এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সিনেমা

  • সিনেমার আলো

    সুপ্রতীক চক্রবর্তী
    আলোচনা | সিনেমা | ২৭ অক্টোবর ২০২৪ | ৫৬৮ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (৪ জন)

  • সিনেমার আলো কতরকম হয়? স্বেন নিকভিস্ট এর উত্তরে বলেছিলেন যে আলো অনেকরকম হয়। সম্ভ্রান্ত, স্বপ্নবৎ, নিঃস্ব, জীবন্ত, মৃত, পরিচ্ছন্ন, দৃঢ়, তীর্যক, যৌনময়, আবছা, বিষাক্ত, রহস্যময়, উত্তপ্ত, অন্ধকারাচ্ছন্ন, হিংস্র, প্রেমময়, পতনশীল, শান্ত এবং বিবর্ণ!

    নিকভিস্ট বার্গম্যানের কুড়িটি ছবির সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন। দুবারের অস্কার বিজয়ী।

    এই যতরকম আলোর কথা বলা হল তারমধ্যে সবচেয়ে পরিচিত আলো কোনটা জানি না! আলোর গভীরে একটা ইমেজ থাকে,যেটা শুধুই অনুভূতিগ্রাহ্য! যেমন ধরুন "শান্ত আলো"! আপাত ভাবে এর কোনো অর্থ হয় না। এবার এই "শান্ত আলো" শব্দ দুটিকে নিয়ে একটু ভাবা যেতে পারে। ধরে নিন একটা মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাড়ির উঠোনে নিঝুম অপরাহ্নের আলো এসে পড়েছে। একটা বিড়াল ঘুমোচ্ছে। গৃহস্থের ঘর ভেতর থেকে বন্ধ! এই নিবিড়তাকে শান্ত ভাবা যেতেই পারে। অর্থাৎ আলোর চরিত্র নির্ভর করছে তার সাবজেক্টের ফর্মের ওপর। এ কথা খাটে প্রায় সমস্ত রকম আলোর ক্ষেত্রেই। এবার মজার বিষয় হল সাবজেক্টের ফর্মটাও কিন্তু পরিবর্তনশীল। ফর্ম মানে "অ্যাকুমুলেশন অফ ইনগ্রেডিয়েন্টস"! সবকিছুরই একটা ফর্ম থাকে। সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষিতে আলো একটু চ্যুত হলেই ফর্মও রূপান্তরিত হয়। একটা উদাহরণ দিচ্ছি! ধরে নিন, নিশুত রাতে বন্ধ ঘরে স্বামী স্ত্রী একে অপরকে আদর করছেন। এখানে নব্বই শতাংশ কালারিস্ট নীল রঙকে প্রেফার করবেন কিংবা স্ট্রীটলাইটের একটা ফ্যাকাশে ধূসর আলো নিয়ে আসবেন ঘরের ভিতর। প্রেমকে আরো নিবিড় ও বাঙময় করে তোলাই এখানে উদ্দেশ্য! এবার কোনো বুদ্ধিমান কেউ এই দৃশ্যে কালার কনট্রাস্ট ঘটাতে পারেন! আলোর অর্থ আর ছবির অর্থ বিপরীত হয়ে যেতে পারে সেক্ষেত্রে! দর্শক যখন আলোর অর্থ ধরে ফেলেন তখন সেই নির্দিষ্ট ইমেজটিও আরো সার্থক হয়ে ওঠে।

    সুস্বাদু বিরিয়ানি খাওয়া আর সুস্বাদু বিরিয়ানি বানানোর মধ্যে তফাত আছে। আলোর মহিমা বুঝতে হলে রেমব্রাঁর ছবি দেখতে হবে। পেইন্টিং! আলো ছায়ার অলৌকিক ভারসাম্য! সেখানে আলো ও অন্ধকার দুটোই তৈরী করছে দুরকম রঙ! সিনেমার ক্ষেত্রে সেটাই করছে প্রযুক্তি! চ্যাপলিন বলেছিলেন একটা কথা। একজন ফিল্ম মেকারকে আর কিছু না হোক, তিনটে বিষয়ে জানতে হয়। এক লিখতে জানতে হয়, দুই পেইন্টিং জানতে হয়, তিন ফিজিক্স জানতে হয়! এর থেকে খাঁটি কথা কিছু হয় না। আমাদের দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ তিন বাঙালি পরিচালক সত্যজিৎ, মৃণাল এবং ঋত্বিক ঘটকের মধ্যে দুজনই অসাধারণ ছবি আঁকতে জানতেন। শুধু মৃণাল সেন জানতেন না। পেইন্টিং একটা সিনেমাকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে সেটা সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালীতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম ছবির কিছু দৃশ্য যেন হাতে আঁকা ছবি। আরেকটা দিক হল আলো বা রঙের দিক। জোড়াসাঁকোর দোতলার বারান্দায় ঠিক বিকেল চারটের সময় একটা তীর্যক রোদ এসে পড়ে। নিকভিস্টের সংজ্ঞা অনুযায়ী সেটাকে "পতনশীল আলো" বলা যেতে পারে। আমি নিজে প্রথম সেটা দেখি জোড়াসাঁকোতে নয়, বরং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চিত্রে, শান্তিনিকেতনের মিউজিয়ামে। এই একই কথা পরে পড়লাম লীলা মজুমদারের একটি লেখায়। তারপর স্বচক্ষে গিয়ে দেখলাম হুবহু সেই আলো! পতনশীল, একটা মরবিড আলো। মনখারাপি রঙ! গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল! একটা ডকুমেন্টেড রৌদ্র! এরকম গায়ে কাঁটা আরো দিয়েছে। যেমন ভ্যান গগের "পটাটো ইটার" ছবিটিতে যে রঙের ব্যবহার সেই একই রঙ আলো হিসেবে ব্যবহার করছেন বেলা টার তাঁর "টিউরিন হর্স" ছবিতে। বিবর্ণ আলো বলা যায় তাকে। "অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহি রে..."


    ভ্যান গগের "পটাটো ইটার"




    বেলা টারের "টিউরিন হর্স"



    বাকি থাকল ফিজিক্স! অ্যানাটমি অফ লাইট! ক্যামেরা নামক পদার্থটিকে চালাতে গেলে ফিজিক্স জানতেই হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি৷ কিন্তু ক্যামেরার শরীরের কলকব্জা আর তার ফর্ম অফ রিফ্লেকশন বুঝতে গেলে সোজাকথা ফিজিক্স জানতে হবে। স্পেস আর লাইটের যে অন্তর্ঘাত এবং বহির্ঘাত , ফ্রেমের ডায়মেনশন, রুল অফ থার্ড, ফোকাল লেন্থ, সি এস ও, অ্যাপারচার! গভীর জ্যামিতির দাবি রাখে। "ফিল্ম ইজ অল অ্যাবাউট জিয়োমেট্রি", ত্রুফো বলেছিলেন।

    ছবি তৈরীর দুনিয়ায় একটি শটের আত্মা হিসেবে ধরে নেওয়া হয় লাইটিংকে! হার্ড লাইট, সফ্ট লাইট, ব্যালেন্স লাইটিং, কনট্রাস্ট লাইটিং, লাইন লাইটিং আরো কত কি! বিশ্বাসযোগ্য করতে হয় সবটা! লাইটস্কিমের পরিকল্পনা করতেই একমাস লেগে যায়! যেমন ধরুন একজন লোক জানলার কাছে বসে লিখছে। তার ডানদিকটা আলোকিত, বামদিকটা ছায়া! ছায়ার ডিটেলটাও দেখা যাচ্ছে! কারণ আমাদের চোখ ১/১০০০ আলোর স্তর বিভাজন দেখতে পারে।কিন্তু ক্যামেরার লেন্স দেখতে পারে মাত্র ১/১০০ স্তর! সুতরাং সেক্ষেত্রে লেন্সের অক্ষমতা পুষিয়ে দিতেই ফিল লাইটের ব্যবহার অনিবার্য। এ এক অতল মজার ব্যপার! সিনেমায় যেখানে গোটাটা অন্ধকার মনে হচ্ছে সেখানেও অ্যাকচুয়ালি আলো রাখা আছে। সিনেমায় আলো থাকেনা,থাকে আলোর খন্ড খন্ড রূপ! ঠিক তেমনি থাকে অন্ধকারেরও খণ্ড খণ্ড রূপ! সংগীতের মতো আলোরও সরগম থাকে, স্বরলিপি থাকে, টোনিং থাকে!

    একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলে শেষ করব।প্রায় দেড় বছর আগে একটি ফিল্মের শুটিং দেখতে গেছি। একেবারে শেষ দৃশ্যের শুটিং চলছে। সেট তৈরী। অভিনেতারাও নিজের নিজের পজিশনে। একটা রিহার্সাল টেক নেওয়া হল। সুন্দর একটা কনট্রাস্ট লাইটিং তৈরী করা হয়েছে। হঠাৎ পরিচালকের মনে হল আলোর ব্রাইটনেস কমাতে হবে। বেশী এক্সপোজড হয়ে যাচ্ছে। সিনেমাটোগ্রাফারের কানে কানে গিয়ে সেটা বলা হল। তারপর ফাঁকিবাজ ছাত্রের মতো পরিচালক বললেন "বাদ দিন। টেকটা হয়ে যাক। পরে এডিটে কমিয়ে দেওয়া যাবে"। পোড় খাওয়া সিনেমাটোগ্রাফার রেগে টং! এডিটে কমিয়ে দেওয়া যাবে মানেটা কি? এটা কি তুমি সেলফি তুলছ নাকি? শর্টকাট বলে কিছু হয় না! তারপরেই উনি আবার লাইট স্কিম চেঞ্জ করলেন। হাই টোন কমিয়ে দেওয়া হল। শট শেষ হল। আর আমি বুঝে গেলাম আলো এক গুরুত্বপূর্ণ জিনিষ! নিতান্ত নিরুপায় না হলে কমপিউটারে বসে তাকে নিয়ন্ত্রণ না করাই ভালো।


    ভ্যান গঘ ও বেলা টারের ছবি: উইকিমিডিয়া
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৭ অক্টোবর ২০২৪ | ৫৬৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • . | ২৭ অক্টোবর ২০২৪ ০৫:৫৮538899
  • চমৎকার সুন্দর করে বোঝানো হয়েছে।
    একটা উচ্চারণ ঠিক করে নিতে পারলে ভালো হয়, রেমব্রান্ট হবে নামটা। ডাচ নাম, পুরোটাই উচ্চারিত হয়।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন