২.
" পথের হাওয়ায় কী সুর বাজে
বাজে আমার বুকের মাঝে
বাজে বেদনায়..."
রাস্তার ওপর উত্তপ্ত পিচ। তাপমাত্রা প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। খালি পায়ে হাঁটলে ফোসকা পড়ে যাবেই। এখন যদিও কেউ হাঁটে না। কিন্তু সাকচি অটোস্ট্যান্ডে কিছু অপরিষ্কার, ছেঁড়া জামা, খয়েরি চুল, হাতে, নাকে মুখে কালো কালো ছোপমার্কা অসহায় কিছু বালক বালিকার দিকে তাকিয়ে সহ্যশক্তি কল্পনা করি। অটো ঢোকা মাত্রই কোথা থেকে যে পঙ্গপালের মত ছুটে আসে! জুতো নাই, জামা নেই... খাবার নেই, জল নেই... ঘর নেই... মা- বাবা আছে হয়ত কারো কারো। একটাকা, দু'টাকা পাওয়ার আশায় ছুটছে... ছুটছে... জীবনযুদ্ধে...
আমি সেই পেতে ধরা ক্ষুদ্র হাতটির রেখা দেখি। ভাগ্যের চক্র মেনে, মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করি রাজচক্রবর্তী যোগের। তারপর ' অচ্ছে দিনে'র কল্পনা করতে করতে সানগ্লাস ঠিক করে নিই। দ্রুত হাঁটি। সাকচির এই অটোস্ট্যান্ড আমাকে দ্রুতগামী জীব বানিয়ে ফেলে। যেন একটা জলজ্যান্ত জীবনের আয়না তুলে ধরে আমার সামনে। আর তখন স্ট্যান্ড এ লাগানো নব্বই ইঞ্চির বিরাট টিভিতে আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি,আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী কোটি টাকা দামের স্যুট পরে চিৎকার করে বলেন..." মিত্রোঁঁ..."
"নতুন সংবিধানের সাহায্যে ভারতকে স্বাধীন করা, ক্ষুধার্ত দেশবাসীর মুখে অন্ন তুলে জোগানো, নির্বস্ত্র মানুষের জন্য বস্ত্রের সংস্থান এবং প্রত্যেক ভারত কবাসীকে নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী নিজেকে বিকশিত করার পূর্ণ সুযোগ দেওয়া।"
নিজের মনেই বিড়বিড় করতে করতে রাস্তা পার হই। তীব্র হর্ন কান ঝাঁঝরা করে দেয়। আর দেশের প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো হারিয়ে যায় জনস্রোতের বিপুল উচ্ছ্বাসে। বাচ্চাটি তখন অন্য কারো কাছে হাত পেতে দাঁড়িয়েছে। হয়ত একটা বিকশিত দেশের দৃশ্য। এই পথ আমাকে লজ্জা দেয়। এই পথ আমাকে দৃষ্টিহীন, দৃশ্যহীন করে তোলে। আমি বধির হয়ে চোখে এঁটে নিই কালো চশমা। তারপর পথ পা বাড়াই। পেছনে পড়ে থাকে মূঢ় অহং, লজ্জা, ঘৃণা...
সমগ্রের এই পথে হাঁটতে হাঁটতে সমগ্র এক দৃশ্য এসে জড়ো হয় চোখের সামনে। মানগো চকে বিএমডব্লিউ এর কাছে জীর্ণ সাইকেল দাঁড়িয়ে থাকে। দেখি, শীতলা মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে যৌন সেবিকা। কেন? শুধু ক্ষুধা! শুধু জীবনকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার পীড়িত সত্ত্বা। এই ক্ষুধার পথে দেশ কী! রাজনীতি কী!
আসলে এই দেশের পথ নেই... রাস্তা নেই। আর্থিক বৈষম্য, অসাম্য এবং অনায্যতার বিরুদ্ধে যে ডাক উঠেছিল -- সে ডাক হারিয়ে গেছে পথভ্রষ্ট হয়ে। তবে? এখন আমরা মেতে উঠেছি রঙে... ঝাঁ চকচকে রাস্তার ধারে জারুল, কৃষ্ণচূড়া, সাদা নাইটকুইন--- অসংখ্য রঙের ছড়াছড়ি। আর আছে চির বৈরাগ্যের, চির সন্ন্যাসীর রঙ! যে রঙ আমাদের মাতৃঘাতক করে তুলেছে...