এমনিতেই শহরের এই বাসার সাথে রোদের আড়ি, তার ওপর এদিকে যদি জলভরা মেঘের বাড়বাড়ন্ত হয়, তাহলে তো দিনই আসে না সহজে। তবে জাম-জামরুলের ছায়ার তলে বাসাটা যতই নিরিবিলিতে অন্ধকার মেখে থাকুক না কেন, অফিসের ভাত রান্নার জোগাড় শুরু হতেই বোঝা যায়, এই বাসায় দিন শুরু হয়ে গিয়েছে। ঘরের চৌকাঠে জল ছিটিয়ে মা স্নান করে আসতে না আসতেই স্টোভের নীলচে আগুনের আঁচ আর কেরোসিনের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে এই বাসার বাতাসে।
এরপর একে একে বন্ধ হয়ে যায় ঘরের সিলিং ফ্যানগুলো। মশারির চারমাথাও খুলে যায় খাটের কোনা থেকে,
“মনি ওঠো, রেওয়াজে বসতে হবে। ওঠো, তাড়াতাড়ি ওঠো।”
হ্যাঁ উঠতে তো হবেই। যতই ভোরবেলার ঘুমের আলস্য আমাকে জড়িয়ে থাকুক না কেন, বিছানা ছেড়ে ব্রাশ শেষ করতে না করতেই হাতে চলে আসে লবণ মেশানো এক কাপ উষ্ণ জল। তাতে গার্গল সেরেই মেঝেতে নামানো হারমোনিয়ামের সুরে গলা মেলাতে হয়।
এমন ছকবাঁধা সকাল আমার একদম ভাল লাগে না। এসব সকালে পুজোর ফুল তুলতে যাওয়া নেই, দিনের আলো ফোটার আগেই সাদা আলো হয়ে ফুটে থাকা কাঠটগরের গাছ নেই, এ’বাড়ি-ও’বাড়ির জেঠিঠাকুমা বা কাকিমাদের আলসে সকালের গালগল্প নেই। আছে শুধু নিয়ম – যে নিয়মে কাজের তালিকাগুলো একদম ঘড়ির কাঁটায় মাপা থাকে।
দেয়ালে টাঙানো বড় ঘড়িতে ছ’টা দশ বাজতেই মা’র কেরোসিনের স্টোভে চায়ের জল বসে যায়। আর তার মিনিট পাঁচেক পরেই মুসা’র মা টিনের ফটকে টোকা দেয়,
“আপা, খোলো।”
না, আমাকে যেতে হয় না ফটক খুলতে। ততক্ষণে তো আমি হারমোনিয়ামের রিডে আরোহণ আর অবরোহণে গলা মেলানো শুরু করে দিয়েছি,
স ঋ গ ম প দ ন র্স
র্স ন দ প ম গ ঋ স…
উঠোনে রাতভর পলকা বাতাসে ঝরে পড়া পাতাগুলো ঝাড়ু দিয়ে জড়ো করতে মুসা’র মায়ের খুব সময় লাগে না। এরপর টাইমকলের জল ধরে চৌবাচ্চা ভরতে শুরু করতেই থেমে যায় আমার সুর সাধা। ঘড়িতে তখন পৌনে সাতটা।
মা চায়ের কাপগুলো একটা স্টিলের থালে সাজিয়ে নেয়। সাথে ক’খানা নোনতা বিস্কুট। মুসা’র মা’র ভাষায় ‘সলটিন বিস্কুট’। তবে বিস্কুটের নামে যতই গরমিল করুক না কেন, তা আঁচলে জড়াতে ভুল হয় না কিন্তু মোটেও মুসা’র মা’র,
“সলটিন বিস্কুটগুলা মুসা খুব হাউস করি খায়।”
হ্যাঁ, পেটমোটা খালিগায়ের হাফপ্যান্ট পরা মুসাকে যতই হাতভরে খাবার দেওয়া হোক না কেন, মায়ের পাতের খাবার না খেলে ওর ক্ষুধা ফুরায় না।
ঘড়িতে এখন সাতটা কুড়ি। কেরোসিনের স্টোভে এখন ভাত ফুটছে। স্কুলের খাতা নিয়ে আমি বসে গেছি। কালরাতে হাতের লেখা শেষ করতে পারিনি যে। খাতাজুড়ে লাইনভরে লিখি,
আমার নাম স্মৃতি
আমি প্রথম শ্রেণীতে পড়ি
আমার প্রিয় ঋতু বর্ষা…
- মনি, লাইন ভরে লেখো। আর এতবার মুছতে হয় না। মন দাও, ভুল হবে না তাহলে।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মা বলল।
কী ভাবে মন দেব আমি? আমার চোখ বারবার চলে যাচ্ছে ঘড়ির দিকে। চোখ দিয়ে গুনি সময়ের হিসাব। আর বেশি নয়, ঘণ্টা সাতেক আছে। অদ্ভুত একটা আনন্দ হয় আমার,
- আজ স্কুলে যাবো না, মা।
লেখার খাতায় মুখ ডুবিয়ে আমি বলি। তা না করে উপায় আছে? আমার এই আবদারে মা’র চোখদুটোয় শাসন এসে জড়ো হয় যে। যার অর্থ হল – আর যাই কর, পড়াশুনোয় ফাঁকি দেওয়া যাবে না। তবে আজ শাসনের ফাঁকে অবশ্য আজ একটু আশ্বাসও মিলল,
“রহিম চাচা আজ তাড়াতাড়ি তোমাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসবে।”
সকালের পাত পড়ে গেল। আলোচালের নরম ভাত, আলু সেদ্ধ, ডাল সেদ্ধ, নরম কুসুমের ডিম সেদ্ধ আর চামচ ভরে ঘি। বাবার পাতে এসবের সাথে বাড়তি কাঁচামরিচও পড়েছে।
বাসার গেটে রিক্সার বেল বেজে উঠল। ঘড়িতে প্রায় দশটা বাজতে চলল। বাবা বেরিয়ে গেল আমার আগেই। চুলে দুটো কান-বেণী করে আকাশী রঙের স্কুলড্রেস পরিয়ে দিল মা,
“স্কুলে পড়ো মনোযোগ দিয়ে।”
আমি রিক্সায় বসতে না বসতেই প্যাডেলে পা চলে গেল রহিম চাচার।
ব্যস্, আমার সকাল ফুরিয়ে গেল।
এরপর তাড়াতাড়ি বারবেলা আসার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে আমি ঢুকে পড়লাম স্কুলের গণ্ডিতে। ঊষাদি, মঞ্জুদি, অশোকাদি, আল্পনা-আপা, নুরজাহান-আপা – যত না পড়া ধরে, তারচেয়ে বেশি গল্প করে। কার বাসা গতবছরের বন্যায় ডুবে গিয়েছিল, কে যুদ্ধের বছরে শরণার্থী হয়ে ক্যাম্পে গিয়েছিল, কার বাড়ির আতা গাছে ফল ধরেছে — সে সব গল্পে গল্পে যতটুকু পড়া বাদ পড়ে, তার সবটুকুই ষোলোআনায় পুষিয়ে দেয় দীপঙ্কর স্যার। কড়া ধাঁচের ছোটখাটো মানুষটি শুধু স্কুলে পড়িয়েই ক্ষান্ত হয় না, প্রতিদিন বিকেলে বাসাতেও যায় আমাকে পড়াতে।
কিন্তু আজ বিকেলে আমি কী ভাবে দীপঙ্কর স্যারের কাছে পড়ব? আমি মনে মনে পণ করে ফেলি, স্যার যতই বকা দিক, আজ আমি ছুটি নেবই নেব।
স্কুলের সময় আজ আমার খুব দ্রুত ফুরিয়ে গেল। স্কুলে ছুটির ঘণ্টা পড়ার বেশ আগেই রহিম চাচা চলে এল,
“বৌদি আজ তাড়াতাড়ি নিইয়্যা যাইতে কইলো তোমাক।”
হ্যাঁ, সে তো আমি জানিই, আজ আমার তাড়াতাড়ি বাসায় না পৌঁছালে হবে?
শুধু তাড়াতাড়ি পৌঁছেই আমি ক্ষান্ত হই না, চৌবাচ্চা থেকে কয়েক ঘটি জল মাথায় ঢেলে তাড়াহুড়ো করে মায়ের পাশে এসে বসি। বারান্দায় কেরোসিনের স্টোভের আজ আঁচ কমেনি একবারের জন্যও। রান্না হয়েছে ঘি দিয়ে মুগডাল, বেগুন ভাজা, আলুর ঝুড়ি ভাজা, আইর মাছের রসা আর জলপাইয়ের টক। এখন আঁচে বসবে চিংড়ির পাতুরি। নদীর তাজা চিংড়ি মাছ আজ সকালে বাবা নিয়ে এসেছে।
সেই মাছ বেছে ধুয়ে মুসা’র মা গিয়েছিল ভাদুড়ি বাড়ির বাগানে। সেখান থেকে কলাগাছের সবুজ পাতা কেটে এনে দিয়েছে।
মা শিলপাটায় রাইসর্ষে, একটু লবণ আর কাঁচামরিচ মিশিয়ে বেটে নিচ্ছে। সর্ষের ঝাঁজ থেকে চোখ বাঁচিয়ে আমি তাকাই ফটকের দিকে। বারান্দার এপাশটা থেকে ফটকটা পরিষ্কার দেখা যায়। নিরিবিলি এই পাড়াটা এখনো অবশ্য বারবেলার মতো ঝিমিয়ে পড়েনি। দু’-একটি রিক্সা একটু পর পর ঘণ্টা বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। আর বাজছে আইসক্রিম গাড়ির ঘণ্টা। তিনচাকার এই গাড়িটার ঘণ্টা কানে এলেই আমি একটু উশখুশ করে উঠি। কিন্তু মা’র সেই একই কথা,
“বরফ খেলে গলা নষ্ট হয়ে যাবে।”
আজ অবশ্য আইসক্রিম গাড়ির ঘণ্টার দিকে আমার খুব একটা মনোযোগ নেই। আমি বারবার ফটকের সামনে একটাই মুখ খুঁজছি।
স্টোভের আঁচে মা কড়াই বসাল এখন। তাতে ক’খানা কেটে রাখা কলাপাতা সেঁকে নরম করে নিল। স্টিলের একটা বড় বাটিতে সর্ষেবাটা, নারিকেল কোরা, লবণ, হলুদ, সর্ষের তেল আর অল্প একটু চিনি পড়ল। এরপর তাতে পড়ল ধুয়ে রাখা চিংড়ি মাছ। খানিকটা সর্ষের তেল ঢেলে দিয়ে মা হাত দিয়ে মাখিয়ে নিল সব।
সেঁকে নরম করে রাখা কলাপাতাগুলোর রঙ এখন গাঢ় সবুজ। মা সেই কলাপাতা থেকে কিছু শিরা বের করে নিল। এরপর একটার উপর আরেকটা কলাপাতা সাজিয়ে তাতে ঢেলে দিল মাখানো চিংড়ি মাছ। এপাশ ওপাশে ভাঁজ ফেলে মুড়িয়ে নিল চিংড়িগুলোকে। এরপর মা আলাদা করে রাখা শিরাগুলো দিয়ে বেশ ভাল করে বেঁধে নিল চিংড়িসহ কলাপাতার পুঁটুলি।
আঁচে বসানো তেতে ওঠা কড়াইয়ে কলাপাতার পুঁটুলি বসিয়ে ঢেকে দিল মা।
মাঠের মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে। টাইমকলে জল এল। মা কলতলা চলে গেল চৌবাচ্চা ভরতে।
অল্প আঁচে বসানো কলাপাতার রঙ বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। আর পুঁটুলির ফাঁকফোকর থেকে উপচে পড়া সর্ষে আর নারিকেলের মিশ্রণ কড়াইয়ে গড়িয়ে পড়তেই অদ্ভুত সুঘ্রাণ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।
মা আজ ঝিঙেশাইল চালের ভাত করেছে। উপুড় করে রাখা সাদা লম্বা চালের সেই ভাতের হাঁড়ি থেকেও ঘ্রাণ ছুটেছে খুব।
মা কলাপাতার পুঁটুলিটা উল্টে দিল। এ’পাশটা পুড়ে কালো হয়ে উঠেছে। ও’পাশটা আরেকটু পুড়ে উঠলেই মা আঁচ থেকে নামিয়ে নেবে চিংড়ি পাতুরি।
বাড়ির ফটকে একটা রিক্সা এসে থামল।
টাইমকলের জল উপচে পড়ছে বালতি ভরে। মা আঁচ থেকে কড়াই নামিয়ে ফেলল।
ফটক ঠেলে ভেতরে এল কতদিনের না দেখা মুখগুলো।
জামগাছের ছায়া বাঁচিয়ে বারবেলার যেটুকু রোদ ফটকের সামনে আলগোছে পড়ে আছে, তার সবটুকু গায়ে জড়িয়ে ঠাকুমা ডেকে উঠল,
“দিদি…”