এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • ধর্মাধর্ম - চতুর্থ পর্ব - ষষ্ঠ  ভাগ

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ০২ আগস্ট ২০২২ | ১৫১৩ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)
  • চতুর্থ পর্ব - থেকে ১৩০০ সি.ই. – ষষ্ঠ ভাগ
     
    ৪.৬ রাজা হর্ষ পরবর্তী উত্তর ভারত

    এই অধ্যায় এবং এর পরবর্তী অধ্যায়গুলি পড়তে বিরক্তি আসতেই পারে। যাঁরা ইতিহাস নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছেন কিংবা ঐতিহাসিক হয়েছেন, তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু এত রাজবংশ, রাজাদের নাম এবং তাঁদের অজস্র সালতামামি মনে রাখার ভয়ে আমাদের মধ্যে অনেকেই স্কুলজীবনের পর ইতিহাস বই ছুঁয়েও দেখিনি। তা সত্ত্বেও, ইতিহাস-বিরক্ত পাঠকদের অনুরোধ করব, খুঁটিয়ে পড়তে ইচ্ছা না হলে পড়বেন না, শুধু চোখ বুলিয়ে যান। লক্ষ্য রাখুন, ৬৪৭ সি.ই.-তে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর মোটামুটি ১৩০০ সি.ই. পর্যন্ত – দীর্ঘ এই প্রায় সাড়ে ছ’শো বছরের ভারতীয় রাজনীতির পরিস্থিতির দিকে। সে সময় আমাদের এই ভারতবর্ষ কতগুলি টুকরো ছিল। এবং সেই টুকরোগুলির অধিকার নিয়ে কতগুলি রাজবংশ সৃষ্টি হয়েছে, আর কতগুলি ধ্বংস হয়েছে। প্রত্যেকটি টুকরো রাজ্য কীভাবে প্রতি নিয়ত ব্যস্ত ছিল লাগাতার যুদ্ধে। শুধু সেইটুকুই লক্ষ্য রাখুন।

    তা নাহলে কী করে বুঝবেন, আমাদের আধুনিক ভারতবর্ষের চেহারাটা কেন এমন হল? উত্তরভারতের সঙ্গে কেন বনে না দক্ষিণভারতের? বঙ্গ–বিহার-উড়িষ্যার মতো প্রতিবেশী রাজ্যবাসীদের মনে কেন সুপ্ত হয়ে রয়েছে বিদ্বেষ? একটু ফুলকির স্পর্শেই কেন ঘটে যায় দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাসমূহ? আমরা যতই আশ্চর্য ও অত্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তিময় যুগে জীবনযাপন করি না কেন, আমাদের মানসিকতার সিংহভাগ পড়ে আছে সেই ত্রয়োদশ শতাব্দীর আশেপাশেই!     

    “এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে” - কবিগুরু যখন এই কথাগুলি লিখেছিলেন, তখন কী তিনি ভারতের এই ইতিহাস জানতেন না? আমি নিশ্চিত, অন্ততঃ আমার থেকে সহস্রগুণ ভালোভাবে জানতেন। তবুও তিনি লিখেছিলেন, হতে পারে, তার একটিই কারণ – ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সাধারণ ভারতীয়দের ঐক্য দেখে তিনি আশ্চর্য হয়েছিলেন এবং স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বাধীন ভারত বুঝি বা এমনই থাকবে। কিন্তু কই, আমরা তেমন তো রইলাম না? কিন্তু কেন থাকতে পারলাম না? এই সাড়ে ছশ’ বছরের রাজতন্ত্র এবং প্রশাসনিক উচ্চমহলের আত্মক্ষয়ী নির্বোধ অহংকার আমাদের জীবন এবং ভাবনা- চিন্তায় যে চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল, সেই অভিশাপই যে আমরা আজও বহন করে চলেছি।  

    ৪.৬.১ কনৌজ

    ৪.৬.১.১ রাজা যশোবর্মন
    ৬৪৭ সি.ই.-র কাছাকাছি কোন সময়ে রাজা হর্ষের মৃত্যুর পর প্রায় পঁচাত্তর বছর কনৌজের ইতিহাস তেমন কিছু জানা যায় না। তারপরে মোটামুটি ৭২৫ – ৭৫২ সি.ই. পর্যন্ত যশোবর্মন কনৌজের রাজা ছিলেন। যথারীতি তাঁর বংশ পরিচয় স্পষ্টভাবে জানা যায় না, অনেকে মনে করেন, তিনি মৌখরি বংশের রাজা। তাঁর সময়ে কাশ্মীরের রাজা ছিলেন, ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় এবং চীনের এক লেখা থেকে জানা যায় রাজা যশোবর্মন মধ্যভারতের রাজা ছিলেন এবং চীনের রাজসভায় দূত পাঠিয়েছিলেন।
     
    যশোবর্মনের রাজ্য বিস্তারে, তিনি যে মগধের রাজা “মগহনাহ”কে পরাজিত করেছিলেন এবং বঙ্গের অনেকটা জয় করেছিলেন, সে বিষয়ে হয়তো সন্দেহ নেই। কিন্তু কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য ৭৩৩ সি.ই.তে তাঁর কাশ্মীর জয়ের আশা পূর্ণ হতে দেননি। এই রাজা যশোবর্মনেরই সমসাময়িক ছিলেন, কবি ভবভূতি, যাঁর কথা আগেই বলেছি, তাঁর সভায় আরেক কবির নাম পাওয়া যায়, “বাকপতি”, তাঁর গ্রন্থের নাম “গৌড়ারোহ”। যশোবর্মনের পরে তাঁর উত্তরসূরি আরও তিনজন রাজা হয়েছিলেন, তবে তাঁদের সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না।

    ৪.৬.১.২ আয়ুধ রাজবংশ
    এই বংশের তিনজন রাজা কয়েক বছরের জন্য রাজত্ব করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রথম রাজার নাম ছিল বজ্রায়ুধ। তাঁর রাজত্বকালের শুরু হয়তো ৭৭০ সি.ই.-তে। তিনি হয়তো কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্যকে পরাস্ত করতে পেরেছিলেন কিন্তু পরে কাশ্মীরের রাজা জয়াপীড় বিনয়াদিত্যের (৭৭৯-৮১০সি.ই.) হাতে পরাস্ত হয়েছিলেন। তাঁর পরবর্তী রাজা ছিলেন ইন্দ্রায়ুধ এবং তাঁর সমসাময়িক কালেই বঙ্গের পাল রাজাদের উত্থান এবং রাষ্ট্রকূট বংশের ধ্রুব (৭৭৯-৭৯৪ সি.ই.) গঙ্গা-যমুনার দোয়াব অঞ্চল পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। বাংলার রাজা ধর্মপালের কাছে ইন্দ্রায়ুধ পরাজিত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর পুত্র চক্রায়ুধকেই রাজা ধর্মপাল কনৌজের প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু প্রথম অমোঘবর্ষের শিলালিপি থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রুবর পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ (৭৯৪-৮১৪ সি.ই.), ধর্মপাল এবং চক্রায়ুধ দুজনকেই রাষ্ট্রকূট রাজাদের বশ্যতা স্বীকার করিয়েছিলেন। এই বিশৃঙ্খলা গঙ্গা-যমুনার দোয়াব অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল করে তুলেছিল এবং সেই সুযোগে প্রতিহার বংশের দ্বিতীয় নাগভট্ট চক্রায়ুধকে পরাস্ত করে কনৌজ অধিকার করে নিয়েছিলেন।

    ৪.৬.১.৩ গুর্জর-প্রতিহার
    রজোরার (আলোয়ার) শিলালিপিতে প্রতিহারদের “গুর্জর-প্রতিহারানবায়” অর্থাৎ গুর্জরদের এক শাখা গোষ্ঠী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গুর্জররা ছিলেন, মধ্য এশিয়ার এক উপজাতি, যাঁরা গুপ্তসাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর, হুণদের কিছু পরেই উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পথে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন।

    প্রতিহারদের প্রথম অস্তিত্ব পাওয়া যায় মধ্য রাজস্থানের মান্দোর (যোধপুরের কাছে) অঞ্চলে এবং রাজত্ব করতেন হরিচন্দ্র। তাঁদের একটি শাখা দক্ষিণে এগিয়ে উজ্জয়িনী অধিকার করেছিলেন। প্রতিহারদের এই শাখার রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, নাগাবালোক অথবা প্রথম নাগভট, শোনা যায় তিনি শক্তিশালী ম্লেচ্ছদের বিতাড়িত করেছিলেন এবং ভারুকচ্ছ (ভারুচ) পর্যন্ত নিজের আয়ত্তে এনেছিলেন। এই ম্লেচ্ছ সম্ভবতঃ আরবের যোদ্ধা কোন উপজাতি। প্রথম নাগভটের পরবর্তী দুই রাজা গুরুত্বহীন কিন্তু তাঁদের পরবর্তী বৎসরাজা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মধ্য রাজস্থানের ভাণ্ডি বা ভাট্টি উপজাতিদের পরাস্ত করেছিলেন, প্রায় সম্পূর্ণ রাজপুতানা অধিকারে এনেছিলেন। তিনি গৌড়ের রাজা ধর্মপালকেও পরাজিত করেছিলেন। যদিও এর কিছুদিন পরেই রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রুব তাঁকে উৎখাত করে দেন এবং শোনা যায় তিনি মরু অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

    বৎসরাজার পর রাজা হয়েছিলেন দ্বিতীয় নাগভট (৮০৫-৮৩৩ সি.ই.)। তিনি পিতৃরাজ্য আবার অধিকারের জন্যে খুবই চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দের কাছে চূড়ান্ত পরাজিত হয়েছিলেন এবং দুর্বল কনৌজ অধিকার করেছিলেন। তৃতীয় গোবিন্দর ৮১৪ সি.ই.-তে মৃত্যু হওয়াতে দ্বিতীয় নাগভট কিছুটা স্বস্তি পেলেও, গৌড়ের রাজা ধর্মপাল এইসময় কনৌজ অধিকার করে নিয়েছিলেন। এরপর তিনি ভয়ংকর লড়ে মুদ্‌গগিরি (মুঙ্গের) জয় করেন এবং পরবর্তী কালে এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন, যার ফলে অন্ধ্র, সিন্ধু, বিদর্ভ এবং কলিঙ্গের রাজারা তাঁর সঙ্গে মৈত্রী করতে বাধ্য হয়েছিলেন। গোয়ালিয়র শিলালিপি থেকে জানা যায়, এরপর দ্বিতীয় নাগভট একে একে আনর্ত্ত (উত্তর কাথিয়াবাড়), মালব (মধ্য ভারত), মৎস (পূর্ব রাজপুতানা), কিরাত (হিমালয় অঞ্চলে), তুরুস্ক ( পশ্চিম ভারতের আরবি সম্প্রদায়) এবং বৎস রাজাদের অধীন কোশাম্বি (উত্তরপ্রদেশের একটি জেলা) জয় করে নিয়েছিলেন।

    দ্বিতীয় নাগভটের পর রাজা হয়েছিলেন তাঁর পুত্র রামভদ্র, তিনি খুবই দুর্বল রাজা ছিলেন, এবং তাঁর রাজত্বকালে সাম্রাজ্যে নানান বিশৃঙ্খলা দেখা গিয়েছিল। তাঁর পুত্র মিহির ভোজ(৮৩৬-৮৫ সি.ই.) সিংহাসনে বসেই কঠোর হাতে সাম্রাজ্যের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন এবং মধ্যদেশের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠলেন। প্রথমেই তিনি পূর্বদিকে বঙ্গ ও গৌড় জয়ের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বঙ্গের তৎকালীন রাজা দেবপাল (৮১৫-৫৫ সি.ই.)-এর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে, পূর্বের আশা ছেড়ে দক্ষিণে মন দিলেন। তিনি নর্মদা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করতে পারলেও রাষ্ট্রকূট রাজ দ্বিতীয় ধ্রুব ধারাবর্ষের কাছে পরাস্ত হলেন, হয়তো ৮৬৭ সি.ই.-তে। যদিও তাঁর বিভিন্ন প্রত্ন-নিদর্শন থেকে আন্দাজ করা যায় তাঁর রাজ্য পশ্চিমে পেহোয়া (কারনাল) এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। একজন আরবি ভ্রমণকারী, সুলেইমানের ৮৫১ সি.ই.-র লেখা থেকে জানা যায়, ভোজ একজন দক্ষ প্রশাসক ছিলেন, তাঁর সমৃদ্ধ রাজত্ব ছিল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এবং রাজ্যে কোথাও চুরি-ডাকাতির ঘটনা ছিল না। তবে তিনি “আরবিদের পছন্দ করতেন না” এবং “মুসলিম ধর্মবিশ্বাসীদের প্রতি অত্যন্ত শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন”।

    মিহির ভোজের পর রাজা হয়েছিলেন, তাঁর পুত্র প্রথম মহেন্দ্রপাল (৮৮৫-৯১০ এ.ডি)। তিনি পূর্বদিকে মগধ এবং উত্তরবঙ্গ অধিকার করলেও, তাঁর সাম্রাজ্য অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। প্রথম মহেন্দ্রপাল সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তাঁর সভাকবি ছিলেন রাজশেখর, তাঁর গ্রন্থগুলির নাম “কর্পূরমঞ্জরী”, “বাল-রামায়ণ”, “বালভারত”, “কাব্যমীমাংসা” ইত্যাদি। প্রথম মহেন্দ্রপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রদের মধ্যে কিছুটা বিবাদ হয়েছিল, কিন্তু শেষমেষ সিংহাসনে বসেছিলেন মহীপাল (৯১২ – ৪৪ সি.ই.)। মহীপাল রাজা হওয়ার পরেই রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় ইন্দ্রের ভয়ংকর আক্রমণে কনৌজ এবং পূর্বদিকের রাজ্যগুলিও প্রতিহারদের হাতছাড়া হয়ে যায়। রাষ্ট্রকূটরা ফিরে যাওয়ার পর, প্রতিহারদের দুর্বলতার সুযোগে, বঙ্গের পাল রাজারা ৯১৬-১৭ সি.ই.-তে তাঁদের অধিকৃত রাজ্যগুলির অনেকটাই জয় করতে পেরেছিলেন।

    মহীপালের পরে রাজা হয়েছিলেন দেবপাল, তিনি সিংহাসনে বসেছিলেন ৯৪৮ সি.ই.-র কিছুদিন আগেই, কিন্তু তাঁর দুর্বলতার সুযোগে, প্রথম মাথাচাড়া দিয়ে উঠল চান্দেলরা এবং প্রতিহার সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করল। প্রতিহার বংশের পরবর্তী রাজা বিজয়পালের সময়ে, প্রতিহার সাম্রাজ্য বেশ কয়েকটি খণ্ডরাজ্যে বিভক্ত হয়ে গেল, যেমন, যোজকভুক্তির (বুন্দেলখণ্ড) চান্দেল, অনহিলওয়াড়ার (পাতান, গুজরাট) চালুক্য, গোয়ালিয়রের কচপঘাত, দাহলের চেদি, মালবের পরমার, দক্ষিণ রাজপুতানার গুহিল এবং শাকম্ভরির (রাজস্থান) চাহমানরা। যাই হোক, দশম শতাব্দীর শেষ দশকে পরবর্তী রাজা রাজ্যপাল যখন সিংহাসনে বসলেন, প্রতিহার সাম্রাজ্যের সূর্য তখন অস্তাচলে। এই সময়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের মুসলিম রাজ্য থেকে ভারতজয়ের অভিযান শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাজ্যপাল উদ্‌ভাণ্ডপুরের (ভাটিণ্ডা) শাহী রাজা জয়পালের সঙ্গে যৌথভাবে ৯৯১ সি.ই.তে সুলতান সবুক্তিগিন এবং ১০০৮ সি.ই.-তে জয়পালের পুত্র আনন্দপালের সঙ্গে সুলতান মামুদকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। এই যৌথ প্রচেষ্টা দুবারই ব্যর্থ হয়েছিল, এবং ১০১৮ সি.ই.তে রাজ্যপাল গঙ্গা পার হয়ে বারিতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এরপরেও ১০৩৬ সি.ই. পর্যন্ত প্রতিহার রাজাদের কথা শোনা যায়, শেষ রাজার নাম ছিল যশপাল।

    ৪.৬.১.৪ গাড়োয়াল
    গাড়োয়াল রাজাদের বংশপরিচয় জানা যায় না। তবে ১০৮০ বা ১০৮৫ সি.ই.-র মধ্যে কোন এক সময় গাড়োয়াল বংশের প্রথম রাজা চন্দ্রদেব, কোন এক গোষ্ঠী প্রধান গোপালকে পরাস্ত করে, কনৌজ অধিকার করেছিলেন। চন্দ্রদেবের শিলালিপি থেকে জানা যায়, তিনি কাশি, উত্তর কোশল (ফৈজাবাদ জেলা), কুশিকা (কনৌজ) এবং ইন্দ্রপ্রস্থ (দিল্লি)-র রক্ষাকর্তা। চন্দ্রদেব সম্ভবতঃ ১১০০ সি.ই.তে মারা যান। চন্দ্রদেবের পর রাজা হন মদনপাল, তারপর ১১১৪ সি.ই.-তে রাজা হন মদনপালের পুত্র গোবিন্দচন্দ্র। রাজা হওয়ার আগেই যখন তিনি যুবরাজ ছিলেন ১১০৯ সি.ই.-তে, মুসলিম রাজা তৃতীয় মাসুদের (১০৯৮-১১১৫ এ.ডি) সেনাপতি হাজিব তুঘাতিগিনের অভিযান প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন। রাজা হবার পর তিনি বঙ্গের দুর্বল পালরাজাদের থেকে মগধ এবং মুঙ্গের অধিকার করে নিয়েছিলেন, আরও জয় করেছিলেন মালবের পূর্বাংশ। এছাড়া কাশ্মীরের জয়সিংহ (১১২৮-৪৯ সি.ই.), গুজরাটের সিদ্ধারাজ জয়সিংহ (১০৯৫ -১১৪৩ সি.ই.) এবং সম্ভবতঃ দক্ষিণের চোলদের সঙ্গেও তাঁর মৈত্রী সম্পর্ক ছিল।
     
    গোবিন্দচন্দ্রের পর রাজা হয়েছিলেন তাঁর পুত্র বিজয়চন্দ্র ১১৫৪ সি.ই.-তে। সেসময় গজনির আলাউদ্দিন ঘোরির কাছে পরাস্ত হয়ে লাহোর অধিকার করেছিলেন আমির খুসরু। বিজয়চন্দ্রকে এই আমির খুসরু বা তাঁর পুত্র খুসরু মালিকের ভারত অভিযান প্রতিরোধ করতে হয়েছিল। বিজয়চন্দ্রের সময় চাহমান (চৌহান) এবং চান্দেলরা আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলে এবং সম্ভবতঃ তাঁর রাজত্ব থেকে দিল্লি হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।

    বিজয়চন্দ্রের পুত্র জয়চন্দ্র রাজা হয়েছিলেন, ১১৭০ সি.ই.-তে। তাঁর রাজত্বকালের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল সুলতান সিহাবুদ্দিন ঘোরির ভারত আক্রমণ। ১১৯১ সি.ই.-তে চাহমান বা চৌহান রাজা পৃথ্বীরাজ সুলতান ঘোরিকে তারৌরির যুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন। এই পরাজয়ে সুলতান ঘোরি এতই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে, পরের বছর ফিরে এসে তিনি রাজা পৃথ্বীরাজকে পরাস্ত করেন এবং হত্যা করেন। এই ঘটনায় জয়চন্দ্র সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন এবং কিছুটা স্বস্তিও পেয়েছিলেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, পৃথ্বীরাজের মৃত্যুতে উত্তর ভারতে তাঁর শক্তি বৃদ্ধি হবে। কিন্তু তাঁর সে স্বপ্ন পূর্ণ হয়নি, কারণ ১১৯৪ সি.ই.-তে সুলতান সিহাবুদ্দিন কনৌজ আক্রমণ করেন এবং চন্দোয়ার ও এটাওয়ার যুদ্ধে জয়চন্দ্র পরাজিত এবং নিহত হন। যদিও সুলতান সিহাবুদ্দিন জয়চন্দ্রের পুত্র হরিশচন্দ্রকে কনৌজের প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন। এরপর মোটামুটি ১২২৬ সি.ই.-তে গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চল মুসলিম রাজত্বের অধিকারে চলে গিয়েছিল।

    ৪.৬.১.৫ চাহমান বা চৌহান
    চাহমান বা চৌহানরাও সম্ভবতঃ মধ্য এশিয়ার কোন উপজাতি এবং অগ্নির উপাসক বা অগ্নিবংশ বলে পরিচিত ছিলেন। অগ্নির পবিত্রতায় তাঁরা ভারতীয় সমাজে খুবই সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাঁদের বেশ কয়েকটি শাখা গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন সাকম্ভরী বা সাম্ভর গোষ্ঠী। তাঁদের কথা প্রথম জানা যায়, ৯৭৩ সি.ই.-র শিলালিপি থেকে এবং তাঁদের রাজা প্রথম গুবক, প্রতিহার রাজ দ্বিতীয় নাগভটের সমসাময়িক ছিলেন। তবে দ্বাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই বংশের রাজা অজয়রাজ, রাজস্থানে অজয়মেরু নামে এক নগরের প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজকের আজমীড়। আরেকজন রাজার নাম জানা যায় চতুর্থ বিগ্রহরাজ বিশালদেব (১১৫৩-৬৪ সি.ই.), তিনি নাকি দিল্লি জয় করেছিলেন এবং গাড়োয়াল রাজ বিজয়চন্দ্রকে পরাজিত করেছিলেন। এই বংশের সব থেকে বিখ্যাত রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজ (১১৭৯-৯২ সি.ই.), যাঁকে মুসলিম ঐতিহাসিকরা রাই পিথৌরা বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর সম্বন্ধে অনেক নায়কোচিত কাহিনী শোনা যায়। সমসাময়িক কনৌজের রাজা জয়চন্দ্রের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সম্পর্ক মোটেই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। রাজা জয়চন্দ্র নিজের কন্যা সংযুক্তা বা সংযোগীতার বিবাহের জন্যে যে স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেছিলেন, সেখানে রাজা পৃথ্বীরাজকে তিনি আমন্ত্রণ জানাননি। কিন্তু পৃথ্বীরাজ সভার মাঝখানে হঠাৎ উপস্থিত হয়ে বীরের মতো সংযুক্তাকে হরণ করেছিলেন, শোনা যায় কন্যা সংযুক্তারও এতে পরোক্ষ সম্মতি ছিল, তিনি রাজা পৃথ্বীরাজের গুণমুগ্ধা ছিলেন। এই পৃথ্বীরাজ চান্দেল রাজ পরমারদি (১১৬৫-১২০৩ সি.ই.)-কে পরাস্ত করে বুন্দেলখণ্ড জয় করেছিলেন এবং গুজরাটের চালুক্যরাজ দ্বিতীয় ভীমের সঙ্গেও তাঁর যুদ্ধ বেধেছিল।  তাঁর শেষ পরিণতি এবং মৃত্যুর কথা আগেই বলেছি।

    ৪.৬.২ কাশ্মীর
    কাশ্মীরের ইতিহাসের সব থেকে নির্ভরযোগ্য নথি কলহনের “রাজতরঙ্গিণী”। কিন্তু কলহনের এই অমূল্য গ্রন্থের রচনাকাল ১১৫০ সি.ই., অতএব খুব স্বাভাবিক ভাবেই সপ্তম শতাব্দী বা তারও আগেকার ঘটনার ব্যাপারে রাজতরঙ্গিণী আমাদের খুব একটা সাহায্য করতে পারে না। সম্রাট অশোকের সময় কাশ্মীর মৌর্য সাম্রাজ্যেরই অংশ ছিল, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা করা যায়, কারণ সম্রাট অশোক কাশ্মীরে অনেকগুলি বৌদ্ধবিহার ও স্তূপ নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং শ্রীনগর শহরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অশোকের মৃত্যুর পর, শোনা যায়, তাঁর এক পুত্র জালুক বা জলোকা স্বাধীন কাশ্মীর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার কয়েক শতাব্দী পরে কণিষ্ক এবং তাঁর পরবর্তী কুষাণ রাজারা কাশ্মীর শাসন করেছিলেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের আমলে কাশ্মীর স্বাধীন রাজ্য থাকলেও, হুণরাজ মিহিরকুল কাশ্মীরেই তাঁর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

    ৪.৬.২.১ কাশ্মীরের করকোটক রাজবংশ
    রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে কাশ্মীরের রাজা দুর্লভবর্ধনের ঘনিষ্ঠ মিত্রতা ছিল। এই রাজা দুর্লভ ছিলেন নাগ-করকোটক বংশের রাজা, এবং শোনা যায় তাঁরা নাকি পৌরাণিক গো-নন্দ বংশের বংশধর। রাজা দুর্লভ রাজা হর্ষকে ভগবান বুদ্ধের একটি “দাঁত”-এর অবশেষ উপহার দিয়েছিলেন, যেটি কনৌজের স্তূপে রাজা হর্ষ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকালেই হুয়ান সাং কাশ্মীরে ৬৩১-৬৩৩ সি.ই. দু বছর ছিলেন।

    এই বংশের সব থেকে শক্তিশালী এবং উদ্যোগী রাজা ছিলেন, ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় (৭২৪-৭৬০ সি.ই.)। ললিতাদিত্য পাঞ্জাবের বেশ বড়ো একটা অংশ জয় করেছিলেন এবং তাঁর দিগ্বিজয়ের মধ্যে গৌড় এবং তিব্বতও ছিল। যদিও তিনি গৌড় অথবা তিব্বতে রাজ্য বিস্তার করেননি। মুক্তাপীড় চীনের সম্রাটের সভায় রাজদূত পাঠিয়েছিলেন। জানা যায় কাশ্মীরের সঙ্গে চীনের তার আগে থেকেই সুসম্পর্ক ছিল, কারণ মুক্তাপীড়ের পূর্ববর্তী রাজা চন্দ্রাপীড়কে সমসাময়িক চীন সম্রাট বিভূষিত করে সম্মান জানিয়েছিলেন। ললিতাদিত্য অনেকগুলি হিন্দু এবং বৌদ্ধ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার মধ্যে সূর্যদেবের–মার্তণ্ড মন্দির বিখ্যাত।
     
    ললিতাদিত্যর নাতি জয়াপীড় বিনয়াদিত্য (৭৭৯-৮১০ সি.ই.) ককোটক বংশের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য রাজা। জয়াপীড় নেপাল এবং পৌণ্ড্রবর্ধন (উত্তরবঙ্গ) পর্যন্ত অভিযান করেছিলেন। তিনি বিদ্যোৎসাহী রাজা ছিলেন, তাঁর সভায় বেশ কয়েকজন বিদ্বান ও পণ্ডিত মনীষীর নাম জানা যায়, যেমন উদ্ভাট, বামন এবং দামোদরগুপ্ত। জীবনের শেষ দিকে তিনি নাকি অর্থলিপ্সু এবং প্রজাপীড়ক রাজা হয়ে উঠেছিলেন, তার কারণ হয়তো বিভিন্ন অভিযানের জন্যে বিপুল অর্থব্যয় এবং রাজকোষ শূণ্য হয়ে ওঠা! জয়াপীড়ের পরের রাজারা গুরুত্বহীন এবং দুর্বল হয়ে উঠেছিলেন এবং যার ফলে কিছুদিনের মধ্যে করকোটক বংশের পর নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি উৎপল বংশের সৃষ্টি হয়েছিল।

    ৪.৬.২.২ কাশ্মীরের অন্যান্য রাজবংশ
    উৎপল বংশের প্রথম রাজা অবন্তিবর্মন ৮৫৫ সি.ই.-তে রাজত্ব শুরু করেছিলেন। করকোটকদের রেখে যাওয়া শূণ্যগর্ভ রাজকোষের জন্যে তিনি রাজ্যবিস্তার ছেড়ে, মন দিয়েছিলেন রাজ্যের আর্থিক উন্নতিতে। তিনি কাশ্মীরের সেচ ব্যবস্থার বিপুল উন্নতি করেছিলেন। এমনকি বাঁধ দিয়ে বিতস্তা (ঝিলাম) নদীর বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই জলও সেচের কাজে ব্যবহার করেছিলেন। রাজা অবন্তিবর্মনের নাম কাশ্মীরের মানুষ আজও মনে রেখেছেন, তাঁদের শহর অবন্তিপুরের নামে। অবন্তিবর্মনের পর কাশ্মীরের রাজা হয়েছিলেন তাঁর পুত্র শংকরবর্মন– ৮৮৩ সি.ই.-তে। শংকরবর্মন পিতার পথ অনুসরণ না করে রাজ্য জয় এবং অভিযানে মন দিয়েছিলেন। শংকরবর্মনের মৃত্যু হয়েছিল ৯০২ সি.ই.-তে। শংকরবর্মনের পুত্র গোপালবর্মন রাজা হলেও তিনি একটি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ৯০৪ সি.ই.-তে নিহত হন, তারপরেও ৯৩৯ সি.ই. পর্যন্ত উৎপল বংশের গুরুত্বহীন অস্তিত্বটুকুই অবশিষ্ট ছিল।
     
    ৯৩৯ সি.ই.-তে ব্রাহ্মণেরা রাজা গোপালবর্মনের মন্ত্রীর পুত্র প্রভাকরদেবকে রাজা নির্বাচিত করেছিলেন। তাঁর ৯৪৮ সি.ই. পর্যন্ত রাজত্বে রাজ্যে শান্তি এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ৯৪৯ সি.ই.-তে তাঁর পুত্র সংগ্রাম এবং অন্যান্য বংশধরকে হত্যা করে, নিজেই সিংহাসনে বসেছিলেন তাঁর মন্ত্রী পর্বগুপ্ত। এই বংশের সব থেকে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব একজন মহিলা, নাম দিদ্দা। দিদ্দা ছিলেন ভীমশাহির নাতনী এবং পুঞ্চের রাজা লোহার রাজসিংহর কন্যা। তিনি রাজা ক্ষেমগুপ্তর রাণি হিসেবে (৯৫০-৯৫৮ সি.ই.), তারপর পুত্রের অভিভাবিকা হিসেবে এবং পরে নিজের হাতেই (৯৮০-১০০৩ সি.ই.) রাজ্যের শাসনভার তুলে নিয়েছিলেন।

    রাণি দিদ্দা মৃত্যুর আগেই, তাঁর ভাইয়ের পুত্র সংগ্রামরাজাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার দিয়েছিলেন। সুতরাং ১০০৩ সি.ই.-তে রাণির মৃত্যুর পর কাশ্মীরের রাজা হলেন লোহার বংশের সংগ্রামরাজ (১০০৩-২৮ সি.ই.)। সংগ্রামরাজ খুব সফল রাজা হয়ে উঠতে পারেননি, যার ফলে কাশ্মীরে বিশৃঙ্খলা এবং অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকেই রাজা হয়ে কিছুদিনের জন্যে সিংহাসনে বসেছেন, আবার কেউ না কেউ এসে তাঁদের সরিয়েও দিয়েছেন। যাই হোক এই ভাবে ১৩৩৯ সি.ই. পর্যন্ত কাশ্মীরে যে হিন্দু রাজত্ব কোনরকমে চলছিল, তার সমাপ্তি হল মুসলিম অভিযানকারী শাহ্‌ মিরের হাতে, তিনি শামসুদ্দিন রাজ বংশের সূচনা করলেন।

    ৪.৬.৩ বঙ্গ
    নানান প্রত্ন-নিদর্শন থেকে স্পষ্ট ধারণা করা যায়, চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দীতে বঙ্গ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে বঙ্গ কয়েকটি (সম্ভবতঃ চারটি) স্বাধীন রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়। অন্ততঃ তিনজন রাজার নাম জানা যায়, যাঁরা দুর্বল গুপ্তদের বশ্যতা অস্বীকার করেছিলেন, যেমন ধর্মাদিত্য, গোপচন্দ্র এবং সমাচারদেব। ষষ্ঠ শতাব্দীতে বঙ্গের গৌড় অঞ্চল (পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব বঙ্গ) মৌখরিদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল।

    ৪.৬.৩.১ শশাঙ্ক
    গৌড়ের সব থেকে বিতর্কিত রাজার নাম শশাঙ্ক। তাঁর সঙ্গে থানেশ্বরের পুষ্যভূতি এবং কনৌজের মৌখরিদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিল। রাজা শশাঙ্কের পূর্বপুরুষ কিংবা তাঁর পরবর্তী কোন রাজাদের নামও শোনা যায় না। তবে অনুমান করা হয়, গুপ্ত রাজত্বের শেষ দিক থেকেই গৌড়ের সঙ্গে মৌখরিদের বিবাদের সূত্রপাত। সে সময় শশাঙ্ক  সম্ভবতঃ গুপ্তদের সামন্তরাজা ছিলেন। পরবর্তী সময়ে গুপ্তদের শক্তি হ্রাস হওয়াতে, শশাঙ্ক স্বাধীন রাজা হয়ে উঠেছিলেন এবং গুপ্ত এবং মৌখরিদের শত্রুতা কাজে লাগিয়ে, গৌড়ের সীমা পশ্চিমে বাড়াতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। প্রথমেই তিনি মালবের গুপ্ত-রাজ দেবগুপ্তর সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করলেন এবং যৌথভাবে মৌখরি রাজ্য আক্রমণ করলেন। এই যুদ্ধে মৌখরি রাজ গ্রহবর্মন নিহত হলেন, এবং তাঁর স্ত্রী রাজ্যশ্রীকে, যিনি থানেশ্বরের রাজা প্রভাকর বর্ধনের কন্যা ছিলেন, কনৌজের কারাগারে বন্দিনী করে রাখলেন।

    প্রভাকর বর্ধনের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজ্যবর্ধন বিশাল সৈন্য নিয়ে কনৌজ আক্রমণ করলেন, তাঁর বোনকে উদ্ধার করতে। রাজ্যবর্ধন দেবগুপ্তকে পরাজিত করলেন, কিন্তু ৬০৬ সি.ই.-তে নিজেই নিহত হলেন শশাঙ্কের হাতে। পূষ্যভূতি বংশের ঘনিষ্ঠ মিত্র, কবি বাণভট্ট এবং হুয়েনসাং–এর লেখা থেকে জানা যায়, শশাঙ্ক নাকি রাজ্যবর্ধনকে বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করেছিলেন। যাই হোক শশাঙ্ক খুব বেশি দিন কনৌজ অধিকারে রাখতে পারেননি।

    রাজ্যবর্ধনের ভাই হর্ষবর্ধন নিশ্চয়ই তাঁর দাদা এবং বোনের প্রতি অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শশাঙ্কের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা স্পষ্ট করে কিছুই জানা যায় না। এটুকু জানা যায়, হর্ষের সঙ্গে কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মনের মৈত্রী সম্পর্ক ছিল। শশাঙ্কের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ (মুর্শিদাবাদ জেলা, পঃবঙ্গ)। শশাঙ্কর রাজ্য গঞ্জাম (উড়িষ্যা) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শশাঙ্ক মারা যান হয় ৬১৯ অথবা ৬৩৭ সি.ই.-তে। সম্ভবতঃ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর ভাস্করবর্মন কর্ণসুবর্ণ অধিকার করেছিলেন, এবং শশাঙ্কের উত্তরসূরিকে সিংহাসন চ্যুত করেছিলেন।

    ৪.৬.৩.২ বঙ্গের পালবংশ
    শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বঙ্গে অরাজক অবস্থা চলেছিল বহুদিন, সংস্কৃতে যাকে “মাৎস্যন্যায়” যুগ বলা হয়ে থাকে। শশাঙ্কের মৃত্যুর কিছুদিন পরে হুয়েন সাং বঙ্গে এসেছিলেন। তাঁর বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, বঙ্গে তখন প্রধান রাজ্য ছিল চারটি পুণ্ড্রবর্ধন (উত্তরবঙ্গ), কর্ণসুবর্ণ (পশ্চিমবঙ্গের মধ্যভাগ), সমতট (দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গ) এবং তাম্রলিপ্তি (তমলুক–মেদিনিপুর এবং উড়িষ্যার পূর্বাংশ)। ভাস্করবর্মন কর্ণসুবর্ণ অধিকার করলেও, কর্ণসুবর্ণের প্রশাসনিক দায়িত্বে মনোনিবেশ করেছিলেন বলে মনে হয় না, তিনি করদ রাজ্য থেকে কর আদায়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। ভাস্করবর্মনের পরে কনৌজের যশোবর্মন সম্পূর্ণ বঙ্গ অধিকার করেছিলেন বলে শোনা যায়, এমনকি কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য জয়াপীড়ও কিছুদিনের জন্যে বঙ্গ অধিকার করেছিলেন।

    এইরকম অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি কোন সময়ে “জনগণ এই অরাজক (মাৎস্যন্যায়) পরিস্থিতি - প্রত্যেকেই যেন তার প্রতিবেশীর সহজ শিকার – থেকে মুক্তির জন্যে গোপালকে রাজা করলেন”! কোন দিক থেকেই গোপালের বংশ বা তাঁর পারিবারিক পটভূমি নিয়ে কোন কথাই শোনা যায় না। এমনকি গোপাল রাজা হয়েও, কোন পৌরাণিক কিংবা প্রাচীন রাজবংশের সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত করেননি। যদিও অনেক পরবর্তী কালের লিপিতে পালবংশকে সৌরবংশের উত্তরসূরি বলে দাবি করা হয়েছে। গোপালকে বঙ্গ (পূর্ববঙ্গ) এবং গৌড়ের (পশ্চিমবঙ্গের) প্রভু বলা হলেও, তাঁর রাজনৈতিক কৃতিত্বের কোন তথ্য পাওয়া যায় না এবং অনুমান করা হয়, তাঁর রাজত্বকাল ৭৫০-৭৭০ সি.ই.।

    গোপালের পর রাজা হয়েছিলেন তাঁর পুত্র ধর্মপাল (৭৭০-৮১০ সি.ই.)। তাঁর সময়েই পালরাজ্য প্রায় সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছিল। তাঁর সমসাময়িক প্রতিহার রাজারা ছিলেন, বৎসরাজা (৭৩৮-৭৮৪ সি.ই.) এবং দ্বিতীয় নাগভাট (৮০৫-৮৩৩ সি.ই.)। দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটবংশীয় রাজা ছিলেন ধ্রুব (৭৭৯-৭৯৩ সি.ই.) এবং তৃতীয় গোবিন্দ (৭৯৩ – ৮১৪ সি.ই.)। উত্তর ভারতের সার্বভৌম অধিকার পাওয়ার জন্যে এই রাজারা দীর্ঘদিন নিজেদের মধ্যে বারবার যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু শেষ অব্দি প্রতিহাররাই আয়ত্ত্বে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে কিছুদিনের জন্যে ধর্মপাল কনৌজ অধিকার করে চক্রায়ুধকে সামন্তরাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এবং কখনো কখনো সমগ্র উত্তরভারত অধিকার করলেও স্থায়ীভাবে এবং স্বস্তিতে সাম্রাজ্য ভোগ করতে পারেননি।
     
    ধর্মপালের পর রাজা হয়েছিলেন তাঁর পুত্র দেবপাল (৮১০ -৮৫০ সি.ই.), কিছু লিপি থেকে জানা যায়, তিনি উড়িষ্যা, প্রাগজ্যোতিষ বা কামরূপ, হুণ, গুর্জর এবং দ্রাবিড়দের পরাজিত করেছিলেন। তবে লিপি যাই বলুক, কামরূপ এবং উড়িষ্যা ছাড়া, তাঁর সম্পূর্ণ রাজত্বকাল ধরেই তাঁকে গুর্জর-প্রতিহার, রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে। দেবপালের মৃত্যুর পর পালরাজ্য বা সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে সংকীর্ণ ছোট এবং দুর্বল হয়ে পড়েছিল। দেবপালের পর পালবংশের রাজারা হলেন, প্রথম বিগ্রহপাল (৮৫০–৮৫৪ সি.ই.) এবং নারায়ণপাল (৮৫৪-৯০৮ সি.ই.)। নারায়ণপালের পর কামরূপ এবং উড়িষ্যা স্বাধীন রাজ্য হয়ে উঠেছিল। নারায়ণপালের পর রাজা হয়েছিলেন রাজ্যপাল (৯০৮-৯৪০ সি.ই.) এবং তারপর দ্বিতীয় গোপালের (৯৪০-৯৬০ সি.ই.) সময় পালরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল মগধ এবং উত্তরবঙ্গ। রাজ্যপালের সঙ্গে রাষ্ট্রকূট রাজকুমারীর সম্ভবতঃ বিবাহ হয়েছিল, হয়তো এই বৈবাহিক সম্পর্ক পালরাজাদের কিছুদিন স্বস্তি দিয়েছিল। কিন্তু প্রতিহারদের পতনের পর অনেকগুলি নতুন রাজবংশ উত্তরভারতে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, যেমন বুন্দেলখণ্ডের চান্দেল, চেদির (মধ্যপ্রদেশের) কলচুরি, মালবের পরমার, গুজরাটের চালুক্য এবং শাকম্ভরির (রাজপুতানা) চাহমান বা চৌহান। এই রাজবংশগুলির মধ্যে চান্দেল এবং কলচুরি বঙ্গ আক্রমণ করেছিলেন দ্বিতীয় গোপাল এবং দ্বিতীয় বিগ্রহপালের (৯৬০-৯৮৮ সি.ই.) রাজত্বে। সে সময় পালরাজাদের ক্ষমতা খুবই সীমিত হয়ে পড়েছিল। এরপর প্রথম মহীপাল (৯৮৮-১০৩৮ সি.ই.) পালরাজ্যের কিছুটা শক্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন, কিন্তু বারবার চোল এবং কলচুরিদের আক্রমণের বিরুদ্ধে খুব একটা কিছু করতে পারেননি। তাঁর পরবর্তী পালরাজারা হলেন, নয়পাল (১০৩৮-১০৫৫ সি.ই.), তৃতীয় বিগ্রহপাল (১০৫৫-১০৭০ সি.ই.) এবং দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭০-১০৭৫ সি.ই.)। উত্তরবঙ্গের একটি বিদ্রোহ সামলাতে গিয়ে সেখানেই দ্বিতীয় মহীপালের পরাজয় এবং মৃত্যু ঘটে, উত্তরবঙ্গের রাজা হন এক কৈবর্ত, দিব্য। এরপর পালরাজারা বাংলার ইতিহাসেও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিলেন।
     
    পালরাজারা সকলেই বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন এবং বৌদ্ধধর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। প্রধানতঃ পাল রাজাদের সময়েই বিহার ও বঙ্গে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বাকি ভারতবর্ষের তুলনায় অনেকটাই বেশি ছিল। পালরাজাদের পতনের পরপরই বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্য ভারতবর্ষ থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। পালরাজাদের আমলে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার নির্মিত হয়েছিল, যেমন বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরি, রক্তমৃত্তিকা, সোমপুরা ইত্যাদি। এ সময়েই বাংলার সঙ্গে তিব্বত, নেপাল এবং বার্মার নিবিড় যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল।
    পালরাজাদের সময়ে বাংলায় সংস্কৃতের গুরুত্ব বেড়ে উঠেছিল, যদিও মাগধী প্রাকৃত, অপভ্রংশ এবং বাংলাও প্রচলিত ছিল। এই সময়েই বাংলা ভাষার নিজস্ব লিপির প্রচলন হয়েছিল। প্রথম বাংলা ভাষার গ্রন্থ “চর্যাপদ” এই সময়কালেই রচিত।

    ৪.৬.৩.৩ বঙ্গের সেনবংশ
    বঙ্গ থেকে পালবংশকে মুছে দিয়ে নতুন সেনবংশের সূত্রপাত করেছিলেন সামন্তসেন। যতদূর জানা যায় সেনরা দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটপ্রদেশ থেকে বঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে এসেছিলেন। তাঁরা নিজেদের কর্ণাট-ক্ষত্রিয় এবং ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয় নামে পরিচয় দিতেন এবং বলতেন সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা বীরসেন ছিলেন চন্দ্রবংশের বংশধর। সামন্তসেনের পৌত্র বিজয়সেন দীর্ঘ বাষট্টি বছর রাজত্ব করেছিলেন, (১০৯৫ -১১৫৮ সি.ই.)। তাঁর সময়েই সেনরাজ্য বিস্তার লাভ করেছিল এবং সম্পূর্ণ বঙ্গ সেন রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তিনি একসময় গঙ্গার তীর ধরে যুদ্ধ অভিযানে বেরিয়েছিলেন এবং পশ্চিমের বহু রাজ্যই নাকি তাঁর অধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিল। অন্যদিকে তিনি হয়তো  কামরূপ এবং কলিঙ্গও অধিকার করেছিলেন।
     
    বিজয়সেনের পর রাজা হয়েছিলেন, তাঁর পুত্র বল্লাল সেন, তাঁর মাতা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের শূর বংশের রাজকুমারী বিলাসদেবী। বল্লাল সেন কোন নতুন রাজ্য জয় করেননি, কিন্তু পিতার রাজ্য অক্ষত রাখতে পেরেছিলেন। পিতা বিজয়সেনের মতোই বল্লালসেনও শৈব ছিলেন। কথিত আছে বল্লালসেন বঙ্গের বর্ণ প্রথার সংস্কার করেছিলেন এবং তিনিই কৌলিন্য প্রথার প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু এই প্রবাদের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায় না। বল্লালসেন পণ্ডিত এবং বিদ্বান রাজা ছিলেন বলে শোনা যায়। তাঁর গুরুদেবের নির্দেশে তিনি দুটি গ্রন্থ সংকলন শুরু করেছিলেন - “দানসাগর” এবং “অদ্ভূতসাগর” - কিন্তু শেষ করতে পারেননি।

    বল্লালসেনের পুত্র লক্ষ্মণসেনের যুদ্ধ জয়ে আগ্রহ ছিল। তিনি অভিযানে বেরিয়ে যে যে অঞ্চল জয় করেছিলেন, সেখানে বিজয়স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করিয়েছিলেন। এরকম বিজয়স্তম্ভের নিদর্শন পাওয়া গেছে, বেনারস এবং এলাহাবাদে। সমসময়ে ওই দুই অঞ্চলের রাজা ছিলেন গাড়োয়াল বংশীয় শক্তিশালী রাজা জয়চন্দ্র। অতএব বেনারস ও এলাহাবাদ বিজয়ের কথা সত্যি হলে, তাঁকে বীর একথা মানতেই হয়। কিন্তু মুসলিম সেনাপতি মহম্মদ ইব্‌ন্‌ বখতিয়ার খিলজি বিহার জয় করে, যখন নদীয়া আক্রমণ করেছিলেন, সেসময় রাজা লক্ষ্মণসেন নাকি প্রাসাদের পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গঙ্গা পথে পূর্ববঙ্গে পালিয়েছিলেন! ১১৯৯ সি.ই.-তে নদীয়ার এই ঘটনায় রাজা লক্ষ্মণসেনের বীরত্বের কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি।
     
    যদিও সম্পূর্ণ ঘটনাটি চিন্তা করলে পুরোটাই অবিশ্বাস্য মনে হয়। কারণ বখতিয়ার খিলজি বিহার জয় করেছিলেন ১১৯৭ সি.ই.-তে, শোনা যায়, তিনি সেখানে “মুণ্ডিত মস্তক ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধদের গণহত্যা করিয়েছিলেন”। তারপর তিনি নদীয়ার – লক্ষ্মণ সেনের তৎকালীন রাজধানী - দিকে এগিয়েছিলেন। বঙ্গ-বিহারের সীমান্ত থেকে রাজধানী নদীয়া পর্যন্ত বখতিয়ার খিলজি (শোনা যায় তাঁর সঙ্গে মাত্র আঠারোজন অশ্বারোহী সৈন্য ছিল) কোথাও কোন বাধা পেলেন না, সরাসরি রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করতে সক্ষম হলেন! এই বিষয়েই মনে ঘোরতর সন্দেহ আসে। সেনরাজাদের প্রশাসনিক এবং সামরিক ও নিরাপত্তা আধিকারিকদের চরম দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্র ছাড়া এমন ঘটনা কী করে সম্ভব?
     
    সে যাই হোক, লক্ষ্মণসেন এর পরেও ১২০৬ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর পরেও সেনবংশ পূর্ববঙ্গে আরও প্রায় পঞ্চাশ বছর রাজত্ব করার পর, সমগ্র বঙ্গ মুসলিম অধীনে চলে গিয়েছিল। সম্প্রতি কিছু সূত্র থেকে জানা যায় লক্ষ্মণসেনের এক পুত্র রূপসেন ভাগ্যান্বেষণে উত্তর-পশ্চিম ভারতে চলে গিয়েছিলেন এবং পাঞ্জাবে ছোট্ট একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার রাজধানী ছিল রূপনগর (রোপার)। পরবর্তীকালে, তাঁর বংশধরেরা আরও উত্তরে মাণ্ডি (হিমাচল প্রদেশ) অঞ্চলে দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছিলেন[1]
     
    পিতা বল্লাল সেনের মতো লক্ষ্মণসেনও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তাঁর সভাকবি ছিলেন বিখ্যাত কবি জয়দেব এবং ধোয়ি। জয়দেবের কাব্য “গীতগোবিন্দ”-এর কথা আগেই বলেছি। ধোয়ির কাব্য “পবন-দূত”, মহাকবি কালিদাসের লেখা “মেঘদূত”-এর অক্ষম অনুসরণ। লক্ষ্মণসেন তাঁর পিতার অসমাপ্ত কাব্যগ্রন্থ “অদ্ভূতসাগর” সম্পূর্ণ করেছিলেন।

    ৪.৬.৪ আসাম
    আসামের পৌরাণিক নাম পাওয়া যায় কামরূপ এবং কোন একসময় নরক ছিলেন কামরূপের রাজা। ব্রাহ্মণ্যধর্ম মতে রাজা নরক ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ অসুর, যাঁকে সাধারণ ক্ষত্রিয় সৈন্যবাহিনী দিয়ে পরাজিত করা যায়নি, ভগবান বিষ্ণুকে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। সে যাই হোক সেই রাজা নরকের পুত্র ছিলেন ভগদত্ত, যিনি মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে নাকি কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন।
     
    তবে কামরূপের প্রথম ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যায় সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ শিলালিপি থেকে, যেখানে তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী রাজ্য হিসেবে কামরূপের উল্লেখ করেছিলেন। গুপ্ত সাম্রাজ্য পতনের পর, পরবর্তী গুপ্তরাজা মহাসেনগুপ্তের অন্য একটি লিপি থেকে জানা যায় তাঁর রাজত্বের সীমা লোহিত্য নদীর (ব্রহ্মপুত্র) তটভূমি পর্যন্ত এবং তিনি কামরূপ রাজা সুস্থিতবর্মনকে পরাস্ত করেছিলেন। এই কামরূপের রাজা সুস্থিতবর্মনের পুত্র ভাস্করবর্মনের কথা ইতিহাসে বারবার উঠে এসেছে। ৬৪৩ সি.ই.-তে হুয়ান সাং যখন কামরূপ গিয়েছিলেন তখন কামরূপের রাজা ছিলেন ভাস্করবর্মন। ভাস্করবর্মন প্রতিবেশী কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্কের আতঙ্কে, শুরু থেকেই রাজা হর্ষের সঙ্গে “অনন্ত মৈত্রী”-তে আবদ্ধ ছিলেন। রাজা হর্ষের আয়োজিত দুটি মহামৈত্রী সম্মেলনে, একটি কনৌজ এবং অন্যটি প্রয়াগে, তিনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। হর্ষের মৃত্যুর পরে তাঁর সিংহাসনে বসা অযোগ্য রাজাকে সরানোর ব্যাপারেও তিনি চীনের রাষ্ট্রদূতকে পূর্ণ সহায়তা করেছিলেন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর ভাস্করবর্মন কর্ণসুবর্ণ জয় করেছিলেন।

    ভাস্করবর্মণের পর কামরূপের ইতিহাস খুবই অস্পষ্ট। অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি শ্রীহর্ষ নামে এক রাজার নাম পাওয়া যায়, যিনি গৌড়, ওড্র (উড়িষ্যা), কলিঙ্গ, কোশল এবং আরও অনেক অঞ্চল জয় করেছিলেন। আবার একাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রত্নপাল নামে এক রাজার নাম পাওয়া যায়, যিনি গুর্জরদের রাজধানী, গৌড়রাজ, দাক্ষিণাত্যের রাজা (হয়তো চালুক্যরাজ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য, যিনি কামরূপ অভিযান করেছিলেন), কেরালেশ ( হয়তো চোল বংশের প্রথম রাজেন্দ্র), বাহিকা এবং তৈকদের পরাজিত করেছিলেন।
     
    যদিও এর মধ্যে বাংলার পালবংশের রাজা দেবপাল (৮১৫-৫৫ সি.ই.), তাঁর ভাইপো জয়পালকে প্রাগজ্যোতিষ অভিযানে পাঠিয়েছিলেন এবং পাল রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। দ্বাদশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক পর্যন্ত প্রাগজ্যোতিষ রাজা কুমারপালের অধীনেই ছিল এবং তাঁর প্রতিনিধি মন্ত্রী বৈদ্যদেবের যথেষ্ট কর্তৃত্ব ও প্রভাব সেখানে ছিল।

    কিন্তু ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে আসাম অধিকার করে নিয়েছিলেন, অহোম নামের শান উপজাতিদের একটি শাখা। যাঁদের থেকে গোটা রাজ্যের নাম অহোম বা আসাম বলা হয়ে থাকে। আসামে মুসলিম অভিযান সাফল্য পেয়েছিল অনেকটাই পরে, মুঘল সম্রাট ঔরংজেব তাঁর বিখ্যাত সেনাপতি মিরজুমলাকে (১৬৬২ সি.ই.) পাঠিয়ে প্রথম আসাম অধিকার করেছিলেন।

    ৪.৬.৫ উড়িষ্যা
    প্রাচীন কলিঙ্গ সীমানার ধারণা হল গোদাবরী থেকে মহানদী পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চল। যদিও এই সীমানা কখনোই ধরাবাঁধা ছিল না। কোন কোন সময় কলিঙ্গ রাজ্য, উৎকল, ওড্র এবং কলিঙ্গ নামেও একই বা তিনটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। আবার অনেক সময়েই দক্ষিণবঙ্গের তাম্রলিপ্তি বন্দর সহ মেদিনীপুর কলিঙ্গের অন্তর্গত ছিল, আবার কোন কোন সময় উড়িষ্যার গঞ্জাম পর্যন্ত বঙ্গের সীমানার মধ্যে ছিল।

    ঐতিহাসিক সময় থেকে কলিঙ্গ নন্দ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, তারপর সম্রাট অশোক কলিঙ্গকে মৌর্যসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। মৌর্যদের পর কলিঙ্গের রাজা হয়েছিলেন শক্তিশালী খারবেল, তিনি একসময়ে মগধ এবং  অন্ধ্রের বেশ কিছুটা অংশ কলিঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এরপর কলিঙ্গের স্পষ্ট ইতিহাস পাওয়া যায় না। গুপ্তরাজাদের সময় কলিঙ্গ গুপ্ত সাম্রাজ্যের মধ্যেই ছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষ দিকে কলিঙ্গের রাজা ছিলেন প্রাচ্য গঙ্গবংশীয় রাজারা।
     
    ৪.৬.৫.১ প্রাচ্য গঙ্গ
    গঙ্গবংশের উৎপত্তি মহীশূরের কোলার অঞ্চলে, তাঁদের একটি শাখা পূর্বদিকে কলিঙ্গে রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। এই কারণে তাঁদের প্রাচ্য গঙ্গ বলা হয়। রাজা ইন্দ্রবর্মন ছিলেন প্রাচ্য গঙ্গ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর রাজধানী ছিল গঞ্জাম জেলার কলিঙ্গপতনম বা মুখলিঙ্গম। এই প্রাচ্য গঙ্গ বংশ প্রায় চারশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। খ্রীষ্টিয় দশম শতাব্দীতে চালুক্য ও চোলরাজাদের আক্রমণে কলিঙ্গ রাজ্য বারবার বিধ্বস্ত হয় এবং প্রাচ্যগঙ্গ বংশের রাজারা দুর্বল হয়ে পড়েন।

    ১০৭৭ সি.ই.তে গঙ্গবংশের রাজা অনন্তবর্মণ চোড়গঙ্গর রাজত্বকালে, কলিঙ্গ আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাঁর নাম চোড়গঙ্গ হয়েছিল, কারণ তাঁর পিতা রাজারাজগঙ্গ বিবাহ করেছিলেন, রাজেন্দ্র চোড়ের কন্যা রাজসুন্দরীকে। চোড়গঙ্গ দীর্ঘ সত্তর বছর রাজত্ব করেছিলেন (১০৭৭-১১৪৭ সি.ই.)। এই অনন্তবর্মনই পুরীর জগন্নাথ মন্দির এবং আরও অনেক মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর গঙ্গবংশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বাংলার সেনরাজা কলিঙ্গ রাজ্যের কিছুটা অধিকার করে নিয়েছিলেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই মুসলিমরা বঙ্গের সেনবংশকে উৎখাত করতে পারলেও, গঙ্গরাজারা মুসলিমদের আরও প্রায় একশ বছরের ওপর ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। মোটামুটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মুসলিমরা কলিঙ্গ জয় করেছিলেন।
     
    এর মধ্যে কেশরী রাজবংশও দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছিলেন, সম্ভবতঃ উৎকল রাজ্যে, তাঁদের রাজধানী ছিল ভুবনেশ্বর। মন্দির শহর ভুবনেশ্বরের বিখ্যাত মন্দিরগুলির অধিকাংশই কেশরী রাজাদের প্রতিষ্ঠিত। খ্রীষ্টিয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সমগ্র উড়িষ্যা জুড়ে অজস্র মন্দির নির্মিত হয়েছিল, যার আদর্শ ছিল ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ, পুরীর জগন্নাথধাম এবং কোনার্কের সূর্য মন্দির।

    ৪.৬.৬ ত্রিপুরির কলচুরি
    শোনা যায় কলচুরি রাজবংশের পূর্বপুরুষ ছিলেন, পৌরাণিক রাজা কার্তবীর্যাজুন, হৈহয় বংশের শাখা, যাঁরা নর্মদা উপত্যকায় রাজত্ব করতেন এবং তাঁদের রাজধানী ছিল মাহিষ্মতী বা মান্ধাতা। কলচুরি বংশের উত্থান যে রাজার হাত ধরে, তাঁর নাম প্রথম কোকল্ল, তিনিই ত্রিপুরী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর অঞ্চলে। তাঁর রাজত্বকাল নবম শতাব্দীর শেষ দশক থেকে দশম শতাব্দীর শুরুর দুই দশক। তাঁর এই রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে বৈবাহিক সম্পর্কও থাকতে পারে। তিনি চান্দেল রাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণের (৮৭৫ - ৯১১ সি.ই.) কন্যা রাজকুমারী নট্টদেবীকে বিবাহ করেছিলেন। এছাড়াও জানা যায় তাঁর জামাই ছিলেন রাষ্ট্রকূটবংশীয় রাজকুমার। অতএব এই তিনটি রাজবংশীয় মিলিত শক্তি নিয়ে, তিনি চালুক্য, ভোজ এবং প্রতিহার রাজবংশের রাজাদের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে গেছেন। একসময় তাঁর সম্বন্ধে, “জগজ্জয়ী” উপাধিও ব্যবহার করা হত।

    প্রথম কোকল্লের পর কলচুরি বংশের আরেক রাজার নাম পাওয়া যায়, তাঁর নাম গাঙ্গেয়দেব (১০১৯-১০৪১ সি.ই.)। ইনি “বিক্রমাদিত্য” উপাধি নিয়েছিলেন, এবং তাঁকেও “জগজ্জয়ী” বলা হত। রাজা গাঙ্গেয়দেব, প্রতিহার বংশের রাজাদের পতনের পর উত্তর ভারত অভিযান করেছিলেন এবং কীর দেশ (কাংড়া উপত্যকা), প্রয়াগ এবং বারাণসী জয় করেছিলেন। যদিও পরবর্তী কালে পরমার বংশের ভোজরাজার হাতে তিনি পরাস্ত হয়েছিলেন। গাঙ্গেয়দেবের পুত্র লক্ষ্মী-কর্ণ (১০৪১-৭২ সি.ই.), কলচুরি বংশের সব থেকে প্রতিপত্তিশালী রাজা ছিলেন। রাজা কর্ণ কয়েক বছরের জন্যে কাংড়া থেকে বারাণসী এবং কনৌজ নিজের অধিকারে রাখতে পেরেছিলেন। বারাণসীতে তিনি একটি শৈব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যাকে “কর্ণ-মেরু” বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

    এরপর কলচুরি বংশের রাজা হন রাজা লক্ষ্মীকর্ণর পুত্র যশকর্ণ (১০৭৩-১১২০ সি.ই.)। শোনা যায় যশকর্ণের মাতা ছিলেন হুণ জাতীয়া। যশকর্ণকেও প্রায় সারাজীবনই যুদ্ধবিগ্রহে লেগে থাকতে হয়েছিল। তাঁর সময়ে উত্তরের এলাহাবাদ, বারাণসী এবং কনৌজ জয় করে নিয়েছিলেন গাড়োয়ালরা, এমনকি তাঁরা ত্রিপুরী রাজধানীও আক্রমণ করেছিলেন। চান্দেল, চালুক্যদের সঙ্গে তাঁর নিত্য যুদ্ধ তো ছিলই। যশকর্ণের পুত্র গয়া-কর্ণের পর কলচুরি রাজবংশ ইতিহাসে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল।

    ৪.৬.৭ জিজাকভুক্তির (বুন্দেলখণ্ড) চান্দেল
    চান্দেল বংশের উৎপত্তি পূর্ণচন্দ্র এবং ব্রাহ্মণ কন্যার বিবাহ থেকে! অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, তাঁরা প্রাচীন ভারতের ভর বা গোণ্ড জাতির শাখা, যাঁদের আদি নিবাস ছিল ছতরপুর রাজ্যের মানিয়াগড়ে, কেন নদীর ধারে। নবম শতাব্দীর শুরুর দিকে চান্দেল বংশের প্রতিষ্ঠা করেন, নান্নুক। তাঁর নাতির নাম জিজা বা জয়শক্তি– তাঁর নাম অনুসারেই তাঁদের রাজ্যের নাম হয় জিজাকভুক্তি। অনুমান করা হয়, চান্দেল বংশের প্রথম দিকের বেশ কিছু রাজা ছিলেন, কনৌজের প্রতিহার সাম্রাজ্যের সামন্ত রাজা। তাঁদের মধ্যে হর্ষদেব চান্দেল তাঁর প্রভাব এবং ক্ষমতা বাড়িয়ে তুললেন, প্রতিহার রাজ মহীপালের সৎভাই দ্বিতীয় ভোজকে সরিয়ে, তাঁকে কনৌজের সিংহাসনে বসতে সাহায্য করে। এরপর কনৌজের রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, চান্দেলরা আরও বেশি স্বাধীন ও শক্তিশালী হয়ে উঠলেন। এইসময় রাজা হলেন, হর্ষদেবের পুত্র ধঙ্গ (৯৫০-১০০২ সি.ই.)। শোনা যায় তাঁর সময়ে কনৌজ কিছুদিনের জন্য চান্দেল রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। খাজুরাহোর একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় “রাজা ধঙ্গ খেলার ছলে অধিকার করেছেন, কালঞ্জর (কালিঞ্জর দুর্গ –বুন্দেলখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ), সুদূর মালব নদীতটের ভাস্বত (?), যমুনার তীর, চেদি রাজ্যের সীমানা, এমনকি গোপগিরি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল”। ধঙ্গ কোন এক সময় বারাণসী জয় করেছিলেন, তার প্রমাণও পাওয়া যায়। ৯৮৯ অথবা ৯৯০ সি.ই.তে সবুক্তিগিনকে প্রতিরোধ করার জন্যে শাহী রাজা জয়পাল যখন রাজা ধঙ্গের কাছে সামরিক সাহায্য চেয়েছিলেন, রাজা ধঙ্গ তাঁর সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিলেন এবং আর্থিক সাহায্যও করেছিলেন।
     
    একইভাবে রাজা ধঙ্গের পুত্র গণ্ডের কাছে আনন্দপাল শাহী ১০০৮ সি.ই.-তে গজনির সুলতান মামুদের আক্রমণ প্রতিরোধের সাহায্য চাইলে রাজা গণ্ডও সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই হিন্দু যৌথশক্তির পরাজয় হয়েছিল। এরপর সুলতান মামুদের ভয়ে (কাপুরুষের মতো?) পালিয়ে যাওয়া কনৌজের প্রতিহাররাজা রাজ্যপালকে শাস্তি দিতে, রাজা গণ্ড ও শাহী যুবরাজ বিদ্যাধর, ১০১৮ খ্রীষ্টাব্দে রাজ্যপালকে হত্যা করেন। এই সংবাদ যখন গজনিতে সুলতানের কানে পৌঁছল, রাজা গণ্ডকে শাস্তি দিতে সুলতান মামুদ ১০১৯ সালে চান্দেল রাজ্য আক্রমণ করলেন। এবার রাজা গণ্ড সুলতানের সামরিক শক্তি দেখে কোন ঝুঁকি নিলেন না, রাতের অন্ধকারে (বীরের মতো?) পালিয়ে জীবন রক্ষা করলেন। এরপর সুলতান মামুদ ১০২২ খ্রীষ্টাব্দে আবার চান্দেল রাজ্য আক্রমণ করেন এবং গোয়ালিয়র দুর্গ ও কালিঞ্জর দুর্গ অধিকার করে নিলেন। এই সময় রাজা গণ্ড সুলতান মামুদের (বীরের মতো?) বশ্যতা মেনে নিয়েছিলেন। সুলতান মামুদ রাজা গণ্ডকে দুর্গদুটি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, বদলে প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে গজনি ফিরে গিয়েছিলেন।

    এরপর চান্দেল বংশের উল্লেখযোগ্য রাজারা হলেন, কীর্তিবর্মন, মদনবর্মন, পরমার্দি (১১৬৫-১২০৩ সি.ই.) প্রমুখ। তাঁরাও প্রতিবেশী রাজ্যগুলি কখনো জয় করেছেন, কখনো আবার পরাজিতও হয়েছেন। এই সময়ে ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দে কুতব-উদ্দিন আইবক কালিঞ্জর দুর্গ অবরোধ করেন এবং চান্দেল রাজত্বের অবসান ঘটান। অবশ্য এরপরেও প্রায় ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ছোট রাজ্যের শাসক হয়ে, চান্দেল বংশের অস্তিত্ব ছিল।
     
    চান্দেল রাজাদের অন্যতম কীর্তি খাজুরাহো মন্দির, কালিঞ্জর দুর্গ এবং মাহোবা নগর। সমসাময়িক কালে এমন সুসজ্জিত দুর্গ এবং সুন্দর শহর ভারতে কমই ছিল। চান্দেল রাজারা বেশ কিছু মন্দির এবং সুন্দর সরোবর বানিয়ে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলেছিলেন বুন্দেলখণ্ড এবং মাহোবা শহর। মাহোবার এরকমই একটি সরোবরের নাম মদনসাগর, যেটি নির্মাণ করিয়েছিলেন রাজা মদনবর্মন।

    চলবে...

    (এই পর্বের সপ্তমভাগ আসবে ০৭/০৮/২২ তারিখে।)
     

    গ্রন্থ ঋণঃ
    ১. History of Ancient India – Rama Shankar Thripathi.
    ২. Penguin History of Early India – Dr. Romila Thapar.
    ৩. The Wonder that was India – A. L. Basham.

       

    [1] কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন হিমাচলের কুলু ও মাণ্ডি অঞ্চলে আমাকে বাস করতে হয়েছিল এবং সেই সময়েই বেশ কয়েকজন স্থানীয় “সেন-মহাশয়”-এর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাঁদের কেউই বাংলার সঙ্গে তাঁদের কোনরকম যোগসূত্রের কথা কোনদিনই শোনেননি, বরং আমার কৌতূহলে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বেশ বিরক্তই হয়েছিলেন। কিন্তু আমার কৌতূহল তাতে নিবৃত্ত হয়নি, মাণ্ডি অঞ্চলের অনেক তথ্য ঘেঁটে রূপসেনের ঘটনাটি জানতে পারি। এই ঘটনার সঙ্গে হয়তো অনেক মিথ জড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু রোপার ও মাণ্ডির সঙ্গে বাংলার সেনবংশের কোন একটা ঐতিহাসিক যোগসূত্র যে ছিল, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তার সমর্থনে একটি লিংক এখানে শেয়ার করলাম - https://hpmandi.nic.in/history/   

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০২ আগস্ট ২০২২ | ১৫১৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অরূপ | 45.25.***.*** | ০২ আগস্ট ২০২২ ১০:০৬510679
  • এত সুন্দর উপস্থাপনা...এমন পাঠ্যবই পেলে ইতিহাসই পড়তাম।
    মান্ডিতে সেনরা, খুব ইন্টারেস্টিং! 
  • হীরেন সিংহরায় | ০২ আগস্ট ২০২২ ১২:৩৭510687
  • এতদিনে ইতিহাস পড়ার , জানার সুযোগ হলো । ছাপা হলে এটি আমার পাঠ্য বই হবে । 
     
    কিশোর- বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান অতুল প্রসাদের লাইন কিন্তু 
  • হীরেন সিংহরায় | ০২ আগস্ট ২০২২ ১২:৫১510688
  • কিশোর 
     
    বই যখন হবে পরিশিষ্টে নিশ্চয় টাইম লাইন দেবেন । স্কুলের ইতিহাস বইতে কখনো পাই নি। 
    জানতে ইচ্ছে করে সে সময়কার অর্থনীতি কি রকম ছিল। ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ ? শারলামেন , পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য ? 
  • Kishore Ghosal | ০২ আগস্ট ২০২২ ১৩:২৯510693
  • হীরেন স্যার, ছি ছি, এমন ভুলের কোন ক্ষমা হয় না, নিঃশব্দে বদলে ফেললাম। 
     
    পরিশিষ্টে টাইমলাইন দেওয়ার ইচ্ছে আছে। ফাইন্যাল করার আগে আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনাও করতে হবে। 
     
  • Sara Man | ০২ আগস্ট ২০২২ ১৩:৩১510694
  • চালিয়ে যান, পড়ে যাচ্ছি। 
    "তা নাহলে কী করে বুঝবেন, আমাদের আধুনিক ভারতবর্ষের চেহারাটা কেন এমন হল? উত্তরভারতের সঙ্গে কেন বনে না দক্ষিণভারতের? বঙ্গ–বিহার-উড়িষ্যার মতো প্রতিবেশী রাজ্যবাসীদের মনে কেন সুপ্ত হয়ে রয়েছে বিদ্বেষ? একটু ফুলকির স্পর্শেই কেন ঘটে যায় দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাসমূহ? আমরা যতই আশ্চর্য ও অত্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তিময় যুগে জীবনযাপন করি না কেন, আমাদের মানসিকতার সিংহভাগ পড়ে আছে সেই ত্রয়োদশ শতাব্দীর আশেপাশেই!"  - এমন লোভ দেখিয়ে দিলেন,  এর উত্তরটা জানতেই হবে।
  • Kishore Ghosal | ০২ আগস্ট ২০২২ ১৯:২৫510698
  • @ অরূপ, পাঠ্যবই এমন হলে, সমাজের উচ্চস্তরের মানুষদের বিস্তর অসুবিধে হত যে, আমাদের বোকা বানাতে। 
     
    @ শারদা ম্যাম, এতদিন সঙ্গে রয়েছেন, লেখার শেষ না দেখে কোথায় যাবেন? smiley
  • হীরেন সিংহরায় | ০৩ আগস্ট ২০২২ ১৪:৪০510712
  • কিশোর 
     
    সানন্দে সহযোগিতা করব। আপনি আমাদের দেশের ইতিহাসের ইতিহাস রচনা করছেন। আমরা পড়ে ধন্য। চাওয়ার শেষ নেই!
    টাইম লাইনে যদি পাশাপাশি সমসাময়িক পারস্য রোম গ্রিস ইউরোপের কথা যোগ করা যায়। 
  • Kishore Ghosal | ০৩ আগস্ট ২০২২ ১৬:৩০510715
  • একদম, স্যার, বিদেশের টাইমলাইনের জন্যেই আপনার সাহায্য একান্ত দরকার হবে। ওটাতে আমার মোটেই দখল নেই।  
  • তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় । | 2401:4900:3149:8eb:0:50:d13a:***:*** | ০৬ আগস্ট ২০২২ ০৯:৪১510807
  • খুবই তথ্যপূর্ণ  লেখা । এত বিস্তৃত ইতিহাস আগে পড়িনি।  আরো লিখুন।  
    অনেক ধন্যবাদ। 
  • Kishore Ghosal | ০৬ আগস্ট ২০২২ ২০:২১510817
  • অনেক ধন্যবাদ তাপসবাবু। সঙ্গে থাকুন, প্লিজ। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন