রুই জিঙ্ক, জন্ম ১৯৬১ সালে লিশবোয়ায়। ছোটোবেলা থেকে আঁকাঝোকা করতে করতে বছর ষোলো বয়স থেকে লিখতে শুরু করেন। প্রথম উপন্যাস বেরোয় ১৯৮৬ সালে। তারপর থেকে এতাবৎ আরও ৪৪ টি বই বেরিয়েছে। এর মধ্যে বাচ্চাদের বই আছে, গ্রাফিক উপন্যাস আছে, রম্যরচনাও আছে। কবিতা লেখা বিশেষ পছন্দ করেন না, কারণ তাঁর মতে একজন লেখকের পক্ষে কবিতা লেখা নাকি সবচেয়ে সহজ কাজ। নিজেকে বর্ণনা করেন এই বলে, ‘বই লেখে, ক্লাস নেয়, জিনিসপত্র কল্পনা করে’। লেখার পাশাপাশি তিনি লিশবোয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পোর্তুগিজ সাহিত্যের অধ্যাপক এবং সমাজকর্মী।
এ হেন মানুষটির সাতটি বইয়ের তরজমা বাংলা ভাষায় আছে— ছ-টি উপন্যাস ও একটি গল্প-সংকলন।সব ক-টি বই-ই এই অধম অনুবাদ করেছে। প্রথম বইটির নাম ‘এক সমুদ্দুর বই’। বেরোয় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে; আর সাত নম্বর ‘বেড়াতে যাওয়ার ঠিকানা’ করোনাদেবীর কৃপায় ‘যন্ত্রস্থ’। শুরুটা ২০১২ সালে। রুইবাবুর আশীর্বাদ নিয়ে কপিরাইট জোগাড় করে ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে একটু একটু করে অনুবাদ করি আর বুঝি যে যার জন্য এই বইটা এত ভালো লেগেছিল সেই কথার খেলাই আমার স্বখাত সলিল হবে। বইয়ের গোড়াতেই, মানে যেটা কিনা পরে ‘এক সমুদ্দুরের’ ১২ পৃষ্ঠায় বেরোবে—‘বুঝলে ছোকরা, জাহাজে তিন রকমের দড়ি আছে: ঘড়ির চেন, জুতোর ফিতে আর যে-দড়ি দিয়ে ডিউটির সাথে একজন নাবিকের টিকি বাঁধা থাকে।’ এইখানে আমি ঝাড়া ছ-মাস আটকে ছিলাম।
পোর্তুগিজে ছিল corda (রশি) নিয়ে খেলা। সেটা একেবারেই বাংলায় অনুবাদ করা সম্ভব ছিল না। শেষে এই গোছের একটা ব্যাপার লিখতে বাধ্য হলাম, যেটা কিনা এখনও আমার পছন্দ নয়। ওই আটকে-থাকা অবস্থাতেই দু-মাসের জন্য ফির্নান্দু পেসোয়া-র ওপর গবেষণার কাজে লিশবোয়ায় গেলাম। এখানে বলে রাখা ভালো যে রুইয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ২০১১ থেকেই। তাই এই দু-মাসে রুইয়ের সঙ্গে প্রচুর আড্ডা হল, ওঁর বউ, দুই ছেলে আর তিনটে বেড়ালের সঙ্গে আলাপ হল আর এসবের ফাঁকেফোকরেই ‘আনিবালেইতর’ অনুবাদ করার অসুবিধেগুলো নিয়েও কথাবার্তা হল।
রুইয়ের সাফ কথা—অনুবাদ ভালো করার জন্য ওঁকে প্রচুর প্রশ্ন করতে হবে, তাতে উনি বিরক্ত তো হবেনই না, বরং না করলেই ভয়ংকর দুঃখ পাবেন। দ্বিতীয়ত, পোর্তুগিজে বইটা ওঁর, কিন্তু বাংলায় যে বইটা বেরোবে সেটা আমার। সেটাকে সুপাঠ্য করতে হলে যা যা করা প্রয়োজন তা আমাকেই করতে হবে; তার জন্য মূলের প্রতি বিশ্বস্ত থাকাটা আবশ্যক নয়। আমি পড়লাম মহা ফাঁপরে। আমার অনুবাদে হাতেখড়ি এমন একজনের কাছে যিনি বারবার বলে দিয়েছেন আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে মূলের যতখানি সম্ভব কাছে যাওয়ার। এখানে খোদ লেখক বলছেন উলটো কথা। সে যে কী ভয়ানক দোটানা! সেটা কাটিয়ে উঠতে আমার সাতটা বই সময় লেগেছে। সঙ্গে অবশ্য রুই সমানে উৎসাহ দিয়ে গেছেন।
২০১৪-র গোড়ার দিক থেকে শুরু হল মেল চালাচালি—‘আনিবালেইতর’-এর অনুবাদ শেষ করার জন্য। বেশ কয়েকটা শব্দ আর বাক্যের লিস্ট পাঠাই আর ফিরতি মেলে রুই সেগুলোর মানে ব্যাখ্যা করে দেন; কখনও উদাহরণ দেন, কখনও কোনো লিঙ্ক পাঠান। সে বছরের ২৬ জুনের মেলে লিখেছেন দেখছি, পোর্তুগিজ আর ইংরেজি মিশিয়ে—‘ওয়েন ইন দাউত, ইনভেন্তা। ইউ হ্যাভ মাই ব্লেসিং।’ এরপর বড়োসড়ো গোল বাধল বইটার নামকরণ নিয়ে—সেটারও সমাধান রুই-ই করলেন; নাম দিলেন ‘উম মার দ্য লিভ্রুশ’ যার বাংলা হল ‘এক সমুদ্দুর বই’। সেটাই রইল।
সমস্যা হয়েছিল ‘ওসু’-র বাংলা অনুবাদের নামকরণ নিয়েও। Osso হল একটি ‘প্যালিন্ড্রোম’, মানে এমন একটি শব্দ যা ডানদিক বাঁদিক যেদিক দিয়েই পড়া হোক না কেন তার বানান বা রূপ একই থাকে। এই শব্দটির মানে ‘হাড়’। উপন্যাসের সঙ্গে এর কোনোই সম্পর্ক নেই। রুইয়ের দরকার ছিল একটি প্যালিন্ড্রোমের; ‘ওসু’ সেই শব্দ এটা ঠিক করে নেবার পর সেই অনুযায়ী কিছু সংলাপ উনি লেখেন বা বলা ভালো শব্দটি গল্পের শরীরে ঢোকানোর জন্য কিছু পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। ২০১৫ সালে প্রকাশিত এই বই প্রথম বাংলাতেই অনূদিত হয়, তারপর ফরাসিতে। রুই পরিষ্কার বলে দিলেন বাংলাতেও নামটিকে একটি প্যালিন্ড্রোমই হতে হবে। অনুবাদ শেষ হয়ে গেল প্রায় কিন্তু নাম আর মাথায় আসছে না। শেষে একজন ছাত্রী বলল ‘নয়ন’ হতে পারে না? ভেবে দেখলে ‘নয়ন’ ‘ওসু’-র চেয়ে অনেক বেশি লাগসই নাম। রুই মহা খুশি। হাড়ের বদলে চোখ বসলে উপন্যাসের যা যা পরিবর্তন দরকার তা আমায় করে নিতে বললেন। বেশ কিছু জায়গা আমি নতুন করে লিখলাম, রুইও একটা অনুচ্ছেদ আলাদা করে লিখে দিলেন। ফরাসি অনুবাদটি অবশ্য ‘লে জোয়াইয়্যো তেররিস্ত’ নামে বেরিয়েছে।
সম্প্রতি আর-একটি সমস্যা দেখা দেয়। যে বইটিতে এই সমস্যা দেখা দেয় সেটি ওই সাত নম্বর যন্ত্রস্থ বই। বইটির নাম ‘বেড়াতে যাওয়ার ঠিকানা’। মূল বইতে ছিল: ‘...para o derradeiro …encontro com o criador. Ou com ela.’ অনুবাদে: ‘আর সৃষ্টিকর্তার সাথে তার অন্তিম… সাক্ষাৎকারের জন্য… ।’ গোল বাধল ‘Ou com ela’ নিয়ে কারণ বাংলায় তো সর্বনামের পুংলিঙ্গ বা স্ত্রীলিঙ্গ হয় না। সমস্যার কথা শুনে প্রথমে রুই স্তম্ভিত—লিঙ্গ ছাড়া তোমরা কমিউনিকেট কর কী করে? তারপর বললেন ওই জায়গাটা আমাকে নিজের মতো করে লিখতে হবে যাতে বোঝা যায় যে উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের কাছে মৃত্যু প্রেমিকার মতোই কাম্য। আমি অনেক ভেবে ‘Ou com ela’-র জায়গায় লিখলাম: “অথবা ছলনাময়ী মরণের সাথে।” আর তারপরে যোগ করলাম: ‘মরণ রে তুহুঁ মম রাধা সমান।’ এই বইটি অনুবাদ করার সময়ে আর-একটা ব্যাপার ঘটেছিল। পোর্তুগিজে এর প্রধান চরিত্রের নাম ছিল সেরভাজিত দুভলা, ভারতীয়। থাকে খুব সম্ভবত মাপুসায়, বাবা হিন্দু আর মা গোয়ানিজ। বাংলা অনুবাদের কথা উঠতেই রুই বললেন চরিত্রটি হবে বাঙালি, বাস কলকাতায়, নাম শোভন। সেই অনুযায়ী আমি যেন বইতে যা অদলবদল করার তা করে নিই। বইটা যখন ২০০৮ সালে লেখেন তখনও অবধি উনি কখনও ভারতে বা কলকাতায় আসেননি। তারপর অবশ্য চারবার এসেছেন। তাই এদেশের বিশেষ বর্ণনা বইতে নেই আর আমিও কিছু জুড়িনি বা কোনো তথ্যের বদল ঘটাইনি। বোহেমিয়ান র্যাপ্সডির কিছু লাইন আছে বইতে, রুই আমাকে তার বদলে কোনো হিন্দি সিনেমার গান ব্যবহার করতে বলেছিলেন। আমি অবশ্য সেটা করিনি, কারণ বোহেমিয়ান র্যাপ্সডি-ই আমার ওই জায়গাতে লাগসই মনে হয়েছে আর তা ছাড়া হালফিলের হিন্দি গান সম্পর্কে আমার বিশেষ কোনো ধারণা নেই।
মেলের ব্যবস্থা এখনও চালু আছে। প্রতিটা বইয়ের জন্য যে মেলগুলি সেগুলো আলাদা আলাদা করে একসঙ্গে রেখেছি। আমার এক বন্ধুর কথায় এগুলোর প্রত্যেকটিকে নিয়ে আমি একটি করে ‘দ্য মেকিং অফ...’ বলে একটি সিরিজ বার করতে পারি। সবচেয়ে বেশি মেল চালাচালি হয়েছিল ‘আপোকালিপ্স নাউ’ (বাংলায় “শেষের সে দিন) অনুবাদ করার সময়ে। রুই নিজেই বলেছিলেন যে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসেই তিনি সব চেয়ে বেশি ভাষা নিয়ে খেলেছিলেন। আর এই সময়েই বলেছিলেন যে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে উনি বুঝতে পেরেছেন যে উনি ওঁর পাঠকদের জন্য যেন সবসময়ে একটা ট্র্যাপডোর পেতে রাখেন। রুইয়ের ভাষার বৈশিষ্ট দুটি—একদিকে যেমন খুব পাণ্ডিত্যপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করেন তেমনি আবার একেবারে গ্রাম্য শব্দ বা প্রাচীন কোনো বাগধারাও তাঁর লেখাতে পাওয়া যায়। দুটি ক্ষেত্রেই সেগুলি সাধারণ অভিধানে পাওয়া সম্ভব নয়।
মেলের প্রয়োজন হয়নি ‘দ্য ইন্সতালাসাঁও দু মেদু’ অনুবাদ করার সময়ে, যেটি বাংলায় ২০১৮ সালে ‘ভয়’ নামে বেরোয়। কারণ এই উপন্যাসের অনুবাদ—ইংরেজি এবং বাংলায়—খোদ লেখকের সামনে বসেই করেছিলাম। ২০১৭ সালে রুইয়ের লেখালিখি এবং অন্যান্য কাজকর্ম (পথনাটিকায় অভিনয়, রেডিও ও টেলিভিশানের অনুষ্ঠান, অপেরার লিব্রেত্তো রচনা) নিয়ে গবেষণা করার জন্য লিশবোয়া গিয়েছিলাম। দু-মাস ছিলাম ওঁর বাড়িতে। সেই সময়েই উনি আমায় অনুরোধ করেন ‘মেদু’ ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেবার জন্য। তাই সকালে অনুবাদ করতাম আর বাকি সময়টা গবেষণার কাজ করতাম। একমাস পর বইটা বাংলায় অনুবাদ করার জন্য পোর্তুগিজ সরকার অনুদান মঞ্জুর করলেন। তখন ইংরেজি অনুবাদের কাজ প্রায় শেষ। তারপর ওখানে থাকতেই বাংলা অনুবাদে হাত দিলাম; সেটা শেষ হল অবশ্য কলকাতায় ফিরে। কিন্তু ইংরেজিতে অনুবাদ করার সময়েই সব সমস্যা সামনাসামনি মিটিয়ে নিতে পেরেছিলাম। তাই আর মেল করার দরকার হয়নি। তবে লেখকের সামনে বসে (উনি সারা সকাল রান্নাঘরের টেবিলে ল্যাপটপ খুলে কাগজপত্র ছড়িয়ে গোটা দুই বেড়াল নিয়ে বসে নিজের কাজ করতেন আর আমি বসার ঘরের সোফায় কোলে ল্যাপটপ আর পাশে আরও দুটো বেড়াল নিয়ে বসে অনুবাদ করতাম) তাঁরই লেখা অনুবাদ করার অভিজ্ঞতাই আলাদা। সমস্যা হলে অভিনয় করে, গল্প বলে, গান শুনিয়ে মানে বুঝিয়ে দিতেন। দুঃখের বিষয় সেই ইংরেজি অনুবাদটি আজও অপ্রকাশিত।
শেষের সে দিন
রুই জিঙ্ক
তরজমা: ঋতা রায়
যাদবপুর ইউনিভার্সিটি প্রেস
৩০০ টাকা
বইটি অনলাইন কেনা যেতে পারে এখানে।
রুই জিঙ্কের সঙ্গে ঋতা রায়ের একটি সাক্ষাৎকার ডাউনলোড করে বা অনলাইন পড়তে পারেন এখানে।