দ্বিতীয় পর্ব - ১২,০০০ থেকে ৬০০ বি.সি.ই (দ্বিতীয় ভাগ)
২.২.১ সামাজিক শ্রেণী বিন্যাস
এমন নয় যে গ্রামের সক্কলেই নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং উপকরণের সুবিধে ভোগ করতে পেরেছিল। আজও যেমন হয় না। এরোপ্লেনের ভাড়া অনেক কম হয়ে গেছে বলে, ট্রেন কিছু ফাঁকা হয়ে যায়নি। মোটরবাইক বা স্কুটার সহজলভ্য হওয়ায় সাইকেল উঠে যায়নি। চারচাকা তুলনামূলক সস্তা হয়ে গেলেও বাস তুলে দেওয়া যায়নি। আজও আমাদের দেশে এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা টেলিভিসন, মোবাইল-ফোন, কম্পিউটার কী জানেন না, ব্যবহার তো দূরের কথা। সেসময়ও পরিস্থিতি একই রকম ছিল।
যারা লোকবল ব্যবহার করে প্রচুর জমি জায়গা আয়ত্ত্ব করতে পেরেছিল, তারা তাদের উদ্বৃত্ত ফসলের বদলে আমদানি করতে লাগল একের পর এক প্রযুক্তি। তারা বলদের কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে চাষ করতে লাগল বছরের প্রায় দশমাস। উদ্বৃত্ত ফসল আরও অনেক উদ্বৃত্ত হতে লাগল। উদ্বৃত্ত ফসলের বদলে ভরে তুলল তাদের খামার - গরু, বলদ, ছাগল, ভেড়ায়। আজকাল তারাও শিখে ফেলেছে এঁড়ে বাছুরকে কীভাবে বলদ করে তোলা যায়। অতএব বলদও হয়ে উঠতে লাগল উদ্বৃত্ত সম্পদ। গাভীর দুধ পরিবারের শিশু এবং বৃদ্ধদের..
"ধর্মাধর্ম" গ্রন্থাকারে গুরুচণ্ডা৯ থেকে প্রকাশিত।
তারা হল অরণ্য বাসী, আরণ্যক শ্রেণী। এখানে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার সে সময়ের সমস্ত মানুষই যে শিকারী-সংগ্রাহী জীবন ছেড়ে দিয়ে কৃষিসমাজে চলে এসেছিল তা কিন্তু নয়। এই উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অরণ্য অঞ্চলে বেশ কিছু মানুষগোষ্ঠী রয়ে গেল আগের মতোই, একই পেশা, একই ধরনের পারিবারিক আচরণ এবং বিশ্বাস নিয়ে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাদের অধিকাংশই এই আগ্রাসী কৃষি সমাজকে খুব ভাল চোখে দেখেনি। কারণ এই আগ্রাসী কৃষিসমাজ সর্বদাই নদী তীরবর্তী অগভীর অরণ্য গ্রাস করে কৃষি জমি বানিয়েছে এবং তাদের ঠেলে দিয়েছে, বিপজ্জনক গভীরতর অরণ্যের দিকে। যেখানে জীবনধারণ করা শুধু বিপজ্জনকই নয়, অনেক বেশি দুরূহ।
অতএব এই তথাকথিত সভ্য হয়ে ওঠা মানুষগোষ্ঠীদের ওপর আরণ্যক গোষ্ঠীদের একাংশ বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠল। তাদের সেই বিদ্বেষ প্রায়ই হয়ে উঠল হিংস্র অতর্কিত আক্রমণ। সভ্য মানুষদের বসতি এবং গ্রামে তারা প্রায়শঃ হানা দিত শস্যের লোভে এবং গৃহপালিত পশুর লোভে। সে আক্রমণে হতাহত হত অনেক গ্রামবাসী। কারণ কয়েক হাজার বছরের মধ্যে গ্রামবাসীরা, শিকারী-সংগ্রাহী মানুষদের তুলনায় হয়ে উঠেছিল অনেক শ্লথ, দুর্বল এবং লড়াইতে অদক্ষ। যার ফলে গ্রামের কৃষিনির্ভর মানুষদের মনেও এই অরণ্যবাসী মানুষদের সম্পর্কে গড়ে উঠল আতঙ্ক। কয়েক হাজার বছর আগেকার সমগোত্রীয় অরণ্যবাসী শিকারী-সংগ্রাহী মানুষরাই এখন সভ্য সমাজের চোখে হয়ে উঠল ভয়ংকর রাক্ষস কিংবা দৈত্য-দানব শ্রেণী।
আবার অরণ্যে থেকে যাওয়া সকল শিকারী-সংগ্রাহী মানুষই কৃষি সমাজের ওপর বিদ্বিষ্ট এবং হিংস্র হয়ে উঠেছিল তাও নয়। কিছু কিছু দল নিজেদের শিকারী-সংগ্রাহী বৃত্তিকে না ছাড়লেও, তারা বাইরে থেকে কৃষি সমাজের সুবিধেগুলোও কিছু কিছু উপভোগ করত। যার ফলে তাদের সঙ্গে কৃষিসমাজের কিছুটা দূরত্ব থাকলেও একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে উঠেছিল, এবং সাংঘাতিক বিদ্বেষ ছিল না। এই শিকারী-সংগ্রাহী মানুষেরা জঙ্গলের বিশেষ কিছু শিকার এবং সংগ্রহ নিয়ে আসত, কাছাকাছি কৃষিসমাজের গ্রামগুলিতে। যেমন তারা শিকার করে আনত হরিণ, বুনো শুয়োর, সংগ্রহ করে আনত মধু, বুনো কন্দ, ওষধি লতাপাতা। তার বদলে তারা নিয়ে যেত গম, যব বা ধান, কিংবা ব্রোঞ্জের অস্ত্র-শস্ত্র, সরঞ্জাম। কৃষিজীবি মানুষদেরও পোষ্য প্রাণীর একঘেয়ে মাংসের থেকে হরিণ কিংবা বুনো শুয়োরের মাংসে মুখ বদল হত, গ্রামে বসেই পেয়ে যেত মধু কিংবা ওষধি লতাপাতার সংগ্রহ। কৃষি সমাজের সভ্য মানুষেরা একদা সমগোত্রীয় এই শিকারী-সংগ্রাহী মানুষদের নাম দিল কিরাত, ব্যাধ, শবর, নিষাদ, ইত্যাদি।
২.২.২ নিবিড় বাণিজ্য
সমাজের অভিজাত শ্রেণীরই একাংশ আবার অনেকে বণিকও হয়ে উঠল, অথবা অন্যভাবে বললে বণিক সমাজের অনেকে অভিজাত হয়ে উঠল। তারা গ্রাম ছেড়ে সুবিধেজনক জায়গায় বসতি-স্থাপন করতে লাগল। এই বসতি-স্থাপন যে কোন জঙ্গল সাফ করে গ্রাম বা কৃষিক্ষেত্র বানিয়ে তোলার মতো সহজ সরল নয়। এর অবস্থান নির্দিষ্ট হত কৌশলগত দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনার থেকে।
বাণিজ্যের নিবিড় আন্তর্জাল (network) গড়ে তুলতে প্রধান যে কয়েকটি বিষয়ে নজর দিতে হয়, সেগুলি হলঃ
ক) যোগাযোগঃ দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান উপায় ছিল সড়কপথ।
"ধর্মাধর্ম" গ্রন্থাকারে গুরুচণ্ডা৯ থেকে প্রকাশিত।
সত্যি কথা বলতে পৃথিবীর যে কোন দেশের বাণিজ্যিক মহানগর এবং নগরগুলি উপরের নিয়মেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই উপমহাদেশেরই এক প্রান্তে এমনই সফল বাণিজ্যের এক নিখুঁত পরিকাঠামো গড়ে তোলার সূচনা করেছিল। সে আলোচনায় একটু পরেই আসছি। আর সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, এই পর্যায়ে মানুষের সামাজিক জীবন যাপনের পরিস্থিতির দিকে সংক্ষেপে চোখ রাখা যাক।
২.২.৩ কৃষি সমাজে জীবনযাত্রার মান
ভুলকা পরিবার এবং বিশ্ভাইয়ের যে কল্পনা দিয়ে এই পর্বের শুরু করেছিলাম, তার সময়কাল আজ থেকে মোটামুটি চোদ্দ হাজার বছরের শুরুতে। যখন অধিকাংশ মানুষের সমাজই পুরোপুরি অথবা আংশিকভাবে কৃষিকাজে এবং পশুপালনে যুক্ত হয়ে গেছে। এবং এই অধ্যায় শেষ করছি আজ থেকে মোটামুটি ন’হাজার বছরের শেষে।
আলোচ্য এই পাঁচ হাজার বছরে মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে যে যে উন্নতি এবং অবনতি ঘটল, তা এই রকমঃ -
১) শিকারী-সংগ্রাহী মানুষের সম্পদ যত সামান্যই হোক, পরিবারের কোন সদস্যেরই তাতে ব্যক্তিগত অধিকার ছিল না, সে সম্পদ ছিল সম্পূর্ণ পারিবারিক। এক পরিবারের মেয়ে অন্য পরিবারে বধূ হয়ে আসাতে পারিবারিক বাঁধন আলগা হতে শুরু হল। এখন পরিবারের সম্পদে ব্যক্তিগত অধিকারের প্রশ্ন এবং বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। কারণ একই পরিবারভুক্ত ভাইরা এবং পুত্রেরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ পরিবারের কর্তা। অর্থাৎ এখন যে কোন পরিবারই অনেকগুলি ছোট ছোট পরিবারের সমষ্টি। তাদের সকলেই পিতার সম্পদের অধিকারী। এই সম্পদের অধিকার ও বণ্টন থেকেই জ্ঞাতি শত্রুতার উদ্ভব হতে লাগল। এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন আমাদের আজও হতে হয়। এই ভাঙনের জন্যে ঠিক কে কতটা দায়ি, সে বিতর্কের প্রসঙ্গ আমাদের এখানে আলোচ্য নয়। দায়ি যেই হোক, আমি শুধু পারিবারিক অশান্তি আর দুশ্চিন্তার বিষয়টির দিকেই মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছি। পরিবারের সামগ্রিক বিপদ-আপদ, প্রাকৃতিক এবং আশেপাশের আরণ্যক প্রতিকূলতার সঙ্গে নতুন এক শত্রুশ্রেণী গড়ে উঠল, যার নাম জ্ঞাতিশত্রু – একই পরিবারের রক্ত সম্পর্কিত ভাইদের মধ্যে বিবাদ। অর্থাৎ নিবিড় পারিবারিক বন্ধন ভেঙে, এখন মানুষের মনে পারিবারিক অন্তর্কলহের দুশ্চিন্তা এনে দিল।
২) পরিবারে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের যে সমমর্যাদা এবং সমদক্ষতার অবস্থান ছিল, সেখান থেকে অনেকটাই সরে গিয়ে, কৃষিসমাজের পরিবারগুলি পুরুষপ্রধান - পিতৃতান্ত্রিক হয়ে উঠল। মেয়েরা এখন জন্ম থেকেই পরের ঘরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হতে থাকল। অতএব আগের মতো দক্ষ শিকারী, অরণ্যচারী হওয়ার থেকে মেয়েরা এখন রূপচর্চা করে, কোমল ও পেলব অবলা নারী হয়ে উঠতে শুরু করল। তাদের সঠিক বরে এবং ঘরে বিয়ে দেওয়াটাই হয়ে উঠল পরিবারের অন্যতম দুশ্চিন্তার বিষয়।
"ধর্মাধর্ম" গ্রন্থাকারে গুরুচণ্ডা৯ থেকে প্রকাশিত।
... শোধ করার জন্যে সপরিবার-নাতিকে মহাজনের জমিতে বেগার খাটার ঘটনা আকছার শোনা যেত।
৯) প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আরণ্য বিপদ-আপদের দুশ্চিন্তা এবং আতঙ্কের জন্যে, শিকারী-সংগ্রাহী মানুষেরা পশুপতিদেব, দেবীমা এবং নানান আত্মার ওপর নির্ভর করত। কিন্তু সেই নির্ভরতায় অসহায়তা ছিল অনেকটাই কাল্পনিক। সে কথা আগেই বলেছি। কখনো কখনো ঝড়ে বা হাতির দলের আক্রমণে তাদের পর্যুদস্ত হতে হত, দলের কিছু লোক মারাও যেত। তার পরেও দলের বেঁচে যাওয়া মানুষরা দেবতা-দেবী অথবা আত্মাকে তাদের প্রাণরক্ষার জন্যে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, স্বাভাবিক জীবনে আবার সহজেই ফিরে যেতে পারত। যেভাবে আমরা আজও যে কোন মৃত্যুর শোক-দুঃখ এবং বিচ্ছেদকে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় চট করে ফিরে আসি।
কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, সমাজের অধিকাংশ মানুষ - কৃষক থেকে সাধারণ শ্রমিক এতটাই অসহায় অবস্থায় ছিল, আজকের যুগে তা কল্পনা করাও অসম্ভব। এই অসহায় অবস্থা থেকে কবে, কীভাবে তারা মুক্তি পাবে তারও কোন দিশা তাদের সামনে থাকত না। এই বছর কৃষকরা হয়তো খরায় সর্বস্বান্ত হল, কিন্তু পরের বছর কী হবে? সুবর্ষা, বন্যা, নাকি আবারও খরা? অতএব তারা আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠছিল, ভাগ্যের ওপর, অর্থাৎ পশুপতিদেব এবং দেবীমার ওপর। অতএব দ্রুত বাড়তে লাগল পূজা-পার্বণ, ব্রত, মানত, নতুন নতুন প্রথা, আচার, আচরণ, এমনকি নিত্য নতুন দেব-দেবীও!
২.২.৪ এই সময় কালের প্রত্ন নিদর্শন এতদিন পর্যন্ত আমি আদিম মানুষের জীবনযাত্রার পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টা করেছি পুরোটাই কল্পনায়। কিন্তু এই সময়কালে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে খুঁজে পাওয়া বেশ কিছু প্রত্ন নিদর্শন, আমার এই কাল্পনিক পুনর্নির্মাণকে অনেকটাই সমর্থন করবে। সেরকমই কিছু প্রত্ন নিদর্শনের কথা এখানে আমি উল্লেখ করব-
প্রথমদিকে আদিম মানুষদের আবাস ছিল পাহাড়ের গুহায়, অথবা পাথর সাজিয়ে কিংবা কাঠকুটো আর বড়োবড়ো পাতা দিয়ে বানিয়ে তোলা অস্থায়ী আস্তানায়।
পাহাড়ের গুহায় বেশ কিছু মানব ও মানুষের গোষ্ঠীর বসবাসের নিদর্শন পাওয়া গেছে, মধ্যপ্রদেশের ভিমবেটকা, উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের সাঙ্ঘাউ, অন্ধ্রের কুর্নুলে। পাহাড়ের গুহার আস্তানা থেকে তাদের সম্বন্ধে জানা যতটা সহজ, অস্থায়ী আস্তানার ক্ষেত্রে ততটা সহজ নয়। কারণ আজ বেশ কয়েক হাজার বছর পরে তাদের অস্তিত্ব প্রমাণ করার কোন প্রত্যক্ষ সূত্র নেই। বিশেষজ্ঞরা অস্থায়ী আস্তানার হদিশ সেখানেই আন্দাজ করেন, যে যে বিশেষ এলাকায় একত্রে অনেক ধরনের জীবাশ্ম উদ্ধার করা গেছে। যেমন একসঙ্গে প্রচুর পশুহাড়, বেশ কিছু পাথরের যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রের জীবাশ্ম। একই জায়গায় নানান ধরনের পশুহাড়ের প্রচুর জীবাশ্ম থেকে আন্দাজ করা যায়, এগুলি ওই মানব প্রজাতির শিকার ও খাদ্যের অবশেষ। এই পশুদের মধ্যে হরিণ, বুনো ছাগল, ভেড়া, শুয়োর, গবাদি পশু এমন কি বন্য বেড়াল জাতীয় প্রাণীর হাড়ও পাওয়া গেছে। এই ধরনের আবাসগুলি হত, কোন নদী বা বড়ো জলাশয়ের কাছাকাছি এবং ঝোপঝাড়ওয়ালা অগভীর জঙ্গলে। অতএব ওই সময়ে মানুষের জীবনধারণের একমাত্র উপায় ছিল শিকার - সংগ্রহ এবং পরিভ্রমণ। এক জায়গা থেকে অন্য কোন অনুকূল জায়গায় ঘুরে বেড়ানো।
মধ্য প্রদেশের ভীমবেটকা গুহাগুলির অনন্য বিশেষত্বের কথা একটু বিস্তারিত বলা প্রয়োজন। ভূপাল শহর থেকে ৪৫ কি.মি. দূরে রাইসেন জেলার সাতটি পাহাড়ে প্রায় ৭৫০টি গুহার সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রায় দশ কি.মি.-র মধ্যে ছড়িয়ে থাকা এই গুহাগুলিতে লক্ষাধিক বছর ধরে মানুষের নিরন্তর বসবাসের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। কয়েকটি গুহায় এক লক্ষ বছর আগেও যাদের বসবাস ছিল, তারা নিশ্চয়ই ইরেক্টাস অথবা অন্য কোন মানব প্রজাতি, হোমোস্যাপিয়েন্স নয়। এর পরে দশ হাজার বছর আগে পর্যন্ত এই গুহাগুলি বিভিন্ন সময় এবং পর্যায়ে মানুষের আবাস ছিল। যার ফলে একই জায়গায় মানব ও মানুষে
[3]র সাংস্কৃতিক বিবর্তনের পর্যায়গুলি খুব স্পষ্ট চিনে নেওয়া যায়। এই গুহাগুলিতে পাওয়া বিভিন্ন সময়ের পাথরের সামগ্রী, অস্ত্রশস্ত্র এবং গুহাচিত্র থেকে বিভিন্ন যুগের – প্যালিওলিথিক, মেসোলিথিক এবং নিওলিথিক - মানুষদের সম্পর্কে অনেক তথ্য নিশ্চিত করা যায়।
আদিম প্রস্তর বা প্যালিওলিথিক যুগের বিভিন্ন পর্যায় এবং নব্য প্রস্তর যুগের মূল পার্থক্য হল পাথরের অস্ত্র ও সামগ্রীর গুণগত পার্থক্য। আদিম যুগের মানুষেরা নদীর ধারে কিংবা পাহাড়ি জঙ্গলে পড়ে থাকা নুড়ি পাথরকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। সেই পাথরকে ভেঙে ধারালো করে তোলা হল পরবর্তী পর্যায়। তারপর অভিজ্ঞতা থেকে বিশেষ কোন পাথরকে, যেমন ফ্লিন্ট বা কোয়ার্জ, চিহ্নিত করে, তাকে বিশেষ স্তরে ভেঙে আরো ধারালো অস্ত্র তৈরি হল পরবর্তী পর্যায়। নব্যপ্রস্তর যুগে এল আরো ছোট ছোট অস্ত্র, যাকে মাইক্রোলিথ (microlith) বলা হয়, যার সাইজ ৫ সেন্টিমিটারের মধ্যে এবং তীক্ষ্ণ ধারালো ফলক। এগুলি নানান কাজে ব্যবহার হত, পশুর চামড়া ছাড়ানো বা মাংসের ফালি কেটে নেওয়ার ছুরি, শস্য কাটার কাস্তে, হাতির দাঁত বা পশুর হাড় থেকে পুঁতি এবং গয়না বানানোর কাজে। কিছু তিনকোণা ধারালো ফলক পাওয়া গেছে, যেগুলি কাঠির ডগায় বেঁধে তির হিসেবে ধনুক থেকে ছোঁড়া হত, এবং বর্শার ফলক তো ছিলই। তির-ধনুকের ব্যবহারে দূর থেকে শিকার করতে যেমন সুবিধে হয়েছিল, তেমনি বেড়েছিল শিকারীর নিরাপত্তা।
নব্যপ্রস্তর বা মেসোলিথিকযুগে পাথর-প্রযুক্তির আমূল পরিবর্তনে মানুষের নুড়ি পাথরের জন্যে শুধু নদীর ধারে বা পাহাড়ের কাছাকাছি থাকার দরকার হত না, বরং যে অঞ্চলে বেশি ফ্লিন্ট বা কোয়ার্জ পাথর পাওয়া যেত সেই সব অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল। নব্য প্রস্তর যুগের শেষ থেকেই শিকারী-সংগ্রাহী মানুষেরা চাষ-আবাদ এবং পশুপালনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছিল, তার সঙ্গে শুরু করেছিল আগুনে পুড়িয়ে মাটির নানান রকম পাত্র বানাতে।
প্যালিওলিথিক এবং মেসোলিথিক পর্যায়ের নিদর্শন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্রই পাওয়া গেছে। সুদূর উত্তর-পশ্চিমের সোয়াৎ নদীর অববাহিকা, পটোয়ার উপত্যকা থেকে মধ্যপ্রদেশের আদমগড়, গুজরাটের লঙ্ঘনাজ, রাজস্থানের সরাই নাহার রাই, উত্তরপ্রদেশের মহাদহ এবং বিহারে। একথাও মনে রাখা দরকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি বলেই, কোন অঞ্চলে যে মানুষের বসবাস ছিল না এমন ধারণা করার কোন অর্থ হয় না। কারণ যে যুগ যত আদিম ...
"ধর্মাধর্ম" গ্রন্থাকারে গুরুচণ্ডা৯ থেকে প্রকাশিত।
... সমাজ গঠনের সূত্রপাত, তার পিছনে “বিবাহ” নামক সামাজিক প্রথা ছাড়া আর কোনভাবেই সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। এই সামাজিক প্রথা সৃষ্টির পিছনে নিশ্চয়ই ছিল গভীর চিন্তা-ভাবনা, দীর্ঘ তর্ক-বিতর্ক এবং দূরদৃষ্টি। এই চিন্তা-ভাবনার পিছনে অবশ্যই ছিল মানুষের জিন ও মস্তিষ্কের অনন্যতা। আগুনকে রান্নার কাজে ব্যবহারের ফলস্বরূপ যার বিকাশ ঘটেছিল। তা নাহলে শিম্পাঞ্জি বা হাতিদের পারিবারিক দলগুলিও এতদিনে সমাজ-টমাজ গড়ে আমাদের সভ্যতার সঙ্গে টক্কর দিতে পারত। অতএব আমার কল্পনার ঘটনাগুলি যে ঘটেছিল, এ কথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।
তবে এখন আর কল্পনার প্রয়োজন নেই, কারণ আমরা যে পর্যায়ে চলে এসেছি, সে সময়ের প্রত্ননিদর্শনের খুব অভাব নেই। বরং বেশ কিছু স্থানে প্রত্ননিদর্শনের হদিশ জেনেও আমরা প্রত্ন-খনন করতে পারিনি, আর্থিক এবং রাষ্ট্র পরিচালকদের সদিচ্ছার অভাবে। অতএব এখন থেকে ইতিহাস চলবে তার ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে।
২.২.৬ গ্রাম থেকে জনপদঅখণ্ড ভারতের বালুচিস্তানের কোয়েতা অঞ্চলের মেহেরগড়ে নিওলিথিক যুগের বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে বেশ বড় একটি জনপদের প্রত্নতাত্ত্বিক হদিশ পাওয়া গেছে। এই জায়গাটির গুরুত্ব এই কারণে যে, পরবর্তী কয়েক হাজার বছরে মানুষের কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে নাগরিক সমাজে উত্তরণের পর্যায়গুলি এখানে সুস্পষ্ট ধরা পড়ে।
মেহেরগড় জনপদের শুরু মোটামুটি ৭০০০ বিসিই অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ন হাজার বছর আগে। মেহেরগড়ের মানুষরা প্রধানতঃ গম আর যবের চাষ করত। গরুবাছুর, ছাগল, ভেড়ার মতো কিছু পশুপালন করত। রোদে পোড়া ইঁটের বাড়িতে বাস করত এবং অধিকাংশ বাড়িতে রান্নার উনুন ছিল। কিছু কিছু কাঠামোকে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা শস্যভাণ্ডারের নিদর্শন বলে মনে করেন। মাটির নিচে বেশ কিছু সমাধি পাওয়া গেছে, সে সমাধিতে কিছু কিছু উৎসর্গ সামগ্রীও পাওয়া গেছে, যেমন লাপিস ও টারকোয়েজ
[4]-এর পুঁতির মালা এবং ছোটছোট কিছু মাটির মূর্তি।
মেহেরগড়ের কিছুটা উত্তর-পশ্চিমে মোটামুটি একই সময়ে শুরু হয়ে মোটামুটি সাত হাজার বছর আগেকার আরও কিছু জনপদের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেমন কিলে গুল মহম্মদ, রানা ঘুণ্ডাই, শেরি খান তারাকাই, গুমলা এবং রেহমান ঢেরি। এই জনপদগুলিতেও কৃষি এবং পশুচারণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই জনপদগুলির অবস্থান, পশ্চিমদিক থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করার যে সুপ্রাচীন স্থলপথ তার আশেপাশেই এবং সিন্ধু নদের অববাহিকার খুবই কাছে। সিন্ধু নদের অববাহিকায় আরও দুটি জনপদের নিদর্শন মিলেছে কোট দিজি আর আমরিতে। এই সবকটি জনপদকেই প্রাক-হরপ্পা সংস্কৃতির বাহক বলা চলে।
কোট দিজি থেকে মাটির পাত্রের যে নমুনা মিলেছে, তাতে রঙ দিয়ে আঁকা অশ্বত্থের পাতা, কিংবা মাছ বা মাছের আঁশের নকশা – হরপ্পা থেকে পাওয়া মাটির পাত্রের সঙ্গে তাদের মিল চোখে পড়ার মতো। কোট দিজির মতোই নকশাদার মাটির পাত্র পাওয়া গেছে রাজস্থানের সোথি এবং কালিবাংগান এলাকা থেকে। আরো পূর্বে হরিয়ানার কুনাল এবং বানাওয়ালি থেকেও একই রকমের নকশাকাটা মাটির পাত্র পাওয়া গেছে। আবার দক্ষিণে গুজরাটের ধোলাভিরাতেও, প্রাক-হরপ্পা জনপদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
আরাবল্লি পাহাড় আজও খনিজ তামার উৎস। তামা এবং তার সংকর ধাতুর উৎপাদনে ওই সময় গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল গানেশ্বর। সংকর ধাতু উৎপাদনে হরপ্পা সংস্কৃতির ছিল একাধিপত্য, অতএব আরাবল্লির পাহাড়ি এলাকা থেকেই সেখানে তামা ও অন্যান্য ধাতু সরবরাহ হত। ইতিমধ্যে এসে গেছে সোনা ও রূপো। রূপো আসত আরাবল্লী থেকে আর রাজস্থান ও গুজরাটের পাহাড়ি হিরণ্যগর্ভ অঞ্চল থেকে সোনা আসত তার লোভনীয় ঔজ্জ্বল্য নিয়ে।
সিন্ধু ছাড়াও হাকরা নদীর অববাহিকায় আধুনিক বাহাওয়ালপুর এবং চোলিস্তানের কাছে দুটি জনপদের সঙ্গে রাজস্থান ও পাঞ্জাবের বেশ কয়েকটি জনপদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সেই সময় হাকরা যথেষ্ট শক্তিশালী নদী থাকলেও পরের দিকে শুকিয়ে গিয়েছিল এবং গতিপথ পালটে পাঞ্জাবের ঘাঘর নদী হয়ে উঠেছিল।
অতএব সিন্ধু-হাকরা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা জনপদগুলির মধ্যে যে নিবিড় সংযোগ গড়ে উঠেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এক জনপদ থেকে অন্য জনপদে যাওয়া-আসার জন্যে জলপথে নদী এবং শাখানদীগুলি সহায়ক ছিল। আর ছিল সেই স্থলপথ – যে স্থলপথ দিয়েই সমস্ত মানব প্রজাতি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এবং পরবর্তীকালে হোমো স্যাপিয়েন্সরাও ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে। আরও পরবর্তী কালে ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্থান স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত, সোয়াৎ উপত্যকা হয়ে ওই স্থলপথই ছিল পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে আসা এবং যাওয়ার একমাত্র স্থল পথ। এই জনপদগুলির আন্তর্বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান এবং মৈত্রী-সম্পর্ক, কয়েক শ বছরের মধ্যে হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদরো-র মতো সুপরিকল্পিত নাগরিক সভ্যতা গড়ে ওঠার সহায়ক হয়েছিল। এর পিছনে পিতা পশুপতি বা পশুপতিদেব, মিত্তিকা বা দেবীমা এবং বিশ্ভাই বা বিশ্দেবের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।
চলবে...
(০৬/০৫/২০২২ তারিখে আসবে দ্বিতীয় পর্বের তৃতীয় অধ্যায়।)
গ্রন্থ ঋণঃ
১) The penguin history of Early India – Romila Thapar
২) Sapiens - A brief history of humankind – Yuval Noah Harari
৩)
https://www.harappa.com[1] এই ট্র্যাডিশন আজও চলছে। শহর ও শহরতলির আওতা ছাড়িয়ে একটু দূরের গ্রামে ঢুকলে আজও এমন দৃশ্য ভারতবর্ষের সর্বত্র চোখে পড়বে। দশ-বারো হাজার বছরে ভারতের গ্রামীণ সমাজে আহামরি তেমন পরিবর্তন ঘটে ওঠেনি। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুতের আলো কিংবা প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনা এই ধরনের মানুষদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তায় তেমন আলোকপাত করতে পারেনি। তবে একথাও সত্যি, স্বাধীন ভারতে এই শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে দু-একজন করিতকর্মা মানুষ বছর পাঁচেক কোন শাসক দলের সোনারকাঠির ছোঁয়া পেলে, কাঞ্চনপ্রভায় সমাজের চোখ ঝলসে দিয়ে থাকেন।
[2] পঙ্গপাল এক ধরনের ঘাসফড়িং। সাধারণতঃ এরা একা একাই থাকে এবং সে সময় এরা আদৌ বিপজ্জনক নয়। কিন্তু কোন কোন সময়, বিশেষতঃ দীর্ঘ খরার পর প্রচুর বৃষ্টির ফলে, শস্যক্ষেত্র যখন দ্রুত সবুজ হয়ে উঠতে থাকে, তখন এদের মস্তিষ্কে সিরোটিন নামে একটি হরমোনের ক্ষরণ হঠাৎ বেড়ে যায়। যার ফলে এই পতঙ্গের অসম্ভব দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটে এবং স্বাভাবিক চরিত্র বদলে এরা দলবদ্ধ হয়ে ওঠে। তখন দলবদ্ধ কোটি কোটি পতঙ্গের ঝাঁক মেঘের মতো উড়তে শুরু করে এবং যাযাবরের মতো স্থান পরিবর্তন করতে থাকে। সেই সময় এদের ওড়ার পথে যত শস্যক্ষেত্র পড়ে সেগুলিকে আক্ষরিক অর্থেই ধ্বংস করে দিয়ে যায়। সুপ্রাচীন কাল থেকে ভয়ংকর এই পতঙ্গের উল্লেখ বিশ্বের প্রায় সব প্রাচীন সভ্যতাতেই পাওয়া যায়। এই পতঙ্গকে নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে।
[3] আরেকবার মনে করিয়ে দিই, হোমোস্যাপিয়েন্স প্রজাতিকে আমি “মানুষ” বলে বর্ণনা করছি, এবং তাদের আগেকার প্রজাতিগুলিকে একত্রে “মানব” প্রজাতি বলছি।
[4] লাপিস ও টারকোয়েজ – লাপিস লাজুলি (Lapis Lazuli) বা সংক্ষেপে লাপিস হল গভীর নীলরঙের খনিজ পাথর আর টারকোয়েজ (Turquoise) হল নীলচে-সবুজ রঙের খনিজ পাথর – তামা বা অ্যালুমিনিয়ম ঘটিত ফসফেট যৌগ। এই দুই পাথরই সুন্দর রঙের জন্যে দামি পাথর হিসেবে অলংকারে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।