" জানি জানি তুমি এসেছ এ পথে মনের ভুলে
তাই হোক তবে তাই হোক, দ্বার দিলেম খুলে"...
গান নিয়ে বসে আছি। বহুদিন পরে আঙুলের স্পর্শ নেচে উঠছে সুরে। জৈষ্ঠের রঙে আজ আবীর। চারপাশে বয়ে যাচ্ছে সোঁদা গন্ধ। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে শহরের ঘাম। গাছের নিবিড় গন্ধ ঢুকে পড়ছে কর্পোরেট দুনিয়ার লোহার গ্রিলে... আর এই ইস্পাতের শহর খিলখিল, খিলখিল করে হাসছে।
--তীব্র আনন্দ মানুষকে কী দেয়?
--চোখের জল!
--আর?
--হতাশা মণ্ডিত অতীতের স্মৃতি!
--আর?
--সমস্ত দুঃখের দিন ভেসে ওঠে...
আর তখনই গানের ভুবন থেকে বেজে ওঠে " আমায় শূন্য করে দাও গো"...
গানের মধ্যে সুরের মধ্যে আপনভোলা পথ আছে... এক নিবিড় যাপন আছে... সেই পথ তোমাকে হাঁটতে শেখাবে কান্নার আওয়াজে, সুখের স্রোতে আর তুমি ভাসতে ভাসতে, ঘুরতে ঘুরতে জড়িয়ে পড়বে এক আশ্চর্য সুরমণ্ডলীর মধ্যে। রাগের ভেতর সাপের মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঢেলে দেবে সুরের বিষ। তৃষ্ণার্ত পথিক সেই আঁচলা ভরে পান করে নেবে মৃত শহরের সমস্ত ঝরে যাওয়া শোক। দুঃখ। অভিমান। তখনই নিজেকে ঈশ্বর মনে হয়। সমস্ত না-পারার খেদ ধুয়ে মুছে চোখের জলে ভেসে ভেসে সুবর্ণরেখায় মেশে। আর সেই গভীর ধ্যান পথ হয়ে ওঠে লাল বিপ্লবের। চারপাশে ছড়ানো ছিটানো মোরামের কাঁকর। খালি পা জ্বালা করে। পিচপিচ করে রক্তের স্রোত ছুটে... গানের মত? জ্বলেপুড়ে মরা শহর, বস্তির কুটিল সাম্রাজ্য তোমাকে সুবিধাভোগীর হাত থেকে বাঁচাবে! কক্ষনো না!
আর তখনই রহস্যময়ী, সন্ধানী সে সুর ভেসে আসবে সুদূর মঙ্গল গ্রহ থেকে, যে সুর ভেসে উঠছে ব্ল্যাক হোলের অসীম সাহস ভেঙে... যে সুর নির্জন পাইন বন ফিসফিস করে, ধর্ষিতা রমণীর মত পথ ছেড়ে দিয়েছিল, ওভারলোড বুলডোজারকে!
অথচ, এই সুরের পথে তুমি কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছ না। কিছুতেই নিবিড় করে স্পর্শ করা যাচ্ছে না তাঁর শরীর, তাঁর কথা, তাঁর ধ্বনি। দূরে বাঁশি বাজছে, দূরের স্রোতে বাজছে মুরজমুরলী... আর কীর্তন করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছে রাধানাম... কাঁদছে... কাঁদছে... ভেসে যাচ্ছে আমার বালিকা চণ্ডীমণ্ডপ... সহজ চোখ আর দৃশ্য... আর সেই প্রথম আমি মুগ্ধ হচ্ছি রাধায়... অন্তরাত্মায় বাজছেন কৃষ্ণ... অন্ধকার আরও অন্ধকার... দয়াল ওগো! আমাকে হত্যা করো।
তারপর শুরু হয় জার্নি... সুদীর্ঘ জার্নি। হাঁটতে হাঁটতে ন্যাশানাল হাইওয়ে এসে পড়ে...গাড়ির মধ্যে বাজতে থাকে ব্লুজ...কাজের মধ্যে এসে পড়ে বিষন্নতা আর আমি শ্রমিক হয়ে উঠি। এই জনপদ আমাকে তুলে দেয় কাস্তে, কুঠার। পাথর ভাঙার কাজ। রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে ফাঁকা থালা বাটি ঝনঝন করে ওঠে। মৃত ভেবে ভারী বুট ঘষটে ঘষটে টেনে নিয়ে যায় পথের ঝুপড়িতে... দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে গন্ধ ভেসে ওঠে পোকাধরা চালের... আর তখনই বেজে ওঠে ব্লুজ... পথ কথা বলে ওঠে। প্রকৃতিও কথা বলে। ভাষা হয়ে ওঠে দৃশ্য। আর সুর এসে স্নান করায় তাদের।