এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • ধর্মাধর্ম – পঞ্চম পর্ব  - ষষ্ঠ ভাগ

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৮৬১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ৫.৬.১ হিন্দু দেবী
    বৈদিক দেবীদের তুলনায় হিন্দু দেবীর সংখ্যা এবং তাঁদের গুরুত্ব অপরিসীম। বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য দর্শনের প্রকৃতি, যাঁর সংযোগে পুরুষোত্তম ব্রহ্ম এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় করে থাকেন, হিন্দু ধর্মে সেই প্রকৃতি হয়ে উঠলেন দেবী - তিনিই আদ্যাশক্তি, মহামায়া। ভগবান বিষ্ণু বা বলা ভাল তাঁর প্রধান অবতার শ্রীকৃষ্ণের মহিলা-মোহিনী মহিমা থাকা সত্ত্বেও, ভাগবত মতে দেবীদের প্রাধান্য নেই বললেই চলে। বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মীদেবী বিষ্ণুর, সীতাদেবী শ্রীরামচন্দ্রের এবং শ্রীকৃষ্ণপ্রিয়া শ্রীরাধিকা শ্রীকৃষ্ণের পাশে পূজিতা হয়ে থাকেন। যদিও এই তিনদেবীর মধ্যে লক্ষ্মীদেবীর জনপ্রিয়তা সর্বজনীন, সম্পদের দেবী হিসেবে প্রত্যেক হিন্দুর ঘরেই তিনি স্বাধীনভাবে পূজিতা হয়ে থাকেন। তবে সেই লক্ষ্মীদেবী, যত না সমুদ্রমন্থনে উত্থিতা বিষ্ণুর পত্নী হিসেবে পূজিতা হন, তার থেকে অনেক বেশি পূজিতা হন, মহাদেব ও পার্বতীর কন্যা হিসেবে। ভাগবত মতে মাতৃকাদের যে নাম পাওয়া যায়, সেগুলি হল, পৌর্ণমাসী, পদ্মা, অন্তরঙ্গিকা, গঙ্গা, কলিন্দতনয়া, গোপী, বৃন্দাবতী, গায়ত্রী, তুলসী, পৃথিবী, গো, বৈষ্ণবী, শ্রীযশোদা, দেবহূতী, রোহিণী, শ্রীসতী, দ্রৌপদী, কুন্তী এবং শ্রীকৃষ্ণের দশ পত্নীগণ, যাঁদের নাম আগেই বলেছি। এঁদের মধ্যে গঙ্গা, গায়ত্রী, তুলসী, পৃথিবী ও গো মাতৃকার পূজা ভারতের সর্বত্রই প্রচলিত, অন্যান্য মাতৃকারা অঞ্চলভেদে পূজিতা হয়ে থাকেন।   

    অন্যদিকে ভগবান মহেশ্বরের পত্নীদের সকলেই মহামায়া আদ্যাশক্তির বিভিন্ন রূপ। কখনো তিনি সতী, কখনো গিরিকন্যা উমা বা পার্বতী বা গৌরী। ভক্ত হিন্দুদের মনে এই দৈব দম্পতি হর-গৌরী, দাম্পত্যের আদর্শ ও প্রতীক। পার্বতী বা গৌরী একদিকে পতিনিষ্ঠ পত্নী - প্রেমে, অভিমানে, অনুরাগে, অনুযোগে মাধুর্যের শেষকথা। আবার অন্যদিকে তিনিই মাতৃস্বরূপা– তিনি শুধুমাত্র লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ জননীই নন, তিনি ভক্তজনেরও মাতা, তিনি তাদের দুর্গতিনাশিনী, পাপহারিণী, ভবতারিণী। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সময়ে তিনি ভক্তজন এমন কি দেবতাদের পরিত্রাণের জন্যেও শান্ত-পূত-পবিত্র পার্বতী রূপ ছেড়ে যোদ্ধারূপও ধারণ করেছেন বার বার। কখনো তিনি দেবী দুর্গা - মহিষাসুরমর্দিনী, কখনো দেবী চণ্ডী – চণ্ডমুণ্ড ও রক্তবীজ অসুরনাশিণী আবার কখনো তিনিই ব্যাঘ্রবাহিনী অম্বা। এই দেবীদের সকলেই ভারতের প্রায় সর্বত্র পূজিতা হয়ে এসেছেন এবং আজও পূজিতা হয়ে থাকেন। তাঁর আরেকটি রূপ অন্নপূর্ণা – এই রূপেই তিনি ভক্ত প্রজাদের সমৃদ্ধি, শস্য এবং সম্পদ দান করেন। দেবী লক্ষ্মী ধনের দেবী, সে কথা আগেই বলেছি। দেবী সরস্বতী বৈদিক কালে বাক্‌-দেবী বা ভাষার দেবী ছিলেন, এখন তিনি সর্ববিদ্যার দেবী। শৈব মতে ষোড়শ মাতৃকার নাম পাওয়া যায়, গৌরী, পদ্মা, শচী, মেধা, সাবিত্রী, বিজয়া, জয়া, দেবসেনা, স্বধা, স্বাহা, শান্তি, পুষ্টি, ধৃতি, তুষ্টি, আত্মদেবতা ও কুলদেবতা।

    ৫.৬.২ শক্তি, শাক্ত ও তন্ত্রধর্ম

    ৫.৬.২.১ শক্তির দেবী
    শৈব ধর্মের আরেকটি জনপ্রিয় ও শক্তিশালী শাখা হল শাক্ত। শাক্ত ধর্মের মূলকথা শক্তি – যে আদ্যাশক্তির কথা শৈবধর্মে বলা হয়েছে, সেই শক্তিই এখানে প্রধানা দেবী এবং তাঁর ভক্তরা শক্তির উপাসক। শাক্তদের উপাস্য দেবী প্রধানতঃ দশজন, তাঁদের একত্রে দশমহাবিদ্যা বলা হয়ে থাকে। এই দশমহাবিদ্যা হলেন, কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা। এই দেবীরা সকলেই শিবজায়া সতী ও পার্বতীর বিভিন্ন রূপ। প্রসঙ্গতঃ পৌরাণিক মতে সতী ও পার্বতীও একই দেবী, দক্ষের যজ্ঞে দেহত্যাগ করার পর সতীদেবীই পরজন্মে পার্বতী হয়েছিলেন, সেকথা আগেই বলেছি। এই দশমহাবিদ্যার উৎপত্তি নিয়ে বহু পুরাণে বহু কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে, তার মধ্যে যে কাহিনী সব থেকে প্রচলিত, সেটি এরকম,-

    নিমন্ত্রণ ছাড়াই সতীদেবী পিতা দক্ষের যজ্ঞে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায়, মহাদেব তাঁকে যখন বারবার নিষেধ করেছিলেন, তখন ভীষণ রেগে গিয়ে সতীদেবী স্বামীকে তাঁর এই দশরূপ দেখিয়েছিলেন।
    কালী - এলোকেশী, ঘন মেঘের মতো কালো গায়ের রং, ত্রিনয়না, বড়বড় দাঁত ও লোলজিহ্বা। গলায় মুণ্ডমালা, তার থেকে রক্ত ঝরছে, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন শবের বুকে। তিনি চতুর্ভুজা, তাঁর বাঁহাতের একটিতে তীক্ষ্ণ খড়গ, অন্যটিতে কাটা মুণ্ড। দুই ডানহাতে বরাভয় মুদ্রা। ইনি কৈবল্যদায়িনী– সংসারে পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি দেন।
    তারা - তাঁর গায়ের রং নীল, লোলজিহ্বা, ত্রিনয়না, করালবদনা, মাথার জটাতে খেলে বেড়াচ্ছে সাপ। কপালে পাঁচটি অর্ধচন্দ্রের ভূষণ, পরনে বাঘছাল। তিনি শিবের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর চারহাতে নীলপদ্ম, খড়গ, কাতি[1] ও নরখুলি। ইনি বিপদ-আপদ, ভূত-প্রেত থেকে সকলকে ত্রাণ বা তারণ করেন, তাই তারা।
    ষোড়শী (রাজরাজেশ্বরী) - তাঁর গায়ের রং লাল, ত্রিনয়না, কপালে চন্দ্রভূষণ, তাঁর চার হাতে পাশ, অঙ্কুশ, তীর ও ধনুক, তিনি বসে আছেন যে মঞ্চে সেই মঞ্চ ধারণ করে আছেন, পাঁচ দেবতা - ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ঈশ্বর, মহেশ ও রুদ্র। ইনি ত্রিগুণাতীতা–অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের ঊর্ধে অবস্থিতা। 
    ভুবনেশ্বরী - এই রূপে তিনি পদ্মাসনা, রক্তবর্ণা, সালংকারা, কপালে চন্দ্রভূষণ, চার হাতে পাশ, অঙ্কুশ ও বরাভয় মুদ্রা। ইনি এই বিশ্ব ভুবনকে পালন করেন।
    ভৈরবী - ইনিও পদ্মাসনা, রক্তবর্ণা, ত্রিনয়না, সালংকারা, কপালে চন্দ্রভূষণ, গলায় মুণ্ডমালা, চার হাতে অক্ষমালা[2], পুঁথি ও বরাভয় মুদ্রা। ইনি ভৈরবের ভার্যা - সকল দুঃখ নাশ করেন। 
    ছিন্নমস্তা - প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর বিপরীত রতিক্রিয়ায় মগ্ন মিথুনের উপর তিনি দণ্ডায়মানা, তিনি দ্বিভুজা, দিগম্বরী, উপবীতের মতো তাঁর কাঁধে মুণ্ডমালা এবং সাপ। একহাতের খড়্গ দিয়ে তিনি নিজের মুণ্ড কেটে ফেললেন, অন্য হাতে ধরলেন, নিজেরই কাটা মুণ্ড। কণ্ঠ থেকে উৎসারিত হল তিনটি রক্তধারা। দুই পাশের রক্তধারা পান করতে লাগল তাঁর দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ডাকিনী সহচরী এবং মধ্যের রক্তধারাটি পান করলেন হাতে ধরে থাকা নিজের কাটা মুণ্ডটির মুখ দিয়ে। ইনি ত্রিশক্তিরূপিণী, মোহনাশিনী ও মোক্ষদায়িনী। 
    ধূমাবতী - ধূমাবতী অতি বৃদ্ধা বিধবা, তাঁর গায়ের রং ধূসর ধোঁয়ার মতো, তাঁর দুই স্তন বাতাসে দুলছে, তিনি শীর্ণা, ক্ষুধায় আকুল, তাঁর একহাতে একটি কুলা, অন্য হাত কাঁপছে থরথর করে। ইনি ধূম্রাসুরকে বধ করেছিলেন। ইনি চতুর্বর্গ – ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ দান করেন।
    বগলা – রত্নময় গৃহে, রত্নময় সিংহাসনে তিনি বসে আছেন, তিনি পীতবর্ণা, পীতবসনা, সালংকারা, তাঁর ত্রিনয়নে চন্দ্র, সূর্য এবং অগ্নি, কপালে চন্দ্রকলা, একহাতে তিনি এক অসুরের জিভ টেনে ধরে আছেন, অন্য হাতে মুগুর। ইনি স্বয়ং চৈতন্যরূপিণী
    মাতঙ্গী – রক্তপদ্মাসনা, শ্যামবর্ণা, রক্তবসনা, চতুর্ভুজা – খড়্গ, চর্ম, পাশ, অঙ্কুশধারী, ত্রিনয়না, কপালে অর্ধচন্দ্র। ইনি মতঙ্গ অসুরকে বধ করেছিলেন, সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন।
    কমলা (মহালক্ষ্মী)– সুবর্ণ বর্ণা, কমলাসনা, চার হাতের দুই হাতে পদ্ম, দুই হাতে বরাভয় মুদ্রা, দুই পাশে দুই-দুই হাতি তাদের চারটি করে দাঁত। দুই হাতি সোনার ঘট থেকে রত্ন এবং অন্য দুই হাতি সোনার কলস থেকে অমৃত ঢেলে দেবীকে অভিষিক্তা করছে।

    দেবাদিদেব মহাদেব মনে করলেন, এঁরা কেউই তাঁর নরম-সরম পত্নী সতীদেবী নয়, অন্য কেউ। তিনি আতঙ্ক ও ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা কে? আমার সতী কোথায় গেল?” উত্তরে কালীরূপী সতীদেবী বললেন, “তুমি তো সবই জান, এখন কেন ভুলে গেলে? চিন্তা করে দেখ আমিই পরমা প্রকৃতি। সৃষ্টির আদিতে তুমি, বিষ্ণু এবং ব্রহ্মা যখন কারণ জলে ছিলে, আমিই তোমাদের তিনজনকে প্রসব করেছিলাম। তোমরা তিনজনেই তখন সৃষ্টির জন্যে তপস্যা করছিলে, এমন সময় আমি শব হয়ে জলে ভেসে সেখানে উপস্থিত হলাম। শবের পূতি গন্ধে বিষ্ণু উঠে গেলেন, ব্রহ্মা মুখ ফিরিয়ে চতুর্মুখ হলেন। একমাত্র তুমিই ঘৃণা না করে, আমাকে আসন করলে এবং আমি প্রকৃতি রূপে তোমার পুরুষ রূপের ভজনা করলাম। সেই তুমি, সেই আমি – এবার মনে পড়েছে?” এই কথা শুনে মহাদেবের সব মনে পড়ে গেল, সেই শবসাধনা, সেই তন্ত্রমন্ত্র। সতীদেবীই যে সেই মহামায়া সে কথা মনে করে, তিনি সতীদেবীকে দক্ষের যজ্ঞে যাওয়ার অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন।

    প্রসঙ্গতঃ এখানে শাক্তমতে সৃষ্টি তত্ত্বের আরেকটি কাহিনী জানা গেল।

    ৫.৬.২.২ মহাভারতে শক্তিপূজা
    মহাভারতে শক্তি দেবীদের পূজার বহু উল্লেখ আছে। সবগুলির আলোচনায় না গিয়ে, খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটিমাত্র ঘটনার উল্লেখ এখানে করতে চাই। পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী বারো বছর বনবাসের পর, এক বছর অজ্ঞাতবাসের জন্যে বিরাটরাজ্যে আত্মগোপনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু মানসিক উদ্বেগের শেষ নেই, অজ্ঞাতবাসের সময় দুর্যোধনাদি কৌরবপক্ষ যদি তাঁদের অবস্থান জেনে ফেলে, তাহলে আবার তের বছরের জন্যে দুর্ভোগ চলবে। উদ্বিগ্ন রাজা যুধিষ্ঠির ভগবতী দুর্গার কৃপা প্রার্থনার জন্যে, তাঁর স্তব শুরু করলেন,
    “হে যশোদাকন্যা, নারায়ণপ্রিয়া, কংসের ধ্বংসকারিণি, অসুরবিনাশিনি, ভগবতি, বরদায়িণি, আপনাকে নমস্কার।  আপনি ব্রহ্মচর্য্যস্বরূপা, বাসুদেবের ভগিনী। দুর্ধর্ষ কংস আপনাকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে, শিলাতলে আছাড় মারতে গেলে, আপনি তার হাত থেকে অনায়াসে নিজেকে মুক্ত ক’রে, আকাশে অদৃশ্য হয়েছিলেন। হে ভুবনেশ্বরি, আপনি দিব্য বস্ত্র ও মালায় সুসজ্জিতা। আপনার হাতে তীক্ষ্ণ খড়্গ ও ঢাল শোভা পাচ্ছে। হে ত্রৈলোক্যতারিণি, যাঁরা পাপের ভার ক্ষালনের জন্যে আপনাকে একান্ত ভাবে স্মরণ করেন, আপনি তাঁদের দুস্তর পাপের পঙ্ক থেকে উদ্ধার করে থাকেন”।
    তারপর রাজা যুধিষ্ঠির, সকল ভাই ও স্ত্রী দ্রৌপদী মিলে দেবীকে দর্শনের ইচ্ছায় আরো অনেকরকম স্তব করতে লাগলেন, “হে নবোদিত সূর্যের মতো স্নিগ্ধ উজ্জ্বল দেবি, আপনার চার হাত, চার মুখ, আপনি ময়ুরপুচ্ছ বলয়ধারিণী, পীনস্তনী, গুরুনিতম্বিনী, কেয়ুরধারিণী দেবী। আপনি লক্ষ্মীর মতো শোভা লাভ করে থাকেন। আপনার মুখমণ্ডলের আভায় চাঁদের জ্যোৎস্নাও লজ্জিত হয়। আপনার দুই কান, সোনার কুণ্ডলে অলংকৃত। বিচিত্র আপনার মাথার মুকুট এবং অত্যন্ত রমণীয় আপনার কেশবন্ধন। হে বিবিধ অস্ত্রধারিণি, আপনার বিপুল বাহুসমূহ শক্রধ্বজার মতো। আপনার কটিতটে  ভুজঙ্গের অলঙ্কারে, আপনি মহানাগ বেষ্টিত মন্দর গিরির মতো রূপ ধারণ করেছেন। ময়ুরের পাখায় সাজানো আপনার ধ্বজদণ্ডের কী অপূর্ব শোভা হয়েছে। হে  ত্রিদশেশ্বরি, আপনি কৌমার ব্রতে সুরলোক পবিত্র করেছিলেন, সেই কারণে ত্রিদশগণ সর্বদা আপনার স্তব ও পূজা করেন। আপনি ত্রিলোককে রক্ষা করার জন্য মহাসুর মহিষাসুরকেও সংহার  করেছিলেন। আপনি জয়া, বিজয়া, বরদা এবং আপনি সংগ্রামে বিজয় দান করেন, অতএব আমাদের প্রতি এখন প্রসন্ন হোন, কৃপা করে আমাদের বিজয় দান করুন। হে মদ্য ও পশুমাংসপ্রিয়ে[3], কামচারিণি, নগেন্দ্র বিন্ধ্যাচল আপনার শাশ্বত বাসস্থান, প্রলয়কালে নিখিল জীব ও জড় আপনাতেই লীন হয়। হে কালি, হে মহাকালি, যাঁরা প্রভাতে আপনাকে স্মরণ ও প্রণাম করেন, তাঁদের সকল দুঃখের ভারমুক্তি ঘটে এবং প্রভূত ধন-পুত্র লাভ সুলভ হয়। হে দুর্গে, আপনি বিপদের দুর্গ থেকে লোককে উদ্ধার করেন বলেই আপনার নাম দুর্গা। গহন অরণ্যে অবসন্ন, সাগরজলে নিমগ্ন ও দস্যু কবলে আক্রান্ত জনের আপনিই একমাত্র গতি। হে দেবি, জলপোতে, নির্জন প্রান্তরে কিংবা গভীর অরণ্যে বিপন্ন হয়ে, আপনাকে ভক্তিভরে স্মরণ করলেই, আর বিপদের ভয় থাকে না, বিপদ থেকে তৎক্ষণাৎ উদ্ধার পাওয়া যায়। হে সুরেশ্বরি, আপনি কীর্তি, লক্ষ্মী, ধৃতি, সিদ্ধি, লজ্জা, বিদ্যা, সন্ততি, বুদ্ধি, সন্ধ্যা, রাত্রি, প্রভা, নিদ্রা, জ্যোৎস্না, কান্তি, ক্ষমা ও দয়া। আপনার পূজা করলে মানুষের বন্ধন, মোহ, পুত্রনাশ, ধনক্ষয়, ব্যাধি, মৃত্যুভয় কিছুই থাকে না। হে ভক্তবৎসলে, শরণাগতপালিকে, দুর্গে, আমি রাজ্যভ্রষ্ট হয়েছি। এখন আপনার শরণাপন্ন হয়েছি, আপনাকে প্রণাম করি, আপনি আমাদের সকলকে রক্ষা করুন”
    রাজা যুধিষ্ঠিরের এই স্তবে দেবী প্রসন্না হলেন, তাঁদের সামনে আবির্ভূতা হয়ে বললেন, “হে রাজা, আমার প্রসাদে তোমাদের অচিরকালের মধ্যেই বিজয় লাভ হবে। তুমি ও তোমার ভ্রাতৃগণ নিখিল কৌরবদের পরাজিত করে, নিষ্কণ্টকে রাজ্য ভোগ করবে, সুখে এবং শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করবে। হে ধর্মরাজ, যে সকল নিষ্পাপ লোকেরা আমার নামসঙ্কীর্তন করে, আমি তাদের প্রতি প্রসন্ন হই এবং আমি তাদের রাজ্য, আয়ু, সম্পদ, সুন্দর স্বাস্থ্য ও সন্তান প্রদান করি। প্রবাসে, নগরে, যুদ্ধে, সংগ্রামে, অরণ্যে, দুর্গম পাহাড়ে ও সাগরের যে কোন দুর্গম স্থানে বিপন্ন হলেই, যারা আমাকে স্মরণ করে, তাদের আর কিছুই দুর্লভ থাকে না।  তোমার এই স্তব ও স্তোত্র শুনলে অথবা পাঠ করলে তাদের সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন হয়, সকল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। হে পাণ্ডবগণ, আমি প্রসন্ন হয়েই বলছি, তোমরা এই বিরাটনগরে বাস করলে, এখানকার লোকেরা এবং কৌরবরাও, কেউ তোমাদের সঠিক পরিচয় জানতে পারবে না”। (বিরাট/ ৬)। যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বলে, দেবী পাণ্ডবদের আশীর্বাদ করলেন এবং সেখানেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

    রাজা যুধিষ্ঠিরের এই দুর্গা স্তবের কাহিনী, মহাভারতে যুক্ত হয়েছে হয়তো খ্রিস্টিয় তৃতীয় চতুর্থ শতাব্দীতে। মোটামুটি ৯০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি সময় মহর্ষি ব্যাসদেব রচিত মূল মহাভারতে এই কাহিনী নিশ্চয়ই ছিল না। কারণ আগেই বলেছি মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম থেকে কংস বধ (অর্থাৎ বৃন্দাবন থেকে মথুরা) কাহিনীর কোন উল্লেখ আমরা পাই না। তাহলে রাজা যুধিষ্ঠির কী করে জানলেন, তিনি যশোদা কন্যা, এবং কংস তাঁকে পাথরে আছাড় মারতে গিয়েছিলেন? উপরন্তু আমরা আগেই দেখেছি, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বা মহাভারত রচনার কাল থেকে প্রায় পনেরশ (!) বছর বাদে দেবর্ষি নারদের বকাবকিতে, মহর্ষি ব্যাসদেব ভাগবত ও অন্যান্য বহু পুরাণ রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন (অধ্যায় ৫.৩.৩)। অতএব মহাভারতে ভগবতী দুর্গা যখন রাজা যুধিষ্ঠিরের স্তবে আবির্ভূতা হয়েছেন, ততদিনে ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অতএব এই কাহিনীটি প্রক্ষিপ্ত, কাক-ভক্ষ্য মহাভারতকে হংস-বিহারী মহাভারতে রূপান্তরিত করার বহু প্রয়াসের মধ্যে এটি একটি।    

    ৫.৬.৩ তন্ত্র ধর্মের উৎপত্তি
    শিব এবং শক্তির পূজা ভারতের প্রাচীনতম পূজা পদ্ধতি, ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল, নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে এঁনাদের সকলেই অনার্যদের মাতৃকা দেবী এবং বেশ কিছু অনার্য গোষ্ঠীর মধ্যে এঁদের পূজার যে বহুল প্রচলন ছিল, তার প্রত্ননিদর্শণ পাওয়া গেছে সিন্ধু সভ্যতার অবশেষ থেকে। অনুমান করা যায় এই দেবীদের সকলেই নারী যোদ্ধা, হয়তো মাতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রধানা ছিলেন। অথবা বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে লড়াইতে কোন গোষ্ঠীর অধিকাংশ পুরুষের মৃত্যু হওয়াতে, সেই গোষ্ঠীর নারীরাই ভয়ংকর যোদ্ধা হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছিলেন। যার ফলে তাঁরা একটু বেশি মাত্রায় নৃশংস হয়ে, নরমুণ্ডমালিনী এবং হাতে রক্ত-ঝরা কাটা মুণ্ড ধারণ করেছিলেন।

    ভারতের অনার্য মানুষের মধ্যে কিছু কিছু মাতৃতান্ত্রিক বা মাতৃকূলীয় সমাজের অস্তিত্ব যে ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। আজও মেঘালয়ের খাসি, জয়ন্তিয়া ও গারো জনগোষ্ঠীর মানুষদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। শোনা যায়, কেরালার নায়ার গোষ্ঠীর মানুষদের সমাজও মাতৃতান্ত্রিক ছিল। এই সমাজের মানুষদের, টিপু সুলতানের এতই উদ্ভট লেগেছিল, তিনি উঠে পড়ে লেগেছিলেন, এই গোষ্ঠীর মানুষদের নিকেশ করার জন্যে। এই নায়ার গোষ্ঠীর পুরুষরা কিন্তু যোদ্ধা হিসেবে দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ জনজাতি। এঁদের উপাস্য দেবতা ছিলেন নাগ বা সর্প। যে সাপ মহাদেব এবং দেবী তারার অঙ্গভূষণ। পৌরাণিক মতে, দেবী সতীর শবদেহের টুকরো থেকে যে একান্নটি শক্তিপীঠের সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলি ভারতের একান্নটি অনার্য অঞ্চলের মাতৃকাদেবী, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। তাঁরা সকলেই দেবী সতীর বিভিন্ন রূপ হয়ে হিন্দুধর্মে অন্তর্ভুক্তা হয়েছেন।

    তন্ত্রপুজোর প্রচলন অতি প্রাচীন। আগেই বলেছি, প্রাথমিক ভাবে তাঁদের পুজোর উপচার এবং পদ্ধতি খুবই সরল ছিল। উপচারের মধ্যে ছিল ফুল-পাতা। নৈবেদ্যর মধ্যে ছিল, মানুষের যা যা খাদ্য তার সবকিছুই। ফলমূল, মিষ্টান্ন, ভাত-ডাল-সব্জি-মাছ-মাংস, সাধারণ মানুষের যা যা প্রিয় খাদ্য, সবই দেবতার নৈবেদ্য। আর মন্ত্র ছিল দেবতার কাছে মনের যাবতীয় ইচ্ছে বা স্বপ্ন নিবেদন। এই পূজায় তাঁরা কিছু প্রতীকও ব্যবহার করতেন, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ আকার, স্বস্তিক এবং নানান চিত্রলিপি – যা দিয়ে প্রকৃতিকে চিনে নেওয়া যায়, যেমন পর্বত, গাছ, গাছের পাতা – অশ্বত্থের পাতা, নদী, নানান পশু-পাখির আকার, এমনকি মানুষের আকারও। এই প্রতিটি প্রতীকেরই নিদর্শন পাওয়া গেছে সিন্ধুসভ্যতার প্রত্নাবশেষ থেকে।

    অনার্য দেবদেবী এবং তাঁদের পূজাপদ্ধতি হিন্দু ধর্মে অন্তর্ভুক্তির সময়েই তাত্ত্বিক তন্ত্র শব্দের উৎপত্তি হল। সংস্কৃত এই শব্দটির উৎপত্তি, পণ্ডিতেরা বলেন, যে শব্দ থেকে তন্তু এবং তাঁত শব্দের উৎপত্তি, সেই শব্দ থেকে। অর্থাৎ এই অর্থ ধরলে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনে ওতপ্রোত জড়িত বিভিন্ন পূজাপদ্ধতির তত্ত্ব নিয়ে বুনে তোলা একটি তত্ত্বই তন্ত্র। আবার অনেকে বলেন, তত্ত্ব আর মন্ত্র নিয়ে তন্ত্র। অর্থাৎ অনার্যদের সাধারণ যে মনোবাসনার মন্ত্র ছিল তার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য তত্ত্ব জুড়ে তন্ত্র শাস্ত্র গড়ে উঠেছিল।

    আগেই বলেছি, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রাথমিক স্তরে, জীবনের তিনটি বর্গ বা লক্ষ্য ছিল, ধর্ম, অর্থ ও কাম। অর্থাৎ ধর্ম পথে থেকে সুস্থ জীবিকা উপার্জন করা আর সংসার জীবনের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য কামনা, বাসনা উপভোগ করা। ব্রহ্মলাভ, ব্রহ্মজ্ঞ হওয়া বা মোক্ষলাভ বিষয়টা সাধারণের জন্যে নয়, সেটা ছিল তপস্বী বা সাধকদের জন্যে, যাঁরা জন সমাজের বাইরে - অরণ্যে তপস্যা বা সাধনা করে থাকেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৌদ্ধ এবং জৈনধর্ম এই মোক্ষলাভ বা মুক্তি বিষয়টাকে ভীষণ জনপ্রিয় করে তুললেন। সেই অনুসরণে ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিতরাও মুক্তি বিষয়টিকে জীবনের লক্ষ্যে স্থির করে দিলেন, চতুর্বর্গ – ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। বেদ ও উপনিষদে এই মোক্ষলাভের কথা সবিস্তারে বর্ণনা করাই ছিল। পরবর্তী কালের হিন্দু পুরাণকাররা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের চতুর্বর্গ এবং উপনিষদের মোক্ষলাভের সাধনার পথই অনুসরণ করলেন, একটু অন্যভাবে। ভাগবত ধর্মে বিষ্ণু এবং শৈবধর্মে শিব হলেন পরমপুরুষ বা ব্রহ্ম। ব্রহ্মত্ব-লাভের মতো বিষ্ণুত্ব-লাভের জন্যে ভক্তি সাধনার কথা আগেই বলেছি, এবার তন্ত্রমতে শিবত্বলাভের সাধনার কথা বলব।

    প্রশ্ন উঠতে পারে, তন্ত্র বা শক্তি সাধনায় তো দেবীদের প্রাধান্য, সেখানে দেবীত্ব লাভ না হয়ে শিবত্ব লাভ হবে কেন? এর উত্তর, এই সাধনায় দুটোই হবে। কারণ দেবীরা হলেন আদ্যাশক্তি প্রকৃতি - মহামায়া, আর শিব হলেন পরমপুরুষ বা ব্রহ্ম। সাধনার উচ্চতম স্তরে অনুভব করা যাবে শিব ও শক্তি –অর্থাৎ পরমপুরুষ ও পরমাপ্রকৃতি একাকার হয়ে আছেন।

    তন্ত্রশাস্ত্রের বহু গ্রন্থের কথাই শোনা যায়, তার মধ্যে অধিকাংশই অবলুপ্ত হয়ে গেছে, আমাদের কাল পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে সবথেকে নির্ভরযোগ্য যে গ্রন্থটি তার নাম “মহানির্বাণ তন্ত্র”। এই গ্রন্থের লেখকের নাম পাওয়া যায় না, তবে এই গ্রন্থের সৃষ্টি কর্তা স্বয়ং শিব ও পার্বতী। তাঁদের ধর্মতত্ত্বের আলোচনা থেকেই তন্ত্রধর্ম সম্বন্ধে বিশদে জানা যায়।

    ৫.৬.৪ তন্ত্র সাধনতত্ত্ব
    তন্ত্রের শাস্ত্রগ্রন্থ নিয়ে আলোচনার আগে, তন্ত্র সাধনতত্ত্ব বিষয়ে একটু বিশদে আলোচনা করা যাক, নচেৎ আধুনিক হিন্দুধর্মের ভিত যে তন্ত্রধর্ম সেটার উপলব্ধি অধরা থেকে যাবে।

    আগেই বলেছি নানান তত্ত্ব ও মন্ত্র নিয়ে তন্ত্রের সৃষ্টি। তন্ত্র তত্ত্বের মূল সাংখ্য দর্শন, যার কথা আগেই বলেছি। পঁচিশটি তত্ত্ব নিয়ে যে সাংখ্য তত্ত্ব, সেখানে আমরা দেখেছি তার চব্বিশটি তত্ত্বের জ্ঞান সম্যক আয়ত্ত্ব করতে পারলে, পঁচিশতম তত্ত্বটি আপনিই উপলব্ধি করা যায়, সেই জ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান, পরমজ্ঞান।

    তন্ত্র মতে এই চব্বিশটি তত্ত্বের জ্ঞান অর্জনের জন্যে নিবিড় আধ্যাত্মিক সাধনার প্রয়োজন, আর সেই সাধনার অন্যতম সহায় হল আধ্যাত্মিক কিছু শব্দের বারবার ব্যবহার – এই শব্দগুলিকেই বীজমন্ত্র বলে, যেমন, ওঁ, হ্রীং, ক্লীং, বষট্‌ ইত্যাদি। অতএব মন্ত্র দিয়ে যে তত্ত্বজ্ঞানের সাধনা, তাকেই তন্ত্র বলে। তন্ত্রদর্শন ছাড়া অন্য দর্শনে মন্ত্রের ব্যবহার নেই বললেই চলে, কিন্তু এই মন্ত্র ছাড়া তন্ত্র অচল।

    তন্ত্র-তত্ত্বের মূল কিন্তু বেদ, উপনিষদ এবং সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শন। বেদের কর্মকাণ্ডে যত যাগ-যজ্ঞের বিধিনিয়ম আছে, তন্ত্র-তাত্ত্বিকেরা নিজেদের মত করে সে সবই আত্মসাৎ করেছিলেন। উপনিষদের মূল বক্তব্য হল ত্যাগ এবং বিবেক বিচারে “নেতি” “নেতি[4]”  করতে করতে পরমার্থ লাভ। অর্থাৎ পার্থিব সব বিষয়কে ত্যাগ করতে করতে পরমার্থ সাধনায় প্রবৃত্ত হওয়া। তন্ত্র এই বিষয়টিকেও তাঁদের তত্ত্বে যুক্ত করে নেওয়ায়, বৈরাগ্যও তন্ত্রের একটি তত্ত্ব হয়ে গেল। রাজযোগের যে দর্শন শরীর ও মনকে পবিত্র করা, তন্ত্র সেটাও গ্রহণ করেছে। পুরাণের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হল বৈধী ভক্তি এবং পরাভক্তি। বৈধী ভক্তি আনুষ্ঠানিক, যেমন গঙ্গা স্নান, তুলসী পাতা খাওয়া, চন্দনের তিলক আঁকা, ষোড়শোপচারে পূজা করা, ইত্যাদি। আর পরাভক্তি হল, ঈশ্বরে পরম আস্থা, অহৈতুকী নিঃশর্ত ভক্তি। তন্ত্র এই দুই ভক্তির মধ্যে পরাভক্তিকে গ্রহণ করেছে, তন্ত্রের ভক্তি ঈশ্বরকে নিবিড় ভালোবাসা। খুব সংক্ষেপে বললে, তন্ত্রতত্ত্ব অনুযায়ী, তন্ত্রসাধককে পার্থিব বিষয়সমূহ ত্যাগ করে সাধনা করতে হবে, ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে এবং আকুল ভক্তিতে ঈশ্বরের কৃপা প্রার্থনা করতে হবে। 

    তন্ত্রমতে জীবনের উদ্দেশ্য ভোগ আর অপবর্গ। ভোগ মানে এই জগতের ভোগ আর অপবর্গ মানে মুক্তি বা মোক্ষ। এই ব্যাপারেও তন্ত্রের সঙ্গে বেদ বা মহাভারতের কোন পার্থক্য নেই। বেদ বা মহাভারত বলেছেন, জীবনের উদ্দেশ্য চারটে– ধর্ম, অর্থ, কাম আর মোক্ষ। তন্ত্র বলছে, মোক্ষ ছাড়া সবকিছুই ভোগ।

    তন্ত্রমতে যাঁরা সাধনা করেন, একই সাধনায় তাঁরা ভোগ এবং অপবর্গ দুটোই পেতে পারেন, শুধু সংকল্প স্থির করতে হবে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হবে। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে আমরা দেখি রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি একই দৈবীসূক্তম্‌ মন্ত্র জপ করতে লাগলেন। দীর্ঘ সাধনার পর দেবী শ্রীচণ্ডী দুজনকেই বর দিতে আবির্ভূতা হলেন। রাজা সুরথ বললেন, আমি সমগ্র ভূমণ্ডলের রাজা হতে চাই, দেবীর বরে তিনি তাই হলেন, অর্থাৎ রাজা সুরথের ভোগ লাভ হল। অন্যদিকে বৈশ্য সমাধি বললেন, আমি অন্য কিছু চাই না, শুধু মুক্তি চাই, দেবী তাঁকে মুক্তিই দিলেন, অর্থাৎ তাঁর অপবর্গ লাভ হল। অতএব তন্ত্রমতে মন্ত্র এবং সাধনা একই থাকবে, শুধু সংকল্প স্থির করতে হবে। পুরাণের থেকে তন্ত্রের আরেকটি পার্থক্য হল, পুরাণে অনেক ক্ষেত্রেই বলা আছে, ঈশ্বরের অহেতুক করুণা বা কৃপা হলেও মুক্তি হয়ে যায়। যেমন অজামিলের কাহিনী আছে, অজামিল জীবনে কোনদিনই সাধনা-টাধনার ধার ঘেঁষেননি, তিনি শুধু নিজের পুত্রের নাম রেখেছিলেন “হরি”। মৃত্যুকালে তিনি ব্যাকুল কণ্ঠে পুত্র হরিকে ডেকেছিলেন, “হরি, ও হরি, আমার পাশটিতে একবার আয়” - তাতেই অজামিলের মুক্তি হয়ে বৈকুণ্ঠলোক লাভ হয়েছিল, কারণ তিনি মৃত্যুকালে “হরি” নাম করেছিলেন! তন্ত্র এই ফাঁকি স্বীকার করে না। 

    তন্ত্র সাধন তত্ত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রাণবায়ু বা প্রাণ এবং নাড়ী।  উপনিষদ বলছে, প্রাণ পাঁচটি – অপান, প্রাণ, সমান, ব্যান, উদান। পায়ু ও উপস্থে যে প্রাণবায়ু অবস্থান করে, তার নাম অপান। চোখ, কান, নাক ও মুখে প্রাণ অবস্থান করে এবং দুইয়ের মাঝখানে অর্থাৎ নাভি মণ্ডলে অবস্থান করে সমান। আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি, তাকে পরিপাক করে, শরীরে শক্তি ও পুষ্টি বিধান করে সমান বায়ু।  আমাদের আত্মা অবস্থান করেন আমাদের হৃদয়ে। সেই হৃদয়ে একশ একটি নাড়ী আছে, সেই নাড়ীর প্রত্যেকটিতে আবার একশটি করে শাখা নাড়ী আছে। প্রত্যেক শাখা নাড়ীতে আছে বাহাত্তর হাজার করে প্রতিশাখা নাড়ী। তার মানে আমাদের সারা শরীরে মূল নাড়ী ১০১টি; শাখা নাড়ী = ১০১ x ১০০ = ১০,১০০;  প্রতিশাখা নাড়ী = ১০,১০০ x ৭২০০০ = ৭২,৭২,০০,০০০। অতএব মোট নাড়ী সংখ্যা = ৭২,৭২,১০,২০১![5] এই সমস্ত নাড়ীর মধ্যে অবস্থান করে ব্যানবায়ু অর্থাৎ আমাদের সারা শরীরেই ব্যানবায়ু ব্যাপ্ত রয়েছে। এর মধ্যে মূলনাড়ীর ঊর্ধমুখী একটি নাড়ীতে উদান বায়ু অবস্থান করে, এই উদানবায়ুই আমাদের পুণ্যকর্ম থেকে পুণ্যলোক, পাপকর্ম থেকে পাপলোক এবং উভয়কর্ম থেকে মনুষ্যলোক প্রাপ্ত করায়। ঊর্ধমুখী ওই নাড়ীকেই তন্ত্রে সুষুম্না বলে।

    তন্ত্র সাধন পদ্ধতিতে প্রাণায়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের ভিতরে প্রাণবায়ু গ্রহণ অর্থাৎ পুরক, শরীরে তাকে রুদ্ধ করা অর্থাৎ কুম্ভক এবং শরীর থেকে সেই বায়ু ত্যাগ করা অর্থাৎ রেচকের পদ্ধতিকেই প্রাণায়াম বলে। তন্ত্রে তিনটি নাড়ীও খুব গুরুত্বপূর্ণ – ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না। মেরুদণ্ডের কেন্দ্রে যে সূক্ষ্মনাড়ী তার নাম সুষুম্না, তার বাঁয়ে থাকে ইড়া আর ডানদিকে পিঙ্গলা। সুষুম্নার শুরু মূলাধার থেকে – মেরুদণ্ডের শেষ প্রান্তে গুহ্যের কাছাকাছি জায়গায়। আবার এই মূলাধারেই থাকে কুণ্ডলিনীশক্তি। তন্ত্র মতে আমাদের সাধারণ অবস্থায় এই কুণ্ডলিনীশক্তি সাপের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকে, সেই সময় মানুষের মন সুখ-দুঃখ-শোক-আনন্দ-কামনা-বাসনায় জর্জরিত থাকে। সাধনা শুরুর সঙ্গে এই কুণ্ডলিনী জেগে ওঠে এবং সুষুম্না পথে ওপরের দিকে যাত্রা শুরু করে।

    সুষুম্না নাড়ীতে ছটি পদ্ম আছে, একদম নিচে মূলাধার, তারপর ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা। তন্ত্রমতে এই ছটি পদ্মকে বলে চক্র – ষট্‌চক্র ভেদই তন্ত্র সাধনার মূল উদ্দেশ্য, বেদে এই ছটি পদ্মকে বলা হয় ভূমি। মূলাধারের অবস্থানের কথা আগেই বলেছি, স্বাধিষ্ঠান চক্রের অবস্থান উপস্থের, মণিপুর নাভিমণ্ডলের, অনাহত হৃদয়ের, বিশুদ্ধ কণ্ঠের এবং আজ্ঞা চক্র ভ্রূর সমান্তরালে অবস্থান করে। সাধনার বিভিন্ন পর্যায়ে সুষুম্নানাড়ী পথে কুণ্ডলিনী শক্তি এক একটি চক্র ভেদ করে উপরের দিকে উঠতে থাকে। কুণ্ডলিনী যখন হৃদয়ের অনাহত চক্র স্পর্শ করে তখন সাধকের মন থেকে সমস্ত কামনা বাসনার অবসান হয়, সাধক অদ্ভূত এক জ্যোতি দেখতে পান। এরপর কুণ্ডলিনী বিশুদ্ধ চক্র স্পর্শ করলে সাধকের মন ঈশ্বর চিন্তায় ব্যাকুল হয়, তখন ঈশ্বরের বিষয় ছাড়া অন্য কথা বলতে পারেন না, অন্য কথা শুনলেও অসহ্য বোধ হয়। এরপর কুণ্ডলিনী ষষ্ঠ চক্র আজ্ঞাভূমি স্পর্শ করলে, সাধক ঈশ্বরকে দেখতে পান, কিন্তু একটু আড়াল থাকে – যেমন লণ্ঠনের আলো, দেখা যায়, কিন্তু কাচের জন্যে স্পর্শ করা যায় না। ষষ্ঠ চক্র অতিক্রম করে কুণ্ডলিনীশক্তি যদি সপ্তমভূমিতে সহস্রার অর্থাৎ সহস্রদল পদ্মে মিলিত হয়, তখন সাধকের সমাধি হয়। সমাধিস্থ হলে সাধকের বাহ্যজ্ঞান লোপ পায়, সাধক দেহ রক্ষা করতে পারেন না, একুশ দিনের মধ্যে তাঁর দেহের অবসান হয়। সপ্তমভূমির এই সহস্রদল পদ্মের অবস্থান, মাথার ব্রহ্মতালুতে। এই সহস্রার পদ্মেই সচ্চিদানন্দ শিব অবস্থান করেন, সাধকের শক্তি শিবের সঙ্গে মিলিত হন। শিব-শক্তির এই মিলনই তন্ত্রের পরমার্থ লাভ, উপনিষদের ব্রহ্ম লাভ।

    যাঁরা ঈশ্বরকোটি সাধক অর্থাৎ অবতার, তাঁরা লোকশিক্ষার জন্যে সমাধি অবস্থা থেকেও আবার নেমে আসতে পারেন। তাঁদের অবস্থান থাকে ষষ্ঠ ও সপ্তমভূমির মাঝখানে। তাঁদের মধ্যে ভক্তভাবের অথবা দাসভাবের সামান্য অহংটুকু – ভক্ত আমি, দাস আমি - থাকে। যেমন হনুমান ছিলেন, দাসভাবে; নারদ, সনক, সনন্দ, সনাতন, সনৎকুমার প্রমুখ ছিলেন ভক্তভাবে, যেমন শ্রীশ্রীচৈতন্য ছিলেন প্রেমভাবে এবং শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন সন্তানভাবে।        

    তন্ত্র সাধনার নিম্ন স্তরে - মূলাধার থেকে অনাহত চক্র স্পর্শ করার আগেই সাধকের আটটি দৈব ক্ষমতার সিদ্ধি ঘটতে থাকে। এই সিদ্ধিকে বিভূতিও বলে - আটটি সিদ্ধি এরকম – অণিমা (সূক্ষ্ম হয়ে ওঠা), লঘিমা (পালকের মতো হাল্কা হওয়া), গরিমা (অস্বাভাবিক ভারি হয়ে ওঠা), মহিমা (বিশাল চেহারা), প্রাপ্তি (ইচ্ছেমতো যে কোন বস্তু হাতে আনা), প্রাকাম্য (ইচ্ছেমতো যে কোন বিষয় অর্জন করা), বশিত্ব (যে কোন মানুষ বা জীবকে বশ করা), ঈশিত্ব (সৃষ্টি বিষয়ে নাক গলাতে পারা!)।

    সেকাল থেকে আজ পর্যন্ত, তীর্থে-তীর্থে এবং কলকাতা বা যে কোন বড়ো শহরের রত্নব্যবসায়ীদের চেম্বারে প্রায়ই স্বঘোষিত সিদ্ধ সাধকদের দেখা যায়। তাঁদের অনেকে আবার স্বর্ণপদক প্রাপ্ত – এই পদক কোন প্রতিষ্ঠান দিয়ে থাকে জানা যায়না। তবে এঁরা বশীকরণ করতে পারেন, আপনাকে যে কোন কাজে সার্থক করে তুলতে পারেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল বৈদেশিক আক্রমণের সময় এঁদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যোদ্ধাদেরই সীমান্তে লড়তে হয়ে। তাঁরা বশিত্ব দিয়ে বিপক্ষ সৈন্য বা সেনাপতিদের বশ করে যুদ্ধ বন্ধ করতে পারতেন, কিন্তু কোনদিন করেননি। অথবা সাধারণ আকৃতির সাধক মহিমা সিদ্ধি দিয়ে হঠাৎ বিশাল শরীর বানিয়ে, গরিমা সিদ্ধিতে তাঁদের পায়ের তলায় পিষে একজন শত্রুকেও বিনাশ করতে পেরেছেন - এমন শোনা যায় না।      

    তন্ত্রসাধনায় এই আটটি সিদ্ধিলাভকে খুবই তুচ্ছ এবং অবহেলার চোখে দেখা হয়েছে। এই বিভূতি দিয়ে সাধারণ মানুষকে অবাক করে, যাঁরা অর্থ, যশ বা প্রতিপত্তি উপার্জন করেন, তন্ত্রশাস্ত্র তাঁদের খুবই নীচু স্তরের সাধক বলেছেন।

    ৫.৬.৫ তন্ত্রশাস্ত্র
    তন্ত্রে বেদ - বেদান্ত সর্বশাস্ত্রকে একত্রে বলা হয় নিগম এবং তন্ত্র-শাস্ত্রকে বলা হয় আগম। উভয়ের সম্পর্ক পিতা-পুত্রের মতো। পুত্র পিতাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে, কিন্তু যুগোপযোগী হতে গিয়ে তার মতের সঙ্গে পিতার মতের অমিল হয়। আবার পিতা অর্থাৎ বৈদিক মতের সনাতন পণ্ডিতেরা, তন্ত্রকে তাচ্ছিল্য করেন, বলেন, হতভাগা এত লেখাপড়া শিখেও উচ্ছন্নে গেল?

    মহানির্বাণ তন্ত্র চোদ্দটি পর্বে বিভক্ত, এই পর্বগুলিকে “উল্লাস” বলা হয়েছে। প্রথম উল্লাসে জগজ্জননী পার্বতী সাধারণ মানুষের জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে পতিদেব শিবকে বলছেন, “হে সর্বভূতেশ, তুমি সকলের অন্তর্যামী, চারবেদ তোমার দ্বারাই প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বেদ থেকেই বর্ণাশ্রমাদি  প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সত্যযুগে মানুষ সত্যবাদী, ধার্মিক ছিল, তারা অতিলোভী বা কামুক ছিল না, সকলেই সর্বদা আনন্দে থাকত। সত্যযুগের পরে, মানুষ বেদ অনুসরণ করে, সব কর্ম করতে পারত না, বৈদিক কর্ম তাদের কাছে কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তবুও তারা বেদ ত্যাগ করেনি। তখন তুমি পৃথিবীতে বেদার্থযুক্ত স্মৃতিশাস্ত্র প্রকাশ করেছিলে, সেই শাস্ত্র অনুসরণ করে, মানুষ দুঃখ-শোক-রোগ-তাপ থেকে উদ্ধার পেয়েছিল। তারপর দ্বাপরে মানুষ স্মৃতির সুকর্মও ত্যাগ করে, মনোকষ্ট এবং ব্যাধিতে আকুল হয়ে উঠেছিল। তখন তুমি ব্যাসাদি ঋষি হয়ে সংহিতাশাস্ত্র (পুরাণাদি) উপদেশ দিয়ে মানুষকে উদ্ধার করেছ।

    [লক্ষ্য করার বিষয়, এখানে দেবী পার্বতী বললেন, মহেশ্বর শিবই চারবেদের প্রকাশক, তিনিই মনু হয়ে স্মৃতিশাস্ত্র রচনা করেছেন, আবার তিনিই বেদব্যাসের মতো ঋষি হয়ে পুরাণাদি রচনা করেছেন! শ্রীশ্রী গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিভূতি যোগের মহিমাকেই তিনি যেন খণ্ডন করলেন!]   

    তারপর পাপরূপী, সর্বধর্ম-বিলোপকারী কলিযুগ এসে গেল। এখন দেবতারা শক্তিহীন, স্মৃতি এখন স্মৃতিহীন, নানা পথ প্রদর্শনকারী পুরাণাদির বিনাশ হতে চলেছে। মানুষ মন্দমতি, শঠ, নীচ, পরের সম্পদ চুরি করে। ব্রাহ্মণেরা সন্ধ্যা-বন্দনাদি ছেড়ে শূদ্রের মত আচরণ করে। মানুষের মনে কখনো সৎচিন্তা, সৎকথা শোনা যাবে না। এই নরাধমদের উদ্ধারের জন্যেই তুমি সকল তন্ত্র রচনা করেছ এবং ভোগ ও মুক্তিপ্রদ আগমশাস্ত্র সৃষ্টি করেছ। কিন্তু এখনকার লোক কলির পাপযুক্ত, সর্বদাই অস্থিরমতি, নিদ্রা ও আলস্যে আসক্ত, এদের ভাবশুদ্ধি কী ভাবে হতে পারে?

    দেবী পার্বতীর মানবের প্রতি এই মাতৃসুলভ ব্যাকুলতার উত্তরে সদাশিব দ্বিতীয় উল্লাসে বলেছেন, “হে মহাভাগে, তুমিই জগতের কল্যাণকারিণী, তুমি খুবই ভাল প্রশ্ন করেছ, এমন প্রশ্ন আগে কেউ করেনি। হে প্রিয়ে, তুমি সর্বজ্ঞা, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বিষয়ে তুমি যা যা বললে, সবই যথার্থ। হে প্রিয়ে, আমি সত্য সত্য পুনঃ সত্য বলছি, কলিকালে আগমোক্ত পথ ছাড়া অন্য পথ নেই।  কলিকালে বেদের মন্ত্রসকল বিষহীন সাপের মতো নির্বীর্য হয়ে পড়েছে, যে মন্ত্র সত্যাদি যুগে ফলদায়ী ছিল, কলিতে তারা সকলেই মৃতের মত নিষ্ফলা হয়ে গেছে।  হে দেবেশি, বেদ, আগম, বিশেষতঃ বহু তন্ত্রের সার আমি তোমাকে সংক্ষেপে বলছি। যেমন, মানুষের মধ্যে তত্ত্বজ্ঞানী শ্রেষ্ঠ, নদীর মধ্যে গঙ্গা শ্রেষ্ঠ, দেবতাদের মধ্যে আমি শ্রেষ্ঠ, তেমনি সমস্ত আগম শাস্ত্রের মধ্যে এই মহানির্বাণ তন্ত্রই শ্রেষ্ঠ। এই মহাতন্ত্র বিশেষ ভাবে জানলে, জীব সর্বসিদ্ধি লাভ করে।

    হে পরমেশ্বরি, বিশ্বের হিত করলে বিশ্বের ঈশ্বর প্রীত হন, কারণ তিনিই বিশ্বের আত্মা, বিশ্ব তাঁকেই আশ্রয় করে রয়েছে। তিনি এক, অদ্বিতীয়, সত্য, পরাৎপর, স্বপ্রকাশ, সচ্চিদানন্দস্বরূপ। তিনি নির্বিকার, নির্বিশেষ, গুণাতীত, সর্বাত্মা, সর্বব্যাপী, সর্বদর্শী, বিভু ও সনাতন। হে মহেশ্বরি, সেই পরমেশ্বরই সর্বপ্রাণীর একমাত্র কারণ; তাঁর নিযুক্তিতেই ব্রহ্মা জীব সৃষ্টি করে স্রষ্টা পদবী পেয়েছেন। তাঁর ইচ্ছাতেই বিষ্ণু এই জগৎকে পালন করে, পালয়িতা হয়েছেন। তাঁর ইচ্ছাতেই সংহারকারী হয়ে, আমি জগতে সংহর্তা আখ্যা পেয়েছি। তুমিই তাঁর পরমা প্রকৃতি, সেহেতু তুমি ত্রিভুবনে পূজ্যা”।

    চতুর্থ উল্লাসে ভগবান সদাশিব বলেছেন, “হে মহাভাগে, হে দেবি, তোমার থেকেই এই নিখিল জগৎ উৎপন্ন হয়েছে। হে শিবে, তুমিই এই নিখিল জগতের জননী। তুমি সকলের আদ্যা অর্থাৎ আদিভূতা। সকল বিদ্যা এবং আমরা সকলেও তোমার থেকেই উৎপন্ন হয়েছি। তুমি জগতের সকল বিষয় জান, কিন্তু তোমাকে কেউ জানতে পারে না। তুমি কালী, তুমি তারিণী, তুমি দুর্গা, তুমিই ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ধূমাবতী, তুমিই বগলা, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, তুমিই অন্নপূর্ণা, বাগ্‌দেবী, তুমিই কমলালয়া লক্ষ্মী, তুমি সর্বশক্তিস্বরূপা এবং তুমিই সর্বদেবময়ী। তুমি সাকারা হয়েও নিরাকারা। তুমি মায়া দিয়ে বহুরূপ ধারণ কর, তুমিই সকলের আদি, অনাদি, কর্ত্রী, হর্ত্রী (হননকারিণী) এবং পালিকা। হে দেবি, এই কারণেই তোমাকে বলছি, ব্রহ্মমন্ত্রে দীক্ষিত সাধক যে ফল লাভ করে, তোমার সাধনা করেও সে একই ফল লাভ করতে পারে”।

    তৃতীয় উল্লাসে দেবীর প্রশ্নের উত্তরে মহাদেব শঙ্কর বলেছেন, “হে দেবি, কুলাচার বিনা শক্তিমন্ত্র সিদ্ধিপ্রদ হয় না, অতএব কুলাচারে নিরত হয়েই শক্তিসাধন করতে হবে। হে আদ্যে, শক্তিপূজা বিধানে মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন এই পঞ্চতত্ত্বের কথা বলা হয়েছে। পঞ্চতত্ত্ব ছাড়া সাধকের ইষ্টসিদ্ধি হয় না, পদে পদে বিঘ্ন ঘটে”।
    আবার ষষ্ঠ উল্লাসে, মহাদেব শঙ্কর পঞ্চতত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন,
    মদ্য - “উত্তম মদ্য বা সুরা তিনপ্রকার– গৌড়ী, পৈষ্টী এবং মাধ্বী, এই সুরা তাল, খেজুর, মধু থেকে সঞ্জাত। এই সুরা যেভাবেই তৈরি হোক এবং যেই নিয়ে আসুক, এ বিষয়ে কোন জাতিভেদ নেই, শোধন করলে সর্বসিদ্ধি দান করে। শুদ্ধি বিনা মদ্যপান, বিষপানের তুল্য – সাধক চিররুগ্ন এবং স্বল্পায়ু হয়।
    মাংস – তিন প্রকারের – জলচর, ভূচর, খেচর। এই মাংস যেখান থেকেই আনা হোক বা যে ব্যক্তিই সে প্রাণীর ঘাতক হোক, শোধনের পর কিছু আসে যায় না।  বলিতে পুরুষ-পশু বিহিত, স্ত্রী-পশু হত্যা নিষিদ্ধ।
    মৎস্য– শাল, বোয়াল, রুই মাছ – এই তিন মাছ উত্তম। অন্যান্য কাঁটাহীন মাছ মধ্যম, বেশি কাঁটাযুক্ত মাছ অধম।
    মুদ্রা –চাঁদের মতো শুভ্র, যব অথবা গম থেকে তৈরি এবং ঘিয়ে ভাজা, মনোহর মুদ্রা (লুচি বা পুরি) উত্তম। ধান থেকে তৈরি মুদ্রা মধ্যম। অন্য শস্য (ছোলা, মটর) ভেজে তৈরি মুদ্রা অধম।
    মৈথুন – নিজের দীক্ষিতা পত্নী অথবা শক্তিরূপা দীক্ষিতা পরকীয়া নারী সঙ্গম”।

    সাধারণ জন এই পঞ্চতত্ত্বকেই “পঞ্চ-ম” বলে জানেন এবং বিশেষতঃ এই পঞ্চ-ময়ের কারণেই তাঁদের মনে তন্ত্র-সাধনা সম্পর্কে একটা বিভীষিকা কাজ করে, তাঁদের মনে হয়, তন্ত্রসাধনা মানেই যেন এই “পঞ্চ-ম”-এর অনাচার ও ব্যাভিচার। সাধারণের মন থেকে এই আতঙ্ক ও বিরূপভাব দূর করার জন্যে পরবর্তী অনেক তন্ত্রতত্ত্বে এই পঞ্চতত্ত্বের যে ব্যাখা করা হয়েছে, তার কথাও এখানে বলে রাখি। প্রসঙ্গতঃ বলি, ওপরের পঞ্চ-ম-এর তত্ত্ব বিবৃত করেছেন, স্বয়ং ভগবান মহাদেব, অন্ততঃ মহানির্বাণতন্ত্রে তাই দাবি করা হয়েছে। কিন্তু নিচের এই আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করেছেন পরবর্তী পণ্ডিতগণ -   

    ইড়া ও পিঙ্গলার শ্বাসবায়ুকে একত্র করে, ধীরে ধীরে বায়ু গ্রহণ করতে হয়, তারপর মূলাধার সংকুচিত করে, “হংসঃ”[6]-মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে কুম্ভক করলে, মৎস্য সাধনা হয়। মৎস্য এখানে ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে ঊর্ধমুখী কুল-কুণ্ডলিনী শক্তি।
    এরপর কুণ্ডলিনী শক্তিকে হৃদয়ের অনাহত-পদ্মে এনে পূজা, জপ ও হোম কার্য করতে হবে, তারপর সহস্রার মহাপদ্মের ভেতর পারদের মতো উজ্জ্বল বিন্দুরূপ শিবস্থানের কল্পনা করতে হয়, এরই নাম মুদ্রা সাধনা।
    এর পর সাধক কল্পনায় হৃদয়পদ্ম থেকে ষোড়শী, স্থির যৌবনা, পীন পয়োধরা, সর্বালঙ্কারভূষিতা, রক্তবর্ণা, সুন্দরদর্শনা, মৃদুহাস্যবদনা ইষ্ট দেবীকে সহস্রারপদ্মে ভগবান শিবের কাছে উপস্থিত করবেন। সাধক মৌনী হয়ে আরও চিন্তা করবেন, ওই দেবী ভগবতী ভগবান শিবের কাছে বসে, তাঁর মুখপদ্ম চুম্বন করছেন। এই চিন্তনই মাংস সাধনা।
    এরপর সাধক চিন্তা করবেন, দেবী ভগবতী ভগবান শিবকে আলিঙ্গন করে সঙ্গমে নিরত রয়েছেন, এই সময় সাধক নিজেকে শক্তির সঙ্গে অভিন্ন চিন্তা করে নিজেকে পরমসুখী ও আনন্দময় জ্ঞান করবেন, এই সাধনার নাম মৈথুন।
    এরপর সাধক তাঁর জিহ্বাগ্র দিয়ে তালু কুহর রোধ করে ধ্যান করবেন যে, শিব ও শক্তির মিলন ও বিহারে সুধাক্ষরণ হচ্ছে, সে সুধার স্বাদ তিনি জিহ্বাগ্রে যেন অনুভব করছেন। এই সাধনাই মদ্য সাধনা। এই সময় সাধকের নেশাগ্রস্তের অবস্থা হয়, এই অবস্থাকেই সমাধি বলে। সমাধি অবস্থার যে আনন্দ – সে আনন্দ শরীর ও মনের অব্যক্ত – ভাষায় তার বর্ণনা করা যায় না ।   

    অষ্টম উল্লাসে দেবী পার্বতী প্রশ্ন করলেন, “হে বিভো, বর্তমানে (কলিকালে) বর্ণ ও আশ্রম কী কী? সেই বর্ণে ও আশ্রমে যে আচার-আচরণ বিহিত আছে, সে কথাও আমায় বল”। দেবাদিদেব সদাশিব বললেন, “হে সুব্রতে, সত্য প্রভৃতি তিন যুগে চার বর্ণ ও চার আশ্রমের কথা বলা আছে। কিন্তু কলিকালে বর্ণ পাঁচ - ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং সামান্য, আর আশ্রম দুই – গার্হস্থ্য ও ভৈক্ষুক– ব্রহ্মচর্য ও বাণপ্রস্থ নেই। কলিকালে গৃহস্থদের সকল কাজই আগমোক্ত ও তন্ত্রমতে কর্তব্য। কলিযুগে ভৈক্ষুকাশ্রমেও বেদোক্ত দণ্ডধারণ নেই, কারণ ওটা বৈদিক সংস্কার। কলিতে শৈব সংস্কার বিধি অনুসারে, অবধূতাশ্রম ধারণকেই “সন্ন্যাস গ্রহণ” বলা হয়। কলিযুগে ব্রাহ্মণ এবং অন্য সকল বর্ণেরই এই দুই আশ্রমে অধিকার থাকবে।

    বৃদ্ধ মাতা-পিতা, শিশু পুত্রকন্যা, পতিব্রতা ভার্যা, অসমর্থ বন্ধুজনকে ত্যাগ করে প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাস গ্রহণ নিষিদ্ধ। সাধক গৃহস্থোচিত কর্তব্য শেষ করে, আত্মীয়-স্বজন সকলকে পরিতুষ্ট করে, মমতাশূণ্য, কামনাশূণ্য ও জিতেন্দ্রিয় হয়ে গৃহত্যাগ করতে পারে। গৃহস্থাশ্রম ছেড়ে যদি কেউ সন্ন্যাস গ্রহণে ইচ্ছা করে, সেক্ষেত্রে তাকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী এবং গ্রামের সকলের শুভেচ্ছা ও অনুমতি প্রার্থনা করতে হবে। এর আগের পর্বে (৪.৩.১) আমি লিখেছিলাম বৌদ্ধ ধর্মের বিপুল জনপ্রিয়তার কালে, সমাজের বহু তরুণ এবং যুবক সংসারের দায়িত্ব এড়াতে, সংসার ত্যাগ করে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়ে বৌদ্ধ-বিহারে যোগ দিত। অতএব তন্ত্র-শাস্ত্র রচনার কালে, সমাজের যুবসম্প্রদায়ের সেই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণের জন্যেই সন্ন্যাস গ্রহণে এত বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছিল।     

    সন্ন্যাসীর দেহ কখনও দাহ করা যাবে না, মরদেহ গন্ধপুষ্পে অর্চনা করে, ভূমিতে সমাধি অথবা জলে নিমগ্ন করতে হবে। 

    এখানে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই, দশম উল্লাসের ৭৯ ও ৮০ সংখ্যক শ্লোকে দেবাদিদেব শঙ্কর বলেছেন, “কুলকামিনীকে মৃতা স্বামীর সঙ্গে দগ্ধ করবে না, যেহেতু ওই রমণী জগতে অপ্রকাশিত শরীরা তোমারই (দেবী পার্বতীর) স্বরূপ। মোহবশতঃ কোন রমণী স্বামীর চিতায় উঠলে, সে অবশ্যই নরকগামিনী হবে”। এমন স্পষ্ট নিষেধ সত্ত্বেও এই সেদিন পর্যন্ত সহমরণ ও সতীদাহের হিড়িক উঠেছিল কেন? এই সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার উদ্যোগের জন্যেই ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায়কে সমাজচ্যুত করেছিলেন তৎকালীন হিন্দুসমাজের মাতব্বরেরা। এই ধর্ম প্রথার উৎপত্তি কি, বিধবার সম্পত্তি গ্রাস এবং সংসারে বিধবাকে পালনের ঝামেলা এড়াতে, ব্রাহ্মণ ও সমাজপতিদের বানানো স্বার্থ-ধর্ম? তা ছাড়া আর কীই বা হতে পারে?

    সকল উপাসক বা সাধকের গুরুর কাছে অভিষিক্ত এবং দীক্ষিত হওয়া আবশ্যিক। গুরু ছাড়া তন্ত্র সাধনা হতে পারে না। কৌলগুরু যে কোন সম্প্রদায়ের গুরুপদের জন্য প্রশস্ত, কৌলগুরুর অভাবে নিজ সম্প্রদায়ের গুরু গ্রহণই প্রশস্ত, যেমন শাক্তদের শাক্তগুরু, বৈষ্ণবদের বৈষ্ণবগুরু ইত্যাদি। যিনি সকল বিষয় ব্রহ্মে এবং সকল বিষয়েই ব্রহ্মকে দেখতে পান, তিনিই জীবন্মুক্ত সৎকৌল, তিনিই প্রকৃত কৌলগুরু।     

    মহানির্বাণ তন্ত্রের অন্তিম ও চতুর্দশ উল্লাসে মহেশ্বর শিব সাধকের মুক্তি বিষয়ে বলেছেন, “ব্রহ্মা থেকে সামান্য তৃণ পর্যন্ত সমস্ত জগৎই মায়া এবং মিথ্যা –এক পরমব্রহ্মই সত্য, এই জ্ঞানই পরমজ্ঞান। এই জ্ঞান অর্জন করতে পারলে সমস্ত কর্মবন্ধন এবং “অহং” জ্ঞান থেকে মুক্ত হওয়া যায়। যতক্ষণ দেহাদিতে “অহং” জ্ঞান থাকে, ততক্ষণ জপ, হোম, শতশত উপবাস করলেও মুক্তি হয় না। কিন্তু, “ব্রহ্মই আমি” এই উপলব্ধি হলে, দেহী মুক্ত হয়। “ব্রহ্মই সত্য, আর সমুদায় মিথ্যা” – এই ভাবই উত্তম। ধ্যানভাব মধ্যম। স্তব ও জপতপ অধম। বাহ্যপূজা অধমের থেকেও অধম। যাঁর মনে পরম জ্ঞান উপলব্ধি হয়েছে, তাঁর জপ, যজ্ঞ, তপস্যা, নিয়ম ব্রত প্রভৃতি কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই। মায়ার বশে জ্ঞান, জ্ঞেয়, ও জ্ঞাতা এবং ধ্যান, ধেয় ও ধাতা – এই তিনকে ভিন্ন স্বরূপ মনে হয়, কিন্তু বিচার করলে দেখা যায়, আত্মাই অবশিষ্ট থাকেন। চিন্ময় আত্মাই জ্ঞান ও ধ্যান, চিন্ময় আত্মাই জ্ঞেয় ও ধেয় এবং সেই আত্মাই জ্ঞাতা ও ধাতা। যাঁর এই জ্ঞান হয়েছে, তিনিই আত্মবিৎ - এই জ্ঞান চতুর্বিধ অবধূতের পরমধন”।

    শ্রীভগবতী বললেন, “একটু আগেই তুমি গৃহস্থ ও ভৈক্ষুক – এই দুই আশ্রমের কথা বললে, এখন আবার চার অবধূতাশ্রমের কথা বলছ? চার অবধূত কারা, তাঁদের লক্ষণ কী?”

    শ্রীসদাশিব বললেন, “হে প্রিয়ে, ব্রহ্মমন্ত্রের উপাসক গৃহস্থাশ্রমে বাস করলেও, তাঁদের “যতি” বা ব্রাহ্মাবধূত বলে জানবে। যে সকল মানুষ পূর্ণ অভিষিক্ত হয়ে সংস্কৃত হয়েছেন, তাঁরা শৈবাবধূত। এঁরা সকলের পূজনীয়।  এই অবধূতও দুই প্রকার – পূর্ণ ও অপূর্ণ। পূর্ণ শৈবাবধূত ও ব্রাহ্মাবধূতের নাম পরমহংস। আর যে অবধূতের অদ্বৈতভাবের জ্ঞান পূর্ণ হয়নি, তিনি অপূর্ণ অবধূত। তিনি সর্বদা ব্রহ্মনিষ্ঠ থেকে “ওঁ তৎসৎ” এই মন্ত্র উচ্চারণ করে, “সোঽহমস্মি” এই ধ্যান করতে থাকবেন। “ওঁ তৎসৎ” এই মন্ত্র সর্ব সুখসাধ্য, এই মন্ত্রে কোন বাহুল্য নেই, কিন্ত এই মন্ত্র অনন্ত ফলদায়ক। এই মন্ত্র নিগম, আগম ও তন্ত্র সমুদায়ের সারাৎসার”। 

    মহানির্বাণ তন্ত্রে, বিস্তারিত উল্লেখ না থাকলেও, তন্ত্রতত্ত্বে শব-সাধনাও একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। এই সাধনা বীরভাব-সাধনার অন্তর্গত। বীরভাবের সাধক নির্জন ঘরে, নদী তীরে, পাহাড়, নির্জন স্থানে, বেলগাছের তলায় অথবা শ্মশানের কাছকাছি নির্জন বনে শব সাধনা করতে পারেন। শবসাধনার সময়ের নির্দেশে বলা হয়েছে, কৃষ্ণ কিংবা শুক্ল পক্ষের অষ্টমী ও চতুর্দশী তিথিতে মঙ্গলবারের রাত্রে, এই সাধনা করলে সাধক উত্তমা সিদ্ধি লাভ করতে পারে।

    সাধারণ জনসমাজে তন্ত্রতত্ত্ব নিয়ে যতই বিরূপতা এবং আতঙ্ক থাক, হিন্দু দেব-দেবীর পূজার সঙ্গে তন্ত্র তার মন্ত্র ও যন্ত্র নিয়ে ওতপ্রোত মিশে আছে। যে কোন দেবদেবীর পূজার অধিকাংশই পদ্ধতিই, আমরা না জেনে, তন্ত্রমতের অনুসরণ করে থাকি। যেমন, সমস্ত পূজার সাধারণ কর্মানুষ্ঠান, যেমন আচমন, স্বস্তিবাচন, গন্ধাদির অর্চনা, সঙ্কল্প, ঘটস্থাপন, সামানার্ঘ্য, জলশুদ্ধি, আসনশুদ্ধি, করশুদ্ধি, পুষ্পশুদ্ধি, দ্বারদেবতাপূজা, ভূতাপসারণ ও দিগ্বন্ধন, পঞ্চামৃত শোধন, প্রতিমার চক্ষুর্দান, প্রাণপ্রতিষ্ঠা, আবাহন ইত্যাদির সবই আমরা তন্ত্রমতে করে থাকি। দেব-দেবীর স্তব, পূজা, প্রণাম মন্ত্রগুলি এসেছে, বেদ থেকে, কিছু আচার্য শঙ্করের রচনা, কিছু মন্ত্রের সৃষ্টি করেছেন পুরাণ এবং তন্ত্র।

    তন্ত্রে যন্ত্র বলতে নানান জ্যামিতিক আকারকে বোঝায়। পূজার যজ্ঞবেদী নির্মাণের অনেক বিধি-নিয়ম বেদ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু তন্ত্রে যজ্ঞ ছাড়াও প্রায় প্রত্যেকটি পূজা পদ্ধতির মধ্যে সরল ও বক্র রেখা ব্যবহার করে, তার মধ্যে প্রধানতঃ পাঁচ রঙের চূর্ণ(গুঁড়ি)-র প্রয়োগ আছে। সে আকার ত্রিভুজ, আয়ত, বর্গ, বৃত্ত, স্বস্তিকা, পদ্ম, মীন, কূর্ম ইত্যাদি নানান আকারের হতে পারে। যে কোন পূজায় মেঝে কিংবা দেওয়ালে আল্পনা আঁকার প্রচলনও তন্ত্র-তত্ত্বের শৈল্পিক বিবর্তন বলেই মনে হয়। এই প্রসঙ্গে বলি, স্বস্তিকা, পদ্ম, মীন, কূর্ম ইত্যাদি অনেক প্রতীক বা চিহ্ন সিন্ধুসভ্যতার সিলগুলিতে এবং মৃৎপাত্রের গায়ে চিত্রিত পাওয়া গেছে। অতএব তন্ত্র-ধর্মর অনার্য-সংযোগ এবং তার প্রাচীনতা নিয়ে কোন সংশয় থাকে না।    

    চলবে…
    (পঞ্চম পর্বের সপ্তম ভাগ আসবে ২৩/৯/২০২২ তারিখে।)

    গ্রন্থ ঋণঃ
    ১. মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত মহাভারত – মূল সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ – মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয়। প্রকাশক - বসুমতী সাহিত্য মন্দির, কলকাতা ৭০০০১২।
    ২. শ্রীমদ্ভাগবত– মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস (?) রচিত মূল সংস্কৃত থেকে বাংলায় গদ্য অনুবাদ – সম্পাদনা তারাকান্তকাব্যতীর্থ ভট্টাচার্য।
    ৩. লিঙ্গপুরাণ - মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস (?) রচিত মূল সংস্কৃত থেকে বাংলায় গদ্য অনুবাদ –পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন প্রভৃতি কর্তৃক অনুবাদিত।
    ৪. মহানির্বাণ-তন্ত্রম্‌ – বাংলায় অনুবাদ – শ্রীশ্যামাচরণ  কবিরত্ন।
    ৫. তন্ত্রদর্শন ও সাধনার সারসংক্ষেপ (২০১১) – স্বামী সমর্পণানন্দ, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ ইউনিভার্সিটি, বেলুড় মঠ।
    ৬. শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত (অখণ্ড) – শ্রীম-কথিত – উদ্বোধন কার্যালয়।
      

    [1] কাতি – শাঁখ কাটার দুমুখো করাত, এখানে নিশ্চয়ই দুমুখী ধারাল কোন অস্ত্র।

    [2] অক্ষমালা –জপমালা, জপসংখ্যা গোনার জন্যে সাধারণতঃ রুদ্রাক্ষ, কমলাক্ষ ফল অথবা তুলসীকাঠ থেকে বানানো হত। কাচ, স্ফটিক বা সোনার গুটিকা বা পুঁতি দিয়েও জপমালা বানানোর প্রচলন আছে।  

    [3] কী কাণ্ড, মহাভারত বলছে মদ্য ও পশুমাংস দেবী দুর্গার প্রিয় খাদ্য – কিন্তু আধুনিক ভারত তা মানবে কেন?      

    [4] সন্ধি বিচ্ছেদে নেতি শব্দ হয় ন + ইতি। অর্থাৎ সাধক নিজের চারপাশে এবং তাঁর অন্তরেও ব্রহ্মের স্বরূপ সন্ধান করতে একেকটি বিষয় চিন্তন করবেন, আর একসময় উপলব্ধি করবেন, না এটি নয় – ন ইতি। এইভাবেই ধীরে ধীরে তিনি পৌঁছে যাবেন তাঁর লক্ষ্যে এবং যখন উপলব্ধি করবেন,  “এই আত্মাই ব্রহ্ম” অথবা “আমিই ব্রহ্ম” তখনই তাঁর মোক্ষ ঘটে যাবে।        

    [5] প্রশ্নোপনিষদ– তৃতীয় প্রশ্নের ৫ থেকে ৭ সংখ্যক শ্লোক – অনুবাদঃ লেখক।

    [6] “হংসঃ” - শাক্ত ও শৈব তত্ত্বে একে অজপা মন্ত্র বলে – অর্থাৎ জীবকে এই মন্ত্র জপ করতে হয় না, তার শ্বাস – প্রশ্বাসের সঙ্গে স্বতঃই অহোরহ এই মন্ত্র জপিত হয়। নিশ্বাসের সময় “হং” শব্দে বায়ু শরীর থেকে বের হয়ে আসে, এবং “সঃ” শব্দে বায়ু শরীরে প্রবেশ করে। প্রতি মিনিটে ১৫ বার শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া হয় ধরে নিলে সারাদিনের ২৪ ঘণ্টায় আমরা নাকি ২৪ x ৬০ x ১৫ = ২১,৬০০ হংসঃ মন্ত্র জপ করে থাকি।       
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৮৬১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • guru | 146.196.***.*** | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১০:৫৮512018
  • কিশোরবাবু ,
     
    ভীষণ ভালো লিখছেন | এগিয়ে যান | নতুনকরে ইতিহাসকে আপনি তুলে ধরেছেন | অনেক ধন্যবাদ |
     
    সম্প্রতি দেবদত্ত পট্টনায়ক এর একটি ভিডিও তে একটি ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার দেখলাম |
     
    উনি বলছেন যে "অসুর" এই সংস্কৃত শব্দটি আসলে ইরানের ভাষা "আহুর" থেকে এসেছে | এছাড়া "দেব " এই সংস্কৃত শব্দটিও আসলে ইরানি শব্দ "ডিভাস বা দেভাস" যার অর্থ মন্দ বা খারাপ থেকে এসেছে |
     
    উনি আরো দেখিয়েছেন যে খৃস্ট পূর্ব ইরানে আহুরা বা অসুর দের উপাসনা করা হচ্ছে ও দেভাস বা দেব দের মন্দ বা খারাপ বলা হচ্ছে |
    দেবদত্ত আরো বলছেন যে সমসাময়িক বেদের সময়েও কিন্তু অসুরদের মূল শত্রু বলা হচ্ছেনা |
     
    অথচ পরবর্তী কালে অসুরদেরই মূল শত্রু ও দেবতাদের মূল উপাস্য চিহ্নিত করা হচ্ছে রামায়ণ মহাভারত ও পুরানের আমলে |
     
    আমার মনে পড়ছে যে আজথেকে অনেকদিন আগে নব্বই দশকের সময়ে দূরদর্শনে রামানন্দ সাগরের "আলিফ লায়লা " সিরিজ এও যেখানে অনেক ইরানিয়ান লোককথা আছে সেখানেও কিন্তু বেশ কিছু খলনায়ক চরিত্রকে "দেব" বলে সম্বোধন করা হয়েছিলো | আমার তো এও মনে হয় যে ইংরেজিতে ডেভিল বা শয়তান কথাটি হয়তো এই ইরানীয় ডেভ বা দেব কথাটি থেকেই এসেছে |
     
    আমার প্রশ্ন হচ্ছে অসুর বা আহুর এবং দেব দের ব্যাপারে ইরান ও ভারতের আর্য দের এইরকম এতো ভিন্ন ধারণা হলো কেন ?
     
  • হীরেন সিংহরায় | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০৬512021
  • কিশোর 
     
    অসাধারন । অতুলনীয় । বাংলায় এর তুল্য কিছু জানি না। একটা কথা - বই যখন হবে ছবি স্কেচ থাকা দরকার! দাবিটা জানিয়ে রাখলাম! 
  • Kishore Ghosal | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:৩৪512053
  • গুরুবাবু 
     
    আপনার উৎসাহের জন্য আমার অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা জানাই। 
     
    আর আপনি যে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন,সে নিয়ে আলোচনা করেছি এই গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ ভাগের তৃতীয় অধ্যায়ে - "আর্যদের ভারতে আগমন" প্রসঙ্গে (অধ্যায় ২.৪.৩), যেমন - 
     
    "বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রাচীন ইরানী ভাষা থেকেই বৈদিক ভাষার উদ্ভব। কারণ প্রায় সমসাময়িক কালে প্রাচীন ইরানী ভাষার “আবেস্তা” এবং আমাদের আর্যদের “ঋগ্বেদ”-এর মধ্যে আশ্চর্য সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় – শুধু ভাষাতেই নয়, বিষয়েও। আবেস্তা হল মহান জরথুস্ত্র (Zarathustra) বা জরোয়াস্তার (Zoroaster) ধর্মগ্রন্থ। নিজেদের গোষ্ঠী পরিচয়ে আবেস্তায় বলা আছে তারা “আইরিয়া”, আর ঋগ্বেদে সেই পরিচয় হল আর্য (সঠিক উচ্চারণ আরইয়া)।  দুই ভাষার সব থেকে বেশি অমিল শুধু “হ” এবং “স” অক্ষরের। আবেস্তার হওমা, দাহ, হেপ্তহিন্দু, অহুর, ঋগ্বেদে সোমা, দাস, সপ্তসিন্ধু, অসুর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, ঋগ্বেদের দেবতা এবং অসুরের ধারণা, আবেস্তার ধারণার ঠিক উলটো। যেমন আবেস্তায় ইন্দ্র হল “দয়েব” মানে দৈত্য, কিন্তু ঋগ্বেদে তিনি প্রধান দেবতা - দেব। অহুর মাজদাকে আবেস্তায় পরমেশ্বর মনে করা হয়, অথচ ঋগ্বেদে অসুর মানে দেবতাদের শত্রুপক্ষ
  • Kishore Ghosal | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:৩৯512054
  • হীরেন স্যার,
     
    এই পর্বে কিসের ছবি বা স্কেচ দেওয়া যায়? সিন্ধু সভ্যতায় "তন্ত্র-যন্ত্র"-এর নিদর্শনগুলি? সে তো অজস্র আছে তবে কপিরাইট আইন ভঙ্গের আশঙ্কায় সেগুলি দিতে ভরসা পাইনি।   
  • Kishore Ghosal | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:৪২512055
  • গুরুবাবু,
    আপনার আরেকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে ভুলে গেছি - "আমার প্রশ্ন হচ্ছে অসুর বা আহুর এবং দেব দের ব্যাপারে ইরান ও ভারতের আর্য দের এইরকম এতো ভিন্ন ধারণা হলো কেন"?
     
    সত্যি বলতে এর কোন ঐতিহাসিক তথ্য বা তত্ত্ব পাওয়া যায়নি,পাওয়া সম্ভবও নয় - তবে ওই অধ্যায়ে সেটা নিয়েও আলোচনা করেছি।  
  • Sara Man | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২৩:০৭512060
  • কিশোর বাবু, পূর্ব ভারতে দেবী পুজোর রমরমা বেশি - কারণ এখানে অনার্য উৎস, সংসর্গ সব কিছু বেশি - এইরকম একটি সমানুপাতিক ধনাত্মক  উপসংহার টানা কি ঠিক হবে? দক্ষিণবঙ্গে সতীপীঠগুলির আধিক‍্যে‍র কারণ ও তার মানে এটাই। প্রতিটি শক্তিপীঠের ভৌগোলিক অবস্থান যাচাই করে এটি প্রমাণ করা যেতে পারে। এইভাবে কী কোন গবেষণা হয়েছে?  
  • Kishore Ghosal | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১১:৪৯512076
  • শারদাম্যাম, 
    ঠিকই বলেছেন। আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণ্য মানুষদের কাছে বঙ্গ তথা পূর্বভারত ছিল অনার্য অধ্যুষিত অনাচারের দেশ। যার জন্যে এই অঞ্চলে কেউ এলে, আর্যাবর্তে ফিরে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। এই চিত্রটা পাল্টেছিল জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারের সময় - কারণ ভগবান মহাবীর ও বুদ্ধের মূল কর্মক্ষেত্র ছিল আধুনিক পূর্ব বিহারে - অতএব পূর্বভারতের সঙ্গে মিশ খেতে তাঁদের সন্ন্যাসীদের খুব কিছু অসুবিধে হয়নি। প্রকৃতপক্ষে মৌর্য ও গুপ্ত আমলে উত্তরভারতের সঙ্গে পূর্ব ভারতের ঘনিষ্ঠ সংযোগ গড়ে ওঠে - এবং ততদিনে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উন্নাসিক "ঝাঁজ"ও অনেকটাই প্রশমিত হয়ে এসেছিল। যার ফলে পূর্বভারতের অজস্র  অনার্য দেবী, হিন্দুধর্মের আদ্যাশক্তি মহামায়া কালী বা দুর্গার বিভিন্ন রূপে - শক্তিপীঠের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছি্লেন। 
    এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন গবেষণা হয়েছে কিনা জানিনা, তবে ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের "বাঙ্গালীর ইতিহাস" গ্রন্থে বিষয়টি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করা আছে।  
  • guru | 103.249.***.*** | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:৩৫512081
  • @কিশোরবাবু 
     
    আপনাকে ধন্যবাদ | আমি আপনার প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড যেইখানে আপনি প্রাগৈতিহাসিক সময়ের কথা লিখেছেন পড়লাম | এই লেখাগুলি পড়ে এককথায় বলতে গেলে আমার মনে হলো  রাহুল সাংকৃত্যায়ন এর "ভোলগা থেকে গঙ্গা " এর মতোই আপনিও এক পথিকৃৎ | যেইভাবে আপনি সাধারণ কিছু মানুষ যেমন অগ্নি , পশুপতি মিত্তিকা উসী বিশ্‌ভাই এদের মাধ্যমে প্রাগৈতিহাসিক সময়ের গল্প বলেছেন কেবল মাত্র রাহুল সাংকৃত্যায়ন এর "ভোলগা থেকে গঙ্গা " এর সঙ্গেই এর তুলনা করা যেতে পারে | এক হিসাবে আপনি তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন যেহেতু রাহুল সাংকৃত্যায়ন এর "ভোলগা থেকে গঙ্গা " একটি অনুবাদ কিন্তু আপনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একেবারেই স্বকীয় | চালিয়ে যান |
     
    আপনাকে একটি অনুরোধ করছি আপনি দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক সময়ের কথাও সেই সময়গুলির কোনো চরিত্রের গল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলুন | আমার মতো ইতিহাস অজ্ঞ ব্যক্তির যার ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিতি ও ইতিহাস বোঝার ক্ষমতা কেবল মাত্র ফিকশন গল্পের মাধ্যমে আপনাকে এই অনুরোধটুকুই করতে পারি |
     
    আরেকটি প্রশ্ন আছে আপনাকে | ধর্মাধর্ম - দ্বিতীয় পর্ব - দ্বিতীয় ভাগ এর ২.২.৬ গ্রাম থেকে জনপদ অধ্যায় আপনি বলেছেন "অখণ্ড ভারতের বালুচিস্তানের কোয়েতা অঞ্চলের মেহেরগড়ে নিওলিথিক যুগের বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে বেশ বড় একটি জনপদের প্রত্নতাত্ত্বিক হদিশ পাওয়া গেছে।" অখন্ড ভারত বালুচিস্তান এই সবই তো বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ আমলের রাজনৈতিক ধারণা | বর্তমানে বালুচিস্তান মূলত পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে বিভক্ত একটি ভূখণ্ড পাকিস্তানের অন্তর্গত | এটিকে "অখণ্ড দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের বালুচিস্তানের কোয়েতা অঞ্চলের মেহেরগড়ে নিওলিথিক যুগের বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে বেশ বড় একটি জনপদের প্রত্নতাত্ত্বিক হদিশ পাওয়া গেছে।" বললেই কি সঠিক হতোনা ?
  • Kishore Ghosal | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২১:০৭512114
  • গুরুবাবু,
    "অখণ্ড ভারতবর্ষ" বা "বৃহত্তর ভারত" এই নামটি আমি ব্রিটিশ ভারতের ধারণা থেকেই বলেছি, কারণ আমরা আবাল্য যে ইতিহাস পড়ে বড়ো হয়েছি সে ইতিহাস লেখা হয়েছে ব্রিটিশদের চোখ দিয়েই। তার বদলে হঠাৎ নতুন নাম আনলে confusion হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। 

    প্রকৃতপক্ষে, সিন্ধু উপত্যকা এবং সিন্ধু নদের পূর্বের দেশটিকে পারসীরা বলত হিন্দ (প্রাচীন ইরানী ভাষায় সিন্ধুকে “হিন্দু” বলা হত), গ্রীসের পণ্ডিতেরা বলেছেন ইণ্ডাস, ইন্ডি (তাঁদেরও reference line ছিল সিন্ধু নদ, যাকে তাঁরা Indus বলতেন) ইত্যাদি। অতএব পরবর্তীকালে আরবী প্রভাবে আমাদের দেশের নাম হল হিন্দুস্তান আর ইওরোপিয় প্রভাবে হল ইন্ডিয়া।

    কিন্তু আমাদের ভাগবতপুরাণ থেকে জানতে পারি – এই ভূমণ্ডল (পৃথিবী) সপ্তদ্বীপে বিভক্ত বিরাট একটি সাতকোষী পদ্মের মত। সেই সাতকোষের মাঝখানে আছে জম্বুদ্বীপ। এই জম্বুদ্বীপে আছে নটি বর্ষ, যেমন, তার মাঝখানে আছে ইলাবৃত বর্ষ, তার উত্তরে যথাক্রমে আছে রম্যক বর্ষ, হিরণ্ময় বর্ষ ও উত্তরকুরু বর্ষ। ইলাবৃত বর্ষের দক্ষিণে যথাক্রমে হরিবর্ষ, কিম্পুরুষবর্ষ ও ভারতবর্ষ। ইলাবৃত বর্ষের পশ্চিমে আছে কেতুমালবর্ষ ও পূর্বে ভদ্রাশ্ববর্ষ। ভারতবর্ষের নামটি এসেছে এই অঞ্চলের মহাপরাক্রান্ত পৌরাণিক রাজা ভরতের নাম অনুসারে। রাজা ভরত ছিলেন রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুত্র।

    পুরাণের এই ভৌগোলিক বিবরণ থেকে ভারতবর্ষের সঠিক অবস্থান বুঝে ওঠা অসম্ভব। সেই কারণেই আমাদের দেশের বিংশ শতাব্দীর পণ্ডিতেরা ব্রিটিশদের “Undivided India”-র ধারণাটিকে একটি সনাতন রূপ দিতে, ভারতীয় নাম দিয়েছিলেন “অখণ্ড ভারতবর্ষ”। বাস্তবে এই অখণ্ড দেশটির প্রায় নব্বই শতাংশের রাজা ছিলেন মৌর্য রাজারা – চন্দ্রগুপ্ত, বিন্দুসার ও অশোক এবং মোটামুটি সত্তর শতাংশের রাজা ছিলেন গুপ্ত রাজারা, সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, কুমারগুপ্ত ও স্কন্দগুপ্ত। এই দুই রাজবংশের আমল ছাড়া - আধুনিক ভারতবর্ষ কিংবা অখণ্ড ভারতবর্ষ – হিন্দু বা মুসলিম রাজত্বকালে কোনদিনই এক দেশ বলে বিবেচিত হয়নি। সিন্ধু সভ্যতার যুগে তো এ ধারণার কোন প্রশ্নই ছিল না।   

    সেই কারণেই আমিও সেই অখণ্ড ভারতটিকেই কল্পনা করেছি, যার ষোড়শ মহাজনপদের গান্ধার জনপদটির অবস্থান ছিল আধুনিক পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের কাবুল ও সোয়াৎ উপত্যকায়।  যে জনপদের রাজকন্যা ছিলেন গান্ধারী।

    আর "অখণ্ড দক্ষিণ এশিয় উপমহাদেশ" বলতে আপনি ঠিক কোন সীমানাটুকু নির্দিষ্ট করার কথা ভাবছেন, আধুনিক আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং মায়ানমার?

    পরিশেষে জানাই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা – আমার লেখাটি আপনি মন দিয়ে পড়েছেন, চিন্তা করেছেন, এবং আমাকেও নতুন করে চিন্তা করিয়ে এতকথা লিখতে প্ররোচিত করলেন বলে। আপনাদের মতো পাঠক পেলে লেখার পরিশ্রম সার্থক হয়।                         
     
  • guru | 103.175.***.*** | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২২:৩৪512123
  • অনেক অনেক ধন্যবাদ কিশোরবাবু |
     
    আমি "অখণ্ড দক্ষিণ এশিয় উপমহাদেশ" বলতে , আধুনিক আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং মায়ানমার এবং চীন (তিব্বত) এই ভাবেই বোঝাতে চাইছি |
     
    আমার মনে হয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক দুটি ভিন্ন সংজ্ঞা আছে | রাজনৈতিক ভাবে আমি এই অঞ্চলকে দক্ষিণ এশিয় উপমহাদেশ" বলতে , আধুনিক আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং মায়ানমার এবং চীন (তিব্বত) এই ভাবেই বোঝাতে চাইছি | সংস্কৃতিক ভাবে অনেক ভাবেই এই অঞ্চলকে ব্যাখ্যা করা যায় | আমার মনে হয় আপনি নিজেও অখণ্ড ভারত বলতে সংস্কৃতিগত একটি  কমন পরিচয়ের কথা বলছেন এই সমগ্র অঞ্চলের জন্য | 
     
    সিন্ধু সভ্যতার ও আর্য্য সভ্যতা নিয়ে আমার মাথায় একটি প্রশ্ন ঘুরছে অনেকদিন ধরেই | আপনি আপনার লেখাতে দেখিয়েছেন যে সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক আর্য্য সভ্যতার অনেকখানি অংশই বর্তমান রাজনৈতিক ভূগোল অনুযায়ী পাকিস্তানে পড়ছে | তাহলে পাকিস্তান কি সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক আর্য্য সভ্যতাকে দাবি করতে পারে নিজেদের পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতার অংশ করে যেইভাবে আমরা ভারতে করি ? বর্তমানে কিছু পাকিস্তানের ইন্টেলেক্চুয়ালদের কথা শুনে মনে হয় তারা এইরকম কিছু একটি করার কথা ভাবছেন |nicher এই লিংকটি দেখুন , এই ভদ্রলোক অত্যন্ত সুনিপুনভাবে পাকিস্তানকে একটি স্বতন্ত্র সভ্যতা বলে দাবি করছেন যেইখানে সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক আর্য্য সভ্যতা ভৌগোলিক কারণে এই পাকিস্তানী সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ | (17:48) মিনিট এই নিচের ভিডিও টি দেখলেই বুঝতে পারবেন যেখানে যিনি নিজেকে "ইন্দাস ম্যান " বলে দাবি করছেন | এই ভদ্রলোক পাকিস্তানের প্রাক্তন মন্ত্রী |
     
     
    এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক আর্য্য সভ্যতা বর্তমান ভূ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কে দাবি করতে পারে ? এদুটি পাকিস্তানী সভ্যতার না ভারতীয় সভ্যতার অংশ ? এই বিতর্কের মধ্যে আমার মনে হয় এই দুটি সভ্যতাকে অখণ্ড দক্ষিণ এশিয় উপমহাদেশ এর সভ্যতা বলে দাবি করা সঠিক কূটনৈতিক ভাবে | আপনার এই বিষয়ে মতামতের অপেক্ষাতে রইলাম |
     
    সিন্ধু সভ্যতা  নিয়েও আপনার মনোজ্ঞ প্রবন্ধ দুটি (পর্ব ২ ভাগ ৩ ও ভাগ 4)আরো মন দিয়ে পড়ছি | কয়েকটি প্রশ্ন রয়েছে সেইগুলি নিয়ে পরে আপনাকে জানাবো |
     
    শুধু পরিশেষে বলি আপনি এক অতুলনীয় কাজ করছেন | চালিয়ে যান | আরো যদি কয়েকটি গল্প পেতাম বিশেষত সিন্ধু সভ্যতার পতন ও বৈদিক আর্য্য সভ্যতার বিকাশ নিয়ে সেই সময়কার মানুষের চোখ দিয়ে তাহলে আমার মনে হয় আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ইতিহাসটাকে ভালোবেসে ফেলতে পারতো |
     
     
  • Kishore Ghosal | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৩:০৬512139
  • গুরুবাবু, 
     
    রাজনৈতিক স্বার্থে ইতিহাসকে বিকৃত করা আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আধুনিক সভ্যতার আদিকাল থেকে বিজয়ী দেশ বিজিতদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করেছে বারবার, সে প্রক্রিয়া আজ আমাদের দেশেও অতি সক্রিয়। তা নাহলে মোগলসরাইয়ের নাম বদলে যায়? নাকি বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির তৈরি হয়? কিন্তু রামমন্দিরের ভিতের তলায় বৌদ্ধস্তূপের নিদর্শন পাওয়া গেল কিনা, সে কথা সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাই। 
     
    আমরা হয়তো ততদিন থাকবো না, কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্মরা ভুলেই যাবে, একদা এই দেশ মুসলিম শাসনাধীন ছিল, এবং মুসলিম শাসকরা আমাদের দেশের বহু প্রাচীন মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছিল। যেমন আমরা ভুলে গেছি আমরা (হিন্দুরা) বহু বৌদ্ধ বিহার ও স্তূপ ভেঙে হিন্দু মন্দির বানিয়েছিলাম। বৌদ্ধদের অজস্র শাস্ত্র-পুঁথি আমাদের হিন্দু পূর্বপুরুষেরা নিঃশেষে ধ্বংস করেছিলেন - সৌভাগ্যক্রমে  যার অধিকাংশই আমরা ফিরে পেয়েছি - প্রতিলিপি বা অনূদিত অবস্থায় - তিব্বত, নেপালের বৌদ্ধ বিহারগুলি থেকে। এই অপ্রিয় সত্যগুলি আমরা সযত্নে - সচেতনে এড়িয়ে যাই। 
     
    তাই, পাকিস্তান যা করতে চেয়েছে সেটা আমার কাছে তেমন অভিনব মনে হল না। 
     
    এবার আসি মূল প্রসঙ্গে, সিন্ধু সভ্যতার সিংহ ভাগ ভৌগোলিক অঞ্চলই যে অধুনা পাকিস্তানে এবং কিছু আফগানিস্তানে  - সে কথা তো কঠিন বাস্তব। কিন্তু আমরা - ভারত ও পাকিস্তান - কোন দেশই সেই সভ্যতার যোগ্য উত্তরসূরী এমন বলার তো কোন জায়গাই নেই। আমরা সিন্ধুসভ্যতার এতগুলি, নগর, জনপদ, গ্রামের অস্তিত্বই ভুলে গেছিলাম। এই সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার আমাদের আয়ত্ত্বের বাইরে। এই সভ্যতার বা এই অঞ্চলের কী নাম ছিল, এখানকার অধিবাসীরা নিজেদের কী বলে পরিচয় দিত, সে কথাও আমরা বিস্মৃত হয়েছি। বরং মেসোপটেমিয়ার প্রত্নলিপি থেকে এ বিষয়ে কিছু কিছু তথ্য আমরা জেনেছি - কিন্তু এই সভ্যতা সম্পর্কে তথ্য তো দূরের কথা -  আমাদের  স্মরণে এতটুকু জনশ্রুতিও অবশিষ্ট নেই! জনশ্রুতি এটুকুই - "মহেঞ্জোদরো - মানে মৃতের সমাধি বা ঢিবি"! যার থেকে তার আড়ালে থাকা এত উন্নত একটা সভ্যতার কোন হদিশ পাওয়াই যায় না।
     
    আমাদের দেশে (আধুনিক ভারতে) বণিক হিসেবে দুটি গোষ্ঠীর সুপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে - একটি গুজরাটি, অন্যটি ম্যাঙ্গালোরের শেট্‌ঠি সম্প্রদায়। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় - সিন্ধুসভ্যতার বিস্মৃত বাণিজ্যিক পরম্পরা এই দুটি গোষ্ঠীই আজও বহন করে চলেছেন। কারণ গুজরাটের "লোথাল" এবং "ধোলাভিরা" বন্দর - জনপদ দুটি সিন্ধুসভ্যতার প্রধানতম সমুদ্রবন্দর ছিল সুদীর্ঘ প্রায় দেড়হাজার বছর ধরে। 
     
    আর্যাবর্ত এবং ষোড়শ মহাজনপদের কিছু জনপদ আধুনিক পাকিস্তান - আফগানিস্তানে ছিল বৈকি!  আলেকজাণ্ডারের ভারতবিজয় মানেও তো আধুনিক আফগানিস্তান ও পাকিস্তান বিজয়। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাস নিকেটারকে পরাজিত করে আধুনিক আফগানিস্তান অধিকার করেছিলেন, তাঁর পুত্র যুবরাজ অশোক গান্ধার-তক্ষশিলার ভাইসরয় ছিলেন। গুপ্ত সম্রাট স্কন্দগুপ্ত আধুনিক পাকিস্তান - আফগানিস্তান সীমান্তে হুণদের ঠেকাতে অজস্র বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন। 
    পাকিস্তানের নিজস্ব ইতিহাস ১৯৪৭ থেকে শুরু - কিন্তু তার পূর্ববর্তী ইতিহাস যে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত - একথা মুছে দেওয়া - বদলে ফেলা সম্ভব? আমার তো মনে হয় না। 
     
    বড়ো বেশী দীর্ঘ করে ফেললাম। আপনার ধৈর্যচ্যুতি না ঘটে।              
  • guru | 146.196.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:১৪512164
  • কিশোরবাবু 
     
    অনেক ধন্যবাদ এত বিস্তারিত ভাবে আপনার বক্তব্য বলার জন্য | গুরুতে আপনার ও হিরেনবাবু এই দুজনেরই লেখার আমি ফ্যান | অনেক কিছুই শিখি আপনাদের দুজনের থেকে |
     
    আমাদের দেশে ইতিহাস নিয়ে যে সাধারণ মানুষের এতো জ্ঞানের অভাব সেই নিয়ে আপনার বক্তব্য এর আমি সমর্থন করি | আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি , বাংলাতে ১৮ শতকের মারাঠা বা বর্গী আগ্রাসন নিয়ে আমি অনেকটা বয়সেও প্রায় কিছুই জানতামনা এই ইতিহাস আমি জেনেছি সুনীল বাবুর "অন্ধকারের বন্ধু " উপন্যাসটি থেকে | আমি সত্যি কথা বলতে কি দাক্ষিণাত্যে শৈব চোলা রাজাদের তাদের বৈষ্ণব প্রজাদের ওপর আক্রমণ ও অত্যাচার যেটি আরো বৃহত্তর শৈব বৈষ্ণব বিরোধ ও সংঘর্ষের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র সম্বন্ধেও কিছুই জানতাম না যতক্ষণ না ২০০৭ সালে আমি চেন্নাই তে কমল হাসানের "দশাবতার" সিনেমাটি দেখি |
     
      ইতিহাস নিয়ে যে সাধারণ মানুষের এতো জ্ঞানের অভাব এর দুটি মূল কারণ আছে আমি মনে করি | ১ | ভারতে লিখিত তথ্য ভিত্তিক ইতিহাসের পরিমান খুব সীমিত , প্রায় নেই বললেই চলে | লিখিত তথ্য ভিত্তিক ইতিহাসের না থাকার কারণেই খুব সম্ভবত লোককথা রামায়ণ পুরাণ এইগুলিতে আমাদের ইতিহাসের সন্ধান করতে হয় |  এই একটি ব্যাপার যার জন্য ভারতে এক প্রজন্মের ইতিহাস ও সেই প্রজন্মের উপলব্ধি পরবর্তী প্রজন্ম এর মধ্যে ট্রান্সফার করেনা | 
     
    চীনের সঙ্গে ভারতের সম্ভবত এটাই মূল পার্থক্য যে ভারতের তুওলনাতে সেখানে লিখিত ইতিহাসের পরিমান অনেক বেশি | অশ্বঘোষ প্রভৃতির লেখা আমরা পেয়েছি পরবর্তীকালের চীনা পর্যটক সুয়ান জাঙ (xuan zang) এর লেখা থেকে যেহেতু মূল গ্রন্থগুলির আর অস্তিত্ব নেই |
     
    এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ হচ্ছে যে সিন্ধুসভ্যতার নর্দমার ব্যবহার | আমি মনে করি যে সিন্ধুসভ্যতার হয়তো সবচেয়ে বড় অবদান হতো নর্দমার ব্যবহার | এটি এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি অবদান যে আমরা দেখি কয়েক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানে প্রবল বন্যাতে সিন্ধু প্রদেশের মহেঞ্জোদড়ো এলাকাটি পুরো ডুবে যায় | যেহেতু এটি একটি গ্লোবাল হেরিটেজ সাইট তাই কয়েকদিনের মধ্যেই বিশেষজ্ঞরা গিয়ে দেখেন যে মহেঞ্জোদড়ো এলাকাটি থেকে প্রায় সব জল নেমে গেছে সেখানকার ৫০০০ বছর আগের নর্দমা সিস্টেমের জন্য কিন্তু আসে পাশে জেলাগুলিতে এখনো জল আছে | তাহলেই দেখুন এই ধরণের একটি নর্দমার সিস্টেম আমাদের সময়ে ব্যবহার করা থেকে আমরা বঞ্চিত যেহেতু সেই আমলের কোনো সুরক্ষিত ইতিহাস নেই আমাদের কাছে |
     
    আমি এই কারণেই হিরেনবাবু ও আপনার কাছে কৃতজ্ঞ যে আপনারা আপনাদের জীবনের বিপুল অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাচ্ছেন যা অসম্ভব মূল্যবান হতে যাচ্ছে আজ থেকে ২৫-৩৫ বছর পরের প্রজন্মের কাছে |
     
    ২ | আরেকটি বড়ো কারণ হলো যে একটি সাম্রাজ্য চলে যাবার পরের সাম্রাজ্য আগের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে মুছে দিয়েছে এই একটি প্যাটার্ন আমরা দেখতে পাচ্ছি | যেই কারণে মৌর্য্য যুগের ইতিহাস pushyomitro শুঙ্গ এসে ধ্বংস করেছে আবার যেমন মৌর্য্য বংশ তার আগের নন্দ বংশ ইতিহাস ধ্বংস করেছিল | বর্তমানেও এই প্রবণতা আছে |
     
    ভারতের তথা হিন্দুধর্মের ইতিহাসের ক্ষেত্রে বারবার বলা হয় বৈচিত্র ও সহনশীলতার কথা| অথচ নিজেদের পুরানো ইতিহাস সম্বন্ধে এতো অসহিষ্ণুতা কেন এটি একটি কন্ট্রাডিকশন ব্যাপার এই দেশের সভ্যতার ক্ষেত্রে যেটি আমি বুঝে উঠতে পারিনি |
     
    আপনার মতামতের অপেক্ষাতে রইলাম |
     
     
  • r2h | 192.139.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:২১512165
    • guru | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:১৪
    • "...একটি সাম্রাজ্য চলে যাবার পরের সাম্রাজ্য আগের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে মুছে দিয়েছে এই একটি প্যাটার্ন আমরা দেখতে পাচ্ছি | যেই কারণে মৌর্য্য যুগের ইতিহাস pushyomitro শুঙ্গ এসে ধ্বংস করেছে আবার যেমন মৌর্য্য বংশ তার আগের নন্দ বংশ ইতিহাস ধ্বংস করেছিল | বর্তমানেও এই প্রবণতা আছে |

      ভারতের তথা হিন্দুধর্মের ইতিহাসের ক্ষেত্রে বারবার বলা হয় বৈচিত্র ও সহনশীলতার কথা| অথচ নিজেদের পুরানো ইতিহাস সম্বন্ধে এতো অসহিষ্ণুতা কেন..."
    অন্য লোকেরা নিজেদের নয়, ওরা আমরা নই, তাই। সব প্রাচীন সভ্যতাতেই তো তাই, গ্রীক রোমান। অন্য লোকেদের ইতিহাস রক্ষায় কার দায়?
  • guru | 146.196.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২২:৪২512170
  • বুঝলাম r2h |  কিন্তু কখনো কখনো কিছু বিষয় থাকে যেইগুলি একটি বিশেষ সাম্রাজ্য চালু করলেও পরবর্তীকালের সময়ে সেটি কাজে লাগে | এই দেশেরও এইরকম উদাহরণ আছে | আকবরের আমলে যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন ভূমি রাজস্ব সংস্কার এর ব্যাপারে সেই রাজা টোডরমল কিন্তু আকবরের ঘোর শত্রু শেরশাহের আমলের লোক ছিলেন এবং তার প্রায় সব পরিকল্পনা মূলত এসেছিলো শের শাহের পৃষ্টপোষকতায় কিন্তু আকবর এই লোকটির কাজের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাকে ও তার ভূমি রাজস্ব সংস্কার নীতি চালু রেখেছিলেন |
     
    xuan zang নিজেও কিন্তু অনেক সময় ও পরিশ্রম ব্যয় করে অনেক বছর ভারতে থেকে সেখান থেকে অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে নিয়ে যান যদিও ততদিনে চীনে রাজনৈতিক পালা বদল হয়ে গেছে কিন্তু নতুন রাজাও তাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে তার রচিত গ্রন্থগুলি প্রচারের ব্যবস্থা করে দেন | xuan zang এর মৃত্যুর পরেও কিন্তু চীনের অন্য সাম্রাজ্যের শাসকরা তার কাজ কে ফেলে দেননি |
     
    ঘটনা হচ্ছে যে রামায়ণ ও মহাভারত এই দুই জায়গাতেই কিন্তু পরাজিত শত্রুর কাছ থেকে শিক্ষা নেবার উদাহরণ আছে | মহাভারতে যুধিষ্ঠির ভীষ্মের কাছ থেকে ও রামায়ণে রাম রাবনের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন | কিন্তু বাস্তবে এই নীতি রূপায়ণ আকবরের মতো খুব কম লোকই করতে পেরেছিলেন সেই কারণেই প্রকৃত রেকর্ডেড ইতিহাস ভারতে সেইরকম নেই |
  • Kishore Ghosal | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০৭512176
  • গুরুবাবু, 
     
    আপনার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর  r2hবাবু দিয়ে দিয়েছেন। কাজেই সে কথার পুনরাবৃত্তি করছি না। 
     
    তবে আপনার "ভারতের তথা হিন্দুধর্মের ইতিহাসের ক্ষেত্রে বারবার বলা হয় বৈচিত্র ও সহনশীলতার কথা" এই মন্তব্যে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। বৈচিত্র ও সহনশীলতা বৃটিশযুগে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ বিশিষ্ট কিছু কবি দার্শনিকের কথা। বাস্তবে এমন মানসিকতা সারা বিশ্বে কদাচিৎ দেখা যায় - এবং দেখা গেলেও সেটা দৈবাৎ ও ব্যতিক্রমী।
     
    দেশ বা সমাজের অর্থনীতি যতদিন স্বচ্ছল ও  স্বাস্থ্যবান থাকে - ততদিন এই  মানবিক মানসিকতা অর্থাৎ মূল্যবোধ অনেকটাই রক্ষা করা যায়, কিন্তু যখনই সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক অবক্ষয় ঘটতে থাকে, মানবিক প্রবৃত্তি ও মূল্যবোধেরও দ্রুত অধঃপতন ঘটতে থাকে।  
     
    এই বিষয়গুলি নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা আসবে এই পর্বের সপ্তম ভাগে এবং অষ্টম ও উপসংহার ভাগে। একটু ধৈর্য নিয়ে পড়তে থাকুন, প্লিজ।  
  • হীরেন সিংহরায় | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১০:৫৯512198
  • কিশোর 
     
    যথার্থ বলেছেন। বিজয়ীরা ইতিহাস লেখে । বিজিতের কথা কে মনে রাখে।

    আজকের পোল্যান্ড লাটভিয়া এস্টোনিয়া লিথুয়ানিয়ার প্রায় সকল প্রাচীন অট্টালিকা বিশ্ববিদ্যালয় গিরজে বানিয়েছিলেন টিউটনিক নাইটরা।   এই মাত্র আটশো বছরের ইতিহাস ! প্রতিটি জমিদার বাড়ি দুর্গের নাম বদলেছে। উদাহরণ হাজার হাজার ।  ১৫শ শতাব্দীতে তৈরি প্রাশিয়ান মারিয়েনবুরগ দুর্গ সম্পূর্ণ ইটের এবং আয়তনের হিসেবে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো । আজ তার নাম মালবর্ক , পোল্যান্ড। প্রাশিয়ানদের নাম খুঁজে পাওয়া শক্ত।  স্পেনের করডোবা এবং সেভিয়ার বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল ছিল মসজিদ , ইস্তানবুলের হায়া সফিয়া (পুণ্য জ্ঞান ) সম্রাট জাস্তিনিয়ানের আদেশে বানানো ক্রিসটান দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো ক্যাথেড্রাল, পরে মসজিদ, মিউজিয়াম এবং আবার মসজিদ।

    নাইজেরিয়ান লেখক চিনুয়া আচেবে বলেছেন ‘ যতদিন অবধি সিংহ তার আপন ঐতিহাসিক না যোগাড় করতে পারছে, শিকারের  গল্প শিকারির শৌর্য গাথা গাইবে’ ।
     
  • Kishore Ghosal | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১১:১৫512199
  • "নাইজেরিয়ান লেখক চিনুয়া আচেবে বলেছেন ‘ যতদিন অবধি সিংহ তার আপন ঐতিহাসিক না যোগাড় করতে পারছে, শিকারের  গল্প শিকারির শৌর্য গাথা গাইবে’ "।
    ওঃ এমন অদ্ভূত সত্য কথা বহুদিন শুনিনি। লেখক চিনুয়া আচেবের নাম শুনিনি - না শোনারই কথা - আমরা ইওরোপ, আমেরিক, লাতিন আমেরিকা ছাড়া আর কোন বইয়ের খবর পাই - লেখককে আমার প্রণাম? 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন