সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা মিম ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকদিন। প্রধানমন্ত্রীর হাস্যোজ্জ্বল ছবির ওপরে লেখা, দে, সব বেচে দে লরেন।
ঠাট্টার ছলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত আর তাঁর গুরুর কথোপকথন নকল ক'রে বানানো মিমটি কিন্তু হাসির আড়ালে খুব মারাত্মক একটি সত্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তা হল বর্তমান সরকারের কর্পোরেটের কাছে সব বিক্রি করে দেবার প্রবণতা।
যা কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত, সে লাভজনক বা অলাভজনক, ঢেলে বিক্রি চলছে মোদীর আমলে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব যত পারা যায় কম ক'রে ছলেবলেকৌশলে বেসরকারিকরণের হিড়িক পড়ে গেছে যেন! বেসরকারিকৃত ক্ষেত্র বা প্রতিষ্ঠানগুলির ভালমন্দের দায়িত্ব সরকারের আর রইল না, ফলে তার কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করা বা তার সঙ্গে জড়িত মানুষগুলি মরল না বাঁচল তার হিসেব কে রাখে!
বিজেপি সরকারের এই পরিকল্পিত বিশাল কর্মকাণ্ডের আঁতুড়ঘর হল যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ। ফলে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষাই ওখান থেকে শুরু হয়। যেমন লাভ জিহাদ সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করলে (না করলেও মিথ্যে অভিযোগ এনে) ভিটেমাটি চাটি করে দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু শিশুকল্যাণ নিয়ে কেন্দ্রীয় মদতে উত্তরপ্রদেশে যা হচ্ছে তাতে প্রশ্ন উঠেই যায় শিশুর পুষ্টি, নারী কল্যাণের মতো বুনিয়াদি বিষয়গুলির দায়িত্বও যদি বেসরকারি কাঁধে চাপিয়ে দিতে হয়, তাহলে জনগণের করের টাকা কি কেবল বিলাসবহুল পার্লামেন্ট ভবন তৈরিতে ব্যয় করা হবে? না কি তিনশ ফুট উঁচু মূর্তি তৈরিই জনকল্যাণের শেষ কথা ?
আইসিডিসি বা অঙ্গনওয়ারি ব্যবস্থা যা ৩ বছর থেকে ৬ বছর বয়সের বাচ্চাদের এবং তাদের মায়েদের পরিপূরক পুষ্টি ও অন্যান্য স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান এবং প্রিপ্রাইমারি শিক্ষার বন্দোবস্ত করে, উত্তরপ্রদেশ সরকার আপগ্রেডেশনের নাম ক'রে তার বেসরকারিকরণের ব্যবস্থা করছে। কাদের কাছে এই দায়িত্বভার হস্তান্তরিত হবে? অনিল আগরওয়াল ফাউন্ডেশন( বহুনিন্দিত মাইনিং কম্পানি বেদান্ত লিমিটেডের সহযোগী সংস্থা) এবং বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের কাছে৷ এই দুই সংস্থা কেন্দ্রের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে উত্তরপ্রদেশের ১.০৯ লাখ (অনুমোদন আছে আরো বেশির, ১.৮৮ লাখের) অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্রের মধ্যে ৫০০ টির দেখাশোনা দিয়ে শুরু করবে। দেখে নেওয়া যাক এই দুই সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা কেমন।
বেদান্তের অনিল আগরওয়াল সেই কর্পোরেটদের একজন যারা প্রকৃতি এবং প্রকৃতির সন্তানদের বলি দিয়ে মুনাফার পাহাড় বানায়। হয়ত ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাবে, তবু দক্ষিণ-পশ্চিম ওড়িশার আদিম উপজাতি ডোঙরিয়া কন্ধদের সঙ্গে বেদান্তের টক্কর নেবার ইতিহাস সবিস্তারে জানলে ভাল হয়।
ডোঙরিয়া কন্ধরা বহুদিন হল খবরের শিরোনামে। শুধু তাদের অরণ্যনির্ভর অসাধারণ জীবনযাত্রা বা তাদের যাপন-অনুপ্রাণিত অস্কারজয়ী অবতার সিনেমার সুবাদে নয়। জমিহাঙর, পরিবেশ ও খনিজখোর কর্পোরেট ও কর্পোরেটবান্ধব রাষ্ট্রের সঙ্গে অসম লড়াইতে প্রথম রাউন্ড জিতে যাবার জন্যও বটে। জানিমানি কম্পানি বেদান্ত রিসোর্স-এর বক্সাইট উত্তোলন রুখে দিয়ে তারা গোটা বিশ্বে এই ধরনের প্রতিবাদ ও লড়াইয়ের আন্তর্জাতিক মুখ।
ওড়িশার দুর্ভিক্ষপীড়িত কালাহান্ডি থেকে রায়গড় অব্দি টানা নীল পাহাড়শ্রেণির নাম নিয়মগিরি। এইখানেই বাস কন্ধ উপজাতির। এঁদেরই এক শাখার নাম ডোঙ্গরিয়া কন্ধ। নিয়মগিরিই তাঁদের নিয়মরাজা, যাঁর বসত ঠিক ওই পাহাড়ের মাথায়। তাদের প্রতিপালক এবং দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তিনি অবলীলায় ঠিক করে দেন পরিবেশ, ব্যক্তি এবং সমাজজীবনের সমস্ত নিয়ম। পাহাড় এবং পাহাড়জোড়া অরণ্য পূজ্য, কারণ বনাঞ্চল তাদের জীবনধারণের সমস্ত উপকরণ সরাবরাহ করে, পাহাড়ের মাথা থেকে নেমে আসা ঝরনা নদী তৃষ্ণার জল এবং সেচের জল যোগায়। আর দেয় আত্মিক শান্তি, দুর্লভ জাতিগত সত্তা। ফলে পূর্বজদের আশীর্বাদধন্য এই ভূমি তাদের স্বর্গসমান। পাহাড় তাদের রক্তে এমন ভাবে মিশে আছে যে ডোঙ্গরিয়ারা যেন পাহাড়ময়। তাদের মন্দিরের চুড়ো, অভ্যন্তরের নানা মোটিফ, এমনকি হাতে বোনা শাল অব্দি পাহাড়ের তেকোনা ডিজাইনে ভর্তি। তাঁদের জাতিনামটি এসেছে ডোঙ্গার কথাটি থেকে যার অর্থ হল পাহাড়। নিজেদের তাঁরা ডাকেন ঝার্নিয়া, এই শব্দটির অর্থ ঝরনার প্রহরী। শান্তিপ্রিয় এই মানুষগুলির স্নেহচ্ছায়ায় এই অঞ্চলে টিকে রয়েছে বন্যপ্রাণীর জন্য দু দু-খানা অভয়ারণ্য— কার্লাপট ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি এবং কোটগড় ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি।
ডোঙ্গারিয়াদের বিশ্বাস নিয়মগিরির ঢালে চাষবাস করবার অধিকার তাঁদের অর্পণ করেছেন স্বয়ং নিয়মরাজা। এই ঐশ্বরিক অধিকার কেড়ে নেবার হিম্মত পৃথিবীর কোনও মানুষের নেই। বন থেকে তাঁরা আহরণ করেন দুশোর বেশি খাদ্যবস্তু এবং নিজেরা চাষবাস করে ফলায় আরও একশ রকম। আনারস, কাঁঠাল, আম, কলা, কমলালেবু, মধু, ভেষজ উদ্ভিদ ভরা বনভূমিতে আশ্রয় পায় অনেক পশুপাখি। এত স্বয়ংসম্পূর্ণ এই উপজাতি, নিজেদের ভেষজ চিকিৎসার ধারা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তাঁরা, নিরাময় করছেন আর্থ্রাইটিস, আমাশা, ম্যালেরিয়া, হাড়ভাঙা এবং সর্পদংশন। বোঝাই যায় এই কন্ধভূমি নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে বিস্তীর্ণ এলাকার বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়া।
ঠিক তাই-ই হতে যাচ্ছিল ২০১২ সালে, যখন নিয়মগিরি রেঞ্জের মাটিতে প্রচুর জমে থাকা বক্সাইটের লোভে এই অঞ্চলে নজর পড়ে বিশিষ্ট কর্পোরেট-শকুন, বেদান্ত রিসোর্সের মালিক অনিল আগরওয়ালের। ভারতে নিও-লিবেরাল অর্থনীতির আগমন তখন এদের সামনে সদ্য তুলে ধরেছিল অবাধ লুণ্ঠনের অধিকার। তারই সদ্ব্যবহারে কালক্ষেপ না করে ডোঙ্গরিয়াদের বাসভূমিতে শুরু হয়ে যায় সার্জিকাল স্ট্রাইক, বক্সাইট থেকে ছেঁকে অ্যালুমিনিয়াম তোলবার কারখানা।
প্রথমেই দখল হয় লাঞ্জিগড়। কত দুঃসাহস এই আধুনিক বানিয়াদের যে বক্সাইট খননের নিয়মমাফিক সরকারি অনুমতি পাবার আগেই সংশোধনাগার খুলে বসে সবুজ ডোঙ্গরিয়া গ্রামটির বুকের ওপর। সরকারকে কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে এই সংশোধনাগারের জন্য বনভূমিকে বিন্দুমাত্র ধ্বংস করবে না। কিন্তু মুনাফা আর মিথ্যার বেসাতি যখন ক্রমে বেড়েই চলে, কথা রাখবার দায় তার কোথায় থাকে! প্রথম খেপেই বেদান্ত ৬০ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস করে সংশোধনাগার তৈরি করে এবং সরাসরি পাহাড় থেকে বক্সাইট আনবার জন্য দৈত্যাকৃতি কনভেয়ার বেল্ট বসায়। চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায় লাঞ্জিগড় এবং কিনারি গ্রাম। রিহ্যাব কলোনিতে পুনর্বাসন দেওয়া হয় কন্ধদের। নদী ঝরনা পাহাড়বিহীন কুৎসিত কংক্রিটের খুপরি, নানা রোগের ডিপো আর স্বরাট সম্রাট প্রকৃতির সন্তানের পরিবর্তন হয় কিছু শোষিত কুলিকামিনের কঙ্কালে। বাদবাকিরা সব-হারানো দিন আনি দিন খাইয়ের দলে।
দাবানলে তো দেবালয়েরও রেহাই নেই, তাই সংশোধনাগার থেকে দূষিত বর্জ্য অন্যান্য গ্রামেও নানা চর্মরোগ নিয়ে আসে, সঙ্গে গবাদি পশুর মড়ক। ভূগর্ভে সঞ্চিত জলও রেহাই পায় না দূষণের হাত থেকে। বংশধারা নদী যা কন্ধদের জীবনরেখা, লাল হয়ে যায় দূষিত বর্জ্যে। বেদান্ত কিন্তু আশ্বাস দিয়েছিল খনন সম্পূর্ণ হবার পর অনেক গাছ পুঁতে বনভূমি ফিরিয়ে দেবে। তবে সে কেমন খনন? দিনে ১৬ ঘণ্টা, সপ্তাহে ৬ দিন, ২৩ বছর ধরে চলবে গাছপালা উৎপাটিত করে, মানুষ পশু মেরে বক্সাইট তোলার নামে ধরিত্রীর এই লাগাতার ধর্ষণ। সে সবের শেষে গুটিকয়েক ইউক্যালিপটাসের সদ্য পোঁতা চারা গরম বাতাসে কচি মাথা নাড়াবে— এই-ই হয়তো ছিল বেদান্তের ক্ষতিপূরণ আর বনভূমি সৃজনের ধারণা! পয়সা হজম তো খেলও খতম! হারিয়ে যাওয়া নদী ঝরনা, বাস্তুতন্ত্রের কী হবে সে ব্যাপারে বেদান্ত চুপ। পরিবেশের এই অপূরণীয় ক্ষতি আর একটা দুর্ভিক্ষপীড়িত কালাহান্ডির জন্ম দেবে কিনা ওড়িশায়, সে প্রশ্নে তার মাসতুতো ভাই সরকার বাহাদুরও চুপ। এ সবই বোধহয় কোল্যাটারাল ড্যামেজ। সভ্যতার নির্মাণ আর প্রকৃতি লুণ্ঠনের সময় এসব-ই হয়, বারবারই হয়েছে।
হয় বলে হতেই হবে তা তো নয়। এবার প্রতিরোধ গড়ে তুলল ডোঙ্গরিয়া কন্ধেরা। হাত মেলাল কিছু পরিবেশকর্মী, অন্য কিছু সচেতন মানুষ যাদের শহুরে নকশাল বলে ডাকাটা আজকালকার ফ্যাশন। পাশে দাঁড়াল কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। রাস্তা অবরোধ, গ্রামসভা, মিটিং মিছিল, গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের সব চেষ্টার পরেও যখন বেদান্তের জিপ পৌঁছে গেল পাহাড়চূড়ায়, ঠিক যেখানে নিয়মরাজার বাস বলে কন্ধদের বিশ্বাস, দলে দলে ক্ষিপ্ত ডোঙ্গরিয়া আগুন ধরিয়ে দিল সেই জিপে। আন্তর্জাতিক খবর হয়ে উঠল এই অসম লড়াই। এবার নড়েচড়ে বসে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ওই অঞ্চলের সমস্ত গ্রামসভাকে নির্দেশ দেওয়া হয় গ্রামবাসীরা কী চায় তা জানবার। বারোটি গ্রামসভায় একজোট হয়ে গ্রামবাসীরা জানায় তারা বেদান্তের কারখানা চায় না।
আর দেরি করেনি কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক। বন্ধ করে দেওয়া হয় বেদান্তের বাড়াবাড়ি, সবুজ বনভূমি ধ্বংস করে কুৎসিত খোলামুখ খনি তৈরি ও মুনাফা লোটার পরিকল্পনা।
একটা গণতান্ত্রিক, কল্যাণকামী রাষ্ট্রে এইভাবেই মধুরেণ সমাপয়েত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দেশটার নাম ভারত। তাই ডোঙ্গরিয়াদের কাহিনি এইখানেই শেষ নয়, বরং আরও যেন নিঃশেষ হল তাদের লড়াই। কারণ এইবার শুরু হল হাতে না পেরে ভাতে মারার কাহিনি, আর তাতে নতুন করে জড়িয়ে যেতে থাকল এই বিশাল দেশের কোনায় কোনায় থাকা অসংখ্য আদিবাসী, উপজাতীয় মানুষজন।
কর্পোরেটকে জল-জমিন-জঙ্গলের অধিকার পাইয়ে দেবার প্রবণতা মসনদে শাসক বদলের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে আরও প্রকট হয়েছে। এমন তো নয় যে লাঞ্জিগড়ের রিফাইনারি বন্ধ হয়ে গেছে। তা চলছে বহাল তবিয়তেই। বেদান্ত এ দেশের অন্য জমি খুঁড়ে, কখনও দেশের বাইরে থেকে বক্সাইট আনিয়ে রিফাইনারি চালু রেখেছে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর যা বন্ধ হয়েছে তা হল সম্প্রসারণ। ১১২টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে যদি আবার খনন শুরু হয়। সেগুলোতে আবহমান কাল ধরে বসবাস করছে ডোঙ্গরিয়া ও কুটিয়া কন্ধরা। এছাড়াও আছে কিছু দলিত। এদের সবাইকে নিয়ে পরিবেশ রক্ষার্থে তৈরি হয়েছে নিয়মগিরি সুরক্ষা সমিতি। ২০১৬ সালে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক হঠাৎ এই সমিতিকে মাওবাদী প্রভাবিত আখ্যা দেয়। তার উদ্দেশ্য কী সে তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। জমির ওপর অধিকার কায়েম রাখবার দুই হাতিয়ার হল ল্যান্ড একুইজিশন অ্যাক্ট, ২০১৩ এবং ফরেস্ট রাইট অ্যাক্ট, ২০০৬। এইসব মানবিক আইনি অধিকার ক্রমাগত সংশোধনের চেষ্টা চলছে সরকারি তরফে। বলা বাহুল্য সে সংশোধন কর্পোরেটের কোলেই ঝোল টেনে দিচ্ছে। ২০১৫ সালে সংশোধিত হয়েছে মাইনস অ্যান্ড মিনারেল অ্যাক্ট। এই সংশোধনের জোরে বেদান্ত খোয়াব দেখছে প্রাকৃতিক সম্পদের নিলামে অংশগ্রহণ করে নিয়মগিরিতে আবার থাবা বসাবার। দশ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ওই রিফাইনারির পেছনে। এত সহজে তা ত্যাগ করার প্রশ্ন আসে কি, বিশেষত শাসক যখন তার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন।
তাই সে আজও অবলীলায় উৎপন্ন করে চলেছে রিফাইনারি থেকে বার হওয়া টক্সিক বর্জ্য রেড মাড। লাঞ্জিগড়ের আশেপাশের বাতাস বিষিয়ে যাওয়া আজও চলছে অবাধে। শুধু তাই নয়, ২০১৬ সালে ওড়িশা মাইনিং কর্পোরেশন চেষ্টা চালায় ২০১৩-এর সুপ্রিম কোর্টের রায়, যা গ্রামসভার রায়কে প্রাধান্য দান করেছিল, তাকে পুনরায় বিবেচনা করাবার। যদিও তাদের সে চেষ্টা ধোপে টেঁকেনি তবুও তা বয়ে এনেছে এক অশনিসংকেত। নিয়মরাজার প্রজারা ভীত সন্ত্রস্ত যে নতুন করে খোলা খনিমুখ থেকে যাবতীয় দূষণ গলগলিয়ে বেরিয়ে এসে পণ্ড করে দিতে পারে তাদের এতদিনের সংগ্রাম।
মাওবাদী ছাপ্পা যখন পড়েই গেছে তখন লোকাল বাজারগুলোতে বনজ দ্রব্য বিক্রি করতে আসা ডোঙ্গরিয়াদের কেন রেহাই দেবে সিআরপিএফ আর ওড়িশা সরকারের অ্যান্টি-মাওয়িস্ট ট্রুপ? প্রায়ই জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে তাদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, পুছতাছ চলে। মিথ্যে চার্জ এনে গ্রেপ্তারিও চলে।
গ্রামগুলিতে আজও কোনও পাকা রাস্তা হয়নি সরকারি উদ্যোগে। না হয়েছে স্কুল বা হাসপাতাল। উন্নয়নবিরোধী তকমা লাগিয়ে দিয়ে গ্রামবাসীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে নাগরিকের পাওনা সুযোগসুবিধার প্রাথমিক স্তর থেকে।
হাতে যাদের এতো রক্ত, সেই বেদান্ত নাকি উত্তরপ্রদেশের শিশু এবং মায়েদের পুষ্টি এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে! কোন রেকর্ড দেখে, কী বিবেচনায় কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত তা বোধগম্যতার অতীত।
বিল মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন( BMGF) কিছু ফিলান্থ্রপিস্ট কাজকর্ম সত্ত্বেও অতি সঙ্গত কারণেই ভারতে এবং পৃথিবীর অন্য দেশেও প্রচন্ড সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। আফ্রিকান কৃষিতে মন্স্যান্টো (monsanto) খাতে প্রচুর ডলার ইনভেস্ট করা ছাড়াও টিকাকরণ নিয়ে ভারতে এক কেলেংকারির জনক এই ফাউন্ডেশন। ২০০৯সালে তৎকালীন অন্ধ্রপ্রদেশের খাম্মাম জেলায় ৯থেকে ১৫ বছর বয়সী প্রায় ১৬০০০ মেয়েদের সার্ভিকাল ক্যান্সারের টিকা দেওয়া হয়। এরা বেশিরভাগই ছিল সরকারি হস্টেলে থাকা আদিবাসী মেয়ে। কয়েক মাস বাদ থেকে তাদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে এবং২০১০ এর মধ্যে ৫ টি মেয়ে মারাও যায়। ব্যাপারটি সুপ্রিম কোর্ট অব্দি গড়ালে খাম্মামে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম পাঠানো হয় এবং জানা যায় এই টিকাকরণের সম্মতি বেশির ভাগই দিয়েছিল হস্টেল সুপাররা, যা একেবারেই বেআইনি। গরীব আদিবাসী মেয়েদের গিনিপিগে পর্যবসিত করে এই টিকাকরণের পুরো প্রোগ্রাম চালিয়েছিল যে দুটি সংস্থা, তাদের সম্পূর্ণ আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছিল BMGF.
এই বিতর্কিত সংস্থাগুলির হাতে দেশের দরিদ্র শিশু ও তাদের মায়েরা কতটুকু নিরাপদ? কৃষি, খনি, কর্মসংস্থান, রেল, বিমান, সমস্ত ক্ষেত্র থেকেই হাত তুলে নিচ্ছে এই কর্পোরেটের সরকার, এখন জনকল্যাণমুখী কর্মসূচিতেও কাটছাঁট? তবুও এই আপগ্রেড প্রোগ্রামে বিতর্কিত সংস্থাগুলি কতো টাকা দেবে সেসম্বন্ধে কোনো নিশ্চয়তা না পেয়েই সরকার এতোবড় একটি সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে! পরিকল্পনার কোনো স্পষ্ট রূপরেখা, আর্থিক প্রতিশ্রুতি ছাড়াই বেদান্তের মুখপাত্র সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে অঙ্গনওয়াড়ির আধুনিকীকরণই তাদের লক্ষ্য। মডেল অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্র না বানিয়ে তারা ক্ষান্ত দেবে না। এটা বলতে গিয়ে মুখপাত্রটি টেনে এনেছে বেদান্তের দ্বারা পরিচালিত নন্দ ঘরের কথা। নন্দ ঘর বেদান্তের চাইল্ড কেয়ার সেন্টার যার সম্বন্ধে বিশদে জানে এরকম মানুষ বিরল। নন্দ ঘরের কর্ম পদ্ধতি, পরিচালন ব্যবস্থা, সমস্ত কিছু অজানা থাকা সত্ত্বেও কোন ভরসায় বিশাল আইসিডিএস কর্মকান্ডকে তার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ? কোন সমীক্ষা বা জনমত পর্যালোচনা হয়েছে কি ? বাম এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলি একে বেসরকারিকরণের সরকারি প্রয়াস হিসেবেই দেখছে। পাবলিক ওয়েল্ফেয়ার স্কিমে ফান্ড কমানো এবং ধীরে ধীরে তার থেকে বার হয়ে আসার সরকারী পরিকল্পনার এটি প্রথম ভাগ মাত্র। কিছুদিন পর সরকার বলতে পারে যে নন্দ ঘর এতো ভালো কাজ করছে যে আলাদা করে অঙ্গনওয়ারির আর দরকার নেই। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার, যেখানে কোনো কর্পোরেটই কোনোদিন গিয়ে কাজ করবে না সেখানকার দরিদ্র মা ও শিশুদের বঞ্চনা করবার এবং সমস্ত অঙ্গনওয়ারি কর্মীদের ব্যাপক ছাঁটাই করবার এই নীল নকশা সময় থাকতেই বুঝে নেওয়া দরকার।
সরকার যদি সত্যিই এই ব্যবস্থার উন্নতি চায়, তাহলে অতি অল্প মাইনেতে কাজ করা আইসিডিএস কর্মীদের ভদ্রস্থ বেতন দিতে পারে যাতে তারা আরো উৎসাহ নিয়ে সুচারু ভাবে কাজ করে। বেসরকারি উদ্যোগকে ততোটুকু প্রবেশাধিকার দিতে পারে যাতে তারা এই কর্মীদের উন্নত ট্রেনিং দেয় এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচারের উন্নতি ঘটায়। চোরের মায়ের বড় গলা, তাই একথা শুনে খুব হাসি পায় যে গত পাঁচ বছরে এই খাতে টাকার বরাদ্দ এক পয়সাও বাড়েনি। বাজেটের সেই ১%ই রয়ে গেছে, যদিও মোট জনসংখ্যার ৬৭.৭% হচ্ছে নারী ও শিশু।
বেসরকারিকরণের মধ্যেই কি তাহলে মোদী সরকার খুঁজে পেয়েছে সর্বরোগহর বিশল্যকরণী? লরেন কি তাহলে সত্যিই সব বেচে দেবে? আপামর ভারতবাসী হবে কর্পোরেটের দাস?
কী ভয়ানক :-(
এটা পড়ে আর আগে হনন নামে একটা লেখা বেরিয়েছিল সেটা দেখে আমার এই ভিডিও টার কথা মনে পড়ল।
একবার দেখতে অনুরোধ করব।
অসামান্য লেখায় ঋদ্ধ হলাম। এর আগেও এই ব্যাপারে একটা লেখা আপনার পেয়েছিলাম। মহানদী উপন্যাসটাতেও এই বিষয়েই আলোকপাত করা হয়েছিল। এই লেখাটার লেখিকার নাম ভুলে গেছি।
যাইহোক বেদান্ত ইন্ডাস্ট্রি আর সরকারী গোঠ বন্ধন কে রুখতে সমাজ কর্মী ও এই ভূমির আদিবাসী কন্ধ উপজাতিরা সচেতন হয়ে আছেন এটাই বড় প্রাপ্তি। আপনার মতন মানবিক সিমাজকর্মীরা আছেন আজও সেটাই হয়ত কোনদিন রক্ষা করবে জল জঙ্গল ও জমি।
লেখিকা অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠা ও সাবলীলতার সাথে সরকারের অপদার্থতা ও ঔদাসীন্য প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তুলে ধরেছেন কর্পোরেট গোষ্ঠীর সীমাহীন লোভ, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে লাভের উদগ্র কামনা! আজ এই প্রতিবাদ খুব দরকার! লেখিকাকে ধন্যবাদ!
এই সব ঘটনাক্রম মানুষকে জানানো'ই এ মুহূর্তের দেশপ্রেম। প্রতিরোধের প্রথম পাঠ। কর্মসূত্রে লঞ্জিগড় গিয়েছিলুম। সবুজ স্বর্গের বুকে দগদগে লোডার, ডাম্পার আর এক্সক্যাভেটারের পদচিহ্ন। বেদান্ত একটা বিপজ্জনক বণিক। সিংভূমে সুরদা আর চাপড়ির জঙ্গলপাহাড় কেটে তামা খুঁজতেও এসেছিলো ওরা। তখন মুসাবনিতে ছিলুম। নানা কারণে স্থগিত হয়ে গেছে সেটা। ওদের সি এস আর'ও উদ্দেশ্যরহিত হতে পারে না।
এই মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে এই লেখা। বাজার, অর্থনীতি ও সরকার এই ভার্চুয়াল ত্রিভুজের মধ্যে মানুষের অবস্থান ঠিক কোথায় এই প্রশ্ন একটি স়ংশয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো থিওরি দিয়ে এর সমাধান সম্ভব কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত নই। লেখাটি সেই অনিশ্চিত ধারণার দিকে দিকনির্দেশ করে বলে মনে হয়।
খুব সময়োপযোগী প্রতিবেদন !!আশ্চর্য্য হতে হয় ।...এর পরেও এই সব সরকার ( কংগ্রেস বিজেপি এরা )) এখনো মানুষের কাছে ভোট চায় এবং আমরা কত সহজ ভাবে এদের জিতিয়ে দিই !!আরো অবাক হই ।..যখন দেখি এই সব ইসু গুলো বাদ দিয়ে সাংসদ গন পার্লামেন্ট নামক খোঁয়াড়ে দিনের পর দিন ঘোৎ ঘোৎ করে চলেন আরো কত কি নিয়ে ।..দেশ টাকে এই হারামির বাচ্চারা বিক্রি করে দিচ্ছে ।..আর আমরা সুশান্ত রাজপূত ..কঙ্গনা ..শুভেন্দু ...মমতা ..আর ওই দাড়িওয়ালা খুনি টার গপ্পো শুনছি ????
তোমার লেখা যত পড়ি ততই শিখি তত জানি।দেখবে মাঝে মাঝে ই বস্তীতে আগুন লেগে যায়। সব ভস্মীভূত। মিডিয়ার ক্যামেরা একশান প্যাক আপের পর আর কি হলো দায় থাকে না। আমরাও আর জানতে পারিনা। শুধু দেখি শশ্মানে কলস ভেঙে যাওয়ার মতো পড়ে আছে কিছু পোড়া গৃহস্থালি
অনেক তথ্য সংগ্রহ করে লেখা। সরকারি নীতির সমালোচনা অবশ্যই যৌক্তিক।
তবু একটি বিনীত প্রশ্ন আমাদের শহুরে নাগরিক সমাজের দায়িত্ব কি এইসব লেখালেখিতেই সীমিত? বিপুল ও ক্রমবর্দ্ধমান ভোগের যে জীবন আমরা যাপন করি, তা কি আরো ভোগ আরো উৎপাদনের মূল কারণ নয়?
আমাদের প্রত্যেককে বদলাতে হবে জীবনযাপনের ধারা। চাহিদা কমলে যোগান শেষ পর্যন্ত কমতে বাধ্য। এ তো অর্থনীতির গোড়ার কথা।
বেদান্ত শুধু ওড়িশা নয় , আফ্রিকার জামবিয়াতে এক খেলা দেখিয়েছেন। বেদের অন্ত
কি সর্বনাশ! ঝার্নিয়ারা প্রতিরোধ গড়েছেন জেনে ভাল লাগছে। কর্পোরেট বাণিজ্যকে রুখতেই হবে!
~
তীর ধনুকে দাও শান/ আবার হবে উলু গুলান!