জুনের মেঘলা দুপুরে লাঞ্চের পর সৌমেন, মৌমিতা ও পৌলমী সৌমেনদের ফ্ল্যাটে আড্ডা দিচ্ছে। সৌমেন ওর একমাত্র শ্যালিকা পৌলমীকে আদর করে পুলি বলে ডাকে। আড্ডার মাঝে একসময় পুলি বলে, জানেন সৌম্যদা, শুনেছি যাদের কান ছোট হয় তারা নাকি স্বল্পায়ু হয়। বালাই ষাট, দিদিভাইয়ের কান দুটো যেন ছোটই মনে হচ্ছে। আপনার কান কিন্তু স্বাভাবিক।
মৌ বলে, তাহলে তো ভালোই, এমনিতে আমার থাইরয়েড, প্রেশার আর সুগার আছে। ছোট কানের দৌলতে আমি বেশ ওর আগেই চলে যাবো। ও আমার আগে গেলে মুশকিল।
সৌমেন বলে, তুমি আগে চলে গেলে আমার কী হবে?
মৌ বলে, কী আবার হবে। কিছুদিন খারাপ লাগবে। যতই হোক এতদিনের অভ্যাস। তারপর সেই অভাববোধও ক্রমশ অভ্যাস হয়ে যাবে। রাঁধুনী, কাজের লোক রাখবে। না হয় কোনো বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবে। তোমার জগৎ তো আমার থেকে বিস্তৃত তাই আমার অবর্তমানে তোমার খুব একটা অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। অমোঘ পরিণতি নির্মোহভাবে মেনে নেওয়ার মানসিকতাও তোমার আছে। সংসারে তোমার বাঁধনও আলগা। তাই দীর্ঘ দিন মহানন্দে একা একা ঘুরে বেড়াও। তখন কদাচিৎ আমায় ফোন করো।
সৌমেন বলে, তার মানে বলতে চাইছো আমি খুব আত্মকেন্দ্রিক, তাই তো?
মৌ বলে, খুব না হলেও কিছুটা তো বটেই - তুমি নিজের দুনিয়ায় থাকতে ভালোবাসো। তাই বেশ আত্মমগ্নও বটে। কারুর প্রতি তোমার টান আন্তরিক হলেও আকুলতা কম। এটা যে খারাপ, তা বলছি না। মহাজনরা তো বলেনই - মায়ার বাঁধনেই কষ্ট বেশি। তাই বেড়ানো, বই পড়া, লেখালেখি এসব নিয়ে আমার অবর্তমানেও তোমার জীবন মোটামুটি ভালোই কেটে যাবে। কিন্তু আমার জগৎ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষকে নিয়ে। তুমি, নীলু, মা, বাপী, পুলি, ওর বর, মেয়ে এইসব। নীলু বড় হয়ে কাজে কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। হয়তো দু্রে চলে যাবে। তখন তুমিই আমার সঙ্গী। আমি বুড়ি হয়ে গিয়ে গুটগুট করে হাঁটবো, তুমি আমায় হাত ধরে রাস্তা পার করাবে। জ্বরজারি হলে তোমার হাতে সেবা খাবো। তাই তুমি না থাকলে আমি খুব একলা হয়ে যাবো। কী নিয়ে থাকবো? তাই ভেবে দ্যাখো, আমার আগে চলে যাওয়াই ভালো।
সৌমেন মুখ ঝামটা দেয়, সেবা খাবো, গুটগুট করে হাঁটবো, হুঁঃ, আদিখ্যেতা আর ধরছে না। পুলির ঢপের ফান্ডা শুনে এমন ভাবে বলছো যেন ট্রেনের টিকিট, হোটেল বুকিং করাই আছে এবার নির্দিষ্ট দিনে ট্রেনে উঠলেই হয়। দ্যাখো, কে, কার আগে যাবে তা অনিশ্চিত। ছোট থেকে ঘরে বদরাগী বাবা বা বাইরে তিরিক্ষে শিক্ষকদের কানমলা খেয়ে লম্বকর্ণ বিটলেও পরে পুলিশের গুলিতে অকালে টপকে যেতে পারে। তার বেলা? আমার হাতের আয়ুরেখাও অসমাপ্ত। জ্যোতিষ মতে এর অর্থ ষাটের পর যে কোনো সময় অপঘাতে মৃত্যু। ৫৮ হতে চললো, মানে ক্যালেন্ডারের বাকি পাতা ফুরোলো বলে। তাহলে? তোমার ছোট কান না আমার থমকানো আয়ুরেখা - কোন ফান্ডা আগে ফলবে কে বলতে পারে? তাই এসব ফালতু কথা না ভেবে যতদিন মানুষ বাঁচবে যে যার মতো চেষ্টা করবে জীবনকে উপভোগ করতে, এটাই সার কথা। মরতে একদিন সবাইকে হবে। বিদেশে জীবদ্দশাতেই কবরখানায় পছন্দমাফিক জায়গা বুক করে রাখে। সে ঠিক আছে - preparation for the inevitable - তবে যাওয়া নিয়ে অবান্তর প্রসঙ্গে ভাবলে থাকার আনন্দই মাটি হয়।
সেদিন আড্ডায় ওখানেই ইতি হয়। দু বোন লাঞ্চের পর যায় হাওড়ায় বাপের বাড়ি। কয়েকদিন থাকবে ওখানে। নীলু আছে কর্ণাটকে কলেজ হোস্টেলে। সৌমেন থেকে যায় ছিমছাম উপনগরীতে ওদের আটতলার ফ্ল্যাটে। যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, কুসংস্কারমুক্ত - প্রকাশ্যে পরে থাকা এহেন সব আলখাল্লা থেকে পুলির কথায় নির্জন ঘরে উঁকি মারে কিঞ্চিৎ ভাবিত সত্তা। মুঠোফোনের জ্ঞানসমুদ্রে খোঁজে পুলি যা বলে গেলো তার কোনো ভিত্তি আছে কিনা। আন্তর্জালে পুলির ফান্ডার - অর্থাৎ ছোট কানের সাথে অকালমৃত্যুর সম্ভাবনা - এমন কোনো যোগসূত্র পাওয়া গেল না। বরং জানা গেল বয়েসের সাথে শারীরিক সামর্থ্য, রূপের জৌলুস কমলেও বাড়তে থাকে কানের দৈর্ঘ্য। হয়তো মাধ্যাকর্ষণের আকর্ষণে। তবে সে বৃদ্ধির হার খুবই সামান্য। এক যুগে হয়তো দু মিলিমিটার।
পরদিন সকালে সৌমেন বাজারে যায়। ফুটপাথে একটা সাদা ছাগল ল্যাম্পপোষ্টে বাঁধা রয়েছে। আগেও বেশ কয়েকবার ওখানে দেখেছে ওকে। মিষ্টি দেখতে। নিরীহ ভাবভঙ্গি। সেদিন বছর চারেকের একটা বাচ্চা ছেলে তার গলা জড়িয়ে কপালে হাত বুলোচ্ছে। ছাগলটা মাথা নীচু করে আদর খাচ্ছে। সুন্দর দৃশ্য। সৌমেন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখে। শিশুটি একটু বাদে ওকে ছেড়ে রাস্তার উল্টোদিকে কয়েকটি বাচ্চার সাথে খেলতে চলে যায়।
আর তখনই সৌমেনের চোখে পড়ে ছাগলটির কান দুটো। অস্বাভাবিক লম্বা! খরগোশের কান যে বড় হয় তা সবাই জানে। সেদিন একটা ডকুতে কিছু লম্বা কানের প্রাণী দেখাচ্ছিল। আফ্রিকা, এশিয়ার মরু অঞ্চলের এক প্রকার মাইক্রো ক্যাঙারুর মতো পুঁচকে ইঁদুর দেখালো - লাফিয়ে লাফিয়ে চলে - নাম তার জারবোয়া (Jerboa) - তার ইয়াব্বড় বড় কানের দৈর্ঘ্য নাকি তার শরীরের দুই তৃতীয়াংশ। দেখালো মরুশেয়াল ফেনেক ফক্স (Fennec fox) - শিয়ালকুলের পুঁচকে সদস্য - সেও মরু অঞ্চলের বাসিন্দা।
কিন্তু কোনো ছাগলের যে নেকটাইয়ের মতো এতো দীর্ঘ, প্রায় বুক অবধি ঝোলা কান হয়, তা আজ অবধি দেখে নি সৌমেন। আগেও কয়েকবার দেখেছে ছাগলটাকে এখানে, কিন্তু ওর কানের দিকে এভাবে নজর পড়ে নি। তাহলে আজ কেন পড়লো? পুলির কথা শুনে ওরও কি মানসিক দৌর্বল্য দেখা দিলো? পুলির ঐ ফর্মুলা কি ছাগলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? তাহলে এও হয়তো দীর্ঘায়ু হবে! যাঃ, কী সব ভাবছে পাগলের মতো। আপন মনে হেসে সৌমেন এগিয়ে যায় বাজারের দিকে।
একা মানুষের রোজ বাজারে যাওয়ার দরকার পড়ে না। দুদিন পর আবার বাজারে যায় ও। সেদিন ল্যাম্পপোষ্টে বাঁধা সেই ছাগলটিকে দেখতে পায় না। বরং সেখানে চেয়ার পেতে বসে আছে একটি বয়স্ক লোক। নিরীহ কৌতূহলে তাকেই জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, এখানে কয়েকদিন ধরে বড় কানওয়ালা একটা সাদা ছাগল বাঁধা থাকতো, কোথায় গেল সেটা?
ওদিকে বেশ কয়েক ঘর মুসলিম পরিবারের বাস। যাকে জিজ্ঞাসা করলো সৌমেন, সেও এক চাচা। তিনি বলেন গতকাল বকরিদ ছিল তো, তাই …. চাচা নিজের গলায় হাতের পাঞ্জা টেনে হালালের ইংগিত করেন। এবার বোঝে সৌমেন। তাই ওকে তোয়াজ করে পাতা টাতা খাইয়ে জিইয়ে রাখা হয়েছিল এতোদিন।
এক্ষেত্রেও কানের দৈর্ঘ্যের সাথে আয়ুর যোগসূত্র ধোপে টিকলো না। তাহলে পুলির ফান্ডা ঢপেরই হবে। একটু হালকা বোধ করে বাজারের দিকে এগিয়ে যায় সৌমেন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।