বঙ্গদেশে সুধীসমাজে একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে। ন্যাকা - বোকা - বিজ্ঞ - সাহসী - ভীতু - রোমান্টিক - শুষ্কং-কাষ্ঠং - কর্মবীর - বিনদাস - রসিক - বেরসিক - উদার - সংকীর্ণ - অনসূয়া - পরশ্রীকাতর - উদ্ধত - বিনীত - শালীন - অশালীন … ইত্যাদি - প্রভৃতি … যত ধরণের চরিত্রের বাঙ্গালীই হোক না কেন - জীবনের বিভিন্ন পর্বে, অবস্থায়, ঋতুতে তাদের নানা মনোভাব অতীতের এক শ্মশ্রুগুম্ফময়, দীর্ঘদেহী, আপাদলম্বিত আলখাল্লা পরা, নিয়মিত নিমের শরবৎ পান করা, ঋষিপ্রতিম মানুষের গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস বা নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে।
লেখক শংকর তাই বলেছেন - “রবীন্দ্রনাথের গানেই তো আমাদের মুক্তি। কালের ওপার থেকে বেদ উপনিষদের যে শব্দ ধ্বনিত হয় সে তো কোন সুদূর প্রান্তের বাণী, সংস্কৃতের প্রায়ান্ধকার অরণ্যের মধ্যে সে যে সম্পূর্ণ ধরা দেয় না। তাকে ভালবাসার আগেই আগাম বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ! দুঃখী বাঙালীর ক্ষুদ্র গৃহকোণে অমৃতপুত্র তুমি, বিধাতার কোন ইচ্ছা পূরণের জন্য আবির্ভূত হলে? তোমার গানেই যে আমাদের আনন্দ, আমাদের মুক্তি, আমাদের নিশিযাপন। তুমি আমাদের প্রেমে, বিরহে, মিলনে, বিচ্ছেদে, আনন্দে, বেদনায়, অপমানে, অবহেলায় সদাসঙ্গী।” রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এইভাবেই দেখেছেন শংকর।
৪২% প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে ৬৩ শীত পার করেও আমার লেখ্যভঙ্গিতে লঘু রম্যরসময়তার প্রবণতা গেল না। অথচ ঐ রস উচ্চমার্গীয় আঙ্গিকে পেশ করার যোগ্যতাও নেই। তাই ওসব ধ্রুপদী পাঠকের ঋদ্ধরুচির উপযোগী নয়। ফলে তাঁদের রুচিশীল মন্তব্যে শালীন বিশেষণে অল্পাধিক উষ্মা, বিরক্তির প্রকাশ হয়ে পড়ে - যেমন “ঘাসবিচালি টাইপ রসিকতা”। তাতে অবশ্য আমি বিশেষ বিচলিত হই না। বিড়ম্বিতবোধও করি না। বরং তা নিয়েও আবার “খেলো টাইপস” রসিকতা করে ফেলি - এই যেমন এখন করছি।
আমি লজ্জার মস্তক ভোজন করা, দুকান কাটা বিকর্ণ। তাই আমার মনে পড়ে শোলের দুহাত কাটা ঠাকুরসাহেবের মোক্ষম সংলাপ - “লোহে লোহে কো কাটতা হ্যায়।” মনে পড়ে সেই প্রাজ্ঞ ঋষির কথাও - মনে গুনগন করে ওঠে "এই ছড়াটি মনে রেখো…"
কোন ছড়াটি? ভূমিকা। কবে লেখা? এই ভবলোক ত্যাগ করার তিন বছর আগে - সাতাত্তর বছর বয়সে! যে বয়সে মানুষটি আইনস্টাইনের সাথে - বস্তুর অস্তিত্ব শুধুমাত্র মানুষের চেতনায় - এহেন ভাববাদীমার্গে গভীর তত্ত্বালোচনা করেছেন, যা তিনবার পড়েও আমার মাথার তিন হাত ওপর দিয়ে চলে গেছে, সেই তিনিই লিখে গেছেন এমন ছড়া! ভাবা যায় !!!
জমিদার বংশের "বাড়ি থেকে পালানো" এক চরিত্রের যাপনেও পাওয়া যায় আশ্চর্য উদাসীন সরলতা। তাঁর নিরাড়ম্বর জীবন যাপনে তিনিও এক ঋষিপ্রতিম মানুষ। তাই তিনি সহাস্যে বলতে পারেন - "মুক্তারামের তক্তারামে শুক্তারামে" - দিব্যি কেটে যাচ্ছে। কেউ - "কেমন আছেন?" জানতে চাইলেই বলতেন, "বেশ আছি"। মৃত্যুশয্যায় হাসপাতালেও ফাইনালি চলে যাওয়ার আগে তাইই বলে গেলেন -"বেশ আছি"।
দারিদ্র্য সত্ত্বেও কারুর কাছে তিনি হাত পাতার মানুষ নন। প্রায়ই কফিহাউসে এক কোনে চুপ করে কিছুক্ষণ এককাপ কফি নিয়ে বসে থাকতেন। খাবার কেনার পয়সা নেই। অক্সফোর্ডের ডক্টরেট, পরবর্তীতে ওখানেই ভারতীয় সভ্যতা ও ইতিহাসের অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী তখন যুবক। স্কটিশের ছাত্র। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন কফিহাউসে। নামে দুই ভগবান সত্ত্বেও দরিদ্র লেখককে একা এক কাপ কফি নিয়ে বসে থাকতে দেখে তাঁরা কয়েকজন কাছে গিয়ে পালা করে প্রায়ই তাঁকে কিছু খাবার কিনে দিতেন।
লেখক সংকোচের সাথে একদিন বলেন, তোমরা এভাবে রোজ রোজ আমায় খাওয়াও, আমার খারাপ লাগে, আমি তো তোমাদের কিছু খাওয়াতে পারি না। তপনরা বলেন, আপনি আপনার লেখার মাধ্যমে আমাদের কতো আনন্দ দেন। তার তো প্রতিদান হয় না। তবে আপনাকে সামান্য কিছু খাইয়ে যদি আমাদের আনন্দ হয়, অনুগ্ৰহ করে তার জন্য কিছু মনে করবেন না। আশা করবো সেই আনন্দ থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে কফিহাউসে আসা বন্ধ করবেন না।
তপনদের থেকে দু দশকেরও বেশী অগ্ৰজ লেখক ওদের কথা শুনে আবেগবিহ্বল হয়ে পড়েন। এটা লিখতে গিয়ে আমিও হয়ে পড়লাম। কারণ এমন সহবৎবোধ এখন ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। গুরুর মতো ওপেন ফোরামে এখন মতের, পছন্দের অমিল হলে ক্রুদ্ধ, অশ্লীলতার প্রকাশই প্রত্যাশিত।
রবীন্দ্রনাথের হাজির জবাব রসিকতার অর্থাৎ “Ready Wit” এর কিছু নমুনা জানা ছিল। জালসাগরে জানা গেল Ready Wit শব্দবন্ধটি এ্যারিস্টটলের মস্তিষ্কপ্রসূত যার রাণীর ভাষ্যে নির্গলিতার্থ হচ্ছে the type of instant jokes laced with truth, intelligence and keen understanding of human nature. রবীন্দ্রনাথের হাজির জবাবের তিনটি নমুনা এখানে রাখছি:
১. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বানান সংস্কার কমিটি পুরনো রীতির বদলে নতুন বানানরীতি চালু করতে গিয়ে ‘গরু’ বানান নিয়ে সমস্যায় পড়ে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে নিরীহ প্রাণীটি অনেকদিন ধরেই নানা সমস্যার মূলে - বানান - মেরুকরণ - নির্বাচন ..। কমিটির মত ‘গরু’ না লিখে ‘গোরু’ লেখা উচিত। কারণ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃতের ‘গো’ শব্দ থেকে। আদিতে ‘ও’ কার থাকায় চলিত বাংলায় ‘গোরু’ উচিত। কিন্তু প্রায় সব বাংলাভাষী লেখক, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক গরু লেখেন। কী করা যায়! কমিটির সিদ্ধান্ত হলো, এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের মত নেয়া দরকার। দেখা যাক, উনি কী বলেন।
বোঝো কাণ্ড! যে লোকটা ফর্মালি স্কুল কলেজে পড়াশোনাই করেননি তাঁর সাথে শলা করতে শান্তিনিকেতনে চললো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার কমিটি যার প্রধান ছিলেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়!
কবিকে তাঁরা আগমনের হেতু জানিয়ে বললেন, এ বিষয়ে আমরা আপনার মত জানতে এসেছি। রবীন্দ্রনাথ মৃদু হেসে বললেন, 'তা তোমাদের ও-কার দিয়ে গরু লেখার ব্যাপারে অন্তত একটা সুবিধাই হবে যে, আমাদের দেশের জীর্ণকায় হাড় জিরজিরে গরুগুলোকে অন্ততঃ কাগজে কলমে একটু মোটা দেখাবে!'
২. একবার এক ভদ্রলোক রবীন্দ্রনাথের কাছে কলম ধার চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এই কবিতার দ্বিতীয় লাইনটা জানেন? প্রথম লাইনটা হচ্ছে ‘সকল পক্ষী মৎস্য ভক্ষী, মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী'।
রবীন্দ্রনাথ কলমটা দিয়ে বললেন, 'নিশ্চয়ই জানি। লাইন দুটো দাঁড়াল এ রকম :
‘সকল পক্ষী মৎস্য ভক্ষী,
মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী।
সবাই কলম ধার চেয়ে নেয়,
আমিই শুধু কলম কিনি!'
৩. জীবনের শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথ একটু সামনের দিকে ঝুঁকে উবু হয়ে লিখতেন। একদিন তাঁকে ওভাবে উবু হয়ে লিখতে দেখে তাঁর এক শুভাকাঙ্ক্ষী বলল, ‘আপনার নিশ্চয় ওভাবে উপুড় হয়ে লিখতে কষ্ট হচ্ছে। বাজারে এখন এ রকম অনেক চেয়ার আছে যেগুলোতে আপনি হেলান দিয়ে বেশ আয়েশের সঙ্গে লিখতে পারেন। ওরকম একটা আনিয়ে নিলেই তো পারেন।’ লোকটির দিকে একটু তাকিয়ে থেকে রবীন্দ্রনাথ জবাব দিলেন, ‘তা তো পারি। তবে কি জানো, এখন উপুড় হয়ে না লিখলে কি আর লেখা বেরোয়! পাত্রের জল কমে তলায় ঠেকলে একটু উপুড় তো করতেই হয়।’
বার্ধক্যেও আমার স্বভাবে, লেখনীতে কৈশরের হালকা চাপল্য, প্রাকযৌবনের মেদুর লঘুতা হয়তো চলতেই থাকবে। হয়তো প্রাজ্ঞতার অভাবে গাম্ভীর্যের আলখাল্লা এ জীবনে আর আমার মননে চাপবে না। কেউ যখন তাচ্ছিল্য করবে আমার মনে গুনগুন করবে - "আমার রম্য রসের ধারা, বহিছে, মোর লেখাতে … তাতে হোক না ওরা দিশেহারা, আমার…।"
ভূমিকা
ধূমকেতু মাঝে মাঝে হাসির ঝাঁটায়
দ্যুলোক ঝাঁটিয়ে নিয়ে কৌতুক পাঠায়
বিস্মিত সূর্যের সভা ত্বরিতে পারায়ে--
পরিহাসচ্ছটা ফেলে সুদূরে হারায়ে,
সৌর বিদূষক পায় ছুটি।
আমার জীবনকক্ষে জানি না কী হেতু,
মাঝে মাঝে এসে পড়ে খ্যাপা ধূমকেতু--
তুচ্ছ প্রলাপের পুচ্ছ শূন্যে দেয় মেলি,
ক্ষণতরে কৌতুকের ছেলেখেলা খেলি
নেড়ে দেয় গম্ভীরের ঝুঁটি।
এ জগৎ মাঝে মাঝে কোন্ অবকাশে
কখনো বা মৃদুস্মিত কভু উচ্চহাসে
হেসে ওঠে, দেখা যায় আলোকে ঝলকে--
তারা কেহ ধ্রুব নয়, পলকে পলকে
চিহ্ন তার নিয়ে যায় মুছে।
তিমির-আসনে যবে ধ্যানমগ্ন রাতি
উল্কাবরিষনকর্তা করে মাতামাতি--
দুই হাতে মুঠা মুঠা কৌতুকের কণা
ছড়ায় হরির লুঠ, নাহি যায় গনা,
প্রহর-কয়েক যায় ঘুচে।
অনেক অদ্ভুত আছে এ বিশ্বসৃষ্টিতে,
বিধাতার স্নেহ তাহে সহাস্য দৃষ্টিতে।
তেমনি হালকা হাসি দেবতার দানে
রয়েছে খচিত হয়ে আমার সম্মানে--
মূল্য তার মনে মনে জানি।
এত বুড়ো কোনোকালে হব নাকো আমি
হাসি-তামাশারে যবে কব ছ্যাব্লামি।
এ নিয়ে প্রবীণ যদি করে রাগারাগি
বিধাতার সাথে তারে করি ভাগাভাগি
হাসিতে হাসিতে লব মানি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(শ্যামলী, শান্তিনিকেতন, পৌষ, ১৩৪৫)
চারিপাশে দেখি বহু রাশভারী মুখ
রসেবসে রয়ে আমি পাই বেশ সুখ হেজুবুড়ো - ২৫.৫.২৪
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।