গোড়াতেই একটা কথা খোলসা করে বলে দেওয়া দরকার: জনজীবনের মূল বিষয়গুলো কী সেটা আমরা ঠিক করতে পারি না। সমাজ নানা ভাগে বিভক্ত, সে অংশগুলোর জনজীবনও আলাদা। এখন কোন জনজীবন কোন বিষয়টাকে গুরুত্ব দেবে, সেটা তার বাস্তব অবস্থার ওপর নির্ভর করে। যেমন, ছাত্র-যুবরা চাকরি চাইতে পারে, চাকরিজীবীরা চাইতে পারেন মাইনে বাড়ুক, ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিরা দাবি করতে পারে ব্যবসা বাণিজ্যে আইনি বাধানিষেধগুলো তুলে নেওয়া হোক, কিম্বা ব্যাংক থেকে তাদের নেওয়া ঋণ পুরো মকুব করে দেওয়া হোক। এবার, কিছু অংশের বাস্তব অবস্থার সুবাদে তাদের দাবিগুলো নির্বাচনী প্রচারে জায়গা পেয়ে যায়, সুতরাং আমাদের বলার উপায় নেই যে, জনজীবনের দাবিগুলো একেবারে উপেক্ষিত থেকে গেল। কিন্তু, বহু মানুষ আছেন যাঁরা নিজেদের দাবিগুলো মুখ ফুটে বলেই উঠতে পারেন না, এঁদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁদের দাবি বিষয়ে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। দুর্ভাগ্যের কথা, আমরা যারা নিজের এবং অন্যের মন কী বাত নিয়ে খুব বাতচিত করি, তাদের কাছেও এই দাবি তুলতে না পারা অংশটার গুরুত্ব খুব একটা স্বীকৃতি পায় না।
একটা উদাহরণ হল, বাচ্চারা – বিশেষত সমাজের অসহায় অংশের বাচ্চারা। গেল বছর যখন লকডাউন হল, তখন দেড়-দু মাস ধরে টীকাকরণ হল না – লক্ষ লক্ষ বাচ্চা কিছু খুব জরুরি টীকা পেল না, এবং বিশেষ কিছু রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারল না। এখন এই বাচ্চা বা তাদের মা-বাবা যেহেতু দাবি তুলতে পারেন না, কোনো পার্টির প্রচারে আমরা শুনলাম না যে, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, বাচ্চাদের টীকাকরণ বন্ধ হবে না। আপনাদের মনে করিয়ে দিই, এক সময় আফ্রিকার দুই যুদ্ধরত দেশের মধ্যে একদিনের যুদ্ধবিরতির রফা হয়েছিল, শুধু যাতে বাচ্চাদের টীকাকরণ সম্পূর্ণ করা যায়। তেমনি, গত এক বছর ধরে দেশের সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে রয়েছে। বিপুল সংখ্যক শিশু না পারে অনলাইনে শিক্ষা নিতে না তাদের বাড়ি বা পরিজনে কেউ আছে যে তাদের পড়ার কাজটা জারি রাখতে সাহায্য করতে পারে। কার্যত, কয়েক কোটি বাচ্চা শুধু যে শিক্ষাবছরটা হারাল, তাই নয়, তাদের বিপুল অংশের জীবন থেকে লেখাপড়ার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। অথচ, সরকারি বা বিরোধী কোনো দলের কর্মসূচিতে এই জিনিসটা আসল না। তেমনি উঠল না মিড ডে মিলের প্রসঙ্গটা, স্কুলে তারা যে খাবারটুকু পেত সেটা থেকেও তাদের বঞ্চনার কথা।
আর একটা উদাহরণ হল, সাধারণভাবে দিন-আনি-দিন-খাই লোকেদের এবং বিশেষ করে সামাজিক ও ভৌগোলিকভাবে প্রান্তিক মানুষদের ভয়াবহ জনজীবন। লোকালয়ে কাজ নেই। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার দশটি ব্লকে সীমিত আকারে করা একটি সমীক্ষায় ২৫০ জনের মধ্যে ডাক্তারি পরীক্ষায় সিলিকোসিস ধরা পড়েছে। এঁদের অনেকে মারা গেছেন, অনেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে বেঁচে আছেন। এই অঞ্চল থেকে আসানসোল, জামুড়িয়া, মহম্মদবাজার, প্রভৃতি অঞ্চলে পাথর খাদানের কাজ করতে যাওয়া আরো ৭০০ জনের মধ্যে সিলিকোসিসের উপসর্গ পাওয়া গেছে, রোগনির্ণয়ের প্রক্রিয়া চলছে। এই সব জায়গার কয়েক হাজার লোক পাথর খাদান, সিমেন্ট কারখানা, মার্বেল পাথরের কাজ, নির্মাণ শিল্প এবং দাদন পদ্ধতিতে ইটভাটার কাজের সঙ্গে যুক্ত – একপ্রকার বাঁধুয়া মজদুর। আজ সকালে কথা হচ্ছিল আমাদের বন্ধু স্বরূপ বিশুইর সঙ্গে, ওর গ্রামের বাড়ি বেলপাহাড়ির কাছে। সেখানে আছে ঢাঙ্গিকুসুম নামে একটা গ্রাম। শ’খানেক ঘর – জনসংখ্যা কমবেশি চারশ; ৯০% আদিবাসী, ১০% দলিত। সাক্ষরতার হার ৪৭% (পু ৫৬%, স্ত্রী ৩৮%)। জনগণনার তথ্য বলছে এই গ্রামে এক জন বাদ দিয়ে কেউই বছরে ছ মাস কাজ পান না। সারা দিন খেটে যা রোজগার হয় তা দিয়ে পেট ভরে খাবারটুকুও জোটে না। স্বরূপ বলছিলেন, দেখে চোখের জল ধরে রাখা যায় না। ওই রোদের মধ্যে মাথার ওপর ছায়া নেই, মেয়ে-পুরুষরা পাথর কেটে চলেছে, পাথরের গুঁড়ো ঢুকছে, পাশে শুয়ে থাকা বাচ্চা, তার নাকেও গুঁড়ো ঢুকছে। খাবার জল নেই। দূর থেকে নিয়ে আসতে হয়। খাবারের নিশ্চয়তা নেই। একই দশা জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকায়, বীরভূম-মালদা-মুর্শিদাবাদ-উত্তর দিনাজপুরে, কালচিনি-নাগরাকাটা-মাদারিহাটে।
আবার, শুধু কুলতলি ব্লকের মেরিগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৫,০০০ মানুষ ইটভাটার শ্রমিক – তাঁদের জীবনে ছুটি বলে কিছু নেই, থাকতে হয় ছোট ছোট খুপরিতে গাদাগাদি করে। স্বাস্থ্যের অবস্থা ভয়ংকর বিপজ্জনক। অথচ, তাঁদের দেহ বিগড়োলে ডাক্তারের কাছে যাওয়াটাও বিলাসিতা – একদিনের মজুরি কাটা যাবে, ডাক্তার দেখানো বা ওষুধ কেনার খরচ যদি নাও লাগে। সংখ্যায় প্রচুর হলেও ক্ষমতার দিক দিয়ে এঁরা নগণ্য, তাই এঁদের এই বন্দিদশা থেকে মুক্তির উপায়্ নিয়ে ভোটের প্রচার হয় না। কিছুদিন আগে কলকাতা শহরে পাঁচ জন দিনমজুর মারা গেলেন - সাফাইয়ের কাজ করতে গিয়ে, ম্যানহোলে ঢুকে। তাঁদের মৃত্যু নির্বাচনে ছাপ ফেলে না।
লোকে যে কাজ পায় না, আইনে তাদের কাজ দেওয়ার যে স্বীকৃতি আছে সেটাও পায় না, সেগুলো ভোটের প্রচারে জায়গা পায় না। গতবছর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে শুধু দেগঙ্গা ব্লকে ৬০০ জন মানুষ জব কার্ডের জন্য আবেদন করেছেন। এঁরা এতদিন আবেদনটাই করতে পারছিলেন না। মূল ধারার রাজনীতির বাইরে কাজ করে চলা কিছু কর্মীর উদ্যোগে তাঁরা আবেদনটা দিতে পারলেন। তা ছাড়া, এঁদের সহায়তায় আরো সাতশো মানুষ কাজের জন্য আবেদন করলেন। আবেদনপত্র নিতে প্রশাসনের ঘোর আপত্তি ছিল, কিন্তু চাপে পড়ে নিতে বাধ্য হয়। যদিও এখনো তেমন কাজ দেয়নি। উলটে এইসব কর্মী ও স্থানীয় কিছু লোককে গ্রেপ্তার করে, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। এই কর্মীদের উদ্যোগে আলিপুরদুয়ারে দু হাজারের বেশি লোক বিডিও অফিসে জড়ো হন। একইরকম জমায়েত হয়, কোচবিহার ও মালদায়, এবং উত্তর ২৪ পরগণার কিছু ব্লকে। সারা রাজ্য জুড়ে কাজের অধিকার ভাঙার অজস্র ঘটনা ঘটে চলেছে, কিন্তু সেগুলো ভোটের ইস্যু হয় না। আর কাজ চাইতে গিয়ে পুলিশের ডান্ডা খেলে, গ্রেপ্তার হলে, সেগুলো নিয়েও প্রশ্ন ওঠে না, কারণ, অধিকার হারানো মানুষগুলো ক্ষমতার বিচারে প্রান্তিক।
আর একটি উদাহরণ দিয়ে থামব। সেটা হল, মেয়েদের সুরক্ষা, ইত্যাদি নিয়ে প্রচার দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু, যুগ যুগ ধরে মেয়েদের জীবনের মৌলিক একটা অ-স্বাধীনতা চলে আসছে, সেটা হল আইনসিদ্ধ বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়া – যাকে বালবিবাহ বলা যায়। আমাদের রাজ্যে এই রকম বিয়ের অনুপাত ৪২%, দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ – এ ব্যাধির জাত-পাত বা ধর্ম নেই, এমনকি শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব ভাগটাকেও সে পাত্তা দেয় না – বিশেষত গ্রামাঞ্চলে মোটামুটি সব সমাজে বিরাজমান । এর পরিণতি কেবল মেয়েদেরই ভোগ করতে হচ্ছে তাই নয়, সেটা ভোগ করতে হচ্ছে গোটা জনসমষ্টিকে। অথচ, এই ভয়ানক সাংস্কৃতিক পশ্চাদমুখীনতা দূর করার ব্যাপারে কোনো বিজ্ঞাপন দেখি না।
লোকসাধারণের এই অংশগুলো সংখ্যায় বিপুল, অথচ তাঁদের সঙ্গে আমাদের বাক-বিনিময় প্রায় হয়ই না, তাঁদের ভাষা আমরা শেখার চেষ্টা করিনি, আমাদের ভাষা তাঁদের অধরা। এই বিপুল লোকসমষ্টি যেমন একদিকে ভারতীয় গণতন্ত্রের শক্তি, তাঁদের চির-দুর্বল রেখে দেওয়াটাই আমাদের গণতন্ত্রের সব চেয়ে বড় দুর্বলতা। যাঁরা আছেন বলে আমরা আছি, যাঁদের শ্রমে ঘামে এই দেশের নির্মাণ, তাঁদের কথা আমাদের কথায় বড় একটা আসে না, তাই নির্বাচনী প্রচারেও এঁদের স্বার্থ গুরুত্ব পায় না। গণতন্ত্রের চাহিদা ও তার প্রয়োগের মধ্যে এই বিরাট ফাঁকটা আজ ভরাট করে চলেছে এক পশ্চাদমুখী রাজনীতি – যতক্ষণ মানুষের বস্তুজগতের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি নিয়ে আন্দোলন থাকে, তর্ক-বিতর্ক থাকে ততক্ষণ মানুষের মনে কোনো কল্পিত বাস্তবের জায়গা হয় না, সমাজ পরিচ্ছন্ন থাকে। সবল বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাস তাই বলে: আজ খুব সহজে লোকের মধ্যে মুসলমান-বিদ্বেষ প্রচার করা হচ্ছে, কিন্তু, দুর্বল-অসহায় মানুষদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন যখন তীব্র ছিল, তখন কুকর্মীরা সমাজে এই বিষ ঢালার সাহস পেত না। আন্দোলন স্তিমিত হলে, নানা সামাজিক শ্যাওলা সমাজকে জড়িয়ে ধরে – মানুষের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যায়, এবং মিত্রকে শত্রু ও শত্রুকে মিত্র ভেবে বসে।
অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য।
"গণতন্ত্রের চাহিদা ও তার প্রয়োগের মধ্যে এই বিরাট ফাঁকটা আজ ভরাট করে চলেছে এক পশ্চাদমুখী রাজনীতি – যতক্ষণ মানুষের বস্তুজগতের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি নিয়ে আন্দোলন থাকে, তর্ক-বিতর্ক থাকে ততক্ষণ মানুষের মনে কোনো কল্পিত বাস্তবের জায়গা হয় না, সমাজ পরিচ্ছন্ন থাকে। সবল বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাস তাই বলে: আজ খুব সহজে লোকের মধ্যে মুসলমান-বিদ্বেষ প্রচার করা হচ্ছে" - অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য।
একটা রাজনৈতিক দল কে দেখান তো ...যারা কোনো সামাজিক ইসু নিয়ে সোচ্চার ????একটা ?? সবচেয়ে করুন দশা বাম পন্থী দের !!ওনারা তো এখন "secular" পদবি যুক্ত দল কে সঙ্গেনিয়ে প্রমান করতে চাইছেন ওনারা সেক্যুলার ( এতদিন সেক্যুলার হয়তো ছিলেন না তাই ) !! বাকি রা তো সামন্ত প্রভু দের মতো এলাকা দখলের লড়াই তে ব্যস্ত !!চুলোয় যাক মানুষের সমস্যা ......!!