টিনের চালে সারারাত ধরে চলা বরই গাছের দাপাদাপি একটু আগে থামল। পাতা চুঁইয়ে জমে থাকা বৃষ্টির জল এখনো টিপ টিপ করে শব্দ তুলছে। কাঠের জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে একটু-আধটু হাওয়া যেটুকু আসছে, তাতে বৃষ্টিজলের শীতলতা মিশে আছে।
ঠাকুমা আমার গায়ের কাঁথাটা টেনে দিতেই আমি আরেকটু সরে এলাম ঠাকুমার দিকে।
“ও দিদি, আজ অনেক কাজ আছে। আমাকে উঠতে হবে। তুমি শুয়ে থাকো আরেকটু”। কথাটুকু শেষ করে আমার হাত সরাতে যতটুকু সময় – এরপরেই ঠাকুমা উঠে পড়ল।
ঠাকুমা বড়ঘরের দরজাটা আলগোছে খুলতেই উঠোনের কালচে অন্ধকার টুক করে ঘরের অন্ধকারে মিশে গেল।
এই প্রথম আমি মনে মনে চাইলাম এই অন্ধকার না ফুরাক। আজকের সকাল না আসুক।
আমার চাওয়াতে তো আর সব হয় না! সময় ঠিকই তার ইচ্ছেমতন চলতে থাকে। আর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা মানুষটি তাই চটজলদি মিশে গেল উঠোনের অন্ধকারে। মানুষটি ভোরের উঠোনে নেমে পড়া মানেই এ বাড়ির দিন শুরু হয়ে যাওয়া।
আজও তার ব্যত্যয় ঘটল না। ভেজানো দরজার এপাশ থেকেই আমি বুঝতে পারলাম উঠোনে গোবরজলের ছরা পড়ছে। ফটকে পরপর তিনবার আঘাত বুঝিয়ে দিল – পূর্ণির মা চলে এল।
আমি হাতের কড়ে সময় গুনি। বুকের ভেতর কেমন যেনো করে ওঠে। সময় তো আর খুব বেশি নেই।
মনিপিসি মনে হয় কিছু বুঝতে পারে। উপরতলা থেকে নেমে এসে আমার পাশে শোয়, “আমার পরীক্ষা শেষ হলে মাকে নিয়ে শহরে যাব। তখন আমরা প্রতিদিন বিকেলে নদীর তীরে ঘুরতে যাব”।
হ্যাঁ, মনিপিসি এরমধ্যেই জেনে গিয়েছে শহর জীবনের আমার একমাত্র পছন্দের বিষয় প্রতিদিন বিকেলে যমুনা নদীর পাড়ে ঘুরতে যাওয়া। আমলাপাড়ায় আমাদের বাসার খুব কাছেই যমুনা নদী। মসজিদের মাঠ পেরিয়ে গীতাদিদিদের বাড়ি পার হলেই মুসা’র মাদের পাড়া। আর সেই পাড়া ঘেঁষেই বিশাল নদী।
মুসা’র মা আমাদের বাসার বাইরের কাজগুলো করে দেয়। ওই তো এঁটো বাসন ধুয়ে দেওয়া, ক্ষারজলে সেদ্ধ কাপড় ধুয়ে দেওয়া আর উঠোনের পাতাগুলো বারবার ঝাড়ু দিয়ে এক জায়গায় করা।
বারবার ঝাড়ু না দিলে হবে? আমাদের বাসাটায় এত গাছ, যে উঠোন পেরিয়ে রোদ বারান্দায় বসার আগেই টুপ করে গাছের ছায়ায় তলিয়ে যায়।
আমলাপাড়ার নিরিবিলি বাসাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আমার বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে। আমি ফিসফিস করে বলি, “ও মনিপিসি, বাবার শহরের চাকরি কবে ফুরাবে?”
মনিপিসি কি একটু হেসে উঠল? অন্ধকারে তা ঠাওরে উঠতে পারলাম মা। তবে আমার কাছে আরেকটু সরে এসে মনিপিসি বলল, “এই শহরের পর আরোও বড় শহর, তারপর আরোও বড় শহরে যেতে হবে তোকে। তোকে অনেক বড় হতে হবে মনি”।
মনিপিসির স্বরে কিছু একটা আছে। উত্তর খুঁজে পাইনা আমি। মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করি, “বড় হলে কি আর নিজের বাড়ি, নিজের জায়গাতে আর ফেরা যায় না?”
প্রশ্নটা নিয়ে ভাবনা শুরু হবার আগেই মনিপিসি আমার পাশ থেকে উঠে পড়ে, “আজ ঠাকুমাকে কাজে সাহায্য করতে হবে রে, বয়স বাড়ছে তো, আর পেরে ওঠে না এখন”।
সকাল না হওয়ার আমার সব চাওয়া ব্যর্থ করে এ বাড়িতে যেন আজ সময়ের বেশ আগেই দিন এল। ঠাকুমা বাসি কাজ সেরে স্নান করে এরমধ্যেই বড়ঘরে চলে এসেছে। হাততালি দিয়ে ঠাকুরঘরে গৌর নিতাইয়ের ঘুম ভাঙাচ্ছে।
আমি বিছানা ছেড়ে উঠতেই দাদুর ডাক, “গিন্নি, চটিজোড়া দেখ তো পায়ে দিয়ে। তোমার বলে দেওয়া রঙ মিলল কিনা দেখে নাও”।
বাড়ি আসার পরপরই বায়না ধরেছিলাম – হাওয়াই মিঠাই রঙের একজোড়া চটির। এক’দিনে সে বায়না কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
আমি খবরের কাগজে মোড়ানো চটিজোড়া খুলে দেখি। উঠোনের অন্ধকার মুছে ফেলা আবছা আলোয় আমি দেখি – যে রঙ আমি ভেবে রেখেছিলাম, দাদু ঠিক ঠিক সেই রঙে খুঁজে এনেছে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দাদু বুঝে নেয় অনেককিছু। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, “গিন্নির জন্য এই বুড়োটা সারাদুনিয়া খুঁজে পছন্দের জিনিষ এনে দেবে”।
আমি কিছু বলি না, পায়ে পায়ে দাদুর খাটের কাছে এসে দাঁড়াই। এখান থেকে ঠাকুরঘরটা পরিষ্কার দেখা যায়। জ্যেঠিঠাকুমার উঠোনের নীলমণি ফুল আজ পড়েছে গৌর-নিতাইয়ের পায়ে। গৌর-নিতাইকে ধুয়েমুছে ঠাকুমা সেই ফুল দিয়েই তিলকের ফোঁটা পরিয়ে দিল। নিজেও তিলক টেনে নিল কপালে। কণ্ঠে তিলক পরে ঠাকুমা গুনগুন করে উঠল,
“জয় জয় নিতাই গৌর
প্রেমানন্দে হরিবোল…”
বাড়ির উনুনে আজ খুব তাড়তাড়ি আঁচ পড়েছে। সাথে লালবারান্দায় ঠাকুমার কেরোসিন স্টোভের ফিতাতেও আগুন জ্বলেছে। নীলচে আগুনের শিখায় মনিপিসি চায়ের খাবড়ি চড়িয়েছে। আজ এ বাড়িতে সবারই খুব তাড়াহুড়ো। শুধু আমার অলস বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে।
“মনি, ব্রাশ করে নাও। আজ ঢিলেমি কোরো না”।
মা’র তাড়াহুড়োতে আমি বড়ঘরের ঘড়ির দিকে তাকাই। আন্দাজ করতে চেষ্টা করি ছোটো কাঁটাটা কোথায় ঠেকলে আমাদের বেরোতে হবে।
সারারাতের ঝড়বৃষ্টির পর দিন এলেও রোদ্দুর কিন্তু ওঠেনি। দেবদারু বাগানের ছায়ায় উঠোনটাকে কেমন মনমরা লাগছে। পেয়ারাগাছের পাতা চুইঁয়ে একটু-আধটু বৃষ্টির জল এখনো পড়ছে।
আজ সকালে বড়ঘরে চায়ের আড্ডা বসল না। যে যার জায়গাতে কাজ করতে করতেই চায়ের কাপে চুমুক দিল। সকালের জলখাবারের আজ লুচি, পাঁচ তরকারি আর সুজির মোহনভোগ হল। সেখান থেকে কিছু সরিয়ে রাখা হল অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন ক্যারিয়ারে।
সকালের খাওয়া সেরে ঠাকুমা লালবারান্দায় নারকেল কুড়তে বসে গেল। আর মনিপসি বাছতে বসল খই।
বাড়ি এসেই আমি গরম গরম খইয়ের বড়া খেতে চেয়েছিলাম যে।
উনুনের ঢিমে আঁচে মা কড়াই বসাল।
ঠাকুমা কালো পাথরের বড় বাটিতে অনেকখানি কোরা নারিকেল, সাদা খই, ঝোলা গুড় দিয়ে এঁটে মাখিয়ে নিল। একটুও জল পড়ল না তাতে। ঠাকুমা অল্প একটু ময়দা ছিটিয়ে আরও এঁটে নিল মিশ্রণটা। সবার শেষে মিশ্রণে পড়ল দু’মুঠো কিশমিশ।
আর দেরি করে না ঠাকুমা।
ঢিমে আঁচে উনুনের কড়াইয়ের তেল থেকে খুব হাল্কা ধোঁয়া উঠছে।
ঠাকুমা একে একে হাতের মুঠোয় গোল করা বড়াগুলো তেলে ছেড়ে দিল। উনুনের আঁচ বাড়াল না একটুও। ঢিমে আঁচে উল্টেপাল্টে লাল করে ভেজে নিল ঠাকুমা। খুলে পড়া দু’একটি ফুলে গোল হয়ে ওঠা কিশমিশগুলো পুড়ে যাবার আগেই বাটিতে তুলে নিল ঠাকুমা।
বাটিখানা আমার দিকে এগিয়ে দিল ঠাকুমা, “ও দিদি, ফুঁ দিয়ে জুরিয়ে খাও”।
অল্পসময় পর সেই বাটিতে পড়লো মুচমুচে খইয়ের বড়াও, “দিদি রে, এই বড়া আজ না বানালে আমার আত্মা পুড়ত, মনে হত দিদি আমার খেতে চেয়েছিল যে”।
আমি মাথা নিচু করে ফেলি। আমার চোখে জল দেখলে ঠাকুমার তো আবার আত্মা পুড়বে।
বাইরবাড়িতে রিক্সা এসে দাঁড়াল। আজ সঞ্জীবকাকু আমাদের শহরে পৌঁছে দিতে যাবে।
ঠাকুমা আর মনিপিসি আর ক’দিন পরেই তো আমাদের বাসায় যাবে। তবুও আমার মনটা কেমন খারাপ লাগে।
ঠাকুমা আমার বা’হাতের ছোটো আঙুলটায় আস্তে করে কামড়ে দেয়। আর কোহিনূরদাদি দোয়া ভরা রূপার তাবিজখানা মা’র হাতে দেয়, “ও বৌমা, শুক্কুরবার দেখে পড়ায়ে দিও। আল্লাহ করলি আর ঘুমের ভেতর ভয় পাবেনানে মেয়ে”।
আমাদের রিক্সা এগোয়। অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন ক্যারি, কাপড়ের ব্যাগ, ঠাকুমার বাগানের শাক সব নিয়ে আমরা এগোতে থাকি।
পেছনে ঠাকুমা, মনিপিসি, গোলেনূর দাদি, বড় বৌমা, মেজো বৌমা দাঁড়িয়ে আছে জেনেও আজ পেছন ফিরে তাকাই না আমি।
কারণ এতদিনে আমি বুঝে গেছি এভাবেই বারবার সবাইকে পেছনে ফেলে আমাকে সামনের দিকে এগোতে হবে।