হুজুগের ফিকির
দেখতে দেখতে এসে গেল বৈশাখ। ওড়িশার সুন্দরগড়ে গ্ৰীষ্মকালে গরম ভালোই পড়ে। তবে অনেক প্রাচীন বড় বড় গাছপালা ও ফাঁকা জায়গা থাকায় সৌমেনদের এলাকায় তখনো বিশেষ গরম লাগে না। পঁচিশে বৈশাখের তখনও এক হপ্তা বাকি, এক রবিবার সন্ধ্যায় সৌমেনদের বাড়িতে তাসের আড্ডায় সুদীপ প্রস্তাব দেয়, 'চলুন বৌদি, আমরা এ বছর রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করি।'
কবিতা আবৃত্তি, গীতিনাট্য, রবীন্দ্রসংগীত ইত্যাদিতে রমেনের বিশেষ আগ্ৰহ নেই। তবে সুন্দরগড়ের মতো শান্ত জায়গায়, নিস্তরঙ্গ জীবনে একটু আনন্দ উচ্ছ্বাস করার হুজুগের গন্ধ পেয়ে রমেনও বলে, 'হ্যাঁ, হ্যাঁ, বেশ হবে। তাহলে আপনাদের ছাদেই হোক। আপনাদের বাড়িটা একানে, ছাদটাও বেশ বড়। কিছু লোকজন, বাচ্ছাদের জমায়েতে হৈচৈ হবেই, তবে আপনাদের বাড়িওয়ালাও বাঙ্গালী, মনে হয় আপত্তি করবেন না। তাহলে ছাদে লাইটিং করার দায়িত্ব আমার।'
মৌমিতা হাসে, 'তোমরা বাড়ির কর্তার মত না নিয়ে নিজেরাই সব ঠিক করে ফেললে যে। এই যে কর্তামশাই, আপনি কিছু বলুন।'
সুদীপ হেসে বলে, 'সৌমেনদা আবার কী বলবেন? আমরা কী ভুলে গেছি কদিন আগে দোলের দিন কী হোলো। রঙ না মাখানোর খুব শর্ত টর্ত করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সৌমেনদাই তো দেবীবৌদিকে কষে রঙ মাখিয়ে দিলো মাথায় ঝড়াস করে ঢেলে এক বালতি জল। এবারও হয়তো প্রথমে না, না, করে পরে দেখবো ওনারই উৎসাহ সব থেকে বেশি।'
সৌমেন মুচকি মুচকি হাসে। ভুল বলেনি ছোঁড়া। বলে, 'তা বেশ তো, হোক না। তবে রবীন্দ্রজয়ন্তী শুনলেই আমার মৌয়ের ঠাকুর্দার ঘটনাটা মনে পড়ে।'
যাকগে চলবে
শুনেই মৌমিতা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছে। গল্পের গন্ধ পেয়ে সুদীপ, রমেন দুজনেই উদগ্ৰীব। চারজনে তাস খেলা হচ্ছিল শোয়ার ঘরে বড় খাটে বসে। রমেন হাতের তাস বিছানায় উল্টে রেখে ওর পেটেন্ট 'ওওও মুখার্জীদাআআআ' আওয়াজ ছেড়ে বলে, 'কী রকম, কীরকম। বলুন তো শুনি।'
সৌমেন বলে, 'শিবপুরে মৌয়ের ঠাকুর্দার চেম্বারের সামনে ছিল একটা মাঝারি সাইজের খেলার মাঠ। ছিল মানে, এখনও সে মাঠ আছে। কেবল ঠাকুর্দা মারা যেতে সে চেম্বার উঠে গেছে। ঐ মাঠটা ছিল একটা শরিকী জমি। বেদখল হয়ে বারোয়ারী হয়ে গেছে। ওখানেই হয় শিবপুর সার্বজনীন দুর্গোৎসব। ছেলেরা বিকেলে ফুটবল পেটায়। স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলন হয়, এইসব হয় ওখানে। একবার তোমাদের মতো ওখানকার কয়েকটি কিশোরের মাথায় এসেছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী করার। সেই মতো বেদী করা হয়েছে। নির্দিষ্ট দিন সকালে ফুল, মালা, ধূপ সব হাজির। কেবল কবিগুরুর ফটো নিয়ে যার আসার কথা, সেই বেপাত্তা।"
সুদীপ বলে ফ্যালে, 'যাঃ, তারপর?'
- ঠাকুর্দার চেম্বারের বাইরে অপেক্ষারত পেশেন্টের জন্য কক্ষে গুটিকয় চেয়ার ও একপাশে বড় একটা বেঞ্চ পাতা ছিল। কারুর শরীর খারাপ লাগলে শুয়ে পড়ার জন্য। তার ওপরে দেয়ালে সার দিয়ে টাঙানো ছিল কয়েকজন মনীষীর ছবি। নেতাজী, গান্ধীজী, বিবেকানন্দ ইত্যাদি। পাড়ার একটি কিশোর এসে বলে, 'জেঠু একটা ফটো নিয়ে যাচ্ছি। একটু বাদে ফেরৎ দিয়ে যাবো।' চেনা ছেলে, তাই রোগী দেখার মাঝে ঠাকুর্দা অন্যমনস্ক হয়ে বলেন, 'ঠিক আছে নিয়ে যা, দেখিস, পাড়তে গিয়ে ফেলে ভাঙিস না যেন।'
রমেন বলে, 'ছেলেটা স্মার্ট আছে বলতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যান বি ছকে ফেলেছে।'
সৌমেন গম্ভীর মুখে বলছে কিন্তু মৌমিতা থেকে থেকে হেসে ফেলছে বলে ওরা কিঞ্চিৎ দিশেহারা। এতে হাসির কী হোলো! মৌ রমেনকে বলে, 'শেষ অবধি শোনোই না কী হয়।'
সৌমেন বলে, 'ঘন্টা দুয়েক বাদে, তখন কোনো পেশেন্ট নেই, ঠাকুর্দা একটু আড়মোড়া ভাঙতে চেম্বার ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেখলেন ঐ ছেলেটা ফটোটা ফেরৎ দিতে আসছে। ডাক্তারীর ব্যস্ততায় ওনার মনেই ছিল না সেদিন রবীন্দ্রজয়ন্তী। ছেলেটাকে ফটো হাতে আসতে দেখে ঠাকুর্দার মনে পড়ে, তাইতো, কেন নিয়ে গেছিল সেটাই তো জানা হয়নি। তাই বললেন, 'হ্যাঁরে, তো কী রাজকম্ম হোলো ফটো দিয়ে?'
সুদীপের আর তর সইছে না। নড়েচড়ে বসে।
সৌমেন ভাবলেশহীন মুখে বলে, 'ছেলেটা বলে, 'জেঠু আজ আমরা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করলাম। যার ফটো নিয়ে আসার কথা ছিল সে আসেনি বলে আপনার চেম্বার থেকে এটা নিয়ে গেছিলাম।' ঠাকুর্দা আঁতকে উঠে বলেন, 'বলিস কী রে!' ছেলেটা ভেবলে গিয়ে বলে, 'কেন? কী হোলো?'
মৌ এবার ফুলে ফুলে হাসছে। রমেন বলে, 'এতে ওনার আঁতকে ওঠার কী হোলো?' সুদীপ মাঝে মাঝে বোকার মতো তাকাচ্ছে হাস্যরতা মৌমিতার দিকে।
সৌমেন নির্বিকার মুখে ডেলিভারি দেয় ক্লাইম্যাক্স, 'ঠাকুর্দা কপাল চাপড়ে বলেন, 'ওরে হতভাগা, এটা তো ঋষি অরবিন্দর ছবি! ওখানে তো রবীন্দ্রনাথের ফটো ছিলই না!'
এবার রমেন ও সুদীপও ভ্যাক করে হেসে ফেলেছে। মৌমিতা মুখে আঁচলচাপা দিয়ে হাসতে হাসতে হাত ইশারায় জানায়, ক্লাইম্যাক্সের এখোনো কিছুটা বাকি।
সৌমেন বলে, 'ছেলেটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে, 'এ্যাঁ, তাই নাকি! এঃ হে, তাহলে তো খুব ভুল হয়ে গেছে। তাই কে একজন বললো, ছবিটা তো ঠিক রবীন্দ্রনাথের মতো লাগছে না। তাতে আবার বিমল বিজ্ঞের মতো বললো, এটা ওনার অল্পবয়সের ছবি। যাকগে চলবে। পরের বার খেয়াল রাখতে হবে।'
এবার আর রমেন, সুদীপের হাসি থামতেই চায় না। রমেন খাটে চাপড় মেরে মেরে হাসছে আর বলছে, ' কী বললো ছেলেটা? যাকগে চলবে?'
সৌমেন বলে, 'আমি তো তাও ঠিকমতো বলতে পারলাম না। প্রথমবার বাপী এটা এমন ক্যারিকেচার করে রসিয়ে রসিয়ে বলেছিলেন যে শুনে আমারও তোমাদের মতোই অবস্থা হয়েছিল। তাই বলছি, দেখো, তোমরাও যেন এরকম কিছু কেলোর কীর্তি করে ফেলো না।'
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।