খাপ কথাটা শুনলেই অনিবার্যভাবে পঞ্চায়েত শব্দটা মনে আসে। আর পঞ্চায়েত যেহেতু গেঁয়ো ব্যাপার, সেহেতু শহুরে মানুষ নাক সিঁটকান। কিন্তু ভারতবর্ষ আজও আসলে গ্রামীণ সভ্যতা। মানে শহরে গ্রামের মৃদুল মলয়, মাঠে মাঠে ধান আর গাছে গাছে পাখি থাক বা না থাক; পরনিন্দা, পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা বিলক্ষণ থাকে। তাই যাঁরা নাক সিঁটকান তাঁরাও সুযোগ পেলে খাপ পঞ্চায়েত বসাতে ছাড়েন না। ১৪ জুন অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃতদেহ উদ্ধার হওয়ার পরের ঘটনাবলী এর প্রমাণ। তদন্তে যদি শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয় সুশান্ত খুনই হয়েছেন এবং রিয়া চক্রবর্তীই খুনটা করিয়েছেন (যদিও সি বি আই, ই ডি, এন সি বি এই মুহূর্তে খুনের নামও করছে না), তাহলেও গত তিন মাস ধরে টিভি স্টুডিও আর আমাদের বৈঠকখানার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে যা চলছে, তা আসলে ই-খাপ পঞ্চায়েত বা খাপিনার (ওয়েবিনার বলে ওয়েবিনারকে অপমান করা অনুচিত)।
খাপ পঞ্চায়েত কেমনভাবে কাজ করে? প্রথমত, খাপ নিজেই নিজের আইন; দেশের আইন ফালতু। দ্বিতীয়ত, ওখানে অভিযুক্ত আর অপরাধী সমর্থক। অভিযোগের খতিয়ে দেখা হয় না, কী শাস্তি দেওয়া হবে তা ঠিক হয়। তৃতীয়ত, অপরাধ যে বা যারাই করে থাক, শাস্তি হয় গোটা পরিবারের। তিন মাস ধরে ঠিক তাই চলছে সুশান্তের মৃত্যু নিয়ে, আর গেঁয়ো ভূত থেকে শুরু করে আলোকপ্রাপ্ত মহানগরের মানুষ পর্যন্ত সকলেই শখ মিটিয়ে বিচারকের ভূমিকা পালন করছেন। কিন্তু এই খাপ পঞ্চায়েত বসাল কে? কেনই বা এই ঘটনা নিয়েই জাতীয় খাপ পঞ্চায়েত বসল? সেসব ভেবে দেখা দরকার।
সুশান্তের চেয়ে অনেক কম বয়সে জিয়া খান আত্মহত্যা করেছিলেন মাত্র তিন বছর আগে। কে বা কারা তাঁকে এমন করতে বাধ্য করল তা ছ পাতার সুইসাইড নোটে লেখা ছিল। তখন এমন আবেগমথিত খাপ বসেনি, সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া হয়নি। প্রধান অভিযুক্ত পাঞ্চোলিপুত্র গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তবে এখন বহাল তবিয়তে আছেন।১ অতএব সুশান্তের মৃত্যু দুঃখজনক, বিহ্বল করে দেওয়ার মত, তবু অভূতপূর্ব নয়। তাহলে এভাবে খাপ প্রবৃত্তিকে জাগ্রত করতে পারল কী করে? ভাবা যাক।
ঘটনার কেন্দ্রে রয়েছে বলিউড। ব্যাপারটা ভাল হোক আর মন্দ হোক, যতজন ভারতীয় বলিউডি ছবি দেখেন, ততজন নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতা শোনেন না। ফিল্মের মাধ্যমে কোন বার্তা দিলে সে বার্তা যে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায় এবং বার্তার জোর অনেক বেশি হয় সেকথা বামপন্থী, মধ্যপন্থী, দক্ষিণপন্থী --- সকলেই বোঝেন। উপরন্তু বলিউড ভারতের মানুষের কাছে পুরাণকথিত স্বর্গলোক, যেখানে দেবদেবীদের বসবাস। সুতরাং বলিউডি ছবির বার্তা বিরাট অংশের মানুষের কাছে বেদবাক্য --- কখনো সচেতনভাবে, কখনো অবচেতনে --- এ কথা বুঝতে আধুনিক চাণক্য হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অতএব যাদের ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তাদেরও কিন্তু হিন্দি ছবি দিয়ে বশ করা যায়। বাজপেয়ী-আদবানির আমলে বিজেপি নেতাদের এবং অনেক নিরপেক্ষ বিশ্লেষককেও জোর গলায় বলতে শোনা যেত “বিজেপি আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এক জিনিস নয়।” মোদীশাহির শুরুর দিকেও এ কথা বলা হত, ইদানিং তত শোনা যায় না। অনেকেই বুঝছেন যে সঙ্ঘের হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্নপূরণই বিজেপির আসল অ্যাজেন্ডা। হিন্দুরাষ্ট্র শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে নির্মাণ করা যায় না, সাংস্কৃতিক বিজয় প্রয়োজন। সে বিজয় বলিউডকে করতলগত করতে না পারলে সম্পূর্ণ হয় না। প্রথমে স্বজনপোষণের অভিযোগ, তারপর মাদক নেওয়ার অভিযোগ --- এসব আসলে বলিউডকে পেড়ে ফেলার প্রয়াস কিনা তা ভাবা বিশেষ প্রয়োজন।
ভারতীয় জনতার এখন দুটো আফিম --- ক্রিকেট আর বলিউড। প্রথমটাকে সরকারপক্ষ নির্বিঘ্নে নিজেদের কাজে লাগাতে পেরেছে। যে কোন বড় সরকারি সিদ্ধান্তে দারুণ ক্ষিপ্রতায় ভারতের বর্তমান এবং প্রাক্তন ক্রিকেটাররা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। বিমুদ্রাকরণের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলি জানিয়ে দিয়েছিলেন ওটা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। শচীন তেন্ডুলকর, অনিল কুম্বলে, বীরেন্দ্র সেওয়াগ --- সকলেই অর্থনীতিবিদ হয়ে বসেছিলেন। অতঃপর তো খোদ ক্রিকেট বোর্ডটাই দখল করা গেছে। বাংলার গৌরবের নেতৃত্বে চাণক্যপুত্র স্বয়ং বোর্ডের অন্যতম কর্ণধার হয়েছেন, এবং মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও উভয়েই আদালত ও অতিমারীর দয়ায় চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন। অথচ বলিউডকে কিন্তু বাগে আনা যাচ্ছে না।
নাগরিকত্ব বিল, এন আর সি, এন পি আরের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে আন্দোলন চলছিল অনতি অতীতে, সেই আন্দোলনের কথা স্মরণ করুন। বলিউডের একটা বড় অংশ কেবল টুইট করে ক্ষান্ত হয়নি। স্বরা ভাস্কর, অনুরাগ কাশ্যপরা রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন। সেই আন্দোলনের অসংখ্য মনে রাখার মত দৃশ্যের মধ্যে একটা ছিল --- মুম্বাইয়ের কার্টার রোডে দাঁড়িয়ে স্বানন্দ কিরকিরে গাইছেন “বাওরা মন দেখনে চলা এক সপনা”, আর সামনে বসা বলিউডি সহকর্মীরা গলা মেলাচ্ছেন। বিশাল ভরদ্বাজ, অনুভব সিনহা, রিমা কাগতি, দিয়া মির্জা, রিচা চাড্ডা প্রমুখ ছিলেন সেখানে। যারা প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা ঠুকেছিল, তারা স্বরার বিরুদ্ধে দিল্লির এক পথসভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য একই মামলা দায়ের করতে চেয়েছিল। অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপালের আপত্তিতে হয়ে ওঠেনি।
বলিউড অভিনেতা-অভিনেত্রীদের এভাবে রাস্তায় নেমে আসা হিন্দুরাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য নিঃসন্দেহে সুখবর নয়। কিন্তু বলিউডি বিদ্রোহ সেখানেও শেষ হল না। জে এন ইউ তে সশস্ত্র হামলা হল, প্রতিবাদের মঞ্চে পৌঁছে গেলেন দীপিকা পাড়ুকোন। এঁর জনপ্রিয়তাকে স্বরার মত “ফ্লপ অভিনেত্রী” তকমা দিয়ে উপেক্ষা করার উপায় নেই। ফিল্মফেয়ার পত্রিকার মতে গত এক দশকে যে দশটা ভারতীয় ছবি সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করেছে২, তার মধ্যে অষ্টম ছবিটার নাম ‘পদ্মাবত’। দীপিকা সেই ছবির নায়িকা। ইন্ডাস্ট্রির প্রায় সব বড় ব্যানারে সব বড় অভিনেতার সাথে কাজ করে ফেলেছেন তার আগেই।
ফিল্মফেয়ারের তালিকার দশটা ছবির মধ্যে তিনটের কেন্দ্রীয় চরিত্রে আমির খান (দঙ্গল ৩৮৭.৩৮ কোটি; পি কে ৩৪০.৮ কোটি; ধুম থ্রি ২৮৪.২৭ কোটি) আর তিনটের সলমন খান (টাইগার জিন্দা হ্যায় ৩৩৯.১৬ কোটি; বজরঙ্গি ভাইজান ৩২০.৩৪ কোটি; সুলতান ৩০০.৪৫ কোটি)। প্রযোজক, পরিচালকদের মধ্যে একাধিকবার নাম পাচ্ছি রাজকুমার হিরানি-বিধু বিনোদ চোপড়া জুটির (পি কে; সঞ্জু ৩৪২.৫৩ কোটি), আদিত্য চোপড়া (টাইগার জিন্দা হ্যায়; ওয়ার ৩১৭.৯১ কোটি; ধুম থ্রি ২৮৪.২৭ কোটি) এবং আব্বাস জাফরের (টাইগার জিন্দা হ্যায়; সুলতান ৩০০.৪৫ কোটি)। দুই খানের নামও প্রযোজক হিসাবে এসে পড়ছে।
‘পদ্মাবত’ ছাড়া ফিল্মফেয়ার উল্লিখিত দশটা ছবির কোনটাই হিন্দু জনগণের কয়েক শতাব্দীব্যাপী নিপীড়নের কাহিনি নয়, আধ সেদ্ধ ইতিহাস ঘেঁটে ঐস্লামিক অত্যাচারের গল্প বলে না। অর্থাৎ দর্শকের কাছে হিন্দুরাষ্ট্রের ঔচিত্য প্রতিষ্ঠায় এই ছবিগুলোর কোন ভূমিকা নেই। উল্টে ‘পি কে’ ধর্ম সম্বন্ধে এক প্রস্থ অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলে। ছ নম্বরে থাকা ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ আবার ভারত-পাকিস্তান শত্রুতার বদলে সৌহার্দ্যের বার্তা দেয়।
এদিকে ২০১৯-এ একগুচ্ছ সরকারি বয়ানের অনুগত ছবি মুক্তি পেয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল ব্যবসা করেছে ‘উরি: দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক’ (২৪৪.০৬ কোটি)৩, অথচ এই দশকের সবচেয়ে ভাল ব্যবসা করা ছবিগুলোর তালিকায় দশ নম্বরে থাকা ধুম থ্রি ও তার চেয়ে বেশি ব্যবসা করেছে। অবশ্য সর্বজন মান্য ফিল্ম ব্যবসার বিশ্লেষক তরণ আদর্শের তালিকায় ধুম থ্রি আছে ন নম্বরে, উরি দশে।
অজয় দেবগন অভিনীত ‘তানহাজি’৪, যেখানে হিন্দু-মুসলমান লড়াইয়ের কাহিনি আছে, তা অবশ্য তরণবাবুর মতে ২৭৫ কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য করেছে। তবু এই দশকের প্রথমে দশে ঢুকতে পারেনি।
শোচনীয় অবস্থা সুশান্তের সুবিচার তথা বলিউডের মাদকচক্রের পর্দা ফাঁস আন্দোলনের নেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াত নির্দেশিত ও অভিনীত (যিনি মহারাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর মাদক সেবনের উল্লেখ হওয়ার পরেই রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে মুম্বাই ছেড়েছেন) ‘মণিকর্ণিকা’৫ র। যাঁরা বলিউডের খবর রাখেন, তাঁরা জানেন যে অমন জাঁকজমকের ছবি বানাতে একশো কোটি খরচ হয়েই যায়। ‘মণিকর্ণিকা’র আয় কিন্তু ৯০.৭৬ কোটি।
সঙ্ঘ পরিবারের বর্ষীয়ান পোস্টার বয় অনুপম খেরকে মনমোহন সিং এর চরিত্রে রেখে ‘দি অ্যাকসিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ বলে একটা ছবি হয়েছিল। কোন সূত্রই ছবিটার আয় ৯৫-৯৬ কোটির বেশি হয়েছে বলছে না।
সবচেয়ে বেশি দুর্দশা অবশ্য বিবেক ওবেরয় অভিনীত ‘পি এম নরেন্দ্র মোদী’৬ ছবিটার। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের মুখে, প্রধানমন্ত্রীর উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তার মুহূর্তে মুক্তি পেয়েও ছবিটা ২৫ কোটির বেশি ব্যবসা করতে পেরেছে এমন কথা কোন সূত্র বলছে না।
স্পষ্টতই মনোগ্রাহী প্রোপাগান্ডা বলিউডে তৈরি হচ্ছে না। এমনকি বিজেপি সমর্থকদের সকলকেও আকর্ষণ করতে পারছে এইসব ছবি। তাতে আর্থিক ক্ষতির চেয়েও বড় ক্ষতি যা হচ্ছে তা হল ভারতীয় জনতার মস্তিষ্কের একচেটিয়া দখল ফসকে যাচ্ছে। কঙ্গনা, বিবেক, অজয়, অক্ষয়দের দিয়ে যে ও কাজ হবে না, তা নাগপুরের সঙ্ঘ বিল্ডিং রোড থেকে দিল্লির অশোকা রোড, রেসকোর্স রোড পর্যন্ত সকলেই বুঝে ফেলেছে। আমির বা সলমন লোককে যতটা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারেন, অজয় বা বিবেক পারেন না। রাজু হিরানি জানেন কেমন করে দর্শক টানতে হয়, সঙ্ঘের সঙ্গী পরিচালকরা জানেন না।
এটা শৈল্পিক উৎকর্ষের আলোচনা নয়। বক্স অফিসই বলে দিচ্ছে দক্ষিণপন্থী প্রোপাগান্ডিস্টরা বলিউডের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির লোক। প্রথম সারির লোকেদের দিয়ে সঙ্ঘ কিছুতেই নিজেদের কথা বলাতে পারছে না। তাঁরা স্বেচ্ছায় বা চাপে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সেলফি তুলে যাচ্ছেন, কিন্তু ফিল্ম বানানোর সময় নিজেদের মর্জি মতই চলছেন।
স্বীকার্য যে এ যুগের মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বিমল রায়, কে আসিফ, রাজ কাপুর বা দিলীপ কুমারদের ইন্ডাস্ট্রি নয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাণিজ্যিক ছবি করার সময়েও তাঁরা সচেতন ছিলেন যে নতুন দেশ গড়ে তুলতে তাঁদের সদর্থক ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। আজকের বলিউড নেহাত লাভ ক্ষতির হিসাবে চলে। কিন্তু তা নিয়ে উন্নাসিক না হলে টের পাওয়া যায় হিন্দুত্ববাদের প্রচ্ছন্ন প্রতিরোধ বলিউডে চলছে। তা না হলে প্রথম সারির নির্দেশক, অভিনেতাদেরই প্রোপাগান্ডা ফিল্ম বানাতে দেখা যেত। বিজেপির তো আর টাকার অভাব নেই। সম্ভবত আরো বেশি যা ঘটত, তা হল একের পর এক সূক্ষ্মতর দক্ষিণপন্থী অ্যাজেন্ডার ছবি তৈরি। তা হচ্ছে না। ফলে বলিউড সঙ্ঘ পরিবারের হতাশা ও আক্রোশের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুশান্তের মৃত্যুতদন্ত ক্রমে বলিউডে মাদক যোগের তদন্ত হয়ে দাঁড়াল কয়েক গ্রাম গাঁজার জন্য। এক টিভি চ্যানেল বলে দিল রিয়া নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর জিজ্ঞাসাবাদে আরো জনা বিশেক মাদকাসক্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাম জানিয়েছেন, তার মধ্যে জনা দুয়েকের নাম প্রকাশও করে দিল। অথচ এন সি বি বলছে এমন কোন নাম তারা রিয়ার কাছ থেকে পায়নি।৭ স্পষ্টতই এরকম ভুয়ো খবর ছড়ানোর পিছনে উদ্দেশ্য বলিউডে প্রতিষ্ঠিত কিন্তু, ক্ষমতাবানদের অপছন্দের ব্যক্তিদের এবং তাদের পরিবারকে সাধারণ মানুষের চোখে অপরাধী প্রতিপন্ন করা। ভেবে দেখুন, স্বজনপোষণ নিয়ে চেঁচামেচি করে কাদের আক্রমণ করা হয়েছে?
প্রথমত, করণ জোহর। নব্বইয়ের দশক থেকে এঁর তৈরি বিপুল জনপ্রিয় ছবিগুলো সঙ্ঘ পরিবারের সামাজিক আদর্শকে, ভারতীয়ত্ব ও দেশপ্রেমের সংজ্ঞাকে মানুষের মধ্যে চারিয়ে দিতে নিঃসাড়ে সাহায্য করেছে। কিন্তু তার সুবিধা বিজেপি ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই ফুরিয়ে গেছে। সফটওয়্যারের ভাষায় যাকে পরের প্রজন্ম বলে, সেই পরের প্রজন্মের প্রোপাগান্ডা ফিল্ম করণের প্রোডাকশন হাউস থেকে এখন অব্দি বেরোয়নি। বরং তিনি বা তাঁর প্রোডাকশন হাউস নাচ-গানওলা ছবিই করে যাচ্ছেন, এমনকি বিকল্প যৌনতার গল্পও ইদানীং উঠে আসছে তাঁর ক্যামেরায়। দুটোই সঙ্ঘের লক্ষ্যবিরোধী। করণ এমনিতে লক্ষ্মী ছেলে। পাকিস্তানের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যখন মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা বাদ দিতে বলেছিল, তিনি মেনে নিয়েছিলেন।৮ অথচ ২০১৮ তে মুক্তি পাওয়া ‘রাজি’ ছবির তিনি অন্যতম প্রযোজক। সে ছবিতে এমনকি পাক সেনাবাহিনীর লোকেদেরও রক্তমাংসের মানুষ হিসাবে দেখানো হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, মহেশ ভাট আর আলিয়া ভাট। আলিয়া সাধারণত রাজনীতি এড়িয়ে চলেন। কিন্তু তাঁর বাবা মহেশ বরাবরই সোচ্চার বিজেপিবিরোধী। মহেশের দোষ হল রিয়ার সঙ্গে তাঁর বেশ কিছু ছবি আছে, তাঁর প্রোডাকশন হাউসের সাথে রিয়ার যোগ আছে। এ ছাড়াও জাভেদ আখতার-ফারহান আখতার, নাসিরুদ্দিন শাহ।
এবং অনুরাগ। গত এক সপ্তাহে সুশান্ত ক্রমশ আলোচনার বাইরে চলে গেছেন। বাঙালিদের কেউ কেউ বাঙালি মেয়ে রিয়ার উপর আক্রমণে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এখন সে ক্ষোভের অভিমুখ ঘুরে যাবে অনুরাগ কাশ্যপের দিকে। আরেক বাঙালি অভিনেত্রী পায়েল ঘোষ অনুরাগের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন। অনুরাগ নাকি পায়েলকে যৌন সংসর্গে রাজি করাতে বেছে বেছে সোচ্চার বিজেপিবিরোধী অভিনেত্রীদের নাম (হুমা কুরেশি, রিচা চাড্ডা, মাহি গিল) করে বলেছেন তাঁরা অনুরাগকে নিয়মিত তৃপ্ত করেন। এই প্রথম বোধহয় কোন #মিটু অভিযোগে অন্য মহিলাদের নাম করা হল। প্রধানমন্ত্রীকে ট্যাগ করা পায়েলের টুইট দেখে অবিলম্বে অভিযোগ জমা দিতে বলেছে জাতীয় মহিলা কমিশন। এ হেন তৎপরতা সব মহিলার কাঙ্ক্ষিত হলেও, কার্যক্ষেত্রে তাঁরা ধর্ষিত হলেও না মহিলা কমিশনের মনোযোগ জোটে না ।
এই মুহূর্তে বিজেপিবিরোধী সকলেই আক্রমণের লক্ষ্য। সুতরাং যে পরিমাণ গাঁজা যে কোন মুহূর্তে নেহাত অনামী সাধুদের আখড়াতেও পাওয়া যায় অথবা অধুনা আই টি সেলের সদস্য হওয়া ইঞ্জিনিয়ারদের হোস্টেলে পাওয়া যেত, তা নিয়ে অক্লান্ত ত্রিমুখী তদন্ত এবং প্রতিদিন প্রাইম টাইম খাপিনার স্রেফ সুশান্তের প্রতি ভালবাসায় বা রিয়ার প্রতি ঘৃণায় চালিত --- একথা মেনে নেওয়া শক্ত।
কঙ্গনা রানাওয়াতের ৯ই সেপ্টেম্বর তারিখের একটা টুইট লক্ষ্য করার মত। ততদিনে তিনি বলে ফেলেছেন মহারাষ্ট্রের অবস্থা পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মত। উত্তরে মারাঠি অস্মিতার স্বনিযুক্ত অভিভাবক শিবসেনা অভব্য ভাষা ব্যবহার করেছে, বলেছে কঙ্গনা মহারাষ্ট্রকে অপমান করেছেন। প্রতিক্রিয়ায় কঙ্গনা কী টুইট করলেন?
“ইন্ডাস্ট্রির একশো বছরে এরা মারাঠি অস্মিতা নিয়ে একটাও ছবি বানাতে পারেনি, আমি মুসলিম অধ্যুষিত ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জীবন এবং কেরিয়ার বাজি রেখেছি, শিবাজি মহারাজ আর রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের সম্বন্ধে ছবি বানিয়েছি, আজ মহারাষ্ট্রের এই ঠিকেদারদের জিজ্ঞেস করো মহারাষ্ট্রের জন্য এরা করেছে কী?” (ভাষান্তর আমার)
এই টুইট থেকে পরিষ্কার যে কঙ্গনা জানেন না মারাঠি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পৃথক অস্তিত্ব আছে। বলিউড হিন্দি ফিল্ম তৈরির জায়গা, মারাঠি অস্মিতা নিয়ে ছবি করার দায়িত্ব তার নয়। কিন্তু এই টুইটে কঙ্গনার মেধার যে অভাব প্রকাশিত, তার দিকে নজর না দিয়ে বরং “মুসলিম অধ্যুষিত ইন্ডাস্ট্রি” কথাটায় মন দেওয়া যাক। বলিউড সম্বন্ধে কঙ্গনার তথা সঙ্ঘ পরিবারের প্রকৃত আপত্তি অনেকটাই ঐ শব্দবন্ধে ধরা আছে।
এক ভাষা, এক ধর্ম, এক রাষ্ট্রের যে ছবি সঙ্ঘ সকলের মাথায় ঢোকাতে চায়, সে ছবি বলিউডে এসেই বর্ণহীন হয়ে পড়ে। উপরে উল্লিখিত বক্স অফিসের যে হিসাব পাওয়া গেছে, তাতে পরিষ্কার যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর দেশে গত দশ বছরে সঙ্ঘের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য সত্ত্বেও আমির খান, সলমন খান জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে। আরেক খান --- শাহরুখ --- এখন আর তত ছবি করেন না, করলেও আগের মত হিট হয় না। তবু তাঁর তারকা চূর্ণের এক কণা গায়ে এসে পড়লে যে এখনো লক্ষ লক্ষ ভারতীয় হিন্দু আত্মহারা হন, তা মোহন ভাগবতও বিলক্ষণ জানেন। ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের সামনে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে সাষ্টাঙ্গ হয়েছে। দেশে সব ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের আরো প্রান্তিক, আরো ভীত এক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা গেছে। কিন্তু বলিউডে এখনো ভরদ্বাজ ব্রাক্ষ্মণ বিশালের সমান দাপটে (জনপ্রিয়তার নিরিখে বেশি দাপটেও বলা যায়) কাজ করে যাচ্ছেন কবীর খান। চাওলা জুহি আর তাঁর স্বামী মেহতা জয়ের সাথে মিলে প্রোডাকশন হাউস চালাচ্ছেন খান শাহরুখ। অন্তত এই একটা ব্যাপার প্রাক-স্বাধীনতা যুগের বলিউডের মতই রয়ে গেছে। উপরন্তু আগে যা কখনো হয়নি, নিম্নবর্গীয় মানুষের নিষ্পেষণ মধ্যে মধ্যে পর্দায় উঠে আসছে (‘আর্টিকল ফিফটিন’), ছোট শহরে আর এস এস - বিজেপির কার্যকলাপকে হাসির খোঁচায় এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে কোন কোন ছবি (‘লুকাছুপি’,‘দম লাগাকে হাইশা’)। ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইন্ডাস্ট্রিতে এমন বেনিয়ম চলতে থাকলে হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান নিরঙ্কুশ হবে কী করে?
তাই বিহার জয় বা মহারাষ্ট্র জয় আশু লক্ষ্য হলেও রাষ্ট্রীয় খাপের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অবশ্যই বলিউড জয়। নইলে সি বি আই তদন্ত চলাকালীন বিজেপি সাংসদ রবি কিষণ কেন সংসদে বলিউডের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে যাবেন? উদ্দেশ্য মহৎ বুঝলে একই দলের সাংসদ হয়েও হেমা মালিনী কেন বিপক্ষে দাঁড়াবেন? জয়া বচ্চনের অসন্তুষ্টি না হয় অগ্রাহ্য করলাম।
অন্যধারার লেখা প্রতীক বাবু আপনার থেকে, বেশ লিখেছেন। অন্যদিকে একটা সম্যক দৃষ্টি খুললো।..
ডুবে গিয়েছিল, তুললাম।
এইসব যা ধাষ্টামো চলছে সে তো অতি কুৎসিত। কিন্তু '...খাপ পঞ্চায়েত কেমনভাবে কাজ করে? প্রথমত, খাপ নিজেই নিজের আইন; দেশের আইন ফালতু। দ্বিতীয়ত, ওখানে অভিযুক্ত আর অপরাধী সমর্থক। অভিযোগের খতিয়ে দেখা হয় না, কী শাস্তি দেওয়া হবে তা ঠিক হয়। তৃতীয়ত, অপরাধ যে বা যারাই করে থাক, শাস্তি হয় গোটা পরিবারের। ...' - তাই কী?
তাছাড়া, দেশের আইনও আজকাল খুব একটা সুবিধের কাজ করছে না। রাম মন্দির, আরটিআই এইসব রায়, বা বিচার প্রক্রিয়ার লুপহোলে ফেঁসে থাকা প্রচুর লোকজন, ওদিকে আর্টিকল ৩৭০ নিয়ে গেন্ডুয়া খেলা, অনেক কিছুই আছে। জিয়া খানের প্রেমিকের(?) বহাল তবিয়তে থাকা আর রিয়া চক্রবর্তীর পুলিশ হেপাজত - এগুলোও দেশের আইনেই হলো।
প্রসঙ্গ থেকে সরে গেলাম, কিন্তু https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=18911 পড়তে পড়তে আরো মনে হলো।
লেখায় বেশ কিছু তথ্যপ্রমাদ আছে, এছাড়াও কিছু যুক্তি বেশ ঘাঁটা লাগল। কিছু R2h লিখেছেন, এছাড়াও আছে।
প্রয়োজনীয় লেখা। ধন্যবাদ।
আশু লক্ষ্য যে বিহার জয়, সে তত্ত্ব কিন্তু আর খাটছেনা। গত এক মাসের ডেভেলপমেন্ট তো সব তত্ত্বই ঘেঁটে দিচ্ছে, বিবিধ পক্ষেই। বিহার নির্বাচনে ইস্যু হলই না কেন?
এই জাস্টিস ফর সুশান্ত নিয়ে ক্রেজটা পুরোই বিজেপির তৈরি, নির্বাচন কি বলিউড দখলের লক্ষ্যে, এও অতিসরলীকৃত মনে হয়।