন), ন্যায়শাস্ত্র (৩৭৮ জন), স্মৃতিশাস্ত্র (৩৩৬ জন) ও সাহিত্য (১২০ জন)। এছাড়াও তারা পড়ত পুরাণ (৮২ জন), জ্যোতিষশাস্ত্র (৭৮ জন), শব্দবিজ্ঞান বা Lexicology (৪৮ জন), অলঙ্কার (১৯ জন), চিকিৎসাশাস্ত্র (১৮ জন), তন্ত্রশাস্ত্র (১৪ জন) বেদান্ত (১৩ জন), মীমাংসা (২ জন) ও সাংখ্য (১ জন)। শিক্ষার মেয়াদকাল, শিক্ষা শুরু ও সমাপ্তির সময় ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষার বিষয় অনুযায়ী ও জেলা অনুযায়ী তারতম্য ছিল। পাঠ্যপুস্তক হিসেবে শিক্ষার্থীদের পড়তে হত ব্যাকরণে সভাষ্য মুগ্ধবোধ, পতঞ্জলির মহাভাষ্য, সিদ্ধান্তকৌমুদী ইত্যাদি; ন্যায়শাস্ত্রে সিদ্ধান্ত মুক্তাবলী; স্মৃতিতে রঘুনন্দনের বিভিন্ন তত্ত্ব; সাহিত্যে ভট্টিকাব্য, হিতোপদেশ, রঘুবংশ, নৈষধচরিত, শকুন্তলা, কুমারসম্ভব, মাঘ ও ভারবি; শব্দবিজ্ঞানে অমর কোষ; অলঙ্কারে কাব্যপ্রকাশ, কাব্যচন্দ্রিকা, সাহিত্যদর্পণ প্রভৃতি।২০
অন্যদিকে টমাস মুনরোর মিনিট থেকে জানা যায়, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কালেক্টররা মোট ১,০৯৪টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা জানান। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৭৯টি ছিল রাজামুন্দ্রিতে (শিক্ষার্থী ১,৪৫৪ জন); তারপর যথাক্রমে কোয়েম্বাটুর ১৭৩টি (শিক্ষার্থী ৭২৪ জন); গুন্টুর ১৭১টি (শিক্ষার্থী ৯৩৯ জন); তাঞ্জোর ১০৯টি (শিক্ষার্থী ৭৬৯ জন); নেল্লোর ১০৭টি; উত্তর আর্কট ৬৯টি (শিক্ষার্থী ৪১৮ জন); সালেম ৫৩টি (শিক্ষার্থী ৩২৪ জন); চিঙ্গলেপুট ৫১টি (শিক্ষার্থী ৩৯৮ জন); মসুলিপট্টম ৪৯টি (শিক্ষার্থী ১৯৯ জন); বেলারি ২৩টি; ত্রিচিনাপল্লি ৯টি (শিক্ষার্থী ১৩১ জন) এবং মালাবারের একটি প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (শিক্ষার্থী ৭৫ জন)। যে সব জেলায় এই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, সে সব জেলার কালেক্টরদের তথ্য থেকে জানা যায় যে সেখানে শিক্ষার্থীরা বাড়িতে বেদ, আইন (স্মৃতিশাস্ত্র), জ্যোতির্বিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, নীতিবিদ্যা ইত্যাদির শিক্ষা গ্রহণ করছে।২১ এখানে রাজামুন্দ্রিতে পাঠ্যপুস্তক ও মাদ্রাজে প্রযুক্তি শিক্ষার দুটি চিত্র (চিত্র-২ ও ৩ দ্রষ্টব্য) সংযোজিত করা হল।
https://i.postimg.cc/SRCM5DrM/Books-in-Rajamundry.jpg
https://i.postimg.cc/tTVZZ28M/Technical-Education-in-Madras.jpg
ভারতবর্ষের পাশাপাশি উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর করলে দেখা যায়, ১৮০১-এ সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩,৩৬৩টি। ১৮৫১ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬,১১৪তে।২২ পড়ুয়ারা কত বছর ওই সব স্কুলে পড়ত, সে বিষয়ে ডবস জানিয়েছেন ‘the average length of school life rises on a favourable estimate from about one year in 1835 to about two years in 1851’।২৩ এমনকি ১৮৩৪ সালেও অধিকাংশ জাতীয় স্কুলেই পাঠক্রম সীমাবদ্ধ ছিল, মূলত ধর্মীয় শিক্ষা এবং লেখা-পড়া-অঙ্ক (The three ‘R’s) শেখার ওপর। অনেক গ্রামীণ স্কুলে অমঙ্গলের আশঙ্কায় লেখা অবধি শেখানো হত না।২৪
অ্যাডামসন ইটনের মতো নামকরা স্কুলের চিত্র জানিয়ে বলেছেন:
In public schools like Eton, teaching consisted of writing and arithmetic (a number of English and Latin books were studied); while those in the fifth form also learnt ancient Geography, or Algebra.
আর যারা সেখানে বেশ কিছুদিন পড়ার সুযোগ পেত, তারা এর বাইরে অতিরিক্ত শিখত ‘part of Euclid’। তবে ‘not till 1851 that Mathematics became a part of the regular school work’।২৫ উনিশ শতকের শুরুতে বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র ছিল এই রকম –
…there were nineteen colleges and five halls in Oxford. There were about 500 fellows in the colleges, a few of whom were engaged in teaching in each college. In addition, there were nineteen professors in 1800. This total had increased to 25 by 1854.
১৮০৫ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা বাড়তে থাকে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে থাকা ছাত্রের সংখ্যা ৭৬০ থেকে ১৮২০-২৪ সালের মধ্যে বেড়ে হয় ১৩০০ জন।২৬
এই পরিস্থিতিতে অ্যাডাম তাঁর তৃতীয় প্রতিবেদনের উপসংহারে, দেশজ ভাষায় দেশজ শিক্ষার প্রচলনের জন্য জোরালো সওয়াল করে বলেন —
I, however, expressed the opinion that, as far as my information then enabled me to judge existing native institutions from the highest to the lowest, of all kinds and classes, were the fittest means to be employed for raising and improving the character of the people — that to employ those institutions for such a purpose would be “the simplest, the safest, the most popular, the most economical, and the most effectual plan for giving that stimulus to the native mind which it needs on the subject of education, and for eliciting the exertions of the natives themselves for their own improvement, without which all other means must he unavailing”.২৭ [নজরটান অ্যাডামের]
কিন্তু হায়! তার তিন বছর আগেই বাংলায় ইংরেজি শিক্ষা পুরোদস্তুর চালু হয়ে যায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই অ্যাডামের এহেন সুপরামর্শে কান না দিয়ে, কলকাতার শিক্ষা সংসদ তাকে ‘almost impracticable’ তকমা দিয়ে ব্রাত্য করে রাখে।
শুধু তাই নয়, শিক্ষাক্ষেত্রে ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’-কে নির্লজ্জ সমর্থন করে তারা জানায় –
দেশে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, প্রচুর অভিজ্ঞতা ও বিবেচনাবোধই আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে গৃহীত পুরনো নীতিটিকে মেনে চলতে বাধ্য করেছে। তাই আমাদের প্রথম প্রচেষ্টা হবে, প্রধান প্রধান শহর বা জেলার সদর শহরগুলিতে শিক্ষাবিস্তারের বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। জনসাধারণের উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির শিক্ষার মান উন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষাসংক্রান্ত সংস্কার, ক্রমশ নিচের দিকে গ্রামাঞ্চলের দেশজ বিদ্যালয়গুলির কাছে দ্রুত পৌঁছবে।২৮
সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষা হয়ে ওঠে মুষ্টিমেয় উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তের ক্রয়যোগ্য বস্তু। নিজেদের কতিপয় কেরানি-শিক্ষক-অধ্যাপক-উকিল-ডাক্তার-মোক্তার হওয়ার একচেটিয়া কারবারকে আরও একচেটিয়া করার অদম্য বাসনায়, তারা ‘দাস্যসুখে হাস্যমুখ’ হয়ে ব্রিটিশের ‘পাদুকাতলে পড়িয়া লুটি’ এই শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বাগত জানায়।
এই নতুন শিক্ষাব্যবস্থা উচ্চশ্রেণির বিশেষত নব্য ভদ্রলোক শ্রেণির পক্ষে যতটা প্রয়োজনীয় ছিল, নিম্নশ্রেণির পক্ষে ছিল ঠিক ততটাই অপ্রাসঙ্গিক। তাই ব্রিটিশ আমলের প্রাথমিক-মিডল-মাধ্যমিক স্কুল আর কলেজের ক্রমসম্পর্কিত ব্যবস্থা, স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশজ শিক্ষাব্যবস্থার গোড়া ধরে টান মারে। উচ্চ ও নিম্নশ্রেণির জন্য একই কেন্দ্রীভূত শিক্ষাব্যবস্থায়, স্বভাবতই শিক্ষার আঙিনার বাইরে চলে যায় অগণন দরিদ্র অন্ত্যজ হিন্দু ও নিম্নশ্রেণির মুসলমান শিশু। সরকারি নিয়মের এক ঝটকায়, তারা হয়ে ওঠে ব্রাত্য ও অবাঞ্ছিত। আর সেই শূন্যস্থান ভরাট করতে, চারিদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠতে থাকে অজস্র অ্যাংলো-বেঙ্গলি স্কুল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে অনাহারে মৃত্যু, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কৃষিজীবীদের জমির মালিকানা হস্তান্তর, কারিগরদের কর্মহীন অবস্থা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নাভিশ্বাস, নিষ্কর ভূমির পরিমাণ ক্রমে কমে যাওয়া প্রভৃতি বিবিধ ঝড়ঝাপটার পরেও বাংলা-বিহার মিলিয়ে অসংখ্য কৃষিজীবী-কারিগর-ছোট ব্যবসায়ী-মালঙ্গীদের অর্থ ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশজ শিক্ষাব্যবস্থা, অবশেষে চরম অসম অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়ে তার স্বাভাবিক জীবনীশক্তি হারাতে থাকে। শুরু হয় দেশজ শিক্ষার ব্যাপক ও বিপুল সংকোচন প্রক্রিয়া।
১৮২৬-এ মাদ্রাজে দেশজ বিদ্যালয় ও কলেজের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১১,৭৫৮টি ও ৭৪০টি। অথচ ১৮৭৯-৮০ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে শিক্ষা সংসদ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় প্রাথমিক, মিডল, মাধ্যমিক, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কলেজ মিলিয়ে মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ১০,৫৫৩টি; তার মধ্যে কেবল প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যাই ১০,১০৬।২৯ আর অ্যাডামের প্রায় ৪৫ বছর পরে, লাহোর সরকারি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও পাঞ্জাব শিক্ষা সংসদের অস্থায়ী কার্যকারী সভাপতি লিটনার (Dr G. W. Leitner) পাঞ্জাবের দেশজ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সমীক্ষা করে জানান যে, ব্রিটিশের পাঞ্জাব দখলের সময়ে ‘3,30,000 pupils in the schools of the various denominations who were acquainted with reading, writing and some method of computation’ অথচ ১৮৮২-তে এই সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ‘little more than 1,90,000’।৩০
দেশজ শিক্ষাব্যবস্থার এই সঙ্গীণ পরিস্থিতি উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৬ সালে তিনি লেখেন —
আপন ভাষায় ব্যাপকভাবে শিক্ষার গোড়াপত্তন করবার আগ্রহ স্বভাবতই সমাজের মনে কাজ করে, এটা তার সুস্থ চিত্তের লক্ষণ। রামমোহন রায়ের বন্ধু পাদ্রি এডাম সাহেব বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার যে রিপোর্ট প্রকাশ করেন তাতে দেখা যায় বাংলা-বিহারে এক লক্ষের উপর পাঠশালা ছিল, দেখা যায় প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই ছিল জনসাধারণকে অন্তত ন্যূনতম শিক্ষাদানের ব্যবস্থা। এ ছাড়া প্রায় তখনকার ধনী মাত্রেই আপন চণ্ডীমণ্ডপে সামাজিক কর্তব্যের অঙ্গরূপে পাঠশালা রাখতেন, গুরুমশায় বৃত্তি ও বাসা পেতেন তাঁরই কাছ থেকে। আমার প্রথম অক্ষরপরিচয় আমাদেরই বাড়ির দালানে, প্রতিবেশী পোড়োদের সঙ্গে। মনে আছে এই দালানের নিভৃত খ্যাতিহীনতা ছেড়ে আমার সতীর্থ আত্মীয় দুজন যখন অশ্বরথযোগে সরকারি বিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার পেলেন তখন মানহানির দুঃসহ দুঃখে অশ্রুপাত করেছি এবং গুরুমশায় আশ্চর্য ভবিষ্যৎদৃষ্টির প্রভাবে বলেছিলেন, ঐখান থেকে ফিরে আসবার ব্যর্থ প্রয়াসে আরো অনেক বেশি অশ্রু আমাকে ফেলতে হবে। তখনকার প্রথম শিক্ষার জন্য শিশুশিক্ষা প্রভৃতি যে-সকল পাঠ্যপুস্তক ছিল, মনে আছে, অবকাশকালেও বার বার তার পাতা উল্টিয়েছি। এখনকার ছেলেদের কাছে তার প্রত্যক্ষ পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হব, কিন্তু সমস্ত দেশের শিক্ষা-পরিবেষণের স্বাভাবিক ইচ্ছা ঐ অত্যন্ত গরিব-ভাবে-ছাপানো বইগুলির পত্রপুটে রক্ষিত ছিল — এই মহৎ গৌরব এখনকার কোনো শিশুপাঠ্য বইয়ে পাওয়া যাবে না। দেশের খাল-বিল-নদী-নালায় আজ জল শুকিয়ে এল, তেমনি রাজার অনাদরে আধমরা হয়ে এল সর্বসাধারণের নিরক্ষরতা দূর করবার স্বাদেশিক ব্যবস্থা।৩১
কিন্তু তাঁর এই উপলব্ধিতে, উনিশ শতকে বাংলার প্রান্তিক মানুষদের কোনও লাভই হয়নি।
কারণ তার আগেই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে সফল করার লক্ষ্য নিয়ে, বাংলার দেশি ধানের মাঠে বিলিতি ওকের চারাগাছ রোপনের জন্য, বিপুল বিক্রমে নেমে পড়বেন বিদ্যাসাগর। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল কিংবা কলেজে দেখা যাবে, কতিপয় উচ্চবর্ণের অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীর দৃপ্ত উদ্ধত স্বার্থপর পদচারণ। নানাবিধ ‘সংস্কার’-এর পরেও তাঁর শিক্ষার অঙ্গন থেকে একই রকমের ব্রাত্য, অবাঞ্ছিত থেকে যাবে দরিদ্র অন্ত্যজ হিন্দু ও নিম্নশ্রেণির মুসলমান ছাত্রছাত্রীরা। জনশিক্ষা বিস্তারের প্রশ্নে, তাঁর মুখে শোনা যাবে অবিকল শাসকের সুর। আর অ্যাডামের শিক্ষাপদ্ধতিকে অনুসরণ করার নির্দেশকে নস্যাৎ করে তাঁর ‘মডেল’ স্কুল স্থাপনের কয়েক বছরের মধ্যে, শাসকরা বুঝতে পারবে তাদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল’। অবশেষে বিস্তর কেঁচে গণ্ডুষের পরে ১৮৮১-৮২ সালে, তত দিন টিকে থাকা প্রায় ৫০ হাজার পাঠশালাকে৩২ পুনরায় শিক্ষা বিভাগের আওতায় নিয়ে আসা হবে। সে সব কাহিনি শুরু হবে পরবর্তী অধ্যায় থেকে, যেখানে ফিরে ফিরে আসবেন যুগপৎ অ্যাডাম ও রবীন্দ্রনাথ।
************************************************************
উল্লেখপঞ্জী:
১. Education Commission Report by the Madras Provincial Committee 1884; উদ্ধৃত Dharampal, The Beautiful Tree: Indigenous Indian Education in the Eighteenth Century, Goa, 2000, p. 352-53। এর পরে কেবল Dharampal, The Beautiful Tree লেখা হবে।
২. Dharampal, The Beautiful Tree, p. 26
৩. তদেব, পৃ. ৩৭৭
৪. Anathnath Basu (ed.), Reports on the State of Education in Bengal (1835 & 1838) by William Adam, Calcutta, 1941, p. xxiv
৫. বিপিনচন্দ্র পাল, সত্তর বৎসর, কলিকাতা, ১৩৬২, পৃ. ২৭
৬. মীর মশার্রাফ হোসেন, আমার জীবনী, কলিকাতা, ১৯৬০, পৃ. ৭৮-৮০
৭. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, কলকাতা, ২০১৯, পৃ. ২০
৮. Anathnath Basu (ed.), Reports on the State of Education in Bengal (1835 & 1838) by William Adam, Calcutta, 1941, p. 6। এর পরে কেবল Anathnath Basu (ed.), Adam’s Reports লেখা হবে।
৯. Anathnath Basu (ed.), Adam’s Reports, p. 146
১০. তদেব, পৃ. ২০৮
১১. তদেব, পৃ. ২১৪
১২. তদেব, পৃ. ২৫১
১৩. তদেব, পৃ. ৬
১৪. তদেব, পৃ. ৭
১৫. Minute of Sir Thomas Munro, March 10, 1826; H. Sharp (ed.), Selections from Educational Records, Part I, 1781-1839, Calcutta, 1920 p. 73
১৬. Dharampal, The Beautiful Tree, p. 375
১৭. Anathnath Basu (ed.), Adam’s Reports, p. 241
১৮. তদেব, পৃ. ১৭
১৯. তদেব, পৃ. ১৮
২০. তদেব, পৃ. ২৫৪-৭২
২১. Dharampal, The Beautiful Tree, p. 34-35
২২. House of Commons Papers, 1852-53, Vol. 79, p.718; উদ্ধৃত Dharampal, The Beautiful Tree, p. 10
২৩. A. E. Dobbs, Education and Social Movements 1700-1850, London, 1919, pp. 157-58; উদ্ধৃত Dharampal, The Beautiful Tree, p. 10
২৪. A. E. Dobbs, Education and Social Movements 1700-1850, p.158; উদ্ধৃত Dharampal, The Beautiful Tree, p. 10
২৫. J.W. Adamson, A Short History of Education, Cambridge, 1919, p. 226; উদ্ধৃত Dharampal, The Beautiful Tree, pp. 10-11
২৬. Dharampal, The Beautiful Tree, p. 12
২৭. Anathnath Basu (ed.), Adam’s Reports, pp. 349-50
২৮. তদেব, পৃ. ৪৮২-৮৩
২৯. Dharampal, The Beautiful Tree, p. 71
৩০. তদেব, পৃ. ৫৭
৩১. ‘শিক্ষার সাঙ্গীকরণ’; রবীন্দ্র রচনাবলী, একাদশ খণ্ড, কলকাতা, ১৩৬৮, পৃ. ৭০৫-০৬
৩২. W.W. Hunter, Report of the Education Commission of India, Calcutta, 1884, p. 69; উদ্ধৃত পরমেশ আচার্য, বাংলার দেশজ শিক্ষাধারা, পৃ. ১১২
অসাধারণ সিরিজ! অনেক কিছু লেখার আছে। পরে লিখছি!
লেখক লিখেছেন, ইংরেজি শিক্ষার সমর্থকরা অ্যাডাম'স্ রিপোর্ট' নিয়ে অকারণ তর্ক করেন । না, সত্যিটা তার ঠিক বিপরীত --- ইংরেজি শিক্ষার সমর্থকরা মোটেই 'অ্যাডাম'স্ রিপোর্ট' নিয়ে অকারণ তর্ক করেন না, বরং আধুনিক শিক্ষার বিরোধীরা এ নিয়ে অকারণ মিথ্যে বলেন । সেই রিপোর্ট এবং তৎকালীন শিক্ষার দশা নিয়ে কিছু তথ্য দিই, তাতে আপনাদের আলোচনায় সুবিধে হয় কিনা দেখুন ---
(১) 'অ্যাডাম'স্ রিপোর্ট' রিপোর্ট একটি নয় তিনটি (১৮৩৫-এ দুটি এবং ১৮৩৮-এ একটি) । (২) উইলিয়াম অ্যাডাম-এর নিজের প্রতিবেদন অনুযায়ীই, তৎকালীন দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় সাক্ষরতার হার ছিল পুরুষদের ক্ষেত্রে ছয় শতাংশ, মহিলাদের ক্ষেত্রে শূন্য শতাংশ, এবং ফলত, সব মিলিয়ে তিন শতাংশ । (৩) তাঁর প্রথম রিপোর্ট-টিতেই শুধুমাত্র একলাখ দেশীয় বিদ্যালয়ের কথা ছিল, যা পরবর্তীকালে অনেকেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেননি । আসলে, এই তথ্যগুলো তাঁর নিজের সমীক্ষাকর্মের ফল নয়, শোনা কথা মাত্র । প্রথম প্রতিবেদনে তিনি শুধু অন্যসূত্রে পাওয়া তথ্যগুলো সংকলন করবার চেষ্টা করছিলেন, এবং সেই সূত্রগুলো প্রায়শই সন্দেহাতীত ছিল না । (৪) তৃতীয় প্রতিবেদনে তিনি বাংলা ও বিহারের বিস্তারিত এক অঞ্চল জুড়ে সমীক্ষা করেন, কিছু নিজে, কিছু অন্যকে দিয়ে । সে সমীক্ষায় বাংলা ও বিহার মিলে দেশীয় বিদ্যালয়ের মোট সংখ্যা এক লাখ থেকে নেমে দাঁড়ায় ছাব্বিশশোর কিছু কম । (৫) সে শিক্ষা ছিল মূলত প্রাচীন ভাষা, সাহিত্য ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক, এবং হয়ত ছড়ার মধ্য দিয়ে অদক্ষভাবে শেখানো কিছু অতি প্রাথমিক ধরণের গণিত । এ দিয়ে পুরুতগিরি, জমিদারের গোমস্তা ও কেরানির কাজ, এবং ওই একই শিক্ষার চর্বিতচর্বণ পরবর্তী শিশুদের মধ্যে সঞ্চারিত করা --- এর বাইরে আর কিছু করা যেত না । আর কিছু যে আদৌ করবার আছে, এ বোধও তৎকালীন সমাজের ছিল না । আরবী-পার্শি শিখে নিলে মুসলমানের শাসকের দরবারে আরেকটু ভালগোছের কাজ জুটতে পারত, তাই অনেক হিন্দুও মক্তব-মাদ্রাসায় এইসব ভাষা শিখতে আসত । (৬) এ শিক্ষায় কোনও উদ্ভাবন ও বিচারশক্তি বিকাশের প্রশ্ন ছিল না, ছিল শুধুই মুখস্থবিদ্যার অনুশীলন । (৭) আধুনিক বিজ্ঞান গণিত প্রযুক্তিবিদ্যা চিকিৎসা ইত্যাদি শিক্ষার প্রশ্নই উঠত না, কারণ দেশীয় সমাজে সে জ্ঞানের অস্তিত্বই ছিল না, এ ব্যাপারে ভদ্রলোক-ছোটলোক-ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলেই সমান অজ্ঞ ছিল । (৮) এমন কি এই দেশীয় মাপেও শিক্ষার অবস্থা খুব শোচনীয় বলে অ্যাডাম সাহেবের কাছে মনে হয়েছিল । তিনি দেখেছিলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এমন কি এই গতানুগতিক বিদ্যাটুকুও ভাল করে জানে না, এবং যা-ও বা জানে সেটুকু সঞ্চারিত করার ব্যাপারে তাদের দক্ষতা বা উৎসাহ কিছুই নেই, তার একটি কারণ এই যে তারা টাকাকড়ি খুব কম পায়, আর তার ফলে বুদ্ধিমান সুশিক্ষিতেরা শিক্ষকতায় আসতেই চায় না । (৯) অ্যাডাম সায়েব এ শিক্ষা ব্যবস্থা পাল্টাতে চাননি, একেই রাখতে ও পুষ্ট করতে চেয়েছিলেন । তিনি ইংরেজ সরকারকে এর পেছনে খরচা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, কারণ, তথাকথিত ঐতিহ্যপ্রেমী বিদ্যোৎসাহী দেশীয় ধনী এবং হোমরাচোমরা সমাজপতিরা নিজের দেশের 'ঐতিহ্যপূর্ণ' শিক্ষার পেছনে যথেষ্ট ব্যয় করতে প্রস্তুত ছিলেন না । ইউরোপীয় শিক্ষা চালু না হলে আমরা আজও এই শিক্ষাই পেতাম ।
খোঁজখবর করে দেখা যাক, এই একলক্ষ সংখ্যাটিতে অ্যাডাম সায়েব পৌঁছলেন ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় । আগেই বলেছি, বঙ্গদেশে দেশীয় শিক্ষার হাল নিয়ে তিনি মোট তিনটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন । তার মধ্যে শুধু শেষের দুটিতে তাঁর নিজস্ব সমীক্ষালব্ধ ফলাফল ছিল, এবং প্রথমটিতে ছিল ইতিমধ্যে এ বিষয়ে যা যা জানা গেছে তার সারসংকলন করবার চেষ্টা । অর্থাৎ, পূর্ববর্তী কোনও সমীক্ষকের কাজ, জেলার খবরাখবরওয়ালা সরকারি কাগজপত্তর, বা পরিচিত অভিজ্ঞ মানুষদের কাছ থেকে শোনা কথা, এই রকম সব । এইসব উৎসগুলো যে খুব একটা নির্ভরযোগ্য নাও হতে পারে, এ আশঙ্কা অ্যাডাম সায়েবের নিজেরই মন্তব্যে পাওয়া যায় । কিন্তু, মজার ব্যাপার, ওই ‘একলক্ষ’ সংখ্যাটি কিন্তু এমন কি এইসব সন্দেহজনক উৎস থেকেও সরাসরি আসেনি, এসেছিল একটি সরকারি সংস্থার কাগজে পাওয়া একটি অন্য মন্তব্য থেকে পরোক্ষ সিদ্ধান্ত হিসেবে । “জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন” সংস্থার মিনিট্স্-এ তিনি দেখেছিলেন, জনৈক সদস্য মন্তব্য করেছেন --- ‘পূবের প্রদেশগুলোতে প্রতিটি গ্রামীণ বিদ্যালয়ের পেছনে যদি মাসে এক টাকা খরচা করা যায়, তবে বছরে মোট বারো লাখ টাকা মত খরচা হতে পারে ।’ এ থেকে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, বিদ্যালয়ের সংখ্যা লাখখানেক হলে তবেই এ রকম হিসেব আসতে পারে । তাঁর মনে হয়েছিল, বিহার-বাংলায় দেড় লাখ মত গ্রাম আছে, তার এক তৃতীয়াংশেই যদি বিদ্যালয় না-ও থাকে, তাহলেও তো সংখ্যাটা লাখখানেকই হওয়ার কথা । কাজেই, তিনি আর এ সংখ্যাটিকে যাচাই করাটা আদৌ প্রয়োজনীয় বলে মনে করলেন না, বরং এ থেকে আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন । সিদ্ধান্তটা এই রকম। ওই অঞ্চলে তখন মোট চার কোটি মত লোক, কাজেই তাহলে প্রতি চারশো লোকের জন্য একটি করে বিদ্যালয় থাকছে । তার ওপর জনসংখ্যাতত্ত্বের বিশেষ পদ্ধতি (“প্রুশীয় পদ্ধতি”) প্রয়োগ করে অ্যাডাম দেখলেন, ওই চারশো লোকের মধ্যে বিদ্যালয়ে পড়তে পারে এমন বয়েসের বাচ্চার সংখ্যা পঁয়ষট্টি মতন হতে পারে । এখন, এর মধ্যে আবার আদ্ধেকই মেয়ে বাচ্চা, তাদের তো বিদ্যালয়ে পড়াবার প্রশ্নই নেই, কাজেই সেই সংখ্যাটা বাদ দিলে পড়ানোর যোগ্য বাচ্চার সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে বত্রিশ । ফলত, মাত্র বত্রিশটি করে বাচ্চার পেছনে এক একটা গোটা বিদ্যালয়, বুক ফুলিয়ে বলার মত শিক্ষাব্যবস্থাই বটে ! এই আশ্চর্য পরিসংখ্যানটিই রাম স্বরূপ খুব গর্বের সঙ্গে তুলে দিয়েছেন তাঁর ‘অন হিন্দুইজ্ম্’ নামক হিন্দু-প্রোপাগাণ্ডার বইতে, এবং বাদ দিয়ে গিয়েছেন এই দরকারি কথাটা যে, এগুলো পাওয়া গিয়েছিল একটি বিচ্ছিন্ন মন্তব্য থেকে পরোক্ষে পাওয়া এবং যাচাই না করা একটি কাল্পনিক সংখ্যার ওপর নানা কেরামতি করবার পর তা থেকে মেয়ে-শিশুদের সংখ্যাটি বাদ দিয়ে । বাদ গিয়েছে এই কথাটাও যে, আসলে, তখনকার বিদ্যালয় বা ‘পাঠশালা’-গুলোতে গড় ছাত্র-সংখ্যা ছিল, বত্রিশ নয়, মাত্রই বারো-চোদ্দ ! এবং, সর্বোপরি, অ্যাডাম সায়েব যখন পরবর্তীকালে তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রতিবেদনে সত্যি সত্যি নিজস্ব কঠোর পরিশ্রমসাধ্য সমীক্ষাগুলোর ফলাফল প্রকাশ করলেন, তখন বাংলা ও বিহারের সাতটি জেলা মিলিয়ে বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়াল ছাব্বিশশোর কাছাকাছি । এসব কথা বাদ দেওয়াটা অবশ্য খুব আশ্চর্যেরও কিছু নয়, হিন্দুত্ববাদীরা কোনওদিনই তথ্যনিষ্ঠার জন্য বিখ্যাত ছিলেন না । তবে, তার মানে এই নয় যে, এ নিয়ে কেউই তর্ক তোলেননি । হ্যাঁ, এই সংখ্যাটির পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের গল্প আছে, এবং সেটাও ইন্টারেস্টিং ।
যাঁরা ‘একলক্ষ বিদ্যালয়’ তথ্যটির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা তুলেছেন ‘বিদ্যালয়’ বলতে ঠিক কী বোঝায় এই ভয়ঙ্কর মৌলিক প্রশ্ন । তাঁদের অভিযোগ, সাহেবরা ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্য না বুঝেই একে অদক্ষ ও অ-যথেষ্ট বলে দেগে দিচ্ছেন, ভারতীয় বিদ্যালয় ইউরোপের বিদ্যালয়ের মত না হলেই তাকে আর ‘বিদ্যালয়’ বলে গণ্যই করছেন না । কিন্তু, এমন অভিযোগের আদৌ দরকার পড়ল কেন, উইলিয়াম অ্যাডাম তো আর নিজেই নিজের ‘একলক্ষ বিদ্যালয়’ তথ্যের বিরোধিতা করেননি, কে তবে বিরোধিতা করলেন ? কেনই বা করলেন ? সে কথাটা একটু বলে নেওয়া দরকার এখন । ১৯৩১ সালে গান্ধিজী লন্ডনের চ্যাথাম হাউসে এক বক্তৃতায় অভিযোগ করেন, ইংরেজরা ভারতীয়দের শিক্ষিত করার বদলে আরও মূর্খ ও নিরক্ষর বানিয়েছে, এবং ঐতিহ্যময় ভারতীয় শিক্ষাদীক্ষার ‘সৌন্দর্যময় বৃক্ষ’-টির শিকড় কেটে তাকে ধ্বংস করেছে । এ অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে তিনি ওই অ্যাডাম-প্রতিবেদন থেকে ‘একলক্ষ বিদ্যালয়’ তথ্যটিকে হাজির করেন, যা নাকি ১৮৩৫ ছিল কিন্তু ১৯৩১-এ আর নেই । সে সভায় উপস্থিত ছিলেন ‘স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ফিলিপ হার্টগ, যিনি এ অভিযোগ একদমই মানতে পারেননি, এবং সে সভাতেই তিনি গান্ধিজীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন। তারপর দুজনের মধ্যে অনেক চিঠি চালাচালি হয়, হার্টগ গান্ধিজীর বক্তব্যের বিরুদ্ধে যুক্তি সাজিয়ে লেখালেখি বক্তৃতা ইত্যাদি করতে থাকেন, এবং শেষপর্যন্ত তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয় । সেখানে তিনি অ্যাডামেরই দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে অসঙ্গতি দেখাবার চেষ্টা করেন । তিনি বলেন, অ্যাডামেরই দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলা-বিহারে প্রতি চারশো লোকপিছু একটি করে স্কুল থাকার কথা, অথচ তাঁরই দ্বিতীয় ও তৃতীয় রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, যেখানে যেখানে তিনি সমীক্ষাগুলো করেছেন সেই সাতটি জেলা বা এলাকার জনসংখ্যাকে চারশো দিয়ে ভাগ করলে স্কুলের সংখ্যা যা হওয়া উচিত তার চেয়ে আসলে আছে অনেক কম । অর্থাৎ, অন্যান্য জায়গাতেও চারশো লোক পিছু একটি করে স্কুল নেই, এবং সেইহেতু সারা বাংলা-বিহারে একলক্ষ স্কুলও আদৌ নেই ।
'ছোট জাত' তো দূরের কথা, ব্রাহ্মণ পরিবারেরও এক বিরাট সংখ্যক শিশু আদৌ লেখাপড়া করত না । আর 'ছোট জাত' যারা খুব অল্প সংখ্যায় ছিল, তারা সব তিলি বা মাহিষ্য বা সদ্গোপ এই সব শ্রেণির, যাদের দোকানপাট ব্যবসা-বাণিজ্য এইসব ছিল, সেইহেতু কিছু আদিম ধরনের পাটিগণিত জানতেই হত । তা বলে, মুচি মেথর ডোম এইসব জাতের লোকেদের পাঠশালার ধারকাছেও আসতে দেওয়া হত না । আর, উচ্চ-নিম্ন কোনও বর্ণেরই মেয়েদের প্রবেশাধিকার ছিল না, একটিও শিশুকন্যা সেখানে যেত না । যে অ্যাডাম সায়েবের প্রতিবেদনকে সম্বল করে এত কথা, সেই সায়েব স্বয়ং এ ব্যবস্থাটি খুঁটিয়ে দেখে খুবই হতাশ হয়েছিলেন । না, তাঁর স্বদেশের শিক্ষার সঙ্গে তুলনা করে নয় --- এ দেশের তৎকালীন শিক্ষার একান্ত নিজস্ব মাপকাঠিতেই । তিনি বলেছিলেন, গুরুমশায়দের বেশিরভাগের নিজের শিক্ষাদীক্ষার দশা অতি করুণ, আর তাঁদের পাওনা-গণ্ডাও বিশেষ ভদ্রজনোচিত নয়, কী আর শিক্ষা দেবেন তাঁরা ! তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল, এদেশের উঁচুতলার ক্ষমতাবান উচ্চবিত্তরা নিজেদেরই শিক্ষাব্যবস্থার পেছনে পয়সা ঢালতে একান্ত নারাজ । সবচেয়ে মজার কথাটা হচ্ছে, যে ইংরেজরা নাকি এ দেশের সুমহান প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা লাটে তুলে দিল বলে এত নাকিকান্না, সেই ইংরেজদেরই খাস প্রতিনিধি অ্যাডাম সায়েব আসলে মোটেই এ ব্যবস্থা তুলে দেবার সুপারিশ করেন নি । এই ব্যবস্থাটি চালু রাখার জন্যই ব্রিটিশ সরকার খরচা করুক, কারণ এরা নিজেরাই নিজেদের শিক্ষাটা ঠিকঠাক চালাতে রাজি নয় --- এই ছিল তাঁর বক্তব্য । বুঝুন তবে, কী ধরনের নির্লজ্জ হলে আমরা এ নিয়ে গর্ব করতে পারি !
এলেবেলে মানে দেবোত্তম চক্রবর্তী বেশ মজার মানুষ। অ্যাডাম বর্ণীত তথাকথিত একলক্ষ পাঠশালা নিয়ে সবচেয়ে বেশি নৃত্য করতেন তিনি নিজেই এবং জনৈক দেবব্রত চক্রবর্তী। কয়েকবছর আগে এই গুরুচণ্ডাঌ ফেসবুক গ্রুপের পাঠকপাঠিকরা নিশ্চয়ই এ ঘটনার সাক্ষী আছেন। আসলে দেবোত্তম চক্রবর্তী নিজে তখনও অ্যাডাম রিপোর্টগুলি পড়েন নি, স্রেফ কাকে কান নিয়ে গেছে শুনেই দিগবিদিগ জ্ঞানশুন্য হয়ে দৌড়েছিলেন।
যাইহোক, প্রথমে দেখা যাক ওই বহুচর্চিত অ্যাডাম রিপোর্টে উনি কি লিখেছিলেন। প্রথম রিপোর্টে অ্যাডাম বলছেন, "A distinguished member of the General Committee of Public Instruction in a minute on the subject expressed the opinion, that if one rupee per mensem were expended on each existing village school in the Lower Provinces, the amount would probably fall little short of 12 lakhs of rupees per annum. This supposes that there are 100,000 such schools in Bengal and Behar, and assuming the population of those two Provinces to be 40,000,000, there would be a village school for every 400 persons."
উইলিয়াম অ্যাডামের প্রথম রিপোর্টের একলাখি অঙ্কটা এতটাই অবিশ্বাস্য যে অ্যাডাম সাহেব যে পরের মুখে ঝাল খেয়ে এ রিপোর্ট লিখেছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ঘটনাটা বাস্তবিকই তাই-ই ; প্রথম রিপোর্টটি পেশ করবার কালে অ্যাডাম সাহেব নিজে গ্রামেগঞ্জে গিয়ে পাঠশালার সংখ্যা মোটেই গণনা করেন নি, কয়েকটি সেকেন্ড হ্যান্ড সোর্সকে ভরসা করে "এক লক্ষ" পাঠশালা আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন, তিনি নিজেই তাঁর প্রথম রিপোর্টের তথ্যসূত্র হিসেবে ওই পাঁচটি সোর্স উল্লেখ করেছেন, "The sources from which the principal facts and statements have been drawn are five. The first is the Buchanan Reports, which are deposited in the office of the Secretary to Government, ... The second source from which I have drawn materials is the records of the General Committee of Public Instructions, ... The third authority to which I have referred is Hamilton's East India Gazetteer, ... The fourth source from which I have obtained information is Missionary Collage and School reports. ... The fifth authority to which I have had resource is a memoir, with supplement, compiled by the Searcher of records at the India House ..."
বস্তুত, ১৮৩৭ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গ-বিহারের একাধিক জেলা পরিভ্রমণ করে অ্যাডাম যখন তৃতীয় রিপোর্টটি লেখেন তাতে তিনি স্বীকার করে নেন, "Many villages did not contain a single person able to write, or even to count." [১১] এবং "Two pandits followed me to Calcutta from the Burdwan district to communicate the details respecting their schools, of which when in the district itself I had not been able to find any trace." বুঝতেই পারছেন উইলিয়াম অ্যাডামের প্রথম রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা কতখানি !
প্রকৃতপক্ষে ১৮৩৭ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গদেশের তিনটি বৃহৎ জেলায় ব্যক্তিগতভাবে সার্ভে করে অ্যাডাম সাহেব যে পাঠশালার সংখ্যা পেলেন তা হল, মুর্শিদাবাদ - ১১৩, বীরভূম - ৫৪৪ এবং বর্ধমান - ৯৩১ অর্থাৎ মোট ১৫৮৮টি। এর মধ্যে বাংলা, হিন্দী, ফারসি, আরবি ও গোটাকয়েক ইংরেজি পাঠশালাও আছে। এছাড়া মিঃ অ্যাডামের সহকারি জনৈক মিঃ ম্যলেট মেদিনীপুরে ৭৭৮টি পাঠশালার সন্ধান পেয়েছিলেন যদিও সেগুলির সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রিপোর্টে নেই। অ্যাডাম নিজে রাজশাহি জেলার নাটোর সাবডিভিশনে আরও ২৭টি পাঠশালার খোঁজ পান। কিন্তু রিপোর্টে এদের বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান না থাকায় থাকায় প্রাথমিকভাবে উক্ত ওই তিনটি জেলার উপরেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছি। ওই তিনটি জেলা মিলিয়ে বাংলা ভাষার পাঠশালা পাওয়া গেল মাত্র ১১০৮টি, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া যার প্রতিটিতে মাত্র একজন করে শিক্ষক। হায় রে, মাত্র দুই বছরেই কোথায় যে হারিয়ে গেল বঙ্গবিহারের তথাকথিত একলাখ পাঠশালা !
অ্যাডাম সাহেব তাঁর তৃতীয় রিপোর্টে ওই তিনটি জেলায় ধর্ম ও জাতিগত ভেদে শিক্ষক ও ছাত্রদের সংখ্যার বিস্তারিত পরিসংখ্যান দিয়েছেন। এতে দেখা যাচ্ছে, তিনটি জেলায় মোট ১১০৮টি বাংলা পাঠশালায় শিক্ষকের সংখ্যা ছিল মোট ১১১৮ জন। এর মধ্যে ১১০০ জন অর্থাৎ ৯৮.৩৯% হচ্ছেন হিন্দু। মাত্র ১৪ জন অর্থাৎ ১.২৫% ছিলেন মুসলমান এবং তথাকথিত নিচু জাতের শিক্ষকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৩ অর্থাৎ ২.৯৫%। এবার ছাত্রদের পরিসংখ্যানে আসি। ১১০৮টি পাঠশালায় মোট ছাত্রসংখ্যা ২০৬৫৩। এর মধ্যে ১৯৫৩১ জন অর্থাৎ ৯৪.৫৭% হিন্দু ছাত্র, ১০৮৩ জন অর্থাৎ ৫.২৪% মুসলমান ছাত্র এবং মাত্র ৩৭৬ জন অর্থাৎ ১.৮২% তথাকথিত নিচু জাতের ছাত্র। এখানে বিনয় ঘোষের বই থেকে প্রাপ্ত ১৮৭১-৭২ সালের একটি পরিসংখ্যানের তুলনা করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হবে। শিক্ষাবিভাগের রিপোর্ট থেকে পাওয়া বাংলায় স্কুলছাত্রের সংখ্যা ১,৯৩,৩০২। এর মধ্যে হিন্দুছাত্র ১,৪৯,৭১৭ অর্থাৎ ৭৭.৪৫% এবং মুসলমান ছাত্র ২৮,০৯৬ অর্থাৎ ১৪.৫৩%। অর্থাৎ এই পরিসংখ্যান থেকে প্রমাণ হচ্ছে, বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে স্রেফ হিন্দুসমাজই উপকৃত হয়েছেন, মুসলমানসমাজ নয়; এটি কিছুটা হলেও একটি ভ্রান্ত তত্ত্ব।
উনিশ শতকের পাঠশালা, যার প্রশংসায় দেবোত্তমবাবু একেবারে পঞ্চমুখ, ঠিক কেমনটি ছিল শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষায় একটূ দেখা যাক, "পাঠশালায় পাঠনার রীতি ছিল এই যে, বালকেরা প্রথমে মাটিতে খড়ি দিয়া বর্ণ পরিচয় করিত; তৎপরে তালপাত্রে স্বরবর্ণ, ব্যাঞ্জনবর্ণ, যুক্তবর্ণ, শটিকা, কড়াকিয়া, বুড়িকিয়া প্রভৃতি লিখিত; তৎপরে তালপাত্র হইতে কদলীপত্রে উন্নীত হইত ; তখন তেরিজ, জমাখরচ, শুভঙ্করী, কাঠাকালী, বিঘাকালী প্রভৃতি শিখিত; সর্বশেষে কাগজে উন্নীত হইয়া চিঠিপত্র লিখিতে শিখিত।" ওই পাঠশালাগুলিতে কি ধরণের পাঠ্যপুস্তক ছিল? উত্তর হল, "বালকেরা স্বীয় স্বীয় মাদুরে বসে লিখিত। লিখিত এই জন্য বলিতেছি, তৎকালে পাঠ্যগ্রন্থ বা পড়িবার রীতি ছিল না।"
দেবোত্তমবাবু এটা বোধহয় মনে রাখেন নি যে, এই ধরণের শিক্ষার মুল সীমাবদ্ধতা হল, এই গতানুগতিক শিক্ষাপ্রচেষ্টা কেবল অসম্পূর্ণ তাই-ই নয়, সমকালীন পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত জ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অগ্রগমন হচ্ছে তার সম্বন্ধেও এটি সম্পূর্ণ অচেতন - এককথায় বদ্ধ জলা বিশেষ। সাধে কি আর বিদ্যাসাগর মন্তব্য করেছিলেন, "The Patshalas, or indigenous schools under Gurumohashoys, such as they are now, are very worthless institutions."
এবার দেখা যাক ওই তথাকথিত গৌরবময় পাঠশালাগুলির আবহাওয়া কেমন ছিল। পাঠশালায় শাস্তির কার্যক্রম সম্বন্ধে যদি জ্ঞানলাভ করতে চান তাহলে জানাই, অ্যাডাম সাহেব তাঁর রিপোর্টে বঙ্গের পাঠশালায় ছাত্রদের সাজা দেওয়ার চতুর্দশ রকমের প্রনালীর কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাদের অনেকগুলির বিবরণ শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, দেবোত্তমবাবু কিন্তু উল্লেখ করেন নি, ন্যারেটিভে খাপ খাচ্ছেনা বলে। ওগুলো শুনলে আপনারা আঁতকে উঠবেন। "হাতছড়ি, নাড়ুগোপাল, ত্রিভঙ্গ প্রভৃতি সাজার বিবিধ প্রকার ও প্রনালী ছিল। পাঠশালে আসিতে বিলম্ব হইলে হাতছড়ি খাইতে হইত ; অর্থাৎ আসনে বসিবার পূর্ব্বে গুরুমহাশয়ের সমক্ষে দক্ষিণ হস্তের পাতা পাতিয়া দাঁড়াইতে হইত, অমনি সপাসপ, পাঁচ বা দশ ঘা বেত তদুপরি পড়িত। এই গেল হাত ছড়ি। নাড়ুগোপাল আর এক প্রকার। অপরাধী বালকচকে গোপালের ন্যায়, অর্থাৎ চতুস্পদশালী শিশুর ন্যায় দুই পদ ও এক হস্তের উপরে রাখিয়া তাহার দক্ষিণ হস্তে একখানি এগারো ইঞ্চি ইট বা অপর কোনো ভারি দ্রব্য চাপাইয়া দেওয়া হইত; হাত ভারিয়া গেলে, বা কোনো প্রকারে ভারী দ্রব্যটি স্বস্থানভ্রষ্ট হইলে তাহার পশ্চাদ্দেশের বস্ত্র উত্তোলন পূর্ব্বক গুরুতর বেত্র প্রহার করা হইত। ত্রিভঙ্গ আর এক প্রকার। শ্যামের বঙ্কিম মূর্ত্তির ন্যায় বালককে এক পায়ে দণ্ডায়মান করিয়া হস্তে একটি গুরু দ্রব্য দেওয়া হইত; একটু হেলিলে বা বারেক মাত্র পা খানি মাটিটে ফেলিলে অমনি পশ্চাদ্দেশের বস্ত্র তুলিয়া কঠিন বেত্রাঘাত করা হইত। কোনো কোনো গুরু ইহার অপেক্ষা গুরুতর শাস্তি দিতেন। তাহাকে চ্যাংদোলা বলিত। কোনো বালক প্রহারের ভয়ে পাঠশাল হইতে পলাইলে বা পাঠশালে না আসিলে এই চ্যাংদোলা সাজা পাইত। তাহা এই, তাহাকে বন্দী করিবার জন্য চারি পাঁচ জন অপেক্ষাকৃত অধিক-বয়স্ক ও বলবান ছাত্র প্রেরিত হইত। তাহারা তাহাকে ঘরে, বাইরে, পথে, ঘাটে, বা বৃক্ষশাখায়, যেখানে পাইত সেখান হইতে বন্দী করিয়া আনিত। আনিবার সময় তাহাকে হাঁটিয়া আসিতে দিত না, হাতে পায়ে ধরিয়া ঝুলাইয়া আনিত। তাহার নাম চ্যাংদোলা। এই চ্যাংদোলা অবস্থাতে বালক পাঠশালে উপস্থিত হইবামাত্র গুরুমহাশয় বেতহস্তে সেই অসহায় বালককে আক্রমণ করিতেন। সেই প্রহার এক এক সময়ে এত গুরুতর হইত যে হতভাগ্য বালক ভয়ে বা প্রহারের যাতনায় মলমূত্রে ক্লিন্ন হইয়া যাইত।" সম্ভবত আজকের দিনে উপরোক্ত একটি প্রনালী ব্যবহৃত হলেই অভিভাবকগণ রে রে করে এসে স্কুল এবং তার সামনের রাস্তা ঘেরাও করে দোষী শিক্ষকের বিতাড়ন দাবী করবেন, অথবা মানবাধিকার কর্মীরা স্যোস্যাল মিডিয়ায় ওই শিক্ষকের মিডিয়া ট্রায়ালের ব্যবস্থা করবেন।
না, এখানেই শেষ নয়, শিবনাথ শাস্ত্রী আরও লিখেছেন, "বালক মাটিতে বসিয়া নিজের এক খানা পা নিজের স্কন্ধে চাপাইয়া থাকিবে; বা নিজের উরুর তল দিয়া নিজের হাত চালাইয়া নিজের কান ধরিয়া থাকিবে; বা তাহার হাত পা বাঁধিয়া পশ্চাদ্দেশের বস্ত্র তুলিয়া জলবিছুটী দেওয়া হইবে, সে চুলকাইতে পারিবে না; বা একটা থলের মধ্যে একটা বিড়ালের সঙ্গে বালককে পুরিয়া মাটিতে গড়ানো হইবে এবং বালক বিড়ালের নখর ও দংষ্টাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হইবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।" পাঠকপাঠিকা, আপনাদের কি হিন্দী সিনেমায় দেখা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পুলিসের থার্ডডিগ্রী প্রয়োগের সিনগুলির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে?
শিবনাথ একা নন, দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পিতা) সেকালের পাঠশালা সম্বন্ধে তাঁর আত্মজীবনচরিত'-এ লিখেছেন, "তদানীন্তন গুরুমশায়দের যেরূপ বিগর্হিত আচরণ এবং শিক্ষা দিবার যেরূপ জঘন্য নিয়ম ছিল, তাহা ইদানীন্তন যুবকবৃন্দের সহজে বিশ্বাস্য হইবার নয়। তাহাদের পাঠশালায় বালবুদ্ধিসুলভ কোন পাঠ্যপুস্তক ছিল না এবং কোন নীতিগর্ভ মিষ্টি গল্প বালকের কর্ণগোচর হইত না। কেবল ক্রোড়ে তালপত্র বা কদলীপত্র, সর্বাঙ্গে মসীরেখা এবং গুরুমহাশয়ের রক্তবর্ণ চক্ষু ও মুষ্টিবদ্ধ হস্তের বেত দৃষ্ট হইত।"
এমন নয়, যে এদেশে উচ্চশিক্ষা ছিল না। সংস্কৃত টোল ও চতুষ্পাঠীগুলিতে ন্যায়, দর্শন, কাব্য ইত্যাদিরও চর্চা হত, কিন্তু তা ছিল মূলতঃ ব্রাহ্মণসন্তান, বড়জোর বৈদ্যসন্তানদের জন্য - সর্বসাধারণের জন্য নয়। ষোড়শ শতাব্দীতে লেখা মধ্যযুগীয় রক্ষণশীল স্মার্ত পণ্ডিতদের রচনা তখনও ছাত্রদের পাঠ্য। রঘুনন্দন ও কুল্লুকভট্টের ন্যায়, সাংখ্যের গবেষণা যা স্রেফ ব্রাহ্মণ ও কিছু সীমিত শিক্ষার্থীর কাছে অধিগম্য ছিল, তার মধ্যে আধুনিক চিন্তাধারার কোনও প্রতিফলন ছিল না। পাশ্চাত্য জগতের বিজ্ঞান ও সমাজদর্শনের চিন্তায় ততদিনে যে বিপ্লব এসে গিয়েছিল, বঙ্গদেশ তা থেকে বহু শতাব্দী পিছিয়ে ছিল।
"অগণন দরিদ্র অন্ত্যজ হিন্দু ও নিম্নশ্রেণির মুসলমান শিশু", এদের দুঃখে দেবোত্তমবাবু বাস্তবিকই কাতর। আপাতদৃষ্টিতে ওনার বক্তব্য বেশ যুক্তিগ্রাহ্য লাগলেও এই বক্তব্যটির মধ্য লুকিয়ে আছে অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল একটি ভাবনা। এটা সতঃসিদ্ধরূপে ধরে নেওয়া হচ্ছে জনসাধারণ চিরকাল অশিক্ষিত জনসাধারণই থাকবে, তাদের শিক্ষাসংস্কৃতির মান কোনোদিনও উন্নত হবে না। কাজেই তাদের উন্নত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা না করে শিক্ষাব্যবস্থাকে তাদের বর্তমান বোধশক্তির আয়ত্ত্বের মধ্যে এনে দাঁড় করাতে হবে। এতে অবশ্য তাদের কোনো সুবিধা হোক বা না হোক শহুরে বুর্জোয়া শ্রেণীর বেশ সুবিধা হয়, পাঠশালায় পড়ে গ্রামের কৃষক-শ্রমিকদের ছেলেরা কিন্তু উচ্চশিক্ষা ও চাকরির বাজারে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারতেন না, একথা অস্বীকার করবার বোধহয় কোনও অবকাশ নেই। এই প্রসঙ্গে বিবেকানন্দের একটি মন্তব্য মনে পড়ে যায়, "জ্ঞানোন্মেষ হলেও কুমোর কুমোরই থাকবে, জেলে জেলেই থাকবে, চাষা চাষই করবে। জাত-ব্যবসা ছাড়বে কেন? ‘সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ’—এই ভাবে শিক্ষা পেলে এরা নিজ নিজ বৃত্ত ছাড়বে কেন? জ্ঞানবলে নিজের সহজাত কর্ম যাতে আরও ভাল করে করতে পারে, সেই চেষ্টা করবে। দু-দশ জন প্রতিভাশালী লোক কালে তাদের ভেতর থেকে উঠবেই উঠবে। তাদের তোরা (ভদ্র জাতিরা) তোদের শ্রেণীর ভেতর করে নিবি।" সম্ভবত দেবোত্তম বাবু ও তাঁর মতাবলম্বী শহুরে বুদ্ধিজীবীদের দল এটাই চান। অনেকদিন আগেই 'বাঙালি মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার' প্রবন্ধে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র প্রশ্ন তুলেছিলেন, "... ভূদেব ও বঙ্কিমচন্দ্রের লিখিত অভিমতের উপর নির্ভর করিয়া যাহারা বাঙালীর, এমন কি, হিন্দু জাতির গৌরবের শ্লাঘা করিয়া থাকেন, তাহারা অজ্ঞাতসারে ভ্রান্ত অভিমত পোষণ করেন মাত্র। রঘুনন্দন ও কুল্লুকভট্টের টীকা টিপ্পনী শ্লাঘার বিষয় জ্ঞান করিয়া যদি উহারই আদেশ সুভ্রান্ত সত্য মানিয়া, সেই অতীতপ্রায় কূট শিক্ষায় মনোনিবেশ আমাদের গৌরবের বিষয় বলিয়া অনুমিত হয়, আর বর্তমানের নূতন আশা, নূতন উদ্দীপনা ঠেলিয়া ফেলিয়া প্রাচীনের প্রচলন স্থির ধীর কৰ্ম্ম বলিয়া আদৃত হয়, জানি না এ মৃতপ্রায় জাতি নূতনের প্রবল অসহনীয় সংঘর্ষে আর কত দিন বাঁচিতে সক্ষম হইবে !
বিবেকানন্দের এই রকমের মতবাদ তুলে ধরলে দুখে, সোমনাথ এরা সব কি রেগে যেত!
আহা! একজন এই নিয়ে তিনবার পোশাক পাল্টালেন। প্রথমে আমার নিক চুরি করে তুহিন মালাকার নামক জনৈক খাজা লেখকের উল্লেখ হল। ইংরেজির ম্যাস্টর নামক ধাস্টামির একশেষ হল। বাঙ্গালার ইতিহাস নিয়ে কেমন দিলুম ভাব দেখানো হল। আমি দিলাম বাঙ্গালার ইতিহাস-এর ডোজ। অতঃপর হুতো সক পাপেটিং-এর উল্লেখ করতেই বীরত্ব উধাও হল।
তারপরে সাজলেন ন্যাল্যাখ্যাপা। দিয়ে খানিক আগডুম বাগডুম বকা গেল সামঞ্জস্যহীনভাবে। সঙ্গের জুড়িদারটির প্রথম থেকেই কাজ ছিল এলেবেলে যে দেবোত্তম এটা না বলা ইস্তক পেটের ভাত হজম না হওয়া। এবারে ইয়ে আর চক্কোত্তির লিঙ্গুইস্টিক্স-এর খোঁচা তো দিলেনই, সঙ্গে বাঙ্গালার ইতিহাস সম্পর্কিত বিশুদ্ধ মূর্খামি নিয়েও। ফলে সব ন্যাল্যাখ্যাপামি উধাও!
এবারে সরাসরি ভক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক মাঠে নেমেছেন ফিলিপ হার্টগ নামক গরুটিকে সঙ্গে নিয়ে। আর খানিক হাম্বা হাম্বা করে নিন। উত্তর দেব না হয় একবারে।
সঙ্গের পুঁটিমাছটি দুবার পাল্টালেন। প্রথমে বাতিল খাতায় সব রেফারেন্স টুকে নেওয়া চলছিল মন দিয়ে কারণ অর্ধেক বইয়ের নাম শোনা হয়ে ওঠেনি।
তারপর? হে হে ফেসবুকের একটি পোস্টের কাঁচা কপি-পেস্ট!!!
ফেসবুকের বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত বিশেষ অজ্ঞ ব্যক্তিটি অবশেষে মেঘের কোলে রোদ উঠেছে গাইতে গাইতে সাইটে প্রবেশ করিলেন। খোরাক হি খোরাক।
এলেবেলেরা জানে না, প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হয়, আর তা না দিতে পারলে মূর্খ নির্লজ্জ প্রতারক সাব্যস্ত হতে হয় । নির্লজ্জতা আর জোচ্চুরির প্রদর্শনী চলুক । উন্মোচনও চলুক । কোথা থেকে কী টোকা হয়েছে, শিগগিরই বলে দেব ।
টই ডিরেল করে লাভ হবে না। যেখানে ইটন নিয়ে উচ্চবাচ্য হয় না, মাদ্রাজ নিয়ে কথা হয় না, শিক্ষা সংকোচনের নিরেট তথ্য খণ্ডনের ক্ষমতায় কুলোয় না, ব্রাহ্মণ-চণ্ডালের একসঙ্গে পাঠাভ্যাস নিয়ে বাক্যব্যয় হয় না, মুসলমান ছাত্রের কাছে হিন্দু ছাত্রের শিক্ষগ্রহণ অস্বস্তির কারণ হয় আর সব বাদ দিয়ে ছাগলের তিন নম্বর সন্তানের মতো এক লক্ষ পাঠশালা নিয়ে কতা কইতে হয় --- সেখানে ভক্তি ঠিকরে বেরিয়ে আসে।
যেমন অন্য একটি ওয়েব ম্যাগাজিনে জন্মের দুশো বছর পরে ভক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন বিদু নাস্তিক ছিল কি না তাই নিয়ে! বলিহারি টপিক, বলিহারি যুক্তিবিন্যাস আর বলিহারি রেফারেন্সের ছিরি। লেখার নীচে খানিক নৈবেদ্যর ফুল আলগোছে ছিটিয়ে রাখা! হে হে।
জোচ্চুরি একে একে উন্মোচিত হবে। বিদুর এবং বিদুভক্তদেরও।
১৭৮৬-তে জোন্সের আলোচনায় যারা বিংশ শতাব্দীর লিঙ্গুইস্টিক্সের চাষ করেন তাদের কাজই হচ্ছে নাপানো। আরও খানিক নাপিয়ে নিন। জবাব দেব। এড়িয়ে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। কারণ প্রশ্নে খানিক কাঁঠাল পাতা চেবানোর দুর্গন্ধ ছাড়া আর কিছু নেই। বেশ করে ব্যক্তি আক্রমণ করুন কারণ যুক্তির ভাঁড়ার তো শূন্য।
তার আগে ঠিক করে নিতে হবে দেবতার আশিস নেবেন নাকি ন্যাল্যাখ্যাপা সেজে থাকবেন! সব গুলিয়ে যাচ্ছে তো!!!
পারসিভ্যাল স্পিয়ার, ১৯৩৮ সালে লিখছেন,
"Elementary vernacular education was ... at a low ebb and for the same fundamental reason-lack of patronage. Yet Adam's investigation showed that without any Government support whatever, in Bengal, approximately 9 % of the boys between five and fifteen were at school. In Delhi territory, Metcalfe's report shows a percentage of about 10, and in the Bareilly district there was evidence showing an increase in the range of castes attending schools.When this percentage is compared with those of the present day, after a century's expenditure of energy and treasure, there is the less cause to belittle the voluntary effort of an im- poverished community. Many schools and some methods were rightly condemned, as where the Koran was learnt by rote by boys who knew no Arabic, and in the Persian schools where the same method was some- times used. But there were two directions in which criticism overshot the mark-as to method and moral content. With singular inconsistency the methods were often condemned at the very time when one of the most prevalent, under the name of Dr Bell's system, had been introduced and become popular in England. There is a constant refrain of the lack of any moral training, while at the same time it is made clear that the Ramayana, "The Hindu Bible of Northern India", and the Hito- padesa in the various vernaculars, and Saadi in Persian, were very general books of reading. The criticism was only justified if all Hinduism was superstitious and immoral, and that, as we shall see, was then a common view. When only the morality of Dr Smiles was looked for, its absence was identified with moral turpitude."
[ সূত্র: Percival Spear. Bentinck and Education: The Cambridge Historical Journal , 1938, Vol. 6, No. 1 (1938), pp. Cambridge University Press
লেখক প্রশ্নকর্তাদেরকে তেড়ে গালি দিচ্ছ্বেন, কিন্তু নিজে যে মূর্খ নির্লজ্জ বা প্রতারক এইটা একবারও অস্বীকার করার চেষ্টা করেন নি । এই সততাটুকু অন্তত ভাল লাগল ।
নাঃ, আর মঙ্গলবার অবধি অপেক্ষা করার মানে হয় না। একে তো ব্যক্তি আক্রমণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, সঙ্গে সীমাহীন মূর্খতার নির্লজ্জ প্রদর্শন চলছে বুক ফুলিয়ে। কাজেই মুখ খোলাই ভালো।
এই ব্যক্তি গুরুর একজন বিশিষ্ট ব্লগার। তো তিনি গুরুরই এক তত বিশিষ্ট নয় ব্লগারের নিকটি চুরি করে ব্যক্তি আক্রমণ শুরু করলেন।
১) ০৪ অক্টোবর ২০২০ ০৭:০৫ তুহিন মালাকারের চটি বইটা দিয়ে কতদিন টানা যাবে?
২) ০৫ অক্টোবর ২০২০ ০৬:৫৪ না, আপনি ইনজিরির ম্যাস্টর কিনা, তাই জানতি চাইনু এজ্ঞে।
৩) হুতো মন্তব্য করলেন ১৩ অক্টোবর ২০২০ ২২:২৫
১০ অক্টোবর ২০২০ ০৬:২০ আর ১০ অক্টোবর ২০২০ ০৭:৫৯-এর পোস্ট দুটি সক পাপেটিং, পরিচয় চুরি ইত্যাদির দায়ে ডিলিট হওয়ার যোগ্য। এবড়োখেবড়ো নিকটি এলেবেলে অনেক দিন থেকে ব্যবহার করেন। গুপু নজর রাখুক।
৪) ১৪ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৪৩ অবশেষে নিক বদলে ন্যাল্যাখ্যাপা সেজে বলা গেল – সেনসেশন তৈরির জন্য লেখক নিজেই নিজেকে গালি দিচ্ছেন নাকি ?
৫) ২২ অক্টোবর ২০২০ ০৩:২৪ জানা গেল ওটা ‘সৌজন্যমূলক’ শক অ্যাবজর্বার
৬) ২২ অক্টোবর ২০২০ ২২:৪৮ মূর্খতা, নির্লজ্জতা আর বুজরুকি এবং ৭) ২৪ অক্টোবর ২০২০ ২৩:১৩ মূর্খ নির্লজ্জ প্রতারক জোচ্চুরি – এই শব্দগুলো লেখকের প্রতি ব্যবহৃত হল অবলীলায়।
এবারে এত ব্যক্তি আক্রমণের পরে, নিজের মূর্খতা প্রদর্শন চলল চুটিয়ে।
১) লেখাটার কোথায় তুহিন মালাকার ক্ষণিকের জন্য উঁকি দিয়ে গেলেন, তা খোদ আল্লাও জানেন না। কিন্তু জ্যোতিষিগিরিটি করা গেল। ভক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক বলে কতা!
২) বাঙ্গালার ইতিহাস নিয়ে পোচ্চুর বারফাট্টাই হল।
ক) মুশকিলটা হল কি জানেন মহায়, এলেবেলে ভাবছেন যে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ বইটা বিদ্যাসাগরের নিজস্ব রচনা নয় বরং জন মার্শম্যানের ‘আউটলাইন অফ দ্য হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল’ বইয়ের স্রেফ অনুবাদ - এই তথ্যটি বোধহয় তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না! খ) কি মুশকিল, আর কতবার বলতে হবে যে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ বইটা জন মার্শম্যানের ‘আউটলাইন অফ দ্য হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল’ বইয়ের অনুবাদ? এলেবেলে বিদ্যাসাগরের বক্তব্য বলে জবরদস্তি করে বার যা চালাতে চাইছেন তা আসলে মার্শম্যানের বক্তব্য!
যথাযথ উত্তর দেওয়ার পরে মুখে সেই যে কুলুপ পড়ল, সে কুলুপ আর ইহজীবনে খুলবে না। কিন্তু তাঁকে প্রতারক বলা যাবেনাকো।
৩) ১০ অক্টোবর ২০২০ ০৬:২০
//ঈশ্বরচন্দ্রের বুদ্ধিমত্তা ও বিদ্যানুশীলনের প্রতিভার বৈচিত্র দেখে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক সকলেই বিস্মিত হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিভার যোগ্য সম্মান দেওয়ার জন্য প্রবীণ অধ্যাপক শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতি মহাশয় প্রস্তাব করলেন, ঈশ্বরচন্দ্রকে একটি উপাধি দেওয়া দরকার। এই প্রস্তাব সমর্থন করলেন প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ। আর এই ঐতিহাসিক প্রশংসাপত্রে স্বাক্ষর করলেন সংস্কৃত কলেজের ছ’জন অধ্যাপক— ব্যাকরণে গঙ্গাধর শর্মা, কাব্যে জয়গোপাল, অলঙ্কারে প্রেমচন্দ্র, বেদান্ত ও ধর্মশাস্ত্রে শম্ভুচন্দ্র, ন্যায়শাস্ত্রে জয়নারায়ণ ও জ্যোতিষশাস্ত্রে যোগধ্যান— যাঁরা প্রত্যেকেই নিজের বিষয়ে ছিলেন সে যুগের দিকপাল পণ্ডিত। খুব কম ব্যক্তিই সেযুগে এই উপাধি পেয়েছিলেন, তারানাথের পুত্র তাঁদের মধ্যে অন্যতম।//
বটেই তো! ভক্তিবাদী সমিতির ভগোমান বিদুকে ‘বিদ্যাসাগর’ সার্টিফিকেট এরাই দিয়েছিলেন বটে!! আর সাদারল্যান্ড ঘোড়ার ঘাস কেটেছিলেন!!!
আর সেই সার্টিফিকেট যে আদৌ ঈশ্বরের ‘বুদ্ধিমত্তা ও বিদ্যানুশীলনের প্রতিভার বৈচিত্র দেখে’ দেওয়া হয়নি – সেই বেসিকটুকু না জেনে ফের বারফাট্টাই করলে সার্টিফিকেটের ছবি দেয়ে দোবো। দেখে চক্ষু সাত্থোক করে নিতে হবে।
৪) এবারে অ্যাডাম সম্পর্কে অপরিসীম অজ্ঞতা, মূর্খতা প্রদর্শন ও নির্লজ্জ সিনাজোরির কিছু নমুনা –
এই সুবাদে বাদ পড়ল ক) টমাস মুনরো, খ) বোম্বে এডুকেশন কমিটির ১৮১৯ সালের রিপোর্ট, গ) ইংল্যান্ডে ১৮০১ সালে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩,৩৬৩টি, এই আঁকাড়া তথ্যটি এবং ঘ) পাঞ্জাবের লিটনারের শিক্ষা সংকোচন সংক্রান্ত মন্তব্য। কারণ? কী আবার, প্রশ্ন কমন পড়েনি তাই! নাহলে সমস্ত তথ্য ধরমপালের থেকে নেওয়া হয়েছে বলা সত্ত্বেও এই কাঁঠাল পাতা কেউ চিবিয়ে যায় যে ‘এই আশ্চর্য পরিসংখ্যানটিই রাম স্বরূপ খুব গর্বের সঙ্গে তুলে দিয়েছেন তাঁর ‘অন হিন্দুইজ্ম্’ নামক হিন্দু-প্রোপাগাণ্ডার বইতে’!
তাই যথারীতি সব বাদ দিয়ে এক লাখ পাঠশালা নিয়ে নাপানাপি শুরু হল। কারণ এইটি কমন পড়েছে। বাকিগুলোতে কোষ্ঠকাঠিন্য! অথচ সেখানেও বিস্তর গণ্ডগোল! যেমন – ক) ‘তখন বাংলা ও বিহারের সাতটি জেলা মিলিয়ে বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়াল ছাব্বিশশোর কাছাকাছি’ । সাতটি জেলায় সমীক্ষা করল কে? বুয়েছি। ভক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক আর তাঁর একান্ত ন্যাওটা রামভক্ত হনুমানটি। তা মোয়ায় টাইম মেশিনে চেপে দেখা করেছিলেন বুঝি অ্যাডাম সাহেবের সঙ্গে? খ) ‘মুচি মেথর ডোম এইসব জাতের লোকেদের পাঠশালার ধারকাছেও আসতে দেওয়া হত না’ । ওলে বাবা লে। এক নম্বর ছপিটা দেখে নিন বরং। শিক্ষকের তালিকাটাও।
এত কিছু কথা কী নিয়ে হচ্ছে বা কাকে সাক্ষীগোপাল মেনে হচ্ছে? না ফিলিপ হার্টগ। তো তিনি কি ভগোমান না তাঁকে কাউন্টার করার লোক পাওয়া যায়নি – কোনটা?
এখানে দুটো ছবি দিলাম। প্রথমটা হার্টগের। পরেরটা অ্যাডাম স্বয়ং যে ছ’টি থানায় নিজে সমীক্ষা করেন, তার। ছবি দেখলে ‘এলাকার জনসংখ্যাকে চারশো দিয়ে ভাগ করলে স্কুলের সংখ্যা যা হওয়া উচিত তার চেয়ে আসলে আছে অনেক কম’ নামক জোচ্চুরি বন্ধ হবে কি না, তা অবশ্য জানি না।
https://i.postimg.cc/HxmmW2fZ/Hartog.jpg
https://i.postimg.cc/D0yKLzf1/Adam.jpg
ভক্ত হনুমানের আর কী উত্তর দেব? হুপ হুপ করতে গিয়ে মানে ফেবু পোস্টের কাঁচা কপি-পেস্ট মারতে গিয়ে //বস্তুত, ১৮৩৭ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গ-বিহারের একাধিক জেলা পরিভ্রমণ করে অ্যাডাম যখন তৃতীয় রিপোর্টটি লেখেন তাতে তিনি স্বীকার করে নেন, "Many villages did not contain a single person able to write, or even to count." [১১]// কোত্থেকে থেকে ১১ সংখ্যক টীকা হাজির হল, সেটাই বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছেন!!!
ছবি আসেনি। ফলে আর একবার দিলাম।
একটা বিষয় লক্ষ্য করে অবাক হচ্ছি। কথাটা হল এলেবেলে যাঁদের আক্রমণ করছেন তাঁদের বিবৃত যুক্তিতথ্যগুলির কিন্তু জবাব দিতে পারছেন না।
উনি এরকমই। নাহলে কেউ বলে ফেসবুক পোস্ট থেকে কপি করেছে? আরে বাবা ওনারই তো ফেসবুক পোস্ট। আর মুল কথা হল যেগুলো লিখেছেন সেগুলো ভুল না ঠিক। এলেবেলে ওরফে দেবোত্তম কিন্তু তা নিয়ে রা কাড়ছেন না।
উইকেন্ড উইকেন্ড! দেবব্রতই তবে ন্যালাখ্যাপা? বাতিল খাতা কি গুবরে ঘোষ স্বয়ং? আড়েঠাড়ে মনে হচ্ছে দেবব্রত-দেবোত্তম ফেবুখেউর হয়েছিল। সেটা পিলিজ একটা আলাদা টইতে পোস্ট করে দিন না দাদারা! পড়ে মজা পাই।
ধুর দেবব্রত না, দেবাশিস। বাদামে নুন বেশি হয়ে এই বিপত্তি।
ইন্দ্রনীল মিত্র, চোখে কি ন্যাবা হয়েছে না চালসে পড়েছে?
একজন লেখককে লাগাতার মূর্খ, নির্লজ্জ, প্রতারক, জোচ্চোর, বুজরুক বলা হচ্ছে - সেটা দেখতে পাচ্ছেন না? নিক চুরি চলছে - দেখতে পাচ্ছেন না?
তাঁদের বিবৃত যুক্তিগুলোর নমুনা -
১) তুহিন মালাকার - কোথায় দেখা গেছে দেবাশিস্ ভটচাজ ছাড়া আর কেউ জানে না। এত বই-এর উল্লেখ করলে ওই খাজাস্য খাজা বইটার উল্লেখ কেন করিনি, সেটাও বুঝতে পারিনি আজ অবধি।
২) বাঙ্গালার ইতিহাস - মোক্ষম উত্তর দিয়ে দিয়েছি। নির্লজ্জতা এক ফোঁটা কমেনি তার পরেও।
৩) 'বিদ্যাসাগর' উপাধি - বেসিক জানা নেই। কারা সেই সার্টিফিকেট কখন, কবে, কী কারণে দিয়েছিল, তা-ও জানা নেই। তারও উত্তর দিয়েছি। তার জন্য তাঁকে প্রতারক বলিনি।
৪) অ্যাডামের এক লাখ পাঠশালা - ফিলিপ হার্টগের জারিজুরি ভেঙে চৌচির করে দিয়েছি ছবি দিয়ে। প্রয়োজনে একই ছবি অন্য বই থেকে দিতে পারি।
৫) তারপরেও বাতিল খাতা ওরফে শিবাশীষ বোস নামক নিরেট মুখ্যু গলা ফুলিয়ে বলে যাচ্ছে 'আরে বাবা ওনারই তো ফেসবুক পোস্ট'। নির্লজ্জতারও একটা সীমা থাকে। মিথ্যা কথা বলারও। মুরোদে থাকলে আমার সেই ফেবু পোস্টের স্ক্রিনশট দিতে বলছি। নতুবা স্বীকার করে নিতে বলছি, এ বিষয়ে উনি নির্জলা মিথ্যা কথা বলছেন।
৬) অ্যাডাম ফুরিয়ে যাননি। পরিষ্কার লেখার শেষে বলা আছে, এই লেখায় ফিরে ফিরে আসবেন তিনি। তখন দেখব এই মূর্খগুলো আবারও নির্লজ্জ প্রতারক বলে কি না আমাকে।
বালক ব্রহ্মচারীর দুর্গন্ধযুক্ত লাশ যেমন পাহারা দিয়েছিল কিছু কায়েমী স্বার্থসম্পন্ন মানুষ, অবিকল একই ভাবে এই ভক্তিবাদী সমিতি যুক্তিবাদ প্রসারের নামে একটা ২০০ বছরের পচা-গলা লাশ আঁকড়ে থেকে, গলার জোরে বাকিদের ভণ্ড বলার ভণ্ডামি দেখিয়ে যাচ্ছে আর লাগাতার অসভ্যতা করে যাচ্ছে।
ঘি মাখানোর পালা শেষ হয়ে গেছে। পরের অধ্যায় থেকে লাশ সোজা চিতায় উঠে দাউ দাউ জ্বলবে। মুখে আগুন দেবেন বিদ্যাসাগরচরিত-এর রবীন্দ্রনাথ। দেখতে থাকুন চুপচাপ।
তুহিন মালাকার ও দেখ্লুম ঐ নিয়ে প্রচুর বকতব্য রেখেচেন, ঔপনিবেশিক ভারত o অ্যাডমস রিপোর্টের মত
এলেবেলে আমার একটি প্রশ্নেরও উত্তর দেননি । এবং, তাঁর অসংলগ্ন কথাবার্তা দেখে সন্দেহ হয়, 'উত্তর দেওয়া' বস্তুটি কাকে বলে সে ব্যাপারটি সম্পর্কেই বোধহয় তাঁর আদৌ কোনও ধারণা নেই । তিনি তাঁর মূল লেখা ও জবাবে এতক্ষণ যা যা বলছেন, তাতে বাংলা ব্যাকরণ একটি ষড়যন্ত্র, তুলনামূলক ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব একটি ষড়যন্ত্র, পশ্চিমী যুক্তিবাদ-বিজ্ঞান ইত্যাদি একটি ষড়যন্ত্র, এবং ইংরেজরা আসার আগে ভারতীয় সমাজ যে কুসংস্কার-অজ্ঞতা-জাতপাত কবলিত একটি চূড়ান্ত অসাম্যের সমাজ ছিল এই কথাটাও একটি ষড়যন্ত্র মাত্র । এইগুলোই তিনি বলতে চেয়েছেন কিনা, সে প্রশ্ন তাঁকে করেছিলাম, কিন্তু জবাব পাইনি । জবাব যে আদৌ দিতে হয়, এ বিষয়ক সচেতনতাও তাঁর কথাবার্তা ও আচরণে টের পাওয়া যায়নি । ফলত, প্রশ্নগুলোর তাৎপর্য বোঝার মত অবস্থায় তিনি আদৌ আছেন কিনা, সে ব্যাপারে ঘোর সন্দেহ অবশ্যম্ভাবী ।
পরবর্তীকালে অ্যাডাম সাহেবের রিপোর্ট নিয়ে যা যা বলেছি, তারও সদুত্তর তিনি দিতে পেরেছেন কিনা, সেটা এই থ্রেডের অন্যান্যরা নিশ্চয়ই নিজের মত করে বিচার করবেন, তাঁরা তো উভয়ের বক্তব্যই দেখতে পাচ্ছেন । কাজেই, পুনরাবৃত্তি করে লাভ নেই ।
প্রশ্নকর্তার 'আসল' পরিচয় নিয়ে তাঁর উদ্ভট ও বিচিত্র গবেষণাকে প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের উত্তর দেবার বিকল্প হিসেবে তিনি যেভাবে ধরে নিয়েছেন, এবং একের প্রশ্নের উত্তর অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে উল্লসিত হচ্ছেন, তাতে তাঁর বক্তব্য মোটেই প্রমাণ হয়নি, কিন্তু তাঁর ছিটগ্রস্ত উন্মত্ততা অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে । তিনি যদি সত্যিই তাই হন, তাহলে তিনি পণ্ডিত না মূর্খ সে নিয়ে মাথা ঘামানো বাস্তবিকই অবান্তর ।
তবু তা সত্ত্বেও, অ্যাডাম সাহেবের রিপোর্ট, লেখকের তুলে আনা সারণি এবং তুহিন মালাকারের বই নিয়ে আরও কিছু কথা বলা জরুরি, কারণ তা না হলে এই থ্রেড অন্য যাঁরা অনুসরণ করছেন তাঁদের বিভ্রান্তি হবে । হ্যাঁ, অবশ্যই বলব । তবে তার আগে লেখককে দুটো প্রশ্ন করি ।
(১) লেখক কি অ্যাডাম সাহেবের রিপোর্ট আদৌ পড়েছেন ? মনে রাখবেন, পড়েছেন কিনা জিজ্ঞেস করেছি, অন্তর্জাল থেকে বইয়ের পাতার ছবি তুলে এনে পোস্ট করতে পারেন কিনা, সেটা কিন্তু মোটেই জিজ্ঞেস করিনি ।
(২) তিনি কি প্রাগৌপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা বিষয়ে ধরমপাল এবং পরমেশ আচার্য ছাড়া আর অন্য কোনও প্রামাণ্য ইতিহাস পাঠ করেছেন ?
এই দুটো প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করব । তারপর আমার বক্তব্য বলব, উত্তর আসুক বা না-ই আসুক ।
এখানে একটা ইতিগজ থেকে যাচ্ছে। এই যে ডোমেস্টিক ইন্সটিট্যুশনের যে পরিসংখ্যান অ্যাডাম সায়েব দিয়েছেন, সেই 'ইশকুল'গুলি সম্পর্কে অ্যাডাম নিজেই লিখে গিয়েছেন যে সেখানে শিক্ষাদান হ'ত তা in general more crude and imperfect, more interrupted and desultory, than that which is obtained in the common schools
তো, সায়েবের নিজস্ব পরিসংখ্যান থেকেই দেখা যাচ্ছে যে এই ইশকুলগুলিতে বড়জোর এক বা দুজন পড়ত। যেমন মুর্শিদাবাদ শহরের দৌলতবাজার থানায় এরকম স্কুলের সংখ্যা ২১৬, কিন্তু এইরম স্কুলে পড়াশোনা করে মোট ৩০০ জন। নুড়িয়া নাকি নাংলিয়া, কুলনা, জেহানাবাদ, ইত্যাদি সব থানাতেই সংখ্যাগুলো এরকম, ৩২৬, ২৮৫,৬৭৬,৫৩৯...নাটোরের তথ্যও হিসেবের মধ্যে ধরলে, মোট একলাখ একুশহাজারের কাছাকাছি পাঁচ থেকে চোদ্দ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে প্রথাগত স্কুলের পড়ে সাড়ে চারহাজার এবং এরকম ডোমেস্টিক ইন্সটিট্যুশনে পড়ে সাড়ে চারহাজার। এ ঐ অ্যাডাম সায়েবের রিপোর্টের দুশবত্রিশ পাতায় রয়েছে। চোদ্দ বছরের বেশী বয়সী বাচ্চাদের হিসেব জানিনা। অ্যাডামের নিজের রিপোর্ট অনুযায়ীই তো সিচুয়েশন খুবই খারাপ ছিল দেখা যাচ্ছে।
মনে হয় এই ডোমেস্টিক ইশকুল হয়ত অবস্থাপন্ন যারা নিজেদের বাড়িতে মাস্টার রেখে পড়াত বা এরকম কিছু।
প্রশ্নকর্তা আসলে নিজেই ‘ছিটগ্রস্ত উন্মত্ততা’-য় ভুগছেন। তাই কখনও তিনি দেবাশিস্ ভটচাজ হচ্ছেন, কখনও ন্যাল্যাখাপা। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই অসম্ভব ‘অসংলগ্ন কথাবার্তা’ বলছেন, সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে দেদার ব্যক্তি আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন।
১) বাংলা ব্যাকরণ একটি ষড়যন্ত্র – বলিনি। কিন্তু সংস্কৃত আশ্রয়ী বাংলা ব্যাকরণ একটি বিশুদ্ধ আচাভুয়া বস্তু। হ্যালহেড তা করলে সেটা আরও আচাভুয়া হবে।
২) তুলনামূলক ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব একটি ষড়যন্ত্র – বলিনি। কিন্তু সংস্কৃতে বিশুদ্ধ মূর্খ জোন্স ১৭৮৬ সালে সেই নিয়ে পাকামো করলে সেটি বিশুদ্ধ ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্র।
৩) পশ্চিমী যুক্তিবাদ-বিজ্ঞান ইত্যাদি একটি ষড়যন্ত্র – বলিনি। বলার প্রশ্নই নেই।
৪) ইংরেজরা আসার আগে ভারতীয় সমাজ যে কুসংস্কার-অজ্ঞতা-জাতপাত কবলিত একটি চূড়ান্ত অসাম্যের সমাজ ছিল এই কথাটাও একটি ষড়যন্ত্র মাত্র – বলিনি। ইংরেজরা আসার পরে তার পরিমাণও বেড়েছিল এবং অসাম্য আরও চূড়ান্ত পর্যায়ে পোঁছেছিল।
৫) লেখক কি অ্যাডাম সাহেবের রিপোর্ট আদৌ পড়েছেন – অবান্তর প্রশ্ন। আর রিপোর্ট নয়, প্রকৃতপক্ষে রিপোর্টস। পৃষ্ঠাসংখ্যা উল্লেখপঞ্জীতে বিশদে আছে। ন্যাল্যাখ্যাপামি করে লাভ নেই।
৬) তিনি কি প্রাগৌপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা বিষয়ে ধরমপাল এবং পরমেশ আচার্য ছাড়া আর অন্য কোনও প্রামাণ্য ইতিহাস পাঠ করেছেন – ফিলিপ হার্টগের ক্যারদানি ওই দুটো বই থেকে দেওয়া হয়নি। বাকি কতগুলো বই পড়েছি, সেটাও অবান্তর। এখানে ক্যুইজ খেলতে আসিনি।
এবারে বিদ্যাসাগরের উপাধি সম্পর্কে, বাঙ্গালার ইতিহাস সম্পর্কে এবং মুনরো ও লিটনার সম্পর্কে যে নিরেট অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন – তার একটার জন্যও ভুল স্বীকার করার সততা দেখাবেন কি? নাকি নিকের নাচন চালিয়ে যাবেন আর ন্যাকা চৈতন্য সেজে ‘ওটা তো আমি বলিনি’ মার্কা চালিয়াতি চালিয়ে যাবেন ভক্ত হনুমানটির মতো?
লেখকের আচরণ অনেকটা পাড়ার পেঁচো মাতালদের মত । তাদেরকে কেউ যদি হেসে জিজ্ঞেস করে --- কি হে মাতাল, দিনকাল কেমন যাচ্ছে --- তাহলে সে মোটেই অস্বীকার করে না যে সে মাতাল, কিন্তু প্রশ্নকর্তার দিকে দাঁত খিঁচিয়ে বলে, 'তুই মাতাল, তোর বাপ মাতাল' । ছিটগ্রস্ততার সঙ্গে এর পার্থক্য যৎসামান্যই ।
তবে, এই যে লেখক আপনমনেই বিভিন্ন ছদ্মনামের আসল মালিককে বার করে ফেলে নিজে নিজেই হাসছেন কাঁদছেন নাচছেন, কে মানল আর কে মানল না গ্রাহ্য করছেন না, এগুলো কিন্তু সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ । তা যদি হয়, তো সেটা ছিটগ্রস্ততা বা পেঁচোগিরির চেয়েও বড় সমস্যা ।
হ্যালহেড-রামমোহন-বিদ্যাসাগর নির্মিত ব্যাকরণ ষড়যন্ত্র ? তো 'আসল' বাংলা ব্যাকরণটি তবে কে কবে লিখলেন ? পাগলাগারদে বসে বসে লেখক নিজেই লিখলেন বুঝি ?
সংস্কৃতে বিশুদ্ধ মূর্খ জোন্স যদি ভাষাতত্ত্ব নিয়ে ষড়যন্ত্র করে থাকেন, তো ঠিক ভাষাতত্ত্বটা বানালেন কে, গ্রিক-ল্যাটিন-জার্মানিক ভাষায় বিশুদ্ধ মূর্খ এলেবেলে উন্মাদ ?
'পশ্চিমী বিজ্ঞান-যুক্তিবাদ একটি ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্র' এ কথা যদি না-ই বলে থাকেন, তো বিদ্যাসাগর নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় তার আবাহন করলে তাকে সাম্রাজ্যবাদের দালালি বলে অভিযোগ করেন কেন, অন্ধকারের জীব পেঁচো মাতালের চোখে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো সয় না বুঝি ?
'প্রাগৌপনিবেশিক ভারতীয় সমাজ ঔপনিবেশিক সমাজের চেয়ে কম অসম ছিল' এই সাজেশনটি নিয়ে বহু ধানাইপানাইয়ের পর লেখক এবার ঝেড়ে কাশতে বাধ্য হয়েছেন --- স্বীকার করেছেন যে তিনি ঠিক ওটাই বলতে চেয়েছেন । তাঁকে বলি, এতে সত্য প্রকাশিত হয়নি, শুধু তাঁর নিপাট মূর্খতাই প্রমাণিত হয়েছে, কারণ এ ধরনের কোনও প্রামাণ্য গবেষণামূলক তথ্যের আদৌ অস্তিত্ব নেই ।
এই প্রত্যেক কটা কথাই আগে হয়ে গেছে, তবু এলেবেলে পণ্ডিত আবারও এইসব বলালেন । মূর্খ নির্লজ্জের কাছ থেকে এর বেশি আর কীই বা আশা করা যায় !
আমার প্রশ্নের উত্তর তিনি দেবেন না, বরং তিনিই আমাকে বলে দেবেন তাঁর লেখার কোন অংশটি নিয়ে মন্তব্য করতে হবে, লেখকের এই সিজোফ্রেনিক আবদারটি চমৎকার । তাঁকে বলি, যা বলার সবই বলব, ইতিমধ্যে ভাল থাকবেন, নিজের যত্ন নেবেন ।
লেখক অ্যাডাম সায়েবের প্রতিবেদন পড়েছেন, এবং শিক্ষার প্রামাণ্য ইতিহাসও পড়েছেন --- এই দুটি দাবি পরিচ্ছন্নভাবে রাখার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই ।
হ্যাঁ, দুটি দাবিই নির্জলা মিথ্যে । কেন বলছি, সে কথায় আসব শিগগিরই ।
"লেখক অ্যাডাম সায়েবের প্রতিবেদন পড়েছেন , এবং প্রাগৌপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা বিষয়ে ধরমপাল এবং পরমেশ আচার্য ছাড়া আর অন্য কোনও প্রামাণ্য ইতিহাসও পড়েছেন" এটা আবার কোথায় বলা হল? নিচের দুলাইনে এই দুটি দাবি পরিচ্ছন্নভাবে রাখা একেবারেই নেই। প্রশ্নদুটিকে অবান্তর বলা আছে।
– ফিলিপ হার্টগের ক্যারদানি ওই দুটো বই থেকে দেওয়া হয়নি। বাকি কতগুলো বই পড়েছি, সেটাও অবান্তর। এখানে ক্যুইজ খেলতে আসিনি।
না, প্রত্যক্ষে না হলেও পরোক্ষে সে দাবি করেছেন ।
অ্যাডামের রিপোর্টের সরাসরি রেফারেন্স যখন তাঁর লেখায় আছে তখন 'ন্যালাখ্যাপামি' না করে অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে তিনি তা পড়েছেন, এই রকমই তাঁর বক্তব্য ।
আর, তিনি যে দুটি সারণির ছবি দিয়েছেন সে দুটি ও দুটো বই থেকে নেওয়া হয়নি, অতএব অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে তিনি ও দুটো ছাড়াও আরও বই পড়েছেন, এটাও তাঁর বক্তব্য ।