সিনেমার আলো কতরকম হয়? স্বেন নিকভিস্ট এর উত্তরে বলেছিলেন যে আলো অনেকরকম হয়। সম্ভ্রান্ত, স্বপ্নবৎ, নিঃস্ব, জীবন্ত, মৃত, পরিচ্ছন্ন, দৃঢ়, তীর্যক, যৌনময়, আবছা, বিষাক্ত, রহস্যময়, উত্তপ্ত, অন্ধকারাচ্ছন্ন, হিংস্র, প্রেমময়, পতনশীল, শান্ত এবং বিবর্ণ!
নিকভিস্ট বার্গম্যানের কুড়িটি ছবির সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন। দুবারের অস্কার বিজয়ী।
এই যতরকম আলোর কথা বলা হল তারমধ্যে সবচেয়ে পরিচিত আলো কোনটা জানি না! আলোর গভীরে একটা ইমেজ থাকে,যেটা শুধুই অনুভূতিগ্রাহ্য! যেমন ধরুন "শান্ত আলো"! আপাত ভাবে এর কোনো অর্থ হয় না। এবার এই "শান্ত আলো" শব্দ দুটিকে নিয়ে একটু ভাবা যেতে পারে। ধরে নিন একটা মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাড়ির উঠোনে নিঝুম অপরাহ্নের আলো এসে পড়েছে। একটা বিড়াল ঘুমোচ্ছে। গৃহস্থের ঘর ভেতর থেকে বন্ধ! এই নিবিড়তাকে শান্ত ভাবা যেতেই পারে। অর্থাৎ আলোর চরিত্র নির্ভর করছে তার সাবজেক্টের ফর্মের ওপর। এ কথা খাটে প্রায় সমস্ত রকম আলোর ক্ষেত্রেই। এবার মজার বিষয় হল সাবজেক্টের ফর্মটাও কিন্তু পরিবর্তনশীল। ফর্ম মানে "অ্যাকুমুলেশন অফ ইনগ্রেডিয়েন্টস"! সবকিছুরই একটা ফর্ম থাকে। সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষিতে আলো একটু চ্যুত হলেই ফর্মও রূপান্তরিত হয়। একটা উদাহরণ দিচ্ছি! ধরে নিন, নিশুত রাতে বন্ধ ঘরে স্বামী স্ত্রী একে অপরকে আদর করছেন। এখানে নব্বই শতাংশ কালারিস্ট নীল রঙকে প্রেফার করবেন কিংবা স্ট্রীটলাইটের একটা ফ্যাকাশে ধূসর আলো নিয়ে আসবেন ঘরের ভিতর। প্রেমকে আরো নিবিড় ও বাঙময় করে তোলাই এখানে উদ্দেশ্য! এবার কোনো বুদ্ধিমান কেউ এই দৃশ্যে কালার কনট্রাস্ট ঘটাতে পারেন! আলোর অর্থ আর ছবির অর্থ বিপরীত হয়ে যেতে পারে সেক্ষেত্রে! দর্শক যখন আলোর অর্থ ধরে ফেলেন তখন সেই নির্দিষ্ট ইমেজটিও আরো সার্থক হয়ে ওঠে।
সুস্বাদু বিরিয়ানি খাওয়া আর সুস্বাদু বিরিয়ানি বানানোর মধ্যে তফাত আছে। আলোর মহিমা বুঝতে হলে রেমব্রাঁর ছবি দেখতে হবে। পেইন্টিং! আলো ছায়ার অলৌকিক ভারসাম্য! সেখানে আলো ও অন্ধকার দুটোই তৈরী করছে দুরকম রঙ! সিনেমার ক্ষেত্রে সেটাই করছে প্রযুক্তি! চ্যাপলিন বলেছিলেন একটা কথা। একজন ফিল্ম মেকারকে আর কিছু না হোক, তিনটে বিষয়ে জানতে হয়। এক লিখতে জানতে হয়, দুই পেইন্টিং জানতে হয়, তিন ফিজিক্স জানতে হয়! এর থেকে খাঁটি কথা কিছু হয় না। আমাদের দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ তিন বাঙালি পরিচালক সত্যজিৎ, মৃণাল এবং ঋত্বিক ঘটকের মধ্যে দুজনই অসাধারণ ছবি আঁকতে জানতেন। শুধু মৃণাল সেন জানতেন না। পেইন্টিং একটা সিনেমাকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে সেটা সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালীতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম ছবির কিছু দৃশ্য যেন হাতে আঁকা ছবি। আরেকটা দিক হল আলো বা রঙের দিক। জোড়াসাঁকোর দোতলার বারান্দায় ঠিক বিকেল চারটের সময় একটা তীর্যক রোদ এসে পড়ে। নিকভিস্টের সংজ্ঞা অনুযায়ী সেটাকে "পতনশীল আলো" বলা যেতে পারে। আমি নিজে প্রথম সেটা দেখি জোড়াসাঁকোতে নয়, বরং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চিত্রে, শান্তিনিকেতনের মিউজিয়ামে। এই একই কথা পরে পড়লাম লীলা মজুমদারের একটি লেখায়। তারপর স্বচক্ষে গিয়ে দেখলাম হুবহু সেই আলো! পতনশীল, একটা মরবিড আলো। মনখারাপি রঙ! গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল! একটা ডকুমেন্টেড রৌদ্র! এরকম গায়ে কাঁটা আরো দিয়েছে। যেমন ভ্যান গগের "পটাটো ইটার" ছবিটিতে যে রঙের ব্যবহার সেই একই রঙ আলো হিসেবে ব্যবহার করছেন বেলা টার তাঁর "টিউরিন হর্স" ছবিতে। বিবর্ণ আলো বলা যায় তাকে। "অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহি রে..."
বাকি থাকল ফিজিক্স! অ্যানাটমি অফ লাইট! ক্যামেরা নামক পদার্থটিকে চালাতে গেলে ফিজিক্স জানতেই হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি৷ কিন্তু ক্যামেরার শরীরের কলকব্জা আর তার ফর্ম অফ রিফ্লেকশন বুঝতে গেলে সোজাকথা ফিজিক্স জানতে হবে। স্পেস আর লাইটের যে অন্তর্ঘাত এবং বহির্ঘাত , ফ্রেমের ডায়মেনশন, রুল অফ থার্ড, ফোকাল লেন্থ, সি এস ও, অ্যাপারচার! গভীর জ্যামিতির দাবি রাখে। "ফিল্ম ইজ অল অ্যাবাউট জিয়োমেট্রি", ত্রুফো বলেছিলেন।
ছবি তৈরীর দুনিয়ায় একটি শটের আত্মা হিসেবে ধরে নেওয়া হয় লাইটিংকে! হার্ড লাইট, সফ্ট লাইট, ব্যালেন্স লাইটিং, কনট্রাস্ট লাইটিং, লাইন লাইটিং আরো কত কি! বিশ্বাসযোগ্য করতে হয় সবটা! লাইটস্কিমের পরিকল্পনা করতেই একমাস লেগে যায়! যেমন ধরুন একজন লোক জানলার কাছে বসে লিখছে। তার ডানদিকটা আলোকিত, বামদিকটা ছায়া! ছায়ার ডিটেলটাও দেখা যাচ্ছে! কারণ আমাদের চোখ ১/১০০০ আলোর স্তর বিভাজন দেখতে পারে।কিন্তু ক্যামেরার লেন্স দেখতে পারে মাত্র ১/১০০ স্তর! সুতরাং সেক্ষেত্রে লেন্সের অক্ষমতা পুষিয়ে দিতেই ফিল লাইটের ব্যবহার অনিবার্য। এ এক অতল মজার ব্যপার! সিনেমায় যেখানে গোটাটা অন্ধকার মনে হচ্ছে সেখানেও অ্যাকচুয়ালি আলো রাখা আছে। সিনেমায় আলো থাকেনা,থাকে আলোর খন্ড খন্ড রূপ! ঠিক তেমনি থাকে অন্ধকারেরও খণ্ড খণ্ড রূপ! সংগীতের মতো আলোরও সরগম থাকে, স্বরলিপি থাকে, টোনিং থাকে!
একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলে শেষ করব।প্রায় দেড় বছর আগে একটি ফিল্মের শুটিং দেখতে গেছি। একেবারে শেষ দৃশ্যের শুটিং চলছে। সেট তৈরী। অভিনেতারাও নিজের নিজের পজিশনে। একটা রিহার্সাল টেক নেওয়া হল। সুন্দর একটা কনট্রাস্ট লাইটিং তৈরী করা হয়েছে। হঠাৎ পরিচালকের মনে হল আলোর ব্রাইটনেস কমাতে হবে। বেশী এক্সপোজড হয়ে যাচ্ছে। সিনেমাটোগ্রাফারের কানে কানে গিয়ে সেটা বলা হল। তারপর ফাঁকিবাজ ছাত্রের মতো পরিচালক বললেন "বাদ দিন। টেকটা হয়ে যাক। পরে এডিটে কমিয়ে দেওয়া যাবে"। পোড় খাওয়া সিনেমাটোগ্রাফার রেগে টং! এডিটে কমিয়ে দেওয়া যাবে মানেটা কি? এটা কি তুমি সেলফি তুলছ নাকি? শর্টকাট বলে কিছু হয় না! তারপরেই উনি আবার লাইট স্কিম চেঞ্জ করলেন। হাই টোন কমিয়ে দেওয়া হল। শট শেষ হল। আর আমি বুঝে গেলাম আলো এক গুরুত্বপূর্ণ জিনিষ! নিতান্ত নিরুপায় না হলে কমপিউটারে বসে তাকে নিয়ন্ত্রণ না করাই ভালো।