কেল্লাবাসীর খাওয়া দাওয়ার কথা বললে প্রথমেই কেল্লায় বসবাসকারী নিজামত পরিবারের খাওয়া দাওয়ার কথা বলতে হয়।তবে নিজামত পরিবারের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে এখন অবশ্য আগের মত সেই সব শাহী খাবারের তেমন চল নেই। বর্তমানে বাঙালিদের রোজকার খাদ্যাভ্যাসের সাথে নিজামত পরিবারের খাদ্যাভ্যাসের তেমন কোনো পার্থক্য নেই বললেই চলে। নিজামত পরিবারেও বাঙালিদের মতোই ভাত ও রুটিই প্রধান খাদ্য, তার সাথে বিভিন্ন রকমের সবজী, ডাল, মাছ, মাংস থাকে। তবে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে আজও মুর্শিদাবাদের নিজামত পরিবারগুলিতে নানান শাহী খাবার রান্না করা হয়। এইসব শাহী খাবার গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, কয়েক রকমের পোলাও (শাহী পোলাও, মাহি পোলাও, ঝিঙ্গা পোলাও, আনানাস পোলাও, আম্বা পোলাও, কোপ্তা পোলাও, খুসকা পোলাও) বিরিয়ানি (যদিও নবাবী আমলে মুর্শিদাবাদে বিরিয়ানির প্রচলন ছিল না, নবাবরা পোলাও খেতে পছন্দ করতেন, তবে নিজামত পরিবারে বিরিয়ানি জনপ্রিয়তা লাভ করে বিংশ শতকের একেবারে শেষের দিকে) জর্দা, মাংসের কাবাব, কোর্মা, কোপ্তা, কিমা, রেজালা, ভুনা, মুর্গ মসল্লাম, মুর্গ কা দম্পক্ত, এছাড়াও মাছ দিয়ে তৈরি মাহি কাবাব, মাছলি কা দমপক্ত, মাছের পোলাও, মাহি চাসনি, মাহি রেজালা ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের রুটি (রুমালি রুটি, মিঠা রুটি, রোগনি রুটি, তুনকি রুটি, হোলে কা রুটি) পরোটা, ক্ষীর, শাহী টুকরা, নানান রকমের হালওয়া, লৌজ সহ আরো নানান খাবার।
তবে আজ স্বাস্থ্য সচেতনতার যুগে নিজামত পরিবারের মানুষরা এইসব অতিরিক্ত ঘি ও মশলা যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলেন। তবে শুধুমাত্র এইসব শাহী খাবার এড়িয়ে চলার এটাই একমাত্র কারণ নয়, এই সব নবাবী শাহী খাবার রান্না করতে প্রচুর খরচ হয়, কিন্তু বর্তমানে নিজামত পরিবারের সদস্যদের পূর্বের সেই অবস্থা নেই, এখন তারা সরকারি ভাতাও পান না, ফলে তাদের পক্ষে রোজ রোজ এইসব শাহী খাবার খাওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠেনা।
নবাব, নবাবী আমল, নবাবী কেল্লা ও কেল্লাবাসিদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যের খোঁজে নিজামত পরিবারে আমার যাতায়াত লেগেই থাকে সব সময়। ফলে আমার বেশ কয়েকবার কয়েকটি নিজামত পরিবারে খাওয়ারও সৌভাগ্য হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ নবাব নবাব নাজিম মনসুর আলি খান ফেরাদুন জার বংশধর নাফিসুন নিসা নাসির (নাফিসা) এর বিয়ের খাওয়া দাওয়ার কথা আজও ভুলতে পারিনি। আগেই বলেছি এক সময় নিজামত পরিবারে বিরিয়ানির কোনো অস্তিত্ব ছিলনা তবে আজকাল নিজামত পরিবারে বিরিয়ানির খুব রমরমা শুরু হয়েছে। নাফিসার বিয়েতেও মূল খাবার হিসেবে বিরিয়ানি খাওয়ানো হয়েছিল, সেই বিরিয়ানির স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। সেবার খেতে বসে প্রথমেই দেওয়া হয়েছিল ঘিয়ে ভাজা পরোটা ও চিকেন রেজালা, ওহ সে কি অপূর্ব স্বাদ। পরোটাটি আকারে বেশ পুরু কিন্তু অদ্ভুত ভাবে সেটি ভীষণ মুচমুচে ও নরম, এরপর আসে বিরিয়ানি, সহযোগী হিসেবে ছিল বুরহানি। জীবনে বিভিন্ন স্থানের বহু ধরনের বিরিয়ানি খেয়েছি কিন্তু নাফিসার বিয়ের বিরিয়ানির স্বাদ সত্যিই অন্যরকম ছিল। বিরিয়ানিতে মাওয়া দেওয়া হয়েছিল, সাথে কাজু কিশমিশও ছিল। বিরিয়ানি মুখে দিলেই মাওয়ার হালকা স্বাদ পাওয়া যাচ্ছিল।বিরিয়ানির ভাত গুলি খুব ঝরঝরে কিন্তু নরম ছিল, বিরিয়ানির মাংস এমন ভাবে রান্না করা হয়েছিল যে মুখে দিতে মুখে ভেতরেই গলে যাচ্ছিল। এক কথায় মুর্শিদাবাদের শাহী বিরিয়ানিতে নবাবী পোলাওয়েরও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। যাইহোক বিরিয়ানির পর শেষপাতে ছিল জর্দা।আমরা যখন খেতে বসেছিলাম তখন অনেক পদ রান্নাই শেষ হয়নি, যেহেতু বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল তাই সেই সময় যে খাবার প্রস্তুত হয়েছিল আমাদের তা দিয়েই আপ্যায়ন করা হয়েছিল।
তবে শুধুমাত্র নাফিসার বিয়েতেই নয়, নাফিসাদের বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে বহু শাহী খাবার খাওয়ার সুযোগ হয়েছে, কখনও নাফিসার হাতের গাজর কা শাহী হালওয়া শাহী টুকরা, কিম্বা চানে কা হালওয়া, রুমালি রুটি ও কিমা, কাবাব, বিরিয়ানি সহ আরো অনেক কিছুই।
নিজামত পরিবারের বেশ কয়েকজন প্রবীণ সদস্যদের কাছে শুনেছিলাম যে নবাব পরিবারে যে কোনো মিষ্টি জাতীয় খাবারই অত্যধিক মিষ্টি দিয়ে তৈরি করা হয়। যেমন ক্ষীর, জর্দা, নানান হালওয়া, মিঠা টুকরা বা শাহী টুকরা, মিঠা রুটি ইত্যাদি। আমারও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল নিজামত পরিবারের চানে কা হালওয়া, লৌজ, শাহী টুকরা, কিম্বা জর্দা খাওয়ার সময়ে। যাদের অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার খাওয়ায় অভ্যেস নেই তাঁরা নবাব পরিবারের এইসব মিষ্টি জাতীয় খাবার খুব একটা খেতে পারবেন বলে মনে হয়না।
একবার নবাবদের শীত মরশুমের বিশেষ শাহী খাবার ' শাকারখন্দ কি ক্ষীর' খাওয়ার সৌভাগ্যও হয়েছে। 'শাকরখন্দ' অর্থাৎ শাক আলুর ক্ষীর। এমনিতে শাক আলু পুড়িয়ে বা সেদ্ধ করে খেয়েছি বহুবার, কিন্তু খুব একটা ভালো লাগেনি খেতে। তাই প্রথম এই শাক আলুর ক্ষীরের কথা ছোটে নবাবের কাছে যেদিন শুনেছিলাম সেদিন এই ক্ষীর সম্পর্কে তেমন আগ্রহ অনুভব করিনি। কিন্তু পরে ভাবলাম এই ক্ষীর যখন নবাবদের ভালো লাগতো তখন ক্ষীরে কিছু আলাদা ব্যাপার তো নিশ্চয় থাকবে। একথা ভেবেই একদিন এই শাকরখন্দ কি ক্ষীরের স্বাদ আস্বাদন করার তাগিদ অনুভব করি, একদিন সেই সুযোগও আসে, খেয়ে দেখে মনে হয়েছিল এ ক্ষীর নয়, যেন অমৃত।
কেল্লার ভেতরে নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জার নাতনী নাজমুন নিসা বেগমের বাড়িতেও একবার মিঠা টুকরা খাওয়ার সৌভাগ্যে হয়েছিল, সেবার আমি নবাবী খাবার নিয়েই কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম সেখানে, বেগম সাহেবার সাথে মিঠা টুকরা নিয়ে আলোচনা করতেই দেখি তাঁর পুত্র রিজওয়ান সাহেব প্লেটে করে মিঠা টুকরো নিয়ে হাজির। অত্যন্ত মিষ্টি ও সুস্বাদু সেই মিঠা টুকরা সেদিন সত্যিই খুব তৃপ্তি সহকারে খেয়েছিলাম। নবাবী শাহী খাবার খাওয়া প্রসঙ্গে আরও একদিনের কথা মনে পড়ে, সেবার কেল্লার ভেতরেই আমার এক ছাত্র ইউসুফ আলি মির্জার বাড়ি গিয়েছিলাম নবাবী আমলের কিছু তথ্য সংগ্রহের জন্য, সেখানে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা নানান বিষয়ে আলোচনার পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার জন্য উঠবো ভাবছি ঠিক তখনই দেখি ইউসুফের বাবা মেহদী আলম মির্জা সাহেব অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানালেন এখন ওঠা যাবেনা, আমাদের জন্য বিরিয়ানির আয়োজন হয়েছে খেয়ে তবেই বাড়ি ফেরার ছাড়পত্র মিলবে। কিন্তু সেদিন ফেরার খুব তাড়া ছিল, কিন্তু ইউসুফের বাবা মেহদী সাহেব সহ বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারিনি। খাবারে ছিল বিরিয়ানি, বুরহানি, ও শেষ পাতে ছিল দই মিষ্টি।
কেল্লার ভেতরে ইরানি সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষও আজকাল বসবাস করেন। একবার মহরমের সময়ে কেল্লার ভেতরে ইরানিদের বিশেষ শরবৎ খাওয়ার সৌভাগ্যে হয়েছিল। আজও সেই স্বাদ ভুলতে পারিনি। আসলে সেদিন অত্যধিক গরম ছিল, সাথে রোদের তাপ শরীরকে অস্থির করে তুলেছিল, এমতাবস্থায় বরফ মেশানো অমন ঠান্ডা শরবৎ পেলে কার না ভালো লাগে। সেই শরবৎ কি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল তা জানতে পারিনি ঠিকই, তবে তাতে গোলাপ জল ও কিছু শুকনো ফল মেশানো ছিল। শরবৎ মুখে দিতেই মুখের ভেতরে কাজু, পেস্তা, আখরোট, আমন্ড বাদামের টুকরো এসে মুখে পড়ছিল। খেয়ে মনে হয়েছিল যেন সমস্ত শরীর সতেজ হয়ে গেলো।
কেল্লায় বসবাসকরী ইরানিদের প্রধান খাদ্য পাগুষ্টি যাকে বিরিয়ানি বা খিচুড়ি জাতীয় খাবার বলা যেতে পারে। আলু, চাল, মাংস ও কিছু মশলা এই খাবারের প্রধান উপকরণ। ইরানিরা প্রচণ্ড ঝাল খেতে অভ্যস্ত। স্থানীয় মানুষদের কাছে জানা যায় যে ইরানিদের রান্না করা খাবার খেলে পেটের সমস্যায় ঔষধ পর্যন্ত খেতে হতে পারে। সমগ্র মহরম মাসে ইরানিদের বাড়িতে রান্না বন্ধ থাকে এই সময় লঙ্গরখানা খুলে সেখান থেকেই বিভিন্ন দিন বিভিন্ন রকমের খাবার রান্না করে সমস্ত ইরানি পরিবারে দুই বেলা পাঠানো হয়।
এছাড়াও কেল্লার বিভিন্ন প্রান্তে আজকাল বহু সাধারণ মানুষরাও বসবাস করেন। এরা আর পাঁচজন বাঙালির মতোই ডাল ভাত, মাছ,মাংস, রুটি, সবজী খেতেই অভ্যস্ত। আমীর মহলের দোতলার দুটি জরাজীর্ণ ঘরে সুনীল ভট্টাচার্য নামে এক বয়স্ক মানুষ তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন। তাঁরা নিজেরা অবশ্য রান্নার ঝামেলায় না গিয়ে হোটেল থেকে হোম ডেলিভারির মাধ্যমে খাবার আনিয়ে খান। তবে তাঁরা মাঝে মধ্যেই বাড়িতে নানান সুখাদ্য তৈরি করেও খান। সুনীল বাবুর বাড়ি গেলে তিনি কিছুতেই খালি মুখে ফিরতে দেন না। যতবারই গিয়েছি প্রতিবারই হয় মিষ্টি না হয় নিজের হাতের তৈরি পায়েস সাথে মাজা খাওয়ান। ভাবতে অবাক লাগে বাড়ীতে তাঁরা দু’জন থাকেন, অথচ আমরা যদি কখনও ১০ থেকে ১৫ জনও না জানিয়ে হঠাৎ করেই উনার বাড়িতে পৌঁছে যাই তবুও ভদ্রলোকের পায়েস ও মাজায় কোনো দিন ঘাটতি হতে দেখিনি।
কেল্লার ভেতরেও গড়ে উঠেছে বহু খাবারের দোকান সেখানে চা ও ঝালমুড়ি থেকে শুরু করে ভাত, রুটি, পুরি এমন কি বিরিয়ানি পর্যন্ত পাওয়া যায়। কেল্লার ভেতরে ভাগীরথীর ধারে বসে বিকেলের মিষ্টি হাওয়ায় ঝালমুড়ি কিম্বা ডিমের পোচ খাওয়ার স্বাদই আলাদা। কেল্লার ভেতরের ভাতের হোটেল গুলিও সারাদিন পর্যটকদের ভিড়ে গমগম করে। দূর দূরান্ত থেকে আসা মানুষগুলি হাজারদুয়ারি দেখতে এসে স্বাভাবিক ভাবে ঘরোয়া খাবারই খোঁজে, আসলে অতিরিক্ত তেল মশলা জাতীয় খাবার খেলে শরীর খারাপের সম্ভাবনা থাকে তাই এই ধরনের ভাতের হোটেল গুলিতে ভাত, ডাল, সবজী কিম্বা মাছ ভাতের চাহিদাই বেশি থাকে। এছাড়াও হাজারদুয়ারি চত্ত্বরে আইস্ক্রিম, ফুচকা, তিলের খাজা ও লাড্ডু, পেয়ারা সহ আরও রকমারি খাদ্য দ্রব্য পাওয়া যায়। কেল্লার ভেতরে বেরা ও মহরম উপলক্ষে মেলা বসে সেই মেলাতেও নানান খাবারের দোকান বসে।
কেল্লার ভেতরে বহু খাবারের দোকান গড়ে উঠলেও সেখানে নবাবী খাবারের কোনো দোকান নেই।নবাবী কেল্লায় আজ কোনো বাবুর্চিখানাও চালু নেই। অথচ এক সময় কেল্লায় বেশ কয়েকটি বাবুর্চিখানা ও লঙ্গরখান ছিল। এই গত বছর শীতের কথা, কেল্লার ভেতরে দেখি একটি ঘরে স্থানীয় কিছু মানুষ নবাবী বিরিয়ানি পোস্টার দিয়ে সেখানে বিরিয়ানি বিক্রি করছে, অনেক পর্যটককেও দেখেছিলাম সেখানে যেতে। আমার অবশ্য সেই বিরিয়ানি চেখে দেখার সুযোগ হয়নি। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম এই বিরিয়ানির সাথে নবাব পরিবারের মানুষরা যুক্ত নয়, ব্যাস তখন থেকেই এই বিরিয়ানি চেখে দেখার ইচ্ছেটাও শেষ হয়ে যায় চিরতরে।