রসুইঘরের রোয়াক ২ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৪৯৩০ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
আজ খুব বেশী রান্না হবে না। দুপুরের খাওয়া সেড়ে আজ মুড়ির ধান বানা হবে যে। আজ বাজারের ব্যাগ নিয়ে কোনো রিক্সাওয়ালাও তাই আসবে না। রান্নাঘরের মাচার নীচে রাখা সবজির ধামার তলানিতে যা আছে তা দিয়েই দুপুরের পর্ব সারা হবে।
ঠাকুমা কালো পাথরের বাটি হাতে বড়ঘরের দিকে যেতেই আমি পিছু পিছু হাঁটা ধরি, ও ঠাকুমা নেলপলিশের রঙটা কত সুন্দর দেখছো? ঠাকুমা পেছনে ফেরে না, ওসব রঙ ভাল না; আমার দিদি তো রঙ ছাড়াই সুন্দর। আমি থেমে যাই। লাল বারান্দায় বসে ভাবি, কাল ফেরিওয়ালা এলে সব ফিরিয়ে দেবো।
রসুইঘরের রোয়াক ৩ - শোলআলুর রসা, শোলমাছ আর শীতের নতুন আলুর রসা : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ০৩ অক্টোবর ২০২০ | ৪৫৮৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
কালিবাড়ির মোড় পেড়িয়ে বাড়ির রাস্তা ধরতেই আমার আবদার, দাদু রঙিন কাঠি লজেন্স নেবো। মোল্লা দাদুর দোকান থেকে আনারস আঁকা কাগজে মোড়ানো কাঠি লজেন্স হাতে নিয়ে দাদুকে পেছনে ফেলে আমি প্রায় দৌড়ে আমাদের তাঁতঘরের সামনে চলে আসি। ততক্ষণে প্রায় ফাঁকা আইনুল চাচার মোষের গাড়ি। দাদুকে রাস্তার কোণায় দেখা যেতেই আমি কাঠি লজেন্স মুখে পুড়ি, দাদু বস্তা আরোও আছে কিন্তু। আমি দাদুর হাত ধরে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই বাড়ির উঠোনে মাষকলাই আর সরিষা গায়ে গা লাগিয়ে পড়ে আছে। আর বাটি ভরা মুড়ি, মুড়কি, গুড় নিয়ে আইনুল চাচা লাল বারান্দায় বসে আছে। ঠাকুমা গ্লাস ভরে চা এনে দিতেই আইনুল চাচার লাল দাঁতগুলো ঝিলিক দেয়, মা একটা পান দিয়েন।
রসুইঘরের রোয়াক ৪ - হাঁসওলের সালুন, ওলকচু দিয়ে হাঁসের মাংসের ঝোল। : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ১০ অক্টোবর ২০২০ | ৫১৫৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ১২
গোলেনুর দাদীর ডাকে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াতেই নাকে ধাক্কা দেয় বেশ অপরিচিত একটি ঘ্রাণ। উনুনের গনগনে আগুনের পাশে গোলেনুর দাদীর ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। কালো লোহাড় কড়াইয়ের বলক আসা জলে ডুমো করা কাটা ওলকচু ফেলেই গোলেনুর দাদী আমার দিকে এগিয়ে আসে। ঠাকুমার জন্য কয়েকটা কাঁচামিঠা আম রাখছি, নিইয়্যা যাস। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে গোলেনুর দাদীর ঘর লাগোয়া আমগাছটার দিকে তাকাই। আমার চোখ আটকে যায় বারান্দায় জলচৌকিতে বসে থাকা মানুষটার সাথে। লম্বা জোব্বা পড়া মানুষটির দাড়িগুলো কী সুন্দর মেহেদী রঙা। লোকটির পাশে বসে সুমী পোড়াদহের গল্প শুনছে, জানো বু' পোড়াদহে কত্ত বড় মেলা হয়? কত্তরকমের মিষ্টি পাওয়া যায়, জানো? সেসব মিষ্টি কত্ত বড় হয় দেখবা? দু'হাত প্রসারিত করে মানুষটি দেখায় মিষ্টির বিশালতা। দাদাজান, পুতুল পাওয়া যায় না? বড়-কনে পুতুল?
রসুইঘরের রোয়াক ৫ - বৌখুদ, ভাঙা চাল বা খুদের পোলাও। : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ১৭ অক্টোবর ২০২০ | ৪৩৮৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
আমি ঝুরিভাজার ঠোঙাটা সেই বারান্দায় রেখেই বাড়ির ভেতরে ঢুকি, ঠাকুমা আমাকে খুঁজছিলে কেন? বাড়ির উঠোনে ক'খানা ধামায় ভরা আধা ভানা ধান। ক'দিন আগেই মাদলা গ্রাম থেকে হিজলদিঘি, কাদম্বিনী আর ঝিঙেশাইল ধান এসেছে। এক রোদ দেওয়া ধানগুলো ঠাকুমা কালথেকেই ঢেঁকিতে ভানছে। আজ শেষবার ধান ঢেঁকির গড়ে পড়বে। চালের গায়ে লেপ্টে থাকা শেষ ধানের পরতটুকু উঠে গেলেই ধবধবে সাদা চাল ঠাকুমার মাটির ডোলে জায়গা করে নেবে। ঢেঁকিতলা পরিষ্কার করতে করতেই ঠাকুমা উত্তর দেয়, সকালের ভাত খেয়েই বেরিয়েছো দিদি; কোথায় ছিলে? আহ্লাদী আসকারার আভাস পেয়ে আমি পায়ে পায়ে ঠাকুমার কাছে যাই, ও ঠাকুমা শংকর জ্যাঠার দোকানে আর কাঠি বিস্কুট আসবে না, জানো?
রসুইঘরের রোয়াক - ৬ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ০৭ নভেম্বর ২০২০ | ৪০২০ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
ঠাকুমাকে পেছনে ফেলে আমি দৌড়ে নামি কাঠের দোতলা থেকে। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সঞ্জীব কাকু। বুকের কাছের আদর্শলিপি ধরে আমাকে ইশারায় ডাকে, কই স্লেট নিয়ে আয়। আমি দৌড়ে গিয়ে দাদুর রেডিও'র পাশ থেকে স্লেট হাতে নিয়েই কাকুর সামনে গিয়ে দাঁড়াই, আমি সব স্বরবর্ণ লিখতে পারলে সন্দেশ বিস্কুট দেবে তো? ঘাড় নেড়ে 'হ্যাঁ' বলে সঞ্জীব কাকু বড়ঘরের মেঝেয় পাটি পাড়ে। সন্দেশ বিস্কুট দেবো, তার আগে সবগুলো স্বরবর্ণ লিখে শুদ্ধ উচ্চারণে আমাকে শোনাতে হবে। আমি দেরী না করে পাটিতে বসেই কালো স্লেট সাদা দাগে ভরিয়ে তুলি। আর মুখে বলি, অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ ৯(লী)। দেখেছো সঞ্জীব কাকু আজ কিন্তু ৯ (লী) লিখতে ভুল করিনি।
রসুইঘরের রোয়াক ৭ - বড়ার পায়েস, কলার বড়া, নারকেল আর কুশরের গুড় দিয়ে ঘন দুধের পায়েস : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ২৮ নভেম্বর ২০২০ | ৪১৬৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭
আমি খেজুর চাচার তাঁতঘর পাড় হয়ে থানার ঘাটের দিকে হাঁটা শুরু করি। তাঁতঘরে একজন দু'জন তাঁতী এরইমধ্যে চলে এসেছে। মাকুরের খটাস খটাস শব্দ সকালের বাতাসে কেমন উদ্দেশ্যহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি মনিপিসির জন্য আর দেরী করি না। দ্রুত হাঁটতে থাকি থানার ঘাটের দিকে, মনিপিসিটা কিচ্ছু বোঝে না। ডলি ফুপুদের বাড়ি থেকে গন্ধরাজ ফুল নিতে হবে তো আমার।
কিন্তু থানা ঘাটের মোড় আসতেই মনিপিসি গলা চড়ায়, মনি ওদিকে না, আগে কলমি ফুল নিয়ে আসি চল্। আমি চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাই। উত্তরে শুধু মনিপিসিকে অনুসরণ করার ইঙ্গিত পাই। আমি পায়ে পায়ে থানা ঘাটের ঠিক পাড়ে এসে দাঁড়াই। ওটা নদী নাকী পুকুর আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
রসুইঘরের রোয়াক ১২ - ইলিশ সুক্তো, রাধুনী আর আদা বাটায় ইলিশের সাদা সবজি ঝোল : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ২৩ জানুয়ারি ২০২১ | ৪১৭৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭
জয়দেব মাঝি আমাকে কোলে নিয়ে নৌকায় বসিয়ে দেয়। দাদু পাশে বসতেই আমি ফিসফিস করে বলি, আমি সবসময় তোমার হাত ধরে থাকবো মাদলা গ্রামে গিয়েও, দেখো তুমি।
পৌষের মরা করতোয়া তখন ঢেউ হারিয়ে নিশ্চুপ। নির্বিকার সে নদীর বুকে বৈঠা আছড়ে পড়লে যেটুকু আলোড়ন উঠছে, তা নিমেষেই কেমন ঝিমিয়ে পড়ছে।
ওপার এখন খুব কাছে চলে এসেছে। অল্পসময় পড়েই ঘাটে লাগে নৌকা। আমি পাড়ে আইনুল চাচা কে দেখে চেঁচিয়ে উঠি, আইনুল চাচা।
ঘাটের পাড় ঘেঁষা জমিতে এখন সবুজ সর্ষে গাছ। গায়ে গা লাগানো গাছগুলো সবুজ চাদরের মতো পড়ে রয়েছে জমির বুকে। ও দাদু, এটা আমাদের জমি? এটা কাদের জমি? কীভাবে বুঝতে পারছো এটা আমাদের জমি না? আমাদের জমি চিনতে পারবে তো?
রসুইঘরের রোয়াক ১৫ - মটরদানার পায়েস, ক্ষীর আর ঝিঙেশাইল আতপের পায়েস : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ০৫ মার্চ ২০২১ | ৩০০৩ বার পঠিত
ঘুমের অতলে হঠাৎ জেগে ওঠে হলুদ আলোর চাঁদ। আমি আর ঠাকুমা সেই আলোয় নিশ্চিন্তিপুরের পথে। ক্ষেতের আইল, নদীর ঘাটে ভাঙা বাড়ি, মরিচের ক্ষেত, আমবাগান সব পেছনে রেখে আমি আর ঠাকুমা ছুটছি। আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি যে! ঠাকুমা আর আমি বারবার একই ক্ষেতের আইলে ঘুরপাক খাচ্ছি। কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে তাঁত মাকুর আওয়াজ। চাঁদের আলোয় আরেক পোচ হলুদ জমলো। বাতাস কেটে ভেসে এলো সুর। বাঁশির সুর।
রসুইঘরের রোয়াক ১৬ - নারিকেল মাখা জালি কুমড়া, নারিকেল আর জালি কুমড়ার ঘণ্ট : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ২০ মার্চ ২০২১ | ৩৫৯০ বার পঠিত
দাদু কয়েকদিন পরেই পাবনা চলে গিয়েছিলো। রূপালী রঙের প্যানাসনিক টেপ রেকর্ডার নিয়ে যখন রিক্সা থেকে বাইরবাড়িতে নেমেছিলো, তখন তাঁতিরা কত খুশি হয়েছিলো আমার মনে নেই। তবে মানিক কাকুর কথাগুলো ঠিক এমন ছিল,
বাবু, এই টেপ রেকর্ডারে সন্ধ্যা মুখোপধ্যায়ের গান বাজলি তো সুচিত্রা সেন সামনে আইস্যা খাড়াইবো।
রসুইঘরের রোয়াক ১৭ - চিতল মাছের রসা, ছোটো আলু দিয়ে চিতল মাছের ঝোল : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ০৩ এপ্রিল ২০২১ | ৩৪৪২ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
—ও ঠাকুমা, নীলঠাকুর কখন যাবে আমাদের বাড়ি?
আমার এই কথা ঠাকুমা পর্যন্ত পৌঁছায় না। ওপাশে রাধারানি সেজে ঋষিপাড়ার পরানকাকা এসে দাঁড়িয়েছে। আর একটু পরেই অস্টকের দল বের হবে।
—ও পরান, দল নিয়ে বেলা পড়লেই চলে এসো আমাদের বাড়িতে।
ঠাকুমা আর দাঁড়ায় না। মন্দিরের মাঠ পেরিয়ে, গোলেনূর দাদির সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাইরবাড়িতে এসে দাঁড়ায়।
আজ দাদু বাজার পাঠিয়েছে তাড়াতাড়ি।
তেলাপোকা : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : ইদের কড়চা | ১৩ মে ২০২১ | ২৪৩০ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
গানটি নবনী ওরফে আয়েশা খুব ভাল গাইতো। আজ বারবার নবনী নামটি এসে টোকা দিচ্ছে হামিদুল সাহেবের মনে। সেই কবে থেকেই তো নামটিকে বনবাস দিয়েছে সে। প্রথম প্রথম 'আয়েশা' নামে অবাক হতো আয়েশা। বলতো, এই নামে কেন ডাকছো, কী হয়েছে তোমার? আর এর সাথেই অসন্তোষের ভাঁজগুলো মুখে ছড়িয়ে জানান দিতো, ভালবাসার সেই 'নবনী' নামটি ছাড়তে নারাজ সে। কিন্তু সে অসন্তোষ খুব বেশীদিন প্রতিরোধ করতে পারেনি। আয়েশা নামের প্রকৃত অর্থের কারিগরি হাজির করে হামিদুল সাহেব বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি এ নামটিকেই ভালবাসতে চান। আর 'নবনী' নামের সাথে সাথেই আয়েশার কাছ থেকে গানও বিদায় নিয়েছে।
রসুইঘরের রোয়াক ২১ - চাল বাঁধাকপি, আতপচাল আর ঘি ফোড়নে বাঁধাকপির ঘন্ট : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : বিবিধ | ০৫ জুন ২০২১ | ৩৬৭১ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭
তবে সবার আগে উনুনে উঠলো জলভরা লোহার কড়াই। এতে বাঁধাকপি ভাপানো হবে। ঠাকুমা খুব ঝুরি করে বাঁধাকপি কাটছে, বাঁধাকপি যত ঝুরি করে কাটা হবে স্বাদ তত খেলবে এর। তবে আমার মনোযোগ বাঁধাকপিতে নেই। সব মনোযোগ ঠাকুমার হাতের শাঁখা-পলা এক অদ্ভুত ছন্দ তুলছে তাতে। ক্রমাগত সে ছন্দ আমার লোভ বাড়িয়ে দিচ্ছে, ও ঠাকুমা, এবার রথের মেলা থেকে আমাকে ঠিক এমন চুড়ি কিনে দিবা?
রসুইঘরের রোয়াক ২২ - কৈ মৌরি, মৌরি আর কাঁচামরিচ বাটায় কৈ মাছ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : বিবিধ | ১৯ জুন ২০২১ | ৩৭৩৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
গোলেনূর দাদির বড়ঘরের বারান্দায় পাটি পড়েছে দুপুরের খানার। হাঁড়ি ভরা ভাত, বাটিতে বাগারের রসুন ভাসা মসুর ডাল আর শাকের ডগা ভাজি। অন্য একটা বাটিতে কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজ। কৈ মৌরি দেখে গোলেনূর দাদির চাপা দীর্ঘশ্বাস, কোহিনূরের আব্বা খুব ভালো খায় কৈ মৌরি। উটকো বাতাসের হিসহিস শব্দ। সাথে একটু একটু মেঘের ডাক। আমরা দাঁড়াই না।কৈ মৌরির থালটা গোলেনূর দাদির হাতে দিয়েই বাড়ির পথ ধরি। পা চালিয়ে ভেতর বাড়িতে চলে আসতেই দাদুর ডাক, গিন্নি তোমার জন্য ওল সেদ্ধ ভাত মাখিয়ে বসে আছি তো।
কাঁচামরিচ ভাতে মাখিয়ে নেবার আগে ওল মাখানো অল্প ভাত দাদু আমার পাতে তুলে দেয়। আমি কাঠের পিঁড়িতে বসে তা মুখে তুলতেই ঝমঝম করে নেমে আসে বৃষ্টি। উঠোনের বুকে জমে থাকা কালো মেঘের ছায়া বৃষ্টি জলে একটু একটু করে মুছে যেতে থাকে। তাঁতঘরে বাঁশির সুর,
রসুইঘরের রোয়াক ২৫ - পুঁই ইলিশ, পুঁইশাক ও ইলিশ মাছের তেলঝোল : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ১২ আগস্ট ২০২১ | ৩০৭১ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
ঠাকুমা কলতলা থেকে এসেই স্টোভের আঁচ বাড়িয়ে দিল। পুঁইয়ের কচি ডগাগুলো হাত দিয়ে ভেঙে নেয় ঠাকুমা। লোহার কড়াইয়ে সেই পুঁইয়ের পাতাডগা, হলুদ, লবণ আর কাঁচামরিচ ফেলে ঠাকুমা তাতে ঢেলে দিল অনেকটা সর্ষের তেল। আলতো নয়, বেশ জোর দিয়েই ঠাকুমা তা মাখাতেই পুঁইয়ের পাতাডগা সব এলিয়ে পড়ল। ঠাকুমা এবার তার উপরে শুইয়ে দিল কতগুলো ইলিশমাছের চাকা। হাত-ধোয়া জল জড়িয়ে গেল মাছগুলোর গায়ে।
শিকার- রূঢ় দৃশ্যকল্প যখন আবেদন সৃষ্টি করে : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | পড়াবই : কাঁটাতার | ২২ আগস্ট ২০২১ | ১৯৬৮ বার পঠিত
বিত্তহীন একটি পরিবারের সবচেয়ে বড় বিত্ত হল আবেগ।
কাঁধ-উঁচো থালাখান, ছিক্ষেত্তরের বাটিখান, তেঁতুলের আচারের ঠিলেডা বা পুরনো একটু ঘি --সবকিছু বস্তায় ভরে নিয়ে গেলেও, ওদের মন-মগজে স্মৃতি জট পাকিয়ে রয়। কী যেন ফেলে যাচ্ছে! পুরুষ-পুরুষের পায়ের ছাপ পড়ে আছে যে বাড়ির আনাচেকানাচে, তার ধুলোটুকুও যেন আগল হয়ে সামনে দাঁড়ায়।....গল্প এগোয়। এগোয় কুঁড়োরামের পরিবার।
রসুইঘরের রোয়াক ২৬ - পাতাবড়া, লাউপাতায় চিংড়ি মাছের বড়া : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ৪২৮০ বার পঠিত | মন্তব্য : ২১
ঠাকুমা আর মানিক কাকুর কথার মাঝেই আমি দেবদারু বাগানের নীচে এসে দাঁড়িয়েছি। হাতে গামছায় বাঁধা খাবার আর গায়ে চাদর জড়িয়ে সাদা কুয়াশার ভেতর ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে তাঁতিরা। সেই ছায়া থেকে আমি খুঁজে খুঁজে বের করি কলিম তাঁতি, মকবুল তাঁতি, পরেশ তাঁতি, নিবারণ তাঁতি, মান্নান ড্রাম মাস্টার সবাইকে।
আজ অন্যদিনের মতো এগিয়ে গিয়ে আমি ওদের সাথে গল্প জুড়ি না। আমি পা বাড়াই গোলেনূর দাদির বাড়ির দিকে। সে বাড়ির উঠোনে এখনো নিঃস্তব্ধতা। শুধু গোলেনূর দাদির বড়ঘরের টিনের বেড়ায় ঝুলানো কবুতরের খোপ থেকে ভেসে আসছে ডানা ঝাপটানোর শব্দ।
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ১ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ২১ এপ্রিল ২০২২ | ৩০১৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ১০
এখন কি আমার খাবার সময় আছে? ব্যাগে পেন্সিলখানা, আমটা আর চিরুনিখানা ঠিকঠাক উঠল কিনা দেখতে হবে তো। সেসব খুঁজে দেখতে ব্যাগ খুলতেই চোখে পড়ে ম্যানোলা স্নো, মিল্লাত পাউডার, রবিন লিকুইড ব্লু আর বল সাবান। সাথে বেলা বিস্কুটের প্যাকেট। বাবা সব এনেছে বাড়ির জন্য।
সে সবের ভিড়ে অবশ্য উঁকি দিচ্ছে আমার আধা ফুরানো নাবিস্কো বিস্কুটের প্যাকেট, নতুন পেন্সিলটা আর কাঁচামিঠে আমটাও।
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ২ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ০৫ মে ২০২২ | ২৫১৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
আজ ঠাকুমার একাদশী। এসব দিন ঠাকুমা আগবেলা নির্জলা থাকে। বারবেলায় সব কাজ সেরে স্নান করে ঠাকুরঘরে গোবিন্দকে সাবুর ফলার সাজিয়ে তারপর নিজে খায়। তবে আজ ঠাকুরঘরে সব নেবার আগে আলাদা পাথর বাটিতে দুধে ভেজানো সাবু, কোরা নারকেল, ক্ষীরের সন্দেশ, একটা বারোমাসি আম আর আমাদের গাছের চন্দন কবরী কলা আলাদা করে সরিয়ে রাখে ঠাকুমা,
“কোহিনূরদের বাড়িতে দিয়ে আসিস।”
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ৩ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ১৯ মে ২০২২ | ২৮২১ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭
“ও মনি, শহরে কিরাম করে থাকিস তুই? ঠাকুমা ছাড়া দিন কাটাতি কষ্ট হয় নারে?”, কড়াইয়ের ফুটন্ত জলে কুমড়ো শাক ছেড়ে দিতে দিতে বলল গোলেনূর দাদি। গরম জলে শাক পড়তেই সবুজ রঙ আরও গাঢ় হয়। শাকের সেই রঙের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে বলি,
“দিন তো কাটে গোলেনূর দাদি, কিন্তু রাতে ঠাকুমার কোল ঘেঁষে ঘুমাতে পারি না বলে ঘুমের ভেতর স্বপ্নে বারবার কেঁদে উঠি।”
তবে সেসব কথা লুকিয়ে আমি একমনে গোলেনূর দাদির উনুনে ভাপানো গাঢ় সবুজ শাকের দিকে তাকিয়ে থাকি।
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ৪ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ০২ জুন ২০২২ | ২৪৯৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
ভোরের আজানের শব্দে ঠাকুমার ঘুম ভাঙলে ফুরিয়ে যায় আমারও ঘুম। আর আজ তো ঘুম ভাঙার অজুহাত আছেই, “ও ঠাকুমা, আমার হাতটা ধুয়ে দেবে একটু? দেখো মেহেন্দি শুকিয়ে সারা বিছানায় গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়েছে”।
ঠাকুমার সাথে আমিও নেমে আসি উঠোনে। বরইগাছের মাথা ছুঁয়ে থাকা আকাশটাই আলো ফুটছে একটু একটু করে। সেই আলো মিশে যাচ্ছে শ্বেতকাঞ্চনের ঝাড়ে। চারপাশের নীরবতার সাথে তাল মিলিয়ে ফিসফিস করে উঠি, “ও ঠাকুমা, পূজার ফুল তুলবে না আজ?”
কলঘর থেকে একঘটি জল এনে ঠাকুমা ঢেলে দেয় আমার হাতে। ঠাকুমার আঁচলে ভেজা হাত মুছি আমি। আবছা অন্ধকারে তাকাই আমার হাতের দিকে। মেহেন্দি আঁকা চাঁদটা কেমন জ্বলজ্বল করছে।
ঠাকুমা বারান্দায় রাখা ফুলের সাজি শ্বেতকাঞ্চনে ভরে দেয়। সেখান থেকে কয়েকটা ফুল মুঠোয় করে নাকের কাছে আনতেই ফুলের ঘ্রাণ ছাপিয়ে নাকে এসে ধাক্কা দেয় মেহেন্দির ঘ্রাণ। আমি ঠাকুমার দিকে তাকাই, “ও ঠাকুমা, আজ ঈদ”।
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ৫ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ২৩ জুন ২০২২ | ২৪২৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
আমলাপাড়ার নিরিবিলি বাসাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আমার বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে। আমি ফিসফিস করে বলি, “ও মনিপিসি, বাবার শহরের চাকরি কবে ফুরাবে?”
মনিপিসি কি একটু হেসে উঠল? অন্ধকারে তা ঠাওরে উঠতে পারলাম মা। তবে আমার কাছে আরেকটু সরে এসে মনিপিসি বলল, “এই শহরের পর আরোও বড় শহর, তারপর আরোও বড় শহরে যেতে হবে তোকে। তোকে অনেক বড় হতে হবে মনি”।
মনিপিসির স্বরে কিছু একটা আছে। উত্তর খুঁজে পাইনা আমি। মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করি, “বড় হলে কি আর নিজের বাড়ি, নিজের জায়গাতে আর ফেরা যায় না?”
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ৬ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ০৭ জুলাই ২০২২ | ২৪৫২ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭
শহরে আমাদের দু’কামরার বাড়িটাকে মা-বাবা বাসা বলে। হ্যাঁ তাই তো, চিলতে উঠোনের নিরিবিলি ছোট্ট এই বাড়িটা কীভাবে আমাদের বাড়ি হবে? বাইরবাড়ি নেই, দুপুরের ভাতঘুম ফাঁকি দিয়ে জেঠি ঠাকুমাদের আড্ডা নেই, আমার খেলার কোনো সঙ্গী নেই আর নেই কোনো হৈ-হুল্লোড়। তাঁতঘর থেকে তাঁতিদের গানের মত ভেসে আসা সুর দূরে থাক, এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে একটু আধটু কারো কথার আওয়াজও পাওয়া যায় না।
আর তা যাবেই বা কী করে? এখানে সব বাড়িই প্রাচীর ঘেরা যে।
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ৮ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ১১ আগস্ট ২০২২ | ২০৩৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
ভাদুড়ি বাড়ির বৌ নাকি লেবু গাছগুলো নিজে হাতে লাগিয়েছিল। তাই এই বাগানের লেবুগুলো বড়দাদি পাড়ার সবাইকে বিলিয়ে দেন,
“খুব রসালো এই লেবু আর ঘ্রাণ, হাতে বারপাঁচেক ধোওয়ার পরেও থেকে যায়। ভাদুদি কত শখ করেই না লাগিয়েছিল। মানুষটা প্রাণভরে গাছের ফলগুলো খেতেও পারল না”
বড়দাদির দীর্ঘশ্বাসে কী থাকে তা না বুঝলেও, ভাদুদি যে বড়দাদির খুব আপন কেউ – তা বুঝতে আমার সময় লাগে না মোটেও। না হলে ভাদুড়ি বাড়ির বাগানের সব ফল শুধু পাড়ায় বিলিয়েই ক্ষান্ত হন বড়দাদি, একটা ফলও নিজের বাড়িতে নেন না,
“ওসব ফল আমার গলা দিয়ে নামবে না। ভাদুদি কখনও ফিরলে দু’জনে একসাথে খাব।”
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ৯ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ২৫ আগস্ট ২০২২ | ২৪২৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
এরপর তাড়াতাড়ি বারবেলা আসার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে আমি ঢুকে পড়লাম স্কুলের গণ্ডিতে। ঊষাদি, মঞ্জুদি, অশোকাদি, আল্পনা-আপা, নুরজাহান-আপা – যত না পড়া ধরে, তারচেয়ে বেশি গল্প করে। কার বাসা গতবছরের বন্যায় ডুবে গিয়েছিল, কে যুদ্ধের বছরে শরণার্থী হয়ে ক্যাম্পে গিয়েছিল, কার বাড়ির আতা গাছে ফল ধরেছে — সে সব গল্পে গল্পে যতটুকু পড়া বাদ পড়ে, তার সবটুকুই ষোলোআনায় পুষিয়ে দেয় দীপঙ্কর স্যার। কড়া ধাঁচের ছোটখাটো মানুষটি শুধু স্কুলে পড়িয়েই ক্ষান্ত হয় না, প্রতিদিন বিকেলে বাসাতেও যায় আমাকে পড়াতে।
কিন্তু আজ বিকেলে আমি কী ভাবে দীপঙ্কর স্যারের কাছে পড়ব? আমি মনে মনে পণ করে ফেলি, স্যার যতই বকা দিক, আজ আমি ছুটি নেবই নেব।
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ১৪ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ২৪ নভেম্বর ২০২২ | ১৭৩১ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
ঠাকুমা কচুপাতা নেবার আগে এ-গাছ ও-গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিচ্ছে। ঠাকুমার বাগানে মাচা ভরা ঝিঙে ধুন্দল ঝুলছে। আর শিউলি গাছ বেয়ে উঠে গেছে পুঁইয়ের লতা। তবে এসবে আমার মন বসে না। আমি শ্বেতকাঞ্চনের ঝাড় ঘেঁষে দাঁড়ালাম। মাটি থেকে দেবদারুর ফল কুড়িয়ে পুকুরের জলে ছুঁড়ে মারলাম। পড়ন্ত আগবেলায় রোদের তাপে ঝিমিয়ে থাকা পুকুরটায় ঢেউ উঠল, কোণায় কোণায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ মাথা তোলা হেলেঞ্চা শাকগুলো নড়েচড়ে উঠলো। আর ঠিক তখনি তাঁতঘর ঘেঁষা নিমগাছটা থেকে ডেকে উঠল কুটুম পাখি,
কুটুম আসুক, কুটুম আসুক…
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ১৭ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৬৬৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
আজ আকাশের গায়ে অন্ধকার একটুও বসতে পারছে না। সুপারি বাগানের মাথায় বসে থাকা চাঁদটা এরইমধ্যে আরোও বড় হয়ে উঠেছে। সেই চাঁদের আলো সন্ধ্যা আকাশের গা থেকে ঠিকড়ে পড়ছে আমাদের উঠোনে। উঠোনে এবার পাঁচ প্রদীপ জ্বলে উঠল। কলার মাইজে একমুঠো ধান, একগোছা দূর্বা আর ক’খানা কড়ি রাখল ঠাকুমা। আর কলার খোলে পড়ল তালের ক্ষীর, তালের ফুলুরি, তিলের ক্ষিরশা আর পাতাপোড়া পিঠা।
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ১৮ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৬২১ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
সারাদিনের মধ্যে এই ফুলতোলার সময়টুকুতেই তো ঠাকুমাকে আমি আমার মতো করে পাই। এ-কথা ও-কথায় আমরা দু-জনকে বারবার জানাই—আর কেউ না, তুমিই আমার সব আবদারের জায়গা। তবে শহরে যাবার পর অবশ্য ঠাকুমার আবদার আমার থেকেও বেড়ে গেছে। ফুলের সাজি হাতে বাইরবাড়িতে যেতে যেতেই ঠাকুমার আবদার,
ও দিদি, এবার বার্ষিক পরীক্ষায় খুব ভালো করতে হবে কিন্তু তোমার। শহরে বাবা নিয়ে গেছে তো ভালো করে পড়াতে। বাবার কথা মানতে হবে দিদি।
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ১৯ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ০৯ মার্চ ২০২৩ | ১২৮২ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
সারাদিনে এই একটা সময় যখন ঠাকুমার ডাকে আমার সারা দিতে ইচ্ছা হয় না। এই সময়ে ঠাকুমাও খুব কঠোর। আমার সকল অনিচ্ছাকে অবহেলা করে নির্দ্বিধায় আমার হাতে ধরিয়ে দেয় পেতলের ছোট গ্লাসে শেফালি পাতার রস আর চিরতার রস। চোখ ভরা অভিমান আর নি:শ্বাস আটকে আমি শেষ করি সেই তিতকুটে রস। ফাঁকা গ্লাস ঠাকুমার হাতে পৌঁছে যেতেই আমি আবার ফিরে পাই আমার সেই ঠাকুমাকে, যে ঠাকুমা কারণে অকারণে আমার হাত ভরে দেয় আনন্দ আর আস্বাদে,
- ও ঠাকুমা, কোথায় পেলে রাঘবসই? দাদু এনেছে?
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ২০ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ৩০ মার্চ ২০২৩ | ১৩১৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
বিপদ নয় তো আমার ভয় ফুরিয়ে আসা দিনে, তরতর করে এগিয়ে আসা ফিরে যাবার দিনে। তাই নবমী ফুরিয়ে দশমীর সকাল আসতেই আমার চোখে কষ্ট জমে জল হয় বারবার। আর আমার সে কষ্টকে বুঝেই ঢাকেও সুর ওঠে,
ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন…
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ২১ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ১১ মে ২০২৩ | ১৩৯৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
ঠাকুমা তো জানে না—এগিয়ে চলা প্রতিটি মুহূর্ত আমার বুকের ভেতর দামামা বাজাচ্ছে। বুঝতে পারছি সব আকুতি বিফল হয়ে আমাদের আরেকটু পরেই শহরে ফিরে যেতে হবে। এমন সময়গুলোতে আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না। এসব সময়ে আমি শুধু দেখি আমার বাড়িটাকে, দেখি বাড়ির মানুষগুলোকে, এমনকি উঠোনে দুলতে থাকা গাছের ছায়াগুলোকেও। শহরের বাসায় রোদতপ্ত নিরিবিলি দুপুরে মা যখন ভাতঘুম দেয়, তখন নির্ঘুম আমি মায়ের পাশে শুয়ে এসব আবার দেখি খোলা চোখের অন্দর পেরিয়ে বুকের কোঠর থেকে।
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ২৪ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ০৭ জুলাই ২০২৩ | ১৫৩২ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ফুরিয়ে গেছে অগ্রহায়ণের নগরকীর্তনও। তবে বাড়ি ফেরার কড়ে গোনা দিন এখনো শেষ হয়নি আমার। ক-দিন আগেই পিয়ন চাচা লাল ঝুলি থেকে দিয়ে গেছে চিঠি। পোস্টকার্ডে লেখা চিঠি। গোটা শব্দের সে চিঠিতে যতটুকু বাড়ি আর নিজের কথা লেখা তারচেয়ে অনেক বেশি লেখা আমার কথা। কেমন হল আমার পরীক্ষা, কতটুকু বড় হলাম আমি, এখনো পাতের খাবার না ফুরাবার অজুহাত খুঁজি কিনা, বাড়ির কথা মনে করে মনমরা হয়ে থাকি কিনা—কতশত প্রশ্ন! সেই পোস্টকার্ড আমি বারবার পড়ি, অনেকবার পড়ি। বিছানার তোষকের তলা থেকে সুযোগ পেলেই বের করে সামনে ধরি সেই পোস্টকার্ড,
মা… ও মা…. ঠাকুমা আর কী লিখেছে? বাইরবাড়ির অর্জুন গাছে ফল এসেছে এবার? গোলেনূর দাদীর তেজপাতা গাছে নতুন পাতা এল? এবার কি পাটাই ব্রত করবে ঠাকুমা?
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ২৬ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১২৮৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
বারান্দায় আজ পাত পড়েছে আমার একার। আর উঠোনে বসেছে মুসা। আমার পাতে আউশের লাল ভাত, উচ্ছেপাতার বড়া আর কাজলি মাছের আদাঝোল। আমার অনিহায় আড়ি দিতে মা নিজেই ক’দিন হলো খাইয়ে দেয় আমাকে। আজও তার ব্যত্যয় হল না। লালভাতে উচ্ছেপাতার বড়া মেখে আমার মুখের সামনে ধরতেই নাকে ধাক্কা দিল উচ্ছেপাতার তিতকুটে ঘ্রাণ। ভাতের গ্রাসটুকু মুখে পুরতেই সোঁদা একটা স্বাদ ছড়িয়ে গেল মুখে,
ও মা, আরেকটু বড়া ভেঙে দাও…
রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় ভাগ) - ৩০ : স্মৃতি ভদ্র
বুলবুলভাজা | খ্যাঁটন : খানা জানা-অজানা | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১০৭৯ বার পঠিত
আসলে তাঁতমাকুর খটাস খটাস শব্দহীন এই পাড়া সত্যিই খুব বেমানান। তাঁতমাকু থেমে যাওয়া মানেই তো সবকিছু থেমে যাওয়া নয়, তাই তো কদিন পরেই শূন্য তাঁতঘরে নতুন দোকানঘর হবে। সেখানে থাকবে নাবিস্কো বিস্কুট, ঝুরি ভাজা, কাঠি লজেন্স, গন্ধ সাবান আরও কত কী! শুধু থাকবে না নিথর দুপুরে তাঁতঘর থেকে ভেসে আসা পুরোনো কোনো গানের সুর অথবা বিরান বিকেলে ভেসে আসা বাঁশির কান্না,
বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে
মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে…