আজ স্কুলে গিয়ে পরীক্ষার খাতা ফেরত দেওয়ার কাজ করছিলাম। আরও কয়েকজন সহকর্মী ছিলেন। আমার পার্টনারও ছিল। মাঝে মাঝে অভিভাবকরা আসছিলেন। খাতা ফেরত দেওয়া হচ্ছিল। আর চলছিল নানারকম গপ্পো। সব ভালই চলছিল। একজন দিদি টিফিন বাক্স খুলে খেতে শুরু করলেন। বললেন, রোজ রোজ এই খাবার খেতে খেতে বোর হয়ে গেছি। আমি প্রমাদ গুণলাম। যথারীতি সেটাই হল। উনি শুরু করলেন, আরুণি, আমাদের খাওয়াও। আর কবে? আমি পার্স বের করে বললাম, কী আনব? সেই থেকে শুরু হল।
একজন জিজ্ঞাসা করছে, দেখাশোনা আছে না আমরা দেখব? যে দিদি প্রসঙ্গ তুললেন, তিনি বললেন, না না ওর দেখা আছে। বছর দুই আগে উনি ওঁর মামাতো বোনের সঙ্গে বিয়ের জন্য আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে জানতে চেয়েছিলেন যে আমি এনগেজড কিনা। তখন বলেছিলাম, হ্যাঁ এনগেজড। এদিকে আমার পার্টনার মৃদু মৃদু হাসছে। ওকে দেখিয়ে বলা হল, সিনিয়র লাইন ক্লিয়ার না করলে জুনিয়র কী করে এগোবে? আমি বললাম, লাইন ক্লিয়ার আছে। কে ধরে রেখেছে? এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলতে থাকল।
এই বহুমুখী আক্রমণ অস্বস্তিকর হলেও, হাসিমুখে মজাদার প্রতিক্রিয়া দিতে হয়। সীমা অতিক্রম করলে একটু মৃদু বিষ মিশিয়েও দিতে হয়। অনেক বছর ধরে এটা করতে হচ্ছে। অন্য কোনো সমবয়সী কিম্বা জুনিয়র সহকর্মীর বিয়ের আগে আইবুড়ো ভাত খাওয়ানোর আয়োজন হয়। তখন এই উপদ্রব আরও বেশি হয়। সরাসরি বলার সাহস হয় না বেশির ভাগ পুরুষ সহকর্মীর। তাদের কথার মধ্যে থাকে পরোক্ষ প্রশ্নমালা।
এইভাবে এক দশকেরও বেশি সময় কাটিয়ে দিলাম কর্মস্হলে।
আজ মনে হচ্ছিল যদি দু’জনে দু’জনের হাতে হাত রেখে জানিয়েই দিই, কী হবে? প্রশ্নটা নিজেরই মনে যেন অনুরণিত হতে থাকল।
কী হবে?
কী হতে পারে?
হয়তো যত ভয় পাই, তত কিছু হবে না। কিম্বা তার চেয়ে খারাপ কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে। যেহেতু আমরা দু’জন সহকর্মী, তাই নিশ্চিতভাবে উঠবে আরও অনেক প্রশ্ন। কে স্বামী? কে স্ত্রী? কী কর? কীভাবে কর? বাচ্চা হবে কী করে? আরও আরও অনেক কিছু।
এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় না নিলেই চলে। তবু এসব প্রশ্নেরও উত্তর দেওয়া যায়।
যার উত্তর দেওয়া যায় না, তা হল কোনো ছাত্রের বাঁকা হাসি।
কোনো ছাত্রের আলাদা করে কাছে এসে কিছু জেনে নেওয়ার এতদিনের স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট হয়ে গেলে শিক্ষক হিসেবে আমাদের মৃত্যু ঘটবে। এক কর্মস্থলে থাকার দরুণ যুগল মৃত্যু।
তাই বেঁচে থাকো শিক্ষক।
ব্যক্তিগত সত্যকে আড়াল করে মহত্বের মুখোশ পরে বেঁচে থাকো, যতদিন না মৃত্যুকে জয় করার শক্তি লাভ কর।