ভরদুপুরের কড়া রোদের সবটুকু তাপ শুষে নিয়ে আমাদের কাঠের দোতলাটা কেমন যেন গুমোট হয়ে থাকে। আর দুপুর পড়তে না পড়তেই সেই গুমোট ভাব উপরতলা ছাড়িয়ে নীচতলার সিলিং-এ এসে জড়ো হয়। তাই সিলিং ফ্যানের বাতাস যতটুকু শীতল, তারচেয়ে ঢের বেশি তপ্ত হাওয়া। সেই হাওয়ায় শরীর জুড়ায় না, তাই তো ঠাকুমার হাতে তালপাতার পাখাটা অনবরত নড়ে চলে।
গোবরজলে লেপা উঠোনে আজ দু’পোঁচ এঁটেল মাটির লেপও পড়েছে দুপুরের পর।
বারবেলায় তাঁতঘরের মাকু খটাস খটাস করে যতই পাড়াটাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, ঝিমিয়ে পড়া পাড়াটাকে জাগাতে পারছে কই?
অনেক সময় হল – দাদুর রেডিওটা কুনকুন করে বেজে চলেছে। অনুরোধের আসর শেষ হয়ে এখন চলছে নাটক। সে নাটক এতটাই আস্তে হচ্ছে, যে দাদুর ভাতঘুমে তা একটুও ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না। ঠাকুমারও তন্দ্রা চলে এসেছে। একটু পর পর হাতপাখাটা থেমে যাচ্ছে। আর এবার থামতেই ঠাকুমা নড়েচড়ে উঠে আবার তালপাতার পাখাটা নাড়তে শুরু করল,
“ও দিদি, একটু জিরিয়ে নাও…”
ঘুমে ঠাকুমার কথা জড়িয়ে এল। আমি পাশ ফিরে শুয়ে উঠোনের দিকে তাকাই। ডালিম গাছের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁচামিঠে আমগাছের মাথাটা মাঝে মাঝে বাতাসে নড়ে উঠছে। আমি ঘাড় উঁচিয়ে দেখতে চাই আকাশে মেঘ দেখা যায় কি না। আজও যদি ঝড় ওঠে?
ঠাকুমার হাতপাখা থেমে গেছে। সেই হাত ঘুমের ভেতরেই আমাকে জড়িয়ে নিল। নিরালা বল সাবান আর তিব্বত স্নো’র ঘ্রাণ মিলিমিশে ঠাকুমার গা থেকে একটা সুগন্ধ আসছে। আমিও ঠাকুমার মতো বড় হলে তিব্বত স্নো মুখে মাখব – ভাবতে ভাবতে লম্বা একটা শ্বাস টেনে ঠাকুমার ঘ্রাণটুকু বুকের ভেতর পুরে ফেলি।
পুরো পাড়ার মতো আমাদের বাড়িটাও ঝিমোচ্ছে। মনিপিসি ব্যাচে প্রাইভেট পড়তে ও’পাড়া গেছে। মা, বড় বৌমা, মেজো বৌমা সবাই দুপুরের কাজ সেরে গা ধুয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে যার যার ঘরে।
আমার গা থেকে ঠাকুমার হাতটা আলগোছে সরিয়ে দিই আমি। খুব নিঃশব্দে পা টিপে টিপে বড়ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াই। চারপাশে যতটুকু শব্দ – তা সব ওই তাঁতমাকুর খটাস্, খটাস্। সেই শব্দ এড়িয়ে আমি কান পাতি দূরে।
না, এখনো কিছু শোনা যায় না।
আমি ফটক খুলে বাইরবাড়ি চলে আসি। না, এপাড়ার সবাই ভাতঘুমে পড়ে নেই। ওই তো কোহিনূর ফুফু ও বাড়ির উঠোনে শাক বেছে নিচ্ছে। গোলেনূর দাদির চরকাটাও ঘুরে চলেছে অনবরত। আজ ফিরোজা রঙের সুতো ববিনে জড়াচ্ছে গোলেনূর দাদি।
আর ওই তো ওদের উঠোনের একপাশে বাঁশের খুঁটিতে নতুন রঙ করা সুতো রোদে শুকাতে দিচ্ছে বাঁশি চাচা।
বাঁশি চাচা খুব কম সময় বাড়িতে থাকে। বেশিরভাগ সময় বাসন্তী অপেরা যাত্রাদলের সাথে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। ওখানে সবসময় বিবেকের পার্টে অভিনয় করে।
আমি পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াই বাঁশি চাচার পাশে, “ও চাচা, তোমার পার্ট নেই আজ বাসন্তী অপেরায়?”
বাঁশি চাচা একটু আনমনা হয়। খুব ধীরে ধীরে বলে, “এখন আর বেশি শো হয় না রে মনি…”
বাঁশি চাচার কথা ফুরাবার আগেই কোহিনূর ফুফু ডেকে নেয় আমাকে, “রোদে রোদে ঘুরছিস কেন? এই ছায়াতে বস্...”। নিজের পিঁড়ি আমাকে এগিয়ে দেয় কোহিনূর ফুফু।
কুমড়ো শাকের একটি পাতা হাতে নিয়ে শিরা ছাড়াতে বেহাল আমি প্রশ্ন করি, “এত শাক কখন বেছে শেষ করবে কোহিনূর ফুফু? বেলা তো পড়ে এল।”
কোহিনূর ফুফু একমনে শাক বাছতে বাছতে বলে ওঠে, “বেলা যাক, ইফতারিতে আজ খেজুর খাবো শুধু। কত শাক দেখেছিস? কাল ঝড়ে মিষ্টিকুমড়ার মাচাটা ভেঙে গেছে।”
গোলেনূর দাদি চরকা থামিয়ে উঠে পড়ে। কচুপাতায় মোড়ানো চিংড়ি মাছ বাছতে বসে,
মাত্র এই কয়খান ইচা মাছ আনিছিস বাঁশি, পনেরো টেকা দিয়া! এই মাছের গন্ধে তো আজ ভাত খাতি হবিনি।
গোলেনূর দাদির চোখেমুখে অদ্ভুত একটা অসহায়তা।
আছরের আজান পড়তেই কোহিনূর ফুফু উনুনে আগুন দেয়। লোহার কড়াইয়ে জল বসিয়ে দিয়ে নামাজ পড়তে চলে যায়। একটুপর চিংড়িমাছ বাছা শেষ করে গোলেনূর দাদিও ওযু করে নেয়।
বাঁশি চাচা গুন গুন করে গান ধরে,
“ওরে মন মন রে আমার
ও তুই খালি হাতে এসেছিলি
যাবি খালিহাতে…”
বাঁশি চাচার সুর এড়িয়ে আমি আবার কান পাতি। ওপাড়া থেকে কি ঢাকের আওয়াজ আসছে? আমি গোলেনূর দাদির উঠোনের মাঝখানে এসে আবার কান পাতি।
এখান থেকে আমাদের বাইরবাড়ি পুরোটা পরিষ্কার দেখা যায়। ওই তো পূর্ণির মা ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো ঝাঁটা দিয়ে এক জায়গাতে জড়ো করছে। আমাদের বাড়ির ফটকখানা খোলা। ভেতরবাড়ির উঠোনে মনিপিসি চালের পিটুলির আলপনা দিতে বসে গেছে।
“ও মনি, শহরে কিরাম করে থাকিস তুই? ঠাকুমা ছাড়া দিন কাটাতি কষ্ট হয় নারে?”, কড়াইয়ের ফুটন্ত জলে কুমড়ো শাক ছেড়ে দিতে দিতে বলল গোলেনূর দাদি। গরম জলে শাক পড়তেই সবুজ রঙ আরও গাঢ় হয়। শাকের সেই রঙের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে বলি,
“দিন তো কাটে গোলেনূর দাদি, কিন্তু রাতে ঠাকুমার কোল ঘেঁষে ঘুমাতে পারি না বলে ঘুমের ভেতর স্বপ্নে বারবার কেঁদে উঠি।”
তবে সেসব কথা লুকিয়ে আমি একমনে গোলেনূর দাদির উনুনে ভাপানো গাঢ় সবুজ শাকের দিকে তাকিয়ে থাকি।
ওপাড়া থেকে এখন স্পষ্ট ঢাকের আওয়াজ আসছে।
কোহিনূর ফুপু শিলপাটায় মিহি করে সর্ষে, কাঁচামরিচ আর একটুখানি লবণ মিশিয়ে বেটে দেয়। গোলেনূর দাদি এর মধ্যে শাকগুলো জলসহ বেতের ঝুড়িতে ঢেলে দিল। সবুজ জল মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। উনুনে আবার কড়াই উঠল। তেতে উঠলে তাতে তেল আর কালোজিরা ফোড়ন। এরপর কুচানো পেঁয়াজ কড়াইয়ে দিয়ে নারিকেলের মালই থেকে খানিকটা লবণ নিয়ে দিয়ে দিল গোলেনূর দাদি। একটু নেড়েচেড়ে চিংড়ি মাছ আর হলুদ ফেলে দিল কড়াইয়ে।
কড়াই থেকে ওঠা ধোঁয়ায় চিংড়ি মাছের ঘ্রাণ গোলেনূর দাদির উঠোনে ছড়িয়ে গেল।
গোলেনূর দাদি আর দেরি করে না, ভাপানো কুমড়ো শাক ঢেলে দিল কড়াইয়ে। কোহিনূর পিসি বেলের শরবত বানাচ্ছে এখন। বাঁশি চাচা ইফতারে প্রতিদিন বেলের শরবত খায়।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে তাকাই। খোলা ফটক দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ঠাকুমাকে। তুলসিমঞ্চের সামনে কাটা ফল সাজিয়ে রাখছে।
ঢাকের আওয়াজ এখন খুব কাছে।
গোলেনূর দাদি সর্ষেবাটায় জল মিশিয়ে ঢেলে দিল শাক চচ্চড়িতে। সঙ্গে অনেকগুলো কাঁচামরিচের ফালি। এবার কড়াইয়ে ঢাকনা পড়ল।
আমি বাড়ি ফেরার জন্য উঠে দাঁড়াতেই গোলেনূর দাদি হাত টেনে বসিয়ে দেয়।
কোহিনূর ফুফু বারান্দার জলচৌকিতে খেজুর, বেলের শরবত আর নারিকেলের বরফি সাজাচ্ছে ইফতারের জন্য।
গোলেনূর দাদি কড়াইয়ের ঢাকনা তুলে আরেকটু নেড়েচেড়ে জ্বলন্ত খড়ি টেনে উনুন থেকে টেনে বের করে নিল। একটি বাটিতে কয়েকটা চিংড়িমাছ তুলে আমার দিকে এগিয়ে দিল গোলেনূর দাদি, “লবণ চেখে দেখ তো বুবু।”
এই প্রথম গোলেনূর দাদি আমাকে বুবু ডাকল। আমি অবাক হয়ে তাকাতেই বলে, “ও মনি, তুই আর সুমি বেবাকই আমার কাছে সমান রে বুবু।”
ঢাকের আওয়াজ হাতড়ে বুঝতে পারি, কারখানার কাছে চলে এসেছে নীলঠাকুরের পাট।
আমি আর দেরি করি না। সবগুলো চিংড়ি মাছ একসাথে মুখে পুরে দিই।
লবণ ঠিকঠাক থাকা শাকচচ্চড়ির ঝালে আমার চোখে জল চলে আসে। কোহিনূর ফুফুর চোখ এড়ায় না তা। সাজানো ইফতার থেকে একটা খেজুর তুলে আমার হাতে দেয়, “খা, ঝাল কমে যাবে।”
নীলঠাকুর নিয়ে অষ্টক গানের দল আমাদের বাড়িতে ঢুকছে এখন। আমি খেজুর মুখে দিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় লাগাই।
আলপনা আঁকা উঠোনে নেমেছে নীলঠাকুরের কালো কুঁচকুঁচে বেল কাঠের পাট। তেল সিঁদুর মাখা পাটে ঠাকুমা আরও তেল ঢালে। পেতলের ঘটে সিঁদুর পরিয়ে পাটেও পরিয়ে দেয় গোলা সিঁদুর। রুদ্রাক্ষ্মের মামলাতেও পড়ে সে সিঁদুরের ফোটা। আর তখনি শিব-দূর্গা সাজা অষ্টক গানের দল গেয়ে ওঠে,
‘শুন সবে মন দিয়ে হইবে শিবের বিয়ে
কৈলাসেতে হবে অধিবাস।
ও তাতে নারদ করে আনাগোনা কৈলাসে বিয়ার ঘটনা
বাজে কাঁসি বাঁশি, মোহন বাঁশরি…’
আমি ঠাকুমার গা ঘেঁষে দাঁড়াই। নীলঠাকুরের পাট থেকে একটু তেল নিয়ে ঠাকুমা আমার মাথায় মুছে দেয়। বেলা ডুবে আসছে। তাঁতমাকুর আওয়াজ থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। সাহাপাড়ার মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসছে। অষ্টক দল গেয়ে চলেছে,
‘আমি দিবো সোনার মুকুট তোর মাথায়
সোনার মল গড়ে দিবো পায়
দুই হাতে দুই কঙ্কণ দিবো
যাতে তোর শোভা হয়…’