
দক্ষিণ ইওরোপের আইবেরিয়ান উপদ্বীপের দেশ। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্য, মধ্যযুগীয় মুসলমান শাসন, প্রাক-আধুনিক ঔপনিবেশিক শক্তি, আধুনিক কালে দীর্ঘ স্বৈরতন্ত্র ও পরে গণতন্ত্রের মিশ্রণে বিচিত্র রঙিন সংস্কৃতি। ঠিক পর্যটক হয়ে সাইট-সিয়িং নয়। কখনও শিক্ষার্থী, পরে তরজমাকার হয়ে এ দেশের নানা শহরের অন্দরমহলে উঁকি-ঝুঁকির অভিজ্ঞতা। এ কিস্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়-শহর কুইম্ব্রা। ঋতা রায় উনিভির্সিদাদ দ্য কুইম্ব্রায় যেতে হলে জার্দিঁ বুতানিকুর সামনে যে বাসস্টপ সেইখানে ত্রলেই বা ট্রলিবাস থেকে নেমে দু-পা হেঁটে গিয়ে বাঁদিকে ঘুরতে হয়, তারপরেই আকুয়াদুতু বা আর্কু দ্য জার্দিঁর খিলানগুলোর তলা দিয়ে ডানদিকে বেশ খানিকটা খাড়াই উঠে যেতে হয়।
আকুয়াদুতুটা প্রথমে তৈরি হয়েছিল রোমানদের সময়ে, পরে ১৫৮৩ সালে দঁ সেবাস্তিয়াঁওয়ের রাজত্বকালে বোলোন্যিয়ার ইঞ্জিনিয়ার ফিলিপ্পো তেরজ়ি এটার ধ্বংসস্তূপের ওপরেই এখন যেটা রয়েছে সেটাকে তৈরি করেন। খিলানগুলোর তলা দিয়ে আপনি গটগটিয়ে হেঁটে পার হয়ে যেতেই পারেন গন্তব্যে পৌঁছতে। কিংবা, দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে হিম পাথরের স্ল্যাবগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে শিহরিত হতে পারেন। শিহরিত হতে পারেন এই কারণেই যে নিজের ইচ্ছে মতো বিপুল পরিমাণ জলরাশি একজায়গা থেকে বহু দূরবর্তী আর-এক জায়গায় বইয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রাচীনতম প্রযুক্তির নিদর্শন এই আকুয়াদুতু। তাতে পাম্প লাগে না, কাজেই বিদ্যুৎ লাগে না, জীবাশ্ম জ্বালানি লাগে না, কোনো দূষণ নেই। শুধু মাধ্যাকর্ষণ এবং জলের চাপের জটিল গণিত স্থাপত্যবিদ্যায় কাজে লাগিয়ে তৈরি হত এইসব আকুয়াদুতু। আবার, ভূগর্ভস্থ জল নয়, ভূতলের জল— যেমন সরোবর বা ঝরনার জলই ব্যবহৃত হত এই ব্যবস্থায়। ৩১২ পূর্ব সাধারণাব্দে, মানে আজ থেকে দু-হাজার তিনশো বছর আগে রোম শহরে তৈরি হয় প্রথম আকুয়াদুতু, তারপর ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সারা সাম্রাজ্য জুড়ে। একেবারে প্রাক-আধুনিক কাল পর্যন্ত সারা ইওরোপ জুড়ে ব্যবহৃত হয়েছে এই প্রযুক্তি। তাক লাগানো এই প্রযুক্তি নিয়ে একটা গোটা কেতাবই লেখা যেতে পারে, তা হয়েওছে। কিন্তু এখানে সে প্রসঙ্গ আর না বাড়িয়ে বরং ছোটো করে দেখে নেওয়া যেতে পারে এই ভিডিওটা—
এমনই একটি আকুয়াদুতু ছিল কুইম্ব্রাতেও। মুশ্তাইরু (মঠ) দ্য সান্তা’আনা আর কুইম্ব্রার কেল্লা, এই দুই পাহাড়ি এলাকার মধ্যে যে নীচু জায়গাটা সেইটা জুড়ে থামের ওপর এর তেইশটা খিলান জল বয়ে নিয়ে যেত।
কুইম্ব্রার আকুয়াদুতুর খিলানের সারি
এখন অবধি আকুয়াদুতুটা বহাল তবিয়তে রয়ে গেলেও কেল্লাটা আর নেই, সেটার যেটুকু পড়েছিল তা-ও ১৭৭৩ সালে ভেঙে ফেলা হয় ওই জায়গাতে ইউনিভার্সিটির মানমন্দির বানানো হবে বলে। সেটা অবশ্য শেষঅবধি ইউনিভার্সিটির উঠোনেই অনেক ছোটো করে তৈরি করা হয়েছিল।
মধ্যযুগে এই শহরের দুটো ভাগ ছিল—সিদাদ আলতা বা আলমেদিনা, যেখানে অভিজাত বংশের লোকেরা আর ধর্মযাজকেরা থাকতেন; ষোলো শতক থেকে ইউনিভার্সিটির ছাত্ররাও ওখানেই থাকত। ভালো কথা, প্রাচীন এই শহরের পত্তন হয় প্রথম রোমান সম্রাট সিজ়ার অগুস্তুসের রাজত্বকালে, মানে ২৭ পূর্ব সাধারণাব্দ থেকে ১৪ সাধারণাব্দের কোনো এক সময়ে। তখন এর নাম ছিল এমিনিউম। পরে এ শহর কাছেই কোনিম্ব্রিগা নামক বিশাল জনপদের অধীনে আসে রোমান আমলেই, সেই থেকেই কুইম্ব্রা। আর এই আলমেদিনা নামটি আরবি, কারণ অষ্টম শতকের গোড়াতেই এখানে ইসলামি শাসন স্থাপিত হয় বেশ কয়েক শতকের জন্য।
শহরটার অন্য অংশটার নাম, সিদাদ বাইশা, যেটা ছিল ব্যাবসাবাণিজ্য আর কারুশিল্পের জায়গা। কুইম্ব্রায় ঘুরে বেড়ানোর একটা মজাই হল, পদে পদে প্রাচীন, মধ্যযুগ আর অত্যাধুনিকের মধ্যে যাতায়াত। বহু জায়গায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হয় এক্কেবারে মধ্যযুগে এসে পড়েছি। কেল্লার চিহ্ন হিসেবে আজ যা পড়ে আছে তা হল তার প্রাকারের কিছুটা আর প্রাকারের গায়ের দুটো মিনার, তর দা আলমেদিনা আর তর দ্য আন্তু। সেকালের ওই সিদাদ বাইশা হল আজকের বাইশা। পোর্তুগালের যে-কোনো শহরের বাণিজ্য এলাকাকেই আজকাল বাইশা বলা হয়ে থাকে আর আজকের কুইম্ব্রার বাইশার প্রধান রাস্তা রুয়া ফেরাইরা বর্জেশর ধারে তর দা আলমেদিনা আর তাতে ঢোকার দরজা পর্তা দা আলমেদিনা।
এককালে এটাই ছিল আলমেদিনা বা পুরোনো শহরে ঢোকার প্রধান দরজা। এই মিনারের মাথার দুটো টারেট পরে কোনো একসময়ে একটা আর্চ বা খিলান দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে এই মিনারকে নানান কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। পঁচিশ বছর আগে এখানে পৌরনিগমের ঐতিহাসিক মহাফেজখানা ছিল। তর দ্য আন্তু তুলনায় ছোটো। এটা একসময়ে বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হত আর এখানেই উনিশ শতকের বিখ্যাত কবি আন্তনিউ নোব্র (১৮৬৭-১৯০০) ছাত্রাবস্থায় থাকতেন। সেইজন্যেই এর নাম তর দ্য আন্তু বা আন্তুর মিনার। এখন এখানে নূক্লিউ মুজ়েউলজিকু দা মেমরিয়া দা শ্ক্রিতা।
কুইম্ব্রা ইউনিভার্সিটির জার্দিঁ বুতানিকু তৈরি শুরু হয় ১৭৭৪ সালে, মুজ়েউ দ্য শ্তরিয়া নাতুরালের অঙ্গ হিসেবে। আর্কু দ্য জার্দিঁর খিলানগুলোর তলা দিয়ে ইউনিভার্সিটির দিকে ওঠার পথে বাঁদিকে জার্দিঁ বুতানিকুর উঁচু পাঁচিল আর ডানদিকে পরপর রেপূবলিকা। এই ইউনিভার্সিটি যখন ১৫৩৭ সালে পাকাপাকি ভাবে কুইম্ব্রাতে থিতু হল তখন দূর দূর থেকে ছেলেপুলেরা এখানে পড়তে আসত, দেশের একমাত্র ইউনিভার্সিটি বলে কথা!
কুইম্ব্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশ
তো তারা থাকবে কোথায়? আজকাল যেরকম সারা শহর জুড়ে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার ব্যবস্থা আছে সেই যুগে তো তা ছিল না; তাই একই গ্রাম বা শহর থেকে আসা ছাত্ররা সবাই মিলে ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি একটা বাড়ি ভাড়া নিত। একদল ছাত্র পাস করে বেরিয়ে গেলে আর-একদল তাদের জায়গায় আসত, ব্যবস্থা সব একই থাকত। এই এক একটা বাড়িকে রেপূবলিকা বলা হয়; তাদের বিভিন্ন নামও আছে। বছর পঁচিশ আগে অবধিও রেপূবলিকাগুলো রমরমিয়ে চলত। তাদের বিচিত্র সব নিয়মকানুন হত; যে সবচেয়ে পুরোনো বাসিন্দা, সে হত প্রেসিডেন্ট; যারা নতুন, তাদের গানবাজনা করে পুরোনোদের খাবার সময়ে মনোরঞ্জন করতে হত। সিদাদ উনিভির্সিতারিয়ার বাসস্টপ থেকে ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে যাবার পথে এরকম বেশ কয়েকটা রেপূবলিকা পড়ে। বলাই বাহুল্য বাড়িগুলো সব সেই ষোলো/সতেরো শতকের। খাড়াই পথটা উঠে গিয়ে শেষ হচ্ছে একটা চ্যাটালো জায়গায়, যার মধ্যিখানে দন্ দিনিশের মূর্তি।
মূর্তির বাঁহাতি রাস্তাটা আবার নেমে গিয়ে কুরাইয়ুশ বা পোস্টাপিসে শেষ হয়েছে। আর ডানদিকে নেমে গেছে একশো পঁচিশটা সিঁড়ির শ্কাদাশ মুনুমেন্তাইশ; প্রথম ধাপটার মাথায় ছোট্ট একটা ঘর— পোশ্তু দ্য তুরিশ্মু। মূর্তির পেছনে দু-ধারে সার সার আখাম্বা সব ইমারত—ফাকুলদাদ দ্য ফার্মাসিয়া, ফাকুলদাদ দ্য মাতমাতিকা, দিপার্তামেন্তু দ্য ফীজ়িকা, দিপার্তামেন্তু দ্য কীমিকা, ফাকুলদাদ দ্য মেদিসিনা; এক্কেবারে শেষ মাথায় মুখোমুখি ফাকুলদাদ দ্য লেত্রাশ আর বিবলিউতেকা জেরাল; এদুটোর মাঝখানে, দন্ দিনিশের মূর্তির সমান্তরালে আছে পর্তা ফেরেয়া (লৌহকপাট), পাসুশ দাশ শ্কলাশ বা ইউনিভার্সিটির ঐতিহাসিক ভবনে ঢোকার দরজা, ওই দরজা দিয়ে ঢুকে বিশাল এক উঠোনের তিনদিক ঘিরে আছে ভিয়া লাতিনা, রেইতরিয়া মানে রেক্টরের আপিস, ফাকুলদাদ দ্য দিরাইতু বা ল ফ্যাকাল্টি, বিবলিউতেকা জুয়ানিনা আর কাব্রা (ছাগলি) মানে ইউনিভার্সিটির ঘড়ি লাগানো মিনার।
একেবারে প্রথমদিকের ছাত্ররা রেগে গিয়ে এর নাম দেয় কাব্রা বা ছাগলি কারণ খুব ভোরে এই ঘড়ির ঢংঢং আওয়াজেই তাদের ঘুম থেকে উঠে পড়তে হত। ষোলো-সতেরো শতকের বা আরও প্রাচীন এইসব নিদর্শনের মধ্যে দন্ দিনিশের মূর্তির পেছনে দু-পাশে সারি দিয়ে ফাকুলদাদগুলোর আখাম্বা বাড়িগুলোকে বড্ড দৃষ্টিকটু লাগে। এগুলো তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম স্বৈরতন্ত্র (১৯২৮-১৯৭৪) শ্তাদু নোভুর সময়ে। বিশাল বিশাল ছ-সাততলা বাড়ি, তার গায়ে বিশাল বিশাল মূর্তি, না আছে কোনো ছিরি না কোনো ছাঁদ। একশো পঁচিশটা সিঁড়ির শ্কাদাশ মুনুমেন্তাইশও তাই। ওই সিঁড়িগুলো দিয়ে নেমে বাঁহাতে আসোসিয়াসাঁও আকাদেমিকা দ্য কুইম্ব্রা (আআসে) মানে ইউনিভার্সিটির ছাত্রসংসদের বিশাল ছড়ানো চারতলা বাড়ি। তার একদিকে দু-তিনতলা জুড়ে বেশ কয়েকটা ক্যান্টিন; তারপর আছে একটা অডিটোরিয়াম, তিয়াত্রু আকাদেমিকু দ্য জিল ভিসেন্ত, একটা বইয়ের দোকান, ইউনিভার্সিটির দুটো গানবাজনার দল, অর্ফেয়ন আকাদেমিকু দ্য কুইম্ব্রা আর তুনা আকাদেমিকা দ্য কুইম্ব্রা-র অফিস আর রিহার্সালের ঘর; এ ছাড়াও আরও বিভিন্ন ক্লাবের ঘর। মুনুমেন্তাইশ থেকে নেমে ডানদিকে কান্তিনা আমারেলা মানে হলুদ ক্যান্টিন, এখানে ছাত্রছাত্রীরা পার্ট-টাইম কাজ করতে পারে।
১৯৯১ সালের ৫ জুলাইয়ের সকালে আমাকে যেতে হবে ফাকুলদাদ দ্য লেত্রাশের গাবিনেত দাশ রেলাসয়েঁশ ইন্তেরনাসিওনাইশে। সেটা কিন্তু ইউনিভার্সিটির পুরোনো যে হাসপাতালটা ছিল কুলেজিউ দ্য সাঁও জেরনিমুতে, সেইখানে। পাঁচ বছর হল বিশাল নতুন হাসপাতাল তৈরি হয়েছে এই ক্যাম্পাস বা পলু ১ থেকে বেশ কিছুটা দূরে, সেলাশে। সেই থেকে এই খালি হয়ে-যাওয়া পুরোনো হাসপাতাল বা অশপিতাল ভায়েল্যিয়ায় লেত্রাশের কিছু কিছু ক্লাস হয়। ওই পোশ্তু দ্য তুরিশ্মুর গা বেয়ে একটা রাস্তা উঠে গেছে অশপিতাল ভায়েল্যিয়ার দিকে। আর এই রাস্তার ওপাশেই বিশাল ফাকুলদাদ দ্য মেদিসিনা। আগের দিন রাত সাড়ে দশটায় প্রথমবার কুইম্ব্রায় এসে পৌঁছেছি। মেরে কেটে তিন মাস ক্লাস করে পেটে যেটুকু পোর্তুগিজের বিদ্যে তা লিশবোয়ার হুম্ব্যার্তু দেলগাদু বিমানবন্দরে নেমে একে ওকে তাকে জিজ্ঞেস করে ৯০ নম্বর বাস ধরে সান্তা’পুলনিয়া (Santa Apolónia) ইস্টিশানে পৌঁছে কুইম্ব্রার টিকিট কেটেই শেষ হয়ে গেছে। তারপর ট্রেনে উঠেও তো একে তাকে থেকে থেকেই জিজ্ঞেস করেছি কুইম্ব্রা কখন আসবে।
তাই ট্রেন থেকে নেমেই জনে জনে “ফালা ইংলেশ? ফালা ইংলেশ?” জিজ্ঞেস করতে করতে প্ল্যাটফর্মের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছি। তার ওপর সন্ধে হয়ে আসছে (হ্যাঁ, জুলাই মাসে কুইম্ব্রায় আঁধার নামতে নামতে এগারোটা বেজে যায়), কোলকাতা থেকে রওনা হবার আগে সব্বাই পইপই করে বলে দিয়েছে সাবধানে চলাফেরা করতে, জলদস্যুদের দেশ বলে কথা! অত রাতে কোথায় যাব কিচ্ছু জানা নেই, সকাল হলে না হয় ইউনিভার্সিটি যাব কিন্তু রাতটা কাটাই কোথায়? শেষমেশ অবশ্য ঝরঝরে ইংরিজি বলতে-পারা একজোড়া কর্তাগিন্নির দেখা মিলল। সেটা যে সেই সময়ে একেবারেই অমাবস্যার চাঁদ সেটা মালুম পড়ল আজ, ঘর খুঁজতে গিয়ে। আপাতত কর্তাগিন্নি আর তাদের দুই ছানাপোনার সঙ্গে গাড়িতে করে রাতটুকু কাটানোর মতো একটা আস্তানার খোঁজে চললুম। যেতে যেতে বেশ খানিক গল্প হল, জানা গেল শহরের ‘পেট্রন সেন্ট’ রাইন্যিয়া সান্তা ইজ়াবেলা-র পরবের দিন বলে কুইম্ব্রাতে এই দিনটা ছুটি থাকে। তাই সুযোগ বুঝে গিন্নি লিশবোয়াতে একটা কাজে গিয়েছিলেন, সন্ধের ট্রেনে ফিরেছেন, কর্তা আর ছানাপোনারা গাড়িতে করে তাঁকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছেন। তেনারা তো আমায় নিয়ে এই হোস্টেল সেই হোস্টেল চক্কর কেটেই চলেছেন, কিন্তু কোথাও আর ঠাঁই মেলে না, সেটা যে পরীক্ষার মাস, সব হোস্টেল ভরতি। শেষটা প্রায় বারোটার সময়ে শহরের পেনিতেন্সিয়ারিইয়া-র (গোদা বাংলায় জেল) কাছে একটা কনভেন্টের গেস্টহাউসে জায়গা পাওয়া গেল। একদিনের ঘরভাড়া বারোশো শ্কুদুশ, সঙ্গে ব্রেকফাস্ট ফ্রি। সেকালে ১ শ্কুদুশ = ৫ টাকা, তাতে অবশ্য কিছু বোঝা যায় না কারণ তিরিশ শ্কুদুশে একটা বীকা মিলত কেবল, তার কমে আর কিছু পাওয়া যেত না। আজকাল এদেশের ক্যাফেগুলোতে এস্প্রেসো বলে যা পাওয়া যায় বীকা হল গিয়ে তাই-ই। পোর্তুগালে বিভিন্ন জায়গায় তার বিভিন্ন নাম; কুইম্ব্রা আর লিশবোয়ায় বলে বীকা, (উ) পোর্তুতে বলে সিম্বালিনু, অবশ্য সবজায়গাতেই কাফে বলা চলে। যাইহোক, সকাল হতে না হতেই চান টান সেরে, ব্রেকফাস্ট করে টুটাফুটা পোর্তুগিজে নানেদের কাছ থেকে ইউনিভার্সিটি যাবার পথের সুলুকসন্ধান নিয়েই রওনা দেওয়া গেল। ও মা! এ তো মোটে মিনিট দশেকের হাঁটাপথ। জেলখানার পাশ দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গিয়েই সামনে ওই জার্দিম বুতানিকুর গায়ে লাগা বাসস্ট্যান্ডটা।
তিরিশ বছর আগে কুইম্ব্রাতে আমি কি করছিলুম? আর কুইম্ব্রাই বা কোথায়? কুইম্ব্রা (Coimbra) মধ্য পোর্তুগালের ছোট্ট একটা শহর, স্বাধীনতার (১১২৮) পর ১২৫৫ অবধি দেশের রাজধানী ছিল, দক্ষিণ থেকে বেরবেরদের তাড়ানোর পর রাজধানী লিশবোয়ায় চলে যায়। এ ছাড়া স্বাধীন পোর্তুগালের ছ-নম্বর রাজা ত্রুভাদোর দন্ দিনিশ ১২৯০ সালে উনত্রিশ বছর বয়সে দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন; প্রথমটা হল ল্যাটিনের বদলে গালাইকো-পুর্তুগেশকে (তখনকার কথায় ভির্নাকুলার) রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে চালু করা আর দ্বিতীয়টা হল সেবছরের পয়লা মার্চ শ্তুদুশ জেরাইশের প্রতিষ্ঠা করা। এই শ্তুদুশ জেরাইশই হল আজকের উনিভির্সিদাদ দ্য কুইম্ব্রা, ইউরোপের সবচেয়ে পুরোনো ইউনিভার্সিটিগুলোর একটা। এটা প্রথমদিকে কুইম্ব্রা আর লিশবোয়ার মধ্যে যাতায়াত করতে করতে ১৫৩৭ সাল থেকে পাকাপাকি ভাবে কুইম্ব্রাতেই থিতু হয়। এখানেই ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে পোর্তুগিজ় ভাষা ও সংস্কৃতির একমাসের সামার কোর্স করতে গিয়েছিলাম। তারপর আবার পরের বছর অক্টোবরে যাই একবছরের টিচার্স ট্রেনিং কোর্স করতে। ভারী সুন্দর শহর, দার্জিলিং আর শান্তিনিকেতনকে মেলালে যা দাঁড়াবে তিরিশ বছর আগে কুইম্ব্রা ছিল ঠিক তাই।
এদেশ থেকে পোর্তুগাল যাবার আজও ওই একটিই সমস্যা—সোজাসুজি কোনো ফ্লাইট নেই, তৃতীয় কোনো দেশ ঘুরে যেতে হয়। ঠিকঠাক কানেকশান পেলে কলকাতা থেকে লিশবোয়া ২০-২১ ঘণ্টার মামলা। যাইহোক, আমি প্রথমে গিয়েছিলাম ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের সন্ধের ফ্লাইট ধরে দিল্লি, পরদিন ভোরে প্যানঅ্যামে করে ফ্রাঙ্কফুর্ট, সেখানে ঘণ্টা তিনেক পর তাপ (TAP – বোম্বেটেদের সরকারি এয়ারলাইন্স, ওদের মধ্যে যারা ইংরিজি জানে তারা বলে টেক অ্যানাদার প্লেন) ধরে লিশবোয়া। ওইখানেই শেষ নয়, আমায় তো আবার ট্রেন ধরে যেতে হয়েছিল সেই কুইম্ব্রায়। প্যাসেঞ্জার ট্রেনে লাগে চার ঘণ্টা, আলফায় (এখন আলফা পেন্দুলার) লাগে আড়াই ঘণ্টা। নাতালিয়া আমায় অতশত বলেনি। খালি বলেছিল এয়ারপোর্ট থেকে ৯০ নম্বর বাস ধরে সান্তা’পুলনিয়া স্টেশনে গিয়ে পোর্তুর ট্রেন ধরে কুইম্ব্রায় নামতে হবে। তারপর কুইম্ব্রায় নেমে সো-ও-ও-জা ইউনিভার্সিটি। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে যেটা ঘটেছিল সেটা ওপরেই বলেছি। আলফা পাইনি, প্যাসেঞ্জার ট্রেন চারঘণ্টা লাগিয়েছিল।
(ক্রমশ...)
ঋতা রায় | 2409:4060:208d:2ead::2879:***:*** | ২৫ মার্চ ২০২১ ০৭:৫৪104030কোনিম্ব্রিগা নয়, কুনিম্ব্রিগা। রিকনকিশ্তা ক্রিশ্তার ফলে১০৬৪ সালে বেরবের বা মূরদের কুইম্ব্রা অঞ্চল থেকে সরে যেতে হয়। আর ১২৪৯ সালে দেশের দক্ষিণতম বিন্দু ফারু থেকে হঠিয়ে দেয় স্বাধীন পোর্তুগাল রাজ্যের পঞ্চম রাজা তৃতীয় দন্ আফন্সোর সৈন্যদল। তৃতীয় দন্ আফন্সোই প্রথম রাই দ্য পুর্তুগাল ই দু আলগার্ভ।
ঋতা রায় | 2409:4060:208d:2ead::2879:***:*** | ২৫ মার্চ ২০২১ ০৭:৫৪104029কোনিম্ব্রিগা নয়, কুনিম্ব্রিগা। রিকনকিশ্তা ক্রিশ্তার ফলে১০৬৪ সালে বেরবের বা মূরদের কুইম্ব্রা অঞ্চল থেকে সরে যেতে হয়। আর ১২৪৯ সালে দেশের দক্ষিণতম বিন্দু ফারু থেকে হঠিয়ে দেয় স্বাধীন পোর্তুগাল রাজ্যের পঞ্চম রাজা তৃতীয় দন্ আফন্সোর সৈন্যদল। তৃতীয় দন্ আফন্সোই প্রথম রাই দ্য পুর্তুগাল ই দু আলগার্ভ।
kk | 97.9.***.*** | ২৫ মার্চ ২০২১ ০৯:০৫104031বেশ লাগলো। চলতে থাকুক। পর্তুগীজ ভাষাটা বেশ খটোমটো আছে তো! নামগুলো উচ্চারণ করা কী কঠিন!
চলতে থাকুক দাদা, পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।