তেতে ওঠা দুপুরে নিরিবিলি এই পাড়াটা আরও যেন নিরিবিলি হয়ে পড়ে। এবাড়ি-ওবাড়ির প্রাচীর পেরিয়ে যেটুকু শব্দ আসে, তা ওই পাখির ডাক কিংবা রাস্তা দিয়ে হাঁক ছেড়ে যাওয়া ফেরিওয়ালার ডাক। তবে যতরকম ফেরিওয়ালাই হাঁক দিক না কেন, ‘লেইসফিতা…’ ডাকে এ পাড়া যতটা জেগে ওঠে, অন্য কোনো ডাকে তা হয় না। কাঁচের বাক্স ভরা চুড়ি, ফিতা, ক্লিপগুলোর সাথে পুরোপাড়ার ভাতঘুম কীভাবে যেন সন্ধি করে ফেলে। প্রাচীর-ঘেরা বিছিন্ন বাড়িগুলোর ফটক খুলে বেরিয়ে আসা মানুষগুলো কিছু সময়ের জন্য খুব আপন হয়ে ওঠে,
“ও দিদি, এই চুড়িগুলো আপনার হাতে খুব মানাবে”
কিংবা
“আপা, চুলের ক্লিপ দু’টো রেখে দিন। চুল বাঁধলে কত ভালো লাগে আপনাকে”
যেন একে অন্যের শখ পূরণেই এদের সব আনন্দ।
তবে এসব আনন্দ আজ আমাকে ফাঁকি দিতে হল। তা না দিয়ে উপায় আছে? ভাদুড়ি বাড়ির বাগান থেকে আজ সারাদিন থেমে থেমে ফিঙে পাখির ডাক ভেসে আসছে। তাই মা, বড়দাদি, শিখা দিদির মা, মুসার মা – সবাই যখন লেইসফিতার রঙিন বাক্সখানা নিয়ে ব্যস্ত, তখন আমি এক পা-দু’পা করে ভাদুড়ি বাড়ির বাগানে পৌঁছে গিয়েছি।
বাগান বললে ভুল হবে, গাছ-আগাছায় ভরে যাওয়া বাড়িটা এতদিনে জঙ্গলই হয়ে যেত, শুধুমাত্র বড়দাদি মাস কয়েক পরপর কামলা এনে জায়গাটুকু পরিষ্কার করায় বলে এখনও ভাদুড়ি বাড়ির বাগান নামটা অক্ষত আছে। আম থেকে আমলকি, বেল থেকে হরিতকি – সবরকম গাছই আছে বাগানে। আর আছে নানারকম লেবু গাছ। কাগজি লেবু, পাতিলেবু, বাতাবিলেবু, বিলম্বলেবু – আরও যে কতরকম লেবু!
ভাদুড়ি বাড়ির বৌ নাকি লেবু গাছগুলো নিজে হাতে লাগিয়েছিল। তাই এই বাগানের লেবুগুলো বড়দাদি পাড়ার সবাইকে বিলিয়ে দেন,
“খুব রসালো এই লেবু আর ঘ্রাণ, হাতে বারপাঁচেক ধোওয়ার পরেও থেকে যায়। ভাদুদি কত শখ করেই না লাগিয়েছিল। মানুষটা প্রাণভরে গাছের ফলগুলো খেতেও পারল না”
বড়দাদির দীর্ঘশ্বাসে কী থাকে তা না বুঝলেও, ভাদুদি যে বড়দাদির খুব আপন কেউ – তা বুঝতে আমার সময় লাগে না মোটেও। না হলে ভাদুড়ি বাড়ির বাগানের সব ফল শুধু পাড়ায় বিলিয়েই ক্ষান্ত হন বড়দাদি, একটা ফলও নিজের বাড়িতে নেন না,
“ওসব ফল আমার গলা দিয়ে নামবে না। ভাদুদি কখনও ফিরলে দু’জনে একসাথে খাব।”
সেই আশাতেই বড়দাদি ফলগুলো জমায়। না, না, বাড়িতে নয় – গাছে। হ্যাঁ গাছেই বাড়তি ফল পেকে, উটকো বাতাসে ঝরে, পচে নষ্ট হয়। আর সেসব ফলের লোভেই কত যে পাখি এই বাগানের এ’ডালে ও’ডালে বাসা বেঁধেছে।
লেইসফিতার লোভ এড়িয়ে ফিঙে খুঁজতে এসেছি ঠিকই, কিন্তু এখন পর্যন্ত তার খোঁজ পেলাম কই?
আমি হরিতকি গাছে উঁকি দিই, সফেদা গাছে চোখ বুলাই – না, নেই – কোথাও দেখা নেই ফিঙে পাখিটার। কোথায় যে লুকিয়ে একটু পরপর ডেকে উঠছে কে জানে?
তবে ফিঙে পাখির লুকোচুরি শেষ হবার আগেই আমার পলান টুক টুক খেলা ফুরিয়ে গেল। হ্যাঁ, মুসার মা ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করে ফেলেছে,
“ভর দুপুর বেলাত এই শুনশান বাড়িত আসতি হয় না, কত জ্বীন-পরী এগুলান সময় ঘুরি বেড়াই জানো তুমি?”
ভাদুড়ি বাড়িকে পারলে মুসার মা ভুতের বাড়ি বানিয়ে দেয়।
তা তো হবে, জনমানবহীন বাড়িটা সেই কবেই এজমালি হয়ে যেত। শুধু বড়দাদির জন্য তা হয়ে ওঠেনি,
“গন্ডগোলের বছরেও ওরা এ বাড়ি ছেড়ে যেতে চায়নি। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ক’দিনের জন্য গ্রামে পাঠাতে পারলেও, ফিরে এসেছিল ক’দিন পরেই। কত মায়া করত এ বাড়িকে। আর এখন বছর দশ হয়ে গেল বাড়ি-ছাড়া ওই মানুষগুলো।”
বাড়িটাকে মানুষগুলো ছেড়ে গেছে। গাছপালাগুলো তো আঁকড়ে আছে বাড়িটাকে। সেই গাছপালাগুলোকে রক্ষা করার নামেই বড়দাদি আসলে ভাদুড়ি বাড়িটা পাহারা দেয়।
আমি বারোমাসি একটা লেবু ছিঁড়ে হাতে নিয়ে বাসার পথ ধরতেই মুসার মা’র গলা,
“একটু সবুর করো আপা, বাতাবিলেবু নিতি হবি; তোমার মা’র আজ পূজা আছে কিন্তুক।”
ও হ্যাঁ, তাই তো! আরেকটু পর থান সাজিয়ে কালিবাড়ির মন্দিরে যেতে হবে। বাড়ি হলে তো আমাদের উঠোনেই আজ আল্পনা পড়ত, কিন্তু এখানে সবকিছুতে ওই মন্দিরেই যেতে হয়।
আমি মুসা’র মা’কে পেছনে রেখেই বাসায় ফিরে আসি। শিলপাটায় ভেজানো মটরের ডাল বাটছে মা।
“ও মা, বড়া বানাবে? এই অবেলায় কেন?”
বারবেলায় স্টোভে আগুন পড়ে শুধু সন্ধ্যার চা আর রাতের ভাত ফুটানোর জন্য। কিন্তু আজ তা হয়নি।
স্টোভের আঁচে সর্ষের তেল ভরা লোহার কড়াই বসেছে আগেই। বাটা মটরডালে লবণ, হলুদ আর চিনি মিশিয়ে মা তাড়াতাড়ি ক’খানা বড়া ভেজে নিল। মুসার মা ঝিঙে ডুমো করে কেটে দিয়ে সর্ষে আর কাঁচামরিচ বেটে দিল মাকে।
কড়াইতে কালোজিরা ফোড়ন পড়ল। তাতে ক’খানা কাঁচামরিচও। এরপর ঝিঙে আর আলু। সবুজ ঝিঙে আগুনের তাপে জল ছেড়ে আরোও সবুজ হচ্ছে। আর ঝিঙের সবুজ জলে সেদ্ধ হচ্ছে আলু।
কড়াইয়ে ঢাকনা পড়ল। স্টোভের আঁচ কমিয়ে মা উঠে গেল ফল ধুতে। সাতরকমের ফল, কাঁঠালি কলা, পান-সুপারি, আলোচাল, দূর্বা ধুয়ে মা চালনে রেখে দিল।
কড়াইয়ের ঢাকনার ফাঁক-ফোকর দিয়ে ধোঁয়ার সাথে ছড়িয়ে পড়ছে কচি ঝিঙে আর কাঁচামরিচের সুঘ্রাণ।
মা ঢাকনা তুলে জল শুকিয়ে আসা ঝিঙে আলুতে মিহি করে বাটা সর্ষে আর কাচামরিচ বাটা দিয়ে দিল। একটু নেড়ে আবার ঢাকনা দিল কড়াইয়ে মা।
বারান্দার রোদ টুক করে উঠোনে নেমে পড়ল। কলতলার জামরুল গাছের ছায়া এসে জায়গা করে নিলো সেখানে। বড়দাদির পায়রাগুলো ছাদঘরে ফিরছে একে একে।
কড়াইয়ের ঢাকনা উঠে এবার পড়ল মটর ডালের বড়া। একটু নেড়েচেড়ে মা ছিটিয়ে দিল খানিকটা চিনি।
শিখা দিদি চলে এসেছে আমাদের বাসায়। আরেকটু পর শিখা দিদির মা চলে আসবে।
মা সর্ষের তেল ছড়িয়ে স্টোভ থেকে কড়াই নামিয়ে ফেললো।
মা আর দেরি করল না। কলঘরে ঢুকে পড়ল। তাড়াহুড়োই স্নান সেরে আবার বসল চালনের সামনে।
সিঁদুর মাখানো চালনে দূর্বা, আমপাতা আর ঘট বসিয়ে নিল।
“দিদি, ও দিদি পুরোহিত মশাই দেরি হলে আমাদের থান ফিরিয়ে দেবে।”
শিখাদির মা’র গলা।
মা তাড়াহুড়ো করে থান হাতে নিয়ে কালিবাড়ির মন্দিরের দিকে পা বাড়াল। তার আগে অবশ্য একবাটি ঝিঙেশ্বরী মুসার মার হাতে ধরিয়ে দিল,
রাতে মুসাকে নিয়ে খেও।
আমরা মসজিদের মাঠ পেরিয়ে, বাবার অফিস আর আমার স্কুল ছাড়িয়ে কালিবাড়ি মন্দিরে পৌঁছালাম। পুরোহিত মশাই ফুলের সাজি হাতে নিয়ে নিয়ে নাটমন্দিরে দাঁড়িয়ে আছেন।
এ পাড়ার সব ব্রত এই নাটমন্দিরেই হয়।
নাটমন্দিরে ঘট আর পট দুটোই বসেছে। সামনে সবার থান। তাতে সাজি থেকে করবী ফুল পড়ল। পুরোহিত মশাই মন্ত্র শেষে ব্রতকথা ধরলেন,
সোনার মা ঘট বামনী।
রূপোর মা মঙ্গলচণ্ডী।।
এতক্ষণ গিয়েছিলেন না
কাহার বাড়ি?
হাসতে খেলতে তেল সিন্দুর মাখতে
পাটের শাড়ি পরতে সোনার দোলায় দুলতে…
ঘট থেকে শিখাদির মা সিঁদুর নিয়ে পরিয়ে দিচ্ছে সকল সবাইকে। মা আমার হাতে ক‘গোছা দূর্বা আর করবী ফুল গুঁজে দিল,
“মনি, ব্রতকথা শুনতে হয় মন দিয়ে”
কী ভেবে আমি চোখ বুজলাম। এয়ো নারীর কথা শুনতে শুনতে ঠাকুমার মুখখানা স্পষ্ট হল আমার সামনে। সিঁদুরে চুল-কপাল লেপ্টে থাকা মুখখানা কত কতদিন হয়ে গেল দেখি না।
ওই তো – ঠাকুমা, জ্যেঠি ঠাকুমা, শুক্লার মা – সবাই আমাদের উঠোনে থান নিয়ে বসেছে। ঠাকুমা সাদা টগর হাতে ব্রতকথা শুনছে একমনে। মনিপিসি পড়ছে,
নির্ধনের ধন দিতে
কানায় নয়ন দিতে
নিপুত্রের পুত্র দিতে
খোঁড়ায় চলতে দিতে
হয়েছে এত দেরি….
আমার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসছে। শক্ত মুঠোয় দূর্বা ঘাসের সাথে করবী ফুল মিইয়ে যেতে থাকে আমার অজান্তেই।