আমি ভেবেছিলাম আজ শপ-লিফ্টারদের গল্প বলবো। ক'বছর আগে আমি গোয়েন্দাগিরির ট্রেনিং নিয়েছিলাম। ইয়ার্কি না, সত্যিই নিয়েছিলাম। সেই সময়ে শপ-লিফ্টারদের নিয়ে অনেক কিছু শিখতে হয়েছিলো। তা সেই গল্প লিখতে বসে দেখি ব্যাপারস্যাপার অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। কেবলই সেই ঘ্যাঁঘাসুরের গল্পের যদু আর গোষ্ঠর মত জলে চলা- ডাঙায় চলা জাহাজ বানাতে গিয়ে এ হয়ে উঠছে 'সরেস গামলা'! যতই লিখতে যাই চোরদের কথা, কেবল এদিক ওদিক থেকে ছায়া ছায়া মত পুরাণের লোকগুলো উঁকিঝুঁকি মারে! কে জানে, আগের গল্পের পাঠকদের মধ্যে ঘ্যাঁঘাসুরের গল্পের সেই ছোট্ট বুড়োমানুষটিই ছিলেন কিনা। পুরাণের গল্প পড়তে পড়তে কোন সময়ে হয়তো বলে বসেছেন "তাই হোক"!
আচ্ছা, তাইই হোক তাহলে। চোরের গল্পটা আপাতত তুলে রাখি। এই যে লোকগুলো আনাচ কানাচ থেকে মুণ্ডু বাড়াচ্ছে এদের কথাই হোক। আজকে আমার একটা রোমান গল্পের কথা খুব মনে হচ্ছে। নলঘাসের বাঁশি আর ময়ুরের পেখমের গল্প। আর অবশ্যই দেবতাদের পেজোমির গল্প। ঐ জিনিস বাদ দিয়ে পুরাণ হয় না! কোন দেশেই না।
বলছিলাম গল্পটা রোমান। এই রোমান আর গ্রিক পুরাণ নিয়ে আবার একটা মজার ব্যপার আছে। গ্রিক মাইথোলোজির যেসব দেবদেবী, তাঁদেরই আবার একটা করে রোমান সত্তা আছে। যেমন গ্রীসে দেবরাজ জিউস। তাঁরই রোমান সত্তা হলো জুপিটার। রানি হেরা গ্রিক, কিন্তু রোমানে তাঁর নাম জুনো। তেমনিই অ্যাথেনা হলেন মিনার্ভা, হেফেস্টাস ভাল্কান, হার্মিস হলেন মার্কারি, অ্যারিস মার্স। অদ্ভুত না? এর কারণ কী, কী বৃত্তান্ত সেই গোলোকধাঁধায় আজ ঢুকছি না। পরে কোনো একদিন সেই নিয়ে আলোচনা করা যাবে। বলেছি তো আজ সেই বাঁশি আর ময়ূর পাখার গল্প। অবশ্য গল্পের শুরু একটা গরুকে নিয়ে। গল্পের গরু, প্রায় গাছেই উঠবে। দেখো তখন।
এখুনি বললাম কিনা দেবতাদের রানির নাম জুনো? তা সেই জুনো একদিন বিকেলবেলা তাঁর সুন্দর বারান্দায় বসে চুল বাঁধছেন। না, হয়তো সত্যি করে চুল বাঁধেননি। কিন্তু দেবতাদের রানি সেলিব্রিটি ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছেন বা কার পেছনে লাগা যায় সেই বসে ভাবছেন বললে ঠিক ভালো শুনতে লাগে না। তাই লিখলাম চুল বাঁধছেন। তো এমন সময় হঠাৎ চারদিক কালো করে মেঘ ঘনিয়ে এলো। অমন সুন্দর বিকেলের দফারফা। এমন মেঘ, এমন মেঘ, যে চারপাশে কিছুই দেখা যায় না!
ব্যাপার বুঝতে জুনোর সময় লাগলো না। মেঘ বিদ্যুতের কলকাঠি তো একজনেরই হাতে। তিনি হলেন বজ্রবিদ্যুতের দেবতা, রাজা জুপিটার। জুনোর কর্তামশাই স্বয়ং! নিজের স্বামীর স্বভাব-চরিত্র রানি ভালোই জানেন। এর মধ্যে কোনো নারীঘটিত ব্যাপার আছে তাতে তাঁর সন্দেহ নেই। যাতে কেউ কিছু দেখতে না পায় তাই মেঘ দিয়ে সব ঢেকে দেওয়া। কিন্তু ঐরকম ছেলেমানুষি ফিকির দিয়ে যে বৌ এর চোখে ধুলো দেওয়া যায়না সে বুদ্ধি কোনদিনই কোনো স্বামীর হলো না! সে যুগেও ছিলোনা, খোদ দেবরাজেরও না!
জুনো তরতর করে নেমে এলেন। জুপিটার তো এদিকে নদীর ধারে, সুন্দর হাওয়ার মধ্যে তাঁর বান্ধবীর সাথে বসেছিলেন। মানে জুনো যেমন 'চুল বাঁধছিলেন' তেমনিই এঁরাও 'বসেছিলেন' ধরে নাও না! সেই বান্ধবী একজন জলপরী। স্বয়ং নদীর দেবতা ইনাকাসের মেয়ে। তাঁর নাম 'আয়ো'। রানির পায়ের আওয়াজ পেয়েই জুপিটার দেখেন কম্ম কাবার! ধরা পড়ার ভয়ে তিনি চট করে আয়োকে একটা গরু বানিয়ে দিলেন। একটা দেবরাজ হয়েও কী বুদ্ধির ছিরি! বানাতে হয় একটা ভালো কিছু বানা। তা না, অমন সুন্দর মেয়েকে একটা গরু? রুচিরও বলিহারি!
যাই হোক, বানিয়ে তো দিলেন একটা গরু। জুনোও এদিকে কম যান না। তিনি গরুটাকে দেখেই ভারী মিষ্টি হেসে রাজাকে বললেন-- "ওমা, এমন চমৎকার গরু এখানে কোত্থেকে এলো গা? দাও না, আমাকে গরুটা দাও। কী সুন্দর দেখতে। আমি পুষবো।"
জুপিটার তো বুঝেছেন অবস্থা মহা বেগতিক! কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে তিনি আর কী করেন? গরুদান করতে বাধ্য হলেন। বেচারি আয়োর কী দুর্গতি! মনোরম বিকেলে, রোম্যান্টিক অভিসার উঠলো মাথায়। সুন্দরী জলপরী এক লোমশ, শিঙাল, দশাসই চেহারার গরু হয়ে জুনোর খোঁয়াড়ে বন্দি হলেন।
না, শুধু খোঁয়াড়ে বন্দি করলেই হয়না। গরুটাকে চরাতেও হবে। জুনো সে কাজের ভার দিলেন আর্গাসকে। এই আর্গাসের হাজারটা চোখ! সারা শরীরময় চোখগুলো বসানো। মাথার পেছনে, হাতের মুঠোয়! তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সত্যি অসম্ভব। তার ওপর আবার চোখগুলো ঘুমোয় পালা করে। সবকটা একসাথে বন্ধ হয়েছে এমন কখনোই হয় না। কাজেই তাকে এড়িয়ে পালাবে এমন কারুর সাধ্যি নেই! আয়ো যে কী করবেন ভেবে পান না।
আর্গাস তাঁকে নিয়ে গেছে জল খেতে নদীর ধারে। ঐ নদীই তো আয়োর বাবা। জলের মধ্যে তাঁর ভাইবোনরা রয়েছে। আয়ো মনেমনে তাঁদের ডাকেন। প্রাণপণে ডাকেন। মনের ডাক কে শুনতে পাবে? কিন্তু তাছাড়া উপায়ই বা কী? মুখ খুললেই যে বিকট "হা-ম-বা-আ-আ" আওয়াজ বেরোয় তা শুনে সবাই চমকে ওঠে! এমনকী আয়ো নিজেও! নদীর দেবতাও ওদিকে চিন্তায় অস্থির। মেয়ে কোথায় হারিয়ে গেলো? কোথাও তার খোঁজ মেলে না।
শেষে, অনেক মাথা খাটিয়ে, বহু কষ্টে আয়ো একদিন নদীর বালির মধ্যে ক্ষুর দিয়ে নিজের নাম লিখলেন। তাই দেখে ইনাকাস একেবারে থ! তাঁর অমন সুন্দর মেয়ের এই দশা? রাগে দুঃখে নদী ফুঁসে ওঠে, উত্তাল ঢেউ ধেয়ে আসে। কিন্তু দেবতাদের রাজারানির কাণ্ড; তার বিরুদ্ধে কে কী করবে? সারা দুনিয়া জুড়ে সব নদীর জল পাগলের মত তীরের পাথরে আছড়ে পড়ে। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে, মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে, খোঁয়াড়ের মধ্যে ভিজে খড়ের সোঁদা গন্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে আয়ো নীরবে কাঁদতে থাকেন (এত করুণ কাহিনীর মধ্যে ফচকেমি করার মত পাপ আর নেই, তবু আর কী, গুদামের পাট থাকুক আর না থাকুক, 'গরু কেবলই কান্দিতেছে' দশা হয়)!
জুপিটারের মনটাও ক'দিন ধরে বড় উচাটন! আয়োর জন্য মন কেমনও করছে,অনুতাপও হচ্ছে, রানির কাছে হেরে গেছেন বলে লজ্জাও কী আর হচ্ছে না? আয়নার সামনে দাঁড়ালেই ভেতর থেকে দাড়িঅলা অন্য লোকটা হয় দাঁত কিড়মিড় করে নয় দুয়ো দেয়! দেবরাজ ভেবেভেবে কূল পাননা কী করে অবস্থা সামালানো যায়। শেষটা আর থাকতে না পেরে তিনি মার্কারির শরণ নিলেন। মার্কারি কে জানো তো? গ্রীসে এঁর নাম হার্মিস। ভ্রমণের দেবতা, পথিকদের দেবতা। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে তাঁর অবাধ যাওয়া আসা। তাই ইনি দেবতাদের মেসেঞ্জারের কাজ করেন। মেসেঞ্জারের বাংলা ‘বার্তাবাহক’, কিন্তু ঐ শব্দটা তো চলতি ভাষায় কেউ আর বলে না!
মার্কারির একজোড়া জুতো আছে, তার মধ্যে ডানা বসানো। সেই জুতো পায়ে দিলে ত্রিভুবনের যেকোনো জায়গায় যাওয়া যায়। একটা জাদুদণ্ডও আছে। সেই দণ্ড দিয়ে কত কী যে করা যায় তার ইয়ত্তা নেই! সে জাদুদণ্ডের নাম 'ক্যাডুসিয়াস'। তাকে নিয়েই একটা আলাদা গল্প লিখে ফেলা যায়। সে হবে খন, অন্য একদিন।
জুপিটার গিয়ে ধরলেন মার্কারিকে। তিনি শুনেছেন ঐ জাদুদণ্ড দিয়ে নাকি যেকোনো লোককে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া যায়। তা ঐ হাজার চোখো রাখালটার চোখগুলো যদি একসাথে একবারটি ঘুমোয় তাহলে জুপিটারের বড়ই উপকার হয়! ইত্যাদি। রাজার অনুরোধই আদেশ। সে ঠেলার সাধ্যি মার্কারির আছে নাকি? কাজেই ডানাঅলা জুতোজোড়া পায়ে দিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন।
দেবরাজ তো বলেই খালাস। শুধুশুধু ক্যাডুসিয়াস দিয়ে ঘুম পাড়ানো সে অন্য যে কাউকে যেতে পারে। কিন্তু আর্গাসের বেলায় সে জিনিস কাজ করবে কেন? মার্কারি চেষ্টা করেননি তা তো নয়! কিন্তু ঐ; শতখানেক ঘুমোলো, বাকিগুলো দিব্যি তাকিয়ে তাকিয়ে এদিক ওদিক দেখছে! যেদিক থেকে, যেমন করেই জাদুদণ্ড ঘোরাননা কেন, সবকটা চোখ কিছুতেই ঘুমোয়না। মার্কারি মাথা চুলকান। ইনাকাস দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আয়োর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
অনেক ভেবে ভেবে মার্কারি শেষে এক বুদ্ধি স্থির করলেন। নিজে সাজলেন এক রাখাল। সঙ্গে তার একপাল ভেড়া। ডানাজোড়া লুকিয়ে রেখে জাদুদণ্ডটাকে একটা বাঁকানো রাখালি লাঠির মত করে নিলেন। আর আমাদের চেনাজানা রাখালদের মত তাঁরও সাথে রইলো একটা বাঁশি। আড়বাঁশের নয়। নলঘাসের বাঁশি। তারও নাম আছে। সিরিংক্স। কেউকেউ প্যান্ডিয়ান পাইপও বলে। দেখো, জাদুদণ্ডের নাম আছে, আর বাঁশির থাকবে না তাই হয় নাকি?
সেই বাঁশিতে অদ্ভুত এক মিষ্টি সুর বাজাতে বাজাতে মার্কারি-রাখাল চলেছেন। ভেড়াগুলো কেউ দুদ্দাড় করে, কেউ নিড়বিড় করে সঙ্গে চলেছে। আর্গাস তাঁকে দেখতে পেলো। ঐ বাঁশির সুরে কী যেন আছে! আর্গাসের কয়েকশো চোখে ঘুম নেমে আসে। মনের ওপর একটা ঠান্ডা প্রলেপ পড়ে যায়। বুকের ভেতরে অনেকদিন আগে ভুলে যাওয়া ভালোলাগারা, মনখারাপরা চুপিচুপি কথা বলতে থাকে। বাঁশির শব্দের মধ্যে কে যেন ভাষাহীণ ভালোবাসার গল্প বলছে। বিচ্ছেদের গল্প। আপনজনকে হারানোর গল্প, পাওয়ার গল্প।
আর্গাস মার্কারিকে ডাক দিলো -- "এই রোদ্দুরে ভেড়া নিয়ে চললে কোথায় সুজন? এখানে দু-দণ্ড জিরিয়ে যাও না। ভেড়াগুলোও একটু বিশ্রাম নিক। তুমিও এসে আমার এই গাছের নীচে ছায়ায় একটু বসে যাও।"
ভেড়াঅলা মার্কারি খুশি হয়ে আর্গাসের সাথে ছায়ায় গিয়ে বসেন। কতগুলো চোখ ঘুমোচ্ছে, কতগুলো চোখ ঢুলছে, আরো বেশি চোখ পটপট করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। আর্গাস তাঁর বাজানোর প্রশংসা করে, সুরের প্রশংসা করে। মার্কারি বললেন -- "বাজানোতে আমার কোনো বাহাদুরি নেই ভাই। এ বাঁশিই জাদুর বাঁশি। মরমী বাজিয়ে পেলে আপনি সুর তৈরি করে নেয়।" আর্গাসের ভারী কৌতূহল হলো!
"বটে? জাদুর বাঁশি কেমন করে হলো? সিরিংক্স নামই বা কেন?"
মার্কারি গল্পটা বলতে শুরু করলেন -- "সিরিংক্স ছিলেন বনের পরী। দেবী ডায়ানার সহচরী।" ডায়ানা কে জানো তো? চাঁদের দেবী। সূর্যদেব অ্যাপোলোর যমজ বোন। গ্রিকরা ওঁকে আর্টেমিস বলে ডাকে। তো এই ডায়ানার বান্ধবী সিরিংক্স অসামান্য সুন্দরী ছিলেন। কত দেবতা, কত মানুষ, প্রকৃতির কত স্পিরিট (এর বাংলা কী করবো? পরীই বলি আমি এদের, সব পরীই মেয়ে হয় না কিন্তু।) যে তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয় তার ঠিকঠিকানা নেই। তাদের প্রেম-নিবেদনের চোটে সিরিংক্স অস্থির! যেভাবেই “না” বলো, যতই উপেক্ষা করো লোকগুলো তাঁর পিছু ছাড়ে না। বেচারী সিরিংক্স পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান।
শেষে একদিন তাঁর পেছনে লাগলেন প্রকৃতিদেব স্বয়ং। তাঁর নাম 'প্যান'। বিশ্রী নাম সন্দেহ নেই। প্যান আবার একটা নাম হলো? কিন্তু দেবদেবীদের নাম নিয়ে ওজর তুলবে, কার ঘাড়ে কটা মাথা! সেই প্যানের শরীরের নীচের অংশটা ছাগলের মত, মাথাতেও পাকানো দুই শিং। প্রকৃতিরই দেবতা, বনের পরী তাঁর কাছ থেকে পালিয়ে কোথায় গিয়ে লুকোবে? তাছাড়া শুধু দেবতাই নন, ইনি এক মস্ত জাদুকর! প্রকৃতির থেকে বড় জাদুকর আর কেউ আছে নাকি? সিরিংক্স যেখানেই যান, প্যান ঠিক তাঁকে খুঁজে বের করেন। রাগ, বিরক্তি, অনুনয় কোনকিছু দিয়েই সিরিংক্স তাঁকে নিরস্ত করতে পারেননা। প্যান নাছোড়বান্দা!
একদিন বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত হলো। প্যান সিরিংক্সকে জোর-জবরদস্তি করে হলেও ধরবেনই। বনপরী প্রাণপণে ছুটে পালাচ্ছেন আর লোভী দেবতা পেছনে দৌড়ে আসছেন! সিরিংক্স দেখেন সামনে খরস্রোতা নদী। তিনি কোনো উপায় না দেখে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এদিকে হয়েছে কী, ঐ নদীর মধ্যে থাকতো জলপরীদের দল। তারা সিরিংক্সের বন্ধু। ওরা ওঁর দুঃখ বুঝতে পেরেছে। বান্ধবীকে তারা এভাবে মরতে দেবে কেন? জলপরীরা জাদু করে সিরিংক্সকে বানিয়ে দিলো একগোছা নলঘাস। জলের মধ্যে কেমন নলখাগড়া জন্মায় দেখোনি?
প্যান ততক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। যে সিরিংক্সকে পাবার জন্য তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তাকে চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেললেন! যা কিছুকেই তুমি জোর করে ধরতে চাইবে, তাইই তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে, এটাই তো নিয়ম। চিরকালই। দুঃখে প্যানের বুকের ভেতর উথালপাথাল করতে লাগলো। প্রকৃতির দেবতা জলে নেমে আস্তে আস্তে সেই নলঘাস তুলে নিয়ে এসে, নিজের সমস্ত জাদু ঢেলে এই বাঁশি তৈরি করলেন। বাঁশির সুরে প্যানের মন্ত্র কাজ করে। বাঁশির সুরে বুক-ভাঙা দেবতার দুঃখ ভালোবাসার গল্প, হারানোর গল্প বলে। দুঃখী মানুষের মনের মধ্যিখানে হাত রাখে। ক্লান্ত মানুষের চোখে ঘুম আনে। জাদুর বাঁশি। তার নাম 'সিরিংক্স', কিম্বা 'প্যান পাইপ'। প্যানের বাঁশি।
জাদু কাজ করছিলো ঠিকই। বাঁশির জাদু, গল্পের জাদু, মার্কারির ক্যাডুসিয়াসের জাদু। সব একসাথে। গল্প শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মার্কারি দেখলেন আর্গাসের সব চোখ বুজে গিয়েছে। একসাথে। লক্ষ বছর ধরে জেগে থাকা ক্লান্ত আর্গাসের চোখে শেষ অব্দি নিদালীর জাদু নেমেছে। মার্কারি উঠে পড়ে এক কোপে ঘুমন্ত লোকটার মাথা কেটে ফেললেন -- "পাহারা দেওয়া ঘুচলো তোমার চক্ষুষ্মান! ডিডনট সি দ্যাট কামিং, হাঁ?"
নিরপরাধ আর্গাস, বিশ্বাসী আর্গাস, বন্ধু আর্গাস, জাদুর গল্প শুনতে গিয়ে ঘুমের মধ্যে আরো গভীর ঘুমে চিরদিনের জন্য তলিয়ে গেলেন। বলেছিলাম না দেবতাদের পেজোমি ছাড়া কোনো পুরাণ হয় না?
মার্কারির কাজ সম্পূর্ণ হলো। জুপিটারের মনের সাধ মিটলো। জুনো বুঝতে পারলেন এমন কাণ্ডটা কে ঘটিয়েছে। কিন্তু প্রমাণ নেই, সাক্ষী নেই। কাকে শাস্তি দেবেন তিনি? তাছাড়া দেবরাজকে পাকে ফেলতে গিয়ে হয়তো একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে! ক্ষমতাধারীদের বেশিদিন দাবিয়ে রাখা যায় না। কোথাওই।
নিঃশ্বাস ফেলে জুনো বিশ্বস্ত আর্গাসের নিথর শরীর থেকে চোখগুলো তুলে এনে নিজের পোষা ময়ূরের পেখমের মধ্যে বসিয়ে দিলেন। ময়ূর জুনোর প্রতীক, পবিত্র পাখি। ওর মধ্যে দিয়ে বেচারা আর্গাস চিরজীবন বেঁচে থাক। আর কেউ যেন কোনদিন তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে না পারে।
কিন্তু দেবতাদের রানি, তাঁর রাগও সামান্য নয়! জুনোর সমস্ত কোপ গিয়ে পড়লো আয়োর ওপরে। তাকে শাস্তি দেবার জন্য জুনো মস্ত একঝাঁক পোকা পাঠিয়ে দিলেন। সেগুলো কেবলই কামড়ায়, চোখে নাকে ঢোকে, এখানে ভিনভিন, ওখানে ভিনভিন। তারা আয়োকে অস্থির করে তুললো। আয়ো কী করেন! এত কাণ্ড করেও তাঁর কষ্টের আর শেষ হয় না।
তিনি পোকার হাত থেকে বাঁচার জন্য পাগলের মত সমুদ্রে ডুব দেন। তাঁর নামে সেই সমুদ্রের নাম হলো আয়োনিয়ান সি। তিনি পালিয়ে বেড়ান। পাহাড়ের চূড়ায়, ধু ধু তেপান্তরের মাঠে, নদীর পাড়ে পাড়ে, দেশ থেকে দেশে। সারা দুনিয়া দৌড়ে বেড়ান, পোকার দল তাঁকে একদণ্ড তিষ্ঠোতে দেয় না।
জুপিটার আর থাকতে পারলেন না। অবস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছোচ্ছে? এভাবে তো আর চলে না! তিনি গিয়ে সরাসরি জুনোর সাথে কথা বললেন -- "ছেড়ে দাও ওকে রানি। কথা দিচ্ছি ওর সাথে আর সম্পর্ক রাখবো না।" দেবতাদের প্রতিজ্ঞায় কতটা বিশ্বাস করা যায় তাতে সন্দেহ আছে বটে। তবু কোনো কারণে জুনো মেনে নিলেন কথাটা। হয়তো ততদিনে এই খেলা তাঁর কাছেও পুরোনো হয়ে গেছে। এতে আর তেমন কোনো মজা নেই।
যাহোক, জুপিটারের সাথে শর্তে এসে জুনো আয়োকে মুক্তি দিলেন। অভিশাপ কেটে গেলো। আস্তে আস্তে, একটু একটু করে মস্ত গরুটার লোম ঝরে পড়তে লাগলো, শিং মিলিয়ে গেলো। ক্ষুর আর লেজ উধাও হয়ে সুন্দর লতানে হাত-পা ফিরে এলো। দিনে দিনে, মাসে মাসে আয়ো তাঁর আগে রূপ ফিরে পেলেন। সুন্দরী জলপরী এতদিন পরে ভুল লোককে ভালোবাসার শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে, নদীর গভীরে নিজের লোকদের কাছে ফিরে গেলেন।
তাহলে বলো এবার, চোরের গল্পের থেকে কি খুব মন্দ হলো? এই গল্পটা?
বেড়ে হয়েছে। দারুন লাগলো।
তবে গোয়েন্দা গিরি শেখার গল্প টাও শুনতে চাই। ব্যাপারটা কি, কিভাবে শিখলেন। সঅব।
খুব মনখারাপ হল। দেখো সেই মেয়েগুলোই কেবল শাস্তি পায়। জুপিটারও তো সমান দোষে দোষী তার কোনওই শাস্তি হল না। এদিকে আয়ো এত শাস্তি পেল। আর্গাস বেচারি বিনা দোষে মরেই গেল।
কি অন্যায় কি অন্যায়!
বাহ, মচৎকার হইয়াছে। আবার এই জুপিটার এট আলের সঙ্গে আমাগো ইন্দ্র এট আলের বেশ মিল পাই।
ইন্দ্ররও সারাগায়ে চোখ ছিল। অ্যাকচুয়ালি লুচ্চামি করতে গিয়ে ধরা পড়ে ঋষির অভিশাপে সারাগায়ে স্ত্রীযোনী চিহ্ন গজিয়েছিল। তাপ্পর কান্নাকাটি করে সেটাকে চোখে কনভার্ট করায়। কিন্তু তার মাথা কে কাটে নি।
কিন্তু আর্গস এক্কেবারে নাম রীহ কর্তব্যপরায়ণ
ওহ্হ্হ্হ কেকে! তুমি গোয়েন্দাগিরির ট্রেনিং নিয়ে গোয়েন্দা হয়েছিলে? এখনও গোয়েন্দা আছো????
আচ্ছা কেকে, পরে ওই আয়ুষ্মতী আয়োর কার সঙ্গে বিয়ে হল? ছেলেপিলে কারা হল? তাঁর বংশেই তো হরকৈলাশ সরি সরি হারকিউলিস জন্মালেন বেশ কয়েক প্রজন্ম পরে, তাই নয়?
খুব ভালো। ছোট্ট মন্তব্য, "মেসেঞ্জারের বাংলা ‘বার্তাবাহক’, কিন্তু ঐ শব্দটা তো চলতি ভাষায় কেউ আর বলে না!" -এর প্রেক্ষিতে। মেসেঞ্জারকে দূত-ও বলা যায়। আর সেটির ব্যবহারও হয়ে থাকে। এই বাজারে শ্রীরাম-দূত হনুমানকে ভোলা যায়?
সবাইকে থ্যাংকু :-)
রমিতবাবু,
হ্যাঁ, ঐ গোয়েন্দাগিরি। আমার আসলে পড়ার ইচ্ছে ছিলো ক্রিমিনাল জাস্টিস। কিন্তু তার জন্য যে পরিমাণ সময় আর অর্থ দিতে হত তা সেই মুহূর্তে আমার বাজেটের বাইরে হয়ে যাচ্ছিলো। তো মনখারাপ করে ফিরেই আসতাম কিন্তু কেরিয়ার কাউন্সেলর বললেন যে ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন পড়া যেতেই পারে। উনি ভালো করে বুঝিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে সেটা সবদিক থেকেই আমার আয়ত্বের মধ্যে থাকছে। তাই তাতেই নাম লিখিয়েছিলাম। গল্পের গোয়েন্দাদের থেকে বাস্তবের গোয়েন্দাদের কত তফাৎ সেটা দেখে বেশ মোহভঙ্গ হয়েছিলো বটে, কিন্তু তা বাদ দিলে প্রচুর ইন্টারেস্টিং ব্যপার আছে। বলবো খন সময় সুযোগ দেখে।
অ্যান্ডর,
হ্যাঁ, গোয়েন্দা আছি এখনও। মানে সার্টিফিকেটটা আছে আর কী। তবে প্র্যাকটিস করিনা, তাই লাইসেন্স রিনিউ করাইনি। আমার তো শীর্ষেন্দুর 'গোলমেলে লোক' এর গুরুপদ'র মত স্বভাব। অনেক বিদ্যেই শিখে রাখি, কিন্তু পেশা হিসেবে সেগুলো কাজে লাগানো হয়না। উপযুক্ত গুরু পেলে পকেটমারিও শেখার ইচ্ছে আছে :-D
ও হ্যাঁ, আয়োর পরবর্তী জীবনের গল্পও তো আছে অনেক। কিন্তু এখনই তো মনে নেই! আবার বই নামিয়ে দেখতে হবে।
দ দি, শঙ্খ,
ইন্দ্রর সেই অনেক চোখ নিয়ে আরেকটা গল্পও ছিলো না? সেই কোন যেন এক অসুরের বা দৈত্যের চোখে ধুলো দেবার জন্য দেবতারা একেক্জন একেক রকম পাখি সেজে কোন এক পাহাড়ে লুকিয়েছিলেন। বরুণ বোধহয় হাঁস হয়েছিলেন, যম হয়েছিলেন কাক। আর ইন্দ্র ময়ূর। ওঁর গায়ের ঐ চোখগুলো তখন পেখমে আঁকা হয়ে গেলো। এরকম কিছু ছিলো না? 'ইন্দ্র' তো পোস্টটার নাম। ঐ ইন্দ্রর নাম ছিলো 'শত্রু'। তাইনা?
:|:
হ্যাঁ ঠিক ঠিক। দূত! দেখুন আপনাকে অনেকে ভাটে 'চতুরানন', 'চতুর্মাত্রিক' এইসব নামে ডাকেন। আমার আবার আপনার নাম কথায় প্রকাশ করলে মনে আসে 'ফুটিচার' :-)
কেকে, শক্র । শত্রু না ।
ফুটিচার কে তাড়াতাড়িতে পড়লাম ফুটিচোর। ঃ-)
ফুটিচার ভালো আবার চার-ফুটিয়া বললেও খুব বেমানান হবে না। উচ্চতার কথা বলছি ;)
ইন্দ্রের আরেকটা নাম শক্র। শত্রু না। ত-এ র-ফলার আঁকশিটা উল্টো দিকে। চন্ডীতে আছে রাজ্যফাজ্য হারিয়ে দেবীকে খুশী করার জন্য স্তব করেছিলেন যিনি। এই দেখুন চতুর্থ অধ্যায়। https://www.exoticindiaart.com/book/details/sri-sri-chandi-bengali-NZJ591/
অ্যাঃ, শক্র। শত্রু না, শত্রু না! (লজ্জায় মুখ ঢাকন)
একটু দেখুন তো, তাঁর কি সবুজ দাড়ি ছিল?
kk এক অতীব ইন্টারেস্টিং, বর্ণময় চরিত্র। জীবনটিও ঘটনাবহুল; বোধ হয় সেই বর্ধমানের রাজবাড়ি থেকে শুরু :)
একেবারে তাই। তিন-চারখানা বা তারও বেশি উপন্যাস লেখা যায় কেকেকে নিয়ে। কিন্তু খুব শক্তিশালী লেখনী দরকার, অতীব শক্তিশালী লেখার হাত দরকার।
কাশ্যপ বাবুর ছেলে যিনি ইন্দ্র হয়েছিলেন শক্র তো তাঁর আসল নাম। আর ইন্দ্র তো পদ। নহুষ ও ইন্দ্র হয়েছিলেন।
@ :৷:
সেই নহুষের ছেলেই যযাতি আর যযাতির ছেলে আমাদের এই যদুবাবু। ঃ-)
হা হা , বাকি পুরু, অনু, দ্রহ বাবুরা গুরুতে আসলে তো সোনায় সোহাগা
হুঁ, নহুষ ইন্দ্র হয়েছিলেন। গিরগিটিও হয়েছিলেন। রং বদলানো আর কাকে বলে!
গিরগিটি না, সাপ। পরে সম্ভবত যুধিষ্ঠির মুক্তি দেন।
যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ব্যাপক গপ্পোগাছাও করেছিলেন। যুধিদাদা সেই বিরাট সাপের সঙ্গে কথাবার্তা কী করে কইলেন কেজানে!
আরে দুত্তোর! আমি তো দেখছি সবই গুলিয়ে ফেলছি। নহুষ হয়েছিলেন সাপ। আর গিরগিটি হয়েছিলেন রাজা নৃগ। মাথাফাথা গেছে গিয়ে!!
নৃগের কাহিনি জানতাম না। তোমার কল্যাণে জানা হল সার্চিয়ে।
হ্যাঁ, নৃগের কাহিনী পড়লাম। বেশিরভাগ জায়গায় খুব শর্টে লিখেছে। তবে পড়ে মনে হল ওনার তেমন দোষ ছিল না। তবে ওই সময় থেকেই ভারতীয় দের মাথায় ক্যাটল মার্ক করার বুদ্ধিটা আসা উচিৎ ছিল।
আমার প্রশ্ন হল, যিনি অভিযোগ করেছিলেন তিনি তাঁর গরু চিনলেন কী করে? বিশাল গরুর দল, এর মধ্যে কোনটা অন্য দলে চলে গেল, এ তো বোঝা মুশকিল। তবে এমন হতে পারে যে ওই ভদ্রলোকের মাত্র গোটা দশেক বা ওইরকম মতন গরু ছিল, আর উনি প্রত্যেকটাকে চিনতেন, নামও হয়তো দিয়েছিলেন। তাই অন্য দলে মিশে হারিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলেন, ওরে আমার মুংলী কই গেল? পরে দেখেন সোনাবাঁধানো শিং নিয়ে সেজেগুজে মুংলী অন্য কার সঙ্গে চলে যাচ্ছে, নাকি দানের গরু!!!!
মুংলি টা শুনে হেবি হাসি পেলো।
দুর্দান্ত
আর্গাসের জন্য ব্যাথাআআয় মন টা ভরে গেল। কেকে তুই কাঁদাস কেন?