প্রথমদিন লাঞ্চের পর লিস্টি হাতে নিয়ে ঘর খুঁজতে বেরোলুম। কিন্তু খানিক পরেই ঠিকানা খোঁজার দম ফুরিয়ে গেল। যে-ক-টা বাড়িতে গেছি কোনোটাতেই আর ঘর খালি নেই; আসলে ইউনিভার্সিটির আশেপাশের বাড়িগুলোতেই আগে খোঁজ করলুম কিনা। এবার তাহলে শহরের পুরোনো অংশ ছেড়ে নতুন এলাকায় যেতে হয়। আমার এদিকে টুটাফুটা পোর্তুগিজ় বলতে বলতে তো জিভ বেরিয়ে গেছে। তিরিশ বছর আগে পোর্তুগালে বিশেষ কেউ ইংরেজি জানত না, বেশির ভাগেরই দ্বিতীয় ভাষা হত ফরাসি। তাই এবারে লিস্টি হাতে ধরিয়ে দিয়ে ডিরেকশন চাইতে লাগলুম। এর ফলে এমন একটা জিনিস জানতে পারলুম যাতে চমকে উঠতে হল। বেশ অভিজাত চেহারার সুন্দর সাজগোজ করা বুড়িরা লাঞ্চের পর কফি খেতে বেরিয়েছে। তাদের হাতেই লিস্টি ধরিয়ে ডিরেকশন চাইতে লাগলুম। ওমা! সব্বাই মাথা নেড়ে বলে কিনা তারা পড়তে জানে না! শেষে যে দনা ইরমেলিন্দার বাড়িতে গিয়ে উঠলুম তিনি অবশ্য বড়ো বড়ো গোটা গোটা অক্ষরের লেখা পড়তে পারতেন। এর রহস্যটা কী? ১৯২৬ থেকে ১৯৭৪ পোর্তুগালে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরতন্ত্রী সরকার, শ্তাদু নোভু। ১৯৬৮ অবধি এর মাথা ছিলেন আন্তনিউ দ্য অলিভাইরা সালাজ়া্র (১৮৮৯-১৯৭০)।
অবিবাহিত সালাজ়া্র নিজেকে জাতির পিতা বলতেন আর দেশবাসীকে নিজের ছেলেপুলের মতোই শাসন করতেন। তাঁর মতে দেশ হবে কৃষিনির্ভর আর বখাটে ইউরোপের পাল্লায় পড়ে ছেলেপুলেরা যাতে গোল্লায় না যায় তার জন্য দেশের মুখটা ঘুরিয়ে অ্যাফ্রিকা আর এশিয়ার দিকে করে দিয়েছিলেন। মেয়েরা হল ঘরের লক্ষ্মী, পড়াশোনা করলে তারা বিগড়ে যাবে, তাই তাদের ইশকুলে গিয়ে কাজ নেই, বাড়িতে বসে ঘরকন্নার কাজ শিখুক। এই কারণেই তিরিশ বছর আগে গিয়ে যত ষাটের ওপর মহিলাদের দেখেছি, তাদের একটা বড়ো অংশ নিরক্ষর। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল তবে গ্রামে বা শহরে অনেক পরিবারের মেয়েদেরই অক্ষরপরিচয়টুকুও সালাজ়া্রের আমলে হত না।
যাইহোক, শেষমেশ বাড়ি জোগাড় করে দিল স্যালি, মাকাওয়ের চিনে মেয়ে, আমার ক্লাসেই পড়ে। কুইম্ব্রায় সেইসময়ে প্রচুর মাকাইয়েন্স পড়তে আসত কারণ মাকাও তখনও পোর্তুগালের। স্যালি আমায় নিয়ে গেল ইউনিভার্সিটি থেকে বেশ খানিকটা দূরে বাইরু নর্তন দ্য মাতুশে। বাইরু মানে পাড়া। এই বাইরুটা একদম নতুন, বছর তিরিশ-চল্লিশ হল তৈরি হয়েছে, এখানকার বেশির ভাগ বাড়িতেই বুড়োবুড়িরা একলা থাকে আর ছাত্রছাত্রীদের ঘর ভাড়া দেয়। বেশির ভাগ মাকাইয়েন্সই এই পাড়ায় থাকে। আমার ঠাঁই হল দনা ফির্নান্দার বসার ঘরে। ৫ জুলাই ছিল শুক্কুরবার। শনি-রবি ছুটি। টানা দু-দিন জেট ল্যাগের ঘুম ঘুমোলাম; দু-একবার উঠে নাহুমস থেকে আনা শুকনো খাবার খেলাম। সোমবার ক্লাস থেকে ফেরার পর দনা ফির্নান্দা আমায় উলটোদিকের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এটা দনা ইরমেলিন্দার বাড়ি, উনিও একা থাকেন, সঙ্গে জনাচারেক ছাত্রী; তারা অবশ্য সবাই পোর্তুগিজ়। এখানে একটা ঘর খালি হয়েছে। এরপর ১৯৯৬ অবধি এই রুয়া আন্তনিউ দ্য নোলার ৩ নং বাড়িটাই ছিল আমার কুইম্ব্রার ঠিকানা।
এরপরের তিনটে শনিবার ইউনিভার্সিটি থেকে বেড়াতে নিয়ে গেল। প্রথমে নিয়ে গেল কুনিম্ব্রিগায়। এবারে কুইম্ব্রার ইতিহাস কিছুটা বলতে হয়। মধ্য পোর্তুগালে মন্দেগু নদের ধারে ছোট্ট পাহাড়ি শহর কুইম্ব্রার পত্তন হয় রোমান সাম্রাজ্যের সময়ে, তখন অবশ্য এর নাম ছিল আএমিনিয়ুম। দক্ষিণে লুসিতানিয়া জেলার শহর অলিসিপো (আজকের লিশবোয়া) আর উত্তরে ব্রাকারা আউগুস্তাকে (আজকের ব্রাগা) জুড়ত যে রাজপথ, তার ধারেই ছিল এই শহর। এখানে যাত্রীরা তাদের ঘোড়া বদল করত। তবে এর তেমন রমরমা ছিল না যেমনটা ছিল মন্দেগুর অন্য পারে বিশ কিলোমিটার দূরে কুনিম্ব্রিগার; এই শহর ছিল রোমান প্রজাতন্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ শহর। ৪৬০ সাল থেকে সুয়েবিরা বারবার কুনিম্ব্রিগাকে আক্রমণ করে তছনছ করে দেবার ফলে ওখানকার বেশির ভাগ বাসিন্দাই নদী পার হয়ে আএমিনিয়ুমে পালিয়ে এসে বসতি স্থাপন করে। সেই থেকেই আএমিনিয়ুমের বাড়বাড়ন্ত আর নামটাও বদলে কুনিম্ব্রিগা হয়ে যায়, সেই থেকেই আজকের এই কুইম্ব্রানাম। আসল কুনিম্ব্রিগা এখন কেবল ট্যুরিস্টদের দ্রষ্টব্য একটা, রোমানদের সময়কার ধ্বংসস্তূপ আজও সেখানে বেশ কিছু আছে। সেটাই আমাদের দেখাতে নিয়ে যাওয়া হল। আসলে রোমান যুগের এতখানি ছড়িয়ে-থাকা নিদর্শন পোর্তুগালে আর নেই। প্রথম রোমান সম্রাট আউগুস্টুস কুনিমব্রিগাকে শহর হিসেবে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। এখন যেসবের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায় তা হল শহরকে ঘিরে থাকা প্রাচীর, থেরমাএ বা পাবলিক বাথ, ফোরাম আর রংবেরঙের টালি বসানো বিভিন্ন ভবনের মেঝে। এখানে একটা ছোটো জাদুঘরও আছে যেখানে মাটি খুঁড়ে বের করা নানান নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। আর আএমিনিয়ুমের একমাত্র নিদর্শন হিসেবে রোমান ফোরামের একটা ক্রিপ্টোপোর্টিকো পড়ে আছে আজকের কুইম্ব্রার মুজ়েউ মাশাদু দ্য কাশ্ত্রুর বেসমেন্টে।
কুনিম্ব্রিগায় প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের শহরের ধ্বংসাবশেষ
মধ্যযুগের কুইম্ব্রার অনেক নিদর্শন পড়ে রয়েছে আজকের কুইম্ব্রায়, যেমন রয়েছে মন্দেগুর ওপারেও। নদীর ওপারে, মানে কুনিম্ব্রিগার দিকে, রয়েছে মুশ্তাইরু দ্য সান্তা ক্লারা-আ-ভায়েল্যিয়া আর কিন্তা দাশ লাগ্রিমাশ। মুশ্তাইরু দ্য সান্তা ক্লারা-আ-ভায়েল্যিয়া তেরোশো শতকে গথিক রীতিতে তৈরি একটা মঠ। দন্ দিনিশের রানি ইসাবেল্লা দে আরাগন বা রাইন্যিয়া সান্তা এই মঠের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বিধবা হবার পর এই মঠেই তিনি আশ্রয় নেন। তবে বারবার বন্যা হয়ে মন্দেগুর জলে মঠ ভেসে যাওয়ার ফলে সতেরো শতকে উঁচু জমিতে নতুন আর-একটি গির্জা ও মঠ (সান্তা ক্লারা-আ-নভা) তৈরি হবার পর এই মঠটি পরিত্যক্ত হয়। নতুন মঠটি তৈরি হয়েছিল ম্যানারিস্ট বা লেট রেনেসঁস রীতিতে। এই মঠে কুইম্ব্রার পেট্রন সেন্টরা ইন্যিয়া সান্তা ইজ়াবেলার দেহাবশেষ রাখা আছে।
কিন্তা দাশ লাগ্রিমাশ (লাগ্রিমাস মানে চোখের জল) তেরোশো শতকের একটা বাগানবাড়ি। পুরোনো সান্তা ক্লারা মঠে জল নিয়ে যাবার জন্য রাইন্যিয়া সান্তা এখানে একটা খাল কাটিয়েছিলেন। যে জায়গা থেকে জলটা বের হয় সেখানকার নাম পরে হয় যায় ফন্ত দুশ আমোরেশ (ভালোবাসার ঝরনা)। এই নামকরণের পেছনে একটা গল্প আছে। রাইন্যিয়া সান্তার নাতি পেদ্রু প্রেমে পড়েছিল তার স্ত্রী, কাস্তিয়ার কন্সতান্সা মানুয়েলের সখী, গালিজ়ার ইনেশ দ্য কাশ্ত্রুর। এই কিন্তা দাশ লাগ্রিমাশেই পেদ্রু আর ইনেশ গোপনে দেখা করত আর এই বাগানবাড়িতেই পেদ্রুর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে পেদ্রুর বাবা, রাজা চতুর্থ আফন্সোর পাঠানো ঘাতকেরা ইনেশের গলা কেটে হত্যা করে।
কুইম্ব্রায় গির্জা আর মঠের ছড়াছড়ি; এদের মধ্যে ইউনিভার্সিটির কাছে সান্তা ক্রুশ খুব গুরুত্বপূর্ণ আর সবচেয়ে পুরোনোও। এই গির্জা ও মঠ তৈরি হয়েছিল বারো শতকে, পোর্তুগালের প্রথম রাজা দন্’আফন্সো এনরিকেশের আমলে। এই গির্জাতেই তিনি ও তাঁর ছেলে, প্রথম সানশু, সমাধিস্থ হয়েছিলেন। ষোলো শতকে, প্রথম মানুয়েলের রাজত্বকালে এই গির্জার ভেতরে চমৎকার সব শিল্পকর্ম যোগ করা হয়। প্রথমবার এত তাড়াতাড়ি সব কিছু দেখতে হয়েছিল যে মাথার মধ্যে সব কীরকম গুলিয়ে গিয়েছিল। পরের বছর যখন লম্বা কোর্স করতে এলাম তখন বারবার দেখতে আসতাম, বিশেষ করে সান্তা ক্রুশ।
তা ছাড়া এইসব গির্জা ও মঠের স্থাপত্য ও শিল্পকর্ম নিয়ে পড়তেও হত। মন্দেগুর দু-পাশ ঘোরানো ছাড়াও আমাদের অন্য শহরেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কুইম্ব্রাকে কেন্দ্র করে দেশের অনেকটাই ঘোরা যায়, সেদিক দিয়ে এর অবস্থানটা খুবই সুবিধেজনক। উত্তরে পোর্তু আর দক্ষিণে লিশবোয়ার (লিসবনের) ঠিক মাঝামাঝি এর অবস্থান। ফলে দক্ষিণে লিশবোয়ার দিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গা যেমন চট করে দেখে আসা যায় তেমনি উত্তরেরও কিছু কিছু জায়গাও সহজেই ঘুরে আসা যায়। এক শনিবার আমাদের নিয়ে যাওয়া হল লাইরিয়া, বাতাল্যিয়া আর আল্কুবাসাতে; সঙ্গে নাজ়ারের সমুদ্রতট ফাউ। এই জায়গাগুলো সবই কুইম্ব্রার দক্ষিণে, ওখান থেকে যেমন দিনের দিন সব দেখে ফিরে আসা যায় তেমনি লিশবোয়া থেকেও তা করা যায়। এখন যখন মাস দুয়েকের জন্য লিশবোয়াতে গিয়ে থাকি তখন ইনোসেন্সিয়া প্রায় প্রতিবারই আমায় ওর গাড়ি করে ফাতিমা, বাতাল্যিয়া আর আল্কুবাসাতে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। আর লাইরিয়ার কাছেই একটা আধা-গ্রাম আধা-শহর, ভিয়াইরা দ্য লাইরিয়াতে সান্দ্রার দেশের বাড়ি। তাই লাইরিয়াও অনেকবার ঘোরা হয়ে গেছে। লিশ (লিশ মানে লিলি) নদীর ধারের এই শহরটার কথা পরে কোনোদিন হবে এখন দুর্গটার কথাই বলি। দূর্গটা ওই ১৯৯১ সালেই একবার দেখেছিলাম, তারপর আর ওটা দেখতে যাওয়া হয়নি। এটা তৈরি করিয়েছিলেন স্বাধীন পোর্তুগালের প্রথম রাজা দন্’আফন্সো এনরিকশ।
আবার একটু ইতিহাসে ফিরে যাওয়া যাক। ৭১১ সালে উত্তর আফ্রিকা থেকে বেরবেররা আজকের পোর্তুগালের (বলাই বাহুল্য পোর্তুগাল বলে তখন কোনো দেশ ছিল না) দক্ষিণদিকটা দখল করে বসলে কুইম্ব্রা হয়ে দাঁড়ায় খ্রিস্টান উত্তরাঞ্চল আর মুসলমান দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের গুরুত্বপূর্ণ এক কেন্দ্র। ভিসিগথদের কন্দাদু দ্য কুইম্ব্রা অর্থাৎ কুইম্ব্রা কাউন্টি তৈরি হয় ৮৭১ সালে। এরপর কুইম্ব্রা কিছুদিনের জন্য বেরবের বা মূরদের অধীনে চলে গেলেও স্পেনের ল্যেন ই কাস্তিয়ার (আজকের স্পেনের) রাজা প্রথম ফেরনান্দো ১০৬৪ সালে রিকঙ্কিশ্তা ক্রিশ্তাঁ (৭২২ সাল থেকে শুরু হয়ে যাওয়া ক্রিস্টানদের পুনর্বিজয়, মানে মুসলমানদের কাছ থেকে হারানো জমি আবার জিতে নেওয়া) চলার সময়ে পাকাপাকি ভাবে জিতে নেন আর মোসারাব (আইবেরিয়ার আর বিভাষী খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী বাসিন্দা, এদের মধ্যে যেমন ভিজ়িগথরা ছিল তেমনি বেরবের আর আরবরাও ছিল) শাসক সেশনান্দু এই কন্দাদুকে এক বিশাল জমিদারিতে পরিণত করেন। এরপর যখন (এখনকার ফ্রান্সের) অঁরি দ্য বুরগোইন ল্যেন ই কাস্তিয়ার রাজা চতুর্থ আফন্সোর অবৈধ কন্যা তারেজ়াকে বিয়ে করে ১০৯৬ সালে কন্দাদু দ্য পোর্তুকালেন্স যৌতুক পেলেন, তখন তার সঙ্গে কন্দাদু দ্য কুইম্ব্রা জুড়ে গিয়ে ল্যেন ই কাস্তিয়ার অধীনে এক বিশাল অঙ্গরাজ্য তৈরি হল; তার রাজধানী উত্তরে গিমারায়েঁশ হলেও কাউন্ট তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন কুইম্ব্রাতেই। তারপর অঁরির মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে আফন্সো এনরিকশ, পোর্তুকালেন্সের দ্বিতীয় কোন্দ, ১১২৮ সালে পোর্তুকালেন্স বা পোর্তুগালকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করলেন। এই কন্দাদু পোর্তুকালেন্সের দক্ষিণ সীমানা ছিল কুইম্ব্রার পাশ দিয়ে বয়ে চলা মন্দেগু নদ। তার দক্ষিণদিক থেকে সমানে হানা দিত মূর বা বেরবেরদের দল, লিশবোয়া তখন ওদেরই দখলে। দন্’আফন্সো এনরিকশ চাইলেন নিজের রাজত্বের পরিধি বাড়াতে আর একই সঙ্গে মূরদের উত্তরে আসাটা ঠেকাতে। এই ভাবনা থেকেই লাইরিয়ার দুর্গের পত্তন। লিশ যেখানে লেনাতে গিয়ে মিশেছে তার একটু দক্ষিণে একটা উঁচু টিলার ওপর এই দুর্গ। দু-দুবার মূরেরা এই দুর্গের দখল নিয়েছে আর দু-বারই দন্’আফন্সো এনরিকশ তা আবার জয় করে নিয়েছেন। মূরদের কাছ থেকে লিশবোয়া জিতে নেওয়ার পেছনেও এই দুর্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই দুর্গের গুরুত্ব ক্রমে এতটাই বেড়ে ওঠে যে ১২৫৪ সালে দেশের অভিজাতবর্গ, যাজকবর্গ ও সাধারণ মানুষদের নিয়ে প্রথম রাজসভা এই দুর্গেই বসে। অনেকদিন ধরে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা এই দুর্গে বিভিন্ন ধরনের স্থাপত্যরীতি দেখা যায়—শুরু হয়েছিল রোমানেস্ক রীতিতে, এরপর এতে চোদ্দো ও পনেরো শতকের দুটি আলাদা গথিক স্থাপত্যরীতির ছাপ পাওয়া যায়।
লাইরিয়া জেলারই আর-একটি শহর আল্কুবাসা। এখানে আছে রেয়াল মুশ্তাইরু দ্য সান্তা মারিয়া দ্য আল্কুবাসা নামের একটি মঠ। দন্’আফন্সো এনরিকশের দান করা জমিতে ফরাসি সিস্টার সম্প্রদায় এই মঠ তৈরি শুরু করে ১১৭৮ সালে।
এটিই পোর্তুগালের মাটিতে তৈরি প্রথম গথিক রীতির স্থাপত্য। গির্জা সংলগ্ন মঠটিতে তিনটি দোতলা ক্লয়েস্টার আছে। রোমানেস্ক থেকে গথিকে উত্তরণ ঘটছে এরকম একটা মধ্যবর্তী রীতিতে গির্জা আর প্রথম ক্লয়েস্টারটি তৈরি হয়। প্রায় ছশো বছর ধরে পুরো মঠটি একটু একটু করে তৈরি হয়। গির্জার ভেতরে দেশের তৃতীয় রাজা, দ্বিতীয় আফন্সো ও পঞ্চম রাজা, তৃতীয় আফন্সোর সমাধি আছে। আর যে প্রেমিকযুগল, পেদ্রু (প্রথম পেদ্রু, অষ্টম রাজা) আর ইনেশের কথা একটু আগে বলেছি, তাদের কবরও এখানে আছে, দুটো কবর এমনভাবে মুখোমুখি রাখা যাতে শেষবিচারের দিনে কবর থেকে উঠে দুজনে মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে। কবর দুটোতে সুন্দর ভাস্কর্যের মাধ্যমে পোর্তুগালের ইতিহাস আর বাইবেলের গল্প বলা হয়েছে। আঠেরো শতকের প্রথম দশকে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী যখন পোর্তুগাল আক্রমণ করে তখন ওই সৈন্যরা এই কবর দুটিকে খুলে তছনছ করেছিল। পরে মঠের সন্ন্যাসীরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন ওগুলোকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। এবার বাতাল্যিয়ার গল্পে যেতে হয়, তবে সে লম্বা গল্প, পরের পর্বে হবে।
(ক্রমশ...)