রাজ্যের বিধানসভা ভোটকে যদি "গণতন্ত্রের উৎসব" হিসেবে দেখি - নিজে প্রত্যক্ষভাবে তার থেকে দূরে রয়েছি গত কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে। নিজের আত্মীয় পরিজনের সুখ দুঃখ - বিয়ে অন্নপ্রাশন তথা শ্রাদ্ধশান্তি তেও গিয়ে উঠতে পারিনি বেশির ভাগ সময়েই।
তবু সেইসব দিনের কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে নিজের মনোজগতে চাঞ্চল্য ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে দি, অনুষ্ঠানের দিনে সকাল থেকেই সম্ভাব্য পরিবেশকে লালন করি - এখন বোধ হয় এইটা হচ্ছে - মাঝে মাঝেই ফোন করে মিলিয়ে নিই। তারা ফোন কখনো তোলে ব্যস্ততার মধ্যেও - অর্ধেক কথা শোনার আগেই সে ফোন কেটে যায়। তাই বিবরণের অনেকটাই হয়ে ওঠে কল্পনাপ্রসূত।
এবারের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোট এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্য্যপূর্ণ - তাতে সন্দেহ নেই। বাংলার সঙ্গে সম্পর্কহীন মানুষজনও (পড়ুন সর্বভারতীয় মিডিয়া দ্বারা খাওয়ানো) বাংলার ভোটে কী হবে - তাই নিয়ে চিন্তিত, অফিসের দু'একজন প্যান্ট্রিতে দেখা হ'তে জিজ্ঞেসও করেছেন। এর আগে ২০০৪ এর লোকসভা ভোটের আগেও লোকজন পশ্চিমবঙ্গের ভোট নিয়ে কথা বলেছিলেন মনে পড়ছে, সেবার অবশ্য কারণ অন্য ছিল, এখনকার মুখ্যমন্ত্রী তখন এন ডি এ'র শরিক ছিলেন।
এবারের নির্বাচন ঘোষণার সময় থেকেই "দলে থেকে কাজ করতে পারছি না" দের ভিড় লক্ষ্য করেছি - স্রোত রাজ্যের শাসক দল থেকে কেন্দ্রীয় শাসক দলের দিকে - এটা কেন্দ্রাতিগ না কেন্দ্রাভিগ বলের প্রভাবে - তা নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকলেও এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই - এরা প্রত্যেকেই "জন সাধারণের সেবা" র জন্য নিবেদিত প্রাণ বলে দাবি করেছেন, তার জন্য নিজের মন্ত্রীত্ব, দল মায় সংসার অবধি ছাড়তে পিছপা নন। জন সেবা করার মতো এত মানুষ থাকা সত্ত্বেও এ রাজ্য তথা দেশের এই হাল কেন - তা নিয়ে চিন্তিত হ'তে দেখিনি প্রায় কাউকে - এও আশ্চর্য জনক।
আরও একটা বিষয় দেখার মতো, যারা এইভাবে দল বদল করছেন তাদের বেশির ভাগেরই বিরুদ্ধে সংশয়াতীত দুর্নীতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ খুবই সহজলভ্য। গোপন ক্যামেরায় হাত পেতে টাকা নেওয়া, এক লপ্তে নিজের পরিবারের তেরো জনের চাকরি করিয়ে দেওয়া নেতারা বেড়া পেরিয়েই তড়পাচ্ছেন ছেড়ে আসা দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে। আর যে দলে পৌঁছচ্ছেন তারা আবার তড়িঘড়ি নয়া নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে থাকা প্রমাণসমূহ নিজ নিজ দলের ইউটিউব চ্যানেল থেকে মুছে ফেলছেন। এই তৎপরতা দেখে আজ হুতুম বেঁচে থাকলে যে কী লিখতেন তাই ভাবি!
টেলি মিডিয়া এই ভোটযজ্ঞের আরও এক প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী। তাদের অধিকাংশ আবার কেন্দ্রীয় শাসকদলের শাঁসজলে প্রতিপালিত। তাঁরাও অকৃতজ্ঞ নহেন। ভোটের প্রচারে আসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় শাসকদলের প্রধাণের জনসভায় মানুষের ভিড়ের চেয়েও এই সব "সাংবাদিক" এর ভিড় বেশি। অভিযোগ- পাল্টা অভিযোগ, গালাগালি- আরও তীক্ষ্ণ গালিগালাজ তারা সারাক্ষণ দেখিয়ে যাচ্ছেন। যার উদ্দেশ্য পরিষ্কার - বেছে নিতে হ'লে এর মধ্যে যাকে পছন্দ তাকে বেছে নিন। এইবারের নির্বাচন যে আসলে তৃণমূল বনাম বিজেপি - যারা শুধু টিভি দেখেন ও বাংলা "নিরপেক্ষ" সংবাদপত্র পড়েন তারা সবাই একমত হবেন।
বস্তুতপক্ষে এই দুই দলই এক মাঠে খেলছেন। একপক্ষ বলে আসছেন "খেলা হবে" - অন্যপক্ষ তার বিরোধিতায় চটুলতর প্রত্যুত্তরে টোন-টিটকিরি করছেন।
তবুও, টিভি- ও বাংলা নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যম ছাড়াও হাতে থাকে ফেসবুক। ভোট শতাংশের হিসেবে ৭ এ নেমে আসা দলের ছেলে-মেয়েদের দেখি দু'চোখ ভরে। দেখি দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কে ফ্যাসিস্ট আক্রমণে রক্তাক্ত হতে। দেখি বিধায়ক পদে ভোটে হেরে যাওয়া এক বর্ষীয়াণ নেতাকে আমফানের পর কাদামাখা রাস্তায় বাঁধ মেরামতের তদারক করতে। দেখি, আচমকা ডেকে দেওয়া লকডাউনে বিপর্যস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে - ওই দলের লোকজনকেই। তা "শ্রমজীবি ক্যান্টিন" খুলেই হোক বা তাদের প্রত্যক্ষ অর্থ সাহায্য করে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টার মাধ্যমে হোক।
ভোটপর্ব শুরু হতে দেখি তথাকথিত "খেলা" র বাইরে গিয়ে ওই দলের প্রার্থী নির্বাচন হ'ল। বুড়ো হাবড়াদের দল বলে প্রচারিত দলের প্রার্থীদের অনেকেই তাদের ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতা নেত্রী। শিক্ষা, মেধা, সাহস ও তারুণ্যে ভরপুর এক ঝাঁক ছেলে মেয়ে যারা সহজ কথা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করতে পারে। যারা "মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই" বললে একটুও বেমানান লাগে না। স্বচ্ছন্দে এঁরা ভোটের প্রচারে গিয়ে বলতে পারেন - "বাকি যাঁরা দাঁড়িয়েছেন, তারা তো বয়স্ক, তাঁরা ভুল করলে কিছু করতে পারবেন না, আমি ভুল করলে কান মুলে দিতে পারবেন"।
মিডিয়া ন্যারেটিভ শুরু হয়, এই দলের জোটে থাকা ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের (আই এস এফ) বিরুদ্ধে। এ কী অসৈরণ কান্ড বামপন্থী দলের পক্ষে! সোজাসুজি সংখ্যালঘু ভোট পেতে "ওদের" সঙ্গে হাত মেলাতে হচ্ছে? যদিও সেই আই এস এফ এর মুখ বলে পরিচিত ভদ্রলোকটির মাথার টুপি ও ফুরফুরা শরীফের বংশপরিচয়টিই সেই সন্দর্ভের মূল বিষয়। অথচ আব্বাস সিদ্দিকি তার প্রতিটি ভাষণে তুলে ধরেছেন শিক্ষার অধিকারের কথা, কাজের অধিকারের কথা। সেইসব ৩০ / ৪০ মিনিটের ভাষণ আজকের টিভি দেখাবে কেন? তার ভাত-কাপড়ের যোগান দেওয়া রাজনৈতিক দলটির প্রতি নেমকহারামি হবে না? আব্বাস সিদ্দিকিকে টিভিতে ডেকে সাক্ষাতকারের মাধ্যমে অপমানের চেষ্টাও ব্যর্থ হয় তাদের। অথচ সাম্প্রদায়িক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীটার সামনে সেই একই সাক্ষাতকারী এইচ এম ভি বিজ্ঞাপনের সেই প্রভুভক্ত কুকুরটি যেন। যাই হোক এরা "বেইমান" তো নন।
আশার পাল্লা ফের ভারী হয় "নিজেদের মতে গান" শুনে। "তোমার কোনও কোনও কোনও কোনও কোনও কোনও কথা শুনব না আর - নিজেদের মতো ভাবব, আমি অন্য কোথাও যাব না, আমি এই দেশেতেই থাকব"। সেই স্পষ্ট উচ্চারণ, যা বিশ্বাস করাতে বা যাকে "সততার প্রতীক" এ মার্কা দিতে হয় না। এবং বলাই বাহুল্য এবারও এই চমৎকার গানের দলে প্রধাণ কলাকুশলীদের বেশির ভাগই কম বয়সী।
আরও একটা দলকে দেখি "নো ভোট টু বিজেপি" বলে উচ্চকিত হ'তে। বিজেপি কে ভোট দেওয়া অপরাধ - এ আমিও বিশ্বাস করি। তবুও এ ক্যাম্পেনে তাদেরই বেশি চোখে পড়ে যায় যারা রাজ্যের বর্তমান শাসকের ভাতা-প্রধাণ, উৎসব-প্রিয় চেহারার আড়ালে মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্য শিক্ষা ও কাজের অধিকার বিরোধি চরিত্রকে সামনে আনতে চান না। কিন্তু মজাটা হ'ল তারা এটাও জানেন ও মানেন যে মানুষের ভালো করার ইচ্ছা বা চেষ্টা মানুষের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের জন্য তাকে যোগ্য করে তোলার ইচ্ছা বা চেষ্টার সমানুপাতিক। এর ব্যাতিরেকে মানুষের কল্যান সম্পূর্ণ হয় না। তবু তারা বর্তমান শাসকের বিরুদ্ধে যেতে চান না বা যেতে চাইছেন সেটা বোঝাতে চান না বলে "নো ভোট টু বিজেপি" র ছাতায় আসেন বলে মনে হয়। মানুষের সুবিধা অসুবিধা থাকে, বুঝি। সোজাসুজি অসমর্থন করতে বাধা থাকে যখন তা কোনও প্রত্যক্ষ স্বার্থের বিপরীতে যেতে পারে। বুঝি। কিন্তু দিনের শেষে এ দলের সব সদিচ্ছা যেন বিজেপির দেশপ্রেমের বিজ্ঞাপন হয়ে দাঁড়ায় যেখানে "পাকিস্তান মুর্দাবাদ" বলে স্লোগান তোলার প্রতিযোগিতাই মুখ্য।
লাজ লজ্জা ভুলে, ইলেকশন কমিশন কে কিনে নিয়ে তাকে দিয়ে একের পর এক পক্ষপাতদুষ্ট কাজ করিয়ে নিয়ে যাওয়া দেশের শাসক দলটি নিয়ে কোনও কথা বলতে না হলেই ভালো লাগত। আট দফায় নির্বাচন শুধু যাতে দেশের প্রধানমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যের প্রতিটি পাড়ায় ঘুরে বেড়াতে পারেন। যেদিন যেখানে ভোট, তার ঠিক পাশের জেলায় বা পাশের আসনে তার ভোট প্রচারের মিটিং থাকে যা কি না সবকটা টিভি চ্যানেল শুরু থেকে শেষ অবধি প্রচার করে চলে। কেন্দ্রিয় বাহিনি এসে শান্তিপূর্ণ ভোট করাতে গিয়ে চারজন ভোটার কে খুন করে। আরও আশ্চর্যের বিষয় এ হেন অসভ্যতাকেও জাস্টিফাই করা হয়। কেন্দ্রিয় শাসক দলের এক রাজ্যস্তরীয় নেতা তা নিয়ে হুমকি দেন ও তা রাজ্যের অন্যতম প্রধাণ "নিরপেক্ষ" সংবাদ পত্র যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেন। এ ঘটনা যদি সন্ত্রাস ছড়ানো না হয়, তা হলে সন্ত্রাস ছড়ানর সংজ্ঞা কী হবে কেউ বলে দিক।
এই রাজ্যের অন্যতম প্রধান "নিরপেক্ষ" সংবাদ পত্রটি এ হেন সংবাদ পরিবেশনের আগে সলতে পাকিয়ে গিয়েছেন অনেক দিন আগে থেকেই। সাম্প্রদায়িক, চুড়ান্ত পুরুষতান্ত্রিক অসভ্য নেতা নেতৃবৃন্দের পুঙ্ক্ষানুপুঙখ দৈনিক কার্যকলাপ তারা সংবাদপত্র দ্বারা প্রচারিত করে গিয়েছেন। তা ছাড়াও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছেন ঋণে জর্জরিত একঝাঁক সিরিয়াল ও সিনেমার মধ্যমানের তারকারা। যখনই তারা এই দুটি দলের ছাতার তলায় এসেছেন বা দল বদল করেছেন। তাদের পছন্দ অপছন্দ প্রেম বা প্রেমহীনতার সবটুকু গিলিয়ে খাইয়েছেন সংবাদপত্রে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। এর চেয়ে জনকল্যানকারী অন্য কোনও পথ এরা পান নি - বলে বিশ্বাস হয় নি।
ভোট আসে ভোট যায়। আরও দফায় দফায় ভোট আসবে। রাজনীতি আরও কলুষযুক্ত হবে যতদিন রাজনীতি মানে কারা একটু কম মন্দ - তার হিসেব করতে থাকব আমরা। ততদিনে সেই ৭ শতাংশের দল হয়ত আরও কয়েক শতাংশ কমবে বা বাড়বে। কিন্তু আমাকে সবচেয়ে অবাক করে এই দলের, এই ৭ শতাংশের দল কীভাবে এই ঝকঝকে শিক্ষিত, মার্জিত, সহানুভূতি সম্পন্ন যুবক যুবতীদের জন্ম দেয়! কেন আসে এরা? কেন "খেলা" য় পরিণত হওয়া গণতন্ত্রকে যতটুকু পারে জোর দিয়ে ঠিক রাস্তায় ফেরানর চেষ্টা করে? কী পাবে এরা? প্রার্থীর সম্পত্তির হিসেব অনুযায়ী - বেশির ভাগেরই তো কিছুই নেই সে অর্থে।
পদলেহনকারী "নিরপেক্ষ" মিডিয়া, প্রচুর টাকা, প্রচুর মাসল পাওয়ার, সরকারী ক্ষমতা নির্বাচন কমিশন সমেত - এত কিছুর বিরুদ্ধে লড়ে এরা দিনের শেষে কটা ভোট পাবে বা পেয়েছে তা দেখা যাবে ২ রা মে তে। হয়ত কেউই জিতবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না বাংলার মানুষ এদের পাওয়ার মতো যোগ্য না হয়ে ওঠেন।
তবু জানি পরের যে কোনও সংকটের সময় এলে ওই খাপছাড়া ভোট না পাওয়া দলের লোকজনই রাস্তায় থাকবে মানুষের পাশে - কারা তাদের ভোট দিয়েছে বা দেয়নি তার তোয়াক্কা না করে।
কে জানে মানুষের ভালো চাওয়ার সদিচ্ছার নামই হয়ত এখনও বামপন্থা - আমি তো এই অর্ধেক হয়ে যাওয়া ভোটের গতিপ্রকৃতি দেখে এইটুকুই শিখলাম।
আমরা একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রজন্ম। আগামী প্রজন্ম মানবিক হোক, স্বাভাবিক হোক। ফিরে আসুক লাল টুকটুকে দিন
একদম ঠিক কথা