১.৬.১ কনে দেখার আলো
এমন উৎসব, এমন অনুষ্ঠানের আয়োজন এই পৃথিবীতে প্রথম। অন্য কোন প্রাণী তো বটেই, সকল মানব প্রজাতিতেও এমন অনুষ্ঠানের কথা কোনদিন কেউ ভাবেওনি। আলাদা দুই পারিবারিক দলের মিলনের অনুষ্ঠান। যার কেন্দ্রে রয়েছে, পিতা পশুপতির পরিবারের নয়নমণি দুই কন্যা, আর মিত্তিকার পরিবারের দুই তরুণ
শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিনে ওরা এল, সকাল-সকাল। বিহি, হানো আর মিত্তিকাকে নিয়ে দশজন মেয়ে-পুরুষ। সকলের মাথায় রঙিন পালকের মুকুট। বিহি আর হানোর মুকুটদুটোই বেশি জমকালো। তাদের দুজনের গায়ে হরিণের উজ্জ্বল চামড়া। পরনে লম্বা পাতার ঝালর। তাদের কোমরে রয়েছে সাপের হাড় দিয়ে গাঁথা মালা, তার মাঝখানে সাপের ত্রিভুজ খুলি। গলায় সরু লতায় গাঁথা রঙিন সুগন্ধী ফুলের মালা। ওদের সঙ্গের মেয়েপুরুষেরাও সুন্দর সেজেছে। তবে মিত্তিকা তেমন সাজেননি, অন্যদিনের মতোই তাঁর পোষাক, গায়ে ছাগলের চামড়া আর পরনে পাতার ঝালর। সকলের হাতেই বল্লম আর কাঁধে সরু লতা আর পাতা দিয়ে বানানো ঝোলা। এই দলের অঙ্গনে এসে ঝোলা উজাড় করে তারা ঢেলে দিল, তাদের উপহার – প্রচুর ফল, বাদাম, শস্যের দানা, বুনো আলু। বেশ কিছু লেবু। ও দলের এক মহিলা বলল, “খাবার জলে দু একফোঁটা লেবুর রস, ঝলসানো মাংসেও একটু লেবুর রস মাখালে, দেখবেন স্বাদ আর গন্ধ কেমন বদলে যায়”। ইতিহাসের প্রথম বরযাত্রী।
"ধর্মাধর্ম" গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। প্রকাশক - গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশন।
...ফল সরিয়ে রাখলেন, শুধু জল খেলেন, তারপর বললেন, “তবে তাই হোক, বাবা, আমিও উপবাসে থাকব। আমিও শুদ্ধ চিত্তে আপনার দুই কন্যাকে গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত হই। আমাদের পরিবারে ওদের সসম্মান প্রতিষ্ঠা করাই হোক আমার একমাত্র ব্রত”। কথা বলতে আবেগে তাঁর গলা কেঁপে উঠল। পিতা পশুপতি মিত্তিকার মাথায় হাত রেখে বললেন, “মঙ্গল হোক মা, তোদের, আমাদের এবং সবার আগে ওই দুই নবীন যুগলের”।
সকলের খাওয়া সাঙ্গ হলে, এ দলের মহিলারা নানান কাজের মধ্যেও বারবার আসছিলেন সকলের সঙ্গে আলাপ করতে। ছোট ছেলেমেয়েরাও ছোট ছোট পোষাকে আর ফুলের সাজে আজ বড়ো সুন্দর হয়ে উঠেছে। আজ বরপক্ষকে ঘিরে তারা খুবই চঞ্চল, উত্তেজিত এবং দুরন্ত। পিতা পশুপতি এবং তাদের মায়েরা মাঝেমাঝেই বকাবকি করছিলেন, মিত্তিকা বললেন, “ওদের আনন্দে বাধা দেবেন না, বাবা। এমন আনন্দের অনুষ্ঠান ওরা কোনদিন দেখেনি যে! আমারই ইচ্ছে হচ্ছে, ওদের মতো দুরন্তপনা করতে, পারি না বুড়ি হয়ে গেছি বড্ডো”!
পিতা পশুপতি কিছু বললেন না, শুধু হাসলেন। মিত্তিকা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা সবাইকে দেখতে পাচ্ছি, ঊষি আর ইশিকে দেখছি না তো? ওরা আজও কি জঙ্গলে গেছে?”
পিতা পশুপতি শান্ত হাসলেন, বললেন, “আজ ওদের জঙ্গলে যেতে দিইনি। জঙ্গলে গিয়ে কোন বিপদ আপদ ঘটলে – না, না, তাই কি হয়? ওরা কোথাও যায়নি, ওই ঘরে রয়েছে। ওদের আমি ঘরের মধ্যেই থাকতে বলেছি, বাইরেও আসবে না। এত কাছে থেকেও, এতক্ষণের অদেখায় ওরা চারজনেই অধীর হয়ে উঠুক। তবেই না ওদের মিলন হবে রোমাঞ্চকর!” মিত্তিকা পিতা পশুপতির কথায় আরও আশ্চর্য হলেন। তাঁর মনের মধ্যেও অদ্ভূত এক অনুভব সঞ্চারিত হল, দুচোখ তাঁর ভরে উঠল অশ্রুতে। তিনি নত মস্তকে পিতা পশুপতির চরণ স্পর্শ করলেন, অস্ফুট স্বরে বললেন, “আপনার দেখানো পথেই আমি যেন বাকি জীবন চলতে পারি, বাবা। আপনার সহায় রয়েছেন আপনার পাথর-আত্মা, আর আমার রইলেন আপনি”।
দুপুরে জঙ্গল থেকে সকলে শিকার ও সংগ্রহ সেরে ফিরে এল। ঊষির বাবা হাসিমুখে, মিত্তিকাকে জোড়হাতে নমস্কার করল, তারপর পিতা পশুপতিকে বলল, “বিহি আর হানোর জন্যে আজ আমরা পেয়ে গেছি, মস্ত দুটো শুয়োর। মিত্তিকাদিদি, আপনাদের বল্লমের তাকৎ সত্যিই দেখার মতো। আমার হাতের বল্লমটাই ফুঁড়ে দিয়েছিল, প্রথম শুয়োরটার কলজে। ওই এক আঘাতেই সে শেষ। যাক আপনাদের জন্যে যোগাড় হয়ে আছে গতকালের একটা হরিণ আর আজকের এই দুটো শুয়োর। আশা করি ভোজ দারুণ জমে উঠবে”।
পিতা পশুপতি বললেন, “এ সবই তাঁর কৃপা”। তা না হলে, তিনি ভাবলেন, কী ভাবে ঘটে চলেছে এমন সাবলীল আনন্দের আয়োজন?”
ভোজ একটা জমল বটে – মহাভোজ। এত হৈচৈ আনন্দ-হাসি আর পর্যাপ্ত আহারে সকলেরই গুরুভোজন হয়ে উঠল। তাও উদ্বৃত্ত হল প্রচুর খাদ্য। পিতা পশুপতি নিজে কিছুই আহার করলেন না, কিন্তু সকলের সঙ্গে বসে সকলের আহারের দিকেই লক্ষ্য রাখছিলেন, তাঁর পাশেই বসে ছিলেন উপবাসী মিত্তিকা। অপরিমিত আহারে তৃপ্ত সকলের মধ্যে বসে নিজের উপবাসী সংযমের শুদ্ধতা এই প্রথম তিনি অনুভব করলেন। এই আনন্দ উপভোগ করতে করতে তিনি মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালেন পিতা পশুপতিকে। মানুষটি এই ক’মাসে শুধু তাঁকে নয়, তাঁর পুরো দলটিকে প্রভাবিত করেছেন। বদলে দিতে পেরেছেন তাঁর দলেরও প্রত্যেকটি মানুষের ভাবনা-চিন্তা। দু দলের সকলেই অনুভব করছে নতুন এই যৌথ জীবনের তাৎপর্য। দুই দলেরই প্রতিটি মানুষ পিতা পশুপতির প্রতি শ্রদ্ধায় আজ অভিভূত। আমরা এই শ্রদ্ধা ও পরম নির্ভরতাকেই, পরবর্তী কালে নাম দিয়েছি “ভক্তি”। পিতা পশুপতির প্রতি একান্ত ভক্তিতে, মিত্তিকার দুচোখে বারবার ভরে উঠছিল অশ্রু, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল তাঁর দৃষ্টি।
গুরুভোজনের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম - কিছুটা অলস গল্প-গুজব। ও দলের মহিলা-পুরুষদের সঙ্গে এ দলের মহিলা-পুরুষদের আলাপ। মায়েদের পেছনে বসে কৌতূহলী কিশোরীরা এবং বালিকারা। ওদের সঙ্গেই বালক এবং কিশোরেরা। মিত্তিকা তাদের মধ্যমণি। বিহি আর হানো আজ বড় শান্ত, কিছুটা অন্যমনস্ক। তারা সকলের সঙ্গেই রয়েছে, কিন্তু নিজেদের কিছুটা যেন সরিয়ে রেখেছে অন্য কোথাও।
পিতা পশুপতি স্মিত মুখে লক্ষ্য করছেন ওদের আর মাঝে মাঝে মুখ তুলে তাকাচ্ছেন, বিকেলের নিস্তাপ রোদ্দুরে উজ্জ্বল পাথর-আত্মার দিকে।
"ধর্মাধর্ম" গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। প্রকাশক - গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশন।
... তাদের ডেকে নিলেন, সম্প্রদান মঞ্চের মাঝখানে। তাঁর বাঁদিকে দুজনকে দাঁড় করালেন পূর্বমুখ করে, তাদের পিছনে রইল অস্তগামী সূর্য। এদিকে বোনেদের সঙ্গে দুই মেয়েও চলে এল সলজ্জ ভীরুপায়ে। ছটফটে, চঞ্চল, গাছে চড়া এবং শিকারে দক্ষ দুই মেয়ের এমন সলজ্জ ভীরু হাঁটা! পিতা পশুপতি, মিত্তিকা এবং দুই মেয়ের বাবা-মা, গুরুজন সকলেই মুগ্ধ হলেন, তাঁদের সপ্রতিভ দুই কন্যার এমন রূপান্তরে। সকলেই অনুভব করলেন, কন্যাদের বাসর গমনের মাধুর্য।
পিতা পশুপতি দুই মেয়েকে দাঁড় করালেন তাঁর ডানদিকে। তারপর ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর বাঁ হাত রাখলেন দুই ছেলের কাঁধে আর ডান হাত রাখলেন দুই কন্যার কাঁধে। তাঁর দীর্ঘ আলিঙ্গনেই যেন আবদ্ধ হল ওরা চারজন। তারপর চোখ বন্ধ করে পিতা পশুপতি উচ্চ উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, “হে পিতা আজ এই অস্তগামী সূর্যকে সাক্ষী রেখে এবং তোমার অনুমতি নিয়ে মিত্তিকার দুই পুত্রের হাতে আমাদের পরিবারের এই দুই কন্যাকে সম্প্রদান করছি এবং ওদের দুই যুগলের মিলন-যজন করছি”।
গোধূলি লগ্নের এই কনে দেখা আলোয় সেদিনের এই সরল অনুষ্ঠান, বহুদিন পরে আরো বহুবিধ জটিল প্রক্রিয়ায় হয়ে উঠেছিল বিবাহ, পরিণয়, মালাবদল। পরবর্তীকালে বিবাহিত দম্পতির বিভিন্ন সংস্কৃতিতে নাম হয়েছিল, পতি-পত্নী, স্বামী-স্ত্রী, মাগ-ভাতার। আধুনিক সভ্য সমাজের উচ্চস্তরে বলা হয়, হাজব্যান্ড-ওয়াইফ। হাবি-বেবি।
১.৬.২ হরিষে বিষাদ
অনুষ্ঠান শেষে পিতা পশুপতির সেজ এবং ছোট কন্যা ওঁনার এবং মিত্তিকার জন্যে খাবার নিয়ে এল। ছোট মেয়ে বলল, “এবার কিছু মুখে দাও তোমরা, সারাদিন উপবাসে রয়েছ”। ওরা কলাপাতায় সাজিয়ে এনেছে কিছু ফল, সেদ্ধ করা বুনো আলু আর অনেকটা হরিণের মাংস। পিতা পশুপতি মৃদু হেসে বললেন, “এই বয়সে এই অবেলায়, অত কিছু খাব না, মা। মাংসটা তুলে নে, ফল আর সেদ্ধ আলুটা থাক। কলা আছে, থাকলে দুটো দে না। মিত্তিকাকেও দিস”। পিতা পশুপতি ফল খাওয়া শুরু করতে, মিত্তিকাও খাওয়া শুরু করলেন। খেতে খেতে ওঁরা দেখলেন, সম্প্রদান-মঞ্চ খুলে ফেলা হয়েছে। আকাশের নিচে, মুক্ত অঙ্গনে সকলের বসার জায়গা করা হয়েছে। তার চারদিকের খুঁটিতে জ্বলছে চর্বির মশাল। সন্ধে গড়িয়ে রাত্রি যত এগোচ্ছে বাতাস স্নিগ্ধ হচ্ছে তত। আর মশালের আলোয় ততই জমে উঠছে দুই পরিবারের গল্প-গুজব আর আড্ডার আনন্দ। অন্যদিন ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুমোনোর জন্যে মা-মাসিদের বিরক্ত করে, আজ ওদের চোখেও ঘুমের কোন লেশ নেই, ছুটোছুটি আর মহানন্দে খেলা করে বেড়াচ্ছে উঠোন জুড়ে।
মিত্তিকা খেতে খেতে বললেন, “কয়েকমাস আগেও কী আমরা একসঙ্গে এমন আনন্দ করার কথা কল্পনা করেছিলাম, বাবা? সবটাই ঘটে গেল স্বপ্নের মতো। আপনার এই উদ্যোগ আমাদের অনেক দূর এগিয়ে দেবে, দেখবেন”।
“আমার নয় মা, এ উদ্যোগ তোর। তুইই তো কন্যা গ্রহণের প্রস্তাব এনেছিলি”।
“তা ঠিক। কিন্তু আপনি যদি আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে, সেই প্রথম দিন না যেতেন, তাহলে আমি এই প্রস্তাব কার কাছে করতাম, বাবা? আমাদের দলের প্রতি আপনার সেই দিনের সহানুভূতি এবং সেই তিরষ্কার – আমাদের সবার – বিশেষ করে আমার, বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল যে। আমাদের এতদিনের পারিবারিক বিশ্বাস, সংস্কার আর অহংকার, আপনার ওই আশ্চর্য শান্ত আঘাতে ভেঙে পড়েছিল, পোকাধরা বিশাল গাছের মতো। আমার বাবা ভয় পেয়েছিলেন, আর আমি ভরসা...।
"ধর্মাধর্ম" গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। প্রকাশক - গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশন।
... উঠে দাঁড়িয়ে পিতা পশুপতির মাথায় হাত রেখে, তাঁর সাদা চুলের মধ্যে আঙুলের বিলি কাটতে কাটতে ইশারায় ছেলেমেয়েদের দল থেকে ঊষি আর ইশিকে ডাকলেন। ওরা এতক্ষণ গল্প-গুজবে মগ্ন ছিল, এদিকে লক্ষ্য করেনি, উদ্বেগে দুই মেয়েই দৌড়ে এল। তাদের পিছনে অন্য সবাই। মিত্তিকা কথা বলতে নিষেধ করলেন সবাইকে।
পিতা পশুপতি একই ভাবে বসে আরও বলছিলেন, “সেই মেয়েরা বড়ো হল, ছটফটে দুরন্ত কিশোরী, আর আমি বৃদ্ধ হলাম। এখন ওরা জঙ্গল থেকে ফিরে এসে রোজ - প্রত্যেক দিন - দুই বোন দুটি করে ফল আলাদা করে রাখত আমার জন্যে। এসে বলত, “বড়োবাবা, দেখ তো মিষ্টি কিনা?” পাকা বুড়ি যেন। তারপর সারাদিন কত কাজ করত আর ঘুর ঘুর করে আমার কাছে এসে বসত বারবার। কত কথা। কত গল্প। কী শক্তপোক্ত আর পাথরের মত কঠিন মানুষ ছিলাম আমি। ওদের আদরে আর ভালোবাসায় নরম হয়ে গেছি, কাদা হয়ে গেছি একেবারে... কিন্তু কাল... কাল থেকে আমি কী করব?” ঊষি আর ইশি এবার জড়িয়ে ধরল তাদের বড়োবাবাকে, তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুমিই তো আমাদের তাড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করলে, বড়োবাবা, কেন করলে?”
আচমকা দুই মেয়ের স্পর্শে পিতা পশুপতি সংযম হারালেন, তিনিও উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, “ভুল করেছি মা, ভুল করেছি। তখন তো এভাবে বুঝিনি, পাঁজর ভেঙে দিয়ে সত্যি সত্যি তোরা চলে যাবি...কতদূরে...কবে আর দেখা পাবো কে জানে, মা?”
বৃদ্ধকে জড়িয়ে দুই কিশোরী কন্যার এই কান্নার দৃশ্য উপস্থিত সকলের চোখেই জল এনে দিল। মেয়েদের বাবা-মা, পরিবারের সকলেই এখন কাঁদছে। কাঁদছে ছোট ছেলে মেয়েরাও।
সারাদিনের এত আনন্দ ও হাসির আড়ালে যে লুকিয়ে আছে এমন কান্না – একথা এতদিন কেউই জানত না। আজ প্রথমবার সকলেই বুঝছে সম্প্রদানের হর্ষের মধ্যেই থাকে কন্যা-বিদায়ের বিষাদ।
এতক্ষণ যা কিছু বললাম সবই আমার অনুমান – আমার কল্পনা। এই মানুষগুলি কোন ভাষায় কথা বলতো, তার কোন হদিশই আমাদের জানার কোন উপায় নেই। এমন ঘটনা ঠিক কবে শুরু হয়েছিল, তারও কোন প্রমাণ আজ আর কোথাও আমরা খুঁজে পাবো না। তবু একথা নিশ্চিত, এভাবেই বিচ্ছিন্ন মানুষের গোষ্টীগুলির মধ্যে সংযোগের সূচনা হয়েছিল। তার কেন্দ্রে অবশ্যই ছিল বিবাহের বন্ধন এবং আন্তঃপারিবারিক প্রজনন সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ। আর বিভিন্ন দল একত্র হয়ে যৌথ পথ চলা দিয়েই গড়ে উঠেছিল নিবিড় সমাজ। অবিশ্যি সফল একটি সমাজের সম্পূর্ণ রূপ পেতে কেটে গিয়েছিল অনেক অনেক হাজার বছর। সে কথায় এর পরের অধ্যায়েই আসছি।
১.৬.৪ পুজো-মানত-ব্রত
এরপর আমরা এগিয়ে যাবো আর হাজার পঁচিশেক বছর পরে, অর্থাৎ আজ থেকে পনের হাজার বছর আগের কোন এক সময়। দেখা যাক, পিতা পশুপতি এবং মিত্তিকার দুই পরিবার যৌথভাবে যে সামাজিক দিক্বদলের পথে হাঁটা শুরু করেছিল, তার ফলাফল কী দাঁড়াল।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সময়েই পৃথিবীর অন্তিম তুষারযুগ শেষ হয়ে এসেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাণীজগতে তুষার যুগের তেমন উল্লেখযোগ্য প্রভাব না থাকলেও, তুষার যুগের শেষে প্রকৃতিতে জলহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছিল দ্রুত। হিমবাহ গলে সমুদ্রের জলস্তর ফিরে আসছিল তার স্বাভাবিক উচ্চতায়। এতদিনের ক্ষীণধারা নদীগুলি, হিমবাহ গলা জলে স্রোতস্বিনী হয়ে উঠছিল। নদীর অববাহিকাগুলি হয়ে উঠছিল সরস, এবং উঠে আসছিল ভূগর্ভস্থ জলস্তর। সুদীর্ঘ ষাট হাজার বছরের রুক্ষ তুষার যুগের অন্তে, গাছপালা, ঝোপঝাড়, তৃণক্ষেত্রে দেখা দিল নতুন প্রাণের জোয়ার। তুষার যুগে জলস্তর নিচে চলে যাওয়ায়, বাতাসের আর্দ্রতা কমে গিয়েছিল বিস্তর, তার ফলে কমে গিয়েছিল বৃষ্টির পরিমাণ। এখন উষ্ণায়নে আকাশে আবার দেখা দিল জল ভরা মেঘ, বৃষ্টিতে স্নান করে তৃপ্ত হল মাটি। তৃণভূমি, অরণ্য, প্রান্তর হয়ে উঠতে লাগল গভীর সবুজ। উর্বর মাটিতে মিশে থাকা শস্য দানা, হঠাৎ যেন প্রাণ পেয়ে নিবিড় সবুজ করে তুলল নদীর দুই পাড়। স্বাভাবিক ভাবেই তৃণভোজী প্রাণীরাও স্বস্তি পেল, স্বস্তি পেল তাদের ওপর নির্ভর করে থাকা মাংসাশী প্রাণী এবং মানুষও।
পরিবেশের এই পরিবর্তন মানুষের চোখ এড়াল না, বরং তারা এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত হতে থাকল দ্রুত।
খুব স্বাভাবিক।..
"ধর্মাধর্ম" গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। প্রকাশক - গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশন।
তার কারণ দুই পরিবারের বয়স্ক মানুষরা এই সমস্যাটিকে এড়িয়ে যান। প্রথমতঃ পশুপতিদেব এবং মাতৃদেবীর সামনে, সূর্য সাক্ষী করা বিয়ে কী ভেঙে ফেলা যায়? এই ঘটনার থেকে যদি দুই দলের মৈত্রী নষ্ট হয়ে, কোনভাবে বৈরীতা সৃষ্টি হয়, সেটা কোন দলের পক্ষেই মঙ্গলজনক হবে না। অতএব দু দলের সকলেই উদাসীন থাকাই শ্রেয় মনে করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, দুটি গ্রামের সমস্ত মানুষের মঙ্গলের জন্যে একটি ব্যক্তিকে উৎসর্গ করাই যায়।
১.৬.৫ পায়ের তলায় শিকড়
শিকারী-সংগ্রাহী জীবনের সরলতা তাদের জীবনে এখন আর নেই। শিকারী-সংগ্রাহী মানুষ আগেকার দিনে যে কোনদিন, যে কোনসময়ে বেরিয়ে পড়তে পারত নতুন চারণক্ষেত্র এবং তৃণভূমির খোঁজে। আগেকার দিনে, একটি দলের সকলেই ছিল একই পরিবারের একই রক্তসম্পর্কিত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। সে সময় পরিবারের দলনেতা অর্থাৎ পিতামহ বা পিতা বেরিয়ে পড়তে চাইলে,
কিছুতেই বনিবনা হয় না। যার ফলে পরিবারের নিবিড় বন্ধন আজকাল কিছুটা যেন আলগা। অতএব শিকারী-সংগ্রাহী মানুষদের পায়ের নিচে গজিয়ে উঠতে লাগল শিকড়।
ঙে করে আটা। চোদ্দটি এলাকার চোদ্দটি দলের সহযোগিতায় খাদ্য সংগ্রহে অসুবিধে হয় না খুব।
তাছাড়া তারা আজকাল আরও যেটা শিখেছে সেটা হল বড়শিকার বা গণশিকার। সবকটি দলের সেরা শিকারীদের যৌথ দল বানিয়ে তারা শিকারে বেরোয়। সে দলে থাকে দারুণ দক্ষ আর চটপটে অভিজ্ঞ শিকারীরা - পঞ্চাশ-ষাট জন তো বটেই। সে দলে মেয়েদের বড় একটা নেওয়া হয় না, মেয়েরা আজকাল ব্যস্ত থাকে ঘরের কাজেই। এরকম দল তারা বানিয়ে তোলে, হাতির দলের সন্ধান পেলে অথবা বাইসন কিংবা নীলগাইয়ের দল। শিকারের কথা সবার কাছে পৌঁছে যায় ঢাকের আওয়াজের সংকেতে। ঠিক সময় মতো, সঠিক জঙ্গলে তারা পৌঁছে যায় সবাই।
অতএব প্রতি বছরের নিয়মিত পরিযায়ী জীবন ছেড়ে আদিম মানুষ এখন হয়ে উঠছে গ্রামবাসী। তাদের ঘরবাড়ি-বাসা এখন আর আগের মতো অস্থায়ী নয়। কাঠের কাঠামো আর মাটির দেওয়াল, বড়ো পাতা, লম্বা লম্বা শুকনো ঘাসের ছাউনি দিয়ে তারা মোটামুটি পোক্ত বাড়ি বানাতে শিখে গেছে। শিকারী-সংগ্রাহীদের যাযাবর জীবন এখন ধীরে ধীরে গৃহস্থী হয়ে উঠছে। এতদিনের যে জীবনযাত্রায় তাদের ছিল ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা, সারল্য এবং কঠোর বাস্তবতা, এখন তাদের জীবনে আসছে কিছু কিছু বিলাসিতা, কিছু আড়ম্বর এবং কিছু কিছু শিল্পকলাও!
১.৬.৬ আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা
এবারে হেমন্তের শুরুতে নদীর দু’ধারেই বিস্তীর্ণ জমিতে শস্য হয়েছে দেখার মতো। এতদিন ছিল নিবিড় সবুজ, শীতের শেষ থেকে তাতে রং ধরল সোনালী। তারপর বসন্তের মাতাল হাওয়ায় সোনালী স্বপ্নের মতো দুলতে লাগল বুনো গম এবং যবের শিষ। নদীর দুই পাড়ের দু’দলের মানুষই প্রস্তুত ছিল, তারা নিজেদের এলাকার সমস্ত শস্য, তুলে আনল নিজেদের গ্রামে। তাদের মাটির জালা উপচে উঠল। রাতারাতি তাদের বানিয়ে তুলতে হল
"ধর্মাধর্ম" গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। প্রকাশক - গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশন।
তাদের চোখের দৃষ্টি আর তাদের লেজের আস্ফালনে - কৃতজ্ঞতার ভাষা বুঝতে ভুল করল না মানুষ। সে আর একটু এগিয়ে গিয়ে হাত রাখল একটি কুকুরের মাথায়, একটু আদর করল। কুকুরের দল মুগ্ধ কৃতজ্ঞতায় মানুষটির সামনে বসে পড়ল পিছনের পায়ে ভর দিয়ে। সেই দিন থেকেই গড়ে উঠল মানুষ আর কুকুরের অনবদ্য এক সম্পর্ক। মানুষের ইতিহাসে এই প্রথম মানুষের সঙ্গে অমানুষ এক প্রাণীর আন্তরিক সখ্যতা গড়ে উঠল।
কিছুদিনের মধ্যেই কুকুর এবং মানুষের পারষ্পরিক বোঝাপড়া এমনই সাবলীল হয়ে উঠল, দুজনেই দুজনকে নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে লাগল। আজকাল দিনের বেলা কিংবা রাত্রেও সমস্ত গ্রাম পাহারা দেয় কুকুরের দল। যে কোন বড়সড়ো প্রাণী কিংবা অচেনা কোন মানুষ এলেই তীব্র চিৎকারে সকলকে সতর্ক করে দেয়। জঙ্গলের পথে একসঙ্গে চলার সময়ও কুকুর অনেক আগেই বিপদের গন্ধ পায়, তার আচরণ এবং ডাকে সতর্ক হওয়া যায় নিরাপদ দূরত্ব থেকেই। এর পর শিকারের সময়েও কুকুর হয়ে উঠল মানুষের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী।
আজ থেকে প্রায় চোদ্দ হাজার বছর আগে কুকুরই মানুষের প্রথম গৃহপালিত প্রাণী হয়ে উঠল। এর পরবর্তী সময়ে মানুষ আরও অনেক পশু ও পাখিকে গৃহপালিত করতে পারলেও, কুকুর ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর সঙ্গে তার এমন নিবিড় নির্ভরতার সখ্য গড়ে ওঠেনি।
একবার শিকারে গিয়ে বুনো ছাগলের বেশ বড় একটা দলকে শিকার করা গেল। তাদের মধ্যে মদ্দা আর মাদীগুলোকে বয়ে আনার সুবিধের জন্যে মেরে ফেলা হয়েছিল। ওই দলে বেশ কিছু ছাগলছানাও ছিল, সেগুলোর কথা মানুষগুলো ভাবেইনি। শিকারীদল যখন জঙ্গলের পথে কাঁধে মরা ছাগল নিয়ে গ্রামে ফিরছিল, ছাগলছানাগুলোও তাদের সঙ্গ নিল। তারা হয়তো বোঝেনি, তাদের মায়েদের পরিণতি, কিন্তু মরা মায়ের গন্ধ শুঁকেই মানুষগুলোকে তারা অনুসরণ করেছিল। এবং আশ্চর্য তারা চলে এল একদম গ্রাম অব্দি! তাদের মধ্যে ছিল ছটা মেয়ে আর দুটো ছেলে ছাগল।
তারা ছড়িয়ে দিল কিছু গমের বীজ। কয়েকদিনের মধ্যেই গজিয়ে উঠল চারা। অবিশ্যি সব গম থেকে চারা বেরোতে পারেনি, কারণ মাটির ওপর থেকে কিছু গম পাখিতে খুঁটে খেয়েছিল, কিছু নষ্ট করেছিল ইঁদুর আর পোকায়। সে যাই হোক, একটা ব্যাপার নিশ্চিত হওয়া গেল, তাদের বানিয়ে তোলা জমির মাটিতেও গম বা যবের মতো ফসল ফলানো সম্ভব। তার সঙ্গে আরও একটা অভিজ্ঞতা হল, গমের দানা থেকে ঠিকঠাক ফসল পেতে হলে, মাটি কিছুটা খুঁড়ে মাটির ভিতরে দানা বসাতে হবে। তা হলে পাখি, ইঁদুর এবং পোকামাকড়ে সহজে সে দানা খেতে পারবে না।
এভাবেই মানুষ ধীরে ধীরে শিখতে লাগল চাষবাস এবং পশুপালন। দিনে দিনে তারা সভ্য হওয়ার দিকে এগোতে লাগল।
এমন সমৃদ্ধি আর স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে শিকারী-সংগ্রাহী মানুষেরা কেন নিঃস্ব যাযাবরের মতো জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতে যাবে, অনিশ্চিত অচেনা বিপজ্জনক এলাকায়? তাদের ঘরেই তো এখন মজুত থাকে শস্য সম্পদ, পোষা থাকে প্রাণী সম্পদ। শিকারী-সংগ্রাহী সমাজ এখন দ্রুত বদলে উঠতে লাগল কৃষিভিত্তিক ও পশুপালক সমাজে।
তথ্য ঋণঃ
১. Sapiens – A Brief History of Humankind – Yuval Noah Harari.
চলবে...
(১৫/০৪/২০২২ তারিখে আসবে প্রথম পর্বের পরবর্তী ও অন্তিম অধ্যায়।)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।