সন্ধ্যা হওয়ার বেশ আগেই আজ আকাশটা কালো হয়ে নেমে এসেছে জামরুল গাছের মাথায়। আর এলোমেলো বাতাসের টোকা লাগতেই জলভরা কালো মেঘ চুঁইয়ে পড়ছে উঠোনে। ও বাড়ির ছাদঘরের কার্ণিশে দিনকে সন্ধ্যা ভেবে ভুল করে একে একে উড়ে আসছে বড়দাদীর পোষা পায়রাগুলো। এদিকে ভাদুড়ি বাড়ির বাগান থেকে বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে কামিনী ফুলের ঘ্রাণ।
ও ঠাকুমা, আজ দেখো, আবার পুরো পাড়া ডুবে যাবে। কী ঢল নেমেছে দেখেছ?
বারান্দা থেকে কেরোসিনের স্টোভ ঘরে চলে এসেছে। মা তাতে কেরোসিন তেল ঢালছে। তারপাশে মনিপিসি বসা। হাতে হারিকেনের কাচ। পাতলা কাপড় দিয়ে মুছে নিচ্ছে। তা না করে উপায় আছে? ঢল আরেকটু পাড়া ভাসালেই অল্প পাওয়ারের হলুদ ইলেকট্রিক বাতিগুলো নিভে যাবে। সিলিং ফ্যানের একঘেয়ে ঘোরা থেমে যাবে আচমকা।
সন্ধ্যায় সারাবাড়িতে ঠাকুমা ধূপ দেখাতে পারেনি বৃষ্টির জন্য। তাই দেয়ালে ঝুলানো ঠাকুরের ছবির সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে গুনগুন করে গাইছে,
“শুক বলে আমার কৃষ্ণ জগতের প্রাণ।
শারি বলে আমার রাধা জীবন করে দান,
নৈলে বাঁচে কি প্রাণ।
শুক-শারি দুজনার দ্বন্দ্ব ঘুচে গেল।
প্রেমভরে সবে মিলে একবার হরি হরি বল,
শ্রীবৃন্দাবনে চল…”
বাতাসের ঝাপটায় জামগাছের পাতা টুপটাপ পড়ছে বৃষ্টির জলভরা উঠোনে। আমি ঠাকুমার পাশে গিয়ে বসি।
শহরের বাসাতে আমাদের ঠাকুরের আসন বসানো হয়নি এখনো। তাই নিত্যপূজাও হয় না। কিন্তু ঠাকুমা আসার পর থেকেই সকাল-সন্ধ্যায় ধূপ প্রদীপ জ্বালিয়ে একটু গোবিন্দ নাম করে। আমি প্রসাদের জন্য ঘ্যানঘ্যান করব ভেবে গোবিন্দ নাম শেষে একখানা গুড়ের কদমা হাতে দেয় ঠাকুমা।
ও দিদি, প্রসাদ নিতে একহাতের উপর আরেক হাত রাখতে হয়। ভুলে গেছ এ’ ক’দিনে দিদি?
আমি ঠাকুমার কথায় একটু লজ্জা পাই। বাঁহাতটা ডান হাতের তলায় ঠেকিয়ে কদমাখানা নিই,
ও ঠাকুমা, প্রতিদিন প্রসাদ না পেলে মনে থাকবে কী করে বল?
আমার ভুলে যাওয়ার অজুহাতে ঠাকুমা দীর্ঘশ্বাস চাপে,
ও দিদি, বাড়ির প্রসাদ তো আমি মুখে তুলতে পারি না, অন্যদের বিলিয়ে দিই।
আমি কিছু না বুঝেই ঠাকুমার কাছ ঘেঁষে বসি। বৃষ্টির তোড় বাড়ে। আর বাতাসের ঝাপটা বাড়তেই দুপ করে নিভে গেল হলুদ বাতিগুলো।
মা হারিকেন-এর ফিতায় আগুন দিল। সাথে সাথে কেরোসিনের স্টোভেও। আজ আর হলুদ বাতিগুলো জ্বলবে না। তাই স্টোভে খানিক ভাত আর বেগুন ভেজে নেওয়া হবে। দুপুরের ডাল আর নিরামিষ তরকারি আছে।
তবে স্টোভে সবার আগে মনিপিসি চায়ের কেটলি বসাল। তাতে জল আর চিনি।
ঠাকুমা এখানে আসার পর থেকেই চায়ের ঘ্রাণে বাড়ির ঘ্রাণ খুঁজে পাই। গুঁড়ো চায়ের সেই ঘ্রাণ আমাকে বারবার বড়ঘরের লাল মেঝের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রতিদিন ঠিক এইরকম সুঘ্রাণ ছড়িয়েই তো বড়ঘরের মেঝেতে বাড়ির সবার আড্ডা বসত। হাতের চা জুড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে যেত সে আড্ডাতে। আর কাঠের টেবিলে কুনকুন করে বেজে চলত দাদুর রেডিও।
বাসার মেঝে বড়ঘরের মত নয়। কালো চলটা ওঠা মেঝেতে চায়ের কাপ আর বাটিতে তেল মাখানো মুড়ি পড়ল।
ফটকে শব্দ হল। বৃষ্টিতে বড় একটা কচুর পাতা মাথায় দিয়ে মুসা’র মা এসে দাঁড়িয়েছে,
বিকেলে আসতি পারি নাই, আমগোরে পাড়ার পানি জমতি শুরু করছে অহন, তাই দেখতি আইলাম এ বাড়িত কতখানি পানি জমিছে।
ঠাকুমা মুসা’র মাকে নিজের গ্লাস থেকে খানিক চা আর একমুঠো মুড়ি দিল। আর মা বাটিতে করে খানিক ডাল আর সবড়ি দিল। প্রতিদিন বিকেলে সব কাজ সেরে রাতের খাবার নিয়েই মুসা’র মা ফিরে যায়। আজ এই ঢলের দিনে তার ব্যত্যয় হবে কেন?
মুসা’র মা বড়দাদীর বাড়ি চলে যেতেই চায়ের আসর ভাঙল। কেরোসিনের স্টোভে উঠল ভাত।
বাইরে একটানা হয়ে চলা বৃষ্টিজলে একটু রাশ পড়ল। ঠাকুমা বেগুনগুলো ভেজে উঠতেই হাওয়ার দমক বাড়ল। সাথে বৃষ্টিও। মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজান বাতাসে ভর করে আজ আরোও দূরে ছড়িয়ে পড়ছে।
রাতের খাবার শেষে ঠাকুমার গা ঘেঁষে শোবার পর যখন হারিকেনের আলো নিভে গেল, তখন উঠোনের বৃষ্টিভেজা অন্ধকার টুক করে ঘরের ভেতর চলে এল। ঠাকুমা আমার গায়ে কাঁথায় কেটে দিল।
ও ঠাকুমা, আইনুল চাচা এবার ঢ্যাপ দিয়েছে তোমাকে? মাদলা গ্রামের জমিতে এবার লাল আউশ আনতে দাদু কাকে সঙ্গে করে গিয়েছিল? শংকর জ্যাঠার দোকান কি আর খুলল?
ঠাকুমার মুখে বাড়ির উঠোনে সারা-বছরী আমগাছের কথা, ডালিম গাছের লাল ফুলের কথা, কাঠের দোতলার জমিয়ে রাখা শুকনো লাল বরইয়ের কথা, বাইরবাড়িতে গোলেনূর দাদীর তেজপাতা গাছের নতুন পাতার কথা – শুনতে শুনতে আমি ঘুমে তলিয়ে যাই।
বাইরে তখন ঢলের জলে ভেসে যাচ্ছে জাম-জাফরুলের ঝরে পড়া পাতাগুলো।
শহরে এলে ঠাকুমাকে অন্ধকার থাকতেই উঠে পড়তে হয় না। উঠোনের ছড়া জল নয়, শুধু পড়ে জলের ছিটা। আর আকাশের গায়ে দিনের আলো একটু ফুটে উঠলেই মুসা’র মা চলে আসে। উঠোনে ঝাড়ু পড়লেই তবে এখানে দিন শুরু হয়।
অবশ্য এরও আগে পৌরসভার ঝাড়ু পড়ে বাসার সামনের রাস্তায়। ঝাড়ুদার ভরতের মা’র সাথে এ ক’দিনে ঠাকুমারও ভাব হয়ে গেছে।
হবে নাই বা কেন? ঠাকুমা তো ভোরের অন্ধকার একটু মিইয়ে যেতেই বিছানা ছাড়ে। ফটক খুলে মসজিদের মাঠে গিয়ে দাঁড়ায়। এর কিছু সময় পর হাঁটতে হাঁটতে গয়লাবাড়ির মাঠ পেরোয়। কেন এত সকালে ওঠো ঠাকুমা? প্রশ্ন করলে উত্তর একটাই — কতদিনের অভ্যাস দিদি, নষ্ট করে লাভ কী?
রাস্তা ঝাড়ু দিতে দিতে ভরতের মা শুধু এ পাড়ার নয়, এই শহরের প্রায় সবাইকেই চেনে। তাই তো ঠাকুমাকে প্রথমদিন দেখেই গল্প জুড়েছিল,
মাইজি, আপ নয়া হে ক্যায়া ইস শহর মে? আজ কে পেহেলে তো নেহি দেখা আপ কো?
অচেনা ভাষার সামনে পড়েও ঠাকুমা খেই হারায় না।
বুঝতে তো পারছি না কী বলছ মা, তবে আমি নাতিনকে দেখতে এসেছি। আমার বাড়ি এখানে নয়।
ব্যস্, এতটুকু কথাতে কী বুঝলো ভরতের ঠাকুমা তারও অতিথি হয়ে উঠল। শহরের কোন পাড়ায় কী মন্দির আছে, কোথায় নিয়ম করে ভগবত পাঠ হয় — সব খবর ঠাকুমাকে জানাতে যেন অস্হির হয়ে উঠল ভরতের মা।
মাইজি, আপ ইস শহরকি মেহমান হে তো মেরা ভি আপ মেহমান হে।
আর আস্তে আস্তে এ ক’দিনে ঠাকুমা ভরতের মায়ের এতোই আপন হয়ে উঠল, যে তার গাছের পেয়ারাটা, গোছা ভরা সজনে ফুলটা, কাঁচা তেঁতুলটা সব এনে ঠাকুমার হাত ভরিয়ে দেয়। আর ঠাকুমাও খানিক আমতেল, পুরোনো দু’খানা শাড়ি, অর্ধেক হয়ে আসা আলতার বোতল সব সরিয়ে রাখে ভরতের মা’র জন্য।
গতরাতের বৃষ্টি ধরে এসেছিল মাঝরাতের পরেই। তাই এ পাড়ায় জমা জল ভোররাতের আগেই গড়িয়ে নদীতে পড়েছে। আর বর্ষার জল নদীতে পড়া মানেই অসংখ্য টাটকা মাছের দেখা মেলে নদীর ঘাটে। বাবা তাই আজ সকালেই চা খেয়ে বেরিয়ে গেল নদীর ঘাটে। আর মা স্টোভে আঁচ দিলো তিনকোনা পরোটা, সুজির মোহনভোগ আর সবজি রান্না করতে।
আমার জন্য এসবকিছুই নয় শুধু চিনি দিয়ে পেঁচানো ঘিয়ে ভাজা পরোটা। ফেলেছেড়ে খেতে না খেতেই ফটকে রিক্সার বেল। রহিম চাচা এল।
আজ অবশ্য স্কুলে যেতে গড়িমসি নেই আমার। না না, পড়াশুনো বা বন্ধুদের জন্য নয়, আজ কালীবাড়িতে অষ্টপ্রহর শুরু হবে যে। আমি পেছনের বেঞ্চে বসে সারাসময় ওটাই দেখব।
হলও তাই, শুধু আমি নয়, স্কুলের সবাই আজ সুযোগ পেলেই জানালায় দাঁড়াচ্ছে। আর হামিদ স্যার তো শুধু দেখা নয়, সুরও মেলাচ্ছে,
“জাগো শ্যামের মনমোহিনী
বিনোদিনী রাই…”
অদ্ভুতভাবে আজ স্কুল শেষ হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। স্কুলের গেটে বসা মাসির কাছ থেকে হজমি কিনে দাঁড়াতেই রহিম চাচা চলে এল। ক্লান্ত মানুষটির পান-খাওয়া দাঁতগুলো আমাকে দেখলেই হেসে ওঠে,
আসো আম্মা…
আজ আর ঠাকুমা উঠোনে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে নেই। কেরোসিনের স্টোভের সামনে বসে ঘেমেনেয়ে একের পর এক পদ নামাচ্ছে। আর তাতে একটু তাড়াহুড়োও আছে যেন। দুপুরের পাত উঠলেই তো আমরা অষ্টপ্রহর শুনতে যাব।
আজ সকালে বাবা নদীর বড় চিংড়ি এনেছে। চকচকে চিংড়িগুলো কেটেবেছে পরিষ্কার করে দিয়েছে মুসা’র মা। স্টোভের কড়াইয়ের তেলে এখন হলুদ, লবণ-মাখানো চিংড়ি মাছগুলো পড়তেই লাল হয়ে উঠছে। অল্প আঁচে তা এপিঠ ওপিঠ করে ভেজে নিল ঠাকুমা।
মনিপিসি এগিয়ে দিল ডুমো করে কাটা ভাপিয়ে রাখা মানকচু। কড়াইয়ে আরো খানিক সর্ষের তেল পড়লো। তাতে তেজপাতা ফোড়ন। দেরি না করে তাতে পড়লো ভাপিয়ে রাখা মানকচু। হলুদ লবণ দিয়ে নেড়েচেড়ে তাতে ঠাকুমা বাটি থেকে মিহি করে বাটা জিরে আর শুকনো মরিচ বাটা দিয়ে দিল। এরপর বাটি ধুয়ে খানিক জলও। জল পেয়ে কড়াইয়ের তেলমশলা ধোয়া ছেড়ে দিল। খুন্তি দিয়ে খুব ভালো করে সেই মশলা কষাতে লাগল ঠাকুমা।
ও দিদি, স্নান করে আস। আজ একটু তাড়াতাড়ি কর সোনা দিদি।
ঠাকুমার কথাতে কিছু একটা ছিল। আমি ঘাড়ের ব্যাগ বারান্দায় রেখেই কলতলা গিয়ে ঢুকি। মা কয়েক ঘটি জল মাথায় ঢেলে দেয় আমার।
উঠোন পেরিয়ে জিরাবাটার ঘ্রাণ এখন কলতলাতেও পৌঁছে গেছে। আমি মাথায় গামছা নিয়েই ঘরে চলে এলাম।
ঠাকুমা মশলা কষানো শেষে এবার খানিক ঊষ্ম জল কড়াইয়ে ঢেলে দিল। ঝোল ফুটে উঠতেই তাতে চিংড়িমাছ পড়ল। ঠাকুমা এবার কড়াইয়ে ঢাকনা দিয়ে স্টোভের আঁচ বাড়িয়ে দিল।
আজ দুপুরের পদ হল ডাঁটা শাক, আলুর চাক ভাজি, চিংড়িমাছের রসা আর জলপাইয়ের টক।
চিংড়িমাছের রসা এখনো হয়ে সারেনি। কেরোসিনের স্টোভে টগবগ করে ফুটছে রসা।
ঠাকুমা আঁচ কমিয়ে কড়াইয়ের ঢাকনা সরাল। সাথে সাথেই চিংড়িমাছের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল বাসার উঠোনে। ঠাকুমা আর দেরি করে না চন্দনের মত বাটা গরম মশলা আর ঘি ছড়িয়ে দিল রসায়। আর নামানোর আগে খানিক চিনি।
আমাদের পাত পড়ে গেল। আমার ওই বড় চিংড়িমাছটা চাই। ওটার কমলা রঙের মগজের প্রতি আমার সব আগ্রহ যে। ঠাকুমা দিলও তাই, তবে নিজের জন্য নেওয়ার আগে একটা বাটিতে চিংড়ির রসা তুলে রাখল ভরতের মা’র জন্য।
রাখতে তো হবেই, নিজের বাড়ির বড় মানকচু সেই তো নিয়ে এসেছে ঠাকুমার জন্য,
হামারে ইয়ে আরুই বহত মিঠি হে মাইজি…
আমার পাতের ভাত আজ সেভাবেই পড়ে রইল। চিংড়ি মাছ ফুরিয়ে যেতেই আমি উঠে পড়লাম,
ও ঠাকুমা, খাওয়া শেষ করো তাড়াতাড়ি অষ্টপ্রহর শুনতে যাবে না?
আমার তাড়াতে সবারই খেয়েই গুছিয়ে নিল। পাটভাঙা একটা ঘিয়ে রঙের তাঁতের শাড়ি পরল ঠাকুমা। তিব্বত স্নো আর সিঁদুরে সেজে নিল। আর মুখে পুরে নিল হাকিমপুরী জর্দা দিয়ে একটা পান। পাটভাঙা শাড়ি, তিব্বত স্নো আর হাকিমপুর জর্দার ঘ্রাণ জড়ানো ঠাকুমার হাত ধরে যখন আমি কালিবাড়ীর পথে তখন এই বারবেলায় কারো বাড়ির রেডিও থেকে ভেসে আসছে,
“তুমি আমারই মতন জ্বলিও জ্বলিও
বিরহ কুসুম হাড় গলেতে পড়িও
ও তুমি আমারই মতন জ্বলিও জ্বলিও
বিরহ কুসুম হাড় গলেতে পড়িও
তুমি যাইও.... যমুনার ঘাটে
তুমি যাইও.... যমুনার ঘাটে
না মানি ননদীরো বাধা…”