এই বই কিন্তু অনেকবার আমায় ভয়ঙ্কর বিপদে ফেলেছে। তাই প্রথমেই যারা পড়েননি-এখনো-কিন্তু-পড়বেন-ভাবছেন তাদের উদ্দেশ্যে কয়েকটা সাবধান বাণী বলেদি’। প্রথমত, কোনো ঘুমন্ত ব্যক্তি বা শিশুর পাশে শুয়ে এই বই পড়বেন না। আপনার হাসির দমকে খাট হঠাৎ হঠাৎ এমন দুলবে যে পাশের মানুষটির ঘুমের পিন্ডি চটকে যাবে। আমার হাসির চোটে যেমন সদ্য ঘুম পাড়ানো ছেলে কেঁদে উঠে পড়েছিল। তারপর সেই বাচ্চাকে আবার ঘুম পাড়ানোর হ্যাপা!! এবার আসি দ্বিতীয় পয়েন্টে। পাবলিক ইমেজ নিয়ে মাথাব্যথা থাকলে ভুলেও বাসে, ট্রেনে, প্লেনে বা ওয়েটিং লাউঞ্জে এ বই পড়বেন না। আপনার আওয়াজে লোকজন চমকে চমকে উঠবে, আপনাকে পাগলও ভাবতে পারে। এমন নিষ্পাপ দেখতে বইয়ের মধ্যে যে কী বস্তু আছে তা তো তারা বুঝবে না! আপনি নির্ভিক হলে আমার কথা একদমই শোনার দরকার নেই। আপনার বই, আপনার সময়, আপনার মর্জি, যখন ইচ্ছে, যেখানে ইচ্ছে পড়ুন!অবশ্য এ বই একবার পড়া শুরু করলে চাইলেও ছাড়তে পারবেন না। নিমো গ্রামের গল্পগুলোই এমন।
এই সেবার বাড়ি যাওয়ার সময় নিমো স্টেশন পেরোলাম। আগেও পেরিয়েছি কতবার কিন্তু এমন চেনা মানুষ দেখার মতো আনন্দ তো হয়নি! আসলে নিমো গ্রামের গল্পগুলো বহুদিন ধরেই সুকান্তদার ফেসবুক ওয়ালে পড়েছি। পড়তে পড়তে নিমো যেন খুব চেনা হয়ে গেছে। এখানকার মানুষেরা এক একটা চরিত্র হয়ে উঠেছে গল্পের। পরে বই আকারে গল্প গুলো প্রকাশিত হলে প্রথম সুযোগে সংগ্রহ করে পড়ে ফেলি। যারা পড়েননি এবং 'নিমো গ্রামটা আবার কি রে বাবা' ভাবছেন তাদের আমি কোনো গল্প শোনাব না এই লেখায়, তবুও একটু ইন্টারেস্ট জাগাবার জন্য কয়েকটা কথা বলছি। নিমো হল বর্ধমান জেলার একটা গ্রাম। 'প্রত্যন্ত' বলব না কারণ সেখানে প্রায় সবই আছে, সিনেমা হল থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছুই। এখন পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য প্রত্যন্ত গ্রাম পাওয়া দুষ্কর। এ ওর গায়ে লেগে একাকার হয়ে আছে; মানে শহর, শহরতলি, গ্রাম এরা আর কি। তো এই নিমো গ্রামে না না রকম সব কান্ড কারখানা হয়। কোনোটাই খুব উচ্চকিত নয়। প্ল্যান, প্লট করে সাজানো গল্পও নয়, তাদের জীবন ও যাপন এমনই যে সেখান থেকে গল্প তৈরি হয়ে যায়। এখানেই আসে লেখকের ভূমিকা, সাধারণ একটা ঘটনা থেকেও যে কী ভাবে হাস্যরস বার করা যায় সেটা বেশ ভালো পারেন তিনি। দেখার চোখের গুনে আর পরিবেশনার বলে একটা সাধারণ ঘটনাও পাঠককে দারুন ইন্টারেস্টেড করে তোলে। সে কোন বিয়েবাড়িতে গিয়ে কোনো এক মেয়ের তিরিশ প্লাস রসগোল্লা খাওয়ার গল্প আর সমাজ বিজ্ঞান যে আসলে বিজ্ঞানই নয় সে নিয়ে থিওরিই হোক না কেন, বা ছেলে পিলের ট্র্যাক্টারে চেপে ফিস্টি করতে যাওয়ার ঘটনাগুলোই হোক না কেন। লেজেন্ড অফ নিমোদের কথা অবশ্য আলাদা। তারা সব বস লোকজন। তাদের ঘটনাই আলাদা লেভেলের। পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল, আরে এতো শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের উদ্ভট সব চরিত্র! কেউ দিন রাত ইলেকট্রিক অফিসে ফোন করে ভেজা ফ্রাই করে, কেউ আবার শেষ বয়সে ঘিয়ে ভাজা লুচির জন্য বিদ্রোহ করে আলাদা হতে চায়, কিম্বা বাঘ মারতে গিয়ে ছড়িয়ে লাট করে। কারুর শেষ ইচ্ছা নিজের হাতে পোঁতা গাছের কাঠেই তাকে যেন পোড়ানো হয়, এদিকে বাড়ির লোক কোনো গাছ কাটতেই নারাজ এবং পরে তার দুরন্ত সলিউশন। তবে কচু পাতার ইংরেজি জানতে চেয়ে উত্তর না পেয়ে স্টেশন ভর্তি লোকের সামনে লেখককে সুবলদার হ্যাটা করাটা সেরা।
বলে রাখি যে এরা কিন্তু সব সত্যিকারের মানুষ। কাল্পনিক চরিত্র নয়। তাই এই বই পড়ে কেউ গবেষণার কাজেও লাগাতে পারেন। আমি খুব সাধারণ মেধার পাঠিকা তাই গুছিয়ে বলতে পারব না লোকাল হিস্টোরি নিয়ে কাজগুলো দেশে বিদেশে এখন কতটা সমাদৃত হচ্ছে। ইতিহাস তো অনেক রকম হয়, এই গল্পগুলোও কিন্তু একটা সময়ের সাক্ষী হয়ে থেকে গেল। নিমো গ্রামের বিবর্তনের কথাও ধরা পড়ে কিছু কিছু গল্পে, যেমন 'যাত্রা' গল্পে। গ্রামও বারবার তার চরিত্র বদলায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকার সময় কী কী পরিবর্তন এসেছিল সেটার কথাও উঠে আসে বিভিন্ন গল্পে। তবে বেশিটাই প্রচ্ছন্ন ভাবে। আবার এটাও ঠিক যে অনেক কিছুই বদলায় না। যেমন বন্ধুত্ব, লোককে বাঁশ দেওয়া, দরকারে এক জোট হওয়া এবং ঘটিদের আলসেমি। গল্প গুলো পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল জীবনে খুব স্ট্রেস হলে কয়েকদিন নিমোতে গিয়ে এই মানুষগুলোর মাঝে থেকে আসব। জীবনদর্শনটাই অন্য লেভেলের এদের অনেকের। অবশ্য অনেকেই নিশ্চয়ই এসব দর্শন-টর্শন মাড়ান না। এই দেখুন, কী সব বলে ফেললাম। আসলে ঠেকের ভাষা পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে লেখাতেও চলে আসে। নিমো গ্রামের গল্পের ভাষা নিয়ে এবার তাহলে দু এক কথা বলেই ফেলি। বলাই বাহুল্য যে এই বইয়ের লেখক সুকান্ত ঘোষ নিমো গ্রামেরই ছেলে। ফলত গ্রামের গল্প তাকে বানিয়ে বলতে হয়নি। ভাষার ক্ষেত্রেও তিনি ন্যাকামো বর্জিত নির্মেদ বাংলা গদ্যই বেছে নিয়েছেন যা আবার হাস্যরসে টইটুম্বুর। যারা গ্রামে থাকেননি, যাদের গ্রাম বলতেই রাখাল ছেলে বাঁশি বাজিয়ে গরু চরায় জাতীয় ছবি মনে ভেসে ওঠে, তাদের একটা বিশাল বড় ধাক্কা লাগবে নিশ্চিত। কারণ গ্রাম তো এমন নয়, গ্রাম নিয়ে বেশিরভাগ লেখায় হয় গ্রামকে খুব দুঃখ-কষ্ট জর্জরিত জায়গা হিসাবে দেখানো হয়েছে অথবা স্বর্গের ফার্স্ট কপি হিসাবে। গ্রাম আসলে কেমন, সেখানকার মানুষরা আসলে কেমন তার একটা চাঁছাছোলা ছবি পেলাম এই নিমো গ্রামের গল্পে। সে ক্ষেত্রে ভাষা খুব মার্জিত হলে গদ্যের মজাই থাকত না। ওথেন্টিকও হত না। বন্ধুদের আড্ডায় কেউ কি আর ইস্কুলের বাংলা বইয়ের ভাষায় কথা বলে! এই বইয়ের ভূমিকায় সম্বিৎ বসু লিখেছেন- "আমি জানতে আগ্রহী ঠেকের রীতিনীতি, আদবকায়দা, শব্দভাষার সঙ্গে খুব পরিচিত নন, এমন পাঠকরা কিরকমভাবে এই লেখা নেন। ইনক্লুডিং মহিলা পাঠক। গুরুচন্ডালিতে জানি সুকান্তর পাঠিকার সংখ্যা কম নয়। কাজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে এই গল্প-রসিকতাগুলো আস্বাদনের দিক দিয়ে লিঙ্গনিরপেক্ষ।" একদমই তাই। এই গল্পগুলো ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সবার ভালোলাগার কথা। তার কারণ শব্দভাষার আড়ালে যে অখ্যানটা রয়েছে বা যে দৃষ্টিভঙ্গিটা রয়েছে সেটা লঘু নয়। আর ঠেকের ক্রিয়া কলাপ সম্পর্কে মহিলারা কিন্তু কিছুটা হলেও ওয়াকিবহাল তাদের দাদা/ভাই/বন্ধু-বান্ধব/বয়ফ্রেন্ড/বর এর কল্যানে। আমি তো বলব লেখক যথেষ্ট ফিল্টার করেই লিখেছেন।
এই বই পড়তে পড়তে বেশিরভাগ সময় হেসেছি, কিছু সময় নস্টালজিক হয় পড়েছি। যদিও আমি গ্রামে থাকিনি কিন্তু আমাদের ছোটবেলাটাও খুব কাছা খোলা ভাবে কেটেছিল শহর থেকে দূরের পরিবেশে। আর ছেলেবেলার বন্ধুদেরকেও খুব মিস করে ফেলছিলাম। কিছু কিছু মানুষ জীবনে তার রুট থেকে দূরে চলে যায়, কাজের কারণে বা অন্য অনেক কারণে। তবে কয়েকশো মাইল দূরে চলে গেলেও মন তো পড়ে থাকে সেই ছোটবেলার জায়গায়। লেখককেও চলে যেতে হয়েছিল তার গ্রাম ছেড়ে কিন্তু তার মন মনে হয় নিমোতেই পড়েছিল। ভাগ্যে পড়েছিল। ওই টান অনুভব না করলে কি আর তিনি এই গল্প গুলো লিখতেন!! বড় বড় সাহিত্যিকরা বলেন যে মনের তাগিদ থাকলে তবেই লেখা ভালো হয়। সুকান্তদার ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য।
যাইহোক হাসতে হাসতে দেখলাম কখন যেন বইয়ের শেষে চলে এসেছি। ততক্ষনে আমি নিমো গ্রামের একজন হয়ে উঠেছি প্রায়। ভারত সেবক সমাজের দলে যেন গোপনে ঢুকে পড়েছি, শিবতলাটা যেন স্পষ্ট দেখতেও পাচ্ছি, সাথে নিমোর ওভার অল রাস্তাঘাটও। রাজু, হাবা, আলম, বুলবুল এদের যেন কতদিন ধরে চিনি। কথায় কথায় হয়তো বলেও ফেলব কোনো দিন, "আরে সেবার ঘোষ বাড়ির দুর্গা পুজোয় যা হল না!...." সত্যি বলছি মোটেই ইচ্ছে করছিল না গল্প শেষ হয়ে যাক। তবে শেষে এই মন খারাপকে আরো অনেক ঘন করে দিল শেষের লেখাটা- 'বার বার নষ্ট হয়ে যাই'। লকডাউনের সময়কার ঘটনা, নিমো স্টেশনে আটকে থাকা একটি পরিবারের গল্প। হাসি মজার পিছনে লুকিয়ে যে যন্ত্রনা ছিল সেটা যেন বেরিয়ে এল এক্কেবারে শেষে। অবশ্য মাঝে মাঝেই কিছু কিছু গল্পে লেখক খুব রূঢ় সত্যি ঘটনা টুক করে গুঁজে দিয়েছেন। এমনিতে চোখ এড়িয়ে যেতে পারে, কিন্তু তারপর মনে হয় যা পড়লাম তা কি ঠিক পড়লাম! এটা তো ইয়ার্কি নয়! 'বাবুর বিয়েতে বরযাত্রী' তেমনই একটা গল্প। ভাইয়ের বিয়েতে আমড়া পাড়তে গিয়ে ধরা পড়ার গল্প ঠাট্টার ছলে বলতে বলতে একটা ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা টুক করে বলে দেন লেখক। সেটা কী না হয় পরে পড়ে নেবেন!
তবে আমার কথাটি মন খারাপের রেশ রেখে ফুরাব না। বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ নির্ঝর নৈঃশব্দ্য চমৎকার করেছেন। প্রশংসা না করলেই নয়। শুধু বইটির প্রুফ রিডিংটা আরো একটু ভালো হলে পড়তে পড়তে মাঝে মাঝেই হোঁচট খেতে হত না। পরের সংস্করণে নিশ্চই অবাঞ্ছিত শব্দরা বাদ যাবে, না পড়া আকার, ইকার সঠিক স্থানে যুক্ত হবে! শেষে এটাই বলব, নিমো গ্রামের গল্প বই হয়ে প্রকাশিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। গল্প গুলো দুই মলাটের মধ্যে রাখার দরকার ছিল। তা নাহলে হয়তো ফেসবুকের বিপুল কন্টেন্টের মধ্যে কোথাও হারিয়ে যেত। হয়তো পরে এই বই নিয়ে কেউ এমফিল, পিএইচডিও করে ফেলবে। অথবা 'পঞ্চায়েত' এর মতো ওয়েব সিরিজ হবে। সে যাই হোক, যারাই লেখেন তাদের কোথাও একটা সুপ্ত বাসনা নিশ্চই থাকে পাবলিশড হওয়ার। আর সেটা বাস্তবে রূপায়িত করেছে গুরুচন্ডালি। তাই পাঠক হিসাবে আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। যতই ডিজিটাল ডিজিটাল করি না কেন, বই হাতে নিয়ে পড়ার সুখকে টেক্কা দিতে এখনো কেউ পারে না। পারে কি?