ইনেশ পিদ্রুজ়া-র জন্ম ১৯৬২ সালের ১৫ অগাস্ট, পর্তুগালের বিশ্ববিদ্যালয়-শহর কুইম্ব্রাতে। যোগাযোগবিজ্ঞানের স্নাতক ইনেশ সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৯৯৩ সালে। তিনি এক অদ্ভুত প্রজন্মের লেখক। তাঁর নিজের কথায় এই লেখক-প্রজন্ম হল ‘ভুলে-যাওয়া প্রজন্ম’ (আ জেরাসাঁও ইশকেসিদা) আর তাঁর সমসাময়িক লেখক রুই জ়িঙ্কের কথায় সান্ডুইচ-প্রজন্ম (আ জেরাসাঁও সান্দুইশাদা)। এই লেখকদের আবির্ভাব হয় কার্নেশান অভ্যুত্থান-পরবর্তী (২৫ এপ্রিল, ১৯৭৪) লেখকদের (আন্তনিউ লোবু আন্তুনেশ, লীদিয়া জর্জ প্রভৃতি) অব্যাহতি পরেই, ভিন্নধর্মী রচনাসম্ভার নিয়ে। এঁদের প্রথম বইগুলি প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ (‘আদেউশ প্রিন্সেজ়া’, ক্লারা পিন্তু কুরেইয়া) থেকে নব্বই দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত। ক্লারা আররুই (‘অতেল লুজ়িতানু’, ১৯৮৬)–এই দুই শক্তিশালী লেখকের উপন্যাস দুটি বলে এক নতুন যুগের কথা, সেযুগ বিশ্বায়নের; তাতে আছে নতুন সব চ্যালেঞ্জ, নতুন আশা ও নিরাশা, এবং, সর্বোপরি, নতুন নতুন ভাষা। ইনেশের কথায়—“আমরা যারা ঔপনিবেশিক যুদ্ধের হিরো আর বিশ্বায়ন-পরবর্তী স্টারদের মধ্যে সান্ডুইচ-প্রজন্মের, সেই আমরা যে যুগে ছোটো ছিলাম, পাত্তা না পাওয়াটাই ছিল আমাদের মন্দের ভালো। আমাদের পাত্তা পাওয়াটা কখনোই ভালোর জন্য হত না; আমাদের ভাগ্যে কোনো পুরস্কার জোটেনি; ঠিক আগের আর ঠিক পরের প্রজন্মের লেখকদের তুলনায় আমরা খুবই কম পুরস্কৃত হয়েছি।” জুজ়ে সরামাগু যখন ১৯৯৮ সালে নোবেল পান তখন এঁদের বয়স ৩৫-৪০ বছর। সরামাগু নোবেল পাবার পর দু-বছর অন্তর পঁয়ত্রিশের কমবয়সি (এটা তিনিই স্থির করেছিলেন) একজন উপন্যাস-লেখককে দেওয়ার জন্য তাঁর নামে একটি পুরস্কার চালু হয়। ফলত এই ভুলে-যাওয়া প্রজন্মের লেখকেরা এর সুযোগ পেলেন না। ইনেশ-রুইয়ের থেকে সামান্য ছোটো লেখকেরা প্রেমিউ সরামাগুর কল্যাণে বিখ্যাত হয়ে উঠতে লাগলেন। এরা এবং গ্যারা কুলোনিয়াল প্রজন্মের লেখকরাই মূলত অনূদিত হন বিভিন্ন বিদেশি ভাষায়; তুলনায় ইনেশ-রুইদের লেখার অনুবাদ প্রায় হয়ই না বলতে গেলে, বিশেষত ইংরেজিতে।
ইনেশের প্রথম উপন্যাস, ‘আ ইন্সত্রুসাঁও দুজ় আমান্তেশ’ (প্রেমিকদের শিক্ষা) বেরোয় ১৯৯২ সালে। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘নাশ তুয়াশ মাঁওশ’ (ইংরেজি তরজমায় In your hands) বেরোয় ১৯৯৭ সালে। তাঁর গল্প-উপন্যাসের মধ্যে এটিই এখন অবধি সমালোচকদের সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পেয়েছে। ‘নাশ তুয়াশ মাঁওশ’ খ্রিস্টধর্মের একটি প্রার্থনার প্রথম ক-টি শব্দ; লিউকের গস্পেল অনুযায়ী জিশুর শেষ ক-টি কথা ছিল—“পিতা, তোমার হাতেই আমি আমার আত্মাকে সমর্পণ করলাম।” এই কথা ক-টি থেকেই খ্রিস্টধর্মীদের রাত্রিকালীন প্রার্থনার উদ্ভব।
উপন্যাসটির তিনটি অংশ; তিন প্রজন্মের তিনজন নারীর আত্মকথন—জেনি, তার পালিতা কন্যা (সমকামী স্বামী আন্তনিউর উভকামী প্রেমিক পেদ্রুর ঔরসজাত সন্তান) কামিলা ও তার জারজ মিশ্র রক্তের সন্তান নাতালিয়া। জেনি সম্ভ্রান্ত ও ধনী পরিবারের কন্যা, সে তার বাবাকে কোনোদিন দেখেনি, ১৯১৭ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, ‘অস্তিত্বহীন এক ইউরোপের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য’ লড়াই করতে গিয়ে মৃত, প্রচুর পদক পাওয়া তার বাবাও তাকে কোনোদিন দেখেননি। ডায়ারির শুরুতে মায়ের সাথে গরমকালটা কাটানোর জন্য জেনি এথেন্সে। সালটা ১৯৩৫। জেনির বয়স আঠারো। এইখানেই তার প্রায়-কন্দর্পকান্তি আন্তনিউর সঙ্গে আলাপ। সে তার একবছরের পুরোনো গিগলো-প্রণয়ী পেদ্রুকে তার বিপথগামিতা আর নারীসঙ্গ লোলুপতার শাস্তি দিতে একলাই গ্রিসে এসেছে। একমাত্র প্রথম দেখার পরই জেনির ভাবী স্বামী তাকে ‘তুমি’ বলে, বাকি জীবনটা ‘জেনিফার’ আর ‘আপনি’ (সম্ভ্রান্ত পরিবারের রীতি অনুসারে) বলেই কাটিয়ে দেয়। পরে কামিলা আর নাতালিয়াও তাকে ‘জেনি’ আর ‘আপনি’ বলবে। জুলিউ দিনিশের ১৮৬৭ সালের উপন্যাস ‘উমা ফামীলিয়া ইংলেজ়া’র চরিত্র জেনিফার ওয়াইটস্টোনের নামে তার নাম, উপন্যাসের জেনির মতোই কেউই আর তাকে পুরো নাম ধরে ডাকে না; অন্যদিকে আন্তনিউকে সবাই ত জ়ে (TóZé) বলে ডাকে, কেবল জেনিই তাকে আন্তনিউ বলে ডাকে। বাগদানের পর দুটি বছর জেনির খুব ভালোই কাটে আন্তনিউ আর পেদ্রুকে নিয়ে, বাকি মেয়েদের হিংসার পাত্রী হয়ে। বিয়ের রাতে তিনজনে হাত ধরাধরি করে জেনির বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার পর আন্তনিউ যখন তাকে বলে “জেনিফার, সোনা আমার, আপনি পেদ্রুর ঘরে শোবেন… ডার্লিং, আমরা চাই এই বাড়িতে আপনি নিজের ইচ্ছে মতো থাকবেন।”—আর পেদ্রুর হাত ধরে ঢুকে যায় নবদম্পতির জন্য সাজানো ঘরে, যেখানে জেনির দিদিমার পালঙ্কে নাতনির বাসর রাতের জন্য তাঁর নিজের হাতে নকশা করা চাদর-পাতা, তখনও সে কিছু বোঝে না। সে দুঃখও পায় না, ভাবে সে ক্লান্ত বলে তার স্বামী তাকে বিশ্রামের সুযোগ দিচ্ছে। পেদ্রুর ঘরটাই হয়ে যায় জেনির ঘর আর তার নিজের ঘর, ছত্রি-লাগানো পালঙ্ক হয়ে যায় তার স্বামী আর তার প্রেমিকের যৌথ জীবনের আস্তানা। জেনি আজীবন বিবাহিতা কুমারী হয়েই থাকে। মানুয়েল আলমাদার মতো অনেক পুরুষই তাকে জীবনভর কামনা করেছে কিন্তু তার নিস্পৃহতার কাছে হার মেনেছে। তার একমাত্র ভালোবাসা তার স্বামী; সে তার ড্রেসিং টেবিলের আয়নার পাশে একটা গর্ত করে আন্তনিউ-পেদ্রুর দাম্পত্যজীবন উঁকি মেরে দেখে আর তার স্বামীকে ঠিক যেভাবে তার প্রেমিককে সোহাগ করতে দেখে ঠিক সেইভাবে নিজের হাত দিয়ে নিজেকেই আদর করে। কোনোদিনই এসব কথা সে কাউকে বলেনি, সব গোপন রেখে স্বামীর সঙ্গে ঘর করেছে; তার কারণ শুধু ভালোবাসা বা সহমর্মিতা নয়, বরং অহংকার আর লোকলজ্জার ভয়। বিয়ের ছ-বছর পরে দানিয়েল, পেদ্রুর ফরাসি ইহুদি প্রেমিকা, নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দেশে ফিরে যাবার আগে কামিলাকে জেনির হাতে তুলে দিয়ে যায়। আন্তনিউ রাগে হিংসায় ভেঙে পড়ে আর জেনি উন্মাদ হতে হতেও হয় না, মেয়েকে আঁকড়ে নতুন জীবন পায়। কামিলার উদ্দেশে সে পরে লেখে—ভালোবাসাই একমাত্র মৃত্যুকে স্থগিত করে, জীবনকে অনন্ততে অবিচল রাখে, সময়কে থামিয়ে রাখার দৈবী দান।
বিয়ের পঞ্চাশ বছর পর আন্তনিউ মারা যায়। একবছর পর পেদ্রু। জেনি বেঁচে থাকে আরও চার বছর। পেদ্রু জেনিকে বিয়ে করতে চেয়েছিল; জেনি রাজি থাকলেও তার নব্বই বছর বয়সি মা রাজি হননি। এখন পঁচাত্তর বছর বয়সে, মৃত্যু আসন্ন জেনে প্রায়-উন্মাদ জেনি তার জীবনের সব না-বলা গোপন কথা কামিলাকে জানানোর জন্য ডায়ারিতে লেখে। দশটি অধ্যায় এই ডায়েরির, বেশির ভাগ সময়েই স্বামীকে উদ্দেশ করে লেখা, মাঝে মাঝে কামিলাকে। জেনির অংশটিই দীর্ঘতম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এর সময়কাল ১৯৩৫ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত। বড়ো গুরুত্বপূর্ণ সময়ের দলিল এই ডায়ারি। আন্তনিউর সঙ্গে প্রথম দেখা দিয়ে শুরু, শেষ আন্তনিউ ও পেদ্রুর মৃত্যু পার করে, কামিলার প্রেমিক এদুয়ার্দুর বজ্রপাতে মৃত্যু, নাতালিয়ার জন্ম, বেড়ে-ওঠা ও বিয়ে পার হয়ে তার নিজের উন্মাদ হয়ে যাওয়া অবধি এই ডায়ারি। এর অনেকটাই ভালোবাসা-বন্ধুত্ব-সম্পর্ক (যদিও তার সঙ্গে আন্তনিউর সম্পর্ক কেমন ছিল নাতনির এই প্রশ্নের উত্তরে সে বলেছিল সে যে সময়কার তখন সম্পর্ক শব্দটারই উদ্ভাবন হয়নি) এই নিয়ে তার ভাবনাচিন্তার ফসল; তা সত্ত্বেও জ়াইটগাইস্ট আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তার লেখাকে। সে ধনীর দুলালি, তার কোনো পেশা ছিল না, তার কথায় তার প্রজন্মই শেষ প্রজন্ম যাদের পেশার পাঁকে নামবার দুর্ভাগ্য হয়নি—“ধনী মহিলাদের জুয়ায় নিঃস্ব হয়ে মরতে দেখেছি কিন্তু দুই বান্ধবীকে একই বসের নজরে পড়ার জন্যে চুলোচুলি করতে দেখিনি।” আমোদপ্রমোদেই কেটে গেছে তার জীবন। সেসবের জন্য অবশ্যই টাকা জুগিয়েছে সে নিজে কারণ আন্তনিউ বা পেদ্রুর না ছিল কোনো পেশা না উপার্জন; উলটে জেনির টাকা তারা বিলাসব্যসনে আর জুয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে। জেনির জীবন যেন সমারসেট মমের কোনো কাহিনি। টাকা ফুরোবার পর জেনি উপার্জনের জন্য নিজের বাড়িতে বার খুলতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও স্বামীর ওপর তার কোনো রাগ নেই।
পেশাদার আলোকচিত্রী কামিলার আত্মকথন তার তোলা দশটি ছবির বর্ণনায়, আর স্থপতি নাতালিয়ার ক্ষেত্রে তা জেনিকে লেখা দশটি চিঠির তাড়ায়, যার শেষ তিনটে মৃত জেনির উদ্দেশে লেখা। তিনজনের জীবনের সব গল্পই জেনি লিখে গেছে। কামিলা আর নাতালিয়ার লেখায় বাড়তি পাওনা কিছু খুঁটিনাটি, তাদের কালের কথা এবং, সর্বোপরি, ভালোবাসা-বন্ধুত্ব-সম্পর্ক নিয়ে তাদের ভাবনাচিন্তা। এই তিনজনেরই বন্ধু ছিল/আছে—জেনির জুজ়েফিনা নাশিমেন্তু, যে জোসেফ বার্থ নামে রহস্যোপন্যাসের মোড়কে সমাজের বৈপ্লবিক সমালোচনা করে; কামিলার বাল্যবন্ধু গ্লরিয়া, যার সঙ্গে তার পরবর্তী কালে পেশাগত কারণে বিচ্ছেদ হয়ে যায়; নাতালিয়ার প্রাণের বন্ধু আর-এক স্থপতি লিয়োনর। জেনির ক্ষেত্রে অবশ্য বন্ধুত্বের বাঁধন অত শক্ত ছিল না যেমনটা তার উত্তরসূরিদের ক্ষেত্রে। তার মতে কামিলার বন্ধুত্বের আবেগটা ওর নিজের ভালোবাসার আবেগের মতো। আর জেনির নাতনি তাকে চিঠিতে লেখে বন্ধুরা হল শৈশবকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র স্থায়ী সম্ভাবনা; সে তার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু লিয়োনরকে হারিয়েছে যৌনতার কাছে, কারণ সে নাতালিয়ার সঙ্গে একটা সমকামী প্রেমের সম্পর্কে জড়াতে চায়। ষাটের দশকের ‘তরল আধুনিকতা বা প্রেম’ কামিলা তার লেখাতে ভালো ভাবেই ফুটিয়ে তোলে আর নব্বইয়ের দশকের প্রথমে জেনি তার ডায়েরিতে লেখে যে আমরা ভালোবাসাকে ডোমেস্টিক অ্যাপ্লায়েন্সের মতো ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, খারাপ হলেই ফেলে দিই, সারানোর চেষ্টা করি না কারণ সারানোর চেয়ে নতুন কিনে ফেলাটা সস্তা। কামিলা এদুয়ার্দুর মৃত্যুর পর মৃত্যুকে তাড়া করে মোজাম্বিক চলে যায় যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে; সেখানে তার আলাপ ফ্রেলিমুর গেরিলা শাভিয়েরের সঙ্গে, তারই অবৈধ সন্তান নাতালিয়া। শাভিয়ের পোর্তুগিজ সেনাবাহিনীর হাতে মারা যায় কামিলার সঙ্গে দেখা হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই। জেনির মৃত্যুর পর নাতালিয়া যুদ্ধ-বিধ্বস্ত মোজাম্বিকে শাভিয়েরের, বা, বলা ভালো নিজের খোঁজে যায়; সেখানে তার দেখা হয় তার মৃত বাবার সহযোদ্ধার সঙ্গে। নিজেকে খোঁজা শেষ করে একবছর পর সে ফিরে আসে শূন্য দাবার বাড়িতে, যেখানে জেনি সারাজীবন একা বাঁচার পর একাই মরেছে। জেনির সেই বাসরঘরে, সেই পালঙ্কে, সেই ফুল-তোলা চাদর পেতে সে তার ভালোবাসা আল্ভারুকে আহ্বান জানায় ‘নূতন করে নূতন প্রাতে’।