এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • ধর্মাধর্ম - চতুর্থ পর্ব - সপ্তম  ভাগ 

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ০৭ আগস্ট ২০২২ | ১২৬১ বার পঠিত | রেটিং ৪ (৩ জন)
  • চতুর্থ পর্ব - থেকে ১৩০০ সি.ই. – সপ্তম ভাগ

    ৪.৭.১ মালবের পরমার বংশ
    শোনা যায়, পরমার বংশের উৎপত্তি হয়েছিল পৌরাণিক বশিষ্ঠ মুনির যজ্ঞবেদী থেকে। কিন্তু সম্প্রতি আবিষ্কৃত একটি শিলালিপি থেকে জানা গেছে, পরমার বংশ দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশের একটি শাখা।

    সেকালের উজ্জয়িনী নগর বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্বের বিচারে, মধ্যভারতের সব থেকে উন্নত শহর ছিল। গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের পর বহু রাজবংশই এই শহরে আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করতেন। তাঁদের  মধ্যে অন্যতম ছিলেন, রাষ্ট্রকূট, কিন্তু তাঁরা উজ্জয়িনীর ওপর অধিকার ধরে রাখতে পারেননি। পরবর্তী কালে প্রতিহার বংশের রাজারা বেশ কয়েক বছর উজ্জিয়িনী তাঁদের অধিকারে রেখেছিলেন। অনুমান করা হয়, প্রতিহার রাজাদের সামন্তরাজা হিসাবেই উজ্জয়িনী বা মালবের পরমার বংশের সূত্রপাত। পরমার বংশের প্রথম যে শাসকের নাম জানা যায়, তিনি শিয়াক-হর্ষ, তিনি ৯৪৯-৭২ সি.ই. পর্যন্ত উজ্জিয়িনীর শাসক ছিলেন। কিন্তু এই পর্যায়ে প্রতিহার বংশের রাজারা দুর্বল হয়ে পড়াতে, শিয়াক-হর্ষ সামন্ত রাজা থেকে নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

    শিয়াক-হর্ষ রাজা হয়ে ওঠায় রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় কৃষ্ণ (৯৫৫-৭০ সি.ই.), উজ্জয়িনী আক্রমণ করেছিলেন, কিন্তু শিয়াক-হর্ষ তাঁকে পরাজিত করেন। শিয়াক-হর্ষ কিছু হুণ গোষ্ঠী রাজাদেরও পরাজিত করে, অবন্তী রাজ্য এবং উজ্জিয়িনী নগরে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাঁর পুত্র বাকপতি অথবা মুঞ্জা রাজা হয়েছিলেন ৯৭৪ সি.ই.-তে। শোনা যায়, কলচুরি, কর্ণাট, চোল এবং কেরালার রাজারা তাঁর তলোয়ারের সামনে মাথা নত করেছিলেন। তবে তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব, চালুক্য রাজা দ্বিতীয় তৈলপের আক্রমণ তিনি অন্ততঃ ছবার প্রতিহত করেছিলেন। জৈন গ্রন্থকার মেরুতুঙ্গের “প্রবন্ধ চিন্তামণি” থেকে জানা যায়, সপ্তমবার চালুক্যদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় বাকপতি-মুঞ্জ, তাঁর মন্ত্রীদের পরামর্শ না শুনে, গোদাবরী পার হয়ে চালুক্য রাজ্যের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েন। সেখানেই তিনি বন্দী হন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর মৃত্যুর কাল অনুমান করা হয় ৯৯৩-৯৪ সি.ই., এর কিছুদিন পরেই ৯৯৭-৯৮ সি.ই.-তে দ্বিতীয় তৈলপের মৃত্যু হয়। বাকপতি মুঞ্জ শুধু রণদক্ষ রাজাই ছিলেন, তা নয়, তিনি প্রজাদের হিতের জন্যে অনেক সরোবর এবং মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। ধারা শহরের মুঞ্জসাগর সরোবর, তাঁরই স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে। তাঁর সভায় কবি ও বিদ্বানরা অত্যন্ত সম্মানীয় ছিলেন, যেমন পদ্মগুপ্ত, ধনঞ্জয় (“দশরূপ” গ্রন্থ প্রণেতা), ধনিক (“দশরূপাবলোক” গ্রন্থ প্রণেতা) এবং ভট্ট হলায়ুধ, যাঁর রচনা দুই বিখ্যাত গ্রন্থ,“মৃতসঞ্জীবনী” এবং “অভিধান-রত্নমালা”।
     
    বাকপতি-মুঞ্জের পর রাজা হয়েছিলেন, তাঁর ছোট ভাই সিন্ধুলা বা সিন্ধুরাজা বা নবশশাঙ্ক। তিনিও কলচুরি, হুণ এবং চালুক্যদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। সিন্ধুলার সংক্ষিপ্ত রাজত্বের পর রাজা হয়েছিলেন, বাকপতি-মুঞ্জের পুত্র ভোজ। তিনি রাজধানী সরিয়ে আনেন ধারাতে। উদেপুর প্রশস্তিতে তাঁকে “সার্বভৌম” বলা হয়েছে, এবং তিনি কৈলাশ থেকে মলয় পর্বত পর্যন্ত “সমগ্র পৃথিবীর রাজা” বলেও দাবি করা হয়েছে। তিনি পিতার হত্যার প্রতিশোধে চালুক্যদের আক্রমণ করে পঞ্চম বিক্রমাদিত্যকে পরাস্ত এবং হত্যা করেন, ১০০৮ সি.ই.-তে। যদিও দাক্ষিণাত্যের এই সাফল্য তাঁকে হারাতে হয়েছিল ১০১৯ এ.ডি-তে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় জয়সীমার (১০১৬-৪২ সি.ই.) কাছে। এরপরেও তিনি নিরন্তর যুদ্ধ করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সঙ্গে, উত্তরের কনৌজ অধিকারের জন্যে, এমনকি “তুরুষ্কু” (মুসলিম)-দের সঙ্গেও। এই মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তিনটি রাজ্য একত্র হয়েছিলেন, কলচুরিরাজ লক্ষ্মীকর্ণ, পরমার-রাজ ভোজ এবং অনহিলওয়াড়ার রাজা প্রথম ভীম। এই যুদ্ধের সময়েই প্রায় পঞ্চান্ন বছর রাজত্বের পর রাজা ভোজের মৃত্যু হয়। রাজা ভোজের মৃত্যুর পর এই মিত্র রাজ্যগুলিই রাজধানী ধারা এবং মালব অধিকার করে নিয়েছিল।

    রাজা ভোজ যেমন অসি চালনায় দক্ষ ছিলেন, তেমনই দক্ষ ছিলেন বিদ্যাচর্চায়। তিনি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অন্ততঃ চব্বিশটি গ্রন্থ লিখেছিলেন, যেমন “আয়ুর্বেদ-সর্বস্ব”, “রাজমৃগাঙ্ক”, “ব্যবহার-সমুচয়”, “শব্দানুশাসন”, “সমরাঙ্গণ-সূত্রধর”, “সরস্বতী-কণ্ঠাভরণ”, “নাম-মালিকা”, “যুক্তি-কল্পতরু”, ইত্যাদি। তিনি ধারা শহরে “ভোজ-শালা” নামে একটি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে দূরদূরান্ত থেকে বিদ্যার্থীরা পড়তে আসতেন। পরবর্তী কালে মুসলিম রাজত্বের সময় এটিকে মসজিদ বানিয়ে তোলা হয়েছিল। রাজা ভোজ শৈব ছিলেন, সমস্ত রাজ্য জুড়ে তিনি অজস্র সুন্দর মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। আধুনিক ভূপালের দক্ষিণে নতুন ভোজপুর শহর নির্মাণ করিয়েছিলেন।
     
    রাজা ভোজের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন মালব নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছিলেন, চালুক্য, কলচুরি এবং অন্যান্য প্রতিবেশী রাজ্যের রাজারা। অবশেষে মালব থেকে ১৩০৫ সি.ই.-তে পরমার বংশের নাম মুছে দিলেন, আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি আইন-উল-মুল্‌ক্‌।

    ৪.৭.২ অনহিলওয়াড়ার চালুক্য (সোলাংকি) বংশ
    অনহিলওয়াড়া বা অনহিল-পাটককে আধুনিক গুজরাটের পাটন বলে চিহ্নিত করা হয়। চালুক্য বা সোলাঙ্কি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মূলরাজ। এই চালুক্যদের সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের চালুক্যদের (যাঁদের কথা পরের অধ্যায়ে আসবে) কোন সম্পর্ক ছিল কিনা অথবা তাঁরাই সৌরাষ্ট্রর (কাথিয়াওয়াড়) চালুক্য গোষ্ঠী কিনা, সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে গুজরাটের লোককথা থেকে জানা যায়, মূলরাজের পিতা ছিলেন, রাজি, কনৌজের এক রাজকুমার কল্যাণকটকের পুত্র। এবং তাঁর মাতা ছিলেন চাবড় বা চাপোটক বংশের কন্যা, যাঁরা চালুক্যদের আগে গুজরাটের ছোট কোন অঞ্চল শাসন করতেন। লোককথায় এমনও শোনা যায়, মূলরাজ তাঁর মাতুলকে হত্যা করে, চাপোটকের সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। এই ঘটনা মোটামুটি ৯৪১ সি.ই.-র। সিংহাসনে বসেই মূলরাজ রাজ্য অধিকারে মন দিলেন। তিনি কচ্ছের লক্ষরাজাকে পরাজিত ও হত্যা করলেন। সৌরাষ্ট্রের বামনস্থলীর (আধুনিক ওয়ানথালি) চূড়াসামা গোষ্ঠীর রাজা গ্রহরিপুকে বন্দী করলেন। দক্ষিণ গুজরাটের লাট অঞ্চলের বারাপ্পা এবং শাকম্ভরীর চাহমান রাজা বিগ্রহরাজকেও আক্রমণ করলেন। যতদূর জানা যায়, ৯৯৫-৯৬ সি.ই.-তে তাঁর মৃত্যু হয়।

    চালুক্য বংশের পরবর্তী রাজা প্রথম ভীম, ইনি মূলরাজার নাতি দুর্লভরাজের ভাইপো ছিলেন। তাঁর রাজত্বকাল মোটামুটি ১০২১ সি.ই. থেকে ১০৬৩ সি.ই. পর্যন্ত। প্রথম ভীমের রাজত্বকাল গজনির সুলতান মামুদের বীভৎস অভিযানের জন্যে অবিস্মরণীয়। ১০২৫ সি.ই.-তে সুলতান মামুদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গুজরাটের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন। তিনি শুনেছিলেন, যুগ যুগ ধরে ওই মন্দিরে বিপুল সোনা, মণিরত্ন-সম্পদ সঞ্চিত আছে। সুলতান মামুদ রাজস্থানের মরু অঞ্চল পেরিয়ে প্রথমেই পৌঁছলেন অনহিলওয়াড়ার সীমান্তে। রাজা প্রথম ভীম সুলতান মামুদের সেনাবাহিনী দেখে আতঙ্কিত হয়ে, কোন রকম প্রতিরোধ না করে, পালিয়ে গেলেন। সুলতান মামুদ বিনা বাধায়, সোমনাথ নগর, সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করলেন এবং নগরের ব্রাহ্মণ ও সাধারণ মানুষ, যাঁরা দুর্বল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের গণহত্যা করলেন। তারপর মন্দিরের সমস্ত সম্পদ লুঠ করে, সোমনাথের মূর্তি ভেঙে গজনি ফিরে গেলেন। শোনা যায়, এই ভাঙা মূর্তির টুকরো দিয়ে তিনি জামা-মসজিদের প্রবেশের সিঁড়ি বানিয়েছিলেন।

    সুলতান মামুদ ফিরে যাওয়ার পর, প্রথম ভীম আবার তাঁর রাজ্য এবং রাজধানীতে ফিরে এলেন। অনতিবিলম্বেই তিনি আবুর পরমার প্রশাসককে পরাজিত করলেন, কিন্তু পরমার ভোজের সেনাপতি কুলচন্দ্রের কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন। এরপর তিনি কলচুরিরাজ লক্ষ্মী-কর্ণের সঙ্গে জোট বেঁধে মালব রাজ্যের ব্যাপক ক্ষতি করেছিলেন। রাজা ভোজের মৃত্যুর পর কলচুরিদের সঙ্গে প্রথম ভীমের সখ্যতা ভেঙে যায়, এবং প্রথম ভীম লক্ষ্মী-কর্ণকে পরাজিত করেন। এই সুযোগেই মালবের পরমার রাজারা আবার স্বাধীন রাজ্য হয়ে উঠেছিল।

    প্রথম ভীমের পর রাজা হলেন তাঁর পুত্র কর্ণ (১০৬৩-৯৩ সি.ই.)। তাঁর সময়ে পরমার রাজত্ব আবার শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, কারণ পরমার রাজা উদয়াদিত্য রাজা কর্ণকে পরাস্ত করেছিলেন। রাজা কর্ণ অজস্র মন্দির এবং সরোবর নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং নিজের নামে নতুন শহরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে শহর এখন আমেদাবাদ। রাজা কর্ণের পরবর্তী রাজা জয়সিংহ সিদ্ধরাজ, তাঁর রাজত্বকাল ১০৯৩ সি.ই. থেকে ১১৪৩ সি.ই.। প্রথমদিকে তিনি নাবালক থাকায়, রাজ্য শাসন করতেন তাঁর মাতা মিয়াংল্লা দেবী। জয়সিংহ ক্ষমতায় এসে নাদোলের (যোধপুর রাজ্য) চৌহান এবং সৌরাষ্ট্রের চূড়াসামা রাজাকে পরাস্ত করে, দুটি রাজ্য অধিকার করেন। এরপর তিনি পরমার রাজা নরবর্মন এবং যশোবর্মনের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধের পর মালব জয় করে “অবন্তীনাথ” উপাধি নিয়েছিলেন। জৈনগ্রন্থ “প্রবন্ধ চিন্তামণি” থেকে জানা যায়, রাজা জয়সিংহ ত্রিপুরির কলচুরি রাজ এবং কাশীর রাজার সঙ্গে সখ্যতা স্থাপন করেছিলেন।

    জয়সিংহ তাঁর পিতার মতোই অনেক মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন, তিনি ধর্মসহিষ্ণু এবং শিক্ষা বিষয়েও উৎসাহী ছিলেন। তিনি হয়তো শৈব ছিলেন, কিন্তু জৈন আচার্য হেমচন্দ্রকে রাজসভায় সম্মানের স্থান দিয়েছিলেন। জয়সিংহের কোন পুত্র না থাকায়, তাঁর দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয়, কুমারপাল সিংহাসন অধিকার করেন। শোনা যায়, তিনি সোমনাথ মন্দিরের পুনর্নির্মাণ করিয়েছিলেন। তিনি হয়তো প্রথমদিকে শৈব ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে আচার্য হেমচন্দ্রের প্রভাবে জৈন হয়েছিলেন। সম্ভবতঃ এই কারণের তিনি তাঁর বিস্তীর্ণ রাজ্যে পশুহত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন। তাঁর সময়ে আচার্য হেমচন্দ্র অজস্র জৈন গ্রন্থ এবং ধর্মশাস্ত্র রচনা করেছিলেন। রাজা কুমারপালের মৃত্যু হয় ১১৭২ সি.ই.-র কিছু আগে। তারপর রাজা হয়েছিলেন অজয়পাল।
     
    এরপর গুজরাটের রাজাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না, কিন্তু ১১৭৮ সি.ই.-তে দ্বিতীয় ভীম (বা ভোলা ভীম) রাজা হয়ে প্রায় ষাট বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর সময়েই ঘুরের সুলতান গুজরাট আক্রমণ করেছিলেন, যদিও ভয়ংকর যুদ্ধের পর ঘুরের সুলতান পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু ১১৯৭ সি.ই.তে কুতব-উদ-দিন অনহিলওয়াড়া জয় করে নিয়েছিলেন, কিন্তু সম্ভবতঃ কুতব-উদ-দিন স্থায়ী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেননি। তবে এরপরে মালবের রাজা এবং দেবগিরির যাদবদের আক্রমণে গুজরাটের চালুক্যরা বিশেষভাবে দুর্বল পড়েছিলেন। এই সময়ে বাঘেলা পরিবার গুজরাটের ক্ষমতা অধিকার করল। এই বাঘেলা পরিবার, শোনা যায়, রাজা কুমারপালের বোনের বংশধর। শোনা যায়, জনৈক লবণপ্রসাদ, রাজা ভোলা ভীমের বাঘেলা সামন্তরাজা, দক্ষিণ গুজরাটে স্বাধীন উঠেছিলেন এবং ধীরে ধীরে তাঁরা সমগ্র গুজরাট অধিকার করে নিয়েছিলেন।
     
    ১২৯৭ সি.ই.-তে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি যখন তাঁর শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী দিয়ে দুই সেনাপতি উলুঘ খান এবং নসরত খানকে পাঠিয়েছিলেন, তখন বাঘেলা রাজ করণ বা করণদেব রাজধানী ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। সুলতান আলাউদ্দিনের সেনাবাহিনী এরপর গুজরাটের প্রধান শহরগুলি অধিকার করে নেওয়ার পর, গুজরাট থেকে হিন্দু শাসন মুছে গেল।

    ৪.৭.৩ দক্ষিণাপথ বা দাক্ষিণাত্যের রাজবংশ
    সংস্কৃতে দক্ষিণাপথ বা দাক্ষিণাত্যের ভৌগোলিক অবস্থান সাধারণতঃ ভারতীয় উপদ্বীপ অঞ্চল, যার বিস্তৃতি নর্মদার দক্ষিণ তীর পর্যন্ত বোঝায়। যেমন উত্তরাপথ বলতে বিন্ধ্য এবং হিমালয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে বোঝায়। তবে সঠিক বললে দাক্ষিণাত্য বলতে নর্মদা থেকে কৃষ্ণা নদী পর্যন্ত অঞ্চল, মহারাষ্ট্র এবং পূর্বের তেলুগু অঞ্চলকেও বোঝায়।

    বৈদিক আর্যদের কাছে দক্ষিণ ভারত সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না, তাঁরা বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণের অঞ্চলটিকে দুর্গম “মহাকান্তার” বলে মনে করতেন। ব্রাহ্মণ্য পর্যায়ে বিন্ধ্যের বাধা পেরিয়ে তাঁরা দক্ষিণে অভিযান শুরু করেছিলেন এবং ধীরে ধীরে দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন জাতি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেছিলেন। যার উদাহরণ পাওয়া যায়, ঐতরেয় ব্রাহ্মণে, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, “অন্ধ্র, পুণ্ড্র, শবর, পুলিন্দ এবং মুটিবরা বৈদিক ঋষি বিশ্বামিত্রের পুত্র”। আবার পৌরাণিক উপাখ্যান আছে, মহামুনি অগস্ত্যের শিষ্য ছিলেন বিন্ধ্যপর্বত। একবার সূর্যের ওপর রাগ করে বিন্ধ্যপর্বত সূর্যের গতিরোধ করার জন্যে খুব বেড়ে উঠছিলেন। সে সময় বিন্ধ্যের বৃদ্ধি কমাতে অগস্ত্যমুনি বিন্ধ্য পার হয়ে দক্ষিণ ভারত যাওয়ার মনস্থ করলেন। মহামুনি অগস্ত্য বিন্ধ্যপর্বতের সামনে দাঁড়াতেই, মহামুনিকে প্রণাম করতে বিন্ধ্য যখন মাথা নত করলেন, মহামুনি বললেন, আমি যতদিন না ফিরে আসি, এভাবেই মাথা নত করে থাকো। অগস্ত্য তারপরে দক্ষিণভারত থেকে আর ফেরেননি, বিন্ধ্যপর্বত আজও মাথা নত করে আছে এবং সূর্যেরও প্রদক্ষিণ পথ আজও রুদ্ধ হয়নি। কাহিনী যাই হোক, এর সার কথা হল মহামুনি অগস্ত্য দুর্গম বিন্ধ্যপর্বত পার হয়ে দক্ষিণ ভারতে যেতে পেরেছিলেন এবং তাঁর দেখানো পথে, পরবর্তী উত্তরভারতের রাজা, ঋষি এবং উপনিবেশ-স্থাপনকারী মানুষেরা, উত্তরের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি নিয়ে দক্ষিণে যাওয়া আসা শুরু করেছিলেন।

    ঐতিহাসিক তথ্য থেকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটামুটি ৫০০ বি.সি.ই-র রচনা পাণিনির “অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে” কলিঙ্গ পর্যন্ত নাম পাওয়া যায়, এবং প্রাচীনতম বৌদ্ধ শাস্ত্র “সূত্ত-নিপাত” গ্রন্থে গোদাবরী তীরে একমাত্র বাভারিন সঙ্ঘের উল্লেখ করেছেন। চতুর্থ বি.সি.ই-র কাত্যায়ন তাঁর পাণিনি-ভাষ্যে মাহিষ্মত, নাসিক্য নগর ছাড়াও চোড় এবং পাণ্ড্যদের কথা উল্লেখ করেছেন। তৃতীয় শতাব্দী বি.সি.ই-র মাঝামাঝি সম্রাট অশোকের শিলালিপি থেকে সমগ্র দক্ষিণ ভারত এবং তাম্রপর্ণীর (সিংহল) প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। অতএব মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়েই উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের নিবিড় যোগাযোগ এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান শুরু হয়েছিল।

    এর কিছুদিন পরে এসেছে সাতবাহন রাজবংশ, যাঁরা দাক্ষিণাত্যের অধিকাংশ অঞ্চল এবং আশেপাশের মালব প্রভৃতি অঞ্চলগুলিও শাসন করতেন। তাঁদের রাজত্বের শেষদিকে শকরা কিছুদিনের জন্যে, মহারাষ্ট্র এবং মালব অঞ্চল অধিকার করে নিয়েছিলেন। খ্রীষ্টিয় তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি আভির গোষ্ঠীর রাজা ঈশ্বরসেন উত্তর মহারাষ্ট্র জয় করেছিলেন। এরপর বাকাতক বংশের রাজারা মধ্যভারত এবং দাক্ষিণাত্যের বেশ কিছুটা অঞ্চলে রাজত্ব করেছিলেন। সাতবাহন সাম্রাজ্যের পতনের পর দাক্ষিণাত্যের পূর্বদিকে ইক্ষ্বাকু এবং পল্লবরা এবং ছোট ছোট অনেকগুলি রাজা রাজত্ব করেছিলেন, যেমন কুদুরার বৃহতফলায়ন, ভেঙ্গিপুরের সালংকায়ন, দেনড়ুলুরুর (ভেঙ্গির কাছে) বিষ্ণুকুণ্ডিন ইত্যাদি। এরপরে দাক্ষিণাত্যের গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশ হল চালুক্য।

    ৪.৭.৪ চালুক্য
    চালুক্যদের উৎপত্তি নিয়ে বিস্তর জল্পনা ও কল্পনা শোনা যায়। অনেকে বলেন দেবী হারীতি যখন তর্পণের জল অর্পণ করছিলেন, তাঁর ঘট থেকে চালুক্য বংশের সৃষ্টি। দেবী হারীতি বৌদ্ধদের দেবী, বিশেষজ্ঞরা বলেন, বৌদ্ধদের এই দেবীর কল্পনা এসেছে - গ্রীস থেকে, জিউস এবং অ্যাফ্রোডাইটের কন্যা - গ্রীক দেবী টাইচের অনুসরণে। অনেকে বলেন, চালুক্য বা সোলাংকি বংশ গুর্জরদের মতো মধ্য এশিয়ার কোন যোদ্ধা উপজাতি। প্রথমদিকে এঁরা রাজস্থানে উপনিবেশ গড়েছিলেন, পরবর্তীকালে এঁদের একটি শাখা দক্ষিণ দিকে চলে এসেছিলেন।
    দক্ষিণের চালুক্য বংশের উপস্থিতি ছোট করে শুরু করেছিলেন জয়সিংহ এবং তাঁর পুত্র রণরাগ। ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে রণরাগের পুত্র প্রথম-পুলকেশি চালুক্য বংশকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। তিনি রাজধানী প্রতিষ্ঠা করলেন বাতাপিতে (এখন বাদামি, বিজাপুর জেলা) এবং অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। তাঁর পরবর্তী রাজা কীর্তিবর্মন উত্তর কোঙ্কন, কদম্ব রাজ্যের (উত্তর কানাড়া) বনবাসি এবং নালদের রাজ্য অধিকার করে নিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, উত্তর কোঙ্কনের তৎকালীন রাজা ছিলেন মৌর্যদের বংশধর! নালদের সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। পুত্ররা নাবালক থাকার জন্যে, কীর্তিবর্মনের পর রাজা হয়েছিলেন, তাঁর ভাই মঙ্গলরাজ বা মঙ্গলেশ। তাঁর সাম্রাজ্য শোনা যায় পশ্চিমের সমুদ্র থেকে পূর্বের সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। একথা সত্যি হোক বা না হোক, তিনি যে রেবতী দ্বীপ (আজকের রেড়ি, রত্নগিরি জেলা) অধিকার করেছিলেন, তার নিশ্চিত নিদর্শন পাওয়া যায়। তিনিই বাদামি পাহাড়ে বিষ্ণুর গুহামন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। মঙ্গলরাজের মৃত্যু হয়েছিল তাঁর সাবালক ভাইপোদের সঙ্গে যুদ্ধের সময়।

    দ্বিতীয়-পুলকেশি
    দ্বিতীয়-পুলকেশি যখন রাজা হলেন, চালুক্য সিংহাসন নিয়ে পারিবারিক বিবাদ তখন তুঙ্গে। কিন্তু সাফল্যের সঙ্গে সেই বিবাদ মিটিয়ে তিনি সাম্রাজ্যের শক্তি বাড়াতে পেরেছিলেন। তিনি নিজেকে “পরমেশ্বর-শ্রীপৃথ্বীবল্লভ-সত্যাশ্রয়” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তিনি গঙ্গবাড়ির (মহীশূরের অংশ) গঙ্গ এবং মালাবারের অলূপা (?) রাজ্য জয় করেছিলেন। শোনা যায়, দক্ষিণ গুজরাটের লাট রাজ্য, মালব এবং গুর্জররা (সম্ভবতঃ ভৃগুকচ্ছ) তাঁর অধীনতা মেনে নিয়েছিল। তবে তাঁর সবথেকে বড় কীর্তি কনৌজের রাজা হর্ষবর্ধনকে পরাজিত করা। এই যুদ্ধজয়ের পর কলিঙ্গ এবং কোশল রাজ্যও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল। এর পরে তিনি পল্লব রাজকুমার প্রথম-মহেন্দ্রবর্মনকে আক্রমণ করে, কাঞ্চীপুর (কাঞ্জিভরম) অবরোধ করেছিলেন, যার ফলে পল্লবরা এবং কাবেরী নদীর অপর পাড়ের রাজ্যগুলি, যেমন চোল, পাণ্ড্য এবং কেরালাও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

    দ্বিতীয়-পুলকেশি যে শুধু রণদক্ষ রাজা ছিলেন তা নয়, তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতাও ছিল অসাধারণ। তাঁর সঙ্গে পারস্যের রাজা দ্বিতীয়-খুসরুর ঘনিষ্ঠ সখ্যতা ছিল, তিনি ৬২৫ সি.ই.-তে পারস্যে রাজদূত পাঠিয়েছিলেন, এবং পারস্যের রাজাও তাঁর রাজধানীতে দূত পাঠিয়েছিলেন। তাঁর রাজত্বের সময় চীনা পর্যটক হুয়ান সাং সম্ভবতঃ ৬৪১ সি.ই.-তে তাঁর সাম্রাজ্যে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তাঁর বর্ণনা থেকে দ্বিতীয়-পুলকেশীর সাম্রাজ্য সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।

    দ্বিতীয়-পুলকেশীর পরবর্তী রাজারা
    তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে পল্লবরাজ নরসিংহবর্মন (৬২৫-৪৫ সি.ই.) চালুক্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন এবং ৬৪২ সি.ই.-তে রাজধানী বাতাপি বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলেন এবং সম্ভবতঃ সেই যুদ্ধেই দ্বিতীয়-পুলকেশীর মৃত্যু হয়। দ্বিতীয়-পুলকেশীর পর রাজা হয়েছিলেন, তাঁর দ্বিতীয় পুত্র প্রথম-বিক্রমাদিত্য। তিনি ৬৫৪ সি.ই.-তে পল্লবদের পরাজিত করে, পিতার হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনেছিলেন। তাঁর পরে রাজা হয়েছিলেন, তাঁর পুত্র ও নাতি, যথাক্রমে বিনয়াদিত্য (৬৮০-৬৯৬ সি.ই.) এবং বিজয়াদিত্য (৬৯৬-৭৩৩ সি.ই.)। বিজয়াদিত্যের পুত্র দ্বিতীয়-বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকাল ৭৩৩ থেকে ৭৪৭ সি.ই. এবং তাঁর পরে রাজা হন দ্বিতীয়-কীর্তিবর্মন। এই সবগুলি রাজার রাজত্বকালেই পল্লব, চোল, পাণ্ড্য এবং কেরালা রাজ্যের সঙ্গে তাঁদের নিরন্তর যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই ছিল। তবে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে তাঁদের সাম্রাজ্য থেকে মহারাষ্ট্র অধিকার করে নিয়েছিলেন, রাষ্ট্রকূটদের দন্তিদুর্গা। দ্বিতীয়-কীর্তিবর্মনের পর চালুক্যবংশ এবং সাম্রাজ্য বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তবে ছোট ছোট রাজ্যে তাঁদের অস্তিত্ব ছিল দীর্ঘদিন।

    চালুক্য বংশের ধর্ম ও শিল্প
    চালুক্য রাজাদের সকলেই একনিষ্ঠ হিন্দু ছিলেন, কিন্তু ধর্ম সহিষ্ণু ছিলেন। তাঁদের রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্যে জৈনদের প্রভাব বেড়েছিল। শোনা যায় রবিকীর্তি নামে একজন জৈন আচার্যকে দ্বিতীয়-পুলকেশী “জিনেন্দ্র” মন্দির নির্মাণে পূর্ণ সহযোগীতা করেছিলেন। বিজয়াদিত্য এবং দ্বিতীয়-বিক্রমাদিত্য জৈন পণ্ডিতদের অনেকগুলি গ্রাম দান করেছিলেন। বরং সেই তুলনায় বৌদ্ধদের তেমন কোন প্রভাব দেখা যায় না। যদিও হুয়ান সাং-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, তিনি শতাধিক বৌদ্ধসংঘ দেখেছিলেন, যেখানে উভয় মতের – হীনযান এবং মহাযান– প্রায় পাঁচহাজার সন্ন্যাসী বসবাস করতেন। রাজধানীর বাইরে অশোকের নির্মিত পাঁচটি স্তূপ ছিল, এবং দেশ জুড়ে অসংখ্য স্তূপ তিনি দেখেছিলেন। এই যুগে পৌরাণিক দেবতাদের মূর্তি এবং মন্দির অজস্র নির্মাণ হয়েছিল, তার মধ্যে প্রধানতঃ ছিলেন ত্রিমূর্তি - ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। অনুমান করা হয় অজন্তা গুহার দেওয়াল-চিত্রগুলির (frescoes) বেশ কিছু এই সময়ের আঁকা। চালুক্য রাজাদের মধ্যে যজ্ঞ আয়োজনের প্রবণতা ছিল, যেমন প্রথম-পুলকেশি একাই অশ্বমেধ, বাজপেয়, পৌণ্ডরিক ইত্যাদি যজ্ঞের আয়োজন করছিলেন।

    ৪.৭.৫ মান্যক্ষেট বা মালখেড়-এর রাষ্ট্রকূট
    যথারীতি রাষ্ট্রকূটদের উৎপত্তি নিয়েও কল্পনা ও বিতর্কের শেষ নেই। তার মধ্যে বিশেষজ্ঞরা যে মতটিকে সব থেকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন, সেটি হল অশোকের শিলালিপিতে উল্লেখ করা কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর নাম, যেমন রাষ্টিক বা রাঠিক, যার থেকে রাষ্ট্রকূট বা রাঠোর। অতএব রাষ্ট্রকূটরা দক্ষিণভারতেরই প্রাচীন অধিবাসী এবং মৌর্যদের সময়ে মহারাষ্ট্র এবং কর্ণাটকের কিছু অংশের সামন্তরাজা ছিলেন। এই বংশের কয়েকজন রাজা, যেমন দন্তিবর্মন, প্রথম-ইন্দ্র পৃছকরাজ, প্রথম গোবিন্দ, প্রথম কর্ক এবং দ্বিতীয়-ইন্দ্ররাজ-এর নামটুকু ছাড়া আর বিশেষ কিছু জানা যায় না। রাষ্ট্রকূট রাজাদের মধ্যে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজা দন্তিদুর্গা। দন্তিদুর্গার মা ছিলেন চালুক্য রাজকুমারী ভবনাগা, যাঁকে তাঁর বিবাহ-বাসর থেকে তুলে এনে বিবাহ করেছিলেন দ্বিতীয়-ইন্দ্ররাজ।
    অষ্টম শতাব্দীর পঞ্চম দশকে দন্তিদুর্গা, চালুক্য সাম্রাজ্য থেকে মহারাষ্ট্র অধিকার করে নিয়েছিলেন। দন্তিদুর্গা সমসাময়িক অনেক রাজাকেই পরাজিত করতে পেরেছিলেন, যাঁদের মধ্যে আছেন, কাঞ্চীর পল্লবরাজ, কলিঙ্গ, দক্ষিণ কোশল, মালব (উজ্জিয়িনীর গুর্জর-প্রতিহার রাজা), লাট (দক্ষিণ গুজরাট), শ্রীশৈল (কারনুল জেলা), ইত্যাদি। দন্তিদুর্গার কোন পুত্র না থাকায়, তাঁর এক কাকা, কন্নর বা প্রথম কৃষ্ণ, ৭৫৮ সি.ই.-র কাছাকাছি, সিংহাসনে বসেন। প্রথম-কৃষ্ণ চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মনকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করে, কর্ণাটক ও তার সন্নিহিত বেশ কিছু অঞ্চল অধিকার করে নিয়েছিলেন। তিনি “রাজাধিরাজ-পরমেশ্বর” উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। এরপর তিনি কোঙ্কন ও গঙ্গবাড়ি (গঙ্গদের রাজ্য) জয় করেছিলেন এবং ভেঙ্গি অঞ্চলের চালুক্য সামন্তরাজা চতুর্থ বিষ্ণুবর্মনকেও পরাস্ত করেছিলেন। এই প্রথম-কৃষ্ণই ইলোরার পাহাড় কেটে বিখ্যাত এবং অনবদ্য কৈলাসমন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন।

    রাষ্ট্রকূটবংশের অন্যান্য রাজারা
    দ্বিতীয়-গোবিন্দঃ  প্রথম-কৃষ্ণের মৃত্যুর পর, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র, ৭৭২ সি.ই.-তে রাজা হয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত অসংযমী এবং কামার্ত মানুষ ছিলেন।
    ধ্রুব নিরুপমঃ  দ্বিতীয়-গোবিন্দের ভাই, ৭৭৯ সি.ই.-তে দাদাকে সরিয়ে সিংহাসনে বসেন। তাঁর পরাক্রমে গঙ্গরাজ পরাস্ত এবং বন্দী হন এবং তিনি গঙ্গরাজ্য অধিকার করেন। তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন, কাঞ্চীর পল্লবরাজ। এরপর তিনি প্রতিহার রাজ বৎসরাজকে পরাস্ত করে, মরু অঞ্চলে (রাজস্থান) বিতাড়িত করেছিলেন এবং উজ্জিয়নী সহ মালব অধিকার করেছিলেন। এরপর তিনি গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলে অভিযান করেছিলেন, রাজা ইন্দ্রায়ুধকে পরাস্ত করেছিলেন। সম্ভবতঃ এই সময়েই গৌড়রাজ ধর্মপালের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ হয় এবং গৌড়রাজকে পরাস্ত করে, তাঁর শ্বেত ছত্র এবং লক্ষ্মী-কমল অধিকার করেছিলেন। উত্তর ও মধ্য ভারতের এই রাজ্যগুলি তিনি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেননি, নিজের পরাক্রম দেখানোর জন্যে অভিযান করেছিলেন এবং অবশ্যই পরাজিত রাজ্যগুলি থেকে প্রভূত ধনসম্পদ সংগ্রহ করেছিলেন।

    তৃতীয়-গোবিন্দ জগত্তুঙ্গঃ ধ্রুবর পর রাজা হয়েছিলেন, তৃতীয়-গোবিন্দ, সম্ভবতঃ ৭৯৪ সি.ই.-তে। তৃতীয়-গোবিন্দকেও প্রতিবেশী সকল রাজাদের সঙ্গে, যেমন গঙ্গ, পল্লব, চালুক্য, প্রভৃতি নিরন্তর যুদ্ধ করে সাম্রাজ্য রক্ষা করতে হয়েছিল। তিনিও কনৌজের চক্রায়ুধ এবং গৌড়ের রাজা ধর্মপালের বশ্যতা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তিনি যখন উত্তর ভারতে ব্যস্ত, তখন তাঁর রাজ্যে যৌথ আঘাত হানল, দক্ষিণের চোল, গঙ্গ এবং পাণ্ড্য রাজারা, যদিও এই যুদ্ধেও তিনিই জয়ী হয়েছিলেন।

    প্রথম-অমোঘবর্ষঃ তৃতীয়-গোবিন্দের মৃত্যুর পর ৮১৪ এ.ডি-তে রাজা হলেন নাবালক প্রথম-অমোঘবর্ষ, তাঁর অভিভাবক হয়ে প্রশাসনিক কাজ সামলাতেন, কর্করাজ-সুবর্ণবর্ষ, রাষ্ট্রকূট-সাম্রাজ্যের গুজরাট অঞ্চলের সামন্তরাজা ও মন্ত্রী। প্রথম দিকে ঠিকঠাক চললেও পরবর্তী কালে বিদ্রোহ এবং বিবাদ উপস্থিত হল। রাজ পরিবারের সাবালাক রাজকুমারদের সঙ্গে কর্করাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হল। এই দুর্বলতার সুযোগে ভেঙ্গির রাজা দ্বিতীয় বিজয়াদিত্য রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য আক্রমণ করলেন এবং অমোঘবর্ষ রাজ্যচ্যুত হলেন। কিন্তু এর পরে গুজরাটের একটি লিপি থেকে জানা যায় ৮২১ সি.ই.-তে অমোঘবর্ষ আবার সিংহাসন অধিকার করেছিলেন, সম্ভবতঃ কর্করাজের সহায়তায়। অমোঘবর্ষ যুদ্ধ-বিগ্রহে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না, কিন্তু তাঁর হয়ে রাষ্ট্রকূট বংশের অন্যান্য রাজকুমার ও সামন্তরাজারা দক্ষতার সঙ্গে সাম্রাজ্যের বিস্তার মোটামুটি অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিলেন। অমোঘবর্ষ তাঁর পরমগুরু জিনসেনার প্রভাবে জৈন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। যদিও অন্য একটি লিপি থেকে জানা যায়, তিনি দেবী মহালক্ষ্মীর ভক্ত ছিলেন। তিনি সাহিত্য ও পাণ্ডিত্যের গুণগ্রাহী ছিলেন। সাহিত্য তত্ত্ব নিয়ে, কানাড়ি ভাষায় রচিত তাঁর “কবিরাজমার্গ” এবং নৈতিক গুণাবলীর ওপর লেখা “প্রশ্নোত্তরমালিকা” উল্লেখযোগ্য। যদিও শেষ গ্রন্থটি অনেকের মতে শঙ্করাচার্য অথবা বিমলের রচনা। শেষ জীবনে তিনি ধর্ম এবং সাধনাতেই নিমগ্ন থাকতেন, এবং রাজকুমার ও মন্ত্রীদের হাতেই রাজ্যভার সমর্পণ করে দিয়েছিলেন।

    মোটামুটি ৮৭৮ সি.ই.-তে অমোঘবর্ষের মৃত্যুর পর, রাজা হয়েছিলেন, তাঁর পুত্র দ্বিতীয়-কৃষ্ণ, যাঁর উপাধি ছিল অকালবর্ষ এবং শ্রী-বল্লভ। দ্বিতীয়-কৃষ্ণ বিবাহ করেছিলেন কলচুরি রাজকুমারী – প্রথম কোকল্লের কন্যাকে। দ্বিতীয়-কৃষ্ণর ৯১৪ সি.ই. পর্যন্ত রাজত্বকালে, তাঁর পূর্বপুরুষদের মতোই প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করতে হয়েছিল। দ্বিতীয়-কৃষ্ণর পর রাজা হয়েছিলেন, তাঁর নাতি তৃতীয় ইন্দ্র। তৃতীয় ইন্দ্রের পিতা ছিলেন, জগত্তুঙ্গ, যিনি কম বয়সেই মারা গিয়েছিলেন, এই জগত্তুঙ্গ ছিলেন, দ্বিতীয়-কৃষ্ণ ও কলচুরি রাজকুমারী লক্ষ্মীর পুত্র। তৃতীয় ইন্দ্র সাহসী যোদ্ধা ছিলেন, তাঁর সব থেকে বড় কীর্তি হল কনৌজ জয়, সম্ভবতঃ ৯১৬ বা ৯১৭ সি.ই.-তে। তাঁর স্বল্পস্থায়ী রাজত্বের পর ৯১৮ সি.ই.-তে রাজা হয়েছিলেন, দ্বিতীয়-অমোঘবর্ষ, এবং তারপরে চতুর্থ-গোবিন্দ। চতুর্থ-গোবিন্দ রাজ্যের প্রশাসনের থেকে বেশি মন দিয়েছিলেন, আমোদ-ফূর্তি এবং নারীসঙ্গে। চতুর্থ-গোবিন্দের পর ৯৩৬ সি.ই.-তে রাজা হয়েছিলেন তৃতীয় অমোঘবর্ষ, তিনি বুদ্ধিমান রাজা ছিলেন, তিনি কলচুরি এবং গঙ্গ বংশের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে, কিছুদিনের জন্যে স্বস্তি পেয়েছিলেন।

    তৃতীয় অমোঘবর্ষের পুত্র তৃতীয় কৃষ্ণ রাজা হয়েছিলেন ৯৪০ সি.ই.-তে। তৃতীয় কৃষ্ণ রণকুশল শক্তিশালী রাজা ছিলেন। তিনি কঠিন হাতে সাম্রাজ্য রক্ষা করেছিলেন, উপরন্তু বুন্দেলখণ্ড জয় করে মধ্য ভারতে কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন। এরপরেই তিনি “পরমভট্টারক”, “মহারাজাধিরাজ” এবং “পরমেশ্বর” উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। এরপর দক্ষিণেও তিনি কাঞ্চি ও তাঞ্জোর জয় করেছিলেন। ৯৬৮ সি.ই.-তে তৃতীয় কৃষ্ণের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রকূট বংশ পারিবারিক কলহের জন্যে অতি দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং ৯৭৩ সি.ই.-র পর এই বংশের কথা তেমন আর শোনা যায়না। 

    ৪.৭.৬ কল্যাণের পশ্চিমা-চালুক্য               
    শোনা যায় এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা তৈলপ ছিলেন, চালুক্যরাজ কীর্তিবর্মনের কোন কাকার বংশধর। যদিও অনেক ঐতিহাসিক এই তত্ত্ব মানেন না। এঁরা বলেন, নাম না জানা কোন গুরুত্বহীন গোষ্ঠীর রাজা ছিলেন তৈলপ। সে যাই হোক, তৈলপের জীবনের শুরু রাষ্ট্রকূটদের সামন্তরাজা হিসেবে। পরমার রাজা যখন রাজধানী মান্যখেটের পতন ঘটালেন, সেই ডামাডোলের মধ্যে তৈলপ রাষ্ট্রকূট রাজা দ্বিতীয় কর্ককে হয় হত্যা করেছিলেন, অথবা দূর কোন নিরাপদ জায়াগায় পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন। এরপর পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে রাষ্ট্রকুটরা যখন নাজেহাল, তখন তৈলপ চতুর্থ ইন্দ্রকে পরাস্ত করে, রাষ্ট্রকূট রাজ্য অধিকার করে নিয়েছিলেন। এরপর তৈলপ দক্ষিণ গুজরাটের লাট জয় করেছিলেন, কিন্তু বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি, অনহিলওয়াড়ার মূলরাজ চালুক্য, তৈলপের প্রশাসক বারপ্পকে লাট থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। শোনা যায়, তৈলপ কুন্তল (কর্ণাটের অংশ), চেদি এবং চোলদের পরাজিত করেছিলেন। যদিও তাঁর রাজ্যের উত্তর সীমান্তে পরমার রাজা বাকপতি-মুঞ্জ বারবার হানা দিচ্ছিলেন। শোনা যায় শেষ যুদ্ধে তৈলপ বাকপতি-মুঞ্জকে বন্দী করে, তাঁকে হত্যা করেছিলেন। এখান থেকেই পশ্চিমা-চালুক্যদের সঙ্গে পরমার রাজাদের চিরশত্রুতার সূত্রপাত হল। তৈলপের মৃত্যু হয় ৯৯৭ সি.ই.-তে, তারপর রাজা হলেন তাঁর পুত্র সত্যাশ্রয় (৯৯৭-১০০৮ সি.ই.)।

    তাঁর রাজত্বকালে চোল রাজা প্রথম-রাজারাজ চালুক্য রাজ্যে প্রভূত ক্ষতি এবং গণহত্যা ঘটিয়েছিলেন, কিন্তু সত্যাশ্রয় অচিরেই চোলদের এই ধাক্কা সামলে তাঁদের সমুচিত শিক্ষাও দিয়েছিলেন। সত্যাশ্রয়ের পরে রাজা হলেন তাঁর ভাইপো পঞ্চম-বিক্রমাদিত্য, খুব কমদিনই তিনি রাজত্ব করতে পেরেছিলেন। পরমার রাজা ভোজ তাঁকে চূড়ান্ত পরাস্ত করে, পরমার রাজা বাকপতি-মুঞ্জের হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। এরপরে রাজা ভোজ দাক্ষিণাত্যের অধিকার সুরক্ষিত করতে শক্তিশালী অনহিলওয়াড়ার প্রথম ভীম এবং কলচুরি রাজাদের সঙ্গে মৌখিক চুক্তি করেছিলেন। কিন্তু পঞ্চম-বিক্রমাদিত্যর পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় জয়সিংহ জগদেকমল্ল (১০১৬-৪২ সি.ই.), মালবের পরমার রাজা ভোজের এই স্বপ্ন পূর্ণ হতে দেননি।

    প্রথম সোমেশ্বর(১০৪২-৬৮ সি.ই.)
    ১০৪২ সি.ই.-তে রাজা হলেন, দ্বিতীয় জয়সিংহের পুত্র, প্রথম সোমেশ্বর। তিনি চোল এবং পরমারদের আক্রমণ করলেন, এবং পরমার রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে মালব রাজ্যের মাণ্ডু এবং ধারা অঞ্চল অধিকার করে নিলেন। রাজা ভোজের অনুপস্থিতিতে, পরমার দুর্বল রাজারা প্রথম সোমেশ্বরের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে না পেরে, উজ্জয়িনী পালিয়ে গেলেন। কিন্তু সেখানেও ধাওয়া করলেন প্রথম সোমেশ্বর এবং উজ্জয়িনী জয় করলেন। এর মধ্যে রাজা ভোজ রাজধানীতে ফিরে উজ্জয়িনী উদ্ধার করে, নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু এরপর অনহিলওয়াড়ার প্রথম ভীম এবং কলচুরি রাজা লক্ষ্মী-কর্ণের যৌথ আক্রমণে পরমারদের দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে এল। এই যুদ্ধে রাজা ভোজ মারা গেলেন, এবং পরমার রাজত্ব বিপন্ন হয়ে উঠল। এই সময়ে ভোজের পরবর্তী পরমাররাজা জয়সিংহ, অনহিলওয়াড়া এবং কলচুরিদের থেকে রক্ষা পেতে, সোমেশ্বরের সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সোমেশ্বর এই সুযোগ হাতছাড়া করলেন না, তিনি চিরশত্রু পরমারদের সঙ্গে সখ্যতা করে, প্রথম ভীম এবং লক্ষ্মীকর্ণকে পরাস্ত করে, জয়সিংহকে পরমার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি জানতেন মধ্য ভারতের যে কোন শক্তিই প্রবল হলে, তাঁর চালুক্যরাজ্যের পক্ষে তাঁরা বিপজ্জনক।

    যুদ্ধে প্রথম সোমেশ্বরের প্রধান সহায় ছিলেন, তাঁর পুত্র ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য। মধ্যভারত নিয়ন্ত্রণে আসার পর, প্রথম সোমেশ্বর উত্তরভারতের দিকে মন দিলেন। গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলের প্রতিহার রাজারা তখন দুর্বল, অতএব চালুক্য সৈন্যরা অতি সহজেই দোয়াব এবং কনৌজ জয় করে নিলেন। তারপর ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের নেতৃত্বে চালুক্য বাহিনী, মিথিলা, মগধ, অঙ্গ, বঙ্গ এবং গৌড় পর্যন্ত বিনা বাধায় চলে এসেছিলেন। তখন গৌড়ের পালরাজারাও প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছিলেন। যদিও কামরূপের রাজা রত্নপাল চালুক্য সৈন্যদের পরাস্ত করেছিলেন এবং এরপর চালুক্য সৈন্যবাহিনী দক্ষিণ কোশলের পথে নিজেদের ঘরে ফিরেছিলেন। এ ভাবেই প্রথম সোমেশ্বরের আমলে প্রায় গোটা ভারতবর্ষই চালুক্য রাজাদের শক্তি টের পেয়েছিল।
     
    প্রথম সোমেশ্বর তাঁর নতুন রাজধানী স্থাপন করেছিলেন কল্যাণে (কল্যাণী, হায়দ্রাবাদ)। ১০৬৮ সি.ই.তে তাঁর মৃত্যুও ঘটেছিল অত্যন্ত নাটকীয় ভাবে। শোনা যায় তিনি মারাত্মক এক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং নিরাময় অসম্ভব জেনে, রীতিমতো উৎসব করে, মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে তুঙ্গভদ্রার জলে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন।

    তাঁর মৃত্যুর পর রাজা হয়েছিলেন দ্বিতীয় সোমেশ্বর আহবমল্ল, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র। যদিও যাবতীয় যুদ্ধ বিজয়ের কৃতিত্ব ছিল, তাঁর ভাই ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যর, কিন্তু প্রথম দিকে সিংহাসন নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে কোন বিবাদ ছিল না। দ্বিতীয় সোমেশ্বরের স্বল্পস্থায়ী রাজত্বে তেমন কিছু কৃতিত্ব লক্ষ্য করা যায় না, তাঁর সময়ে একটাই প্রধান ঘটনা হল, ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের বন্ধু মালবের রাজা জয়সিংহকে আক্রমণ করে, তিনি পরাজিত করেছিলেন।

    ১০৭৬ সি.ই.তে দ্বিতীয় সোমেশ্বরের মৃত্যুর পর ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য রাজা হয়েছিলেন, এবং সেই বছর থেকে চালুক্য-বিক্রমাঙ্ক অব্দ শুরু হয়। এই পশ্চিমা-চালুক্য বংশের সব থেকে সফল ও উজ্জ্বল রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য। তিনি শিল্প, শিক্ষা এবং জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি কাশ্মীরি লেখক বিলহনের গুণমুগ্ধ ছিলেন, বিলহনের লেখা “বিক্রমাঙ্কদেবচরিত”, রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যকে অমর করে দিয়ে গেছেন। তাঁর রাজসভার পণ্ডিত বিজ্ঞানেশ্বর, হিন্দু রীতিনীতির ওপর “মিতাক্ষরা” নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

    ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যর পুত্র তৃতীয় সোমেশ্বর ভূলোকমল্ল ১১২৬ থেকে ১১৩৮ সি.ই. পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর পুত্র দ্বিতীয় জগদেকমল্ল রাজত্ব করেছিলেন ১১৩৮-১১৫১ সি.ই.। তারপর সিংহাসনে বসেন, তাঁর ভাই নুরমডি তৈল। কিন্তু এরপর কলচুরি রাজ্যের রণমন্ত্রী, ভিজ্জলার মন্ত্রণা এবং প্ররোচনায় চালুক্য রাজ্যের সামন্তরাজাদের মধ্যে বিদ্রোহ এবং ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছিল, তাঁরা নুরমডি তৈলকে ১১৫৭ সি.ই.তে সিংহাসন চ্যুত করেন। নুরমডি তৈলর পুত্র ভীর সোম বা চতুর্থ সোমেশ্বর ১১৮২ সি.ই.তে পিতৃরাজ্য কিছুটা উদ্ধার করে ১১৮৯ সি.ই. পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন, কিন্তু দেবগিরির যাদব এবং দ্বারসমুদ্রের হোয়সল রাজ্যের প্রবল আক্রমণে পশ্চিমা-চালুক্যবংশ ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেল।

    ৪.৭.৭ দেবগিরির যাদব
    মহাভারতের ভগবান শ্রীকৃষ্ণর যদু বংশ থেকে যাদবদের উৎপত্তি, এমনই প্রবাদ শোনা যায়। যদিও, তাঁদের রাজ্য পরিচালনার অভিজ্ঞতা শুরু হয়েছিল, মান্যখেটের রাষ্ট্রকূট এবং পশ্চিমা-চালুক্যদের সামন্তরাজা হিসাবে। পশ্চিমা-চালুক্যদের দুর্বলতার সুযোগে যাদবদের উত্থানের শুরু এবং পরবর্তী কালে তাঁরা বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যও প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। এই বংশের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন, পঞ্চম ভিল্লাম। তাঁর রাজধানী ছিল দেবগিরি (হায়দ্রাবাদ জেলার আধুনিক দৌলতাবাদ)। তিনি খুব বেশি রাজত্ব বিস্তার করতে পারেননি, কারণ ১১৯১ সি.ই.-তে হোয়সল রাজ প্রথম বীর-বল্লালের হাতে তিনি পরাস্ত হন এবং খুব সম্ভবতঃ প্রাণও হারান।

    ভিল্লমের পুত্র জৈতুগি বা প্রথম জৈত্রপাল (১১৯১-১২১০ সি.ই.)। তিনি তৈলঙ্গ (ত্রিকলিঙ্গ) রাজ রুদ্রদেবকে পরাজিত করেন এবং হত্যাও করেন, তারপর রাজা রুদ্রদেবের ভাইপো গণপতিকে সিংহাসনে বসিয়ে কাকতীয় বংশের সূচনা করেছিলেন। এভাবেই যাদবরা সমসাময়িক রাজনীতিতে নিজেদের গুরুত্ব বাড়াতে থাকেন।
    যাদব বংশের সব থেকে উদ্যোগী রাজা ছিলেন, জৈত্রপালের পুত্র সিংহন (১২১০ - ১২৪৭ সি.ই.)। তিনি বেশ কিছু অঞ্চল এবং রাজ্য জয় করেছিলেন। তিনি ১২১৫ সি.ই.তে বীরভোজকে পরাস্ত করে, কোলাপুরের সিলাহারা অঞ্চল এবং পরনালা বা পনহালা দুর্গ অধিকার করে নিয়েছিলেন। এরপর তাঁর দাদুর হত্যাকারী হোয়সল রাজ দ্বিতীয় বীরবল্লালকে পরাস্ত করে, কৃষ্ণা নদীর অপর পাড়ে হটিয়ে দিয়েছিলেন। সিংহন এরপরে মালবের রাজা অর্জুনবর্মন, ছত্তিশগড়ের চেদি রাজা জাজ্জল, গুজরাটের বাঘেলা রাজাদের আক্রমণ করেছিলেন, সফলও হয়েছিলেন।

    সিংহন অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী রাজা ছিলেন, তাঁর সভায় বিখ্যাত কিছু গুণী এবং বিদ্বানেরা বিশেষভাবে সম্মানীয় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন সারঙ্গধর, সঙ্গীত বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম “সঙ্গীত-রত্নাকর”। এই গ্রন্থের টীকা এবং ভাষ্য রচনা করেছিলেন, স্বয়ং রাজা সিংহন। সিংহনের সভায় আরেকজন বিদ্বান ছিলেন, শার্ঙ্গদেব, বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ। তিনি খান্দেশ জেলার পাটনায় একটি মঠ (মহাবিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে ভাস্করাচার্যের “সিদ্ধান্ত-শিরোমণি” এবং অন্যান্য জ্যোতিষশাস্ত্র পড়ানো হত।

    সিংহনের পর রাজা হয়েছিলেন, তাঁর নাতি কৃষ্ণ বা কনহার (১২৪৭-৬০ সি.ই.)। তাঁকেও মালব, গুজরাট এবং কোঙ্কনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। তিনি হিন্দু ধর্মের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তাঁর রাজত্বের সময়েই জলহনের কাব্য সংকলন “সূক্তিমুক্তাবলী” এবং আমলানন্দর বেদান্ত ভাষ্য - “বেদান্ত-কল্পতরু” রচিত হয়েছিল। কৃষ্ণের পর রাজা হয়েছিলেন, তাঁর ভাই মহাদেব (১২৬০-৭১ সি.ই.)। তিনি বেশ কিছু রাজ্য, যেমন সিলাহারদের উত্তরকোঙ্কন, কর্ণাটক, গুজরাটের লাট এবং কাকতীয় রাণী রুদ্রাম্বার রাজ্য জয় করে নিয়েছিলেন। মহাদেব এবং তাঁর পরবর্তী রাজা রামচন্দ্র বা রামরাজার (১২৭১-১৩০৯ সি.ই.) মন্ত্রী ছিলেন বিখ্যাত পণ্ডিত হেমাদ্রি বা হেমাদপন্ত। যিনি “চতুর্বর্গ–চিন্তামণি” নামে হিন্দু ধর্মশাস্ত্র রচনা করেছিলেন। শোনা যায় তিনি দাক্ষিণাত্যের মন্দির স্থাপত্যের নতুন প্রথা সৃষ্টি করেছিলেন এবং মোড়ি[1] লিপির সংস্কার করেছিলেন। আরও শোনা যায় রাজা রামচন্দ্র সন্ন্যাসী জ্ঞানেশ্বরের শিষ্য ছিলেন, পণ্ডিত জ্ঞানেশ্বর ১২৯০ সি.ই.-তে মারাঠী ভাষায় প্রথম ভাগবত-গীতার ভাষ্য রচনা করেছিলেন।

    রামচন্দ্রের রাজত্বকালে ১২৯৪ সি.ই.-তে আলাউদ্দিন খিলজি হঠাৎ দেবগিরি অবরোধ করেন, রামচন্দ্র তখন দেবগিরি দুর্গেই ছিলেন। তাঁর পুত্র শংকর তাঁকে মুক্ত করতে, বহু প্রয়াস করেও যখন ব্যর্থ হলেন, তখন রামচন্দ্র বাধ্য হলেন আলাউদ্দিনের সঙ্গে এক তরফা চুক্তি করতে। সেই চুক্তি অনুযায়ী, আলাউদ্দিন “৬০০ মণ মুক্তা, ১,০০০ রৌপ্যমুদ্রা, ৪,০০০ রেশম বস্ত্র এবং প্রচুর দামি জিনিষপত্র” আদায় করলেন এবং দিল্লিতে বাৎসরিক রাজস্ব পাঠানোর শপথ করালেন। এর পর আলাউদ্দিন নিজে যখন দিল্লির মসনদে বসলেন, তিনি সেনাপতি মালিক কাফুরকে পাঠিয়ে ১৩০৭ সি.ই.-তে দেবগিরি অধিকার করলেন এবং পরাজিত রামচন্দ্রকে বন্দী করে দিল্লি নিয়ে গেলেন। সম্রাট আলাউদ্দিন তাঁর নিঃশর্ত আনুগত্যের বিনিময়ে মুক্তি দিলেন, কিন্তু ১৩০৯ সি.ই.-তে রামচন্দ্রের মৃত্যু হয়েছিল। রামচন্দ্রের পুত্র শংকর দিল্লিকে রাজস্ব দেওয়া বন্ধ করে দিলে, ১৩১২ সি.ই.-তে মালিক কাফুর আবার দেবগিরি আক্রমণ করে শংকরকে হত্যা করেন। এরপরেও রামচন্দ্রের জামাই হরপাল যখন মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার চেষ্টা করেন, সুলতান মুবারকের আদেশে জীবন্ত অবস্থায় চামড়া ছিঁড়ে নিয়ে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল[2]। এভাবেই অতি নিদারুণভাবে যাদববংশের সমাপ্তি ঘটেছিল।

    ৪.৭.৮ ওয়ারাঙ্গালের কাকতীয়
    কাকতীয় বংশের উৎপত্তি সঠিক জানা যায় না। কেউ বলেন “কাকত” শব্দের অর্থ কাক, সেখান থেকেই বংশের নাম কাকতীয়। কেউ বলেন স্থানীয় দেবী দুর্গার এক রূপ “কাকতী” সেখান থেকে এই বংশের নাম এসেছে। আবার পৌরাণিক প্রসঙ্গ টেনে কেউ বলেন তাঁরা সূর্য বংশীয় ক্ষত্রিয়। কিন্তু নেল্লোর জেলার কয়েকটি শিলালিপিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে কাকতীয়রা ছিলেন শূদ্র।

    প্রথমদিকে কাকতীয়রাও চালুক্যরাজাদের সামন্তরাজা ছিলেন। চালুক্য সাম্রাজ্যের পতনের সময়, তাঁরা তেলেঙ্গানা অঞ্চলে প্রথম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বহু উত্থান ও পতনের পর, যাঁদের সমাপ্তি ঘটে বাহমনি সুলতান আহমদ শাহের হাতে ১৪২৪-২৫ সি.ই.-তে।
     
    প্রথম দিকে কাকতীয় রাজাদের রাজধানী ছিল অনমাকোণ্ডা বা হনুমাকোণ্ডাতে, পরবর্তী কালে তাঁরা রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন ওয়ারাঙ্গাল বা ওরুঙ্গল্লুতে। প্রথম যে রাজা এই বংশের গৌরব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি প্রোলরাজ মোটামুটি ১১১৭-১৮ সি.ই.-তে। তিনি পশ্চিমা-চালুক্যদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য বিখ্যাত এবং দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর পরে রুদ্র ১১৬০ সি.ই. অব্দি এবং তাঁর ভাই মহাদেব ১১৯৯ সি.ই. পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। এরপর রাজা হয়েছিলেন, রাজা মহাদেবের পুত্র, রাজা গণপতি, তিনি প্রায় বাষট্টি বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর সময়েই কাকতীয় রাজত্বের গৌরব সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিল। তাঁর পরাক্রমে চোল, কলিঙ্গ, যাদব, কর্ণাটের লাট এবং বলনাড়ুরা পরাস্ত হয়েছিলেন।

    রাজা গণপতির পুত্র না থাকায়, তাঁর সিংহাসনে বসেছিলেন তাঁর কন্যা রুদ্রাম্বা ১২৬১ সি.ই.-তে। শোনা যায় তিনি পিতার রাজ্য অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিলেন এবং প্রায় তিরিশ বছর রাজত্বের পর রাজা হয়েছিলেন, তাঁর পৌত্র প্রতাপরুদ্রদেব। এই প্রতাপরুদ্রদেবকে অমর করে গিয়েছিলেন, তাঁর সমসাময়িক কবি বৈদ্যনাথ, তাঁর রচিত “প্রতাপরুদ্রীয়” কাব্যে। এই প্রতাপরুদ্রই ছিলেন কাকতীয় বংশের শেষ রাজা এরপর সেনাপতি মালিক কাফুরের দাক্ষিণাত্য অভিযানে কাকতীয় বংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। শোনা যায় তাঁদের বংশের কোন শাখা বস্তার (মধ্যপ্রদেশ) অঞ্চলে ক্ষুদ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

    ৪.৭.৯ শিলাহার
    শোনা যায় শিলাহার বংশের উৎপত্তি পৌরাণিক রাজা জীমূতবাহনের থেকে, যিনি বিদ্যাধরের রাজা ছিলেন এবং নাগদের রক্ষা করার জন্যে, নিজেকে গরুড়ের আহার হিসেবে উৎসর্গ করেছিলেন। এই কাহিনীর মূল্য যাই থাক, শিলাহাররা সম্ভবতঃ ক্ষত্রিয় ছিলেন।

    যতদূর জানা যায়, শিলাহারদের তিনটি শাখা ছিল এবং তাঁদের আদি বাসভূমি ছিল টগর বা টের নামক কোন অঞ্চলে। প্রাচীনতম শাখা অষ্টম শতাব্দীর শেষ থেকে একাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত দক্ষিণ কোঙ্কনে রাজত্ব করেছিলেন এবং তাঁদের রাজধানী ছিল গোয়া। শিলাহারদের দ্বিতীয় শাখা উত্তর কোঙ্কনে রাজত্ব করেছিলেন, নবম শতাব্দীর শুরু থেকে প্রায় সাড়ে চারশো বছর। তাঁদের রাজত্বের মধ্যে ছিল থানা, রত্নগিরি এবং সুরাট জেলার কিছু অংশ। তাঁদের রাজধানী ছিল থানা। তৃতীয় শিলাহার শাখা একাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, তাঁদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কোলাপুর, সাতারা এবং বেলগামে। শিলাহারদের প্রথম দুই শাখা মোটামুটি কোন না কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্যের অধীনে রাজত্ব করতেন, যেমন, রাষ্ট্রকূট, চালুক্য এবং যাদব প্রমুখ। সে দিক থেকে শিলাহারদের তৃতীয় শাখা মাঝে মধ্যে স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করতে পেরেছিলেন। শোনা যায় এই শাখার এক রাজা বিজয়াদিত্য বা বিজয়ার্ক, চালুক্যবংশের পতনের জন্য কলচুরি মন্ত্রী বিজ্জলকে সাহায্য করেছিলেন। এই শাখার সব থেকে উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন ভোজ (১১৭৫-১২১০ সি.ই.), শোনা যায় তাঁর মৃত্যুর পরে যাদব রাজ সিংহন, শিলাহারদের এই রাজ্যটি অধিকার করে নিয়েছিলেন।

    ৪.৭.১০ কদম্ব
    কদম্বদের সম্পর্কে শোনা যায়, তাঁরা মানব্য গোত্রের ব্রাহ্মণ ছিলেন। শোনা যায় এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা এক ব্রাহ্মণ, নাম ময়ূরশর্মা, একবার পল্লব রাজ্যের রাজধানী কাঞ্চীতে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি কর্ণাটকে একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এবং রাজধানী ছিল বনবাসীতে। এই ঘটনা ঘটেছিল খ্রীষ্টিয় চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি। এরপরে সমুদ্রগুপ্তের দাক্ষিণাত্য অভিযানে পল্লবরাই বিধ্বস্ত এবং গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিলেন। অতএব প্রায় অস্তিত্বহীন কদম্ববংশের ইতিহাসে প্রথম সাড়া পাওয়া গেল, রাজা ককুস্থবর্মনের সময়। এই সময় কদম্ব রাজ্যের পরিসীমা এবং প্রভাব চোখে পড়ার মতো পর্যায়ে এসেছিল। তারপর ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দশকে যখন রবিবর্মন রাজা হলেন, গঙ্গ এবং পল্লবদের সঙ্গে তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল এবং তিনি তাঁর নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, হালসীতে (বেলগাম জেলা)। কিন্তু এরপর বাতাপির চালুক্য বংশের উত্থানে কদম্বরা আবার অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এই কদম্বদের আবার দেখা পাওয়া যায় দশম শতাব্দীর শেষদিকে, রাষ্ট্রকূট রাজ্যের পতনের সময়। এই কদম্বদের ছোট ছোট শাখা দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট ছোট রাজ্য গড়ে তাঁদের অস্তিত্ব স্থানীয় ভাবে বজায় রেখেছিলেন, ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত!

    ৪.৭.১১ তলকড়ের গঙ্গ
    গঙ্গদের উৎপত্তি শোনা যায় পৌরাণিক ইক্ষ্বাকু বংশ থেকে, এমনও শোনা যায় তাঁদের আদি নিবাস ছিল গঙ্গার তীরে অথবা তাঁরা মুনি কণ্বর উত্তরসূরি। মহীশূরের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে গঙ্গদের রাজ্য ছিল এবং সেই সময়ে তাঁদের রাজ্যকে গঙ্গবাড়ি বলা হত। মোটামুটি চতুর্থ শতাব্দীর কোন সময়ে, এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দিদিগ বা কোঙ্গনিবর্মন এবং মাধব। প্রথম দিকে এই রাজ্যের রাজধানী ছিল কুলুবলে (কোলার?)। পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি গঙ্গরাজা হরিবর্মা রাজধানী সরিয়ে নিয়েছিলেন কাবেরী নদীর তীরে, তলবনপুর বা তলকড়ে। গঙ্গদের এক রাজা দুর্বিনীত পল্লবদের সঙ্গে যুদ্ধ করে, দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে গঙ্গদের গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলেছিলেন। তিনি সংস্কৃত ভাষায় “পৈশাচী বৃহৎ-কথা” রচনা করেছিলেন। গঙ্গদের আরেক বিখ্যাত রাজা ছিলেন শ্রীপুরুষ (৭২৬-৭৬ সি.ই.)। তিনি শক্তিশালী রাষ্ট্রকূটদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পেরেছিলেন এবং পল্লবদের পর্যুদস্ত করেছিলেন। অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে গঙ্গরাজাদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন ভেঙ্গির চালুক্যরা এবং মালখেড়ের রাষ্ট্রকূটরা। এই সময় গঙ্গরাজ শিবমার বন্দী হয়েছিলেন এবং তাঁর রাজ্য অধিকার করে নিয়েছিলেন রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুব নিরুপম। এরপর থেকে গঙ্গ রাজারা নানান শক্তিশালী রাজ্যের সামন্তরাজা হিসেবেই রাজ্য পরিচালনা করতেন, যেমন রাষ্ট্রকূট, হোয়সল এবং চোল।
    গঙ্গ রাজারা সাধারণতঃ জৈন ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। এই বংশের রাজা দুর্বিনীত জৈন আচার্য পূজ্যপাদের শিষ্য ছিলেন। এই বংশের আরেক রাজা চতুর্থ-রাজমল্ল এবং তাঁর সেনাপতি ও মন্ত্রী চামুণ্ডরায় ৯৮৩ সি.ই.-তে শ্রবণবেলগোলার সুবিখ্যাত গোমতেশ্বর মূর্তি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

    ৪.৭.১২ দ্বারসমুদ্রের হোয়সল
    হোয়সল বা পোয়সলরা দাবি করেন, তাঁরা “যাদবকূলতিলক” বা “চন্দ্রবংশীয় ক্ষত্রিয়”। তবে এঁদের সম্বন্ধে আরেকটি প্রবাদ শোনা যায়, এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা বীর সাল কোন এক মুনির নির্দেশে, লৌহশূল দিয়ে একা একটি বাঘকে হত্যা করেছিলেন। তার থেকেই এই বংশের নাম হোয়সল বা পোয়সল (হোয় বা পোয় কথার অর্থ হত্যা এবং সাল থেকেই সল)।

    হোয়সল রাজত্বের উন্নতির সূচনা একাদশ শতাব্দীর শুরুতে। তার আগে এঁরা মহীশূরের ক্ষুদ্র অঞ্চলের রাজা ছিলেন। এই সময় তাঁরা চোল বা কল্যাণের চালুক্য রাজাদের অনুগত রাজ্য হয়ে নিজেদের শক্তি এবং প্রভাব বাড়াতে শুরু করেছিলেন। মোটামুটি ১০৪৫ সি.ই.-তে এই বংশের রাজা বিনয়াদিত্য এবং তাঁর পুত্র এরিয়ঙ্গ, চালুক্য রাজাদের সহযোগী হয়ে অনেক যুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন। এরপর রাজা বিত্তিগ বিষ্ণুবর্ধনের (১১১০-৪০ সি.ই.) সময় হোয়সল রাজ্য দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এই রাজা তাঁর রাজধানী ভেলাপুর (বেলুর, হাসান জেলা) থেকে সরিয়ে দ্বারসমুদ্রে (হালেবিদ, হাসান জেলা) নিয়ে আসেন। এই সময় তিনি চালুক্য সাম্রাজ্যের অধীনে থাকলেও, প্রায় স্বাধীন রাজা হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু কখনই কোন “রাজা” উপাধি গ্রহণ করেননি। চালুক্য রাজাদের প্রতিনিধি হয়ে, তিনি সমসাময়িক, চোল, মাদুরার পাণ্ড্য, মালাবার, দক্ষিণ কানারার তুলুব, গোয়ার কদম্ব সকলের বশ্যতা আদায় করেছিলেন। এই সময় রাজা বিষ্ণুবর্ধন সম্পূর্ণ মহীশূর এবং তার সংলগ্ন অঞ্চলের অধিপতি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সম্ভবতঃ জৈন ছিলেন, কিন্তু পরে আচার্য রামানুজের সংস্পর্শে এসে তিনি বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

    রাজা বিষ্ণুবর্ধনের পর উল্লেখযোগ্য রাজা হলেন, তাঁর নাতি প্রথম-বীরবল্লাল (১১৭২-১২১৫ সি.ই.)। তিনিই প্রথম নিজেকে “মহারাজাধিরাজ” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তিনি চালুক্য এবং যাদবদের পরাজিত করে, স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর থেকেই হোয়সল রাজত্বের পতনের শুরু এবং শেষ হোয়সল রাজা তৃতীয়-বীরবল্লাল ১৩১০ সি.ই.তে সেনাপতি মালিক কাফুরের হাতে পরাজিত হন এবং তাঁকে বন্দী করে দিল্লি আনা হয়েছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি হোয়সল বংশ লুপ্ত হয়ে যায়।
     
    হোয়সল রাজাদের স্থাপত্য কীর্তি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। তাঁদের রাজত্ব কালে অজস্র মন্দির ও স্থাপত্য নির্মিত হয়েছিল, যার মধ্যে বেলুর ও হালেবিদের স্থাপত্যগুলি শিল্প সুষমায় অনবদ্য।

    চলবে...
    (চতুর্থ পর্বের অষ্টম ও শেষ ভাগ আসবে ১২/০৮/২২ তারিখে।)

    গ্রন্থ ঋণঃ
    ১. History of Ancient India – Rama Shankar Thripathi.
    ২. Penguin History of Early India – Dr. Romila Thapar.
    ৩. The Wonder that was India – A. L. Basham.

    [1]  সংস্কৃতর দেবনাগরি লিপি ভেঙে মোড়ি লিপি বা মুদিয়া লিপি মারাঠিভাষার প্রথম লিপি, যে লিপির আধুনিক সংস্করণ আজও প্রচলিত।  

    [2] হয়তো ভয়ংকর এই ঘটনার স্মৃতি থেকেই বলিউডি সিনেমায় বহু ভিলেনের মুখে “খাল খিঁচ লুঙ্গা” ডায়লগ শুনতে পাওয়া যায়।   
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৭ আগস্ট ২০২২ | ১২৬১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • guru | 146.196.***.*** | ০৭ আগস্ট ২০২২ ১৩:১৮510834
  • @কিশোরবাবু 
    ভীষণ ভালো ভাবে ইতিহাসের এক চলন্ত ছবি আপনি ফুটিয়ে তুলছেন |
     
    "দ্বিতীয়-পুলকেশি যে শুধু রণদক্ষ রাজা ছিলেন তা নয়, তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতাও ছিল অসাধারণ। তাঁর সঙ্গে পারস্যের রাজা দ্বিতীয়-খুসরুর ঘনিষ্ঠ সখ্যতা ছিল, তিনি ৬২৫ সি.ই.-তে পারস্যে রাজদূত পাঠিয়েছিলেন, এবং পারস্যের রাজাও তাঁর রাজধানীতে দূত পাঠিয়েছিলেন। "
     
    এই দ্বিতীয়-পুলকেশি কী সম্রাট হর্ষবর্ধনকে যুদ্ধে পরাজিত করে আর্যাবর্তের আধিপত্য থেকে দাক্ষিনাত্যে ​​​​​​​কে মুক্তি দেন ?
     
    সেই সময়ে পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে উপমহাদেশের কি সম্পর্ক ছিল জানতে খুবই ইচ্ছে করে |  চিঠির ব্যাপারে এই পারস্যের রাজা দ্বিতীয়-খুসরুর একটি ইতিহাস আছে | ইতিহাসে পারস্যের সাসানাইড বংশের ইনিই ছিলেন শেষ পরাক্রান্ত সম্রাট |
     
    ইনি তার রাজত্বের শেষদিকে একটি চিঠি পান তার রাজত্বের একটি খুব অবহেলিত প্রান্ত হেজাজ থেকে যেখানে এক ব্যক্তি তাকে একটি বিশেষ মতে চলতে অনুসরণ করেন | দ্বিতীয়-খুসরু যথারীতি হেজাজের এই চিঠিকে গুরুত্ব দেননি | তারপর ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায় সেই ব্যক্তির ওই চিঠির নামে |
     
    সত্যি ইতিহাস বড়ো বিচিত্র |
     
     
     
     
  • Sara Man | ০৭ আগস্ট ২০২২ ১৬:১৮510839
  • "তবে সঠিক বললে দাক্ষিণাত্য বলতে নর্মদা থেকে কৃষ্ণা নদী পর্যন্ত অঞ্চল, মহারাষ্ট্র এবং পূর্বের তেলুগু অঞ্চলকেও বোঝায়।" - কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে কী আছে, সেটা তবে উত্তরাপথের আর্যদের জানা ছিলনা? কতদিন পর্যন্ত অজানা ছিল? 
  • Sara Man | ০৭ আগস্ট ২০২২ ১৬:২২510840
  • অনতিক্রম‍্য বিন্ধ‍্যকে ভয় না পেয়ে অগস্ত‍্য পেরিয়ে চলে গেলেন বা পথ তৈরি করলেন। বিন্ধ‍্য পর্বতের মাথা নোয়ানো তার মানে প্রতীকী। ছোটবেলা থেকে গল্পটা জানি, কিন্তু এভাবে ভাবিনি। 
  • Sara Man | ০৭ আগস্ট ২০২২ ১৬:৩০510841
  • বিন্ধ‍্য পর্বতের কাছে মহাকাল পর্বতের অমরকন্টকে অসংখ্য মুনিকে জড়িয়ে গল্প শুনেছি - ভৃগু থেকে কবীর পর্যন্ত। ঐ স্থানটি দর্শন ভৌগোলিক হিসেবে আমার অনন্য অভিজ্ঞতা। ওখানেই ভারতবর্ষ গালে চড় মেরে বুঝিয়ে দিয়েছে পৌরাণিক উপাখ্যানের মধ‍্যে কেমনভাবে লুকিয়ে আছে ভৌগোলিক সত‍্য। ওখানকার কোন ইতিহাস জানতে পারলে বলবেন দয়া করে। 
  • Kishore Ghosal | ০৭ আগস্ট ২০২২ ২০:৪২510849
  • গুরুবাবু, 
    "দাক্ষিণাত্যের পশ্চিমে চালুক্যবংশীয় দ্বিতীয় পুলকেশীর কাছে হর্ষবর্ধন পরাজিত হয়েছিলেন এবং এর পর দক্ষিণ জয়ের চেষ্টা তিনি ছেড়েই দিয়েছিলেন" (অধ্যায় ৪.৪.৬)। হর্ষবর্ধন দাক্ষিণাত্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। 
  • Kishore Ghosal | ০৭ আগস্ট ২০২২ ২১:১১510851
  • শারদা ম্যাডাম, দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে উত্তর ভারতের প্রথম স্পষ্ট পরিচয় মৌর্য আমলে, তার আগে বিচ্ছিন্ন কিছু যোগাযোগ গড়ে তুলেছিল বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের প্রচারক শ্রমণরা। 
     
    উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের  দুর্গম বিভাজক অবশ্যই বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতমালা, দুই পর্বতশ্রেণীর মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত নর্মদা নদী এবং এই নদী উপত্যকার দুই পাশের গভীর ও শ্বাপদসংকুল অরণ্য। 
     
    এই নর্মদা নদী উপত্যকায় বহু  সম্পন্ন ও প্রাচীন  অনার্য সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এবং বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই অঞ্চলকেই পুরাণে "পাতাল" বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শৈব পুরাণগুলিতে নর্মদা উপত্যকাকে "শিবক্ষেত্র" বলা হয়, বলা হয়েছে নর্মদা ভগবান শিবের মানসপুত্রী, যাঁর অন্য নাম "রেবা"। এই নদীর দুই তটরেখায় অজস্র প্রাচীন শিবমন্দিরের অবস্থান এবং সেগুলি ঘিরে অজস্র মুনি ঋষি, রাজা, রাজপুত্রের তপস্যা এবং সিদ্ধিলাভের কাহিনী শোনা যায়। 
     
    আরও বলা হয়ে থাকে, পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা - পাপীদের পাপ ধুতে ধুতে যখন নিজেই ক্লিন্ন হয়ে ওঠেন, তিনি "কৃষ্ণা গাভী"-র রূপ ধরে রেবা নদীতে স্নান করতে যান ক্লেদমুক্ত হতে। 
     
    নর্মদা প্রসঙ্গ সংক্ষেপে আসবে পঞ্চম পর্বে। একটু ধৈর্য রাখুন প্লিজ। 
  • Sara Man | ০৭ আগস্ট ২০২২ ২১:২০510853
  • হ‍্যাঁ নিশ্চয়ই। ধৈর্য রেখেছি। 
  • মাধুরী হাজরা | 2601:282:4980:4740:cce5:cb43:5230:***:*** | ২৫ নভেম্বর ২০২২ ০২:০২514126
  • অনেকদিনবাদে পড়াতে ফেরত এলাম। যথারীতি ভীষণ আগ্রহে পড়ছি। নর্মদা পরিক্রমার লেখা কিছুখিছু পড়ে অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছি। আপনার নর্মদা সম্বন্ধে লেখার জন্যে অপেক্ষায় রইলাম। হয়ত লেখা হয়ে গেছে আমারি পড়া হয় নি। 
     
    অশেষ ধন্যবাদ ভাই ধৈর্য এবং স্থৈর্য ধরে লেখা, আমাদের প্রশ্ন পড়া ও তার উত্তর দেবার জন্যে। 
  • মাধুরী হাজরা | 2601:282:4980:4740:cce5:cb43:5230:***:*** | ২৫ নভেম্বর ২০২২ ০২:০৮514127
  • স্বর্গীয় শৈলেন্দ্রনারায়ণ ঘোষাল মহাশয়ের লেখা "তপোভূমি নর্দমা"র কয়েক খণ্ড বার বার পড়েছি। ওপরে সেটারই উল্লেখ করছিলাম। 
  • Kishore Ghosal | ২৫ নভেম্বর ২০২২ ১১:৩৮514136
  • মাধুরীদিদি, 
    দীর্ঘদিন আপনার মন্তব্য না পেয়ে ভেবেছিলাম, এই লেখাটি নিয়ে আপনি আগ্রহ হারিয়েছেন। আজ বড়ো আনন্দ পেলাম, আপনার ফিরে আসায়। 
    নর্মদা নিয়ে খুব সংক্ষিপ্ত আলোচনা আছে পঞ্চম পর্বের ভগবান শিব প্রসঙ্গে। সুপণ্ডিত শৈলেন্দ্রনারায়ণবাবুর "তপোভূমি নর্মদা" বইয়ের সাতটি খণ্ড বহুবার পড়েছি, বইটি শাস্ত্রীয় তথ্যের আশ্চর্য ভাণ্ডার। তবে অলৌকিক অজস্র ঘটনার উল্লেখগুলি আমার মনকে তেমন নাড়া দেয়নি।     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন