"ফ্যাচ !"
মানেই আরো এক জন শত্রুসৈন্য ঘায়েল, কেল্লা থেকে ছোঁড়া বোমা একদম সঠিক নিশানায় গিয়ে পড়েছে। আর নিচে আহত সেনামশাইটি রাগে তিড়িং বিড়িং করে উঠে, ওপর দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য গোলন্দাজকে খুঁজে না পেয়ে, বাছাই করা কিছু বিশেষণ ছুঁড়তে ছুঁড়তে নিজের সদ্য রঙিন জামার দিকে তাকিয়ে এলাকা ছাড়লেন।
তর্জনের তোড় থামলে ছেনু একটুকুনি মুখ বাড়িয়ে একফাঁকে লোকটার অবস্থা দেখে নিয়েছে, আর ওমনি তার মুখ জুড়ে খেলে গেছে স্বর্গীয় হাসি। আজ যখন এই কেল্লার গোলন্দাজির দায়িত্ব ছেনুর কাঁধে পড়েছে, সে, কাজে কি আর ফাঁকি দিতে পারে। তাই সক্কাল বেলা উঠেই দুই দিদিকে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছে ঠেলে ঠেলে। তারা ঘুম ভেঙে বকুনি দিতেই ছেনু বলে দিয়েছে, বাঃ রে, অতগুলো বেলুন কি আমি একলা ভরতে পারি ? আর কোনোমতে ভরে ফেললেও, আমি তো আর গিঁট বাঁধতে পারিনা। ওগুলো একটু বেঁধে ছেঁদে দে। সেই সজল চক্ষুর দিকে তাকিয়ে তাদের রাগ গলে জল। তিনজনে মিলে ছাদে উঠে বালতিতে রং গুলতে বসল। একটু করে গোলা রং পিচকিরি দিয়ে বেলুনে ঢুকিয়ে বাঁধে আর দরজার দিকে তাকায়। দরজা দিয়ে যদি দুম করে সে উঠে আসে ওমনি সব গোলমাল হয়ে যাবে আর দুই দিদি বিপদ বুঝে পিঠটান দেবে। তারা ছেনুর জন্য বেলুন বাঁধতে রাজি হয়েছে কিন্তু কানমলা খেতে নয়। আসলে ছোড়দা (ছোড়দা শুনে মোটেই পুঁচকে ভাববেন না পাঠকেরা, ওদের দুটি লম্বা লম্বা দাদার মধ্যে ইনি বয়সে ছোট, তাই নাম ছোড়দা, কিন্তু তার গলার বিষম আওয়াজে মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায়, কে ছোড়দা আর কে বড়দা) এই সব রং খেলা টেলার ঘোর বিরোধী। তার দাবি এইদিনেও নাকি কেউ কোন হুল্লোড়পনা না পাকিয়ে সুবোধ বালক হয়ে চুপটি করে ঘরের কোণে বইখাতা নিয়ে বসে লেখাপড়া করবে, নেহাৎ পড়াশুনোয় মন না বসলে সাহিত্য পড়বে, কিন্তু পাড়া বেড়িয়ে রং খেলতে যাওয়া নৈব নৈব চ। তার কথায়, রং খেলে কে কবে মহৎ হয়েছে ? ছেনু মিনমিন করে উত্তর দিতে যাচ্ছিল বটে, কেষ্ট ঠাকুর, কিন্তু ছোড়দার বোমার মত চোখের দিকে তাকিয়ে চেপে যেতে হয়। আগের দিনই ছোড়দা বাড়িজুড়ে ঘোষণা করে দিয়েছে, ছেনুর মতো পুঁচকে ছেলের কোথাও রংটং খেলতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, এক বারান্দা থেকে বসে বসে রং খেলা দেখতে পারে, এই অব্দি। কিন্তু বাড়ির সবাই তো আর এরকম পাষাণ হৃদয় নয়। তাই বড়দা আগের দিন রাতে বাড়ি ফেরার সময় দু কৌটো রং আর এক প্যাকেট বেলুন এনে গোপনে ছেনুকে চালান করে দিয়েছে। এক দিদি আলমারির পিছন থেকে পুরোনো পিচকিরিখানা ঝুল টুল ঝেড়ে উদ্ধার করে এনেছে। আর রং গোলার জন্য ভাঙা বালতিটা জোগাড় হয়েছে তেতলার পিসিমার কাছ থেকে। সেই সব নিয়ে আজ ছাদে বসে তিনজনে মিলে সকাল সকাল সব বেলুন টেলুন বেঁধে ফেলে, চিলেকোঠার ঘরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
এরপর তিনজনে একে একে নেমে, ঠাকুরঘরে গিয়ে ঠাকুরের আর মা'র পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করেছে। ঠাকুরকে প্রণাম করলে তবেই প্রসাদের মিষ্টি মিলবে, মা হাতে সন্দেশটা দিতেই ছেনু খপ করে পুরোটা মুখে পুরে দিয়েছে, আর চিবোতে পারে না। তারপর একটু জল দিতে তবে গলা দিয়ে নামল। ছোড়দা আবার ঠাকুরকে প্রণাম টনাম করে না, তাই সে সকালে কমলা থেকে সন্দেশ কিনে আনার সময়ই নিজেরটা টপ করে খেয়ে নিয়েছে। সন্দেশটা একসাথে মুখে পোরার জন্য মা একটু বকাবকি করে বলল, যা এবার দিদিদের প্রণাম কর। ছেনু মিচকি হেসে বদ্দিকে একগাদা আবির দিয়ে প্রণাম করে পায়ে খিমচে দিতেই, বদ্দিও পাল্টা ছেনুকে ধরে খুবসে কাতুকুতু দিয়ে দিল। আর ছোদ্দিকে প্রণাম করার পালা এলে ছেনু সোজাসাপ্টা জানাল, ওকে বড়জোর মুখ ভেঙিয়ে দিতে পারে, প্রণাম করা সম্ভবপর হচ্ছে না। তাতে ছোদ্দি আবির হাতে নিয়ে ছেনুর টোবলা গালদুটোয় লাগিয়ে চুলটা একটু খেবলু খেবলু করে দিল। দিদিরা আজ যাবে লালবাড়িতে বসন্ত উৎসবে, ওখানে ওদের নেমন্তন্ন, লালবাড়ির মেয়েদের সাথে দিদিদের ভারী ভাব কিনা। ছোড়দাও মানা করতে পারে না, কারণ ওখানে রং টং খেলা হয়না, শুধুই একটু আবির ছোঁয়ায়, আর আসল কথা হল লালবাড়ির লোকেদের চটানো মুশকিল, কারণ ওরাই ছেনুদের বাড়িওলা। তবে বাড়িওলা হলেও লালবাড়ির লোকজন ছেনুদের বড্ড ভালোবাসে, ছেনু মাঝে সাঝে খেলতেও যায় ওই বাড়িতে কিন্তু আজ ছেনুর গন্তব্য অন্য জায়গা - তেতলার বারান্দা। মাকে ছেনু বলে রেখেছে, বসে বসে রং খেলাই যখন দেখব, তখন তেতলার বারান্দা থেকেই দেখা ভাল, আরো উঁচু হবে। তাতে গ্রিল শক্ত করে ধরে থাকার শর্তে ছেনুর ছাড় মিলেছে।
তেতলায় গেলে ছেনুর একচ্ছত্র আধিপত্য, কেউ কিচ্ছুটি বলার নেই, সবাই তাকে মাথায় করে রাখে। ছেনু যেতেই পিসিমা একটা নারকেল নাড়ু বের করে ছেনুর গালে দিয়ে দিল। তারপর ছেনু গিয়ে সেই চিলেকোঠা থেকে নড়তে নড়তে বেলুন, বালতি, পিচকিরি সব টেনে এনে সেসব জিনিস বারান্দা জুড়ে সাজিয়ে রাখল। তারমধ্যে এক ফাঁকে নিচে গিয়ে দেখে নিয়েছে ছোড়দা কি একটা গাবদা বই খুলে পড়ছে, সুতরাং সেদিক থেকে আপাতত কোনো ভয়ের আশঙ্কা নেই। তা এইসময়ে তাদের পুরোনো লঝঝড়ে বাড়িটার তিনতলার বারান্দা থেকে নিচের রাস্তায় লোকজনের গতিবিধি দেখতে দেখতে তার মনে হল, সে আর নিতান্ত পুঁচকে ছেনু নয়, এখন তার নাম মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ, কলকাতার বুকে তার এই বিশাল কেল্লার ঝরোখা থেকে সে এখন শত্রু সৈন্যদের ওপর নজর রাখছে। এই সময় একটা চেয়ার সিংহাসন হিসেবে পেলে মন্দ হত না, বা নেহাৎ একটা কাঠের ঘোড়া। যাইহোক, নিচের পরিস্থিতি দেখে ছেনু ঠিক করল, আহত সৈন্যদের বোমা মারার কোনো মানে হয়না। তাদের আশেপাশের কিছু বাড়ির ছাদ থেকেও মাঝে সাঝে শেলিং হচ্ছে, তাই যেসব সৌভাগ্যবান সেসব এড়িয়ে তাদের বাড়ি পর্যন্ত বেরঙিন, বেদাগ জামায় আসতে পেরেছে, শুধুমাত্র তাদেরকেই সে নিশানা করবে। পুঁচকে হলেও তার হাতের টিপ মারাত্মক। সে রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে তাক করে টপাটপ রং-বেলুন ছুঁড়ছে আর গায়ে ঠিকমতো পড়লেই বারান্দা থেকে ছুট। এভাবে অন্তত গোটা ছাব্বিশ লোককে সে উজালার খরিদ্দার বানালেও দুঃখের বিষয় উজালা কোম্পানি এতবড় উপকারের প্রতিদান কোনো দিনই তাকে দিতে পারেনি, হয়ত বিষয়টা তাদের গোচরেই আসেনি, কে জানে।
তা মহারাজ ছনেন্দ্রনাথের বোমাবর্ষণ দিব্যি চলছিল, বেলুনরাও আজ দারুণ সার্ভিস দিয়েছে, খুব কমই ফুটো বেরিয়েছিল। মাঝে মধ্যে পিচকিরি দিয়েও সে কয়েকজনকে রং ছুঁড়েছে। তার শিকারদের জামা বিতিকিচ্ছিরি ভাবে রঙিন হয়ে গেলেও, মহারাজের জামা এখনো একদম পরিষ্কার। তার মধ্যে মৃদু মন্দ মলয় বাতাস এসে মেজাজটা ফুরফুরে করে দিচ্ছে। এই সময় দূর থেকে দেখা গেল ওনার কিছু বন্ধু এইদিকে আসছে। তারা ইতিমধ্যে রং খেলে ভূত হয়ে গেছে। ছেনু তার মধ্যে থেকেও দিব্যি চিনতে পারলো, বাচকুন, বুলটু, তোড়া, লুচকাই, অভু সবাই আছে। এরা সম্ভবত দ্বারিকের দোকানের দিকে রং খেলতে গেছিল, যেখানে একেবারে চৌবাচ্চার মধ্যে রং গোলা হয়, আর কেউ বেশি বেগড়বাই করলে ধরে সেই বিচিত্র সব রং-গোলা চৌবাচ্চায় ঝুপপুস করে চুবিয়ে দেওয়া হয়। বাঁদুরে রং, ভুতুড়ে রং, কালি, গ্যামাক্সিন এসব তো মামুলি ব্যাপার। তা বন্ধুদের আসতে দেখে ছেনু মনস্থির করল, এরা যা রং খেলেছে, তাতে বেলুন টেলুন একেবারে সামান্য ব্যাপার, পিচকিরি দিয়ে ছুঁড়লেও কামানের সামনে নকুলদানা মনে হবে, তাই গোটা বালতি ধরেই এদের মাথায় রং ঢালতে হবে। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। বালতিটা কোনো মতে ধরে তুলে (বালতিটা আসলে অনেকটা খালি হয়ে এসেছিল তাই রক্ষে) রেলিংয়ের ধার ঘেঁষে এসে ছেনু ঠিক তাক করে ওদের মাথায় গুলে রাখা রংটা ঢেলে দিল। আর বালতি ঢালতে গিয়ে ছেনুর পা-ও পিছলে গেছে। রেলিং না থাকলে বিপদ হত, কিন্তু এযাত্রা একপাটি চটি ছেনুর পা থেকে খুলে নিচে একদম রাস্তার ওপর পড়ে গেল। ওরা ওপর থেকে রং ঢালায় একটু বিভ্রান্ত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু চটিটা দেখে আর কোনো সন্দেহ রইল না। এই চটি তাদের ভীষণই চেনা, এইসব চটিকে সময় বিশেষে গোলপোস্ট বা উইকেট বানিয়ে আকছার তারা গলিপথকে মাঠে রূপান্তরিত করে থাকে। তাই তারা দেরি না করে চটির মালিকের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। অন্যদিন এই দরজা সারাক্ষণ খোলা থাকলেও আজ ছোড়দার নির্দেশে বন্ধ করা ছিল। মা দরজা খুলে বিস্ফারিত চোখে ভৌতিক অবয়বদের দেখে জানালেন, ছেনুর শরীর মোটে ভাল নেই, সে তাই রং খেলতে যেতে পারছে না। তারা সেই শুনে ভালোমানুষের মতো জানাল, একবার ডাকুন না ওকে, ওর চটিটা পড়ে গেছিল তো, দিয়েই চলে যাবো। আর ঠিক এই সময়ই ছেনু তার হারানো চটির সন্ধানে তেতলা থেকে গুটি গুটি পায়ে নেমে এসেছিল। বয়সজনিত কারণে তার উচ্চতা খুব বেশি না হওয়ায় বন্ধুরা যে তার বাড়িতেই ঢুকেছে এটা আর তেতলার বারান্দার রেলিং থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ওদের আর দেখতে না পেয়ে ছেনু ভেবেছে ওরাও বুঝি সেই আহত সৈন্যদের মতোই এলাকা ছেড়েছে। আর সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমেই পড়বি তো পর একদম বাচকুনের সামনে। আর যায় কোথায়। সবাই মিলে ছেনুকে চেপে ধরে ভুতুড়ে, বাঁদুরে, গিরগিটিয়ে, কিম্ভুতুড়ে, মানে আর যা যা বিদঘুটে রং সম্ভব, যা ওদের কাছে ছিল, সব আচ্ছা করে আগাপাশতলা মাখিয়ে দিল। তাতে এমনি খুব একটা অসুবিধে কিছু হয়নি, খালি পাড়ার গার্জেনরা এরপর আর হপ্তাদুয়েক ছেনুকে রাস্তায় দেখে চিনতে পারতো না, এই আরকি।