জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রতীক সান্যাল তার সংস্থার মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের একজনের থেকে একটি এসএমএস পায় পরেরদিন তার ল্যাপটপ, হেডফোন, আরএসএ টোকেন ইত্যাদি সংস্থাপ্রদত্ত যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে অফিসে যাবার জন্য। তাতে আরো লেখা কিছু সরঞ্জাম সুরক্ষাবিধির মানের তুলনায় নিম্নমানের হওয়ায় সেগুলি পরীক্ষা করে দেখা হবে কী করা যায়। প্রতীক পরেরদিন দুপুরে অফিস পৌঁছানো মাত্র দেহের তাপমাত্র পরীক্ষা ও মোবাইলে আরোগ্য সেতু পরীক্ষার পর পরই এক সুরক্ষাকর্মী তার সঙ্গ নিয়ে গাড়িতে চেপে বসেন, তাকে মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়ে মোবাইল ফোন অফ করিয়ে তবে তিনি যান। এরপরে সিস্টেম সাপোর্টের লোক এসে তার ল্যাপটপসহ যাবতীয় জিনিষ পরীক্ষা করার নামে চেয়ে নিয়ে যাবার পর ওকে আরেকটি ঘরে পৌঁছে দেয়। সেই ঘরে দুজন বসে, যারা ওকে একটি সংক্ষিপ্ত চিঠি দিয়ে সই করে দিতে বলে। চিঠিতে লেখা আছে ‘ব্যক্তিগত কারণে প্রতীক সান্যাল আজ এই মুহূর্তে এই সংস্থা থেকে পদত্যাগ করছে’। ওর বিভ্রান্ত মুখ দেখে উপস্থিত দুজনের একজন বলেন কোভিডজনিত কারণে সংস্থার ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় তাঁরা প্রতীককে আর রাখতে পারছেন না। ও যেহেতু গত ৪৫ দিন ধরে কোন প্রোজেক্টে নেই, বেঞ্চে আছে, ফলে ওর বেতন সংস্থার জন্য অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় এছাড়া আর কোন উপায় তাঁরা দেখছেন না।
প্রতীক, বাণিজ্যশাখার স্নাতক, তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে চাকরি করছে আজ ষোল বছর। সাধারণ প্রোগ্রামার থেকে প্রোজেক্ট ম্যানেজার হয়ে উঠতে বেতনও বেড়েছে আশানুরূপভাবেই। থাকে পুণে, কলকাতার বাড়িতে গুরুতর অসুস্থ বাবা মা, মূলত আয়া আর কাজের লোকের ভরসায়। তাঁরা পুণে আসতে নারাজ কলকাতার পাড়া ছেড়ে, ফলত প্রতীককে দুটো সংসারের খরচ হিসেব করে চলতে হয়। মার্চে যখন লকডাউন শুরু হয় প্রতীক তখন পুণেতেই, এপ্রিলে বাড়ি গিয়ে মাসখানেক বাড়ি থেকে কাজ করবে আর ব্যাঙ্কের কাজ, পৌরসভার কর দেওয়া ইত্যাদি সেরে আসবে এরকম পরিকল্পনা ছিল, লকডাউন ক্রমাগত বেড়ে চলায় সেসব ভেস্তে যায়। তবে নিশ্চিন্ত ছিল যে অন্তত টাকা দিয়ে যতটা যা করা যায় সেগুলো করছে। মে মাস নাগাদ ওর রিপোর্টিং ম্যানেজার ওকে ডেকে বলেন আপাতত ওকে আর এই প্রোজেক্টে দরকার হচ্ছে না। ক্লায়েন্ট জানিয়েছে কোভিডজনিত কারণে ব্যবসা মার খাওয়ায় ৩০ শতাংশ লোক কমাতে, কাজেই ওকে আর দশদিন বাদে এই কাজ থেকে মুক্ত করে দেওয়া হবে, ও সংস্থারই অন্যান্য প্রোজেক্টে খোঁজা শুরু করে দিতে পারে।
ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির বৃহদংশই পরিসেবাক্ষেত্রে কাজ করে থাকে। বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক সংস্থা, বিমান পরিসেবাদানাকারী সংস্থা, টেলিফোন, ইন্টারনেট প্রদানকারী সংস্থার জন্য প্রয়োজনীয় নতুন সফটওয়্যার বানানো ও চালু সফটওয়্যারগুলোকে ঠিকঠাক বজায় রাখা, গ্রাহক পরিসেবাকেন্দ্রগুলো চালু রাখা ইত্যাদিই কাজ। এইসব পরিসেবার কাজগুলি বরাদ্দ করে যেসব ক্লায়েন্ট সংস্থা, তাদের কাজের পরিমাণ ও ধরণ অনুযায়ী বিভিন্ন প্রোজেক্টে ভাগ করা হয়। ভারতীয় সংস্থা সেইসব প্রোজেক্টের প্রয়োজন অনুযায়ী কর্মী নিযুক্ত করে। একটা প্রোজেক্ট কর্মী কমালে বা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলেও সংস্থার অন্যান্য প্রোজেক্টে নিযুক্ত হয়ে যাবার সুযোগ থাকে। ফলে প্রতীক সেসময় খুব একটা চিন্তিত হয় নি। এছাড়া কাজের বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কিছু পেশাদার সংস্থা থেকে শংসাপত্রও নেওয়া আছে ওর। মে’র মাঝামাঝি থেকে ও নিজের সংস্থার ভেতরে ও বাইরে অন্যান্য সংস্থায়ও খোঁজ শুরু করে। নিজ সংস্থায় দুই একটি অন্য প্রোজেক্টে কথাবার্তা হয়েও যায়। কিন্তু দুনিয়া জুড়েই কোভিড পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকায় সমস্ত ক্লায়েন্টই আপাতত নতুন কর্মী বাড়ানো স্থগিত রাখে। এই করেই পেরিয়ে যায় ৪৫ দিন। এই ৪৫ দিন প্রতীক ছিল ‘নন বিলেবল’ অর্থাৎ প্রতীকের কাজ ও দক্ষতা বিক্রি করে তার সংস্থা কিছু আয় করতে পারে নি। মজা হল এই ৪৫ দিনের মধ্যে প্রতীক যতবারই মানবসম্পদ উন্নয়নের কোন না কোন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে, প্রত্যেকবারই তাঁরা আস্বস্ত করেছেন ওর ভয় পাওয়ার কিছু নেই, চাকরি যাবে না। এই তো পরের ত্রৈমাসিকের মধ্যেই পেয়ে যাবে প্রোজেক্ট।
প্রাথমিক বিস্ময় ও বিভ্রান্তি কাটিয়ে ‘স্বেচ্ছায়’ সই করতে অস্বীকার করেছিল প্রতীক, বলেছিল সংস্থার যেহেতু আয় কমে গেছে, তারা সেই কারণ দেখিয়ে ওকে বরখাস্ত করুক। এবার ঘরের দ্বিতীয়জন অত্যন্ত অন্তরঙ্গ সুরে হাসিমুখে জিগ্যেস করেন বরখাস্ত হলে প্রতীকের লাভটা ঠিক কী? ও জানায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন এই সঙ্কটজনক মুহূর্তে কাউকে ছাঁটাই না করতে, কাজেই ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জানাবে, কোর্টের দরজায় ঠকঠক করবে, শ্রমদপ্তরকে জানাবে। এই সময় পাশের ঘর থেকে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এসে ঢোকেন, ইনি এতক্ষণ কানে হেডফোন দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলেন। প্রতীক খেয়াল করে এঁর গলায় ঝোলানো ভিজিটরস আইডি অর্থাৎ ইনি এই সংস্থার লোক নন। তিনি নিজ পরিচয় দেন অ্যাডভোকেট রাঠোর বলে, প্রতীককে বলেন প্রধানমন্ত্রী ‘অনুরোধ’ করেছেন, আপনার সংস্থা এতদিন তাঁর অনুরোধ রেখেই এসেছেন কিন্তু আর তো সম্ভব নয়। বলে স্মিত হাসেন। এরপরে জিগ্যেস করেন ওর ব্যবসা বা খেতিজমি কিছু আছে কিনা? শান্তভাবে বোঝান মামলা করলে অন্তত সাড়ে তিন থেকে চার বছর লাগবে ফয়সলা হতে। সংস্থার প্রতিনিধি অধিকাংশ সময় আদালতে উপস্থিতই হবেন না, তাঁদের আইনজীবি তারিখের পর তারিখ নিয়ে মামলা যথাসাধ্য ধীরগতি করবে। এই সময়টা প্রতিটি উপস্থিতির জন্য প্রতীককে তার তরফের আইনজীবিকে খুব সস্তা হলেও অন্তত কুড়িহাজার টাকা করে দিতে হবে। সর্বোপরি এই সংস্থা ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ না দেওয়ায় প্রতীক অন্য কোন সংস্থায় সম্ভবত যোগ দিতে পারবে না। তবে প্রতীক যদি শেষপর্যন্ত মামলা চালিয়ে যায় তাহলে ও’ই জিতবে। কারণ সমজাতীয় যে কটি মামলাই হয়েছে তাতে সংস্থা হেরেছে। বেতননির্ভর নিরুপায় প্রতীক সই করে দেয়।
সেই দিনে সেই সংস্থাটি গোটা ভারতজুড়ে তাদের সবকটি ব্র্যাঞ্চ মিলিয়ে দুশোজনকে ছাঁটাই করে। প্রসঙ্গত বলে রাখা যাক, সেই সংস্থাটি ২০-২১ আর্থিকবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ লাভ দেখিয়েছে। এ তো গেল একটামাত্র সংস্থার কথা। এরকম অন্যান্য তথ্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলিও সমানে ধীর কিন্তু নিশ্চিতভাবে ছাঁটাই করে চলেছে। ২৮শে আগস্ট প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন কোভিডজনিত মন্দায় তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে মোটামুটি ৫ শতাংশ মানুষ ছাঁটাই হবেন। সংখ্যার হিসেবে প্রায় দুই লাখ মানুষ। তাঁদের পরিবার, গাড়িচালক, গৃহকর্মসহায়িকা ইত্যাদি ধরলে খুব কম করে কুড়িলক্ষ মানুষ সরাসরি প্রভাবিত হবেন। মোটামুটি এপ্রিল মে নাগাদই বহু সংস্থা কর্মীদের বেতনের একটা অংশ কমানো, দক্ষতাজনিত বোনাস দেওয়া আপাতত স্থগিত রাখা, বেতনের পরিবর্তনশীল অংশটি ফ্রিজ করে দেওয়া ইত্যাদি পদক্ষেপ নিয়েইছে, যার কোনটাতেই কর্মীদের কোন মতামত গ্রাহ্য করা হয় নি। নতুন নিয়োগও প্রায় বন্ধই। অনেক সংস্থা ইন্টারভিউ নিয়ে তারপর আপাতত এই ত্রৈমাসিকে নিয়োগ বন্ধ বলে স্থগিত রাখছে। সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি নামক এক স্বাধীন সংস্থার সমীক্ষা ও বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে ভারতে ১৮.৯ মিলিয়ন বেতনভুক লোক কাজ খুইয়েছে। অর্থাৎ প্রায় এককোটি আশি লক্ষের বেশী লোক। এর কত শতাংশ তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রের জানা নেই, তবে সেটা নেহাৎ কমও হবে না। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যপার হল ব্যবসা কমে যাওয়ার অজুহাতে ছাঁটাই করা অনেক সংস্থাই এই ত্রৈমাসিকে কিছু না কিছু লাভ দেখিয়েছে। হয়ত তা খানিক কম কিন্তু বড়সড় ক্ষতি নয় কোনওভাবেই। এই মানুষগুলোকে চাকরিতে বহাল রাখলে তাদের ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যেত এমন নয়।
ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে ছাঁটাই একটা মাসিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই ২০১৪-১৫ থেকেই। এর আগে ছাঁটাই হত খানিকটা ঘটনা ও তার প্রভাব নির্ভর। যেমন ৯/১১র পরবর্তী ধ্বস, লেম্যান ব্রাদার্সের ধ্বস ইত্যাদি। তা এতদিন সংস্থাগুলো বেশিরভাগই বলে আসছিল যে এ হল অদক্ষ কর্মীদের সরিয়ে দেবার বাৎসরিক ঘটনা, অদক্ষ কর্মীদের নিয়ে চলা আজকের এই প্রতিযোগীতামূলক বাজারে একেবারেই সম্ভব না। প্রশ্ন হল যে বাৎসরিক ঘটনা হলে প্রায় প্রতিমাসেই কিছু কিছু ছাঁটাই হয় কেন? কারণ এই তথাকথিত দক্ষ বা অদক্ষ কর্মী নির্ধারিত হয় কর্মীটি কতটা বিক্রয়যোগ্য তার উপর। কর্মীর প্রতিদিনের কাজের আটঘন্টার জন্য যদি অন্য কোনও সংস্থার থেকে নিয়োগকারী সংস্থা আয় করতে সমর্থ হয় তবে কর্মী হয় ‘বিলেবল রিসোর্স’ আর এই মূল্যের পরিমাণের উপরই নির্ভর করে সংস্থা কর্মীকে রাখতে ইচ্ছুক না ছেড়ে দিতে। এবার বিবিধ কারণে অনেকসময় এই কাজের বরাতগুলো বিভিন্ন সংস্থা হারায় আবার বিভিন্ন নতুন কাজের বরাত পায়ও। তো বরাত হারাবার পরিমাণ বেশী হলে বেশ কিছু কর্মীকে ছাঁটাই করে। এর বেশ চমৎকার গালভরা নামও আছে, বিজনেস র্যাশনালাইজেশান।
এবার ধরি এরকম একটি কাজের বরাতে (প্রোজেক্টে) ১৫০ জন কর্মী কাজ করেন, যে সংস্থা বরাত দিয়েছিল তারা হয়ত তাদের ব্যবসায় মন্দার জন্য বা এই সংস্থার কাজ পছন্দ না হওয়ার জন্য এই কর্মীসংখ্যা সংকোচন করে ৫০ জনে নামিয়ে আনল। সেক্ষেত্রে ১০০ জন কর্মীর জন্য নিয়োগকারী সংস্থা কোন আয় করতে পারছে না। ওদিকে আরো দুটি সংস্থা হয়ত ২০ আর ৩০ জন করতে পারে এমন কাজের বরাত দিল। অতএব ৫০ জন কর্মীর দ্বারা সংস্থা আবার আয় করতে শুরু করল। মুশকিল হল অবশিষ্ট ৫০ জনের। ভারতীয় সংস্থাগুলি মোটামুটি ১৫ থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত এরকম কর্মীকে রাখে, এর মধ্যে যারা অন্য কোন বিলেবল প্রোজেক্টে ঢুকে যেতে পারে তারা বেঁচে গেল সেযাত্রা। বাকীদের ওই মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন কয়েক আগেই ছাঁটাই তালিকায় নাম চলে যায়। আরো একটা পদ্ধতিতে এই তালিকায় নাম আসে। সেটা হয় সংস্থাগুলোর বাৎসরিক কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের প্রক্রিয়াটি শেষ হবার পর। এই তালিকায় দক্ষতা অনুযায়ী নীচের দিকে থাকা ৫ শতাংশ কর্মীর নাম ওঠে ছাঁটাইয়ের জন্য নির্ধারিত তালিকায়। তবে কিছুদিন যাবৎ প্রচন্ড সমালোচনার কারণেই হোক বা যেসব সংস্থা সরাসরি ছাঁটাই করে দেয় তাদের বিদেশে কাজের বরাত পেতে কিছু বদনামের জন্য অসুবিধে হবার কারণেই হোক, এই তালিকার কর্মীদের সামনে একটা ৩ থেকে ৬ মাসে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা পেশ করে সংস্থার মানবসম্পদের জন্য ভারপ্রাপ্ত দপ্তর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পরিকল্পনা আসলে কর্মীদের কোথাও পৌঁছে দেয় না, তবে এর মধ্যে অন্য সংস্থায় পেয়ে গেলে নির্বিঘ্নে পদত্যাগের একটা উপায় হয়। এইবার যে কর্মীর নিজ দক্ষতা উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট তারিখ যেমন শেষ হয় অমনি তাদের ডেকে ছাঁটাই করা হয়।
বলছি বটে ‘ছাঁটাই’ কিন্তু আসলে যেটা হয়, মানবসম্পদ দপ্তর কর্মীকে ডেকে একটা ছাপা পদত্যাগপত্র দিয়ে সে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছে ব্যক্তিগত কারণে, এই মর্মে সই করে দিতে বলে, যেমন প্রতীককে বলেছিল। কেউ ‘স্বেচ্ছায়’ সই করতে না চাইলে তাকে প্রথমে নানারকম ভয় দেখানো হয়। যথা সংস্থা ওই কর্মীকে তাদের কাছে কাজ করার শংসাপত্র দেবে না, অথবা দিলেও তাতে তার সম্পর্কে ‘সমস্যা সৃষ্টিকারী’ বলা থাকবে, কিংবা পরবর্তী যে সংস্থায় এই কর্মী যোগ দিতে যাবে, সেখান থেকে জানতে চাইলে এর সম্পর্কে বলা হবে ‘অদক্ষ এবং নতুন কিছু শিখতে অক্ষম’ ইত্যাদি। শতকরা ৯৯ জন এটুকু শুনেই ‘স্বেচ্ছায়’ সই করে দেয়। বাকী একজন যদি আইনী লড়াই করার কথা ভাবে, তাহলে তাকে বোঝাবার জন্য ওই প্রতীকের ঘটনার মত একজন অ্যাডভোকেট আগে থেকেই পাশের ঘরে মজুত থাকে, ভারতীয় আইনব্যবস্থার অতি দীর্ঘসুত্রীতা ব্যাখ্যা করা হয়ে গেলেই ওই অবশিষ্ট জনও ‘স্বেচ্ছায়’ই সই করে দেন। এই ছাঁটাইয়ের সময় সাধারণত দুই বা তিনমাসের মূল বেতন (বেসিক স্যালারি) আর ভ্রমণভাতা বা অন্যান্য যে সব ভাতা রসিদ দেখিয়ে আয়কর ছাড় পাওয়া যায়, সেইগুলির ছাঁটাইয়ের তারিখ পর্যন্ত পুঞ্জীভুত অংশ দেওয়া হয়। সবমিলিয়ে হয়ত দুইমাস কি তিনমাস চলে যাবে যদি বড়সড় ঋণ না থাকে। কিন্তু তারমধ্যে অন্য চাকরি পাওয়া যাবেই কিনা তা তো আর কেউ জানে না। আর যে বিষয়টা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যদি কর্মী নিজে পদত্যাগ করে, অদিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে চুক্তিপত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় (২ মাস বা ৩ মাস) কাজ করতেই হয় ছাড়া পাবার আগে। কিন্তু সংস্থা যখন ছাঁটাই করে তখন সেইদিন থেকেই করে আর পাওনাগন্ডার কথা তো বললামই।
ছোট ছোট শহর, টাউনশিপ বা গ্রাম থেকে আসা বহু বান্টি ও বাবলিদের জন্য গত শতাব্দীর শেষ দেড়খানা দশকে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্র ছিল স্বপ্নের চাকরি। একদিকে প্রকৌশলবিদ্যার প্রচলিত ধারাগুলোতে চাকরির সংখ্যা কমছে অন্যদিকে Y2K নামক দৈত্যের থাবা এড়াতে অজস্র ছোটবড় কোম্পানি মোটামুটি ইংরিজি পড়তে লিখতে পারা স্নাতকদের নিয়োগ করছে তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে। এর সাথে একটু বলিয়ে কইয়ে হলে 'অনসাইট' অর্থাৎ আমেরিকা কিম্বা ইউরোপের কোথাও গিয়ে কিছুদিন থেকে কাজ করে আসার সুযোগও মিলে যাচ্ছে। ওয়াইটুকে পরবর্তী চাকরি সংকোচন কিছু হলেও ৯/১১ ও তৎপরবর্তী ধ্বস প্রথম দুঃস্বপ্ন দেখায়। সেইসময় যারা গণহারে ছাঁটাই হয়েছিল এই লেখক তাদের মধ্যে একজন। সেই সময় আমিসহ আমার চেনাজানা সকলেই দেড় থেকে দুইমাসের মধ্যেই অন্য কোন সংস্থায় পেয়ে যায়। এরপরে ২০০৮-০৯এ আরো একবার বড়সড় মন্দা আসে, কিন্তু সেবার ভারত সামলে যায় তৎকালীন অর্থনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রীর দক্ষতায়। আউটসোর্সিং বাড়ে, তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে নানা নতুন টেকনলজি আসে ও নতুন কাজের সৃষ্টি হয়। ফলে ভয়ানক মন্দা বেশীদিন চলে নি, তথ্যপ্রযুক্তিকর্মীরা মোটামুটি সামলে নিয়েছিল। এবার পরিস্থিতি এতই অনিশ্চিত যে আদৌ কবে সামলে ওঠা যাবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যপকহারে ছাঁটাই হওয়ায় এর প্রভাব সহায়ক কর্মক্ষেত্রগুলিতেও পড়েছে। ফলে এক কর্মীর চাকরি গেলে সাথে আরো বেশ কয়েকটি পরিবার বিপাকের মুখে পড়ে যাচ্ছে। লক ডাউনের আগে এই সংস্থাগুলিতে চব্বিশঘন্টাই কাজ চলত। সুতরাং চব্বিশঘন্টার জন্যই সুরক্ষাকর্মী, সাফাইকর্মী, খাদ্য সরাবরাহের সাথে যুক্ত কর্মী, বিদ্যুৎ ও শীতাতপযন্ত্র, বেচকল(ভেন্ডিং মেশিন) ইত্যাদি চালু রাখার জন্য কর্মী লাগত। রাত দশটা থেকে ভোর ছয়টা কি সাতটা অবধি দিনের তুলনায় অনেক কম সহায়ক কর্মী লাগলেও মোট সংখ্যার এক চতুর্থাংশ সহায়ক লাগতই। এছাড়াও রাতের জন্য গাড়ি ও তার চালক এবং মহিলাকর্মীদের বাড়ি পৌঁছানোর জন্য প্রতি গাড়িতে অতিরিক্ত একজন সুরক্ষাকর্মীও লাগত। লক ডাউন শুরু হওয়ার পর প্রথমেই কোপ পড়ে এই রাতের সহায়ক কর্মীদের উপর। সহায়ক কর্মীরা প্রায় কেউই কোন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার স্থায়ীকর্মী নন। এঁরা আসেন অন্য কোন ছোট ঠিকাদারি সংস্থা থেকে। এঁদের বেতন অত্যন্ত কম থাকে এবং স্বাস্থ্যবীমা ইত্যাদি অনেকসময়ই থাকে না। ফলে মাসের পর মাস বসে খাবার মত সঞ্চয়ও খুব কিছু থাকে না। তা মার্চে এঁদের জানানো হয়েছিল আপাতত এঁদের দরকার নেই, যেহেতু কাজ স্থগিত। লক ডাউন উঠলে তাঁরা আবার আসবেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি দিনেদিনে ঘোরালো হয়েছে, মহারাষ্ট্র দীর্ঘকাল করোনা সংক্রমণে ভারতে সবার আগে। ফলে লক ডাউন ও কার্ফিউয়ের সময় যত বেড়েছে এঁদের কাজে ফেরার সম্ভাবনা ততই কমেছে।
ইতিমধ্যে প্রযুক্তি সংস্থাগুলি দেখেছে প্রায় নব্বই শতাংশ কর্মী বাড়ি থেকে কাজ করা সত্ত্বেও কর্মদক্ষতা বেড়েছে, কাজের পরিমাণ বেড়েছে। ফলে কর্মীরা বাড়ি থেকে কাজ করলে প্রোডাক্টিভিটি কমে যাবে বলে যে আশঙ্কা ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তিমহলে বরাবর ছিল, তা অমূলক প্রমাণ হয়েছে। এখন পঁচিশ বা পঞ্চাশ শতাংশ কর্মীকে বাড়ি থেকে কাজ করার প্রস্তাব দেবার কথা বেশ কিছু সংস্থা ভাবছে। এতে অবকাঠামোর জন্য খরচের পরিমাণ কমবে এবং সংস্থাগুলির লাভের সূচক বাড়বে। কাজেই জুলাই আগস্ট নাগাদ ওই সহায়ক কর্মীদের জানানো হয়েছে তাদের আর প্রয়োজন নেই। যেহেতু এটা একটা বা দুটো সংস্থার ব্যপার নয় সমগ্র তথ্যপ্রযুক্তি মহলেরই চিত্র, ফলে এই সহায়ক কর্মীদের নিয়োগ করার মত সংস্থা প্রায় নেইই। আবার যাঁরা ছাঁটাই হচ্ছেন তাঁরা স্বভাবতই খরচ কমাতে কাজের লোক, গাড়ির চালক, সন্তানের গৃহশিক্ষক ছাড়িয়ে দিচ্ছেন, পাড়ার মোড়ের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনা বন্ধ করে দিচ্ছেন যা আগে প্রায় রোজ আনতেন। ফলে এই পরিবারগুলিও রোজগার হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছে। উষা মাত্রে, ষাটোর্ধ ভদ্রমহিলা সপ্তম শ্রেনী পর্যন্ত শিশুদের ইংরিজি, হিন্দি, মারাঠি ও অংক পড়ান। এইই তাঁর জীবিকা। আমাদের আবাসনে মূলত বাবা মা দুজনেই তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে চাকরি করেন এমন বাচ্চারাই তাঁর ছাত্রছাত্রী। চেষ্টাচরিত্র করে মোবাইলে অনলাইন ক্লাস নেওয়া রপ্ত করেছেন। কিন্তু এখন বাবা মা’রা বাড়ি থেকেই কাজ করছেন এবং অনেকেরই বেতনও কমেছে, ফলে তাঁরা আর উষার কাছে পড়াবেন না জানিয়েছেন। উষা এখন চেষ্টা করছেন জামাকাপড় অলটার, পর্দা সেলাই ইত্যাদি করে যদি কিছু রোজগার হয়। কিন্তু এই সময় সেসব কাজও একেবারেই নেই।
সবমিলিয়ে অসম্ভব দমবন্ধ অবস্থা। স্বপ্নের চাকরি আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত। হয়ত এই বাড়ি থেকে কাজ করার সুবিধে একটা অন্যরকম কর্মসংস্কৃতির জন্ম দেবে। হয়ত মেয়েদের কাজ ছেড়ে দেবার প্রবণতা কমে আসবে। কিন্তু এ সবই ভবিষ্যতের কথা। আপাতত খাদের কিনারায় দাঁড়ানো পরিবারগুলোর বিবর্ণ মুখ ঘষাকাচের মত চোখ ঘুমের মধ্যেও তাড়া করে ফিরছে।
# লেখায় ব্যবহৃত ঘটনাগুলো সত্য, নামধাম পরিবর্তিত।
এটি লেখাটির সম্পাদিত রূপ। সম্পাদনার ব্যাপারটি যোগাযোগের গোলযোগের কারণে লেখককে জানানো যায়নি। তাই অসম্পাদিত লেখাটিও রইল এখানে।
জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রতীক সান্যাল তার সংস্থার মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের এক কর্মীর কাছ থেকে একটি এসএমএস পেলেন। এসএমএসে লেখা ছিল পর দিন তাঁকে ল্যাপটপ, হেডফোন, আরএসএ টোকেন ইত্যাদি সংস্থাপ্রদত্ত যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে অফিসে যেতে হবে। তাতে আরো লেখা ছিল, কিছু সরঞ্জাম সুরক্ষাবিধির মানের নির্দিষ্ট মাপকাঠির তুলনায় কম হওয়ায় সেগুলি পরীক্ষা করে দেখা হবে কী করা যায়।
প্রতীক পর দিন দুপুরে অফিস পৌঁছানো মাত্র তাঁর তাপমাত্র পরীক্ষা ও মোবাইলে আরোগ্য সেতু পরীক্ষা করা হয়। এক সুরক্ষাকর্মী তাঁর সঙ্গ নিয়ে গাড়িতে চেপে বসেন। প্রতীককে মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের একটি ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে মোবাইল ফোন অফ করিয়ে তবে তিনি সেখান থেকে যান। এরপরে সিস্টেম সাপোর্টের লোক এসে তাঁর ল্যাপটপসহ যাবতীয় জিনিস পরীক্ষা করার নামে চেয়ে নিয়ে যাবার পর তাঁকে আরেকটি ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেই ঘরে দুজন উপস্থিত ছিলেন। প্রতীককে একটি সংক্ষিপ্ত চিঠি ধরিয়ে তাতে সই করে দিতে বলা হয়। চিঠিতে লেখা আছে ‘ব্যক্তিগত কারণে প্রতীক সান্যাল আজ এই মুহূর্তে এই সংস্থা থেকে পদত্যাগ করছে’। প্রতীকের বিভ্রান্ত মুখ দেখে উপস্থিত দুজনের একজন বলেন, কোভিডজনিত কারণে সংস্থার ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় তাঁরা প্রতীককে আর রাখতে পারছেন না। তিনি যেহেতু গত ৪৫ দিন ধরে কোন প্রজেক্টে নেই, বেঞ্চে রয়েছেন, ফলে তাঁর বেতন সংস্থার জন্য অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় তাঁদের কাছে উপায়ান্তর নেই।
আরও পড়ুন, অতিমারীর মার এবং গৃহপরিচারিকারা
বাণিজ্যশাখার স্নাতক প্রতীক তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে চাকরি করছিলেন ষোল বছর। সাধারণ প্রোগ্রামার থেকে প্রজেক্ট ম্যানেজার হয়ে উঠতে বেতনও বেড়েছে আশানুরূপভাবেই। মে মাস নাগাদ প্রতীকের রিপোর্টিং ম্যানেজার প্রতীককে ডেকে বলেন, আপাতত ওঁকে আর এই প্রজেক্টে দরকার হচ্ছে না। ক্লায়েন্ট জানিয়েছেন কোভিডজনিত কারণে ব্যবসা মার খাওয়ায় ৩০ শতাংশ লোক কমাতে, কাজেই ওঁকে আর দশদিন বাদে এই কাজ থেকে মুক্ত করে দেওয়া হবে, তিনি সংস্থারই অন্যান্য প্রজেক্টে খোঁজা শুরু করে দিতে পারেন।
ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির বৃহদংশই পরিষেবাক্ষেত্রে কাজ করে থাকে। বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক সংস্থা, বিমান পরিষেবাদানকারী সংস্থা, টেলিফোন, ইন্টারনেট প্রদানকারী সংস্থার জন্য প্রয়োজনীয় নতুন সফটওয়্যার বানানো ও চালু সফটওয়্যারগুলোকে ঠিকঠাক বজায় রাখা, গ্রাহক পরিষেবাকেন্দ্রগুলো চালু রাখা এগুলোই মূল কাজ। এইসব পরিষেবার কাজগুলি বরাদ্দ করে যেসব ক্লায়েন্ট সংস্থা, তাদের কাজের পরিমাণ ও ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজেক্টে ভাগ করা হয়। ভারতীয় সংস্থা সেইসব প্রজেক্টের প্রয়োজন অনুযায়ী কর্মী নিযুক্ত করে। একটা প্রজেক্ট কর্মী কমালে বা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলেও সংস্থার অন্যান্য প্রজেক্টে নিযুক্ত হয়ে যাবার সুযোগ থাকে। ফলে প্রতীক সেসময় খুব একটা চিন্তিত হন নি। এছাড়া কাজের বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কিছু পেশাদার সংস্থা থেকে শংসাপত্রও নেওয়া আছে ওঁর। মে’র মাঝামাঝি থেকে তিনি নিজের সংস্থার ভেতরে ও বাইরে অন্যান্য সংস্থায়ও খোঁজ শুরু করেন। নিজের সংস্থায় দু-একটি অন্য প্রজেক্টে কথাবার্তা হয়েও যায়। কিন্তু দুনিয়া জুড়েই কোভিড পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকায় সমস্ত ক্লায়েন্টই আপাতত কর্মীসংখ্যা বাড়ানো স্থগিত রাখে। এই করেই পেরিয়ে যায় ৪৫ দিন। এই ৪৫ দিন প্রতীক ছিলেন ‘নন বিলেবল’ অর্থাৎ প্রতীকের কাজ ও দক্ষতা বিক্রি করে তাঁর সংস্থা কিছু আয় করতে পারে নি। মজা হল এই ৪৫ দিনের মধ্যে প্রতীক যতবারই মানবসম্পদ উন্নয়নের কোন না কোন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে, প্রত্যেকবারই তাঁরা আশ্বস্ত করেছেন ওঁর ভয় পাওয়ার কিছু নেই, চাকরি যাবে না। পরের ত্রৈমাসিকের মধ্যেই প্রজেক্ট পেয়ে যাবে।
পড়ুন: লকডাউনে ব্যতিক্রমী হকারটাউনে
ওই ঠান্ডা ঘরে প্রাথমিক বিস্ময় ও বিভ্রান্তি কাটিয়ে ‘স্বেচ্ছায়’ সই করতে অস্বীকার করেছিলেন প্রতীক, বলেছিলেন সংস্থার যেহেতু আয় কমে গেছে, তারা সেই কারণ দেখিয়ে ওঁকে বরখাস্ত করুক। ঘরের দ্বিতীয় ব্যক্তি অত্যন্ত অন্তরঙ্গ সুরে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করেন বরখাস্ত হলে প্রতীকের লাভটা ঠিক কী? প্রতীক জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, এই সংকটজনক মুহূর্তে কাউকে ছাঁটাই না করতে, কাজেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে বিষয়টি জানাবেন, জানাবেন শ্রমদপ্তরকে, আদালতের দ্বারস্থ হবেন। এই সময়ে পাশের ঘর থেকে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এসে ঢোকেন, ইনি এতক্ষণ কানে হেডফোন দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলেন। প্রতীক খেয়াল করে এঁর গলায় ঝোলানো ভিজিটরস আইডি। অর্থাৎ ইনি এই সংস্থার লোক নন। তিনি নিজের পরিচয় দেন অ্যাডভোকেট রাঠোর বলে, প্রতীককে বলেন প্রধানমন্ত্রী ‘অনুরোধ’ করেছেন, আপনার সংস্থা এতদিন তাঁর অনুরোধ রেখেই এসেছেন কিন্তু আর তা সম্ভব নয়। এসব বলার সময়ে তাঁর ঠোঁটে ঝুলছিল স্মিত হাসি। শান্তভাবে তিনি বোঝান মামলা করলে অন্তত সাড়ে তিন থেকে চার বছর লাগবে ফয়সলা হতে। সংস্থার প্রতিনিধি অধিকাংশ সময় আদালতে উপস্থিতই হবেন না, তাঁদের আইনজীবী তারিখের পর তারিখ নিয়ে মামলার গতি কমিয়ে দেবেন। আর এই সময় জুড়ে প্রতি বারের উপস্থিতির জন্য প্রতীককে তার তরফের আইনজীবিকে খুব সস্তা হলেও অন্তত কুড়িহাজার টাকা করে দিতে হবে। সর্বোপরি এই সংস্থা ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ না দেওয়ায় প্রতীক অন্য কোন সংস্থায় সম্ভবত যোগ দিতে পারবেন না। তবে প্রতীক যদি শেষপর্যন্ত মামলা চালিয়ে যান তাহলে তিনিই জিতবেন। কারণ সমজাতীয় যে কটি মামলাই হয়েছে তাতে সংস্থা হেরেছে।
এরপর বেতননির্ভর নিরুপায় প্রতীক স্বেচ্ছায় চাকরি ত্যাগের চিঠিতে সই করে দেন।
সেই দিনে ওই সংস্থাটি গোটা ভারতজুড়ে তাদের সবকটি শাখার মোট দুশোজনকে ছাঁটাই করে। এই সংস্থাটি ২০-২১ আর্থিকবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ লাভ দেখিয়েছে।
খাপ বললে কিছু বছর আগে কলম বা তলোয়ারের অনুষঙ্গ আসত। এখন অবশ্য ফেসবুক, কিংবা হরিয়ানা। খুব জোর যোগেন্দ্র যাদব কী বলেছিলেন বা রায়া সরকার! সিরিয়াস৯-র পরের সংখ্যা খাপ নিয়ে। লিখছেন তাতিন বিশ্বাস, বল্লরী সেন, প্রতীক, শাশ্বতী দত্তরায়, অভিজ্ঞান সরকার। খাপ এড়াবেন না।
এ তো গেল একটামাত্র সংস্থার কথা। এরকম অন্যান্য তথ্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলিও সমানে ধীর কিন্তু নিশ্চিতভাবে ছাঁটাই করে চলেছে। ২৮ অগাস্ট প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন কোভিডজনিত মন্দায় তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে মোটামুটি ৫ শতাংশ মানুষ ছাঁটাই হবেন। সংখ্যার হিসেবে প্রায় দুই লাখ মানুষ। তাঁদের পরিবার, গাড়িচালক, গৃহকর্মসহায়িকাদের ধরলে খুব কম করে কুড়িলক্ষ মানুষ সরাসরি প্রভাবিত হবেন। মোটামুটি এপ্রিল-মে নাগাদই বহু সংস্থা কর্মীদের বেতনের একটা অংশ কমানো, দক্ষতাজনিত বোনাস স্থগিত রাখা, বেতনের পরিবর্তনশীল অংশটি ফ্রিজ করে দেওয়া ইত্যাদি পদক্ষেপ নিয়েইছে, যার কোনওটাতেই কর্মীদের কোনও মতামত গ্রাহ্য করা হয় নি। নতুন নিয়োগও প্রায় বন্ধই। অনেক সংস্থা ইন্টারভিউ নিয়ে তারপর আপাতত এই ত্রৈমাসিকে নিয়োগ বন্ধ বলে স্থগিত রাখছে। সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি নামক এক নিরপেক্ষ সংস্থার সমীক্ষা ও বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে ভারতে এক কোটি আশি লক্ষের বেশি বেতনভুক মানুষ কাজ খুইয়েছেন। এর কত শতাংশ তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রের তার হিসেব সুস্পষ্টভাবে জানা নেই, তবে সেটা নেহাৎ কমও হবে না। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যপার হল ব্যবসা কমে যাওয়ার অজুহাতে ছাঁটাই করা অনেক সংস্থাই এই ত্রৈমাসিকে কিছু না কিছু লাভ দেখিয়েছে। হয়ত তা খানিক কম কিন্তু বড়সড় ক্ষতি নয় কোনওভাবেই। এই মানুষগুলোকে চাকরিতে বহাল রাখলে তাদের ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যেত এমন নয়।
আরও পড়ুন, উন্নয়নের ভুগোল ও করোনা সংক্রমণ
ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে ছাঁটাই একটা মাসিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই ২০১৪-১৫ থেকেই। এর আগে ছাঁটাই হত খানিকটা ঘটনা ও তার প্রভাব নির্ভর। যেমন ৯/১১র পরবর্তী ধস, লেম্যান ব্রাদার্সের ধস ইত্যাদি। এতদিন সংস্থাগুলোর বেশিরভাগই বলে আসছিল যে এ হল অদক্ষ কর্মীদের সরিয়ে দেবার বাৎসরিক ঘটনা, অদক্ষ কর্মীদের নিয়ে চলা আজকের এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে একেবারেই সম্ভব নয়। প্রশ্ন হল যে বাৎসরিক ঘটনা হলে প্রায় প্রতিমাসেই কিছু কিছু ছাঁটাই হয় কেন? কারণ এই তথাকথিত দক্ষ বা অদক্ষ কর্মী নির্ধারিত হয় কর্মীটি কতটা বিক্রয়যোগ্য তার উপর। কর্মীর প্রতিদিনের কাজের আটঘন্টার জন্য যদি অন্য কোনও সংস্থার থেকে নিয়োগকারী সংস্থা আয় করতে সমর্থ হয় তবে কর্মী হয় ‘বিলেবল রিসোর্স’ আর এই মূল্যের পরিমাণের উপরই নির্ভর করে সংস্থা কর্মীকে রাখতে ইচ্ছুক না ছেড়ে দিতে। এবার বিবিধ কারণে অনেকসময় বিভিন্ন সংস্থা এই কাজের বরাতগুলো হারায় আবার বিভিন্ন নতুন কাজের বরাত পায়ও। তো বরাত হারাবার পরিমাণ বেশি হলে বেশ কিছু কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়। এর বেশ চমৎকার গালভরা নামও আছে, বিজনেস র্যাশনালাইজেশান।
ধরা যাক এরকম একটি কাজের বরাতে (প্রজেক্টে) ১৫০ জন কর্মী কাজ করেন, যে সংস্থা বরাত দিয়েছিল তারা হয়ত তাদের ব্যবসায় মন্দার জন্য বা এই সংস্থার কাজ পছন্দ না হওয়ার জন্য এই কর্মীসংখ্যা সংকোচন করে ৫০ জনে নামিয়ে আনল। সেক্ষেত্রে ১০০ জন কর্মীর জন্য নিয়োগকারী সংস্থা কোন আয় করতে পারছে না। ওদিকে আরো দুটি সংস্থা হয়ত ২০ আর ৩০ জন করতে পারে এমন কাজের বরাত দিল। অতএব ৫০ জন কর্মীর দ্বারা সংস্থা আবার আয় করতে শুরু করল। মুশকিল হল অবশিষ্ট ৫০ জনের। ভারতীয় সংস্থাগুলি মোটামুটি ১৫ থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত এরকম কর্মীকে রাখে, এর মধ্যে যারা অন্য কোন বিলেবল প্রজেক্টে ঢুকে যেতে পারে তারা সে যাত্রা বেঁচে গেল। বাকিদের ওই মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন কয়েক আগেই ছাঁটাই তালিকায় নাম চলে যায়। আরও একটা পদ্ধতিতে এই তালিকায় নাম আসে। সেটা হয় সংস্থাগুলোর বাৎসরিক কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের প্রক্রিয়াটি শেষ হবার পর। এই তালিকায় দক্ষতা অনুযায়ী নিচের দিকে থাকা ৫ শতাংশ কর্মীর নাম ওঠে ছাঁটাইয়ের জন্য নির্ধারিত তালিকায়। তবে কিছুদিন যাবৎ প্রচন্ড সমালোচনার কারণেই হোক বা যেসব সংস্থা সরাসরি ছাঁটাই করে দেয় তাদের বিদেশে কাজের বরাত পেতে কিছু বদনামের জন্য অসুবিধে হবার কারণেই হোক, এই তালিকার কর্মীদের সামনে একটা ৩ থেকে ৬ মাসে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা পেশ করে সংস্থার মানবসম্পদের জন্য ভারপ্রাপ্ত দপ্তর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পরিকল্পনা আসলে কর্মীদের কোথাও পৌঁছে দেয় না, তবে এর মধ্যে কেউ অন্য সংস্থায় কাজ পেয়ে গেলে নির্বিঘ্নে পদত্যাগের একটা উপায় হয়। এইবার যে কর্মীর নিজ দক্ষতা উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট তারিখ যেমন শেষ হয় অমনি তাদের ডেকে ছাঁটাই করা হয়।
এই ছাঁটাইয়ের সময়ে সাধারণত দুই বা তিনমাসের মূল বেতন (বেসিক স্যালারি) আর ভ্রমণভাতা বা অন্যান্য যে সব ভাতা রসিদ দেখিয়ে আয়কর ছাড় পাওয়া যায়, সেইগুলির ছাঁটাইয়ের তারিখ পর্যন্ত পুঞ্জীভুত অংশ দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে বড়সড় ঋণ না থাকলে হয়ত তাতে চলে যাবে দুইমাস কি তিনমাস। কিন্তু তার মধ্যে অন্য চাকরি পাওয়া যাবেই কিনা তা তো আর কেউ জানে না। আর যে বিষয়টা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যদি কর্মী নিজে পদত্যাগ করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে চুক্তিপত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় (২ মাস বা ৩ মাস) কাজ করতেই হয় ছাড়া পাবার আগে। কিন্তু সংস্থা যখন ছাঁটাই করে তখন তা সেইদিন থেকেই কার্যকর।
ছোট ছোট শহর, টাউনশিপ বা গ্রাম থেকে আসা বহু বান্টি ও বাবলিদের জন্য গত শতাব্দীর শেষ দেড়খানা দশকে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্র ছিল স্বপ্নের চাকরি। একদিকে প্রকৌশলবিদ্যার প্রচলিত ধারাগুলোতে চাকরির সংখ্যা কমছে অন্যদিকে Y2K নামক দৈত্যের থাবা এড়াতে অজস্র ছোটবড় কোম্পানি মোটামুটি ইংরিজি পড়তে লিখতে পারা স্নাতকদের নিয়োগ করছে তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে। একটু বলিয়ে কইয়ে হলে 'অনসাইট' অর্থাৎ আমেরিকা কিম্বা ইউরোপের কোথাও গিয়ে কিছুদিন থেকে কাজ করে আসার সুযোগও মিলে যাচ্ছে। ওয়াইটুকে পরবর্তী চাকরি সংকোচন কিছু হলেও ৯/১১ ও তৎপরবর্তী ধস প্রথম দুঃস্বপ্ন দেখায়। সেইসময় যারা গণহারে ছাঁটাই হয়েছিল এই ভাষ্যকার তাঁদেরই একজন। সেই সময় আমিসহ আমার চেনাজানা সকলেই দেড় থেকে দুইমাসের মধ্যেই অন্য কোন সংস্থায় পেয়ে যায়। এরপরে ২০০৮-০৯এ আরো একবার বড়সড় মন্দা আসে, কিন্তু সেবার ভারত সামলে যায় তৎকালীন অর্থনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রীর দক্ষতায়। আউটসোর্সিং বাড়ে, তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে নানা নতুন টেকনোলজি আসে ও নতুন কাজের সৃষ্টি হয়। ফলে ভয়ানক মন্দা বেশিদিন চলে নি, তথ্যপ্রযুক্তিকর্মীরা মোটামুটি সামলে নিয়েছিল। এবার পরিস্থিতি এতই অনিশ্চিত যে আদৌ কবে সামলে ওঠা যাবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
একসময়ের স্বপ্নের চাকরি আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত। হয়ত এই বাড়ি থেকে কাজ করার সুবিধে একটা অন্যরকম কর্মসংস্কৃতির জন্ম দেবে। হয়ত মেয়েদের কাজ ছেড়ে দেবার প্রবণতা কমে আসবে। কিন্তু এ সবই ভবিষ্যতের কথা। আপাতত খাদের কিনারায় দাঁড়ানো পরিবারগুলোর বিবর্ণ মুখ ঘষা কাচের মত চোখ ঘুমের মধ্যেও তাড়া করে ফিরছে।
স্বাতী রায়ের সংগে পূর্ণ সহমত। এই অতি কৃত্রিম প্রগতি কখনোই দীর্ঘস্হায়ী হতে পারে না। ১৯৯০ এর পর বিশ্বজোড়া গ্রামের নাগরিক হয়ে আমরা হঠাৎ ফুলে ফেঁপে উঠেছি। তার প্রভাব সামাজিক স্তরেও ব্যাপক। অর্ধেক ডিমের ডালনা দিয়ে ভাত খাওয়া আমরা কত কিছু আরাম আয়াশই না করতে শিখেছি। সবই মাত্র তিরিশ বছরে।
ভারতবর্ষ কোনদিনই manufacturing এ জোর দেয় নি, করেছে Service sector led growth. আর ব্যবসা। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে ভারতবর্ষ মূলত বণিক জাতি, আমাদের শিল্প গড়ে ওঠার ভিত্তি caste based capitalism. তাই কোন মজবুত ভিত না থাকলে, পায়ে জোর না থাকলে মুখ থুবড়ে তো পড়তে হবেই কোন না কোনদিন।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি, ভয়ানক বিপন্নতা। আমরা সবাই ভীত, চিন্তিত। আত্মসমীক্ষার অধিকারে এ কথাগুলো লিখলাম।
স্বাতী রায়ের বক্তব্যের সহমতে দু'একটা কথা যোগ করছি। আইটি সেক্টারে কাজ করা প্রযুক্তিবিদরা দু প্রকার। বেশির ভাগ কর্মী চাকরির শুরুর কয়েক বছর পর থেকে নতুন কিছু শেখার আগ্রহ ফেলেন। অথচ, এই ক্ষেত্রে প্রত্যেক দিনই প্রযুক্তি পালটে যাচ্ছে। এটা লাইফ লং লার্নিং-এর ক্ষেত্র যদি না আপনি এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়ে থাকেন যেখানে মূল কাজটাই ম্যানেজমেন্ট ধাঁচের। সেখানেও নতুন টেকনোলজিকে বোঝার জায়গাটা থেকেই যায়। থেকে যায় নোতুন নোতুন ব্যবসার জায়গাকে বোঝার জন্য পরিশ্রম করে যাওয়া্র মানসিকতা। কোভিডের মতো পরিস্থিতিতে যারা নিয়মিতভাবে নিজেদের আপগ্রেড করতে পারেননি, তারা পরেছেন সবচেয়ে বিপদে। এদের সমস্যা হলো, এরা কোম্পানির কাছে এমনিতেই বাড়তি ছিলেন, কোভিডের পরিস্থিতিতে যেই কোম্পানির ওপর চাপ এসেছে, এরা চাকরি হারিয়েছেন। অন্যদিকে, যারা ওয়্যারলেস্ নেটওয়ার্কিং, এম্বেডেড সিস্টেম, সাইবার সিকুউরিটি, ক্লাউড কম্পিউটিং জাতীয় নতুন টেকনোলজি শিখে নিতে পেরেছেন তারা বেঁচে গেছেন। গত কয়েক বছরে ভারতের বড় আইটি কোম্পানির মোট আয়ের ২৫-৩০ শতাংশ আসছে এই সব ব্যবসা থেকে। এদের চাহিদাও প্রচুর। কোম্পানিগুলো এদের হাতছাড়া করতে রাজি নয়।