সকালের রোদে গা জুড়ালেও দুপুর হতে না হতেই রোদের তেজে উঠোন কেমন ফেটে ওঠে। আর গাছের ঝরে যাওয়া বাদামি পাতাগুলো এখানে-ওখানে ছড়িয়ে উঠোনটাকে ঢেকে রাখছে প্রায়ই। বাইরবাড়ির দেবদারু বাগানের মাথায় জলভরা মেঘ না জমা পর্যন্ত ফাটা উঠোনের ধুলো সুযোগ পেলেই দখল করে নিচ্ছে লাল বারান্দার সবটুকু।
“মনি ধুলো নিয়ে খেলিস না”, “মনি একটু জল খেয়ে নে”, “রোদে আর ঘুরিস না”, “মনি বড়ঘরে ফ্যানের নীচে একটু বস তো – ঘেমে তো ভিজে গেছিস” –
মনিপিসির সব শাসন বাঁচিয়ে আমি ঠিকই লালবারান্দায় ধুলোতে আঁকতে বসে যাই। কখনো ‘অ’ আঁকি, তো কখনো ‘দ’-এ লম্বা লেজ লাগিয়ে আঁকি পাখি। আর সেই পাখিটার ডানা আঁকতেই যাব, ঠিক তখনই বাইরবাড়ির হিমচাঁপা গাছে ডেকে ওঠে ‘টিক জল’ পাখি।
মনিপিসির শাসন, সিলিং ফ্যানের ঘটাং ঘটাং আওয়াজ আর হিসাবের খাতার গরমিল ঠিক করতে বসা দাদুর বিরক্তি – সব এড়িয়ে আমি পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াই বাইরবাড়িতে। সেখানে হিমচাঁপা গাছ, ফটিকজল পাখি, দেবদারুর ছায়ায় জমে থাকা প্রশান্তি ছাপিয়ে আমার চোখ চলে যায় তাঁতঘরে।
এ ক’দিনে তাঁতঘরটা আরও ছোটো হয়ে এসেছে। গুনে গুনে এখন মোটে দশখানা তাঁত।
ওই তো মানিক কাকু ড্রাম চালাচ্ছে, কিন্তু লোটন দাদা, খয়ের চাচা ওরা কই? ওই যে তাঁতঘরের যেখানটায় শাড়িতে সিল লাগানো হত, সেই পাশটা নতুন টিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে কেন? ওখানেই তো শাড়ি ভাঁজ করতে করতে স্বপন তাঁতি সুর ধরত,
আট কুঠুরি নয় দরজা
মাঝে মাঝে ঝরকা কাটা…
সে সুর আমার মনের ভেতর আবার শুরু হতেই মানিক কাকুর ডাক,
“মনি, কত বড় হয়ে গেছিস! আর চোখমুখ এর’ম বসে গ্যাছে ক্যান? শহরের হাওয়ায় তো মানুষ ফুটফুটে হয় রে!”
মানিক কাকুর এতসব কথায় আমার মনোযোগ নেই। আমি ছোটো হয়ে আসা তাঁতঘরটাই বারবার দেখছি।
“ও মানিক কাকু, তাঁত এত কমে গেছে কেন? আর ওই যে ও পাশটায় অমন নতুন টিন লেগেছে কেন?”
আমার তুলে ধরা আঙুলটা মানিক কাকু ধরে কাছে এসে। আদর করে মাথায় হাত বুলায়,
“চল, ওপাশটা দেখিয়ে আনি তোকে।”
রাজ্যের কৌতূহল চোখে নিয়ে মানিক কাকুর হাত ধরে এগোই আমি।
এপাশটায় নতুন ঝাঁপতোলা একটা মুদি দোকান। সেই দোকানের বয়ামে নোনতা বিস্কুট, ফুল বিস্কুট, পাইনঅ্যাপল বিস্কুট, ঝুরিভাজা – এসব এড়িয়ে আমার চোখ চলে যায় কাঠি লজেন্সের দিকে।
শ্যামলজেঠুর দোকান বন্ধ হওয়ার পর এই প্রথম কাঠি লজেন্সের দেখা পেলাম। শহরে আমাদের মহল্লায় কোনো দোকান নেই। বাবা দোকান থেকে মাঝেমধ্যে টফি এনে দেয়। কিন্তু লাল-নীল রঙের কাঠি লজেন্স যে আমার সবচেয়ে প্রিয় – তা বাবা বুঝতেই চায় না।
লোকমান চাচা মেপে ফেলে আমার চোখ। বয়াম খুলে কাঠি লজেন্স আমার হাতে দিতে দিতে বলে,
“বাবুর নাতিনরে কতদিন পর দেখলাম।”
আমি লজেন্সখানা হাতে নিতেই মনে পড়ে আমার কাছে তো পয়সা নেই। আমি লজেন্স ফিরিয়ে দেবার জন্য বলি,
“এখন এটা রাখেন, ঠাকুমার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে আসি।”
লোকমান চাচা ঘাড় দু’পাশে ঝাঁকায়। হেসে বলে,
“তোমার দাদুরে ঘরভাড়া দেবার সময় এটার দাম কেটে নেবো নে।”
তবুও আমার ভয় হয়। ঠাকুমা যদি বকা দেয়, পয়সা না দিয়ে লজেন্স নিয়েছি যে! আমি কাঠি-লজেন্স পেঁচিয়ে রাখা রঙিন কাগজটা না খুলেই পায়ে পায়ে ভেতরবাড়ির দিকে এগোই।
আমি যখন তাঁতঘর পেরিয়ে দেবদারু বাগানের নীচ দিয়ে ভেতর বাড়ির দিকে এগুচ্ছি, তখন দেবদারুর মাথায় জমতে শুরু করেছে জলভরা মেঘ।
আমি দৌড়ে বাইরবাড়ির বারান্দায় উঠি। চোখ পড়ে গোলেনূরদাদির উঠোনে।
উঠোনে দুইটা থেমে থাকা চরকা দাঁড়িয়ে। সুপাড়ি বাগানের তলায় নিস্তব্ধ উঠোনটা আমাকে কেমন যেন আড়ষ্ট করে দেয়। ও’বাড়ির মানুষগুলো কই?
তবে আমার সে ভাবনা বাড়ার সময় পায় না। বড়ঘরের দরজায় ঠাকুমা দাঁড়িয়ে,
“দিদি, বাতাস ছাড়বে মনে হচ্ছে। তুমি ঘরের ভেতর চল।”
বড়ঘরের মেঝেয় পাতা ভাতঘুমের শীতলপাটি উঠে গেছে। ধূলার দিন বলে পূর্ণির মা আরেকবার মুছে দিয়েছে সে মেঝে। দাদুও ঘুম থেকে উঠে পান মুখে দিয়ে রেডিও-র নব ঘুরাচ্ছে।
“ও ঠাকুমা মনিপিসি কই?”
প্রশ্নের উত্তর আসে লাল বারান্দা থেকে।
“এদিকে আয় মনি”,
মনিপিসি আমাদের বারোমাসি গাছের আম কাটছে।
“ও মনিপিসি, আম মাখাবে আজ?”
মনিপিসি হাসে,
“পেটুক একটা। আজ ঠাকুমার একাদশী তো। সাবুর ফলার বানাবে।”
সাবুর ফলার শুনেই মনে পড়ে কাঠের দোতলার কথা। ওখানে সবচেয়ে ছোট কাঁচের বয়ামে ঠাকুমা কালচে লাল কিশমিশ রেখে দেয়। সাবুর ফলারেই তা পড়বে বলে উপর থেকে নামে। আর সে বয়াম থেকে দুটো আমার হাতেও পড়ে।
উপরতলা থেকে কিশমিশের বয়াম নামার আগেই জলভরা মেঘ দেবদারু গাছের মাথা থেকে নেমে এল। সাথে এলোমেলো বাতাস। উঠোনের ফেটে ওঠা মাটির বুকে যতটুকু ধুলো, তাতে বৃষ্টির জল পড়তেই বাতাসে মিশল সোঁদা ঘ্রাণ।
“ও গিন্নি, ঘরে এস। বৃষ্টির ছাটে ভিজে যাচ্ছ তো।”
তা কী করে হয়? ঠাকুমা কলতলায় সেই কখন গিয়েছে। এখনও তো বের হল না। শুধু বৃষ্টি হলে তবুও হত, সাথে কেমন এলোমেলো বাতাস।
“ও ঠাকুমা, ও ঠাকুমা…”
আমার বুক থেকে উঠে আসা ডাকটা এলোমেলো বাতাসে এদিক ওদিক ঘুরে হারিয়ে যায়।
মা আমাকে হাত ধরে ঘরের ভেতর আনল,
“বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধালে বাবা বকবে মনি, আর ক’দিন আছে জানো তো তুমি।”
বাইরের হু হু বাতাস, বৃষ্টির জলে পেয়ারা পাতার নৌকা হয়ে ভেসে যাওয়া হুট করে আমার মন থেকে হারিয়ে যায়। আমি অস্পষ্ট স্বরে বলি,
“আমি শহরে ফিরবো না।”
সে সব শব্দ মা পর্যন্ত পৌঁছাত কই?
ঠাকুমার পূজার ঘরে বাতি জ্বলে ওঠে।
আকাশের কালোমেঘের ছায়া দেবদারু বাগানের ছায়ায় মিশে পুরো পাড়ায় কেমন আঁধার নামিয়ে এনেছে। যদিও বেলা বুজতে এখনো বেশ দেরি।
আজ ঠাকুমার একাদশী। এসব দিন ঠাকুমা আগবেলা নির্জলা থাকে। বারবেলায় সব কাজ সেরে স্নান করে ঠাকুরঘরে গোবিন্দকে সাবুর ফলার সাজিয়ে তারপর নিজে খায়। তবে আজ ঠাকুরঘরে সব নেবার আগে আলাদা পাথর বাটিতে দুধে ভেজানো সাবু, কোরা নারকেল, ক্ষীরের সন্দেশ, একটা বারোমাসি আম আর আমাদের গাছের চন্দন কবরী কলা আলাদা করে সরিয়ে রাখে ঠাকুমা,
“কোহিনূরদের বাড়িতে দিয়ে আসিস।”
ঠাকুমা পূজোয় বসে যায়।
বাতাস কমে গেলেও বৃষ্টি ধরার নাম নেই। আছরের আজান সেই কখন হয়ে গেছে। মনিপিসি আর অপেক্ষা করে না। দাদুর অ্যাটলাস ছাতাটা নিয়ে বাইরবাড়ির বারান্দা থেকে নেমে পড়ে।
আর মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে আমিও। কেন যাব না? আজ সারাদিন ও বাড়িতে আমার একবারও যাওয়া হয়নি যে!
তেজপাতা গাছ পেরিয়ে সুপারি বাগানের ভেতর দিয়ে আমি আর মনিপিসি এগোই।
গোলেনূরদাদি বড়ঘরের জলচৌকিতে মাদুর পেতে ইফতার সাজাচ্ছে। খেজুর, বুট বিরন আর ডালের বড়া।
মনিপিসির হাতে দুধে ভেজানো সাবু দেখে গোলেনূরদাদির স্বগোতক্তি,
“আমার আম্মা ইফতারে সাবু মাখা দিত আমগোরে, আর এখন বৌ দেয় সাবু। বৌ কিচ্ছু ভোলে না কইলাম।”
গোলেনূরদাদি হাত বাড়িয়ে সব নিতেই কোহিনূরফুফু আমার হাতে ধরিয়ে দেয় অড়হর ডালের বড়া,
“ঝাল লাগলে ঠাকুমার কাছ থেকে বাতাসা চেয়ে খাস।”
আমরা আর দাঁড়াই না। কোহিনূরফুফুদের বাইরবাড়ি আসতেই আমাদের বাড়ির খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পাই ঠাকুমা তুলসীমঞ্চে জল দিচ্ছে।
আমি মনিপিসির ছাতার তোয়াক্কা করি না। বাইরবাড়ির বারান্দায় উঠতেই মা আঁচলে আমার মাথা মোছে। আমি চটজলদি মুখে পুরে নিই কোহিনূর ফুফুর দেওয়া ডালের বড়া।
ডালের বড়াটা মুখে পুরতেই ঝালে জল জমে আমার চোখে। ঠাকুমা ডেকে কাছে বসায়। চন্দন করবী কলা, বারোমাসি আমের টুকরো, নারকেল কোরা, কিশমিশ, আর মোদক মিষ্টান্নের ক্ষীরের সন্দেশ দিয়ে দুধে ভেজানো সাবু মাখিয়ে আমার হাতে দেয়,
“খাও দিদি, মুখ জুড়াবে।”