নিভাদেবী বললেন, “তোর যতো সব উদ্ভট চিন্তা। ওসব ভেবে আর হবেটা কি? আজ সারা উত্তর ভারত হাইওয়ে দিয়ে ঘুরে আয় – ছোট বড়ো ঢাবায় সর্বত্র – বাইরে টিনের বোর্ডে লেখা থাকে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার। তার মানে কথাগুলো শুধু বাংলা নয় সর্বত্র চালু হয়ে গেছে”।
“তা হয়েছে, মানছি। কিন্তু তার আগে কী বলা হত? দিদু জানো?”
ফল্গুর দিদিমা নাতনি আর মেয়ের কথা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলেন। নাতনির প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হেসে বললেন, “বলতো বই কি। সকালের খাওয়াকে বলত জলখাবার। দুপুরের খাওয়াকে বলত ভাত খাওয়া। আর রাত্রের খাওয়াটাকে রাতের খাবারই বলত। তবে সত্যি বলতে ওরকম পোশাকি মানে তোদের ভাষায় ফর্মাল নাম সত্যিই ছিল না। ওই যে তুই বললি না, মধ্যবিত্ত গিন্নিরা ছেলেমেয়েদের খেতে ডাকতেন, খ্যাঁদা, পল্টু মুড়ি বেড়েছি খাবি আয়। অথবা ছাতু মেখেছি খাবি আয়। দুপুরে ডাকতেন, ভাত বেড়েছি, খাবি আয়। কোন কোন উগ্রচণ্ডী মায়েরা রেগে গেলে বলতেন, “ভাত বেড়ে দিয়েছি, গিলে আমায় উদ্ধার করো”। আবার মায়েদের মুখে শুনেছি, স্বদেশী করা ছেলেদের মায়েরা ভাতের হাঁড়ি কোলে সারারাত জেগে অপেক্ষা করতেন। লাঞ্চ, ডিনার তো দূরের কথা – মধ্যাহ্ন-আহার কিংবা নৈশ-ভোজন এসব কথাও কাউকে কোনদিন বলতে শুনিনি – পড়েছি সাহিত্য-উপন্যাসে। ইংরিজিতে শিক্ষিত সাহিত্যিকরা বাংলা উপন্যাস লিখতে গিয়ে লাঞ্চ বা ডিনারের সমার্থক শব্দ বানিয়েছিলেন তৎসম শব্দ ধার করে।
তার ওপর ধর, তখন তো আর ঘরেঘরে বা হাতেহাতে ঘড়ি ঘুরত না। লোকে এই খাবারের নামে সময়ও বুঝে যেত। যেমন ধর আমাদের ছোটকা কোথাও যাবে, মাকে বলল, “এই তো জলখাবার খেয়ে বেরোব, বাড়ি ফিরে ভাত খাবো”। সকলেই বুঝে গেল – ছোটকা সকাল সাড়ে আটটা-নটা নাগাদ বেরিয়ে, দুপুর দেড়টা-দুটো নাগাদ ফিরবে। ঘড়ির দরকারই হত না।
আসলে সে সব দিনে আমাদের বাঙালী ঘরের প্রধান শস্যই ছিল ধান। তার থেকেই তৈরি হত, ভাতের চাল, মুড়ি, খই, চিঁড়ে। ছোলা বা যব গুঁড়ো করে ছাতু। ছোটবেলায় দুধ আর গুড় দিয়ে মাখা যবের ছাতু, আমরা কম খেয়েছি? বেশ আনন্দ করেই খেয়েছি”।
ফল্গু উজ্জ্বল মুখে বললে, “বাঃ বেশ বললে তো, দিদু”।
“বেশ কি বললাম জানি না, বাপু। আজকাল শহরে দেখেছি শনিবার রাত্রে ডিনার করতে করতে লোকে পরের দিন ব্রেকফাস্টে কী খাবে তার প্ল্যান করে। ছেলে বলে সাউথ ইন্ডিয়ান খাবো। মেয়ে বলে চিজ স্যাণ্ডুইচ। বাবা বলে লুচি-আলু চচ্চড়ি। মা বলে ছোলে বাটুরা। সকালে মুখ ধুয়ে ছেলে বা মেয়ে বসে পড়ে ফোন নিয়ে – সবার মনোমতো খাবারের অর্ডার দিয়ে দেয়। আধঘন্টার মধ্যে ঘরে পৌঁছে যায় গরমাগরম খাবার। ব্রেকফাস্ট। আমাদের সময় এমন কল্পনা করতে পারলে, আমাদের নাম আজ জুলে ভার্ন বা এইচ জি ওয়েল্সের মতো স্মরণীয় হয়ে থাকত”।
ব্রেকফাস্ট সাঙ্গ করে ফল্গু আর নিভাদেবী কফির আর দিদু ব্রজবালা চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। ফল্গুর কৌতূহল শেষ হয়নি, সে বলল, “আমাদের স্কুল লাইফ পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল রবি ঠাকুর ছাড়া বাংলা ভাষায় আর কেউ গান লেখেননি। বাংলা ভাষায় তার আগে যা কিছু লেখা হয়েছে – কবিতা কিংবা গদ্য -গল্প, উপন্যাস”।
নিভাদেবী বিরক্ত হলেন খুব, “কি যাতা বলছিস? নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদের গান শুনিসনি?”
ফল্গু এতটুকুও বিচলিত না হয়ে বলল, “কোথায় শুনব, বলো। আমাদের স্কুলের যে কোন অনুষ্ঠানে, পাড়ার যে কোন ফাংশানে সর্বত্র শুনেছি রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাড়িতেও তুমি কিংবা বাবা গান চালাতে – বাংলা মানেই রবীন্দ্র সঙ্গীত – হেমন্ত, সুচিত্রা, কণিকা, দেবব্রত, সাগর, ঋতু। তাছাড়া বাবা কিশোরের আর লতার হিন্দি গান শুনতে পছন্দ করতেন। এ ছাড়া আমাদের গান শোনার কোন উপায় ছিল? ও হ্যাঁ আরেকজনের গান শুনতাম, পাড়ায় কালীপুজোর সময় – পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীত। আমার ধারণা ছিল, গানগুলি ওঁরই রচনা। বাংলা নিয়ে পড়াশুনো করতে গিয়ে দেখলাম, ওরেব্বাবা, বাংলা গানের অথৈ ভাণ্ডার। আমাদেরকে সে সব শুনতেই দেওয়া হয় না। সে সব গানের এখনও চর্চা হয়, কিন্তু রবি ঠাকুরের ভারে সবাই চ্যাপ্টা হয়ে গেছে”।
ব্রজবালা বললেন, “আমার জন্ম স্বাধীনতার ন-বছর আগে। ছোটবেলায় রবিঠাকুরের গান যে শুনিনি তা নয়। তবে সে সব অধিকাংশই দেশাত্মবোধক – বাংলার মাটি, আমার সোনার বাংলা, সঙ্কোচের বিহ্বলতা, আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে। নজরুলের গানও খুব শুনেছি, কারার ওই লৌহ কপাট, দুর্গম গিরি কান্তার। সে সব গাইত আমাদের স্কুলের দাদা-দিদি, কিংবা মাস্টারমশাইরা। অর্থাৎ শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবি না, আমাদের কান জুড়িয়ে দিত চারণকবিদের গান। তাঁদের মধ্যে সবার সেরা ছিলেন মুকুন্দ দাস। সকলে বলত চারণ কবি মুকুন্দ। আহা সে কী গান – গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। ভয় কী মরণে, রাখিতে সন্তানে। আরেকটা গান ছিল, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। সে গান মা, কাকিমা, ঠাকুরমাদের কানে গেলেই দেখতাম মন দিয়ে শুনতেন, তাঁদের চোখ জলে ভরে উঠত। বড়ো হয়ে, তখন ভারত স্বাধীন হয়ে গেছে, আমিও সে গান শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলেছি কতবার। আমি তো মুকুন্দ দাসের কণ্ঠে এ গান শুনিনি, শুনেছি আমাদের গ্রামে আসা গীতজীবীদের কণ্ঠে”।
নিভা অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালেন, ফল্গু জিজ্ঞাসা করল, “গীতজীবী মানে?”
ব্রজবালা লাজুক হেসে বললেন, “ভিক্ষার জন্যে কেউ কেউ গান গায়, সে গানে আন্তরিকতা থাকে না, এবং সে গানের মর্যাদাও সে বুঝতে পারে না। তার আসল লক্ষ্য ভিক্ষা, ভিক্ষা পেলেই গান থামিয়ে পাশের বাড়ি বা পাশের পাড়ায় হাঁটা দেয়। বাড়ির লোকজনও দেখতাম তাদের ভিক্ষে দিয়ে বিদায় করতে পারলে যেন বেঁচে যায়। অন্যদিকে কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁরা বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালে বাড়িতে সারা পড়ে যেত। ঠাকুমাকে বলতে শুনেছি, “অ কেষ্ট, অনেকদিন পর এদিকে এলি, বাবা। খপর সব ভালো তো”। আজ্ঞে খপর ভালই মা ঠাকরোন, এদিকে ছিলম না, গেছলাম ঘোষপাড়ার মেলায়। তাই ক’মাস এদিকে...”। “তা বেশ, একটু বস বাবা, জলখাবার খেয়ে একটু জিরিয়ে নে। হাতের কাজ সেরে গান শুনবো তোর। তা সেই কৃষ্ণপদও নিশ্চিন্তে জলখাবার খেয়ে ছায়ায় বসে টুংটাং করে তার একতারার তার বাঁধত।
দুপুরের রান্নাবান্না-ঘরের কাজ শেষ হলে ঠাকুমা হাঁক পাড়তেন, কই রে কোথায় গেলি সব। সবাই এসে বসলে কৃষ্ণপদ সকলকে প্রণাম জানিয়ে গান ধরত। তার গলা পঙ্কজ মল্লিক, কে এল সায়গল জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত, মান্না, কিশোরের মতো মেজে-ঘষে পোষ মানানো গলা নয়। গ্রীষ্মের দাহে দগ্ধ হতে থাকা ফুটিফাটা মাঠের মতো উদ্ধত। শরতের শস্য-ভরা ক্ষেতের গন্ধমাখা স্বপ্নময়। হেমন্তের হিমঝরা সন্ধ্যার মতো বিষণ্ণ-বিধুর। উদাত্ত, ব্যাপ্ত সেই কণ্ঠ নিমেষে আমাদের বেঁধে ফেলতে পারত, কথা আর সুরের নিবিড় বন্ধনে। বৈঠকখানা ঘরে বসে দাদু এবং তাঁর প্রতিবেশী বন্ধুরা হুঁকোয় টান দিতে ভুলে যেতেন।
পরপর চার-পাঁচখানা গান শুনে ঠাকুমা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বিরতি ঘোষণা করতেন। বলতেন, “এখন থাক বাবা। বেলা হল। পুকুরে ডুব দিয়ে এসে দুটি ভাত মুখে দিয়ে একটু গড়িয়ে নে। রোদের তাপটা পড়লে বাড়ি যাস”।
সেই কৃষ্ণপদ বিকেলের দিকে আরও কখানা গান শুনিয়ে, যখন বাড়ি ফিরত, মায়েরা তার ঝোলায় সিধে ভরে দিত। চাল, ডাল, কিছু আনাজ, তেল, নুন, মশলা। আমাদের দাদু দিতেন নগদ দুটাকা কিংবা তিনটাকা। এই রকম গুণী মানুষদেরই আমি বলি গীতজীবী। গানই ছিল তাঁদের জীবিকা, কিন্তু সেটাকে কেউ ভিক্ষা বলে মনে করত না। সাধারণ মানুষের মন জয় করেই তাঁরা জীবিকা অর্জন করতেন। শুধু কৃষ্ণপদ নয়, আরো অনেকে আসতেন – নাকে-কপালে আঁকা চন্দনের তিলক, গায়ে নামাবলি। তাঁরা গাইতেন – রাধা ও কৃষ্ণের রাসলীলা, মাথুর, মানভঞ্জন…সে সব গানও ছিল অপূর্ব। আমরাও হাঁ করে শুনতাম – আর বড়োরা তো আনন্দে দুঃখে কেঁদে তাঁদের শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ফেলতেন”।
ব্রজবালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর আবার বললেন, “তোদের তো দোষ নেই দিদিভাই, দোষ তো আমাদের । মাতৃভাষা মায়ের দুধের মতো – এ কথাটা আমাদের মনে আসে একমাত্রে ভাষা দিবসে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এখন আমাদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে মায়ের দুধ ছাড়িয়ে বাচ্চাদের কত দ্রুত সেরেল্যাক খাওয়ানো যায়। ভাষার ক্ষেত্রেও এই সেরেল্যাক আমাদের সেরে দিয়েছে – দেশি ডাল-ভাত-শাকসব্জি-মাছ-মাংস ভুলে আমরা বেড়ে উঠছি ইংরিজি আর মুম্বাইয়ান হিন্দিতে...। দুঃখ করে লাভ কি? বাংলা ভাষা এখন ভেসে চলেছে বেনো জলে – তাকে ফিরিয়ে আনবে ভবিষ্যতের কোন বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-শরৎ-রবিঠাকুর – কে জানে?
(চলবে...)