তুষারবাবু, লেখাটি আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমিও খুব আনন্দ পেলাম। তবে আরও ভালো লাগল, আপনার দীর্ঘ আলোচনার জন্যে। এবং একথা ঠিক, যেহেতু সিন্ধু সভ্যতা আমার শেষ লক্ষ্য নয়, অতএব এই প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত বিবরণই দিয়েছি। যার থেকে অন্ততঃ সে যুগের মানুষদের নিখুঁত নগর পরিকল্পনা, নিবিড় বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার সফল ও গভীর ভাবনা-চিন্তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। এবং নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে এই সভ্যতার অবসানে সিন্ধু সভ্যতার পড়শি ভারতীয় সমাজের মানুষদের মনে কি কি প্রতিক্রিয়া ঘটে থাকতে পারে, সেটাও একটু আন্দাজ করার জন্যে।
সে যাই হোক, আপনার আলোচনায়, কয়েকটি বিষয়ে আমার দ্বিধার কথাও আমি সবিনয়ে জানাইঃ –
১। সব বাড়ি পোড়া ইঁটের হত – এমন কথা আমি লিখিনি – আমি লিখেছি, “সমস্ত বাড়িগুলিই বানানো হত, রোদে-শুকোনো ইঁটে, যাকে আমরা আমা-ইঁট বলে থাকি”। পোড়া ইঁটে যে রাস্তা, বাঁধানো নর্দমা বানানো হত, সে কথাও বলেছি।
২। সব ইঁটের এক মাপ বলিনি, লিখেছি “এই সভ্যতায় ব্যবহার করা যত ইঁট পাওয়া গেছে, এই পরিমাপ অনুযায়ী তাদের ছিল সুনির্দিষ্ট আকার।
৩। নগরের পশ্চিমদিক উঁচু এবং পূর্বদিক নিচু রাখা হত এটা আমি জানতাম না, লিখিওনি। অফিস পাড়া এবং কাজের পাড়াগুলি পূর্বদিকে রাখা হত, সেটা লিখেছি। সেটার যুক্তিতে আমার অনুমান দিবালোকের পূর্ণ ব্যবহারের কথা লিখেছি। আমাদের সমাজে বিদ্যুত আসার আগে, রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া এবং ভোরে উঠে কাজের যোগাড় শুরু করার প্রচলন গ্রামাঞ্চলে আমাদের ছোটবেলাতেও দেখেছি। আর পূর্বদিকের বাড়িতে কাজ করার মতো উত্তর বা দক্ষিণের আলো থাকবে না – এমন আমার মনে হয় না। [এ প্রসঙ্গে বাস্তুবিদ্যার কথা না বললেও চলত, কিন্তু আজকাল পাড়ায় পাড়ায় এত বাস্তুবিদ-বাস্তুসংস্কারক, নানান বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ব্যবসা করে চলেছেন, তাই ভয় হয়। এটাকে কেউ বাস্তুবিদ্যা না ভেবে বসেন।]
৪। শস্যাগার – মার্টিমার হুইলার (তাঁর লেখা পড়ার সুযোগ আমার ঘটেনি) বলুন বা না বলুন শহরের এতগুলি অধিবাসী (প্রায় বিশ-পঁচিশ হাজার) এবং দূর দেশ থাকা আসা অতিথি বণিকদের খাদ্য সংস্থানের জন্যে প্রত্যহ সকালে বাজার-সরকার বাজারে যেতেন, এটা মানতে পারলাম না। কোন ঘরের কোনে প্রায় চার-পাঁচহাজার বছরের পুরোনো যব বা গমের জীবাশ্ম মেলেনি বলেই শস্যগার ছিল না, এ যুক্তিও মানতে আমার দ্বিধা আছে। মানুষ সিন্ধু সভ্যতার শহরগুলি ছেড়ে এসেছিল, কিন্তু পিঁপড়ে, কীট-পতঙ্গ শহর ছেড়ে দিয়েছিল এমন ভাবা যায় না। অতএব কোন রকম প্রত্যক্ষ প্রমাণ না পেলেও, circumstantial evidence থেকে অনুমান করা যায়, শস্যাগার নিশ্চিতভাবেই ছিল।
৫। প্রাসাদ বলতে আমি মাইশোর প্যালেস বা আমাদের কলকাতার মার্বেল প্যালেসের তুল্য কোন বাড়ি বোঝাতে চাইনি অবশ্যই। প্রাসাদ বলতে পরিবার, পরিজন, অনেক দাসদাসী, খিদমদগার একত্রে থাকার মতো আলাদা ধরনের building clusters বোঝাতে চেয়েছি।
৬। আধুনিক যুগের মতো খাঁটি তামা, টিন বা ব্রোঞ্জ তারা বানাতে শেখেনি, তাদের সীমিত প্রযুক্তি দিয়ে তেমন করা সম্ভবও ছিল না, একথা বলাই বাহুল্য। প্রসঙ্গতঃ বলি, ব্রোঞ্জ আবিষ্কারের দেড়-দু হাজার বছরের মধ্যে লোহার ব্যবহার শিখে যাওয়ায় ব্রোঞ্জের সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সে জায়গাটি অধিকার করেছিল লোহা। আর আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও ব্রোঞ্জ ও তামার ব্যাপক ব্যবহার প্রচলিত ছিল বাসন-কোসন ও অজস্র অপূর্ব মূর্তি রচনায়। আজও তাম্রকুণ্ড, তামার কোশাকুশি, তামা বা কাঁসার ঘট, ইত্যাদি গৃহস্থ পূজার আবশ্যিক তৈজসপত্র।
৭। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাক-আর্য মানুষরা শান্তিতেই বসবাস করত, এটা সবটাই আমার কল্পনা - এমন নয়। সমগ্র ভারতে এই পর্যায়ে অজস্র নিওলিথিক এবং চ্যালকোলিথিক সংস্কৃতির সমাজের প্রত্ন নিদর্শনে পাওয়া অজস্র সমাধির মধ্যে গণসমাধি নেই বললেই চলে। অন্ততঃ এমন গণসমাধি যার মৃতদেহের অবশেষ থেকে ধারণা করা যায় মানুষগুলির মৃত্যুর কারণ যুদ্ধ বা লড়াইজনিত আঘাত বা মুণ্ডচ্ছেদ। প্রসঙ্গতঃ বলি, সিন্ধু সভ্যতার অবসানের অততঃ সাত-আটশ বছর পরের ঘটনা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র ছিল, তীর - ধনুক, গদা – অসি বা তলোয়ারের উল্লেখ যা আছে তা খুবই গৌণ।
অতএব যুদ্ধ মানেই তলোয়ারের এক কোপে গলা কাটতে হবে, তখনও পর্যন্ত এমন ধারণা তৈরি হয়নি। বরং তীরে বিদ্ধ হয়েই ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ প্রমুখের মৃত্যু ঘটেছিল। এর আগের যুগে পরশুরামের অস্ত্র ছিল – পরশু অর্থাৎ কুড়ুল। ভগবান কৃষ্ণের দাদা বলরামের অস্ত্র ছিল হল – অর্থাৎ লাঙল এবং গদা। তিনি ভীম ও দুর্যোধনকে গদা চালনা শিক্ষা দিয়েছিলেন। ভগবান কৃষ্ণের অস্ত্রটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক – সুদর্শন চক্র, যে অস্ত্র আর কাউকেই কোনদিন ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। অর্জুন, কর্ণ, একলব্য ছিলেন ধুরন্ধর তীরন্দাজ আর ভীম ও দুর্যোধন ছিলেন গদা চালনায় সিদ্ধহস্ত। আরও পরবর্তীকালে ভারতে তলোয়ার, খড়্গ-র প্রচলন এবং জনপ্রিয়তা বেড়েছিল হয়তো গ্রীক ও পারস্য সভ্যতার সংস্পর্শে।
অতএব, ঘচাং করে গলা কাটতে না পারলেও যুদ্ধ হত, যুদ্ধে নিহতও হত বিস্তর, সমসাময়িক বিশ্বে এমন ঘটনার প্রত্ন নিদর্শন প্রচুর পাওয়া গেছে। আসলে যুদ্ধ বা লড়াই করে গণহত্যা করা বিশেষ এক মানসিকতার ব্যাপার, অস্ত্র সেখানে উপকরণ মাত্র।
শেষে আবারও বলি, আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ রইলাম, আপনি এক কথায় ভালো লেগেছে বলে দায় না সেরে, আপনার দীর্ঘ মতামত জানিয়েছেন। অতএব আমাকেও আমার লেখাটি আবার খুঁটিয়ে পড়তে হল, এবং তথ্য সংগ্রহ করেছি যে গ্রন্থ বা ওয়েবসাইটগুলিতে - সেখানেও ঢুকতে হল। সত্যি বলতে, আপনি কাল রাতে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন, মশাই!
আরেকবার অজস্র ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।