দুরাত্মার যেমন ছলের অভাব হয় না, ছাঁটাইয়ের কারণেরও অভাব হয় না। সে কারণ কখনো অতিমারী, যা কোভিড-১৯ এর প্রভাবে এখন চলছে; আবার কখনও আর্থিক মন্দা, যেমনটা ২০০৮-০৯ এ হয়েছিল। কখনও শুধুই “লোক বেশি ছিল”। অনেক সময় আবার কারণ দর্শানোর দরকারই পড়ে না, কারণ খবরটা বিশেষ কারো চোখেই পড়ে না। যেমন এই মুহূর্তে বি এস এন এলের মত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় স্থায়ী, অস্থায়ী কর্মীদের স্রেফ খেদিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথচ তা নিয়ে কর্মী এবং কর্মী ইউনিয়ন ছাড়া বিশেষ কারো মাথাব্যথা নেই। কারণ সংবাদমাধ্যমগুলো ইদানীং মানুষের কাজ হারানোকে আর খবর বলে মনে করে না। পথ অবরোধ, হাতাহাতি বা তারও বেশি কিছু ঘটলে দু একদিন খবরের চ্যানেলে নিউজফ্ল্যাশ হিসাবে এসে পড়ে, বিয়েবাড়িতে ঢুকে পড়া বুভুক্ষু ভিখারির মত খবরের কাগজের ভিতরের পাতায় এক কোণে জায়গা হয়। সেটুকু জায়গাও অবশ্য ঘটনাটা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় হলে তবেই পাওয়া যায়। বেসরকারি সংস্থায় ছাঁটাই হওয়া পূর্ব দিকে সূর্য ওঠা আর পশ্চিমে অস্ত যাওয়ার মতই স্বাভাবিক ঘটনা।
আপনি যদি নাম করা কোম্পানির ভাল মাইনের কর্মচারী হন, তাহলে নিশ্চিত থাকতে পারেন আপনার কাজ হারানোটা খবর নয়। আপনাকে যখন সুললিত ভাষায় জানানো হবে কোম্পানির আর আপনাকে প্রয়োজন নেই, তখন চুপচাপ বাড়ি চলে আসা ছাড়া আপনার আর কিচ্ছু করার নেই। আপনার বা আপনাদের কথা কোথাও এক লাইন লেখা হবে না। আপনাদের কেউ যদি ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েন, একমাত্র তাহলেই টিভি চ্যানেলগুলো দৌড়ে আসতে পারে বা কাগজওয়ালারা আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। কোভিডের প্রতাপে কাজ হারিয়ে এই মুহূর্তে আপনারা কেউ যদি নিজের এবং পরিবারের তেমন সর্বনাশ করবেন বলে ভেবে থাকেন, তাহলে তাঁদের যন্ত্রণার উপশমের জন্য একটা খবর আছে। আপনারা যে তিমিরে, সাংবাদিকরাও সেই তিমিরে। সেই মার্চ মাসের শেষ থেকে এই আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সারা দেশে কয়েক হাজার সাংবাদিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। আপনি যতগুলো কাগজের নাম জানেন, যতগুলো খবরের চ্যানেলের হদিশ আপনার জানা আছে, তার প্রায় সবকটাই কিছু সাংবাদিককে ছাঁটাই করেছে, বাকিদের মাইনে কেটেছে নানা মাত্রায়। তাঁরা মুখ বুজে সহ্য করছেন, আপনিই বা করবেন না কেন?
অনেকদিন অনেক সংখ্যাতাত্ত্বিক চালাকি চলল। এখন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া নিজেই বলছে অর্থনীতির অবস্থা মোটেও ভাল নয়, জি ডি পি ঋণাত্মকও হয়ে যেতে পারে। প্রবাসী শ্রমিকদের আমরা মাইলের পর মাইল হাঁটতে হাঁটতে মরে যেতে দেখে ফেলেছি। সমস্ত ক্ষেত্রেই বহু মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। এমতাবস্থায় হাজার পাঁচেক সাংবাদিকের চাকরি যাওয়া নিয়ে আলাদা করে বলবার কী আছে। সংখ্যার বিচারে হয়ত নেই, কিন্তু সাংবাদিকদের যদি প্রেস্টিটিউট আর শকুন --- এই দুই স্টিরিওটাইপের বাইরে গিয়ে মানুষ বলে ভাবতে রাজি থাকেন, তাহলে সাংবাদিকদের কাজ হারানো আপনার কাজ হারানোর মতই বেদনাদায়ক। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এত সাংবাদিকের চাকরি যাওয়া এই দেশের গণ>তন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক দুঃসংবাদ। আর গণতন্ত্র বিপদে পড়া মানে শুধু আমার আপনার নয়, আমাদের সন্তানদেরও ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
পড়ুন: মহামারী আর লকডাউনে টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির হাল
আপনি বলবেন, কেন? সাংবাদিকদের চাকরি গেলে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে কেন? আসলে হবে নয়, গণতন্ত্র ইতিমধ্যেই বিপন্ন। সেই কারণেই সাংবাদিকরা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছেন, তাঁদের একটা বড় অংশকে বিদায় দেওয়া হচ্ছে। অনস্বীকার্য যে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমই এখন “কলের গান, কুকুর মাথা”, তাদের কিনেছে বিজ্ঞাপনদাতা। আর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনদাতা হল সরকার (কেন্দ্র এবং রাজ্য)। বিজ্ঞাপনদাতাদের চটানো চলে না, অথচ সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহ করতে দিলেই চটবার মত খবর এসে হাজির হবে। মালিকপক্ষ তা চান না। তাঁরা ব্যবসা করতে নেমেছেন, জনসেবা করতে নয়। আপনি যদি সংবাদমাধ্যমগুলোর বিজ্ঞাপনী স্লোগানে মোহিত হয়ে থাকেন, সে আপনার দোষ। আসলে কাগজ তা-ই লেখে যা তাকে লিখতে বলা হয়। সে কাজ করতে তো আর সাংবাদিক লাগে না। তাই সাংবাদিকরা এখন উদ্বৃত্ত। এর প্রভাব আপনার উপর কীভাবে পড়বে বুঝলেন তো? আপনার সুখ দুঃখ বিপদ আপদের খবর ক্রমশই বিরলতর হবে কাগজের পাতায় আর টিভির পর্দায়। পাড়াসুদ্ধ লোকের চাকরি চলে গেলেও, জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেলেও, করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যায় এবং মৃত্যুতে ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিলেও, কাগজ খুললে বা টিভি দেখলে মনে হবে অন্য দেশের খবর দেখছেন। কারণ সংবাদমাধ্যমগুলোকে তেমনটাই করতে বলা হয়েছে। কে বলেছে তা অনুমান করার জন্য স্বর্ণপদক চেয়ে বসবেন না যেন।
করোনার জন্য প্রায় সব পেশাতেই কর্মহানি হয়েছে প্রবল। বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ নিয়ে এ বিষয়ে দুটি সংখ্যা ভাবা হয়েছে। পরের সংখ্যায় থাকছে হকারদের নিয়ে বিশ্বেন্দু নন্দের, গৃহসহায়িকাদের নিয়ে মৌসুমী বিলকিসের প্রতিবেদন ও অর্থনীতির একটি মডেল নিয়ে অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ।
এত তেতো কথা পড়ে যে কেউ বলতেই পারেন, এ সমস্ত প্রোপাগান্ডা। সত্যিই তো অতিমারীর ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে, বেশিরভাগ ব্যবসা বাণিজ্যই ধুঁকছে। কাগজ বা চ্যানেলের মালিকরা কি পকেটের পয়সা দিয়ে ব্যবসা চালাবেন? তাঁদেরও নিশ্চয়ই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সে ক্ষতি পূরণ করতে কর্মী সঙ্কোচন ছাড়া পথ ছিল না।
আচ্ছা, তাহলে অতিমারী নিয়েই কথা হোক। ভারতে করোনার পদার্পণ যেদিনই ঘটে থাক, চার ঘন্টার নোটিশে দেশ জুড়ে লকডাউন চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত অর্থনীতির চাকা তো পুরো দমে ঘুরছিল। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত লকডাউন শুরু হয় ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে, তার আগে ২২শে মার্চ ছিল জনতা কারফিউ। পশ্চিমবঙ্গে লকডাউন শুরু হয়েছিল ২৩শে মার্চই; মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ুর মত কয়েকটা রাজ্যও দেশব্যাপী লকডাউনের কয়েকদিন আগে থেকেই লকডাউন ঘোষণা করে। অর্থাৎ অর্থনীতির চাকা ঘুরতে ঘুরতে একেবারে বন্ধ হয়ে যায় মার্চের শেষ সপ্তাহে। আচ্ছা আর্থিক বর্ষ শেষ হয় কত তারিখে? ৩১শে মার্চ। তাহলে কোভিড-১৯ এর প্রভাব ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে কদিন পড়েছে ভারতের সংবাদমাধ্যমের উপর? বড় জোর দশ দিন। এই দশ দিন এমনই কাঁপিয়ে দিল মহীরূহদের যে বাকি আর্থিক বর্ষের লাভ কমতে কমতে বিপুল ক্ষতিতে চলে গেল! তাই এপ্রিল-মে থেকেই মাইনে কাটা এবং ছাঁটাই শুরু করতে হল বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলোতে? এ যদি সত্য হয়, তাহলে পি সি সরকারের এখনই প্রকাশ্যে নাক খত দিয়ে বলা উচিৎ তাঁর বংশের কেউ আর কোনওদিন ম্যাজিক দেখাবে না।
পড়ুন, কেমন করে টিকে আছেন প্রাইভেট টিউটররা?
বলা যেতেই পারে যে এটা অতিসরলীকরণ হল। বিগত আর্থিক বর্ষের ক্ষতি নয়, এই বিপুল ছাঁটাই এবং মাইনে কাটার কারণ হল বর্তমান আর্থিক বর্ষের বিপুল ক্ষতির সম্ভাবনা। স্রেফ সম্ভাবনার কথা ভেবে মানুষের চাকরি খাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্ন তুলব না। কারণ কর্পোরেট দুনিয়া মানবিক যুক্তিতে চলে না, চলে লাভ ক্ষতির যুক্তিতে। সেখানে মানুষকে নিয়ে আলোচনা বামপন্থী সেন্টিমেন্টালিজম মাত্র। অন্য একটা প্রশ্ন আছে। কর্মীদের মাইনে দেওয়ার খরচ কমালে কতটা খরচ কমে? একটা উদাহরণই যথেষ্ট।
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে এক অতিকায় সর্বভারতীয় সংবাদপত্র তাদের উত্তর সম্পাদকীয় স্তম্ভে দাবি করেছিল কাগজ চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে। যা যা কারণ বলা হয়েছিল, তার মধ্যে একটা ছিল কর্মচারীদের মাইনে দিতে বিপুল খরচ। তার দুদিন পরেই দিল্লি ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্টস নামে সাংবাদিকদের এক সংগঠন পাবলিক রেকর্ড উদ্ধৃত করে বলেছিল, ঐ সংবাদপত্রের মোট আয়ের মাত্র ১১% খরচ হয় মাইনে দিতে। পরিসংখ্যানটা অবশ্য ২০১০-১১ আর্থিক বর্ষের। ধরা যাক সিংহহৃদয় মালিকপক্ষ এতদিনে সে খরচ দ্বিগুণ করে ফেলেছেন। তা এই বিপুল ক্ষতির মরসুমে কর্মী ছাঁটাই করে ঐ ২২% খরচের কতটা কমানো গেল? বাকি ৭৮% থেকে কিছু সাশ্রয় হল কি? এসব প্রশ্ন তুললেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ব্যবসার গোপনীয়তা, কোম্পানি আইনের রক্ষাকবচ ইত্যাদি প্রসঙ্গ এসে যাবে। কোভিডের ক্ষতিপূরণে শ্রম আইন এলেবেলে হয়ে গেছে, আট ঘন্টা কাজের অধিকারের মত ন্যূনতম অধিকারও সরকার ইচ্ছামত স্থগিত রাখছেন। কেউ কিন্তু কোম্পানি আইন দেশমাতৃকার স্বার্থে বলি দিতে রাজি নয়। তাই বলছি, কোভিড নেহাত অজুহাত। এই বিপুল ক্ষতি নিয়ে তিন দিন ব্যাপী অশ্রু বিসর্জন সভা প্রতি বছরের মত এ বছরেও কোন কোম্পানি মরিশাসে কেউ বা মারাকেশে করবেন, নিদেন মুম্বাইয়ের সেভেন স্টার হোটেলে। এদিকে কাজ হারানো সাংবাদিকরা গৃহঋণের ই এম আই দিতে না পেরে ব্যাঙ্কের রিকভারি এজেন্টদের থেকে পালিয়ে বেড়াবেন।
কেউ কেউ হয়ত অগত্যা ধনী রাজনৈতিক দলের টোপ গিলে প্রকাশ্যে বা কৌশলে প্রোপাগান্ডার কাজে লাগবেন। কিন্তু সে সুযোগই বা কজন পাবেন? পশ্চিমবঙ্গে তো এক লহমায় সংবাদমাধ্যমের অনেকের কাজ হারানো অনতি অতীতেই ঘটেছে, যখন সুদীপ্ত সেনের পুঁজিতে পুষ্ট খবরের কাগজ এবং টিভি চ্যানেলগুলো উঠে গেল। অনেকেই আর কাজ পাননি। বাধ্য হয়ে মুদির দোকান, স্টেশনারি দোকান খুলে বসেছেন, কোনও মতে দিন গুজরান হয় --- এমন মানুষও আছেন।
যাঁরা কোন পয়সাওয়ালা রাজনৈতিক দলের দাক্ষিণ্য পাবেন, তাঁরা যদি আপনার পছন্দের দলটির প্রোপাগান্ডা না করেন তাহলে বিলক্ষণ তেড়ে গাল দেবেন। কিন্তু, প্রিয় পাঠক, সাংবাদিকদের এই দুর্দশার কাহিনীতে আপনার ভাববার মত যে উপাদান আছে তা দয়া করে অগ্রাহ্য করবেন না। আজকাল সরকারী চাকরি অনেক কমে গেছে, বেশিরভাগ মানুষই কোন না কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী। অতএব কর্পোরেটের কর্মচারী সাংবাদিকদের সাথে বিশেষ অবস্থাভেদ নেই।
সাংবাদিকদের এমন অবস্থা হল কেন? যাঁরা অমিতশক্তিধর, সরকার গড়তে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন বলে জনশ্রুতি, তাঁদের কাতারে কাতারে চাকরি যাচ্ছে আর কেউ টুঁ শব্দটি করছে না --- এমন হল কেন? হল, কারণ নয়ের দশকে বিশ্বায়নের যুগে দিকপাল সাংবাদিকরা মালিকদের প্ররোচনায় রিমের পর রিম লিখে দেশসুদ্ধ লোককে বোঝালেন যে কর্মী ইউনিয়নের মত খারাপ জিনিস দুটি নেই। ওটি সর্বতোভাবে কর্মনাশা, শিল্পবিরোধী। এর ফলে সরকারি মদতে, মালিকদের ইচ্ছায় সব শিল্পেই ইউনিয়নগুলো দুর্বল হয়ে পড়ল, কোথাও নামমাত্রে পরিণত হল। সংবাদমাধ্যমে ইউনিয়ন কার্যত উঠে গেল। তারপর এল চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। দিকপালরা ভাবলেন তাঁরা ঐতিহাসিক কাজ করলেন। ঠিকই ভাবলেন। তবে ভেবেছিলেন পানিপথের যুদ্ধ জয় করলেন, আজকের সাংবাদিকরা বুঝছেন (বুঝছেন কি? কে জানে!) আসলে ওটা ছিল পলাশীর পরাজয়। হাতে যন্ত্রপাতির বদলে কলম (এ যুগে ল্যাপটপ) থাকে বলে সাংবাদিকরা ভেবেছিলেন তাঁরা শ্রমিক নন। তাই বুঝে উঠতে পারেননি চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে ঠিকা শ্রমিকের চেয়ে বেশি অধিকার দাবি করা যায় না। আর জোট বেঁধে দাবি পেশ করার অধিকার না থাকলে কোন অধিকারই থাকে না, মালিকের খেয়ালে চলতে হয়।
পড়ুন, বাংলাদেশের এক বন্ধ খাবারের দোকানের অন্দরের কথা
খেয়াল মানে খিদে, লাভের খিদে। বাঘের ক্ষুধামান্দ্য হতে পারে, কর্পোরেটের খিদে কখনও কমে না। এই একবিংশ শতকে লাভের নতুন সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে। কর্পোরেট বয়ানে লাভের মানে হল গত বছরের চেয়ে বেশি লাভ। সেই নতুন টার্গেটে না পৌঁছাতে না পারলেই কোম্পানির ক্ষতি হয়, আর তখনই কর্মী ঘচাং ফু। সাংবাদিকও তেমনই এক কর্মী, তার বেশি কিছু নয়। সেই কারণেই আগেকার সম্পাদকরা রাজনৈতিক গুন্ডার হাতে প্রতিবেদক নিগৃহীত হলে বুক দিয়ে আগলাতেন এবং প্রশাসনের বাপান্ত করতেন। এখন খবর পর্যন্ত ছাপেন না অনেক সময়, এফ আই আর ও করতে দেন না। উলটে শাসক দলকে কুপিত করার অপরাধে ঐ প্রতিবেদককে বরখাস্তও করতে পারেন।
তাই আজ সহকর্মী কাজ হারিয়ে গলায় দড়ি দিলেও সাংবাদিকদের এক লাইন লেখার উপায় নেই, ফেসবুকে লিখতেও বুক কাঁপে। নির্জনে শোক পালন ছাড়া গতি নেই।
প্রিয় পাঠক, আপনি যে পেশাতেই থাকুন, কর্মস্থলে আপনার অবস্থা কি এর চেয়ে উন্নত? ভেবে দেখুন তো?
"কারণ সংবাদমাধ্যমগুলো ইদানীং মানুষের কাজ হারানোকে আর খবর বলে মনে করে না"।
-- প্রতীক স্বখাত সলিলে ডুবে মরার মর্মস্পর্শী ছবি এঁকেছেন নির্মম সততায়।
আমার জানা ঘনিষ্ঠদের মধ্যে দিল্লি ও কোলকাতার দুটি সংবাদমাধ্যমে বেশ কিছু সাংবাদিক কাজ হারিয়েছেন। গতকাল কানে এল দি হিন্দুর মত আপাত অ্যান্টি এস্টাব্লিশমেন্ট ট্রাস্ট পরিচালিত পত্রিকাও একশ'র উপর সাংবাদিকদের স্রেফ ফোনে/ই-মেইলে 'কাল থেকে এসো না' বলে দিয়েছে। এক পাতাল খাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু চোখ বাঁধা অবস্থায়।
বাস্তব ! ঘোর বাস্তব!
খুবই ভালো খুবই প্রয়োজনীয় লেখা
আমার সমসময় মনে হয় এ ধরনের সমস্যার মূল নিহিত আছে মনুষ্য নামধারী প্রাণীটির বেসিক চরিত্রের ভেতরে
লোভী স্বার্থপর অলস একটি প্রাণীর এই পরিণতি হওয়ার কথা।
তবে সব সাংবাদিক কলম বিক্রি করে চুপ করে বসে আছে এমনটা ন, ভেতরে থেকেও অনেকে বলছে এবং বাইরে বেরিয়ে এসেও অনেকে বিভিন্ন অল্টারনেটিভ মাধ্যমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
Pratik er lekha ta bhalo laaglo kintu ekta bapar omit korechen. traditional journalism er bapartai to uthe jaache. aage PM ki bollen, omuk jaigai ki hoyeche egulo lekhar bishoy chilo .. ekhon whatsapp facebook twitter er juge instance khobor hoccbe ... besh kichu newspaper theke omuk twitter e ki bollen shei niye news kore ... shei changing market tao ekta factor noi? America te bohu local newspaper ube geche .. even boro newspaper gulor obosthao jothesto norbore
I know Pratik da since The Bengal Post days... incisive piece of writing...
সাংবাদিক দের আমি উচ্ছিষ্ট ভোগী বলেই মনে করি। যেমন পুলিশের প্রতি কোনো সহমর্মিতা আমার নেই, তেমনই সাংবাদিক দের প্রতি... ব্যতিক্রম দু এক জন। বেশীরভাগ সরকারি বা বৃহৎ ব্যবসার স্বার্থে ব্যবহৃত হন ও হতে চান। মিডিয়া হাউসের মালিক ও তাইই চান। আর এই কারনেই খবর নয় বিজ্ঞাপন মূখ্য, খবর গৌন। তার ফলশ্রুতিতে ঘটনা খবর- সব ল্যাবরেটরি তে বানানো।
এসত্বেও এই খবর ভয়াবহ। সরকার ও বৃহৎ ব্যবসার স্বার্থরক্ষাকারী ও পদলেহী যারা তাদের কর্মহীন হয়ে পড়া আসলে বিরাট অংশের সাধারণ মানুষের জন্য অশনিসংকেত।
পেশাদার চাটুকার এর যখন কর্মহীন অবস্থা তখন বাকি পেশার অবস্থা অনুমেয়। লেখার গুরুত্ব এইখানেই।
এমন একটা সংস্থায় কাজ করে এসেছি যেখানে নয়ের দশক থেকেই নতুন নিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে এলেও কোনও কর্মী ছাঁটাই হয় নি। তাই হঠাৎ করে কর্মহীন হওয়ার যন্ত্রণার শিকার হতে হয় নি। বাড়িতে কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করা ছেলের কাছে এখন প্রতিমাসেই শুনি ওদের সহকর্মীদের চাকরি চলে যাওয়ার কথা আর ওকে দেখি মাসের শেষে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে এই বুঝি কোম্পানি গোলাপি চিরকুট ধরিয়ে দিল। প্রতীকের লেখা নিয়ে কী আর বলব! আগ্নেয়গিরির শিখরে যেন পিকনিক চলছে।
আমি আছি সরকারি স্কুলে,তবুও শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের ঠণ্ডা স্রোত বয়ে যায়।কারণ আমি তো এই সমাজ-সরকারের বাইরে নই।
"সাংবাদিক দের আমি উচ্ছিষ্ট ভোগী বলেই মনে করি।"
ওপরে পার্থ মৌলিকের মন্তব্য তীব্র আপত্তিকর। এমন বিদ্বেষপূর্ণ, অশালীন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাই।
#
নিজে এপারে বাংলাদেশে তথ্য সাংবাদিকতার কষ্টকর পেশায় অনেকটা বছর চড়ে বেড়াচ্ছি। করোনাকালে বিজ্ঞাপনের বাজারে ধস নামার সাথে সাথে টিভি, নিউজ পোর্টাল ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যেন সুনামি বয়ে যাচ্ছে, বেতনহীনতা, ছাঁটাই বা মিডিয়া বন্ধের যেন ধুম লেগেছে।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক, যে সাংবাদিকেরা সাধারণ মানুষের নিত্য ভোগান্তি আর দুর্দশার কথা গণমাধ্যম প্রকাশে মরিয়া, কিন্তু তাদের পেশাগত হয়রানির কথা প্রকাশ করার কোনো মাধ্যম নেই, সোস্যাল মিডিয়া ছাড়া।
শীর্ষ একটি দৈনিকে চার মাস বেতন বকেয়া পড়েছে, ছাঁটাইয়ের বিকল্প হিসেবে বিনা বেতনে অনেককে পাঁচ বছরের ছুটিতে পাঠানো হচ্ছে!
শীর্ষ আরেক টিভি চ্যানেল খরচ কমাতে দুটি তালিকা করেছে, একটি ছাঁটাই, আরেকটি যাদের বেতন বেশী, তাদের বেতন কমিয়ে অর্ধেকে নিয়ে আসা!
নিউজ পোর্টালগুলো দফা দফায় ছাঁটাই তো করছেই, এমনকি কর্মচ্যুত সাংবাদিকদের বকেয়াও পরিশোধ করছে না।
জানি না, কোথায় এই অরাজকতার শেষ, আর কবেই মিডিয়ায় পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে!
পার্থ মৌলিক বলেছেন-"সাংবাদিক দের আমি উচ্ছিষ্ট ভোগী বলেই মনে করি।" এভাবে কোনও পেশাকে জেনারালাইজ করার তীব্র নিন্দা করছি।
চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের ফলে আরও একটা ব্যাপার হল। আগে পাশাপাশি ব’সে ক আর খ একই কাজ করতেন, যদি সিনিয়রিটি এক হয়, তবে একই মাইনে পেতেন। ফলে তাঁদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকত না অতিরিক্ত কিছু বাগিয়ে নেওয়ার। ব্যতিক্রম সব সময়ে সব জায়গায় থাকে, তার কথা হচ্ছে না। চুক্তি আসার পর যেটা হল - ক এবং খ পাশাপাশি ব’সে একই কাজ করেন, সিনিয়রিটি যদি একও হয়, তবু তাঁরা সমান মাইনে পান না। তাঁদের মধ্যে একাধিক অদৃশ্য লড়াই চলতে থাকে, কারণ অ্যাপ্রেইজাল বলে একটি কল রয়েছে, যে ঠিক করে ঠোঙার থেকে কার হাতে তিনটি বাদাম যাবে, আর কার আটটি, নাকি একটিও না। অতয়েব তাঁরা আর এক হতে পারেন না। কর্মক্ষেত্রে একের বিপদে অন্যে এগিয়ে আসেন না, ইচ্ছে থাকলেও নয়। ভিতরে এক গুচ্ছ ভয় কাজ করে, ম্যানেজমেন্ট-এর ভ্রূ কুঁচকে যাওয়ার ভয়, অ্যাপ্রেইজাল খারাপ হওয়ার ভয়, মাইনে না বাড়ার ভয়, আর সবার উপরে চাকরি হারানোর ভয়। ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির শিকার হয়ে পাশাপাশি বসে দুই শত্রু কাজ করে চলেন।
যাঁরা অন্যের অন্যায় অবিচারের কথা প্রকাশ করেন, তাঁদের নিজের ঘরের অন্ধকারের কথা আর আলোর মুখ দেখে না।
তবু কিছু অন্য রকম ঘটনাও তো ঘটে। সম্প্রতি শুনলাম এক বৃহৎ গোষ্ঠী এক দফতরের প্রধানকে জানাতে বলে তাঁর অধীনে যারা আছেন তাদের মধ্যে কত জনকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। প্রধান জানান কাউকেই না। তার পরে ফের চাপ এলে তিনি কারোর নাম না নিয়ে নিজেই চাকরি ছেড়ে দেন। ওই যে বললাম ব্যতিক্রম সব জায়গায় থাকে।
বোধি, অল্টারনেটিভ মিডিয়া সম্পর্কে তোমার বোধ যদি আরেকটু বলো, তাহলে ব্যক্তিগত ভাবে আমার খুব সুবিধে হয়।
শ্রী নির্মাল্য নাগ যাঁর কথা বলেছেন, তিনিই এই লেখাটি লিখেছেন।
বোধির কথার উত্তরে প্রবন্ধ নয়, বই লেখা উচিত। কিন্তু কেন লেখা হবে, এ প্রশ্নের উত্তর না পেলে ভূমিকাও লেখা উচিত নয়।
বোধির রেফারেন্স ফ্রেম, রাজনৈতিক ভাষ্য, গোটাটাই ইউরোসেন্ট্রিক। অফেন্সে নিও না। অফেন্সের ব্যাপারও নয়। কিন্তু ওই রেফারেন্স ফ্রেমে এ জগতে খেলা হয় না বোধহয়। খেলাটা কনজিউমারিজমের অবশ্যই। কিন্তু সেটাই একমাত্র নয়। মুখ্য। কিন্তু গৌণ কারণ বহুবিধ। তার অন্যতম ক্ষমতা, অদক্ষের হাতে ক্ষমতা। অদক্ষ ক্ষমতা পেলে তা সে যে কোনও মূল্য দিয়ে টিকিয়ে রাখতে মরিয়া হয়। এটা সর্বত্র সত্য। সে ভয় পায়। ভয় থেকে বহু পদক্ষেপ করে।
আমি লেখাটা শেষ করিনি, তার একমাত্র কারণ আলস্য নয়। তার আরেকটা কারণ, সাপের গর্তে হাত দিয়ে ফেলছিলাম, কোনও বিষহরি ছাড়াই। আমাকে তোমরা বিষহরি দাও, আমি তোমাদের সাপ দেখাব।
পরে হয়ত আরেক চোট লিখব। কিন্তু একটা জেনারেল প্রশ্ন - সাড়ে চার টাকা দিয়ে কাগজ কিনে কী চাও? সে কাগজ পড়ে জানবে সব দুর্নীতি, সমস্ত খেলার খবর ও বিভিন্ন অ্যানালিটিকাল প্রবন্ধ? তার বিনিময়মূল্য তো সেই স্বপ্নে দেখা কমিউনিস্ট পার্টির হোলটাইমারের মত সাংবাদিক৷ যে আদর্শ হবে, গোবিন্দ নিহালনিদের প্যারালাল সিনেমার চরিত্রের মত।
চাও? মাইরি চাও?
তোমরা বড় নিশ। তাতে ক্ষতি কিছু নেই, অনুযোগও নয়, কিন্তু তোমরা এই নিশ অবস্থান থেকে মাস কালচার বিশ্লেষণ করো, এইটা তার খর্বতার জায়গা। খবর কাগজ যাদের বিক্রি করতে হয়, তাদের অত নিশ হবার বিলাসিতা থাকে না। কিছুদিন আগের, এই ধরো মাস তিনেক, একবার দেখা হল, কোন খবর ফেসবুকে থেকে গত ১৫ দিনে সবচেয়ে বেশি চলেছে। সারা ভারতের হিসেব। তাতে দেখা গেল, পাকিস্তানে একটা মন্দির ভেঙে মসজিদ করা হয়েছে, সেই খবর সর্বাগ্রে।
তোমাদের বিশ্লেষণে এই পরিস্থিতি থাকে কি? বোধহয় নয়।
প্রতীক কর্পোরেটের লাভের টার্গেটের কথা উল্লেখ করেছেন। সে টার্গেট কীভাবে নিচের তলা অবধি ছড়ায়? ধরো, বোধি বাবু, একটা পোর্টালের পলিটিক্স সেকশনের দায়িত্বে। সেপ্টেম্বর মাসে ওই সেকশনের রিডার যদি ১ মিলিয়ন হয়, তাহলে পরের মাসে, এমনিই সেটা ১০% বেশি টার্গেট, আনলেস তোমাকে আলাদা করে বলা হয়েছে। সাধারণ ভাবে বলা হয়। জানানো হয় এই টার্গেট ৩০% বা ৫০% বাড়ানো হল। এবার তোমার পালা।
তোমার টিমে আছে দুজন। মিলেনিয়াল। খুব বেশি ঝাড়াই বাছাইয়ের সুযোগ তোমার নেই। একটি ভারতব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সংবাদ গোষ্ঠীর বক্তব্য ছিল, আজকাল খুব ভাল ছেলেমেয়ে সাংবাদিকতায় আসে না। কাজ চালানোর মত নিয়ে নাও। ফলে তোমার এই অস্ত্র, যারা জানে, বিশ্বাস করে, সীমান্তে সেনা মারা গেলে তাকে শহিদ বলতে হয় এবং অন্য পক্ষের সেনাকে, "আমাদের বাহিনী খতম করে"। এই নিম্নমেধা নিয়ে তুমি হাতড়াও, দেড় মিলিয়ন। তোমার মাথায় আছে, পাকিস্তানে মসজিদ ভেঙে মন্দির করার খবর সবচেয়ে বেশি চলেছে।
আমি অনেক লিখতে পারি, বলতে পারি। কিন্তু তাতে কিছু বদলায় না।
এই যে বাংলার বাম গণতান্ত্রিকরা, কন্টিনিউয়াসলি একটা সংবাদ গোষ্ঠীকে খিস্তি করে চলে, আর পরদিন কিম্বা সেইদিন সন্ধেতেই তাদেরই খবর কোট করে, তাদের কাছ থেকে লেজিটিমেসি খোঁজে, এদের কেন একটুও সিরিয়াসলি নেব, এবং এমনকি হিয়ারিংও নেব, বিভিন্ন বিষয়ের নৈতিকতা আ সততা সম্পর্কিত বক্তব্যের, তার কারণ বলতে পারো?
এইখানে এও লিপিবদ্ধ থাকুক, এই বাম গণ মহলের কাছে, আমি বিভিন্ন স্তরে, ২০১৫ সাল থেকে ক্রমাগত বলেছি, প্যারালাল মিডিয়ার কথা। বলেছি, কীভাবে কম খরচে এটা সম্ভব। কিন্তু উদ্যোগী হবার চেয়ে খিস্তি করা সহজ। সব কালে। সব দেশে কিনা জানি না।
ফলে, বোধি, অপরায়ন চলবে। স্মাইলি সহ, স্মাইলি ছাড়া। আমরা এরই মধ্যে বাঁচি ও থুথু ফেলি, করোনা কালেও।