একেকবার মনে হয়, এ জীবন বৃথা গেল! কোথাও তো সেভাবে প্রমাণ করা হল না; সেভাবে নিজেকে দেখাতেও পারলাম না কোথাও। একের পর এক মরীচিকার পেছন ছুটতে ছুটতে পৌঁছে দেখি জল নেই; জীবন অজুহাত মাত্র। আর তার কাছে বসে আছে ক্লান্তি, হতাশা। পথের ফাঁদে এসে জুটেছে এক মাস্তুল ভাঙা নৌকো। দিশাভাবে ঘুরতে ঘুরতে একটা মানুষ কী করে! কীভাবে নিজেকে গুছিয়ে রাখে কাঠের শো-কেসে! আজকাল তাই বোধহয় কেউ এতটা ভাবেনা। যেন গভীরভাবে ভাবতে গেলেই উঠে আসবে জিয়ল মাছ। পাঁকে মেশা। দুর্গন্ধ। আর তাকে কিছুতেই মারা যাবে না! যেন এই পাঁকের ভেতর বাঁচতে বাঁচতে নিজেকে জিয়ল মাছ করে তোলা প্রতি মুহূর্তে। তাতেও শান্তি নেই। স্বস্তি নেই। ঠিক ওই জামশেদপুর সাকচি মার্কেটে ঘুরে বেড়ানো ভিখেরিদের মতো। জানে ভবিষ্যৎ নেই কোনও। জানে, এই নরক যন্ত্রণার চেয়ে মৃত্যু ভালো। কিন্তু তাও তাদের কোলের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে তিন চারটে শিশু। ধূলিধূসর। যে মা এই সব জন্মকে ডেকে আনছে সে কী জীবনকে ভালোবেসে? নাকি অজান্তে? নাকি নিজের জীবনের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণস্পৃহা তাকে আরও জন্মের দিকে ঠেলে দিচ্ছে! ভাবলেই শিউরে উঠি। ভাবলেই কেমন একটা রি রি করে ওঠে শরীর! আর তখনই হতাশায় দীর্ণ হয়ে পড়ি। নিজেই নিজের কাছে উঁপুড় হয়ে থাকি। সাত্ত্বনা খুঁজি। যেন আলো নেই, পথ নেই। সব সব মিথ্যে, সব ভুল। মুছে দিতে ইচ্ছে করে প্রতিটি মুহূর্তকে। তখনই রবি ঠাকুর এসে হাত ধরেন। আলো দিয়ে বলেন ---
" বসিয়া আছ কেন আপন-মনে,
স্বার্থনিমগন কী কারণে?
চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি,
ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি
প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে।"
আলো, আনন্দ, প্রেম কই সেভাবে তো ছুঁয়ে গেল না করতল! সেভাবে একটা কোনও সীমারেখা হয়ে উঠল না আমার দেশ। কোথাও ইচ্ছেমতো বাঁচতে চাওয়া হলো না। তবে এত না এর মধ্যে একটা সমাজ কাকে চাইবে! কাকে দেবে তার আয়ের শতাংশ! চারপাশে ছড়িয়ে আছে অধিকার। অধিকার আর অধিকার। যে তোমাকে কেড়ে নিতে শেখাবে, যে শেখাবে হত্যা, রক্ত আর বিরাট একটা অধঃপতন। মানসিক এবং মানবিক কোনও ভাবালুতা তার কাছে বোকামি মাত্র। এইযে দেশ ছেড়ে যারা বসবাস গড়ে তুলেছিল অন্য একটা সীমারেখায়। যারা সেই সীমারেখাটিকে ভালোবেসেছিল, নিজের ঘর বেঁধেছিল, জন্ম দিয়েছিল জন্মকে--- সামান্য নথিপত্র তাদের উদবাঞ্ছিত করে দেবে! নিয়ম হয়ত তাই। কিন্তু... কিন্তু... এই কষ্ট বোঝাই কাকে!
আর তখনই পথ বেজে ওঠে। তখনই চিৎকার করে ওঠে দিন কাল সময়---
"কার পাপ আমাদের রক্তের ভিতরে;
কার অন্ধকার?
কণ্ঠস্বর
ভেসে আসে, 'জোর যার'...
মানুষ কি এখনও তোমার
চোখ-রাঙানো প্রেমের চাকর?
অথচ কোথায় যাব? এ পৃথিবী আমার, তোমারও!
'মারো! যত পারো!'
(অন্ধ পৃথিবী / বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)