কেল্লার ভেতরে নবাবের দরবারের আলো নিভে গেছে, বহু বছর হল নবাবী গৌরবও অস্ত গিয়েছে। শ্বেত পাথরের ফোয়ারায় আর রঙধনু রং ধরেনা, এখন আর নবাবের ভাঙ্গা প্রাসাদ থেকে দরবারী কানাড়া, দাদরা ঠুংরির আওয়াজ ভেসে আসেনা, প্রতি সন্ধ্যায় সারেঙ্গীর সুরও আর বাজেনা। নবাবের সাধের ফুলের বাগান আজ গভীর জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। আজ আর কেল্লার রাস্তায় নবাবের ফিটন গাড়ি চলেনা, প্রাসাদের সামনে হাতি এসে বেগম সাহেবদের জন্য অপেক্ষা করে না, দক্ষিণ দরওয়াজা, রৌনক আফজা দরওয়াজার উপরে নহবতখানায় আজ আর সানাই বাজেনা।
তবুও থেকে যায় সোনালী স্মৃতি, থেকে যায় রেশ,তবুও কেল্লার ভেতরে অতীতের স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও রয়ে গেছেন নবাবদের উত্তরসূরিরা। না পুরনো দিনের গৌরবময় স্মৃতি আজ আর তাদের আনন্দ দেয়না বরং তাদের বেদনা বাড়িয়ে দেয়।
দেশ ভাগের সময় কেল্লায় বসবাসকারী পরিবারের বাকি সদস্যরা ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া,পাকিস্তান, বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লেও তাদের অনেকেই কিন্তু মুর্শিদাবাদ শহরকে ভালবেসে এই শহরেই রয়ে গেছেন। বর্তমানে নিজামত পরিবারের প্রায় ৪৫০ থেকে ৫০০ জন সদস্য কেল্লা নিজামতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছেন।
একসময় নিজামত পরিবারের সদস্যরা কেল্লার ভেতরে অবস্থিত বিভিন্ন প্রাসাদে বসবাস করতেন কিন্তু একটা সময় প্রাসাদ গুলি অধিগ্রহণ করা শুরু হলে প্রাসাদে বসবাসকারী নবাব পরিবারের মানুষগুলির অবস্থা দুর্বিসহ হয়ে পড়ে। তখন তাঁরা কেল্লার ভেতরেই বিভিন্ন পরিত্যক্ত ভঙ্গুর নানান স্থাপত্যে বসবাস করতে শুরু করেন। যেমন একসময় কেল্লার পাহারা দেওয়ার জন্য কেল্লার বাইরের দিকে নবাবী সেনাদের বসবাস করার ব্যারাক ছিল,সেই সব ব্যারাকে আজ নিজামত পরিবারের মানুষরা বসবাস করেন, এছাড়াও কেল্লার এক সময়ের ব্যান্ড মাস্টার কোয়ার্টার, পুরনো প্রিন্সেস কোয়ার্টার সহ পুরনো আমলের বেশ কয়েকটি বাড়িতেও নিজামত পরিবারের বহু মানুষ বসবাস করছেন। কেল্লার ভেতরে নিজামত পরিবারের অনেকে আবার কেল্লার ভেতরে নতুন বাড়ি নির্মাণ করেও তাতে বসবাস করছেন।
একসময় নিজামত পরিবারের সদস্যরা রাজকীয় ভাতা পেতেন, কোনো ভাতা ভোগী মৃত্যুবরণ করলে সেই ভাতা মৃত ব্যক্তির পরিবারের মানুষদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হতো কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর আমলে এই নিয়ম বাতিল হয়ে যায়, এবং নতুন নিয়ম অনুযায়ী ভাতা-ভোগী ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাঁর ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। এই নতুন নিয়মের ফলে নিজামত পরিবারের সদস্যরা অর্থনৈতিক ভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েন এবং সরকারের অধিগ্রহণ করা নবাবী প্রাসাদে তাঁরা বিভিন্ন ছোট খাটো পদে চাকরী করে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন। বর্তমানে সরকারের প্রতি তাদের অনেক অভিমান রয়েছে, কিন্তু আজ তাদের সমস্ত অভিমান, অভাব-অভিযোগ শুনে মানবিকতার সাথে সেগুলি প্রতিকার করার মতো কেউ নেই। নিজামত পরিবারের সব সদস্যরই যে এমন অবস্থা তা কিন্তু নয়, নিজামত পরিবারের কিছু এমন সদস্যও রয়েছে যারা পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরকারি উচ্চপদে নিযুক্ত আছেন। কেল্লায় বসবাসকারী নিজামত পরিবারের অনেকে শিক্ষক সদস্য রয়েছেন, এছাড়াও রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ সহ আরও অনেক পেশার মানুষ। নিজামত পরিবার গুলি আজও তাদের পুরনো তেহজিব ধরে রেখেছে। হোক বয়সে ছোট কিম্বা বড় সবাইকে তাঁরা "আপ" সম্বোধন করেই কথা বলেন।নবাব যদি বয়সে ছোটোও হতেন তবুও তাঁর চেয়ে বয়সে বড় আত্মীয়স্বজনরা তাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে কথা বলতেন।খেতে বসার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম চালু ছিল, নবাব খাওয়া শুরু করলে তবেই বাকিরা মুখে খাবার তুলতেন। খেতে বসে কোনো কথা বলা যেত না, খাবার খাওয়ার সময় মুখে কোনো আওয়াজ করা যেত না, খেতে বসারও নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছিল, কারো খাওয়া হয়ে গেলেও নবাবের আগে খাওয়া ছেড়ে উঠে যাওয়ার কোনো নিয়ম ছিলনা, হঠাৎ করে কারো ওঠার প্রয়োজন হলে নবাবের অনুমতি নিয়ে তবেই ওঠা যেত। নবাবী আমল না থাকেলও এই নিয়ম গুলি আজও নিজামত পরিবারে প্রচলিত রয়েছে।
আজকাল নিজামত পরিবারের খাওয়া দাওয়াতেও বহু পরিবর্তন হয়েছে। নবাবী আমলের সেই সব শাহী খাবার আজ আগের মতো নিয়মিত রান্না হয়না তাদের রসুইখানায়। এর পেছনে অবশ্যই অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে তবে শুধু অর্থনৈতিক কারণই নয় স্বাস্থ্যগত কারণও এর জন্য দায়ী, কারণ নবাবী শাহী খানায় যে পরিমাণ মসলা ও ঘি ব্যবহার করা হয় তা খেলে শরীর বহু রোগের আঁতুড়ঘরে পরিণত হবে।একবার ছোট নবাব কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন যে তাদের শাহী বিরিয়ানি হজম করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়, শাহী বিরিয়ানি খাওয়ার অভ্যাস না থাকলে এই বিরিয়ানি খেয়ে হসপিটালে ভর্তি হতে হবে।নিজামত পরিবারে বর্তমানে প্রতিদিনের খাওয়া-দাওয়া প্রায় সাধারণ বাঙালিদের মতোই হয়ে গিয়েছে তবুও বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে কিম্বা বাড়িতে কোনো মেহমান এলে তার জন্য আজও শাহী খানার আয়োজন করা হয়।
নিজামত পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের মুখে শোনা যায় তাদের শৈশব জীবন কেটেছে খুব কড়া নিয়ম কানুনের মধ্যে। তাদের স্বাধীনতা খুব কম ছিল সব সময় তাদের পেছনে ভৃত্য নিযুক্ত থাকতো, তাঁরা কখনোই কেল্লার বাইরে একা একা যেতে পারতেন না, নিজামত পরিবারের বাইরের কোনো বাচ্চাদের সাথেও তাদের খেলাধুলো করার আদেশ ছিলনা কারণ তাদের অভিভাবকদের ধারণা ছিল নিজামত পরিবারের বাইরের বাচ্চাদের সাথে তাদের বাচ্চারা মেলামেশা করলে তারা খারাপ সংস্কৃতি শিখবে নবাবী তেহজিব ভুলে যাবে। নিজামত পরিবারের বাচ্চারা স্কুলে গেলেও তাদের সাথে চারজন করে ভৃত্য থাকতো। জানা যায় যদি বাচ্চাদের একটা মশায় কামড়ালেও তাদের সাথে থাকা ভৃত্যদের জরিমানা করা হতো। নিজামত পরিবারের মহিলা সদস্যদের ক্ষেত্রে বাধানিষেধ অনেক বেশী ছিল, তাঁরা বাইরে কোথাও বের হলে পালকি করে কিম্বা চারিদিক ঘেরা ঘোড়ার গাড়ি কিম্বা উটের গাড়িতে করে বেরত। সব সময় যে কাজের উদ্দেশ্যই তাঁরা বেরতেন এমন নয় কিন্তু অনেক সময় শহর পরিভ্রমণেও তাঁরা বেরতেন।কাজ বা ভ্রমণ শেষে তারা যখন পালকি কিম্বা ঘোড়ার গাড়ি করে ফিরতেন কেল্লার ভেতরে প্রাসাদে তখন গাড়ি থেকে নামার সময় একদল ভৃত্য বড় বড় কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাস্তা তৈরি করে দিত। সেই রাস্তার মধ্যে দিয়ে নিজামত পরিবারের মহিলারা গাড়ি থেকে নেমে প্রাসাদের ভেতরে চলে যেতেন।আবার বাইরের কোনো পুরুষ সদস্য প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভৃত্যরা উচ্চ গলায় পর্দা করার কথা ঘোষণা করতেন, প্রসাদের ভেতরে যেসব মহিলারা অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকতেন তারাও এই নির্দেশ শুনে পর্দা করে নিতেন। নিজামত পরিবারের মহিলাদের কেল্লার ভেতরেই আলাদা জগৎ ছিল সেই জগতেই তাঁরা বিচরণ করতেন।
নিজামত পরিবারের সদস্যদের বিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজ বংশেই হয়ে থাকে। তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মুর্শিদাবাদের নিজামত পরিবারের সাথে অওধের শাসক পরিবারের বিবাহ হতো। মুর্শিদাবাদ শহরের রাজাবাজারে বসবাসকারী নিজামত পরিবারের এক প্রবীণ সদস্য ওয়াসিফ বাহাদুর ছিলেন এমন একজন মানুষ যার বাবা ছিলেন অওধের নবাব অসফ উদ দৌলার বংশধর এবং তাঁর মা ছিলেন বাংলার নবাব মুবারক উদ দৌলার বংশধর। ফলে ভদ্রলোকের শরীরে বইছে দুই শাসক বংশের রক্ত।
দেশভাগ ও তার পরবর্তীকালে বিশেষ করে নিজামত পেনশন বন্ধ হয়ে গেলে নিজামত পরিবার গুলিতে যে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছিল সেই সময়তে হাজার আর্থিক কষ্ট সহ্য করেও নিজামত পরিবারের সদস্যরা তাদের আত্মমর্যাদা বিনষ্ট করেননি। আমি নিজামত পরিবারের এক সদস্যের কাছে শুনেছিলাম যে, তীব্র আর্থিক কষ্টের সময় নবাব পরিবারের কিছু সদস্য তাদের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া গয়না বিক্রি করেও সংসার চালিয়েছেন। কিন্তু মজার বিষয় হল তাঁরা সেই গয়না বিক্রি করতেন সবার অলক্ষ্যে যাতে কেউ বুঝতে না পারেন নিজামত পরিবারের দৈন্যদশার কথা। বহুবার অবস্থা এমনও হতো যে গয়না বিক্রি করতে গিয়ে সেখানে তৃতীয়পক্ষ কেউ চলে এলে তখন সেই গয়না ক্রেতাকে বিনামূল্যেই দিয়ে চলে আসতেন যাতে তৃতীয় পক্ষের টের না পায় যে নিজামত পরিবারের সদস্যরা গয়না বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে। এতে তাদের বংশের মর্যাদাহানি হবে কারণ এই বংশের পূর্বপুরুষরাই এক সময় সমগ্র বাংলা বিহার উড়িষ্যার শাসক ছিলেন।
নিজামত পরিবারের এক প্রবীণ সদস্যকে একবার বলতে শুনেছিলাম যে তিনি মুর্শিদাবাদের কোনো চায়ের দোকানে বসে চা খেতে পারবেন না, এতে তাঁর আত্মসম্মানে বাধে, কিন্তু মুর্শিদাবাদ শহরের বাইরে অবশ্য কোনো সমস্যা নেই।আবার এমনও অনেক প্রবীণ সদস্য রয়েছেন যারা আজও সাইকেলে করেই সমগ্র মুর্শিদাবাদ শহর ঘুরে বেড়ান, ব্যাগ হাতে বাজারে যান।
বর্তমান সময়ে মুর্শিদাবাদের নিজামত পরিবার বলতে কিন্তু নাজাফি বংশের বা মীরজাফরের উত্তরসূরিদেরকেই বোঝানো হয়ে থাকে।তারাই আজ কেল্লায় বসবাস করেন। মীরজাফরকে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ বিশ্বাসঘাতক বলে চিনলেও মুর্শিদাবাদের শহরবাসীদের কিন্তু মীরজাফর ও তাঁর বংশধরদের নিয়ে তেমন কোনো তিক্ততা নেই। এলাকাবাসী তাদের যথেষ্ট সমীহ করেন। আর করবে নাই বা কেন? মুর্শিদাবাদ শহরের অধিকাংশ নবাবী স্থাপত্য যে মীরজাফরের বংশধরদেরই তৈরি। শুধু তাই নয় মুর্শিদাবাদ যে একটা সময় সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল তাতেও এই মীরজাফর বংশীয়দের বিরাট অবদান রয়েছে। মীরজাফরকে বিশ্বাসঘাতক বলা হলেও তাঁর বংশধরদের কাছে অবশ্য মীরজাফর কোনো ভাবেই বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না, কেনো ছিলেন না সে বিষয়ে তাদের কাছে অনেক যুক্তি প্রমাণও রয়েছে।সেই সব যুক্তি গুলিও পরের কোনো পর্বে জানাবো।
বর্তমানে কেল্লা নিজামতে শুধুমাত্র নিজামত পরিবারের মানুষরাই নন সেই সাথে নিজামত পরিবারে কর্মরত বেশ কিছু ভৃত্যদেরও নবাবী আমল চলে যাওয়ার পর খুব সম্ভবত বিংশ শতকের প্রায় ছয় কিম্বা সাত দশকের কোনো এক সময়ে কেল্লার ভেতর বসবাসের জন্য জায়গা দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও কেল্লার চক গেটের সন্নিকটে কেল্লার ভেতরে ইরানি সম্প্রদায়ের বহু মানুষও বসবাস করে। অন্যদিকে ভাগীরথীর সন্নিকটে বালাখানা প্রাসাদের নীচের তলাতেও বেশ কিছু গৃহহীন অসহায় মানুষের বসবাস রয়েছে। বালাখানার উপর তলাতেও এক ব্রাহ্মণ তার পত্নী নিয়ে একাকী বসবাস করেন। কেল্লায় বসবাসকারী নিজামত পরিবারের বাইরের এই সমস্ত মানুষগুলিকে কেল্লায় বসবাস করার অনুমতি অবশ্য নিজামত পরিবার থেকেই দেওয়া হয়েছে।
কেল্লায় বসবাসকারীরা প্রতি বছর নওরোজ, বেরা, মহরম শবেবরাত, রমজান ও দুই ঈদ সহ আরও বেশ কিছু উৎসব ও অনুষ্ঠান উপলক্ষে মেতে ওঠেন। পরের পর্বে এই সব নানান উৎসব অনুষ্ঠানের কথা আপনাদের জানাবো।