২০১৪র সাধারন নির্বাচন যে কথাটা সর্বাগ্রে প্রমাণ করল, তা হল – ভারতীয় মিডিয়ার আর যাই থাক না কেন, মেরুদণ্ড নামক বস্তুটি নেই। নরেন্দ্র মোদির ফ্যাসিবাদি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অওয়াজ তোলার এদের না আছে সদিচ্ছা, না আছে সৎ সাহস। এদের মধ্যে কেউ কেউ তো আবার সক্রিয় ভাবে হাত ও মিলিয়েছেন মোদির সঙ্গে। মিডিয়া হাউস গুলো দিনের পর দিন সাংবাদিকতার নামে যা করে গেছে তা হল – মোদি বন্দনা – মোদির প্রোপাগ্যান্ডা। মোদির বেশ কয়েকটা "ফিক্সড" ইন্টারভিউ দেখলে ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয়। সাজানো লাগে। এই সমস্ত "ফিক্সড" ইন্টারভিউগুলোতে মোদিকে স্নুপগেট বা সাজানো এনকাউন্টার নিয়ে একবারও জবাবদিহি করতে হয় না। থাকে না কোনো প্রতি-প্রশ্ন। তাঁর মুখ নিঃসৃত বাণীই প্রশ্ন কর্তার কাছে ধ্রুব সত্য।
DNAতে প্রকাশিত গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে একটা নিবন্ধ যখন রাতারাতি ইন্টারনেট থেকে লোপাট হয়ে যায়, তখন মিডিয়ার এই মেরুদন্ডহীনতা সম্পর্কে সন্দিহান হওয়ার আর অবকাশ থাকে না। কেন উড়িয়ে দিতে হল নিবন্ধটা কে রাতারাতি? নিবন্ধকার শেহজাদ পুনাওয়ালা কংগ্রেসি হলেও নিবন্ধে করা প্রত্যেকটি দাবির সপক্ষে নথি ছিল, বক্তব্যের সাথে তথ্য ছিল। তা থাকা সত্ত্বেও DNAকে কেন সেটা উড়িয়ে দিতে হল? কেনই বা DNA কর্তৃপক্ষকে নতজানু হয়ে মোদিকে তুষ্ট করতে হবে?
নিবন্ধটি প্রথমে এই URLএ প্রকাশিত ছিল http://www.dnaindia.com/analysis/standpoint-mamata-banerjee-calls-narendra-modi-butcher-of-gujarat-here-are-9-mythbusters-on-2002-post-godhra-riots-1983270। শেহাজাদ পুনাওয়ালার নিবন্ধটি এখানে প্রকাশ করা হল।
যাঁরা হঠাৎ করে গুজরাত দাঙ্গার সত্যকে ভুলে মোদির জনসংযোগ বাহিনী সৃষ্ট কিছু মিথ্যা "মিথ"কে সত্যের আসনে বসিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতি ও বিবেকের পুনর্জাগরনের জন্যঃ
মিথ ১। গোধরা পরবর্তী হিংসাকে নরেন্দ্র মোদির সরকার আয়ত্ত্বে নিয়ে এসেছিলো ২-৩ দিনের মধ্যেই।
সত্যিঃ যে হিংসালীলাকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে আয়ত্ত্বে নিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে, তা মাত্রাভেদে অন্তত মাস দুয়েকের বেশি সময় ধরে চলে। সময় যত গড়িয়েছে, বেড়েছে মৃত্যু, বেড়েছে ক্ষয়ক্ষতি।
সূত্রঃ বিচারপতি J.S. Verma র নেতৃত্বে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সর্ব শেষ অর্ডার- http://nhrc.nic.in/guj_finalorder.htm
মিথ ২। গুজরাত পুলিশ দল নির্বিশেষে দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।
সত্যিঃ "পুলিশের সামনেই মুসলমানেদের বাড়ি ঘর পুড়ছিলো। আমরা কয়েকজন মহিলা পুলিশের কাছে সাহায্যের চাইতে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম কিন্তু পুলিশ আমাদের বল - ভেতরে যা, আজ মুসলমানেদের শেষ সময় উপস্থিত।"
সূত্রঃ PW219 নং নথি। এই নথি নরোদা পাটিয়া মামলায় ব্যবহৃত হয়। এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন মায়াবেন কোদনানি, যিনি কিনা তৎকালীন মোদি সরকারের ক্যাবিনেটের সদস্যা ছিলেন। এই কোদনানিই হত্যাকামী জনতার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। http://www.cjponline.org/gujaratTrials/narodapatiya/NP%20Full%20Judgmnt/Naroda%20Patiya%20-%20Common%20Judgment.pdf
মিথ ৩। গোধরা পরবর্তী হিংসা স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা মাত্র, এতে গুজরাত সরকারের কোনো রকম ষড়যন্ত্র নেই।
সত্যিঃ দাঙ্গার প্রথম দিনেই রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা অহমেদাবাদের পুলিশ কন্ট্রোল রুমের দখল নিয়ে নেন। তাঁদের উপরে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল – বিপদগ্রস্ত মুসলমানদের বাঁচানো চলবে না।
ভোটার লিস্ট দেখে মুসলমানদের চিহ্নিত করে টার্গেট করা হয়।
সূত্রঃ Report of Human Rights Watch, April 2002, Vol. 14, No. 3(C). http://www.hrw.org/reports/2002/india/India0402-03.htm#P446_77680
মিথ ৪। মোদির নিরপেক্ষতার কারনেই মায়াবেন কোদনানি দোষী সাব্যস্ত হন।
সত্যিঃ “বেস্ট বেকারি এবং নিষ্পাপ শিশু ও অসহায় মহিলারা যখন পুড়ছিল, তখন আধুনিক নিরোর দল অন্য দিকে তাকিয়ে বসেছিল - সম্ভবত দোষিদের কীভাবে আড়াল এবং রক্ষা করা যায়, সে কথাই ভাবছিল।”
“ন্যায় ও বিচার কিছু “খেলুড়ে বালকদের” হাতে পড়ে ছেলেখেলায় পর্যবসিত হয়েছিলো। রক্ষক যখন ভক্ষকে পরিণত হয়, তখন ন্যায়, অনুশাসন, সত্য বা বিচার - এ সব কোনো কিছুরই আর কোনো মানে থাকে না। গণ অনুশাসন ও জনহিত যেন পরিণত হয়েছিলো শহীদ ও শহীদ বেদিতে।”
“উপরোক্ত ঘটনাবলী থেকে মনে হয় যে অভিযুক্ত বিচার প্রক্রিয়াকে অযৌক্তিক ভাবে ব্যাহত করতে চাইছে। এরকমও মনে হচ্ছে যে অতিরিক্ত সেশন জাজ ও APP (শ্রীযুক্ত রঘুবীর পান্ড্যা, এই কেসের সরকারি আইনজীবি, যিনি কিনা তৎকালিন বিজেপির সদস্য ছিলেন ও ভদোদরার ২০ নং ওয়ার্ডে বিজেপির টিকিটে ১৯৯৬ সালে লড়েওছেন !) নিজেদের কর্তব্য পালনে কোনোরকম তৎপরতা দেখাননি।”
সূত্রঃ Supreme Court in Zahira Habibulla H Sheikh And Anr vs State Of Gujarat And Ors on 12 April, 2004 CASE NO.: Appeal (crl.) 446-449 of 2004.
http://indiankanoon.org/doc/105430/
মিথ ৫। মোদি গোধরা পরবর্তী হত্যালীলাকে কখনোই নৈতিক সমর্থন দেননি।
সত্যিঃ গোধরা পরবর্তি ঘটনায় নিউটনের তৃতীয় সূত্র আওড়ানোর কথা প্রথমে অস্বীকার করলেও জিটিভির ফুটেজ দেখানো হলে মোদির কাছ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর পাওয়া যায়নি। (Annexure 4A)
সূত্রঃ Editors Guild Fact Finding Mission Report dated 2002.
http://www.sabrang.com/gujarat/statement/report.htm#Meeting%20with%20Narendra%20Modi
মিথ ৬। মোদির একমাত্র লক্ষ্য হল উন্নয়ন। ২০০২ এর দাঙ্গা পরবর্তী সময়তেও ওঁনার ভাষণ কখনো সাম্প্রদায়িকতার বিষ মাখানো ছিলো না।
সত্যিঃ মোদির নথিভুক্ত ভাষণ “মাসের পর মাস বিরোধিরা আপার পদত্যাগ দাবি করতে থাকে। যখন সত্যিই পদত্যাগ করলাম, তখন ওরা বুঝে পেল না কি করবে। দিল্লি ছুটল ম্যাডামের কাছে। ওরা বুঝতে পেরেছিল যে নির্বাচন কমিশনার লিংডোই ওদের একমাত্র ত্রাতা। কদিন আগে কিছু সাংবাদিক আমায় জিজ্ঞেস করলেন "লিংডো কি ইতালি থেকে এসেছেন?" আমি বললাম, আমার কাছে তো ওনার ঠিকুজি কোষ্ঠি নেই, রাজীব গান্ধীকে জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে। তখন সেই সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করলো "ওদের মোলাকাত কি কোনো গির্জায় হয়?" বললাম, হতে পারে!
লিংডো আহমেদাবাদ আর ভদোদরায় এসে আধিকারিকদের সাথে অশ্লীল ভাষায় কথা বলেন। গুজরাতিরা কখনো ও ভাষায় কথা বলবে না, আমাদের শিক্ষা দীক্ষা তেমন নয়। তারপর লিংডো বললেন, নির্বাচন হবে না। আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করতে চাইঃ এ সিদ্ধান্ত কি উনি সংখ্যালঘুদের সাথে বৈঠক করে নিয়েছেন? সংখালঘুরাই কি ভারতের একমাত্র নাগরিক? সংখ্যাগুরুরা কি কেউ নয়? সংবিধান কি শুধু সংখ্যালঘুদের জন্য? উনি কি একবারও গোধরায় নিহতদের পরিবারের লোকজনদের সাথে দেখা করেছেন? কেন করেন নি? তাঁদের একবারও জিজ্ঞেস করেছেন, পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুকূল কিনা? কেন? জেমস মাইকেল লিংডো (মাইকেল কথাটির ওপর জোর দিয়ে), গুজরাতের জনতা তোমাকে এ প্রশ্নগুলো করছে।”
সূত্রঃ http://www.outlookindia.com/article.aspx?217399
মিথ ৭। নরেন্দ্র মোদি মার্কিন ভিসার জন্য কখনো আবেদন করেননি।
সত্যিঃ “The Chief Minister of Gujarat state, Mr. Narendra Modi, applied for a diplomatic visa to visit the United States. On March 18, 2005, the United States Department of State denied Mr. Modi this visa under section 214 (b) of the Immigration and Nationality Act because he was not coming for a purpose that qualified for a diplomatic visa. Modi’s existing tourist/business visa was also revoked under section 212 (a) (2) (g) of the Immigration and Nationality Act. Section 212 (a) (2) (g) makes any foreign government official who “was responsible for or directly carried out, at any time, particularly severe violations of religious freedom” ineligible for a visa to the United States. The Ministry of External Affairs requested that the Department of State review the decision to revoke his tourist/business visa. Upon review, the State Department re-affirmed the original decision.” This decision applies to Narendra Modi only. It is based on the fact that, as head of the State government in Gujarat between February 2002 and May 2002, he was responsible for the performance of state institutions at that time. The State Department’s detailed views on this matter are included in its annual Country Reports on Human Rights Practices and the International Religious Freedom Report. Both reports document the violence in Gujarat from February 2002 to May 2002 and cite the Indian National Human Rights Commission report, which states there was “a comprehensive failure on the part of the state government to control the persistent violation of rights of life, liberty, equality, and dignity of the people of the state.”
সূত্রঃ ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড মালফোর্ডের বয়ান, ২১ শে মার্চ ২০০৫। http://2001-2009.state.gov/p/sca/rls/rm/2005/43701.htm
মিথ ৮। বাজপায়ী মোদিকে কখনো "রাজধর্ম" পালন করার উপদেশ দেননি, কখনো মোদিকে ভর্ৎসনা করেননি।
সত্যিঃ সে সময়ে রাজ্য সরকার যে নিজের কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেই অভিযোগের উত্তরে বাজপায়ী বলেন, তিনি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবেন। তিনি বলেন "সরকারি কর্মচারি ও রাজনৈতিক নেতাদের নিজের কাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা উচিৎ"। আহমেদাবাদের শাহ আলম ক্যাম্পে বাজপায়ী বলেন, "গোধরার ঘটনা নিন্দনীয়, কিন্তু তারপরে যা ঘটল, তা এক কথায় উন্মত্ততা।" এক আবেগ বিহ্বল ভাষণে তিনি বলেন, ''উন্মত্ততার জবাব উন্মত্ততা হতে পারে না। সকলের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মন রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সরকারেরই..... এখানে ভেদাভেদের কোনো স্থান নেই"।
সূত্রঃ বিবিসির রিপোর্ট, ৪ই এপ্রিল, ২০০১। http://news.bbc.co.uk/2/hi/south_asia/1910008.stm
মিথ ৯। স্মৃতি ইরানির মতন মোদির সমালোচকেরা আজ যে মোদি ভজনা করছেন, এর পেছনে সুযোগসন্ধানি মনোবৃত্তি নেই।
সত্যিঃ দিল্লির মুসলিম অধ্যুষিত চাঁদনিচক থেকে সংসদিয় নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরে ইরানি কি বলেছেন তা একবার দেখে নেওয়া যাক।
"গুজরাত নিয়ে কথা হলেই লোকে দাঙ্গার কথা বলে গুজরাতিদের কোনঠাসা করে। তাই অটলজী ও বিজেপির প্রতি আমার সম্মান প্রদর্শনের জন্য আমি এই পদক্ষেপ নিতে দ্বিধান্বিত নই (মোদির অপসারণের দাবিতে অনশন)"।
সূত্রঃ টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১২ই ডিসেম্বর, ২০০৪।
উপরোক্ত তথ্যসূত্র গুলি একত্রিত করতে সময় লেগেছে মাত্র এক ঘণ্টা। ভাবলে অবাক লাগে – যে সকল দুঁদে সাংবাদিক সেদিনের দাঙ্গা নিজেদের চোখে দেখেছেন, তাঁরা কেউ মোদিকে তাঁর আজকের মিথ্যাগুলি নিয়ে চেপে ধরলেন না। হয়ত বা তাঁরা ও স্মৃতি ইরানির মতই প্রতি রাতে নিজেদের বলেন "হে রাম".....
http://www.truthofgujarat.com/indian-media-continues-prostrate-modi-dna-deletes-factual-anti-modi-article-gujarat-riots/ থেকে কৌশিক ঘোষ কর্তৃক অনূদিত ।