৫ জুলাই, ১৯৯১। সকাল। কুলেজিউ দ্য সাঁও জেরনিমুতে অশপিতাল ভায়েল্যিয়ায় পৌঁছে গাবিনেত দাশ রেলাসয়েঁশ ইন্তেরনাসিওনাইশ, মানে যে আপিসে বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের টিকি বাঁধা, খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। সেখানে গিয়ে কাগজপত্তর দেখাতেই জলপানির কড়কড়ে ছাপান্নহাজার পাঁচশো স্কুদুশ হাতে হাতে পাওয়া গেল; সঙ্গে আবার যেসব বাড়িতে পেয়িংগেস্ট রাখে সেইসব ঠিকানার একটা লিস্টি।
সকাল নটা থেকে একটা ক্লাস, তারপর একঘণ্টার লাঞ্চ, লাঞ্চের পর আবার চারটে অবধি ক্লাস। কোর্সের চারটে লেভেল আছে; প্রথমদিনেই একটা পরীক্ষা হয়েছিল, তাতে কার কতটা বিদ্যে দেখে বুঝে বিভিন্ন লেভেলে পাঠানো হয়েছে। আমি তো এসেছি পাঁচদিন দেরিতে, তাই নাতালিয়ার দেওয়া সার্টিফিকেট দেখে আমায় দ্বিতীয় লেভেল, এলেমেন্তার বে-তে পাঠিয়ে দেওয়া হল; মানে ধরে নেওয়া হল সামান্য হলেও ভাষাটার কিছুটা আমি জানি। তো এই দুদুভাতু লেভেলে লাঞ্চের পর আর কোনো ক্লাস নেই। ক্লাসে গেলুম, নানান দেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রী, পড়াচ্ছে ছোট্ট মেয়ে মারগারিদা বা গিদা। ক্লাসে আমরা সবাই-ই প্রায় ওর থেকে বড়ো। তখনও আমার বলভরসা জার্মান, নাতালিয়ার সঙ্গে ওই ভাষাতেই কথা বলতুম, এখানেও জার্মানভাষী মিখায়েল আর জ়িল্কির গা ঘেঁষে বসলুম।
ক্লাস শেষ করে সবাই মিলে খেতে গেলুম অশপিতাল ভায়েল্যিয়ার ওপরে কান্তিনাতে। বলতে ভুলে গেছি, নটায় ক্লাস শুরু মানে আসলে শুরু হবে সোয়া নটায়, পনেরো মিনিট তুলেরান্সিয়া। পরে দেখলুম পরীক্ষাতেও পনেরো মিনিট তুলেরান্সিয়া, মানে যখন শেষ হবার কথা তার পনেরো মিনিট পর শেষ হবে। আমি তো তাজ্জব! এরকম জিনিস বাপের জম্মে দেখিওনি, শুনিওনি। তার ওপর সোয়া নটায় ক্লাস শুরু হয়ে এগারোটায় ইন্তারভালু, নাকি সবাই ভোর ভোর (!) ক্লাস করতে আসতে হয় বলে ব্রেকফাস্ট সেরে আসতে পারে না, সেইজন্যেই ওই প্রায় আধাঘণ্টার বিরতি। কত কী যে নতুন জিনিস শিখলাম! স্পেনের ভালেন্সিয়া থেকে এসেছে দুটো কলেজে-পড়া মেয়ে, নিজেদের মধ্যে কাতালানে কথা বলে। ওদের সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল, বহুদিন আমাদের মধ্যে চিঠিচাপাটিও চলেছিল। ওদের কাছেই শুনলাম স্পেনে লোকে এগারোটায় ব্রেকফাস্ট খায় আর তিনটেয় লাঞ্চ; কুইম্ব্রায় এসে খাওয়ার সময়গুলো নিয়ে ওরা খুব অসুবিধেয় পড়েছিল। ওদের কাছে আরও শুনলুম যে ইন্ডিয়ান বলে যেমন কোনো ভাষা নেই তেমনি স্প্যানিশ বলেও আসলে স্পেনে কোনো ভাষা নেই; আমরা যাকে স্প্যানিশ বলি সেটা আসলে কাস্তেলীয় (কাস্তেইয়ানো/কাস্টিলিয়ান) ভাষা। বিভিন্ন স্বয়ংশাসিত অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষা, অবশ্য আমাদের হিন্দির মতোই কাস্তেলীয়রও দাদাগিরি আছে।
ক্লাসঘরের পাশেই করিডোরের শেষ মাথায় ছোট্ট ‘বার’ (পোর্তুগালে ক্যাফে আর বার সমার্থক), সেটা যে চালায় সেই অলিভিয়া আমার সব বৃত্তান্ত শুনে দোতোরা (doutora) বলে ডাকতে শুরু করে দিল। ১৯৯৬ সালে ওর সঙ্গে শেষ দেখা হওয়া অবধি ও আমাকে এইভাবেই সম্বোধন করে গেছে। কেন রে বাপু? আমি তো এখনও পিএইচডি শুরুই করিনি! না, ওদের নিয়ম অনুযায়ী লিসেন্সিয়াতুরা (বিএ) পাস করলেই ‘দোতোর/দোতোরা’। আর আমি তো এমএ পাস। পরে দেশে ফিরে শুনি গোয়ায় এই নিয়ে বিস্তর গণ্ডগোল–-পোর্তুগিজ় ভাবধারায় যারা বেড়ে উঠেছে (জন্ম ১৯৬১-র পরে হলেও) তারা বিএ পাস করেই নিজেদের নামের আগে ‘ডক্টর’ বসাতে থাকে।
যাইহোক, ১৯৯১ সালে এদেশে তো আজকের মতো ক্যাফের এত বাড়বাড়ন্ত ছিল না, আর এসপ্রেসো বলতে আমরা বুঝতাম বিয়েবাড়িতে মেশিনে ফেনা-তোলা দুধ-কফি। তাই বিকা আমার কাছে নতুন জিনিস বইকি! বেশ ভালোলাগল খেয়ে। তবে আমার পছন্দের জিনিস (আজও) হল গালাঁও—কাচের গেলাসে সিকিভাগ বিকা আর বাকিটা গরম দুধ। কতটা বিকা ঢালা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে এটা আবার তিনরকমের হয়—‘ক্লারা’ (হালকা/ফিকে) কম বিকা বেশি দুধ, ‘স্কুরু’ (গাঢ়/কড়া) হল বেশি বিকা আর ‘বাঁইস্কুরু’-তে (বেশ গাঢ়/কড়া), বলাই বাহুল্য, কফির ভাগ অনেক বেশি। গত তিরিশ বছর ধরেই আমার প্রিয় এই ‘বাঁইস্কুরু’। এখনও যখন লিশবোয়ায় থাকি আমার বিকেলের জলযোগ এই গালাঁও বাঁইস্কুরু, সঙ্গে কোনো একটা ‘বোলু’ বা কেক।
কতরকমের নতুন বোলুই তো দেখলাম প্রথমদিন ওই ছোট্ট বারে। চিরকালের পেটুক আমি, মনে হল এর প্রত্যেকটা খেয়ে দেখতে হবে। তারপরের চিন্তা কলকাতায় ফিরে এদের পাব কোথায়? তাই যখনই পোর্তুগাল যাই আশ মিটিয়ে খাওয়াদাওয়া করি—সেটা শুধু বোলুতেই আটকে থাকে না–-আর তাই সাতদিন থাকি বা দু-মাস, ওজন আমার কিলো পাঁচেক বাড়বেই। আর যাতে কলকাতাতেও এইসব বোলু খেতে পারি সেই আশাতেই চারবছর আগে নিজেই এগুলোকে বানিয়ে এই শহরে বিক্রি শুরু করি। তবে যেটা আমার সবচেয়ে প্রিয়, সেই পাশ্তেল দ্য নাতা (সরল ইংরিজিতে ক্রিম পেস্ট্রি, আজকাল মাকাউয়ে এগটার্ট নামে বিক্রি হয়) বানানোর স্পর্ধা বা দুঃসাহস কোনোদিনই আমার হবে না।
আসলে পোর্তুগালের কেক-পেস্ট্রি মাত্রেই খুব ভারী হয়, প্রচুর ক্যালোরিও থাকে, কারণ এগুলোতে প্রচুর ডিমের কুসুম দেওয়া হয়। আমার এক পুরোনো ছাত্রী বলেছিল যেহেতু কনভেন্ট বা মঠগুলোতেই এইসব রেসিপির উদ্ভব তাই নানেরা ডিমের সাদা অংশটা দিয়ে তাদের পোশাকে ‘মাড়’ দিত আর কুসুমটা বেঁচে যেত বলে সেগুলো পুরোটা দিয়েই নানারকম কেক-পেস্ট্রি তৈরি করত। হয়তো-বা তাই-ই। পাশ্তেল দ্য নাতা (পাশ্তেল দ্য বেলাঁই বলে লিশবোয়ার বেলাঁই অঞ্চলে বিক্রি হয়, আমি অবশ্য দুটোতে কোনো তফাত বুঝি না) হল খুব পাতলা পাফ পেস্ট্রির (মাসা ফুল্যিয়াদা) বাটিতে দোস দ্য ওভু (ডিমের কুসুম, দুধ আর ময়দা দিয়ে তৈরি কাস্টার্ড, এতে ভ্যানিলার বদলে সুগন্ধী হিসেবে লেবুর খোসা কুরিয়ে দেওয়া হয়) দিয়ে বেক করা হয়। শুনতে খুব সহজ কিন্তু ওই মিহি পাফ পেস্ট্রি বানাতে জান বেরিয়ে যাবে আর ওটি যদি যথেষ্ট মিহি না হয় তো সব মাটি। পোর্তুগালে তৈরি মাসা ফুল্যিয়াদা পাওয়া যায়, এখানে সহজে পাওয়া যায় না, গেলেও ভয়ংকর দাম, গুণগত মানও খুব একটা সুবিধের নয়।
যেটা খুব সহজেই এখানে করা যায় তা হল আরোশ দোস (arroz doce/মিষ্টি ভাত), যেটা অনেকটা চালের পায়েসের মতো। এটা ডিম দিয়েও হয়, আবার ডিম ছাড়াও হয়। আমার দুটোই ভালোলাগে। আমার বন্ধু সান্দ্রা একবার দোস দ্য ওভু দিয়েও করে খাইয়েছিল। সেটা ওর শাশুড়ির রেসিপি। আমার সেটাও বেশ ভালো লেগেছিল। আমি অবশ্য এখানে যখন করি ডিম ছাড়াই করি। সমস্যা একটাই, এর জন্য যে চালটা লাগে, সেই আরোশ কারলিনু এখানে পাওয়া যায় না। এই চাল (arroz carolino) হল খাঁটি পোর্তুগিজ় চাল, চাল দিয়ে পোর্তুগালের যে-কোনো রান্নাই এতে সবচেয়ে ভালো খোলে; এর বৈশিষ্ট্য হল মোটা মোটা দানা আর এর থেকে প্রচুর পরিমাণে মাড় বেরোয়। পোর্তুগিজ়দের ভাত রান্নার পদ্ধতি হল দু-ভাগ জল আর একভাগ চাল একসঙ্গে বসিয়ে দেওয়া, তারপর চাল সেদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে নেওয়া, ফ্যান গালা হয় না। অনেকে ভাত বসানোর সময়ে এক চিমটি নুন আর একদলা মাখন দেয় (আমি দিই)। তো এই চাল দিয়ে আরোশ দোস তৈরি করলে এর মাড়টা পায়েসটাকে ঘন থকথকে করে তোলে যেটা আমি অনেক চেষ্টা করেও আমাদের অন্য কোনো চাল দিয়ে করে উঠতে পারিনি।
আগ্রহীদের জন্য রেসিপিটাও দিয়ে দিলাম এখানে—
উপকরণ
২৫০ গ্রাম চাল, হাফ লিটার জল, দেড় লিটার দুধ, ৩০০ গ্রাম চিনি, ২৫ গ্রাম মাখনের দুটো টুকরো, দারচিনির বড়ো টুকরো দুটো, দুটো লেবুর খোসা, হাফ চা-চামচ নুন, তিনটে কুসুম আর সেগুলোকে ফেটানোর জন্য একটু দুধ, দারচিনি গুঁড়ো।
রান্না
ডেকচিতে জল আর নুনটা দিয়ে ফুট ধরলে চালটা ছাড়তে হবে। কাঠের হাতা দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে ঢিমে আঁচে বসিয়ে রাখতে হবে, জলটা শুকোলে লেবুর খোসাগুলো, দারচিনি দুটো, একটা মাখন আর দুধটা দিয়ে দিতে হবে। সব কিছু ভালো করে মিশিয়ে আধঘণ্টা মতো ঢিমে আঁচে বসিয়ে রাখতে হবে; মাঝে মাঝে নাড়তে হবে যাতে চালটা তলায় লেগে না যায়। মিনিট কুড়ির মাথায় চিনিটা দিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে। চালটা সেদ্ধ হয়ে গেলে ডেকচিটা নামিয়ে বাকি মাখনটা মেশাতে হবে। সবশেষে সামান্য দুধ দিয়ে ফেটানো কুসুম তিনটে খুব সাবধানে আস্তে আস্তে মেশাতে হবে যাতে সেগুলো গরমে সেদ্ধ হয়ে গিয়ে দলা না পাকিয়ে যায়। এরপর ডেকচিটা আবার ঢিমে আঁচে চড়িয়ে মিনিট দু-তিন নাড়তে হবে যাতে আরোশ দোসটা বেশ ঘন হয় আর কুসুমগুলোও কাঁচা না থাকে। নামিয়ে লেবুর খোসা আর দারচিনির টুকরোগুলো তুলে ফেলে দিতে হবে। ঠান্ডা করে বাটিতে ঢেলে তার ওপরে দারচিনির গুঁড়ো ছড়িয়ে পরিবেশন করতে হবে।
এই আরোশ দোস প্রায়ই দিত ক্যান্টিনে। লাঞ্চে সবই তো নতুন খাবার। স্যুপ, মাছ বা মাংসের একটা পদ আর সোব্রমেজ়া মানে ডেজ়ার্ট। সোব্রমেজ়ায় থাকত আরোশ দোস কিংবা ফল—একফালি খোরবুজা কি তরমুজ নয়তো বিশাল একথোকা আঙুর। স্যুপগুলোও নতুন ধরনের, খুব ভারী কারণ ওগুলোতে প্রচুর আলু থাকে। মাছও থাকত নানারকম, মাংসের মধ্যে শুয়োরই বেশি; নতুন যা খেয়েছিলাম তা হল লুলা বা স্কুইড। প্রথমটা রাবারের মতো ছিবড়ে লাগলেও অসম্ভব ভালো লেগেছিল।
বাকাল্যিয়াউ: শুঁটকি (ওপরে) ও সিদ্ধ
এখানে দেখে নিতে পারেন বাকাল্যিয়াউ রান্নার একটি পদ্ধতি—
আরও একটা নতুন খাবার, দামি বলে খুব কমই দিত, তা হল বাকাল্যিয়াউ (bacalhau) বা কড মাছের শুঁটকি। এটা হল পোর্তুগালের জাতীয় খাবার; এর নাকি হাজাররকম রেসিপি আছে। পোর্তুগালে বড়োদিনের খানার মূল আকর্ষণ হল বাকাল্যিয়াউ সেদ্ধ। প্রথমদিন লাঞ্চের পর লিস্টি হাতে নিয়ে ঘর খুঁজতে বেরোলুম।
(ক্রমশ...)