দ্বিতীয় পর্ব - ১২,০০০ থেকে ৬০০ বি.সি.ই – পঞ্চম ভাগ
২.৫.১ চতুর্বর্ণাশ্রম
ব্রাহ্মণ্য সমাজের এই চারটি শ্রেণী – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র - বিন্যাসকে চতুর্বর্ণাশ্রম বলা হয়ে থাকে। এই বর্ণ মানে কি রঙ? চলন্তিকা অনুযায়ী – বর্ণ শব্দের অর্থ বলা হয়েছে – রঙ, অক্ষর (যেমন স্বরবর্ণ ইত্যাদি), এবং জাতি (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ইত্যাদি)। শব্দকোষের বক্তব্যও প্রায় একই।
তাহলে কী এই শ্রেণী বিভাগ ত্বকের রঙ দেখে করা হয়েছিল? সেক্ষেত্রে আর্য ব্রাহ্মণ – যারা সারাদিন গাছের ছায়ায়, কুটিরে বসে বেদচর্চা করত, তাদের গায়ের রঙ গৌরবর্ণ (? গোধূমবর্ণ)। আর্য ক্ষত্রিয়দেরও একই গায়ের রঙ হওয়ার কথা - কিন্তু রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে তাদের যুদ্ধ শিখতে হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে চোট-আঘাত সহ্য করতে হয়েছে – অতএব তাদের গায়ের রঙ তামাটে (তাম্রাভ) হতে পারে। সমাজের দক্ষ কাজের মানুষরা বৈশ্য - তাদের অধিকাংশ মানুষই ছিলেন অনার্য - তাদের গায়ের রঙ ছিল কালো (কৃষ্ণ)। শুদ্রদের সকলেই অনার্য – তাদেরও গায়ের রঙ কালো। ত্বকের এই বর্ণ বিচার করেই কি ব্রাহ্মণরা চতুর্বর্ণ সৃষ্টি করেছিল? নাঃ, ব্যাপারটা এত সহজ ও সরল বলে মনে হয় না।
সংস্কৃতে একটি ক্রিয়াপদের মূল বা ধাতু হল, বৃ। ব্যাকরণ কৌমুদীতে এই বৃ ধাতুর অর্থ দেওয়া আছে to choose। বৃ-ধাতুর সঙ্গে নানান প্রত্যয়ের যোগসাজসে অনেকগুলি শব্দ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ল্যুট্ প্রত্যয়ে সিদ্ধ হয়ে বৃ হয়েছে বরণ বা বরণম্। যার অর্থ বরণ করা, সসম্মানে গ্রহণ করা – যেমন বধূবরণ, পতিত্বে বরণ। কিংবা কোন বিশেষ উদ্দেশে কষ্ট স্বীকার করা, যেমন কারাবরণ। ক্ত-প্রত্যয়ে সিদ্ধ হয়ে বৃ হয়ে যায় বৃত, যার অর্থ নির্বাচিত, মনোনীত, সিদ্ধান্ত-কৃত (selected, decided)। যদিচ বৃ-ধাতু থেকে কোন প্রত্যয় যোগ করে, “বর্ণ” শব্দে পৌঁছানো যায় – এমন কোন সূত্র ব্যাকরণ কৌমূদীতে মেলেনি। তবু আমার ধারণা, এই শব্দগুলি ব্রাহ্মণদের সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে বেশ মিলে যায়। ব্রাহ্মণরা অনেক বিচার-বিবেচনা, চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এবং নির্বাচন করেছিল, সমাজের কোন স্তরে থাকবে আর্যরা এবং অনার্যদের কোথায় স্থান দেওয়া হবে।
এই প্রসঙ্গে অনেক বিতর্ক ও আলোচনার অবকাশ রয়ে গেল। অতএব এ প্রসঙ্গের এখানেই সমাপ্তি হোক। আমরা বরং মেনেই নিই, অন্যান্য অর্থের সঙ্গে বর্ণ শব্দের মানে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ইত্যাদি জাতি।
এবার আমরা চোখ ফেরাই, নিজেদের মনোমত বর্ণ-ব্যবস্থা গুছিয়ে নিয়ে ব্রাহ্মণ ঠিক কেমন সমাজ গড়ে তুলল। আর এই সমাজ ব্যবস্থা ভারতের কোন কোন অঞ্চলকে কতখানি প্রাভাবিত করল। এই বিষয়ে আমি “মহাভারত”-এর মতো মহাকাব্যকেই প্রামাণ্য হিসেবে ধরেছি। অতএব মহাভারত এই বিষয়ে আমাদের কতখানি সাহায্য করতে পারে সেটাও দেখে নেওয়া যাক।
২.৫.২ ভারতে আর্যদের প্রাথমিক বিস্তার
১৫০০ বি.সি.ই-তে ভারতে পা রেখে, মোটামুটি গুছিয়ে বসে কর্তৃত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠা পেতে আর্যদের চার-পাঁচশ বছর চলেই গেল। বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন অঞ্চল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। যদিও প্রাথমিক ভাবে আর্যরা গঙ্গা পার হয়ে দক্ষিণদিকে তখনও সম্ভবতঃ আসেনি। সে সময় আর্যাবর্তের সীমানা ছিল যমুনা নদী থেকে পূর্বদিকে বঙ্গ[1]র সীমানা পর্যন্ত। দক্ষিণে গঙ্গা এবং উত্তরে হিমালয় পর্যন্ত তরাই অঞ্চল। এই সময়কার প্রত্ন-নিদর্শনেও।..
"ধর্মাধর্ম" গ্রন্থাকারে গুরুচণ্ডা৯ থেকে প্রকাশিত।
...অর্জুনের মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার পাণিগ্রহণের কাহিনী বহু শতাব্দী পরে সংযুক্ত হয়েছে। সেকথা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা যাবে।
২.৫.৩
মহাভারতে সমাজ কথাসমাজের একক যদি ধরা হয় পরিবার, সেক্ষেত্রে পরিবারের অন্যতম সামাজিক অনুষ্ঠান বিবাহ। বিবাহ ছাড়া দাদু-ঠাকুমা-মাতা-পিতা-পুত্র-কন্যা-ভাই-বোন সম্পর্কগুলির প্রবাহ, নির্দিষ্ট অবস্থান, অধিকার ও দায়িত্ব নির্ণয় করা যায় না। এই বিবাহ সম্পর্কে মহাভারতের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গীর দিকে নজর রাখা যাক।
ঋষি উদ্দালকের পুত্র ঋষি শ্বেতকেতু আর্যসমাজে প্রথম বিবাহ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। এই প্রসঙ্গ এসেছিল নিজের অক্ষমতার কারণে রাজা পাণ্ডু যখন পত্নী কুন্তীকে নিয়োগ প্রথায় সন্তান ধারণের কথা বোঝাচ্ছিলেন। তিনি পত্নী কুন্তীকে বলছেন, “হে সুমুখশ্রীযুক্তে, আগেকার দিনে মহিলারা অনাবৃত ছিলেন। তাঁরা ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারতেন। তাঁদের কারও অধীনে থাকতে হত না। যৌবনে তাঁরা এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে আসক্ত হলে কোন দোষের হত না। ইতর প্রাণী অর্থাৎ পশুপক্ষীরা আজও তাই করে থাকে। উত্তরকুরু
[4]তে আজও এই প্রথাই চালু রয়েছে। হে চারুহাসিনি, এই (বিবাহের) প্রথা কীভাবে এদেশে প্রচলিত হয়েছিল, বলছি শোন। প্রাচীন কালে উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন, তাঁর পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। একদিন তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে আছেন, এমন সময় এক ব্রাহ্মণ এসে তাঁর মায়ের হাত ধরে বললেন, “এস, আমরা যাই”। পিতার সামনেই মাতাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়াতে মহর্ষিপুত্র ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। তাই দেখে মহর্ষি উদ্দালক বললেন, “বৎস, ক্রোধ করো না। এটাই স্বাভাবিক ধর্ম। গাভীদের মতো মহিলারাও সজাতীয় শত-সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও, কোন দোষের হয় না”। মহর্ষি পুত্র পিতার কথা শুনে আরও ক্রুদ্ধ হলেন এবং এরপর মানব সমাজে জোর করে এই নিয়মের প্রচলন করে বললেন, “আজ থেকে যে স্ত্রী পতি ছাড়া অন্য পুরুষের সংসর্গ করবে এবং যে পুরুষ পতিব্রতা স্ত্রীকে ছাড়া অন্য মহিলায় আসক্ত হবে, দুজনকেই ভ্রূণহত্যার মতো ঘোরতর পাপের পাঁকে লিপ্ত হতে হবে। আর স্বামী পুত্র লাভের ইচ্ছায় নিয়োগ করলে যে স্ত্রী তাঁর আজ্ঞা অমান্য করবে, তারও ওই একই পাপ হবে”। [আদি/১২২]
[5]এর অর্থ আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার বেশ কয়েকশ বছর পরে, “বিবাহ” নামক প্রথম সামাজিক অনুষ্ঠানের...
"ধর্মাধর্ম" গ্রন্থাকারে গুরুচণ্ডা৯ থেকে প্রকাশিত।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনাত্মীয়া নারী ও পুরুষের মধ্যে সাংসারিক বন্ধনের যে সামাজিক অনুষ্ঠান, যার সংস্কৃত নাম “বিবাহ”, সেই অনুষ্ঠানের অধিকাংশ রীতি ও প্রথাই এসেছে অনার্য সংস্কৃতি থেকে। অর্থাৎ পাত্র ও পাত্রীর প্রাক-বিবাহ এবং বিবাহ-পরবর্তী যাবতীয় প্রথা, সবই অনার্যদের রীতি। এর মধ্যে আর্য রীতি ঢুকেছিল যজ্ঞের অগ্নিকে সাক্ষী রেখে, সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করে বর ও কনের সারাজীবন একত্রে থাকার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ। আর্যদের অগ্নি ছিল অন্যতম অবসেসন (obsession) – জন্ম থেকে মৃতদেহ সৎকার তাদের জীবনের প্রতিটি অনুষ্ঠানের আবশ্যিক উপকরণ হল আগুন। প্রসঙ্গতঃ আর্যরাই আমাদের দেশে শবদাহের প্রথারও প্রচলন করেছিল।
অতএব, এমন সিদ্ধান্ত করাই যায়, ঠিক এই সময় থেকেই, সংস্কৃত ভাষার মোড়কে অনার্য সংস্কৃতি ব্রাহ্মণ্য-ধর্মে ঢুকে পড়ল এবং সম্ভবতঃ এটাই তার হিন্দু ধর্ম হয়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ। বিবাহ-অনুষ্ঠানের সৃষ্টি যদি ব্রাহ্মণ্যধর্মের হত, সারা ভারতে তার প্রকরণ মূলতঃ একই রকম থাকত। কিন্তু তেমনটা হয়নি, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে, আঞ্চলিক নিজস্ব রীতি ও প্রথায় বিচিত্র ধরনের বিবাহ-অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, যার মধ্যে অগ্নিসাক্ষী রেখে পাত্র-পাত্রীর জীবন সঙ্গী হয়ে ওঠার শপথ গ্রহণেই একমাত্র মিল দেখতে পাওয়া যায়।
এই আনুষ্ঠানিক বিবাহ সহ মহাভারতে আটপ্রকার বিবাহের বিধান দেওয়া আছে, সেই আটটি হল,
১. ব্রাহ্ম – বরের বিদ্যা, বুদ্ধি ও বংশ বিচার করে, কন্যাকর্তা যখন কন্যাদান করেন।
২. দৈব - যজ্ঞের ঋত্বিকের উপর সন্তুষ্ট কন্যার পিতা যদি তাঁকে কন্যা দান করেন।
৩. আর্য – কন্যার শুল্কস্বরূপ বরের থেকে দুই বা ততোধিক গো গ্রহণ করে কন্যাদান।
৪. প্রাজপত্য– বরকে প্রচুর ধনরত্নে সন্তুষ্ট করে কন্যাদান।
৫. আসুর – কন্যাপক্ষকে প্রচুর ধনসম্পদে সন্তুষ্ট করে, কন্যা গ্রহণ।
৬. গান্ধর্ব - বর ও কন্যার প্রণয় থেকে যে বিবাহ সম্পন্ন হয়।
৭. রাক্ষস – কন্যাপক্ষ কন্যা দানে রাজি না হলেও, বর যদি গায়ের জোরে ক্রন্দনরতা কন্যাকে বিবাহ করে।
৮. পৈশাচ – ঘুমন্ত অথবা প্রমত্তা কন্যাকে বলাৎকার করে, রমণ করা। [অনু/৪৪]
উপরের আটটি বিবাহ পদ্ধতির মধ্যে ব্রাহ্ম, দৈব এবং প্রাজপত্য সকলের জন্য ধর্মসঙ্গত। এই প্রথার বিবাহ অনুষ্ঠানে উভয় পক্ষের অভিভাবকের সম্মতি আবশ্যিক ছিল। গান্ধর্ব ও রাক্ষস ক্ষত্রিয়দের পক্ষে চলতে পারে। আর্য ও আসুর নিন্দনীয়। পৈশাচ বিবাহ সমাজে নিন্দিত। এই বিবাহ প্রথার নিয়মগুলি থেকে আন্দাজ করা যায়, আর্য সমাজে তখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক বিবাহ অনুষ্ঠান ছাড়াও, নারী-পুরুষের কিছু নিন্দনীয় সম্পর্কও প্রচলিত ছিল। যাকে সমাজ একধরনের বিবাহ বলেই স্বীকৃতি দিয়েছে। অতএব আর্যদের প্রাচীন সামাজিক রীতির কিছুটা আভাস এর থেকে আন্দাজ করা যায়। এ ছাড়াও আরেকটি ধর্মসঙ্গত বিবাহের প্রথা ছিল, স্বয়ংবর বিবাহ। যদিচ সেই প্রথা সাধারণের জন্যে নয়, বিশেষ কোন অসামান্যা রাজকন্যার জন্যে প্রচলিত ছিল।
যদিও ধর্মসঙ্গত প্রথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, মহাভারতের বেশ কয়েকটি প্রধান চরিত্র, কামনা চরিতার্থ করেছিলেন। যেমন,
দুষ্মন্ত-শকুন্তলা – শকুন্তলা তাঁর পালক পিতা কণ্বমুনির অনুমতি ছাড়া মিলিত হতে না চাইলেও, দুর্দান্ত রাজা, দুষ্মন্ত বলেছিলেন, “তোমার শরীর তোমারই অধীন, পিতার অপেক্ষার প্রয়োজন কী? আত্মাই আত্মার বন্ধু, আত্মাই আত্মার গতি। অতএব তুমি নিজেই আমাতে আত্মসমর্পণ করতে পারো”। (আদি/৭৩) আশ্রমবাসীনি এক কিশোরীকে কামনা করে দুষ্মন্তের মতো বিখ্যাত রাজার এই প্ররোচনামূলক উপদেশ তাৎপর্যপূর্ণ বৈকি! প্রসঙ্গতঃ তাঁদের এই মিলনে জাত পুত্রের নাম, ভরত, যাঁর থেকে এই দেশের নাম ভারতবর্ষ।
পরাশর-সত্যবতী – সর্বজনশ্রদ্ধেয় ঋষি পরাশর, কুমারী ধীবরকন্যা সত্যবতী (মৎস্যগন্ধা)-কে কামনা করায়, সত্যবতী বলেছিলেন, “ভগবন্, আমি পিতার অধীন, সুতরাং আপনি সংযত হন। আমার কৌমার্য নষ্ট হলে আমি কী করে পিতৃগৃহে বাস করব?” (আদি/৬৩)। কিন্তু ঋষি সে কথায় নিরস্ত হননি। মিলনের আগে তিনি কন্যাকে পদ্মগন্ধী করে তোলেন এবং মিলনের পরেও কন্যার অক্ষত কৌমার্যের বর দিয়ে ঋষি পরাশর সত্যবতীর সঙ্গে নির্জন এক নদী-দ্বীপে মিলিত হন। তাঁদের পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস – বেদের সংকলক ও মহাভারতের রচয়িতা! এই ধীবরকন্যা সত্যবতীই আবার ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পিতামহী এবং বেদব্যাস তাঁদের পিতা! অর্থাৎ কৌরব আর্যগোষ্ঠীর রক্তে ওতপ্রোত মিশে গিয়েছিল অনার্য রক্ত।
সূর্য্য-কুন্তী – মুনি দুর্বাসার বরের সত্যতা পরীক্ষা করতে কৌতূহলী কিশোরী ও কুমারী কুন্তী সূর্যকে আহ্বান করেছিলেন। সত্যি সত্যি সূর্যদেব যখন উপস্থিত হলেন, কুন্তী ভয়ে এবং লোকলজ্জায় বলেছিলেন, “দেব, আমার পিতামাতা প্রমুখ গুরুজন আমাকে দান করার অধিকারী। দয়া করে আমাকে অধর্মে লিপ্ত করবেন না”। (বন/৩০৫)। বলা বাহুল্য, সূর্যদেব কুমারী কুন্তীকে দয়া করেননি এবং তাঁদের মিলনে জাত পুত্রের নাম, কর্ণ। মহাভারতে অর্জুনের পরেই সব থেকে বর্ণময় চরিত্র।
সাধারণ সমাজে পুরুষের এক বিবাহের প্রচলন থাকলেও, রাজপরিবারের বহুবিবাহ সাধারণ ঘটনা ছিল। অতি প্রাচীন পৌরাণিক কালে ব্রহ্মার মানসপুত্র দক্ষ-প্রজাপতি, তাঁর তেরটি কন্যা মারীচ-কশ্যপকে, দশটি কন্যা ধর্মকে এবং সাতাশটি কন্যা চন্দ্রকে দান করেছিলেন। মহারাজা পাণ্ডুর দুই পত্নীর - কুন্তী ও মাদ্রীর সংস্থান করেছিলেন, তাঁর পিতৃব্য মহামতি ভীষ্ম। পাণ্ডব ভাইদের যৌথ পত্নী দ্রৌপদী ছাড়াও সকলেরই অন্য পত্নী ছিলেন।
পাণ্ডবদের পাঁচ ভাই মিলে দ্রৌপদীকে বিবাহ করা, আর্যসমাজে বিরলতম একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। এই বিবাহের অনুমোদন ও আয়োজন স্থির করতে রাজা দ্রুপদের রাজসভায় বিতর্কের ঝড়।..
"ধর্মাধর্ম" গ্রন্থাকারে গুরুচণ্ডা৯ থেকে প্রকাশিত।
...অন্তঃপুরের দাসীদের কতটা দুর্গতি নীরবে সহ্য করতে হত। এমনকি কৌরব রাজসভায়, পাশা খেলায় সর্বস্ব হারানো পাণ্ডব-পত্নী দ্রৌপদীকে “দাসী” সম্বোধন করে, দুর্যোধন, দুঃশাসন এবং কর্ণ যে আচরণ করেছিলেন, তার থেকেও দাসী সম্পর্কে তাঁদের কদর্য ধারণাই স্পষ্ট হয়। বস্তুত মহীয়সী নারী দ্রৌপদীর বারবার ভাগ্য বিড়ম্বনা না ঘটলে, রাজান্তঃপুরের পরিচারিকা ও দাসীদের দুর্গতির কথা আমরা হয়তো জানতেও পারতাম না।
মহাভারত গ্রন্থের এইখানে অনন্যতা, রাজা-রাজড়াদের স্তব-স্তুতি মূলক অতিরঞ্জন বর্ণনা যেমন আছে, তেমনই আছে এমনই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা অনেক ঘটনার উদ্ঘাটন। এবার আমরা মূল আলোচনায় আবার ফিরে যাই।
২.৫.৪ বর্ণভেদের সমাজ
শুরুতে আর্যদের গোষ্ঠীতে প্রাথমিক ভাবে কোন বর্ণভেদ ছিল না। খুবই স্বাভাবিক, পরিবারভিত্তিক গোষ্ঠীর একই পরিবারের মধ্যে বর্ণভেদ হয় কী করে? অন্য পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে যুক্ত হয়ে যখন সমাজ গড়ে উঠতে লাগল, তখনই বর্ণভেদের সূত্রপাত। প্রথম দিকে পারিবারিক গোষ্ঠীর সদস্যরা সকলেই ব্রাহ্মণ ছিলেন, কারণ ভগবান ব্রহ্মা ছিলেন তাদের সবার পিতামহ। তবে সেই ব্রাহ্মণ চতুর্বর্ণের ব্রাহ্মণ নন, বলাই বাহুল্য।
আর্যদের বহু গোষ্ঠী এবং অনার্য মানুষদের নিয়ে যখন বৃহত্তর সমাজ গড়ে ওঠার সূত্রপাত হল, তখন দেখা গেল, কিছু মানুষ চিন্তাভাবনা, শাস্ত্র-টাস্ত্র এবং ঈশ্বরের ধ্যান নিয়ে শান্তিতে থাকতে ভালোবাসেন - এগুলি তাঁদের সত্ত্বগুণ। কিছু মানুষের স্বভাব মারকুটে, হাঁকডাক করা এবং কর্তৃত্ব ফলানো – এগুলি রজোগুণ। কিছু মানুষের স্বভাব সারাদিন কিছু না কিছু কাজ করে যাওয়া। অনার্যদের থেকে শিখে কেউ চাষবাস করছে, মাটির পাত্র, হাঁড়ি-কলসি বানাচ্ছে। কাঠ দিয়ে রথের চাকা, আসবাবপত্র বানাচ্ছে। লোহা পিটিয়ে যন্ত্রপাতি অস্ত্র-শস্ত্র বানাচ্ছে। এগুলির কিছু রজো আবার কিছু তমোগুণ। আবার কিছু মানুষ একটু বোকাসোকা ধরনের। নিজে থেকে তেমন কিছুই করতে পারে না, কিন্তু অন্যে বলে দিলে, মন দিয়ে সে কাজটা করতে পারে অথবা অন্যের সেবা করতে পারে – এটি তমোগুণ। এই ভাবেই গুণগতভাবেও চার বর্ণের সূত্রপাত হল, যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র (শান্তি/১৮৮)। প্রসঙ্গতঃ মহাভারতের এই অধ্যায়েই বলা হয়েছে, ভগবান্ ব্রহ্মা “দেব, দানব, গন্ধর্ব, দৈত্য, অসুর, যজ্ঞ, রাক্ষস, নাগ, পিশাচ এবং ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চতুর্বিধ মনুষ্যজাতির” সৃষ্টি করেছিলেন। কাজেই এই পর্যায়ে শুধু আর্যরাই ব্রহ্মার সন্তান – এমন সীমিত ধারণা থেকে পিতামহ ব্রহ্মার মুক্তি মিলল।
সামাজিক এই বিন্যাস নিয়ে মানুষের মনে যাতে কোন বিভ্রান্তি না আসে তার পেছনে একটা ধর্মীয় মোড়ক প্রয়োজন। আগে সব মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল ব্রহ্মার থেকে, এখনও তাঁরা তাই রইলেন। কিন্তু তাঁদের জন্মস্থান বদলে গেল। ব্রাহ্মণদের জন্ম হল ভগবান ব্রহ্মার মুখ থেকে, তাঁর বাহু থেকে ক্ষত্রিয়দের, উরু থেকে বৈশ্যদের এবং পা থেকে শূদ্রদের (ভীষ্ম/৬৭)। এবং তাঁদের মধ্যে সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ– এই তিনটি গুণগত পার্থক্য দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হল, কেন তাঁরা একে অপরের থেকে আলাদা ও নিকৃষ্ট। চার বর্ণের আরও একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রত্যেকটি বর্ণই জন্মগত বর্ণ। অর্থাৎ জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণের সন্তান ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ের সন্তান ক্ষত্রিয়, ইত্যাদি।
প্রত্যেক বর্ণেরই প্রধান কর্মসমূহ নির্দিষ্ট ছিল, যার কথা আগেই বলেছি। কিন্তু বর্ণ অনুযায়ী কর্ম না করলেও ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণত্ব..
"ধর্মাধর্ম" গ্রন্থাকারে গুরুচণ্ডা৯ থেকে প্রকাশিত।
...জাতি বলা হয়েছে। বস্ত্র ও কাপড়চোপড় পরিষ্কারের দায়িত্ব ছিল রজক জাতির। রাজসভায় উপস্থিত থেকে রাজা ও অন্যান্য রাজ-অতিথির বন্দনা করতেন বন্দী জাতির মানুষরা। নিষাদ জাতির কাজ ছিল মাছধরা। মদ প্রস্তুত করতেন, মৈরেয়ক জাতি। মাছধরা কিংবা অন্যকাজের জন্যেও যাঁরা জাল বুনতেন, তাঁদের আয়োগব জাতি বলা হয়েছে। দাস জাতির মানুষেরা নৌকা বানিয়ে এবং নৌকা চালিয়ে জীবিকা অর্জন করতেন।(অনু/৪৮)। যাঁরা চিকিৎসা করে, অসুস্থকে নিরাময় করতেন, তাঁরা হলেন, অম্বষ্ঠ বা বৈদ্যজাতি। এরকম আরও কিছু বর্ণসংকর জাতির নাম পাওয়া যায়, যাঁদের বৃত্তি সম্পর্কে সঠিক কোন ধারণা পাওয়া যায় না, যেমন, উগ্র, শ্বপাক, পুক্কশ, স্তেন, মাগধ, করণ, ব্রাত্য ইত্যাদি। (শান্তি/২৯৭)। এই ধরনের জাতিগুলিকে বর্ণ-সংকর বলে, সমাজে নিজেদের বর্ণাশ্রমকে শ্রেষ্ঠতা প্রতিপন্ন করাই যে সমাজরক্ষকদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, একথা সহজেই অনুমান করা যায়।
২.৫.৫ সামাজিক ক্ষোভ ও অসন্তোষ সামাজিক এই শ্রেণী বিভাগে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল শুরুর থেকেই। এতদিন যারা নিজেদের সুখ-দুঃখ নিয়ে নিজেদের সামাজিক ব্যবস্থায় অভ্যস্ত ছিল, নতুন বিভাজনে তাদের মনে ক্ষোভ ও বিরক্তি আসবেই। ব্রাহ্মণরাও তার আঁচ বুঝতে ভুল করেনি। তারা এই অসন্তোষ এবং ক্ষোভ প্রশমনের দাওয়াই নিয়ে এল - জন্মান্তর। এই জন্মে তোমরা যে কষ্ট পাচ্ছো, তার কারণ তোমাদের পূর্বজন্মের কৃতকর্ম। এই জন্মে মন দিয়ে নিজেদের কাজ করো, উচ্চশ্রেণীর সেবা করো। ঝগড়াঝাঁটি, ঝুটঝামেলা বাধিও না, পরজন্মে তোমাদেরও ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় ঘরে জন্ম হবে, তখন সুখই সুখ।
ক্ষোভ এবং অসন্তোষ যতই হোক, অসহায় অনার্যদের কিছু করারও ছিল না, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। এমনকি তাদের এতদিনের ভরসা দেব-দেবীদের কাছে আকুল প্রার্থনা করার স্বাধীনতাটুকুও তারা হারিয়ে ফেলছিল। সেখানেও আর্য মানুষেরা বিদ্রূপ করে, অবহেলা করে, কখনো কখনো তাদের দেব-দেবীর মূর্তি ছুঁড়ে ফেলে দিল আবর্জনায়
[8]। আর্যদের দেবতা ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ। তাঁদের জন্যে আছে গ্রামভারি মন্ত্র, যজ্ঞ, যজ্ঞের আগুনে আহুতি। সে মন্ত্রের ভাষা সাধারণ অনার্যদের কাছে দুর্বোধ্য। তারা দূর থেকে দেখে, পুরোহিতদের গম্ভীর আচরণ, তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ, মন্ত্রের উচ্চারণ, যজ্ঞের আগুনে প্রচুর ঘি এবং প্রচুর আহুতি দান। যজ্ঞের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় গ্রাম। যজ্ঞশেষের ছাই উড়তে থাকে বাতাসে।
এই যজ্ঞের সমস্ত উপচার, অনার্য দাসেরাই সংগ্রহ করে দেয়। যজ্ঞের বেদী নির্মাণ, বিপুল সমিধসম্ভার, তৈজসপত্র, ঘি, দুধ, শস্য, ফল-মূল সর্বত্র তাদেরই হাতের স্পর্শ। যজ্ঞ শেষে পুরোহিতরা দক্ষিণা হিসাবে তাদের ঘরে নিয়ে যায় যে বিপুল সম্পদ – সোনা, রূপো, সবৎসা-গাভী, অজস্র শস্য সম্ভার, ধাতব কিংবা মাটির পাত্র – সে সবই অনার্য বৈশ্য ও শূদ্রদের পরিশ্রমের উৎপাদন। অথচ তারা বুঝতেই পারে না, দেবতারা কারা। পুরোহিতরা কাদের জন্যে যজ্ঞ করছেন। যে মন্ত্র তাঁরা বলছেন, তার মধ্যে কোথাও কী আছে বিপুল এই অনার্য শ্রমের সামান্যতম স্বীকৃতি? কঠোর শ্রমের পরিবর্তে অসহায় তাৎপর্যহীন এই জীবন তাদের ঠেলে দিতে লাগল আরও নিরাশার দিকে। মনে মনে আকুল প্রার্থনায় তারা আরও বেশি করে মাথা কুটতে লাগল তাদের নিজস্ব দেবতাদের পায়ে।
চলবে...
(দ্বিতীয় পর্বের ষষ্ঠ ও অন্তিম ভাগ আসবে ২৭/০৫/২০২২ তারিখে)
গ্রন্থ ঋণঃ
১) The penguin history of Early India – Romila Thapar
২) The wonder that was India – A. L. Basham.
৩) মহাভারতের সমাজ - শ্রীযুক্ত সুখময় শর্মা।
৪) মহাভারত (মূল সংস্কৃত হইতে বঙ্গানুবাদ)–মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ।
৫) শ্রীমদ্ভাগবত গীতা – বাংলা অনুবাদ (চিরসখা হে) – কিশোর ঘোষাল
[1] তখনকার বঙ্গের পুরোটাই প্রায় আধুনিক পূর্ব-বিহার।
[2] সূত্রধরের প্রচলিত অর্থ ছুতোর – অর্থাৎ যাঁরা টুকরো-টুকরো কাঠ জুড়ে কাঠের দ্রব্যাদি বানান। আবার সংস্কৃত শাস্ত্র বা নাটকের শ্লোকগুলিকে “সূত্র” বলা হয়, সেই সূত্রগুলি যাঁরা স্মরণে রাখেন তাঁরাও সূত্রধর।
[3] অর্জুন > অভিমন্যু > পরীক্ষিৎ > জন্মেজয় – অতএব পঞ্চপাণ্ডব জন্মেজয়ের প্রপিতামহ।
[4] উত্তরকুরুর অবস্থান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ আছে। তাঁদের কেউ বলেন, কুরু রাজ্যের উত্তরে, হিমালয়ের পাদদেশে উত্তরকুরুর অবস্থান। কেউ বলেন, উত্তরকুরু আর্যদের আদি বাসস্থান - কিরঘিজস্তানের কোন অঞ্চল, আবার কেউ বলেন, উত্তরকুরুর বাস্তবে কোন অস্তিত্বই নেই।
[5] মহাভারতের যে পর্বের যে অধ্যায় থেকে উদ্ধৃতিগুলি নেওয়া হয়েছে, এটি তার সংকেত। আদি/১২২-এর অর্থ আদি পর্বের ১২২ তম অধ্যায়। এই পদ্ধতি সর্বত্রই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি।
[6] বৈপিত্রেয় বলে বাস্তবে কোন শব্দ আমি পাইনি, কিন্তু পিতার একাধিক পত্নীর সন্তানেরা যেমন পরষ্পরের “বৈমাত্রেয়” ভাই বা বোন হয়, তেমনি একই মাতার একাধিক স্বামীর সন্তানদের “বৈপিত্রেয়” ভাই বা বোন বলা যেতেই পারে।
[7] পাণ্ডুর বর্ণের অর্থ - “শ্বেতপীত, ফ্যাকাসে, শ্বেত” [শব্দকোষ]।
[8] এ ধরনের ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কিন্তু পরবর্তী কালে আমরা এরকম ঘটনার অজস্র উদাহরণের সম্মুখীন হবো, এবং আমরা বুঝতে পারবো ব্রাহ্মণ্য সমাজ কোনদিনই পরমতসহিষ্ণু ছিল না, বরং নৃশংস বিরোধিতায় অভ্যস্ত ছিল।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।