লাল রোয়াকের সেই বাড়িটা ছেড়ে চলে এলেও কারণে-অকারণে ঠিকই ডাক আসে সেখানে ফেরার। হোক তা অল্প সময়ের জন্য অথবা লম্বা ছুটির অবসরে।
আর সে সুযোগ আসা মানেই আমার অসংখ্য আবদারের লম্বা তালিকা,
‘মা, এবার কিন্তু শহরে ফেরার সময় মনিপিসিকে সঙ্গে নিয়ে ফিরব।’
অথবা
‘এবার চড়কপূজার মেলা থেকে আমার নতুন খেলনাবাটি কিনতে হবে কিন্তু। ঠাকুমার কিনে দেওয়া মাটির কড়াইটা সেই কবে ভেঙে গেছে!’
আবার কখনো অসম্ভব কিছু চেয়ে সবাইকে বিব্রতও করে দিতাম নিজের অজান্তেই।
‘মা, এবার আমি আর ফিরব না এখানে। এখানকার স্কুল আমার ভাল লাগে না। আমার কোনো খেলার সঙ্গী নেই তো এখানে।’
আসলে ঘুরতে যাওয়া নয়, সুযোগ পেলেই ফিরে যাবার অদম্য ইচ্ছা আমার।
রোজার ছুটিতে বাড়িতে যাবার ফুরসত এল।
যতই আমি ফিরে যেতে চাই না কেন, তা যে অসম্ভব মা ঠিকই জানে। এজন্য আমার কথাতে হুঁ/হ্যাঁ করে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নেওয়ার তাড়া দেয়। আর বাড়িতে ফেরার গোছানো তো আর খুব অল্পতে হয় না, সে এক বিশাল আয়োজন।
আমি নতুন পেন্সিলখানা নিয়ে নিই ইতুর জন্য, অমলদার দোকান থেকে নাবিস্কো বিস্কুটের প্যাকেটের বেঁচে যাওয়া কয়েকখানা বিস্কুট মনিপিসির জন্য, মসজিদের মাঠে কুড়িয়ে পাওয়া কাঁচামিঠে আমটা শুক্লার জন্য আর নতুন লাল চিরুনিটা ঠাকুমার জন্য।
মা যতই বলুক – ‘ওগুলো রেখে দাও, ওদের জন্য বাবা বসাক স্টোরস্ থেকে সবকিছু আজই কিনে আনবে’ – আমি তা শুনলে তো!
সে তো বাবা দেবে, তাই বলে কি আমি ওদের জন্য কিছু নেব না?
আমি শুধু জিনিসই গোছাই না, শহরের কতশত গল্পও মনে মনে গুছিয়ে নিই ওদের বলার জন্য।
আমায় বলতে হবে তালুকদার চাচির মেহেদিরাঙা চুলের গল্প, বলতে হবে মসজিদের বারান্দায় সারাদিন বসে থাকা সাদা চুল আর দাঁড়ির সামাদ দাদুর গল্প। ও হ্যাঁ, আরও বলতে হবে কবিতা আর শিল্পী নামের জমজ ওই দুই আপার কথা, যারা দেখতে হুবহু এক – শুধু পার্থক্য মুখের ভাষায়।
একজনের মুখে সারাদিন কতরকম শব্দ আর আরেকজন শব্দের অভাবে বড্ড শান্ত।
এতসব গল্প যুগিয়ে আমি অধীর হয়ে অপেক্ষায় থাকি কবে আসবে ছুটি।
শীত ফুরিয়ে গেলেও, এখনো বাতাসে রোদের হলকা লাগেনি। প্রতিদিন সকালে স্কুলে যাবার সময় রহিম চাচা তাঁর রিক্সায় আমাকে বসিয়ে দেয় যত্ন করে। এরপর প্রশ্ন করে,
‘মা, যামু?’
আমি রিক্সার হুড শক্ত করে ধরে হ্যাঁ বলতেই রহিম চাচা প্যাডেলে পা চালায়।
সাথে সাথেই বাতাস কেটে এগুতে থাকি আমি। সে বাতাসে গা শিউরে না উঠলেও কোথাও যেন একটু হিম মিশেই থাকে। তবে স্কুল থেকে ফেরার সময় কিন্তু রোদ বেশ তেড়েফুঁড়েই ওঠে। গাছের নতুন পাতাগুলো যেন সেই রোদের তেজে খানিকটা মিইয়ে যায়।
আমাদের ভাড়াবাসার কলঘরটা লম্বাটে উঠোনের শেষ মাথায়। উঠোনে সারাদিনই রোদের আনাগোনা থাকলেও কলঘরটায় সারাসময়ই ছায়া লেপ্টে থাকে। উঁচু মাথার জামরুল আর জামগাছে ঘেরা কলঘরটায় প্রচণ্ড গরমেও স্নান করতে কেমন গা শিনশিন করে। চৌবাচ্চায় ধরে রাখা টাইমকলের জল সবসময়ই খুব ঠান্ডা।
কিন্তু আজ আমার সে জলের দিকে খেয়াল নেই। স্নান করে খেতে না খেতেই বাবা চলে আসবে অফিস থেকে। দুপুর পড়ার আগে বাস ধরতে পারলে বেলা বুজে আসার আগেই আমরা বাড়ি পৌঁছে যাব।
তাই আমি কোনোরকমে চৌবাচ্চা থেকে কয়েক ঘটি জল মাথায় ঢেলে বেরিয়ে আসি। মা বারান্দায় নকশা করা চটের আসন পেতেছে। তার সামনে কাঁসার জলের গ্লাস আর ভাতের থালা। আজ দুপুরের পদে হাঁসের ডিম কষা, আলুর ঝুড়ি ভাজা আর পাঁচফোড়নে লাউঘণ্ট।
পাতের ভাত ফেলেছেড়ে শেষ করি আমি।
এখন কি আমার খাবার সময় আছে? ব্যাগে পেন্সিলখানা, আমটা আর চিরুনিখানা ঠিকঠাক উঠল কিনা দেখতে হবে তো। সেসব খুঁজে দেখতে ব্যাগ খুলতেই চোখে পড়ে ম্যানোলা স্নো, মিল্লাত পাউডার, রবিন লিকুইড ব্লু আর বল সাবান। সাথে বেলা বিস্কুটের প্যাকেট। বাবা সব এনেছে বাড়ির জন্য।
সে সবের ভিড়ে অবশ্য উঁকি দিচ্ছে আমার আধা ফুরানো নাবিস্কো বিস্কুটের প্যাকেট, নতুন পেন্সিলটা আর কাঁচামিঠে আমটাও।
সেসব নিয়ে আমরা যখন বাসে করি ছুটছি বাড়ির দিকে, তখন সূর্য মাঝ-আকাশ থেকে সরে গেছে অনেকটাই। বাস ছুটছে দু’পাশে সদ্য গজিয়ে ওঠা পাটগাছ ভরা মাঠগুলোকে পিছনে রেখে। আর পথের দু’পাশে কিছুসময় পরপরই লাল কৃষ্ণচূড়ায় নিজেকে সাজিয়ে এক ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ডালপালা ছড়ানো গাছ।
তবে সেসবে আমার মন ভরে না। আমি অপেক্ষায় কখন দেখা যাবে সেই প্রাচীন বটগাছটা।
দুপুরের ভাতঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে। সাথে ছুটে চলা বাসের দুলুনি। বাসের খোলা জানালা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে বাতাস।
সেই বাতাসে সুতার রঙের ঘ্রাণ ভেসে আসতেই বুঝি – আর বেশিদূর নয় আমার কাঙ্খিত গন্তব্য। বাস কন্ডাক্টর হাঁকে,
‘তালগাছি, তালগাছি।’
আমার চোখ লেগে আসে। ঘুম ভাঙে মায়ের ডাকে,
‘মনি, ওঠো। আমরা চলে এসেছি।’
হ্যাঁ, তাই তো! ওই তো বটগাছটা। আর ঢালু বাজারের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাড়িতে জায়গির থাকা সঞ্জীবকাকু।
বাজারের ঢালু রাস্তা গিয়ে শেষ হয় রূপবাণী সিনেমা হলের সামনে। এরপর কালিবাড়ির মোড় পেরোলেই দেখা যায় দেবদারু বাগানের মাথা।
এই তো, আরেকটু এগোলেই বাইরবাড়ি।
সেখানে মাড়হীন কাপড়ে ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে ঠাকুমা।
আমি রিক্সা থেকে নেমে ছুটে যাই।
‘ও দিদি, আস্তে আসো, পড়ে যাবে তো।’
তাতে কি আমার ছুটে যাওয়া থামে!
‘ও ঠাকুমা তুমি এখনো গা ধোওনি?’
বিকেলে সবসময়ই ঠাকুমা গা ধুয়ে মাড় দেওয়া টানটান শাড়ি পড়ে। মুখে তিব্বত স্নো মেখে লাল সিঁদুরের টিপ পড়ে কপালে। আজ তো সেসব কিছুই করেনি।
‘আমার দিদিকে দেখব, সেজন্য সেই কোন দুপুর থেকে বাইরবাড়ি দাঁড়িয়ে আছি’।
কথা শেষ করেই ঠাকুমা আমার হাত টেনে ভেতর বাড়িতে নিয়ে গেল। হাতমুখ ধুইয়ে লাল বারান্দায় পিড়িতে বসিয়ে দিল। মনিপিসি নিয়ে এল গন্ধরাজ লেবুপাতা আর গুড় মেশানো যবের ছাতুর শরবত। সঙ্গে খইয়ের বড়া।
মনিপিসির এ’ক’দিনে আরেকটু গিন্নিপনা হয়েছে! আমাকে কেমন বারবার বলছে, ‘এমন শুকিয়ে গেছিস কেন? খাওয়া-দাওয়া কেন ঠিকমত করিস না? কেন চুলগুলো এমন রুক্ষ হয়ে গেছে? মাকে কেন তেল দিতে দিস না?’
কীভাবে বলি, শহরে কোনোকিছু করতেই আমার ভালো লাগে না। মা তো তেল দিয়ে চুল বেঁধে দিতে দিতে ঠাকুমার মতো গল্প শোনায় না, ভাত খাবার সময় কেউ বলে না, ‘গিন্নি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, আজ বিকেলে আইনুল আসবে গুড়ের নই নিয়ে’।
সেসব কথা নিজের মধ্যে রেখেই আমি লাল বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে আসি। ঢেঁকিপাড়টা এ’ ক’দিনে কি আরেকটু উঠোনের এপাশে সরে এসেছে? নাকি বেদানা গাছের একপাশ শুকিয়ে উঠোনটা বড় হয়ে গেছে?
এসব ভাবনা মনে জেঁকে বসার আগেই মনিপিসির ডাক,
‘মনি, বাগানে আয়।’
ঠাকুমা ততক্ষণে রান্নাঘরে চলে গেছে।
আজ বাঘকাকু হাট থেকে অবেলায় ইলিশ নিয়ে এসেছে আমরা আসব বলে। লাউপাতায় ইলিশ ভাপা হবে। বাগানের লাউয়ের মাচা থেকে কচি কয়েকটি লাউপাতা ছিড়ে আনি আমরা।
মা শিলপাটায় কাঁচামরিচ লবণ মিশিয়ে রাইসর্ষে বাটছে।
ঠাকুমার কথায়, ভাপা ইলিশের স্বাদ রাইসর্ষেতে আরোও খোলে।
উনুনে ফুটছে লাল আউশ চালের ভাত। বড় বৌমা মাছটা কেটে ধুয়ে ততক্ষণে ঠাকুমার হাতের কাছে রেখে দিয়েছে।
উঠোনের রোদে পেয়ারা গাছের ছায়া ততক্ষণে ফুরিয়ে গেছে।
লালচে রোদটুকু দেবদারু বাগানের মাথায় একটু জিরিয়ে নিচ্ছে একটু। খানিকপরেই তো সেই রোদটুকু তলিয়ে যাবে দেবদারুর সবুজ বাগানের গহীনে।
লাউপাতার শিরা ফেলে দু’হাতে পাত্রগুলো একটু ঘষে নরম করে নেয় ঠাকুমা। এরপর মিহি করে বাটা রাইসর্ষের ভেতর অল্প একটু হলুদ গুঁড়ো আর অনেকটা সর্ষের তেল মিশিয়ে দেয় ঠাকুমা। তাতে পড়ে লবণ মাখানো ইলিশের পেটিগুলো। ভালো করে মেখে মাছগুলোকে লাউপাতায় মুড়ে দেয় ঠাকুমা। বেঁধে দেয় লাউপাতার লম্বা শাল দিয়েই।
লাল আউশের ভাত প্রায় হয়ে এসেছে। ঢাকনা তুলে আলগোছে ফেলে দেয় মাছের পুটুলিগুলো। খড়ি ঠেলে উনুনের আঁচ বাঁড়ায় ঠাকুমা। কিছুসময় ফুটিয়ে ভাতের হাঁড়ি পেতলের গামলায় উপুড় দেয় মাড় ছেঁকার জন্য।
বেলা ডুবে এসেছে।
ঠাকুমা দেরি করে না। কলঘরে চলে যায়। সন্ধ্যার পূজা শেষ হলেই বড়ঘরের মেঝেতে আজ অনেকদিন পর চায়ের আড্ডা বসবে। চলবে কতশত গল্প। কার বাড়িতে ইনতুল্লাহর বাচ্চা হয়েছে, কোন বাড়ির মেয়ের বিয়ে ঠিক হল, কার বাড়িতে হাঁড়ি ভাগ হল – গল্পের ভাঁড়ারে টান পড়বে না আজ। আর দাদুর রেডিওতে যতই ভয়েস অফ আমেরিকা চলুক না কেন, এর মাঝেই কারণে অকারণে দাদু ডাকবে, ‘গিন্নি ও গিন্নি!’
আর আমি এসবের মাঝেই গা ঘেঁষে বসব ঠাকুমার। হাকিমপুরী জর্দা, সন্ধ্যার ধূপধুনো সবকিছুর ঘ্রাণ সরিয়ে খুঁজে নেব তিব্বত স্নো’র সুবাস।
যে সুবাস আমাকে শহরেও অনেকবার চমকে দেয় ঠাকুমার উপস্থিতির মিথ্যে জানান দিয়ে। আর দু’হাত ঠাকুমার কোলে গুঁজে বায়না ধরব,
‘ও ঠাকুমা এবার কিন্তু আমি তোমার কাছে থেকে যাব’।