এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • ধর্মাধর্ম - চতুর্থ পর্ব -  দ্বিতীয় ভাগ 

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ১১ জুলাই ২০২২ | ১৪৫৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • চতুর্থ পর্ব - 0 থেকে ১৩০০ সি.ই. – দ্বিতীয় ভাগ

    ৪.২ প্রাক-গুপ্তযুগের ভারত

    ৪.২.১ সাতবাহন সাম্রাজ্য
    আগের পর্বেই বলেছিলাম, মোটামুটি ৫০ বি.সি.ই-তে সাতবাহন সাম্রাজ্যের শুরু হয়েছিল, রাজা সিমুকের হাত ধরে। তাঁর সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা না গেলেও এটুকু জানা যায়, তিনি মোটামুটি ২৯ বি.সি.ই-তে মগধের কাণ্ববংশের উচ্ছেদ ঘটিয়েছিলেন। সাতবাহন বংশের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন, সাতকর্ণি, তাঁর কথাও আগে বলেছি। তাঁর মৃত্যুর পর বেশ কিছু বছর, সাতবাহন বংশের তেমন কোন সংবাদ পাওয়া যায় না। এটুকু শোনা যায়, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দুই নাবালক পুত্র শক্তিশ্রী এবং বেদশ্রীর মাতা, রানি নায়নিকা অথবা নাগনিকা রাজ্য পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন। আরেকজন রাজার নাম পাওয়া যায়, যাঁর নাম হাল, তিনি প্রাকৃত ভাষায় একটি সংহিতা রচনা করেছিলেন, যার নাম “গাথা সত্তসই (গাথা সপ্তশতক)”। খ্রিষ্টিয় প্রথম শতাব্দীর শেষদিকে সাতবাহন সাম্রাজ্যের অধীনস্থ মহারাষ্ট্র জয় করে, প্রথম আঘাত হানল শক-ক্ষত্রপেরা। যদিও শকেরা এই অধিকার খুব বেশিদিন আয়ত্ত্বে রাখতে পারেনি, তাদের পরাস্ত করে, মহারাষ্ট্র আবার জয় করে নিয়েছিলেন, সাতবাহন রাজা গৌতমীপুত্র[1] সাতকর্ণি।

    নাসিকের একটি প্রস্তর লিপি থেকে জানা যায়, “তিনি ক্ষত্রিয়দের গর্ব এবং অহংকার চূর্ণ করেছিলেন। তিনি তাঁর রাজ্যে বর্ণপ্রথার পুনর্নিয়োগ করেছিলেন। তিনি শক, যবন এবং পহ্লবদের বিতাড়িত করেছেন, এবং সাতবাহন বংশের হারানো গৌরব আবার ফিরিয়ে এনেছেন”। এই লিপিটি লিখিয়েছিলেন তাঁর রানীমা গৌতমী বলশ্রী। এই লিপি থেকে আরও জানা যায়, কোন কোন রাজ্য বা অঞ্চল তাঁর অধিকারে ছিল, যেমন গুজরাট, সৌরাষ্ট্র, মালব, বেরার, উত্তর কোংকন এবং পুনা ও নাসিক। তিনি নিজের নামে, রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। অন্য এক লিপি থেকে আরও জানা যায়, তাঁর রাজত্বকালের অষ্টাদশ বছরে নাসিকের কাছে “পাণ্ডুলেন” নামের একটি গুহা এবং চব্বিশতম বছরে বেশ কিছু জমি তিনি সন্ন্যাসীদের দান করেছিলেন। এর থেকে অনুমান করা যায় তিনি অন্ততঃ চব্বিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন।

    গৌতমীপুত্রর পরে মোটামুটি ১৩০ সি.ই.তে রাজা হয়েছিলেন, তাঁর পুত্র বাশিষ্ঠি পুত্র শ্রীপুলমাবি। তিনি প্রায় সমগ্র দক্ষিণ ভারতেই সাতবাহন সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। সম্ভবতঃ তিনিই বৈথান বা পৈথানে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জুনাগড় প্রস্তর লিপিতে তাঁকে দক্ষিণাপথের প্রভু বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই লিপি থেকে আরও জানা যায় তিনি দুবার শক-ক্ষত্রপ রুদ্রদমনের কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন, এবং অবশেষে রুদ্রদমনের কন্যাকে বিবাহ করে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এর পরিবর্তে তাঁকে শক-মহাক্ষত্রপকে অনেক অঞ্চলই ছাড়তে হয়েছিল। শ্রী পুলামাবির মৃত্যু হয়েছিল মোটামুটি ১৫৫ সি.ই.-তে।

    যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণি অথবা শ্রীযজ্ঞ সাতকর্ণি ছিলেন সাতবাহন সাম্রাজ্যের শেষ শক্তিশালী রাজা। তাঁর রাজত্বকাল মোটামুটি ১৬৫ থেকে ১৯৫ সি.ই.। তিনি সাতবাহন সাম্রাজ্যের বিস্তার আরও বাড়িয়েছিলেন, তাঁর সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের সীমানায় ছিল বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমে আরব সাগর। নৌবাণিজ্যেও তিনি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর প্রচলন করা মুদ্রার একদিকে ছিল মাছ, শঙ্খ ও অন্যদিকে ছিল  দুই-মাস্তুলের জাহাজের ছবি।  যজ্ঞশ্রীর মৃত্যুর পর সাতবাহন সাম্রাজ্য অতি দ্রুত দুর্বল হতে শুরু করেছিল এবং আভিররা মহারাষ্ট্র এবং ইক্ষ্বাকু ও পল্লবেরা পূর্বদিকের রাজ্যগুলি অধিকার করে নেওয়াতে সাতবাহন সাম্রাজ্য ভেঙেই পড়ল। 

    ৪.২.১.১ সাতবাহন সাম্রাজ্যের সামাজিক বিন্যাস
    সমাজের মানুষ চার শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। সমাজের উচ্চশ্রেণীতে ছিলেন মহাভোজ, মহারথী এবং মহাসেনাপতি– যাঁরা রাষ্ট্রের প্রশাসন এবং বিভিন্ন প্রদেশকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিলেন আধিকারিকরা– যেমন, অমাত্য, মহামাত্র এবং ভাণ্ডাগারিক, তাছাড়াও ছিলেন, নৈগম (ধনী বণিক সম্প্রদায়), সার্থবাহ (মুখ্য বণিক) এবং শ্রেষ্ঠীন ( বণিকগোষ্ঠী বা গিল্ডের প্রধান)। তৃতীয় শ্রেণীতে ছিলেন বৈদ্য, লেখক (করণিক বা কেরানি), স্বর্ণকার, গন্ধিকা (গন্ধবণিক), হালকীয় (কৃষক) প্রমুখ। আর চতুর্থ শ্রেণীতে ছিলেন, মালাকার, বর্ধকী (সূত্রধর বা ছুতার), দাসক (জেলে)।

    ৪.২.১.২ ধর্ম
    সাতবাহন বংশের রাজারা সাধারণতঃ ব্রাহ্মণ্য ধর্মে বিশ্বাসী হলেও, তাঁরা বৌদ্ধধর্মের প্রতিও সহিষ্ণু ছিলেন। বৌদ্ধভিক্ষুদের জন্যে চৈত্য-গৃহ, মন্দির এবং গুহা নির্মাণে প্রচুর অর্থ সাহায্য করেছিলেন। বৌদ্ধবিহারগুলির পরিচালনার জন্যে নিয়মিত অর্থেরও সংস্থান করতেন। তবে প্রধানতঃ তাঁরা ব্রাহ্মণ্যধর্মেই বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁরা নিয়মিত অশ্বমেধ, রাজসূয় এবং অন্যান্য যজ্ঞেরও আয়োজন করতেন এবং ব্রাহ্মণদের প্রচুর দান ও দক্ষিণা দিতেন। সাতবাহন রাজাদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের ঘনিষ্ঠতা দেখে খুব সহজেই আন্দাজ করা যায়, ব্রাহ্মণদের বর্ণাশ্রম বিধি সে সময় বেশ নমনীয় হয়ে এসেছে। সাতবাহন রাজাদের বর্ণ ক্ষত্রিয় না ব্রাহ্মণ সে কথা জানা যায় না। তাঁদের এত দীর্ঘ দিনের রাজত্বে কোন রাজাই সংস্কৃত জানার চেষ্টাও করেননি। অথচ ব্রাহ্মণরা তাঁদের যজ্ঞে পৌরোহিত্য করেছিলেন। অতএব ততদিনে “রাজা মানে রাজাই, তাঁর আবার বর্ণ বিচারের প্রয়োজন কি?” এমন ধারণা চলে এসেছে। এটাই হিন্দু ধর্মের লক্ষণ - হিন্দু সমাজে বর্ণভেদ তখনও ছিল, আজও আছে, কিন্তু রাজা, রাষ্ট্রীয় প্রধান, উচ্চবিত্ত এবং উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের বর্ণ বিচার করবে কোন নির্বোধ?        

    সাম্রাজ্যের বহু লোক শিব ও বিষ্ণু[2] এবং অন্যান্য দেবতাদের উপাসক ছিলেন, তাঁদের ধর্মাচরণে সাতবাহন রাজারা কখনও বাধা দেননি, বরং সকল ধর্মবিশ্বাসী মানুষই সদ্ভাবে নিশ্চিন্তে বসবাস করত। সাতবাহন রাজারা ব্রাহ্মণ্য হলেও, তাঁরা সংস্কৃতর থেকে প্রাকৃত ভাষাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান ভাষা ছিল প্রাকৃত। এমনকি রাজা হাল প্রাকৃত ভাষাতে “সপ্তশতক” সংহিতা রচনা করেছিলেন। সমসাময়িক কালে গুণাঢ্য তাঁর “বৃহৎকথা” লিখেছিলেন প্রাকৃতে। সর্ববর্মন নামে এক পণ্ডিত “কাতন্ত্র” নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, কোন এক রাজার অনুরোধে। সেই রাজা সংস্কৃত জানতেন না এবং “পাণিনি” পাঠ তাঁর কাছে দুরূহ মনে হত।

    ৪.২.২ শক ও পহ্লব
    খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে শকরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার যাযাবর গোষ্ঠী। চীনের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে দলছুট হয়ে আসা ইউ-চি গোষ্ঠীর চাপে, শকরা তাদের সিরদরিয়া নদের অঞ্চল ছেড়ে দক্ষিণের ব্যাক্ট্রিয়া, পার্থিয়ান এবং সিথিয়ান রাজ্যগুলিতে ঢুকে পড়েছিল। সেই সময়ে এই রাজ্যগুলি নিজেদের মধ্যে নিত্য যুদ্ধ করতে করতে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল, অতএব শকদের পক্ষে এই তিন রাজ্যে ঢুকে পড়া সহজ হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকেও পরবর্তীকালে শকরা বিতাড়িত হয়ে পূর্বদিকে সরে আসতে বাধ্য হল।

    সে সময় কাবুল অঞ্চলে গ্রীক রাজ্য ছিল। গ্রীক রাজ্য পার হয়ে তারা আরও পূর্বে কান্দাহার এবং বালুচিস্তান অঞ্চলে চলে এসেছিল এবং কিছুদিনের মধ্যেই পৌঁছে গেল সিন্ধু নদের নিম্ন অববাহিকায়। সেখানেই তাদের প্রথম নিজস্ব রাজ্য প্রতিষ্ঠা হল – যার নাম হিন্দু শাস্ত্রে শকদ্বীপ এবং গ্রীক ভৌগোলিকরা বলেন ইন্দো-সিথিয়া। এখান থেকেই শকরা পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজ্য স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। শকদেরই অন্য একটি শাখার সংস্কৃত নাম পহ্লব - কোন কোন ঐতিহাসিক তাঁদের ইন্দো-পার্থিয়ান বলেন। কিন্তু ভারতবর্ষে শক ও পহ্লবদের ইতিহাস সর্বদাই সংযুক্ত এবং দুই গোষ্ঠীকে আলাদা করে চিহ্নিত করা খুবই কঠিন।

    ভারতের উত্তরপশ্চিম সীমান্তে গান্ধার অঞ্চলে শক রাজত্বের প্রথম হদিশ পাওয়া যায় ৮০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি। প্রথম যে শক রাজার নাম পাওয়া যায়, তিনি মোয়েস বা মোগা। তাঁর পরবর্তী রাজা ছিলেন এজেস, তিনি ওই অঞ্চলের ইন্দো-গ্রীক রাজাকে পরাস্ত করে, আধুনিক ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করে ফেলেছিলেন। তাঁর রাজত্বকালের শুরু মনে করা হয় ৫৮ বি.সি.ই বা ৭৮ বি.সি.ই। মনে করা হয়, তিনিই তাঁর এই রাজত্বকাল থেকে নতুন অব্দের সূচনা করেছিলেন, যার নাম শকাব্দ। সাধারণতঃ ৭৮ বি.সি.ই থেকেই শকাব্দ গণনার হিসাব করা হয়, যদিও এই অব্দ গণনা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ এবং বিরোধ রয়েছে।
     
    পহ্লবরাও উত্তর পশ্চিম ভারতে তাদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল, প্রথম শতাব্দী বি.সি.ই-র শেষ দিকে। পহ্লবদের একজন রাজা ভগবান যিশুর শিষ্য সেন্ট টমাসের থেকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁর নাম গণ্ডোফারিস বা গণ্ডোফার্নিস। সেক্ষেত্রে তাঁর রাজত্বকাল প্রথম শতাব্দী সি.ই.-র মাঝামঝি কোন এক সময়ে। শোনা যায় সেন্ট টমাস ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চল থেকে গণ্ডোফার্নিসের রাজসভায় এসেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি দক্ষিণ ভারতে চলে আসেন। তবে এই তথ্য খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ ভারতে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের যে ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়, তা অনেক পরবর্তী কালের।

    পরবর্তীকালে চিনের ইউ-চি উপজাতিদের আক্রমণে, শক এবং পহ্লবরা আরও দক্ষিণে এবং পূর্বে ভারতের মূল ভূখণ্ডে সরে আসতে বাধ্য হন। এই অঞ্চলে তাঁদের অস্তিত্ব বোঝা যায় তাঁদের প্রশাসনিক আধিকারিকদের নাম থেকে।

    শক ও পহ্লবরা মূলত অ্যাকিমিনিড এবং সেলুকীয় প্রশাসনিক পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। তাঁদের রাজ্যকে তাঁরা কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে নিতেন, এবং প্রত্যেক প্রদেশের প্রধান হতেন একজন সেনাধ্যক্ষ– যাঁকে “মহাক্ষত্রপ” বলা হত। প্রত্যেকটি প্রদেশকে আবার বেশ কিছু অঞ্চলে বিভক্ত করে, প্রত্যেকটির নিয়ন্ত্রণে নিযুক্ত হতেন একজন “ক্ষত্রপ”। এই ক্ষত্রপেরা নিজেদের নামে মুদ্রা প্রচলন করতে পারতেন এবং প্রজাদের জন্যে নির্দেশ লিপি প্রচার করতে পারতেন। অর্থাৎ এক একটি অঞ্চলে ক্ষত্রপেরা ছিলেন প্রায় স্বাধীন রাজা। এই কারণেই প্রধান রাজারা তাঁদের উপাধিতে “রাজাদের রাজা” বা “মহারাজা” ব্যবহার করতেন।

    সাতবাহন সাম্রাজ্যের রাজাদের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মধ্য ভারতে উজ্জয়িনী, মথুরা এবং পশ্চিম ভারতের গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রের বেশ কিছু অঞ্চলে তাঁদের শক্তিশালী অস্তিত্ব ছিল। শক-ক্ষত্রপ রুদ্রদমনের সঙ্গে সাতবাহন রাজাদের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে শকদের প্রতিপত্তিকে সামাল দেওয়ার প্রচেষ্টার উল্লেখ আগেই করেছি। 

    ৪.২.৩ কুষাণ রাজ্য ও কণিষ্ক
    খ্রিষ্টিয় প্রথম শতাব্দীর শুরুর দিকে, চীনের ইউ-চি-র পাঁচটি যাযাবর গোষ্ঠীর প্রধান কুজুলা কদ্‌ফিসিস ব্যাক্ট্রিয়াতে রাজ্য স্থাপন করেন। তারপর প্রতিপত্তিশালী শকদের তাড়িয়ে তিনি কাবুল থেকে কাশ্মীর – নিজের আয়ত্বে এনেছিলেন। এই রাজ্য থেকেই কুষাণ রাজ্য এবং বংশের সূত্রপাত হল। প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি তাঁর মৃত্যুর পর, রাজা হয়েছিলেন ওয়েমা বা ভিমা কদ্‌ফিসিস। রোমান মুদ্রার অনুকরণে, কুষাণ রাজারাও স্বর্ণ মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন, যেগুলি মধ্য এশিয়ায় বহুল ব্যবহার হত। এছাড়া তামার মুদ্রাও প্রচলন করেছিলেন, তার নাম টেট্রাদ্রাখম– এই মুদ্রায় শিবের মূর্তির ছাপ থাকত।

    কুষাণ বংশের সবথেকে প্রসিদ্ধ রাজা কণিষ্ক। যাঁর সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়া থেকে সমগ্র উত্তর-পশ্চিম ভারত তো বটেই এমনকি, শোনা যায় গাঙ্গেয় উপত্যকার চম্পা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মথুরার কাছে একটি মুণ্ডহীন পাথরের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি পাওয়া গেছে, বিশেষজ্ঞরা সেটিকে কণিষ্কের মূর্তি বলেই সনাক্ত করেছেন। মূর্তির পরনে আছে মধ্য এশিয়ায় প্রচলিত কোট এবং বুট জুতো। রাজা কণিষ্কের রাজত্বকাল অনুমান করা হয় ৭৮ সি.ই.। কেউ কেউ মনে করেন, এ সময় থেকেই শকাব্দের গণনা করার প্রচলন হয়ে থাকতে পারে। কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রধান দুই শহরের নাম পুরুষপুর (আধুনিক পেশোয়ারের কাছে) এবং মথুরা।

    কণিষ্ক এবং অন্যান্য কুষাণ রাজারা বড়োবড়ো উপাধি ব্যবহার করতেন। পণ্ডিতেরা বলেন, এগুলি গ্রীস, রোম বা পারস্যের সম্রাটদের অনুকরণ। যেমন রোমান সম্রাটরা ব্যবহার করতেন, “দিভা ফিলিয়াস” (diva filius), যার অর্থ – স্বর্গের পুত্র, কুষাণ রাজারা নিজেদের “দৈবপুত্র” বলতেন। ইন্দো-গ্রীক রাজারা ব্যবহার করতেন “ব্যাসিলিয়স ব্যাসিলেই” (basileos basilei) – যার অর্থ রাজাদের রাজা, কুষাণ রাজারা নিজেদের বলতেন, “মহারাজাতিরাজ”।

    ৪.২.৩.১ কণিষ্ক ও বৌদ্ধধর্ম
    এই সময়ে কুষাণ সাম্রাজ্যের বিস্তীর্ণ সীমানায় ভারত, চীন ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য তো ছিলই, তার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল সংস্কৃতি ও ধর্মভাবনার আদানপ্রদান, তার মধ্যে ছিল বৌদ্ধ-জৈন-শৈব-ভাগবত-জরোথুষ্ট্রিয়ান-গ্রীকপ্রথার মিশ্রণ। বৌদ্ধরা দাবি করেন, রাজা কণিষ্ক তাঁদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তাঁর সময়েই চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলন হয়েছিল। এই চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলনেই বৌদ্ধদের হীনযানী শাখা ভেঙে নতুন মহাযানী মতের উৎপত্তি হয়েছিল। এই সম্মেলন হয়েছিল কাশ্মীরের কুণ্ডলবনে। এই সম্মলনের আহ্বায়ক ছিলেন, রাজা কণিষ্কের গুরু, পার্শ্ব। এবং সভাপতি ছিলেন বসুমিত্র এবং অশ্বঘোষ। এই সম্মেলনেই মহাযান ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের প্রধান শাখা হয়ে ওঠে। হীনযানী বৌদ্ধরা প্রাচীন পন্থী, তাঁরা মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী ছিলেন না এবং তাঁরা বুদ্ধকে দেবতা নয়, মহামানব হিসেবেই বিশ্বাস করতেন। কিন্তু মহাযানীরা ভগবান বুদ্ধকে দেবতার আসনে বসিয়ে তাঁর পূজা এবং নানান অনুষ্ঠানের প্রথা প্রচলন করেছিলেন। তাঁরা ভগবান বুদ্ধের মূর্তি নির্মাণ করে, ভক্তি ভরে তাঁর পূজার প্রচলন শুরু করলেন। এমন নয় যে এই সম্মেলন থেকেই বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান মার্গের সূত্রপাত হল। মহাযানী বৌদ্ধদের গোষ্ঠী বহুদিন ধরেই সক্রিয় ছিল এবং তাদের সঙ্গে প্রাচীনপন্থীদের প্রায়শঃ মতবিরোধ ঘটছিল। এই সম্মেলনে সেই মতভেদ স্বীকৃতি লাভ করল এবং দুটি গোষ্ঠী আলাদা হয়ে গেল।

    ৪.২.৩.২ গান্ধার শিল্প
    মহাযানী বৌদ্ধ ধর্ম ভারতীয় শিল্পের নতুন এক দিগন্ত খুলে দিল। এতদিন বৌদ্ধ শিল্প বা স্থাপত্য বলতে, কোথাও বুদ্ধদেবের মূর্তি বানানো হয়নি। সাঁচী বা ভারহুত স্তূপে তাঁর জাতকের অথবা তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য গল্পের অজস্র রিলিফ চিত্র দেখা গেছে। সেগুলিতে সরাসরি ভগবান বুদ্ধের মূর্তি কখনো দেখানো হয়নি, তার পরিবর্তে নানান প্রতীক ব্যবহার করা হত। যেমন তাঁর পদচিহ্ন, বোধি-বৃক্ষ, শূণ্য-আসন অথবা ছাতা। কিন্তু এখন থেকে শিল্পীদের হাতের ছেনির প্রিয়তম বিষয় হয়ে উঠল বুদ্ধ-মূর্তি গড়া। এই সময়ের অধিকাংশ মূর্তিই পাওয়া গেছে গান্ধার অঞ্চলে এবং পুরুষপুরের (পেশোয়ার) আশেপাশে। এই শিল্পকেই পরবর্তী সময়ে গান্ধার-শিল্প নাম দেওয়া হয়েছে। কখনও কখনও এই শিল্পকে গ্রেকো-বুদ্ধিষ্ট (Græco-Buddhist) বা ইন্দো-হেলেনিকও (Indo-Hellenic) বলা হয়, কারণ এই মূর্তির নির্মাণে গ্রীক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল। এমনকি কিছু কিছু মূর্তিতে গ্রীক দেবতা অ্যাপোলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য পাওয়া যায়। যদিও পরবর্তী কালের বুদ্ধমূর্তিতে ভারতীয় ভাবনার নিজস্বতা স্পষ্ট ধরা পড়ে এবং সেই মূর্তিগুলিকেই ভারতীয় শিল্পে সর্বত্র অনুসরণ করা হয়েছে।

    ৪.২.৩.৩ কণিষ্কের পরবর্তী রাজা
    কণিষ্কের মৃত্যু সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ধারণা করা যায় না, কোন কোন মতে তিনি তেইশ, আবার কোন মতে তিনি একচল্লিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে বাশিষ্ক এবং তাঁর পরে হুবিষ্ক রাজা হয়েছিলেন। বাশিষ্ক সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে হুবিষ্ক কণিষ্কের সাম্রাজ্যের পুরোটাই ধরে রাখতে পেরেছিলেন এবং যথেষ্ট প্রতাপশালী রাজা ছিলেন। তাঁর রাজত্বে তিনি নিজের নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন। সেই মুদ্রায় তাঁর নিজের ছবি এবং অন্যান্য নানান দেবতার ছবি মুদ্রিত থাকলেও, বুদ্ধের ছবি বা প্রতীক দেখা যায় না। তবে হুবিষ্ক যে বৌদ্ধদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন, তাও নয়। শোনা যায় তিনি মথুরাতে বৌদ্ধ বিহার এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়েছিলেন। তিনি কাশ্মীরে একটি নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করিয়েছিলেন, যার নাম হুবিষ্কপুর বা জুস্কপুর যার এখনকার নাম হুষ্কপুর বা উষ্কুর। হুবিষ্কের পরে আরেকজন রাজার নাম পাওয়া বাসুদেব। তিনিও নিজের নামে মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। তবে তাঁর সময়ে কুষাণ সাম্রাজ্য অনেকটাই ছোট হয়ে গিয়েছিল, হয়তো তাঁর রাজ্যের সীমানা ছিল পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশের কিছুটা এবং মথুরা অঞ্চল। বাসুদেবের মুদ্রা থেকে অনুমান করা হয় তিনি শৈব ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, কারণ তাঁর অনেক মুদ্রায় শিব এবং নন্দী (বৃষ বা ষাঁড়)-এর প্রতীক দেখা যায়। বাসুদেবের রাজত্বের শুরু অনুমান করা হয় ১৫২ সি.ই.-র কাছাকাছি কোন সময়ে এবং তিনি পঁচিশ কিংবা তিরিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন।

    বাসুদেবের পরবর্তী রাজারা অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন এবং পারস্যের সাসানিয়ান রাজা ফিরিস্তর আক্রমণের পর খ্রিষ্টিয় দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষদিক থেকেই কুষাণবংশের অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁদের দুর্বলতার সুযোগে স্থানীয় গোষ্ঠী নেতারা এখানে সেখানে ছোট ছোট রাজ্য গড়ে তুলতে লাগলেন।

    ৪.২.৪ সি.ই. তৃতীয় শতাব্দীর ভারত
    কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পর অনেক ঐতিহাসিক গুপ্তসাম্রাজ্যের সূচনার সময় পর্যন্ত কমবেশি শতাধিক বছরগুলিকে ভারতের তমসাচ্ছন্ন যুগ বলে থাকেন। কারণ এই সময়ের ইতিহাস বেশ অস্পষ্ট এবং রাজনৈতিক দিক থেকে একান্তই গুরুত্বহীন এবং তাৎপর্যহীন।

    সফল রাজা ও রাজ্যের অভাবে, ভারতের ইতিহাস এই পর্যায়ে রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বহীন হলেও, সামাজিক এবং ধর্মীয় দিক থেকে এই সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক।

    এখনও পর্যন্ত খ্রিষ্টপূর্বের দুটি এবং খ্রিষ্টিয় দুটি শতাব্দীতে আমরা লক্ষ্য করলাম, আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত ভারতভূমিতে অদ্ভূত এক সামাজিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। দেশীয় আর্য এবং অনার্য জনগণের সমাজে এসে মিশে যাচ্ছিল বহিরাগত অজস্র জনজাতি। যাদের মধ্যে ছিল গ্রীক, পারসী, ব্যক্ট্রিয়ান, সিথিয়ান, পার্থিয়ানদের মত অত্যন্ত সভ্য এবং প্রাচীন সংস্কৃতিসম্পন্ন জনজাতি। পাশাপাশি শক, পহ্লব, কুষাণদের মতো বেশ কিছু জনগোষ্ঠী – যারা মাত্র কয়েকশ বছর আগেও যাযাবর কিংবা পশুপালক ছিলেন। এই জনগোষ্ঠীর সকলেই বিজয়ী জাতি হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল, কিন্তু ক্রমশঃ তাঁদের সকলেই ভারতীয় সমাজে সম্পূর্ণ মিশে গেল। বহিরাগত এই সমস্ত জনগোষ্ঠী-প্রবাহগুলির প্রত্যেকটি কীভাবে ভারতীয় বর্ণভিত্তিক সমাজ-সমুদ্রে মিশে যেতে পারল, সেকথায় বিস্তারিত যাওয়ার আগে, তখনকার ভারতীয় সমাজের অবস্থান সম্পর্কে একটু আলোচনা সেরে নেওয়া যাক।  

    ৪.২.৪.১ সাংস্কৃতিক মিশ্রণ বিস্তার
    সমুদ্র-বাণিজ্য সূত্রে রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের যেমন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, তেমনই স্থলপথে উত্তর ভারতের সঙ্গে গ্রেকো-রোমান (Greco-Roman) সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। এই যোগাযোগে চিন্তা-ভাবনার আদানপ্রদান যেমন হয়েছিল, তেমনই ভারতীয় সংস্কৃতি ঋদ্ধ হয়েছিল নান্দনিক স্থাপত্য এবং শিল্পকলার দক্ষতায়। প্রথম দিকে বৌদ্ধরাই ছিলেন এই আদান-প্রদানের প্রধান অনুঘটক, কারণ বিদেশী অর্থাৎ অভারতীয়দের কাছে ব্রাহ্মণ্যধর্মের থেকে বৌদ্ধদের সংস্পর্শ অনেক বেশি সহজ ছিল। সাংস্কৃতিক এই আদান-প্রদানেই, নানান ধরনের লোককথা এবং লোককাহিনী, এমনকি পণ্ডিত বিষ্ণুশর্মা রচিত “পঞ্চতন্ত্র”এর গল্পগুলিও, নানান ভাষায় অনুবাদ হয়ে ইওরোপ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল এবং পরবর্তী কালে তার বেশ কিছু অংশ নিয়ে “ঈশপ’স ফেব্‌ল্‌স্‌” (Aesop’s fables) সংকলিত হয়েছিল। “চতুরঙ্গ” বলে একটি খেলার কথাও শোনা যায়, পশ্চিমে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। যে খেলাটি ভারতীয় চতুরঙ্গ (হস্তী, নৌ, অশ্ব ও পদাতিক) সেনা বিন্যাস নিয়ে বানানো এবং চারজন খেলোয়াড় মিলে খেলতে হত। পরবর্তীকালে এই খেলাই কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে “দাবা” (chess) হয়ে উঠেছে, এবং বিশ্বের বহুদেশেই এটি আজও জনপ্রিয়।

    এই আদান-প্রদানে সব থেকে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল ভারতীয় শিল্প, যার সূত্রপাত আফগানিস্তানের গান্ধার অঞ্চলে এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। গান্ধার শিল্পে বহুজাতিক শিল্পের মিশ্রণ ঘটেছিল। তার মধ্যে একটা হল, গ্রেকো-রোমান ব্রোঞ্জভাস্কর্য এবং স্টাকো[3] (stucco) শৈলী। গান্ধার শিল্পের সূচনার কিছুদিনের মধ্যে মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মে বুদ্ধ মূর্তি বানানোর প্রচলন যখন অনুমোদিত হয়ে গেল, খুব স্বাভাবিক ভাবেই বুদ্ধ মূর্তি বানাতে এই শিল্পের প্রচলন শুরু করলেন বৌদ্ধরাই। সে মূর্তি কখনো গ্রীক শৈলীতে বড়ো পাথরের মূর্তি কিংবা গ্রেকো-রোমান শৈলীর ছোট ধাতব মূর্তি। যদিও গান্ধার শৈলী ভারতীয়দের হাতে পড়ে ভারতীয় শৈলী হয়ে উঠতে কয়েকশ বছর সময় পার হয়েছিল সে কথা বলাই বাহুল্য। কারণ গ্রীক ও রোমান শৈলী নিখুঁত অঙ্গ সৌষ্ঠব এবং সুসমঞ্জস অবয়বের অনুসারী। কিন্তু ভারতীয় শৈলীতে তার পরেও প্রয়োজন ছিল ভাব (Expressions) – পরম কারুণিকের করুণা এবং সর্ব জীবে প্রেমের শরীরি ব্যঞ্জনা।

    ভারতীয় দর্শন যে পশ্চিমের ধারণায় নিবিড় প্রভাব ফেলেছিল, সে কথা সবিস্তারে বলেছি, এই পর্বের প্রথম অধ্যায়ে। তবে ভারত সম্পর্কে কিছুদিন আগে পর্যন্ত পশ্চিমের যে ধারণা ছিল, ভারত মানেই সন্ন্যাসী, ম্যাজিক, বিস্ময়কর (Marvellous) এবং মিস্টিক (Mystic) কিছু ব্যাপার-স্যাপার - তারও সূত্রপাত হয়তো এই পর্যায়েই। রোমান ঐতিহাসিকদের রচনা থেকে পাওয়া যায়, ২৫ বি.সি.ই-তে ভারতীয় কোন রাজ্য থেকে রোমান রাজসভায় দুজন রাষ্ট্রদূত ও কিছু উপহার পাঠানো হয়েছিল, পশ্চিম ভারতের ভৃগুকচ্ছ বন্দর থেকে। দুজন রাষ্ট্রদূতের মধ্যে একজন ছিলেন, সন্ন্যাসী এবং অন্যজন হস্তহীন কিন্তু দক্ষ তীরন্দাজ এক বিস্ময়-বালক, যে তার দুই পা দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতায় তির ছুঁড়তে পারত! এ ছাড়া সেই জাহাজে ছিল কিছু বাঘ, কিছু মোনাল পাখি, কিছু সাপ আর কিছু কচ্ছপ! ভারতীয় বন্দর থেকে রোমান সম্রাটের মনোরঞ্জনের জন্যে এই উপহার সমুদ্রপথে পৌঁছতে সময় লেগেছিল প্রায় চার বছর!

    বৌদ্ধধর্মের প্রচারে খ্রিষ্টিয় প্রথম শতাব্দীতে বৌদ্ধরা চীনে পৌঁছে গিয়েছিলেন, সে কথা আগেই বলেছি। চীনের লোয়াং শহরে তাঁদের প্রথম বিহারের নাম শ্বেতাশ্ব (White Horse)। অবিশ্যি তার অনেক আগে থেকেই চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যে যে বস্তু চীন থেকে আমদানি করা হত তার সঙ্গে চীন শব্দ যোগ করে সেই বস্তুর নাম প্রচলিত ছিল, যেমন চীনাংশুক চীনের রেশমবস্ত্র, কিচক– চীনের বাঁশ[4] (বিশেষ এক ধরনের বাঁশকে চীনা ভাষায় “কি-চক” বলে), চীনামাটি (china-clay, porcelain), চীনাসিঁদুর (Chinese vermilion বা red lead – লাল রং হিসেবে ব্যবহার হত), চীনাবাদাম ইত্যাদি । যদিও পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যে ভারতবর্ষেও এই সমস্ত জিনিষের উৎপাদন শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং ভারতীয়, বিশেষ করে বঙ্গের রেশম বস্ত্র – মসলিন হয়ে উঠেছিল রোম সাম্রাজ্য এবং পরবর্তীকালে ইওরোপের অভিজাত সম্প্রদায়ের নয়নের মণি। ভারতে উপনিবেশ গড়ে তোলার পর, এই মসলিন উৎপাদনকে উৎখাত করেছিল, ব্রিটিশ বণিকেরা।

    চীনে বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে পড়ায় ভারতের প্রতি চীনের আগ্রহ বাড়তে থাকে, এবং পরবর্তী কালে অত্যন্ত দুরূহ এবং দুর্গম পথের কষ্ট স্বীকার করেও বহু যুগ ধরে, বহু চৈনিক পণ্ডিত এ দেশে এসেছিলেন বৌদ্ধ দর্শনের শিক্ষা নিতে এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রের প্রতিলিপি সংগ্রহ করতে। সৌভাগ্যের কথা, তাঁদের এই কষ্টসাধ্য প্রয়াসের জন্যেই বৌদ্ধ শাস্ত্রের বিপুল সম্ভার উদ্ধার হয়েছে, তিব্বত, চীন ও নেপালের বহু বৌদ্ধ বিহার থেকে। নচেৎ বৌদ্ধ শাস্ত্রের বহু তথ্যই আমাদের অজানা থেকে যেত। তার কারণ ভারতের মূল পুঁথি এবং স্ক্রোলগুলি হয় কালের নিয়মে নষ্ট হয়েছে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করা হয়েছিল। প্রকৃত অর্থে আজ বৌদ্ধ দর্শন এবং শাস্ত্র সম্বন্ধে আমরা যা কিছু জানি, তার অধিকাংশই আমরা জেনেছি হয় প্রতিলিপি থেকে অথবা মূল গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ থেকে। সম্প্রতি তক্ষশিলার (গান্ধার) ধ্বংসাবশেষ থেকে মাটির জালার মধ্যে সংরক্ষিত একটি মূল বৌদ্ধ স্ক্রোল উদ্ধার হয়েছে, যেটি বার্চ গাছের বাকলের (birch-bark) ওপর লেখা। স্ক্রোলটির ভাষা গান্ধারি-প্রাকৃত এবং লিপি খরোষ্ঠী। বিরল এই মূল স্ক্রোলটি ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।

    দক্ষিণ-পূর্বের দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা আগেই বলেছি। এর ফলে নৌপথে ইরাবতীর (মায়ানমার) বদ্বীপ, মালয় উপদ্বীপ, মেকং বদ্বীপ এবং বালিদ্বীপেও ভারতীয় সংস্কৃতি পৌঁছে গিয়েছিল। শোনা যায় জনৈক ভারতীয় ব্রাহ্মণ, নাম কৌণ্ডিন্যেই কম্বোডিয়ার রাজকুমারীকে বিবাহ করেছিলেন, এবং সেখানে হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সময়ে বাংলার মহাস্থান এবং চন্দ্রকেতুগড় প্রধান দুই বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল, বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ছিল আরও অনেক ছোট ছোট সমৃদ্ধ জনপদ। কলিঙ্গ থেকেও মায়ানমারের ইরাবতী নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে উপনিবেশ গড়ার কথা শোনা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গোষ্ঠী ভিত্তিক সামাজিক বিন্যাসকে পরিবর্তিত করে রাজ্য এবং রাষ্ট্রীয় সামাজিক ব্যবস্থায় আনার ব্যাপারে ভারতীয় বণিক এবং কোন কোন রাজপুত্র অনুঘটকের কাজ করেছিলেন বলে অনুমান করা হয়। যার ফলে ওই অঞ্চলের ধর্ম ও সংস্কৃতিতে ভারতীয় ধর্ম এবং সংস্কৃতির স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ভারতীয় বণিকরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওই অঞ্চলকে সুবর্ণদ্বীপ বলতেন, তার কারণ মনে হয় প্রত্যক্ষ সোনা নয়, বরং ওই অঞ্চলের বাণিজ্য থেকে প্রভূত লাভ অর্জনকে তাঁরা “সুবর্ণ”-র সঙ্গে তুলনা করতেন।

    ৪.২.৪.২ শিক্ষা, জ্ঞান ও দক্ষতা
    ক) বিজ্ঞান
    প্রথাগত শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি প্রধানতঃ নিয়ন্ত্রণ করতেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং বৌদ্ধ বিহারের অর্হৎগণ। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় বর্ণভেদে শাস্ত্রপাঠের অনেক বিধিনিষেধ ছিল, সে কথা আগেই বলেছি। কিন্তু বৌদ্ধ বিহারের সে রকম কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। সেখানে একমাত্র বিচার্য ছিল শিক্ষার্থীর মানসিক স্থিতি ও নিষ্ঠা এবং শেখার আগ্রহ। সুতরাং বৌদ্ধ ধর্মীয়দের মধ্যে সন্ন্যাসী তো বটেই সাধারণ গৃহীভক্তদের মধ্যেও শিক্ষার হার বেড়ে উঠতে লাগল দ্রুত।

    অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়া এবং গ্রীসের পণ্ডিত মানুষদের থেকে জ্যোতির্বিদ্যা (Astronomy), গণিত এবং চিকিৎসাশাস্ত্র ও ভেষজ বিদ্যার আদান-প্রদান করে দুই সংস্কৃতিই সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিত শুধু পুঁথিগত তত্ত্ব হয়ে আর রইল না, কারণ সমুদ্রগামী জাহাজের দিক্‌নির্ণয়ের জন্যে তারামণ্ডলী, রাশিচক্র, গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান জানা অত্যন্ত জরুরি ছিল। এ বিষয়ে বণিকশ্রেণী ও সমিতিগুলির আগ্রহ এবং উৎসাহ ছিল সব থেকে বেশি, এই চর্চার পিছনে তাঁদের পরোক্ষ উদ্যোগ থাকাও আশ্চর্যের নয়।

    শ্রমণ বা ওঝাদের ঝাড়ফুঁক আর শেকড়-বাকড়ের চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে সমান্তরাল চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও উদ্ভব হয়েছিল বৌদ্ধ যুগ থেকেই, জীবকের হাত ধরে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মে এতদিন মানুষের ব্যাধির কারণ হিসাবে যে তত্ত্বটি প্রচলিত ছিল, সেটি হল বায়ু, পিত্ত এবং কফ - এই তিনের সাম্যতা দেহকে সুস্থ রাখে। এই বায়ুর প্রকার আবার পাঁচ ধরনের –পঞ্চবায়ু। এদের মধ্যে সাম্যতা নষ্ট হলেই, শরীর অসুস্থ এবং ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন গাছ-গাছড়া, খনিজ দ্রব্য ও ধাতু এবং প্রাণীজ দ্রব্য থেকে নানান ওষুধ বানানোর পদ্ধতি এবং বিভিন্ন ব্যাধিতে তার নির্দিষ্ট প্রয়োগ বিধি নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক চর্চা শুরু করেছিলেন জীবক, যাকে চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় ফার্মাকোপিয়া (Pharmacopeia) বলা যেতে পারে।

    জীবকের এই ভেষজবিজ্ঞান চর্চাকে আরও সমৃদ্ধ করলেন চরক। তাঁর লিখিত বা সংকলিত গ্রন্থের নাম “চরক সংহিতা”। এই সময়ে শল্য-চিকিৎসা (Surgery) বিজ্ঞানের চর্চা করেও বিখ্যাত হয়েছিলেন সুশ্রুত। এঁদের সময়কাল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এঁনারা দুজনেই কণিষ্কের সমসাময়িক ছিলেন। এই চিকিৎসা-বিজ্ঞান বিষয়ের বেশ কিছু বার্চ-বাকলের ভারতীয় স্ক্রোল পাওয়া গেছে মধ্য এশিয়ায়। এছাড়াও গ্রীক উদ্ভিদবিদ্‌ থিওফ্রাস্টাসের একটি গ্রন্থ আছে ভারতীয় ওষধি গাছ-গাছড়া এবং লতা-গুল্মের ওপর - যার নাম হিস্ট্রি অব প্ল্যান্টস (History of Plants)। অর্থাৎ ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা পশ্চিমের দেশগুলিকে সমৃদ্ধ করেছিল।

    এ বিষয়েও ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের দ্বিচারিতা লক্ষ্য করার মতো। ব্রাহ্মণ্য ধর্মে চিকিৎসক, বিশেষ করে শল্যবিদদের অবস্থান ছিল সমাজের কিছুটা নিম্ন স্তরে। যদিচ তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং প্রথাগত শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু তাও চিকিৎসকদের, বিশেষ করে যাঁরা শল্যচিকিৎসার চর্চা করতেন, তাঁদের সমাজের উচ্চস্তরের ব্রাহ্মণেরা সুনজরে দেখতেন না। কারণ তাঁদের শল্যবিদ্যা চর্চার জন্যে মৃত মানবদেহ কিংবা পশু দেহ নিয়ে কাটাছেঁড়া করার প্রয়োজন হত। অথচ সমাজে, মানুষের জন্যেই হোক কিংবা হাতি, ঘোড়া ও গবাদি পশুর জন্যেই হোক চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তা ছিল অপরিহার্য। পরবর্তী কালে এঁদের “বৈদ্য” বলা হয়েছে, এঁরা ব্রাহ্মণ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও, এঁদের পৌরোহিত্যের অধিকার দেওয়া হয়নি, এঁরা ছিলেন ব্রাত্য ব্রাহ্মণ!

    খ) পেশাগত শিক্ষা ও দক্ষতা
    এই ধরনের প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া পেশাগত শিক্ষার প্রচলন করেছিলেন বণিক-সম্প্রদায় বা গিল্ডগুলি। তাঁরা বিশেষ বিশেষ, দেশজ এবং বিদেশী, কুশলী এবং দক্ষ শিল্পীদের নিয়ে সারা দেশেই প্রচুর শিক্ষাকেন্দ্র বানিয়ে তুলেছিলেন। সেখানে তাঁরা আগ্রহী এবং উৎসাহী শিক্ষার্থীদের শিল্পী বানিয়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই শিক্ষার্থী বাছাইয়েও বর্ণভেদের কোন বালাই ছিল না। বরং পরিশ্রমী শূদ্র ও বৈশ্য তরুণরা সম্মানজনক সৃষ্টিশীল কাজ শেখার আশায় এই সব প্রতিষ্ঠানে যোগ দিত।

    এই পেশাগত শিক্ষার যেমন কোন সীমা ছিল না, তেমনই সীমা ছিল না দক্ষতার। খনি থেকে ধাতু নিষ্কাষণ, যেমন সোনা, রূপো, লোহা, তামা, টিন, সীসা। তার থেকে সংকর ধাতু বানানো, যেমন কাঁসা পিতল, ব্রোঞ্জ, কিংবা কাঁচা লোহাকে ইস্পাত বানানো। তার থেকে বাসনপত্র, যন্ত্রপাতি–লাঙলের ফাল, কোদাল, গাঁইতি, কাস্তে, বঁড়শি; অস্ত্রশস্ত্র – তীরের ফলা, তলোয়ার, বর্শার ফলা, খড়গ। আবার ব্রোঞ্জের মূর্তি বানানো, বুদ্ধ, বিষ্ণু, শিব, শ্রী। অথবা সোনা, রূপা বা তামার মুদ্রা। সোনা বা রূপার অলঙ্কার। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এবং প্রত্যেকটি পদে দক্ষতার মাত্রা আলাদা, সংজ্ঞা আলাদা। এভাবেই প্রত্যেকটি পেশাই - তাঁতি, সূত্রধর, কুম্ভকার, স্থপতি, তৈলকার, নৌকা বানানো, সমুদ্রগামী জাহাজ বানানো, যুদ্ধের রথ এবং রাজাদের বিলাসভ্রমণের রথ বানানো – সমাজের অজস্র প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল পেশাগত দক্ষতা।
     
    নিবিড় এই শিক্ষার সুষ্পষ্ট লক্ষণ এই যুগের প্রতিটি ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়। যেমন এই যুগের এবং পরবর্তী যুগের সোনা, রূপা বা তামার মুদ্রাগুলির চিত্র এবং লিপি মুদ্রণের সূক্ষ্ম শৈলীতে। পাথরের স্থাপত্যে - বৌদ্ধস্তূপ, মন্দির বা পাথর কেটে বানানো গুহাগুলিতে। আগে যে জ্যামিতি এবং পরিমিতি সীমাবদ্ধ ছিল যজ্ঞবেদি বানানোর মধ্যে, সেই জ্যামিতি এবং পরিমিতির জটিল প্রয়োগে গড়ে উঠতে লাগল, অনবদ্য মন্দির এবং প্রাসাদের স্থাপত্য। শুধু মাত্র স্থূল স্থাপত্যই নয়, ছোট-বড়ো, নানান ভঙ্গিমার পাথরের ভাস্কর্যে, তার অলংকরণে, তার সূক্ষ্ম শৈলী ও পালিশে। এই সময় থেকেই ধাতু এবং কাঠের শিল্পসামগ্রী, পাথরের ভাস্কর্য এবং স্থাপত্যগুলি ভারতীয় স্বকীয় শৈলীতে অনন্য হয়ে উঠতে লাগল।

    গ) ভাষা ও সাহিত্য
    ৫০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি কোন সময়ে পাণিনি যে ভাষাতত্ত্ব সহ “অষ্টাধ্যায়ী” ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন, তার ওপর ভিত্তি করেই মোটামুটি ১৫০ বি.সি.ই-তে পতঞ্জলি তাঁর “মহাভাষ্য” রচনা করলেন। এই মহাভাষ্যে পাণিনির প্রাচীন, অপ্রচলিত এবং দুর্বোধ্য কিছু নিয়মকানুন বাদ দিয়ে, বাক্য বিন্যাস পদ্ধতি এবং অজস্র নতুন শব্দ – বিগত কয়েকশ বছরের সামাজিক পরিবর্তনের ফলে যেগুলির উদ্ভব – অন্তর্ভুক্ত করলেন। পতঞ্জলির মহাভাষ্যের আরও একটি বিশেষত্ব হল, এই ব্যাকরণ শুধুমাত্র তাত্ত্বিক নীরস বর্ণনা নয়, অজস্র ঐতিহাসিক ঘটনা এবং প্রচলিত কাহিনীর উদাহরণ দিয়ে, শিক্ষার্থী পাঠকের কাছে তত্ত্বগুলি সহজবোধ্য এবং চিত্তাকর্ষক করে তুলেছিলেন। যাঁরা সংস্কৃত জানেন না, অথচ সংস্কৃত ভাষায় আগ্রহী, মূলতঃ তাঁদের কথা মাথায় রেখেই পতঞ্জলি তাঁর এই মহাভাষ্য রচনা করেছিলেন। অর্থাৎ এই সময়ে তাঁর লক্ষ্য ছিল, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের “ম্লেচ্ছ”, “পুলিশ” ও “যবন”-রা - গ্রীক, পারসী ও মধ্য এশিয়ার পণ্ডিত ব্যক্তিরা।
     
    মহাভাষ্যের সমসাময়িক একটি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায় “গার্গী সংহিতা” – যে গ্রন্থে যবন রাজা দিমিত্রিয়সের নাম পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের “যুগ পুরাণ” অধ্যায়ে বলা হয়েছে, যবনরা ম্লেচ্ছ এবং বর্বর হলেও তাদের জ্যোতিষবিদ্যার জ্ঞানের জন্য তাঁরা নমস্য এবং পূজনীয়! সমসাময়িক ভারতীয় বিজ্ঞানীরা জ্যোতির্বিদ্যায় রোম এবং গ্রীসের অবদানের কথা স্মরণীয় করে রেখেছিলেন তাঁদের “রোমক-সিদ্ধান্ত” এবং “পৌলিশ সিদ্ধান্ত” নাম দিয়ে। “রোমক”-এর অর্থ রোমান এবং গ্রীক বা পার্থিয়ানদের সংস্কৃত শাস্ত্রে “পুলিশ”ও বলা হয়েছে; “পুলিশ”-এর তত্ত্ব অর্থে পৌলিশ সিদ্ধান্ত। অথবা আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ পলের (Paul of Alexandria) নাম থেকেও “পৌলিশ” হতে পারে।
     
    এই সময় কালে সংস্কৃত ভাষায় অজস্র শাস্ত্র এবং ধর্মশাস্ত্র রচনা হয়েছে। তার মধ্যে আছে মনুর “স্মৃতি” এবং বেশ কিছু পুরাণ। হয়তো এই সময়েই, অনেক পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং সংযোজন করে লিখে ফেলা হয়েছে, দুটি মহাকাব্য – রামায়ণ ও মহাভারত। লিখে ফেলা হয়েছে সবগুলি বেদ, তার সংহিতা,  ব্রাহ্মণ, উপনিষদ এবং সূত্রসমূহ। বেদগুলিতে পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের ঝুঁকি নেওয়া হয়নি, কারণ বেদমন্ত্রগুলি, আগেই বলেছি, প্রাচীন ঋষিরা সৃষ্টি বা রচনা করেননি, তাঁরা এই মন্ত্রগুলির দ্রষ্টা অর্থাৎ তাঁরা আদিষ্ট হয়েছিলেন। এই সময়েই সংকলিত হয়ে, লেখা হয়েছে কৌটিল্যের “অর্থশাস্ত্র” – এই সংকলক ছিলেন বিষ্ণুগুপ্ত। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, রাজা বিম্বিসার এবং মৌর্যযুগ থেকে শুরু করে, এই সময়কাল পর্যন্ত ভারতীয় রাজাদের প্রায় কেউই সংস্কৃতভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেননি। তাঁদের সকলেরই রাষ্ট্রীয়ভাষা ছিল প্রাকৃতভাষার নানান আঞ্চলিক রূপ। প্রথম যে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র সংস্কৃতকে প্রশাসনিক ভাষা করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন বিদেশী – উজ্জয়িনীর শক রাজারা, যাঁদের সাধারণতঃ পশ্চিমের ক্ষত্রপ বলা হয়। ক্ষত্রপ রাজা রুদ্রদমনের গিরনার শিলালেখকেই (১৫০ সি.ই.), ঐতিহাসিকরা ভারতের প্রাচীনতম লিখিত সংস্কৃত নথি বলে মনে করেন। প্রসঙ্গতঃ গিরনারের সম্রাট অশোকের প্রাকৃত ভাষার শিলালেখের শিলাতেই, ক্ষত্রপ রুদ্রদমন এই সংস্কৃত নির্দেশ লিখিয়েছিলেন।      

    কিন্তু যে কোন ভাষায় তত্ত্ব এবং শাস্ত্রকথা যতই বলা বা লেখা হোক, ভাষা স্বচ্ছন্দ গতি পায় সাহিত্যে। সাহিত্যের জন্যেই কোন ভাষা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যে ভাষায় মনের কথা প্রকাশ করা যায়, সেই ভাষাতেই মানুষ একাত্ম হতে থাকে। এই যুগে ধর্মশাস্ত্র এবং ব্যাকরণ ছাড়াও সাহিত্যের আঙিনায় সংস্কৃত পা রাখতে শুরু করেছিল। প্রাকৃত ভাষায় কবিতা রচনা করেছিলেন, সাতবাহন বংশের রাজা, হাল, সে কথা আগেই বলেছি। তাঁর কবিতা সংকলনের নাম, “গাথাসপ্তশতী” – এই কবিতাগুলির বেশ কিছু প্রেমের, কিছু অতিরিক্ত ভাবপ্রবণ আবার কিছু ছিল আদিরসাত্মক– তা হলেও সাহিত্যের প্রাথমিক পর্যায়ে মোটামুটি রসোত্তীর্ণ। মোটামুটি এই সময়েই সংকলিত হয়েছিল তামিল ভাষার প্রথম কবিতা সংকলন “শঙ্গম”। শঙ্গমের কবিতাগুলি বহু বছর আগে থেকেই ওই অঞ্চলে প্রচলিত ছিল চারণ কবিদের মুখে মুখে, এবং কবিতার বিষয়বস্তু ছিল ওই অঞ্চলের জনপ্রিয় নানান সামাজিক ঘটনা। এই সময়েই তামিল ব্যাকরণ “তোলকাপ্পিয়ম”ও রচিত হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, সংস্কৃত এবং প্রাকৃত ভাষার বাইরে, তামিল হচ্ছে প্রথম ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষা, যে ভাষার ব্যাকরণ এবং কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল এই পর্যায়ে। 

    বৌদ্ধ দিকপাল পণ্ডিত অশ্বঘোষের লেখা “বজ্রসূচী” – সম্ভবতঃ এই পর্যায়ের প্রথম সংস্কৃত সাহিত্য। এই গ্রন্থটি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, তার সামাজিক প্রথা এবং চতুর্বণের প্রতি তীক্ষ্ণ কটাক্ষ করে লেখা। যদিও অনেকের মতে এটি হিন্দুদের “বজ্রসূচী উপনিষদ” – এবং কোন মতেই অশ্বঘোষের রচনা নয়। যাই হোক, অশ্বঘোষের বুদ্ধের জীবনী নিয়ে লেখা দীর্ঘ কাব্য “বুদ্ধচরিত”– জীবনী কাব্য রচনায় যে পথিকৃৎ, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বুদ্ধচরিতের সংস্কৃত ভাষার অনবদ্য শৈলী, পরবর্তী সংস্কৃত সাহিত্যের পথপ্রদর্শক বললেও খুব একটা অতিরঞ্জন হয় না। এইসময়ের অন্যতম চিন্তাবিদ ও দার্শনিক, বৌদ্ধ পণ্ডিত নাগার্জুনও সংস্কৃত ভাষাতেই বৌদ্ধ শাস্ত্র রচনা শুরু করেছিলেন। পণ্ডিত নাগার্জুনের সংস্কৃত বৌদ্ধশাস্ত্রগুলি, ব্রাহ্মণ্যধর্মের সংস্কৃত শাস্ত্রের প্রেক্ষীতে লেখা। যার ফলে উভয় ধর্মশাস্ত্রের পণ্ডিতদের মধ্যে দার্শনিক তর্ক-বিতর্ক কিংবা তাত্ত্বিক বিচারের পথ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। অতএব সংস্কৃত ধীরে ধীরে আবার উচ্চমেধা (elite) এবং পণ্ডিত সমাজের একমাত্র ভাষা হয়ে উঠতে লাগল। যদিও আঞ্চলিক ভাষা কিংবা স্থানীয় প্রাকৃত ভাষার প্রচলন সমান্তরালেই চলতে লাগল, সাধারণ জনগণের মধ্যে।

    সম্ভবতঃ এই সময়েই সংস্কৃতে ভাস লিখলেন তাঁর অনবদ্য নাটক “স্বপ্নবাসবদত্তম্‌”। ভাসের সময়কাল সঠিক জানা যায় না, তবে এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তিনি মহাকবি কালিদাসের পূর্বসূরি এবং তাঁর জন্মকাল খ্রিষ্টিয় শতাব্দীগুলির প্রথম দিকেই। তাঁর নাটকের বিন্যাস, আজও ভারতীয় নাটকে অনুসরণ করা হয়। তাঁর নাটকের বিষয়বস্তু মহাকাব্যিক অথবা ঐতিহাসিক প্রেমের কাহিনী। ভাসের নাটক অবিশ্যি রাজসভা অথবা বিদ্বৎমহলে সব থেকে জনপ্রিয় হয়েছিল। অশ্বঘোষও সংস্কৃতে কিছু নাটক লিখেছিলেন, সেগুলির মূল পাওয়া যায় না। মধ্য-এশিয়ার তুরফান বৌদ্ধবিহার থেকে তাঁর নাটকের বিভিন্ন অংশ উদ্ধার হয়েছে। যার থেকে অনুমান করা যায়, অশ্বঘোষের নাটকগুলি ধর্মভিত্তিক এবং সাধারণের কাছেও অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং উপভোগ্য হয়েছিল, তা নাহলে তার পাণ্ডুলিপি মধ্য-এশিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গেল কী করে?
     

    চলবে...
    (চতুর্থ পর্বের তৃতীয় ভাগ আসবে ১৬/০৭/২২ তারিখে)
    গ্রন্থঋণ -
    ১) Schools and Sects of Buddhism – by P. V. Bapat and Nalinaksha Dutta – from The Cultural Heritage of India (Volume I) – published by Swami Lokeswarananda, The Ramkrishna Mission Institute of Culture, Kolkata under the board of eminent scholars like, Dr. Sarvepalli Radhakrishnan (Chairman), R.C. Majumdar, Suniti Kumar Chatterji, Humayun Kabir, U.N. Ghoshal, A.D. Pusalker, Niharranjan Ray, et al.
    ২) History of Ancient India – Rama Shankar Thripathi.
    ৩) Penguin History of Early India – Dr. Romila Thapar.
    ৪) The Wonder that was India – A. L. Basham.

    [1] সাতবাহন রাজা সাতকর্ণির নামের সঙ্গে তাঁর মাতৃদেবী গৌতমীর নাম সংযুক্ত হওয়া, আর্য বা ব্রাহ্মণ্য সমাজবিধির পরিপন্থী মনে হয় না? আর্য সমাজে পিতার নামের সঙ্গে পুত্রের নাম জুড়ে দেওয়া খুবই স্বাভাবিক নিয়ম ছিল। যেমন, রামচন্দ্র দাশরথি, পাণ্ডুর পুত্রেরা পাণ্ডব, কশ্যপের পুত্র কাশ্যপ ইত্যাদি। অবশ্য ব্যতিক্রম ছিল, যেমন মাতা কুন্তীর নাম অনুসারে পাণ্ডবদের কৌন্তেয়ও বলা হত। আবার ব্রাহ্মণ্য-বিরোধী বুদ্ধদেবও তাঁর মাতার গৌতমী নামটি নিয়েই “গৌতমবুদ্ধ” নামেই নিজের পরিচয় দিতেন। মাতার নামে পুত্রের পরিচয় অনার্য সমাজে প্রচলিত ছিল কি?   

    [2] আমরা দেখেছি ইন্দ্র, অগ্নি, রুদ্র, পবন প্রমুখরা ছিলেন বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য দেবতা। তার পাশাপাশি সাতবাহন সাম্রাজ্যে শিব, বিষ্ণু এবং অন্যান্য দেবতাদের পুজো-প্রসঙ্গও সামনে আসতে শুরু করেছে।   

    [3] স্টাকো(Stucco) হল পাথর বা ইঁট (বা আধুনিক কংক্রিট) দিয়ে বানানো নির্মাণের ওপর কঠিন পলেস্তারার প্রলেপ। এই প্রলেপ শুধু যে নির্মাণকে সুরক্ষা দেয় তাই নয়, নানান নকশা বা আলপনা বানিয়ে নির্মাণকে সুন্দর সুষমাময়ও করে তোলে। বাংলায় একেই আগেকার দিনে “পঙ্খের” কাজ বলা হত, আজকাল সাধারণতঃ “প্লাস্টার অব প্যারিস” (Plaster of Paris) দিয়ে স্টাকো করা হয়ে থাকে।   

    [4] বাঁশ (Bamboo) ভারতবর্ষের – বিশেষতঃ পূর্বভারতের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক উপাদান, এর নানান ব্যবহার ভারতীয়রা আবহমান কাল ধরেই করে আসছে। চীনা বাঁশ হয়তো তার থেকে কিছুটা আলাদা প্রজাতির, এই বাঁশ থেকে সুদৃশ্য আসবাবপত্রাদি বানানো হত। 
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১১ জুলাই ২০২২ | ১৪৫৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Madhuri Hazra | ১১ জুলাই ২০২২ ২০:৫৯509797
  • নমস্কার। আবারও খুব আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। এ জীবনে ভারতের ইতিহাস (আমার কাছে তো সম্পূর্ণ ইতিহাসই) যে কোনদিন এত সহজ, সুলভ্য হয়ে আমার সামনে আমারই মাতৃভাষায় উপস্থিত হবে; আর আমি সুদূর প্রবাসে বসে তা পড়ে, জেনে এত আনন্দ পাব - কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। 
    নিশ্চয়ই গতজন্মে কিছু ভাল করেছি কোথাও। 
    যাইহোক আপনার এই পর্বের লেখার সঙ্গে আমার আবিষ্কারের কথা বলি। 
    বহু বহু বছর ধরে আমার ভীষণ কৌতূহল যে বুদ্ধদেবের চুল এত কোঁচকানো কেন দেখানো হয় সর্বত্র। 
    ইদানীং কালে, গুগুলের এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোন একটি site এ পড়ি যে গ্রীক ভাস্কর্যের প্রভাব ছিল প্রথম বুদ্ধ মূর্তি (সমূহ) তৈরীতে। সেই থেকেই গ্রীক ধরণে মূর্তিতে চুল সম্ভবতঃ কোঁচকানো দেখানো হয়। পরে তার অনুকরণে সেটাই চালু হয়ে যায়। এ সবই "সম্ভাব্য"র পর্যায়েই ছিল। কিন্তু আমার কাছে খুবই যুক্তিপূর্ণ মনে হয়। 
     
    আর stucco আর পঙ্খের কাজ যে একই জিনিস জেনে ভাল লাগল। ২০১৭ সালে বিষ্ণুপুরে পঙ্খের কাজ আমাদের মুগ্ধ করেছিল। তা যে জানাশোনা স্টাকোর এত কাছের জিনিস তা তো জানতাম না। 
     
    পৃথিবী শুধু গোলই নয়; খুবই ছোট্ট। আমরাই খালি ঝগড়া করে মরি!
  • Kishore Ghosal | ১২ জুলাই ২০২২ ১১:১৫509814
  • ঠিক বলেছেন, দিদি, 
    আমরা আলোকময় সত্যের পথ ছেড়ে, মিথ্যা ধারণা নিয়ে অন্ধকারে হানাহানি করে মরছি।
     
        
  • Amit | 121.2.***.*** | ১৩ জুলাই ২০২২ ০৩:৫৭509822
  • কমপ্লেক্স স্থাপত্য বানানোর স্কিল বা ম্যাসনরি-র র সাথে সাথে ম্যাথেমেটিক্স যেভাবে ইভল্ভ করেছিল -জাস্ট অ্যামেজিং। আমি যেটুকু সামান্য পড়েছি ,  অনেক পাথরের মন্দিরে কোনো মর্টার ব্যবহার করা হয়নি। জাস্ট পাথরগুলো জিগস পাজাল এর মতো করে একটার ওপর একটা খাপে খাপে বসিয়ে এমনভাবে বসানো হয়েছিল যে ভূমিকম্প হলেও সেগুলো স্টেবল থাকতো। বিশেষ করে মন্দিরের বা প্রাসাদের ছাদের বাঁকানো আর্চগুলো। প্রতিটা ইঁট বা ​​​​​​​পাথর একটা ​​​​​​​সার্টেন এঙ্গেলে ​​​​​​​কাটা ​​​​​​​হতো ​​​​​​​যাতে ​​​​​​​কোনো ​​​​​​​মর্টার ​​​​​​​ছাড়াই একটার ওপর আরেকটা পাথর দাঁড়িয়ে থাকে। ​​​​​​​একটা ইটের  ​​​​​​​এঙ্গেল ​​​​​​​এদিক ​​​​​​​সেদিক ​​​​​​​হয়ে ​​​​​​​গেলেই কিন্তু ​​​​​​​পুরো ​​​​​​​আর্চটা ধসে ​​​​​​​যাবে। 
     
    তার ​​​​​​​মানে ​​​​​​​ভাবেন কতটা ​​​​​​​ক্যালকুলেশন ​​​​​​​আর ​​​​​​​কতটা ​​​​​​​পারফেকশন ​​​​​​​লাগতো ​​​​​​​পুরো ​​​​​​​জিনিসটা ​​​​​​​বানাতে। শুধু বেসিক ছেনি হাতুড়ি নিয়ে এইরকম স্কিলসেট ​​​​​​​সত্যি ​​​​​​​অ্যামেজিং। এই ​​​​​​​টেকনিকে ​​​​​​​বানানো ​​​​​​​রেলিকস ​​​​​​​দেখেছি ​​​​​​​দুয়েক ​​​​​​টা জায়গায়- যেখানে কোনো ভূমিকম্পে ​​​​​​​আশেপাশের ​​​​​​​মডার্ন ​​​​​​​সিমেন্ট দিয়ে বানানো বাড়ি ​​​​​​​ধসে ​​​​​​​গেছে ​​​​​​​কিন্তু ​​​​​​​পুরোনো আর্চগুলো ​​​​​​​দিব্যি ​​​​​​​দাঁড়িয়ে ​​​​​​​আছে। এগুলো নিয়ে আরো জানতে ইচ্ছে করে। 
     
    একটা ​​​​​​​কাঁচা ​​​​​​​হাতের ​​​​​​​ছবি ​​​​​​​দিয়ে দিলুম ​​​​​​​যদি ​​​​​​​বোঝাতে ​​​​​​​পারি। আমার ছবিতে অবশ্য সব সোজা সোজা হয়ে গেছে। 
    :):) :) 
     
    এই সিরিজটা অসাধারণ হচ্ছে। আপনি লিখতে থাকুন। 
     
  • Kishore Ghosal | ১৩ জুলাই ২০২২ ১১:০৯509825
  • অমিতবাবু, 
     
    অনেক ধন্যবাদ আপনার উৎসাহের জন্য। 
     
    সেকালের পাথর এবং ইঁটের গাঁথনির প্রযুক্তি এক কথায় অসাধারণ। আমাদের ছাত্রাবস্থায় কিছু কিছু পড়তে হয়েছিল।তাছাড়া শ্রীযুক্ত নারায়ণ সান্যালের গবেষণামূলক বইগুলিতেও, যেমন, কারুতীর্থ কলিঙ্গ, অপরূপা অজন্তা ইত্যাদিতেও এ বিষয়ে সাবলীল আলোচনা রয়েছে।   
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন