গত পর্বে এরদোগানের কথা লেখার সময় আমাদের ছোটোবেলায় পড়া ইন্দ্রজাল কমিক্সের ম্যানড্রেকের গল্পের দুষ্টুলোকের দল ‘আট’-এর কথা এসেছিল, এবং আমি হালকা চালে লিখেছিলাম যে এরদোগান আটে হাসতে হাসতে ঢুকে যাবেন। কথাটা মিথ্যা নয়, তবে আট মানে যদি আটটি অল্টরাইট রাষ্ট্রনায়কের টেবিল হয়, আর সেখানে যদি গোটা বিশ্ব থেকে বাছাই করা দুষ্টু দক্ষিণপন্থীদের এনে বসাতে হয়, তাহলে ব্যাপারটায় বেশ কড়া প্রতিযোগিতা হবে। বস্তুত, আমরা সাধারণ ভাবে খবরের শিরোনাম-নির্ভর ধারণায় যে-কটি দেশের উগ্র দক্ষিণপন্থার ঢক্কানিনাদ শুনতে পাই, একটু খতিয়ে দেখলে মনে হয় জল তার থেকে ঢের বেশি গভীর। গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণপন্থার ‘রেনেসাঁ’ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে1-4। ২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনের পর লেখা হয়েছিল অন্য আরও কারণের সঙ্গে গতানুগতিক রাজনীতির ওপর মানুষের অনাস্থা ফলাফলে প্রতিফলিত হয়েছে 5। কিন্তু সদ্যপ্রকাশিত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা এত সহজ নয়, অনাস্থাই যদি প্রধান কারণ হবে তাহলে সেই অনাস্থা আরও পল্লবিত হওয়ার কথা। শুধু যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরি, তাহলেও, সেখানে যুক্তি-পরম্পরায় বর্তমান রাষ্ট্রপতির পুনর্নিবাচন সম্ভব বলে মনে হত না, মানুষ যদি বিরক্ত বা ক্রুদ্ধ হতেন5। কিন্তু জুলাই মাসে দাঁড়িয়েও, মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় যথেচ্ছ অপদস্থ ও সমালোচিত, অর্থনীতির প্রায় কবরে ঢুকে যাওয়া অবস্থাতেও নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয় সম্পর্কে কেউই নিঃসন্দেহে নন। ভারতে নরেন্দ্র মোদীর পুনরায় প্রবল ভাবে নির্বাচিত হওয়া আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে কয়েক বছরের কুশাসনের ফলে মানুষ তাঁদের সিদ্ধান্ত পালটে ফেলবেন এরকম কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
এটা সমস্ত দিক থেকেই হাইজ্যাকিং-এর যুগ। নতুন প্রযুক্তি এসে যেরকম পুরোনো প্রযুক্তিকে সরিয়ে দেয়, ধীরে ধীরে গিলে নেয়, ঠিক সেই ভাবে নবকলেবরে আসা উগ্র দক্ষিণপন্থা গিলে নিয়েছে দক্ষিণপন্থার যে মূলধারাটি বইছিল তাকে। তার এমনকি এমনই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, যে তাকে মাঝেমধ্যে আদৌ দক্ষিণপন্থা বলেই মনে হয় না। ডান–বাম সরতে থাকায় মাপের দাগ সরে গেছে, মূলধারার দক্ষিণপন্থীরা এখন কোথাও কোথাও প্রায় সেন্ট্রিস্ট।
দুনিয়া জুড়ে কী চলছে, এটা জানা ছাড়া সাধারণ মানুষের হাতে এই মুহূর্তে তেমন কিছু করার নেই, যেহেতু নাগরিক প্রতিরোধের উপায়গুলিও ব্যাহত হচ্ছে কোভিডের জন্য। এই পরিস্থিতিতে এই আগ্রহ খুবই স্বাভাবিক যে পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে, কীভাবে রাজনৈতিক চালচিত্র পালটাচ্ছে। অন্তত খুব আবছা একটা ধারণা থাকার জন্যেও, আমরা সংক্ষিপ্ত আকারে সেগুলো একটু দেখে নিতে পারি। একটু খুঁটিয়ে দেখলে, বিশেষ করে শুধু জয়ী বা শাসকদলগুলি নয়, প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে যে দলগুলি এখন উঠে এসেছে, আমরা যদি তাদের কথাও খেয়াল রাখি তাহলে উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থান সম্পর্কে ধারণা আর-একটু স্পষ্ট হবে।
আমি এই লেখায় খেয়াল রাখার চেষ্টা করছি যাতে সেটা উগ্র জাতীয়তাবাদী দক্ষিণপন্থী বা তথাকথিত বাম বা লেফট-লিবেরাল ভাবাদর্শের দ্বারা হাইজ্যাকড না হয়ে যায়। এই প্রচেষ্টা এই কারণে নয় যে লেখাটি অরাজনৈতিক, সে সোনার পাথরবাটি গড়তে আমি বসিনি। এই প্রচেষ্টা এই জন্য যে দুই দিকের রাজনীতিতেই কিছু কিছু সমস্যার কথা আছে। অনুপাতে বেশি বা কম হতে পারে, কিন্তু এইসময়কে বুঝতে সবকটি সমস্যাকেই সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে হবে। কাজেই শুরুর আলগা কথোপকথনে আটের ভিলেনের সিটের জন্য যে লড়াই, সেখানে শুধু অতি-দক্ষিণপন্থীরাই নন, অনায়াসে বামেরাও থাকবেন। যথাসময়ে আমরা সে তালিকার দিকেও তাকাব।
কথা না বাড়িয়ে, আপাতত দক্ষিণপন্থার জাগরণ বুঝতে, এক এক করে মহাদেশের দিকে তাকাই আসুন। ইউরোপের কথাই ধরা যাক। ইতালির ম্যাটেও সালভিনি, জার্মানির টিনো খ্রুপালা, স্পেনের স্যান্টিয়াগো অ্যাবাস্কাল, ফ্রান্সের মেরিন লে পেন, সুইডেনের জিমি অ্যাকেসন, হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবান, অস্ট্রিয়ার সিবাস্টিয়ান কার্জ—শুধু ইউরোপ থেকেই সাতজন হেভিওয়েট নাম পাওয়া যাচ্ছে6-11। এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় এখনও আমরা ঢুকিনি, যদিও ইউরোপ এবং এশিয়া জুড়ে থাকা রাশিয়া (পুতিন) আরতুরস্ক (এরদোগান) ধরলে সংখ্যাটা নয়ে চলে যায়। ইউরোপের ছবিতে যে স্পষ্ট নামগুলো পাওয়া যাচ্ছে তার বাইরেও পড়ে আছে এমন কিছু দেশ, যেখানে উগ্র দক্ষিণপন্থার পুনরুত্থান ঘটেছে। ফিনল্যান্ডে অল্পের জন্য উগ্র দক্ষিণপন্থী দল সরকার করতে পারেনি। ভোটের ব্যবধান 0.2%। এস্তোনিয়ায় ২০১৫ সালে প্রথমবার নির্বাচনে কোন সিট পায় Conservative People's Party of Estonia (EKRE)। চারবছরের মধ্যে তাদের ভোট বেড়ে ১৮% হয়েছে, এখন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তৃতীয় স্থানে। পোল্যান্ডের রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থী পার্টি PiS 43.5% ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছে। স্লোভেনিয়ার SDS বাস্লোভেনিয়ান ডেমোক্রাটিক পার্টি ২০১৮ সালের নির্বাচনে সর্বাধিক (২৫%) ভোট পেয়েছে, যদিও তা সরকার গড়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না।12
ওপরে যেসমস্ত রাজনৈতিক দলের কথা বলা হল তাদের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য আছে। প্রায় সবকটি দলেরই শীর্ষনেতৃত্বে আছেন যাঁরা তাঁদের বয়স বেশ কম। জন্ম সাতের দশকে এঁদের অনেকেরই (খ্রুপালা, অ্যাবাস্কাল, স্যালভিনি, অ্যাকেসন)। লে পেন আর ওরবান ছয়ের দশক, আর কার্জ তো তেত্রিশ বছরের সদ্য যুবা। প্রায় সবকটি দেশেই অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। প্রায় সবকটি দলেরই রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় ইমিগ্রেশন-বিরোধী, ভূমিপুত্রদের জন্য সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সরিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি, বিশ্বায়নবিরোধী কর্মসূচি, সংখ্যালঘুদের ওপর চাপ সৃষ্টি এইসব রয়েছে। দেশে মুসলমান বেড়ে যাচ্ছে, দেশটি অল্পদিনেই ইসলামিক রাষ্ট্র হয়ে উঠবে এই আশঙ্কাও এজেন্ডায় রয়েছে কিছু ক্ষেত্রে। এর সঙ্গে রয়েছে অ্যান্টিলিবারালিজম। ভারতে বিজেপি যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়াকে প্রচারে ব্যবহার করেছে, উপরোক্ত প্রায় প্রতিটি দল পেশাদারি দক্ষতায় নিজ নিজ দেশে সেই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটিয়ে ফেলেছে। সুইডেনের জিমি অ্যাকেসনকে এই মেরুকরণ নিয়ে সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন মেরুকরণ হয়েই আছে, তিনি বরং (অ্যান্টিলিবারাল রাজনীতি দিয়ে) মেরুকরণের সমাধান খুঁজছেন13। অত্যন্ত সুবক্তা এই রাজনীতিক সাক্ষাৎকারে খুবই সহিষ্ণু ভাবে কথা বলেন। অথচ তাঁর দলের এক শীর্ষনেতা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেছেন, ভালো সুইডিশ আর খারাপ সুইডিশের লড়াই চলছে এবং হয় জয় অথবা মৃত্যু—এই দুয়ের বাইরে আর কোনো পথ খোলা নেই। এখন প্রশ্ন হল, কেন মানুষ এঁদের ভোট দিচ্ছেন, এঁদের কথা শুনছেন? শুধু সোশ্যাল মিডিয়া বা আইটি সেলের জুজু দেখিয়ে এতগুলো জায়গার নির্বাচনের ফলাফলকে ব্যাখ্যা করা যায় না।
এইখানে তাই, একটা কথা খুব স্পষ্ট করে বলার দরকার রয়েছে। ফার রাইট বা উগ্র দক্ষিণপন্থী দলের অ্যাজেন্ডায় যা আছে, সেইসব দলের মুখ্যনেতৃত্ব প্রথাগত লিবারাল সমাজের প্রতি যেসব অভিযোগগুলি করেছেন, বা নিজ নিজ দেশে তাঁরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন ও হচ্ছেন, সেগুলোর সবই মিথ্যাচার বা অতিরঞ্জন নয়। যেমন অর্থনৈতিক সংকট ও তজ্জনিত ধুঁকতে থাকা কর্মসংস্থান, উদ্বাস্তু সমস্যা, সেন্ট্রিস্ট আদর্শের মূলধারার রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্নীতি, বা একরকমের সাংস্কৃতিক যুদ্ধ, যা নিজদেশে মানুষকে পরবাসী করে দিচ্ছে। এগুলোর কোনোটাও গালগল্প নয়, সাধারণ মানুষ বলে যে বহুস্তরীয় পদার্থটিকে নেতারা ভোটব্যাংক ভাবেন, তারা এইসব সমস্যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে দেখতে পায়। কেন এই সমস্যাগুলি তাদের জীবনে মূর্তিমান উপদ্রবের মতো আসছে সে কথা ভাবতে গিয়ে তাদের অনেক সময়ই মনে হয় এইসব সমস্যার অনেকগুলোই জনবিস্ফোরণের ফল। জনবিস্ফোরণের ফল খুঁজতে গিয়ে তারা এমনকি এও ভেবে ফেলতে পারে যে তাদের দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বেশি করে বাচ্চার জন্ম দিচ্ছে, আবার ক্ষেত্রবিশেষে তারা এও ভাবতে পারে যে উদ্বাস্তুরা এসে গিয়ে তাদের এইসব সমস্যার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এমন নয় যে এইসব ভাবনাগুলো ঠিক সঠিক বা তথ্যনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ। এমনও নয় যে ফার রাইট তার প্রযুক্তি দিয়ে এইসব ধারণা তৈরিতে হাওয়া দেয় না। কিন্তু এই ধারণার অস্তিত্ব রয়েছে। এই ধারণাকে, এই ধারণা যে সমস্যার থেকে সৃষ্ট সেই সমস্যাকে অস্বীকার করে স্রেফ উগ্র জাতীয়তাবাদ খারাপ তাই তাদের ভোট দেওয়া অন্যায় এরকম বললে ওই ধারণা বদলায় না। বরং যাঁরা এসব বলবেন, তাঁদের প্রতি মানুষের আস্থা কমে গিয়ে তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন।
আমি ভারতবর্ষের এবং পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি এখানে একটা অদ্ভুত প্যারাডক্স তৈরী হয়। হ্যাঁ এই "ধারণাগুলো" রয়েছে। কিন্তু ঐ যে - "এমন নয় যে এইসব ভাবনাগুলো ঠিক সঠিক বা তথ্যনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ। এমনও নয় যে ফার রাইট তার প্রযুক্তি দিয়ে এইসব ধারণা তৈরিতে হাওয়া দেয় না" - এবারে এই ধারণাকে স্বীকার করতে গিয়ে যদি এইসব পর্যবেক্ষণকেও স্বীকার করতে হয়, তাহলেই তো আমি সেই শাইনিং ভক্তই হয়ে গেলাম। আবার উলটো বললেও নাকি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। অর্থাৎ শাখের করাত। কিম্বা আমড়াতলার মোড় - যেদিক দিয়েই যাও, ঘুরেফিরে আবার সেখানেই এসে পড়তে হবে।
Is acceptable lie better than harmful truth?