ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র নির্দেশক, চিত্রনাট্যকার, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী লুইস সেপুলভেদার জন্ম ১৯৪৯-এর ৪ অক্টোবর চিলের ওভাইয়েতে। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গদ্যসংগ্রহ, ‘ক্রনিকাস দে পেদ্রো নাদিয়ে’। ১৯৬১ সালে খুব অল্প বয়সেই তিনি সক্রিয় কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করে দেন ও সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে সালভাদর আয়েন্দের সরকারের সমর্থক ছিলেন। ১৯৭৩-এ আউগুস্তো পিনোশের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেপুলভেদা গ্রেফতার হন ও তিন বছর জেলে কাটান। এরপর তাঁর সাজা আঠাশ বছরের জেল থেকে কমিয়ে আট বছরের নির্বাসন করে দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালে নির্বাসিত হয়ে ল্যাটিন অ্যামেরিকার নানা দেশ ঘুরে একুয়াদরে পৌঁছোন। সেখানে সাত মাস ধরে ইউনেস্কোর হয়ে শুয়ার জনজাতির ওপর ঔপনিবেশিকতার কী প্রভাব পড়েছে তাই নিয়ে কাজ করেন।
এই কাজ করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন যে ল্যাটিন অ্যামেরিকার মতো মহাদেশে যেখানে একই সঙ্গে বহু ভাষা ও সংস্কৃতি পাশাপাশি রয়েছে, সেখানে পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল গ্রামীণ মানুষের ওপর তাঁর শেখা মার্কসবাদ প্রয়োগ করা যাবে না। একুয়াদরে থাকাকালীনই তিনি সিমন বলিভার আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে যোগদান করেন ও সান্দিনিস্তা বিপ্লবে অংশগ্রহণ করার জন্য ১৯৭৯ সালে নিকারাগুয়ায় যান। এই বিপ্লব সফল হলে তিনি জার্মানিতে গিয়ে হামবুর্গে থিতু হন।
চোদ্দো বছর এই শহরে থেকে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন ও সেই কাজের সূত্রে ল্যাটিন অ্যামেরিকা ও অ্যাফ্রিকা প্রচুর ঘুরেছেন। তার মধ্যেই বেশ কিছু গদ্য আর নাটকও লিখেছেন। এই সময়েই তিনি পরিবেশ আন্দোলনে যুক্ত হন ও ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত গ্রিন পিসের হয়ে কাজ করেন। গ্রিন পিস ছাড়ার পরেও তিনি পরিবেশের সপক্ষে কাজ চালিয়ে যান তাঁর লেখার মাধ্যমে। তাঁর মতে লেখকের একমাত্র দায়িত্ব হল “একটা ভালো গল্পকে ভালো করে বলা আর বাস্তবটাকে না বদলান, কারণ বই কখনও জগতটাকে বদলায় না। সেটা করে নাগরিকেরা।” সেপুলভেদা কয়েকটি ফিল্ম ও তথ্যচিত্রের চিত্রনাট্যকার ও পরিচালকও। ১৯৯৭ সালে থেকে স্পেনের আস্তুরিয়াস স্বয়ংশাসিত অঞ্চলের শিশন শহরে থাকতেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে প্রতিবছরের মতোই উত্তর পোর্তুগালের পভুয়া দ্য ভারজ়িঁ শহরে কুরেন্তেশ দ্য শ্ক্রিতা নামের এক সাহিত্য উৎসবে সস্ত্রীক যোগ দিতে আসেন। সেখান থেকে শিশনে ফেরার চারদিনের মাথায় তাঁদের দুজনেরই কোভিড ধরা পড়ে। প্রায় দেড় মাস কোমায় থাকার পর ১৬ এপ্রিল সেপুলভেদার মৃত্যু হয়।
লেখক হিসেবে সেপুলভেদা আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন ১৯৮৯ সালে ‘উন ভিয়েখো কে লেইয়া নোভেলাস দে আমর’ (The Old Man Who Reads Love Stories) নামের নভেলা প্রকাশিত হবার পর। ১৯৭৮ সালে একুয়াদরে শুয়ার জনজাতির মধ্যে সাত মাস কাটানোর অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে এই ছোটো উপন্যাসটি লেখা। এই গল্পে আছে চারধরনের মানুষ—বসতি স্থাপন করেছে যে কঙ্কিস্তাদররা, গ্রিংগো বা বিদেশি, হিবারো আর শুয়ার। শুয়াররা এখানকার আদি বাসিন্দা, আমাজ়োন অঞ্চলের সব রহস্য তাদের জানা, জঙ্গলের আর তার ভেতরে থাকা পশুপাখিদের রীতিনীতি তাদের নখদর্পণে আর তারা সেসব সসম্মানে মেনে চলে। তারা শুধুমাত্র খিদে মেটানোর জন্যই শিকার করে। বিদেশিরা এখানকার আদিবাসী শুয়ারদের নাম দিয়েছে হিবারো। এদের বৈশিষ্ট্য হল এরা এদের শত্রুদের মেরে তাদের মাথা ছোটো করে রাখে। কিন্তু আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শুয়াররা এল ইদিলিওর হিবারোদের স্পেনীয় কঙ্কিশ্তাদরদের চাটুকার বই আর কিছু বলে মনে করে না; তারা তাদের প্রভুদের অনুকরণ করতে গিয়ে জাত খুইয়েছে। বিদেশিরা এই আমাজ়োন অঞ্চলে আসে পেট্রল আর সোনার লোভে, পশুপাখি শিকার করে বা জ্যান্ত ধরে নিয়ে যাওয়ার লোভে। এরা জঙ্গলের আইনকানুন জানেও না, মানেও না; অকারণে প্রাণীহত্যা করে শুধু নিজেদের নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদেরও বিপদ ডেকে আনে। এরকমই একটা ঘটনা ঘিরে এই বইয়ের কাহিনি।
একুয়াদরের শুয়ার জনগোষ্ঠীর মানুষ
গল্পের মধ্যমণি আন্তনিও হসে বলিভার প্রোয়ান্যিয়ো। কাহিনির শুরুতে তার বয়স প্রায় সত্তর, একুয়াদরের আমাজ়োন অঞ্চলে নাঙ্গারিতসা নদীর ধারে এল ইদিলিও নামের এক জনপদে তার বাস। যুবা বয়সে সে তার স্ত্রী দোলোরেস এনকারনাসিওনের সঙ্গে বিনেপয়সায় পাওয়া জমিতে চাষবাস করে বসতি স্থাপন করতে এখানে এসেছিল। ইমবাবুরা আগ্নেয়গিরির লাগোয়া পাহাড়ি এলাকায় তাদের বাসভূমি থেকে এখানে আসাটা সহজ ছিল না—দু-সপ্তাহ পায়ে হেঁটে, বাসে-লরিতে চেপে এলদোরাদো পৌঁছে আবার সেখান থেকে একসপ্তাহ ডিঙি বেয়ে আসতে হয়েছিল তাদের। স্বাচ্ছন্দ্য আসেনি, মাগনায় পাওয়া জমিতে ফসল ফলেনি, দোলোরেস এনকারনাসিওনও আমাজ়োন অঞ্চলের দ্বিতীয় বর্ষাকালের ধাক্কা সহ্য করতে পারেনি, ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে। স্ত্রীকে হারিয়ে তার মনে হয়েছিল আমাজ়নের ওই গভীর জঙ্গল পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়; কিন্তু তারপর তার মনে হল যে সে ওই জঙ্গলটাকে ঘেন্না করার জন্য যতটুকু চেনা দরকার ততটুকুও চেনে না। শুয়াররা তাকে জঙ্গলে কী করে বাঁচতে হয় শেখাল। স্বাধীনতা কী তা সে কখনও ভেবে দেখেনি, কিন্তু যে জীবন সে আমাজ়নের জঙ্গলে কাটাতে লাগল তার চেয়ে স্বাধীন জীবন আর কিছু হতে পারে না; এইভাবে পাঁচ বছর চলার পর সে একদিন মহাবিষধর ‘একিস’ সাপের কামড় খেয়ে মরতে বসল। সেই অবস্থাতে সে একটা শুয়ারদের গ্রামে গিয়ে হাজির হলে তিন সপ্তাহ ধরে তাদের ওঝার শুশ্রূষায় সে বেঁচে যায়। এই শুয়াররা তাকে তাদেরই একজন করে রেখে দিল। তার পরম বন্ধু হল নুশিন্যিও, সেও শুয়ার তবে এসেছে বহু দূর থেকে, সে একদিন পেরুর সৈন্যদের হাতে গুলি খেয়ে এখানে এসে হাজির হয়েছিল আর সুস্থ হয়ে আন্তনিও হসে বলিভারের মতোই থেকে গিয়েছিল। এভাবেই শুরু হল আন্তনিও হসে বলিভারের শুয়ারদের একজন না-হয়েও যেন তাদেরই একজন হয়ে বাঁচা। কিন্তু দিনে দিনে লোভী বিদেশিদের আনাগোনা বেড়েই চলে আর তাদের হাতে জঙ্গলও কমতে থাকে। শুয়ারদের আর তিন বছর করে একই জায়গায় থাকা চলে না, ঘন দুর্ভেদ্য জঙ্গলের খোঁজে তাদের কেবলই পুবদিকে সরে যেতে হয়। বৃদ্ধ শুয়াররা যখন মনে করে যে তাদের ‘যাবার’ সময় ঘনিয়েছে, তখন তারা সবাইকে একটা বড়ো ভোজ দেয়; আর তারপর যখন তারা ‘চিচা’ আর ‘নাতেমা’-র নেশার ঘোরে তাদের ‘ভবিষ্যৎ জীবনের’ সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে তখন বাকি সবাই ওদের গায়ে প্রচণ্ড মিষ্টি ‘চোন্তা’-র মধু লাগিয়ে দূরের একটা কুঁড়েঘরে রেখে আসে। একরাত্রের মধ্যে তাদের শরীরগুলো ‘আন্যিয়াঙ্গো’ পিঁপড়েরা খেয়ে ফেলে, পড়ে থাকে শুধু ক-খানা হাড়।
একদিন সকালে সেরভাতানার (ব্লোগান) নিশানা ফসকে গেলে আন্তনিও হসে বলিভারের মনে হল তারও এবার ‘যাবার’ সময় ঘনিয়েছে। কিন্তু সে শুয়ারদের মতো হলেও ওদের তো কেউ নয়, নিজের মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করার সাহস তার নেই, তাই সে ঠিক করল যে সে এল ইদিলিওতে থিতু হয়ে শিকার করে পেট চালাবে। এর কিছুদিনের মধ্যেই নদীর মধ্যে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনে ছুটে গিয়ে দ্যাখে পাঁচজন বিদেশি ডায়নামাইট দিয়ে একটা বাঁধ উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের গুলিতে মৃতপ্রায় নুশিন্যিও তার প্রিয়বন্ধুকে অনুরোধ করে তার হত্যাকারীকে শেষ করে দিতে, যাতে মৃত্যুর পর তার আত্মা জঙ্গলে ঘুরে না মরে। আন্তনিও হসে বলিভার সেই গ্রিঙ্গোর পিছু ধাওয়া করে তাকে মারতে সক্ষম হল কিন্তু তা কুরারে মাখানো তির দিয়ে নয়, হত্যাকারীরই শটগান দিয়ে। সে জানত না যে এই কাজটা শুয়ারদের রীতিবিরুদ্ধ আর এর ফলে তার বন্ধুর আত্মা চিরটা কাল একটা অন্ধ পাখির মতো গাছের গায়ে ঠোক্কর খেয়ে ঘুরে মরবে। শুয়াররা কাঁদতে কাঁদতে তাকে ডিঙিতে তুলে দিয়ে বিদায় জানিয়ে তার পায়ের ছাপ নদীতীর থেকে মুছে দিল। আর কখনও কোনো শুয়ার তাদের গ্রামে তাকে ঢুকতে দেবে না। পাঁচদিন ডিঙি বেয়ে সে এল ইদিলিওতে এসে পৌঁছোল, তারপর সেখানেই কুঁড়েঘর বেঁধে রয়ে গেল। তার আগের জীবনে কখনও প্রেমের কাহিনি পড়ার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু এই একলার জীবন তার বড়োই একঘেয়ে লাগতে শুরু করল আর ভোট দেবার জন্য যখন ডাক পড়ল তখন সে দেখল যে অতিকষ্টে হলেও সে পড়তে পারে। সময় কাটানোর জন্য সে এবার পড়তে শুরু করল প্রেমের কাহিনি—তা যত করুণ হবে ততই তার পড়ে আনন্দ।
বছরে দু-বার এল ইদিলিওতে ‘এল সুক্রে’ বলে একটা স্টিমার আসে। তাতে করে আসে বিয়ার, ব্র্যান্ডি আর নুন। ফেরার সময়ে স্টিমার বোঝাই হয়ে যায় সবুজ কলার কাঁদি আর বস্তা ভরতি কফির বিন। পোস্ট-আপিসের পিওনের মতোই এল সুক্রে করে বছরে দু-বার আসেন দাঁতের ডাক্তার রুবিকুন্দ লোয়াচামিন। তিনি নিয়ে আসেন বৃদ্ধর পড়ার জন্য প্রেমের কাহিনি। এইভাবেই চলছিল কিন্তু বিপদ হল যখন একদল গ্রিঙ্গো একটা জাগুয়ারের সঙ্গীকে জখম করে তার ছানাগুলোকে মেরে ফেলল। সেই জাগুয়ার তখন হিংস্র হয়ে পরের পর মানুষ মারতে থাকল। বৃদ্ধর শত্রু, এল ইদিলিওর মেয়র, তাকে বাধ্য করল এই জাগুয়ারকে খুঁজে বার করে তাকে হত্যা করতে। বৃদ্ধ আন্তনিও হসে বলিভার অনিচ্ছাসত্ত্বেও এল ইদিলিওর বাসিন্দাদের মঙ্গলের জন্য তাকে মারতে বাধ্য হল। আর সেটা করতে গিয়ে নিজেও বেশ জখম হল।
এই লেখাটা কি শেষ হয়েছে?