এ এক অদ্ভুত সময়। এ এক হননকাল। পৃথিবীতে কালান্তক করোনার আক্রমণের বাইরেও ঘটে চলেছে একটানা প্রাণঘাতী হননযজ্ঞ। না, ভাইরাস না। ভাইরাস মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। কিন্তু এখানে যার কথা বলা হচ্ছে, তা রীতিমতো আনুষ্ঠানিকভাবে মানুষেরই নিয়ন্ত্রণে। রাজনৈতিক নেতৃত্বে, সম্পূর্ণ পরিকল্পনামাফিক ভাবে নিত্যদিন ধ্বংস করা হচ্ছে, জল, জঙ্গল আবাসভূমি। এ এক অদ্ভুত সময়, যখন সাড়ম্বরে ধ্বংসসাধনের নাম দেওয়া হয়েছে উন্নয়ন, বন্যাকে চিরস্থায়ী করার নাম হয়েছে বন্যানিয়ন্ত্রণ, উচ্ছেদকে বলা হচ্ছে নগরায়ন, আর কর্পোরেট শকুনের নাম বেদান্ত। ঢাকঢোল পিটিয়ে এইসব নিত্যনতুন নামের আবাহন চলছে। চলছে ডিজে সহযোগে লাগাতার ভাসানগীতির উদযাপন। আর এই মহাধামাকার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে, প্রান্তজনের মিহি আর্তনাদ। উন্নতির উৎসব চলছে দিগ্বিদিকে।
প্রতিভা সরকার, ধবংসের এই রাজসূয় যজ্ঞের কথা লেখেন। কর্পোরেট বুটের নিচে চাপা পড়া আর্তনাদের কথা লেখেন। তিনি নিয়মগিরির লুঠেরাদের কথা লেখেন। কীভাবে নিয়মমাফিক সরকারি অনুমতি পাবার আগেই বানিয়ারা শোধনাগার খুলে ফেলে ডোঙরিয়াদের গ্রামে। বসায় দৈত্যাকার কনভেয়ার বেল্ট, চিরতরে ধ্বংস করে দেয় একাধিক গ্রাম। পরিকল্পনা চলে দিনে ১৬ ঘন্টা, সপ্তাহে ৬ দিন, ২৩ বছর ধরে, গাছপালা উৎপাটিত করে, মানুষ-পশু মেরে, বক্সাইট তোলার নামে চলবে ধরিত্রীর লাগাতার ধর্ষণ।
তিনি কোচির কথা লেখেন। কেরালার কথা লেখেন। কোচির ব্যস্ত বিমানবন্দরটি তৈরি হয়েছিল, জলা আর ধানক্ষেত বুজিয়ে। কিন্তু সেই উন্নয়ন ডেকে এনেছিল বন্যা। এক বছরের বন্যায় এই উড়ানের যে দাম চোকাতে হয়েছে, তা অর্থমূল্যে ৫০০ কোটি টাকা। বন্যা অবশ্য শুধু বিমানবন্দর দিয়ে শুরু হয়েছে তা নয়। কেরালায় নদী আছে ৪৪ টি। তাদের উপর আছে ৬১ টি বাঁধ। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, বাঁধ বন্যা আটকায়। কিন্তু একদম জমির খবর নিয়ে লেখিকা লিখছেন, ব্যবহারিক জীবনে ঠিক উল্টো জিনিস ঘটে। বাঁধ টপকে জল আসেই বন্যায়। তারপর জল আর ফিরে যেতে চায়না। বন্যা হয় দীর্ঘস্থায়ী। বাঁধগুলি হয়ে ওঠে দুধারী তলোয়ার।
প্রতিভা কলকাতার কথাও লেখেন। ২০১৭ সালে নিউটাউনে পরিকল্পনা করা হয় এক পাঁচ কিলোমিটার লম্বা ফ্লাইওভারের। যা নিউটাউনের আধুনিক প্রসারকে পায়ের নিচে রেখে সিধে পাড়ি দেবে বিমানবন্দর। পথে বোজানো হবে এক গুচ্ছ জলাভূমি। তার কাজও শুরু হয়ে যায় দ্রুতগতিতে। দশটি জলাভূমিকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বুজিয়ে ফেলা হয়। কলকাতা শহর, আমরা জানি, একটি বাটির মতো। তার জমা জল পাড়ি দেবার একমাত্র জায়গা পূর্বদিকের জলাভূমি। ইতিমধ্যেই অনেকটা বুজিয়ে ফেলার ফলে কলকাতা শহর ক্রমশ জলমগ্ন হয়েই চলেছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়ে গেলে, আরও ডুবত, আন্দাজ করাই যায়। কিন্তু উন্নয়নই যেখানে একমাত্র গন্তব্য, সেখানে বর্তমান বাসভূমিকে অবাসযোগ্য করে ফেলা, এমন আর কি।
শুধু এই তিনটি নয়। মানুষ, পরিবেশ, সরকার, কর্পোরেটকে ঘিরে, যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, এবং চলেই যাচ্ছে, প্রতিভার এই বই তারই বিবরণ। কিছুটা তথ্য, কিছুটা অভিজ্ঞতা মিলিয়ে-মিশিয়ে তৈরি হয়েছে, উন্নয়নের নিচে যে অন্ধকার, যে ডালে বসে আছি, সেই ডালই কেটে ফেলার বাহারি আহাম্মকির বিজ্ঞাপনের যে আড়ম্বর, নিজের আবাসস্থল নষ্ট করে ফেলার বাহাদুরির যে আস্ফালন, তারই আখ্যান। লেখাগুলি বেশিরভাগই প্রকাশিত হয়েছিল গুরুচণ্ডা৯তে। এবার বেরোচ্ছে বই হয়ে। যাঁরা পড়তে চান বইমেলায় পাবেন। আর, সকলেই জানেন, গুরুর বই এক গোষ্ঠীগত প্রচেষ্টা। যাঁরা বই প্রকাশের আংশিক বা সম্পূর্ণ দায়ভার গ্রহণ করে দত্তক নিতে ইচ্ছুক, তাঁরা এই লেখার নিচে জানান। বা মেল করুন guruchandali@gmail.com এ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।