এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • কর্মী সংগঠন ও সংহতির দায়দায়িত্ব

    কুমার রাণা
    আলোচনা | বিবিধ | ০৫ আগস্ট ২০২৩ | ১২৩৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • বিষয়সংকেত
    একটি সমাজ কতখানি অগ্রসর তার একটি মাপদণ্ড হচ্ছে সেই সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রের কর্মীদের জীবনের মান। সেই মান যতটা উন্নত হতে দেখা যাবে সেই সমাজের প্রগতিও ততটাই অবাধ। কর্মীদের জীবনমানের উন্নতি নির্ভর করে তিনটি স্তরের সংহতির ওপর। প্রথমটা হল, তাঁদের নিজেদের মধ্যেকার সংহতি। দ্বিতীয় স্তরটাকে বলা যায় অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মীদের সঙ্গে তাঁদের মৈত্রী। আর তৃতীয়টা হল, সমাজের শিশু থেকে বৃদ্ধ, ছাত্র-ছাত্রী থেকে সংসারসেবী পর্যন্ত, সরাসরি উপার্জনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত নন এমন মানুষদের সঙ্গে গভীর এক বন্ধন। এই ব্যাপক সংহতির ভিত্তি হচ্ছে, নিজের এবং প্রতিবেশীর স্বার্থকে অভিন্ন দেখা, এবং এই অভিন্নতার মধ্যেই নিহিত আছে আমাদের পৃথিবীর টিকে থাকার নিশ্চয়তা। আজকের বিশ্বে কর্মী ও কর্মী সংগঠন সহ ব্যাপক মানুষ যে বিবিধ বিপন্নতার সম্মুখীন তা থেকে মনুষ্য-প্রজাতিকে রক্ষা করবার উদ্যোগে কর্মী সংগঠনগুলির ভূমিকা থাকতে বাধ্য। কর্মীরা সমাজের অগ্রণী অংশ। সংহতির দায়দায়িত্বগুলো কাঁধে তুলে নেওয়ার ব্যাপারেও তাঁদের অগ্রণী হতে হবে।

    এক


    টাটা এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের ৭৭তম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে কিছু বলবার জন্য আপনাদের আমন্ত্রণ পেয়ে আমি একই সঙ্গে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ এবং যারপরনাই সংকুচিত। দেশের প্রাচীনতম কর্মী সংগঠনগুলোর অন্যতম এই সংগঠনের বিপুল প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতি ও অর্জিত অভিজ্ঞতার তুলনায় আমার জ্ঞান অতি তুচ্ছ। সুতরাং আজকের এই সভায় এমন কিছু বোধ হয় বলতে পারব না, যা আপনাদের অজানা। তা সত্ত্বেও আপনাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি এই কারণে যে, জানা কথাগুলোও বারবার বলার প্রয়োজন হয়। এটাই জ্ঞানীদের অভিমত। যে বাস্তবতায় আমরা দিন কাটাই তাকে যদি বদলাবার দরকার হয়, অথচ কাম্য পরিবর্তনটি আসে না, তাহলে পরিবর্তনের প্রয়োজন ও উপায় নিয়ে আমাদের কথা বলে যেতেই হবে। যেমন, আমাদের যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তানুশীলক অমর্ত্য সেনকে বারবার একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, আপনি পুরনো কথাগুলোই বারবার বলে যাচ্ছেন, নতুন কিছু বলছেন না, কেন? তাঁর উত্তরটি অপরিবর্তিত, যতক্ষণ পুরনো সমস্যাগুলো থাকবে ততক্ষণ সেগুলো নিয়ে কথা বলে যেতে হবে, কারণ নতুন কথা বলার জন্য নতুন বাস্তবতার প্রয়োজন।

    আজকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সংহতি, আর তার ধারক কর্মী সংগঠন। সুতরাং ধারক, অর্থাৎ কর্মী সংগঠনের, প্রসঙ্গ ধরেই আলোচনা শুরু হওয়াটা স্বাভাবিক হত। কিন্তু, বর্তমান বিশ্বের আর্থ-রাজনীতিক ও সামাজিক বাস্তবতা আমাদের যে মহাকায় সমস্যার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সেই কথা মাথায় রেখে আজকের বক্তব্যটিকে মানব সমাজে ব্যাপকতর সংহতির দিকটির সঙ্গে যুক্ত করতে চাইব। তাতে যদি গোড়ার দিকে কিছুটা অস্পষ্টতা দেখা দেয়, তার জন্য আমাকে মার্জনা করবেন।

    আমাদের দেশে – এবং পৃথিবীর বহু অঞ্চলে – অপরিবর্তিত থেকে যাওয়া বাস্তবতাগুলোর তালিকা দীর্ঘ। অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, কর্মহীনতা, বৈষম্য, অনাধুনিকতা, ইত্যাদি নানা সমস্যা আমাদের অগ্রগতির পথে বাধা দেয়। তা সত্ত্বেও যে আমরা এই স্থাণুত্ব থেকে মুক্ত হতে পারছি না, তার একটা বড় কারণ সংহতির অভাব। রবীন্দ্রনাথের পথপ্রদর্শক ভাষায়, “আমরা ছাড়া ছাড়া হইয়া নিজের নিজের দায় একলা বহিতেছি। (সমবায়নীতি) দেশের যে-সব সমস্যার কথা আমরা জানি সেগুলোর মধ্যে একটা প্রধান সূত্রই বোধ হয়, নিজের নিজের দায় একলা বহন করার যত্নলালিত প্রবৃত্তি, যার অন্তর্বস্তু হচ্ছে একপক্ষে স্বার্থপরতা ও অহমিকা, এবং অন্যপক্ষে আত্মশক্তির ওপর অনাস্থা ও নিয়তির ওপর সব কিছু ছেড়ে দেওয়া। (এ-বিষয়ে ভারতবেত্তা সুকুমারী ভট্টাচার্যের সুন্দর বিবরণ আছে গাঙচিল প্রকাশিত প্রবন্ধসংগ্রহ তৃতীয় খণ্ডের “নিয়তিবাদের স্বরূপ” রচনায়।) আমার মনে হয়, নিয়তির ওপর সব কিছু ছেড়ে দেবার ব্যাপারটা কেবল শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই প্রবল, তা নয়। যাঁরা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন, দেশ-দুনিয়া দেখার সুযোগ পেয়েছেন, যাঁরা পর-প্রজন্মের সুখী ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও এই প্রবৃত্তি খুবই বলবান। তথাকথিত নিরাপত্তার বেষ্টনী হয়তো বা তাঁদের দৃষ্টিকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে দেয় যে, একান্ত গণ্ডীবদ্ধ ভুবনের বাইরে যে বিপুল বিশ্ব ছড়িয়ে আছে সেটাকে তাঁরা দেখতেই পান না। এর সবচেয়ে প্রামাণ্য উদাহরণ হিসেবে আমরা পরিবেশের দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারি। আজ আমরা যে পৃথিবীতে বাস করছি, তার অস্তিত্ব যে কতখানি বিপন্ন হয়ে পড়েছে তা আর কেবল গবেষণাপত্রেই সীমাবদ্ধ নেই – এই ধরিত্রীর সর্বত্রই মানুষ নানা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে প্রতি মুহূর্তে তা অনুভব করে চলেছে। গত কয়েক দশক ধরে পৃথিবী ক্রমেই উত্তপ্ত থেকে উত্তপ্ততর হয়ে উঠেছে, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, তুফান, এবং মহামারির প্রকোপে মানুষের জীবন শুধু দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে বললে কম বলা হয়, মানব প্রজাতিটাই টিকবে কি না তা নিয়েই সন্দেহ গাঢ়তর হচ্ছে। আজ মোটামুটি সকলের জানা, অস্বাভাবিক, নিয়মভাঙ্গা যে-সব প্রাকৃতিক আচরণে মানুষের নাভিশ্বাস, সেগুলো আসলে প্রকৃতির প্রত্যাঘাত – মানুষের অবিমৃশ্যকারী আচরণ, তার ওপর মানুষের অস্বাভাবিক, মাত্রা-ছাড়া আক্রমণ সইতে না পেরে প্রত্যাঘাত।

    এখন, প্রকৃতির ওপর আঘাত করছে কোন মানুষ? এরা কতিপয় ক্ষমতাবান, যারা ভেবেছিল, পৃথিবীকে – তার মানুষ ও প্রকৃতিকে অবাধে লুণ্ঠন করে আরো মুনাফা করবে, এবং আরো ক্ষমতা কুক্ষিগত করবে। এবং তারা তাই করেছে। অমিতাভ ঘোষের সম্প্রতি প্রকাশিত দ্য নাটমেগস কার্স (পেঙ্গুইন, ২০২১) বই – এবং আরো অনেকের গবেষণায় – উঠে আসছে, আধুনিকতার নাম করে এই লোকেরা লুটপাটের মধ্য দিয়ে কীভাবে গোটা বিশ্বকে বিপন্নতার কিনারায় এনে ফেলেছে। এরা একবারের জন্যও এটা ভাবেনি যে, প্রকৃতির প্রত্যাঘাত সইবার ক্ষমতা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনবান, সবচেয়ে ক্ষমতাবান লোকটারও নেই। বৃষ্টিপাত, জলবায়ু, ইত্যাদির ভয়ঙ্কর পরিবর্তনগুলো যদি কারো কাছে প্রকৃতির প্রত্যাঘাতের প্রমাণ হিসবে যথেষ্ট মনে না হয়, তাহলে তিনি অন্তত কোভিড ১৯-এর অভিজ্ঞতার কথাটা মাথায় রাখবেন।


    দুই


    মানুষের আজকের যে দৈহিক ও সামাজিক অবয়ব, আমরা জানি, তার নির্মাণে সংহতির একটা বিরাট ভূমিকা আছে। রাজ্য সম্প্রসারণ, পরস্বাপহরণ, শত্রুদমনের নামে গণহত্যার বিপুল কলঙ্ক সত্ত্বেও মানব ইতিহাসের নির্মাণে সংহতির পদচিহ্নগুলোকে দেখতে না পাওয়া কঠিন। এই সংহতির ছিল দুটো দিক। এক মানুষে মানুষে সংহতি, আর দুই, মানুষ ও প্রকৃতির সংহতি। কিন্তু, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ মাত্র চারশো বছরেই পৃথিবীর কয়েকলক্ষ বছরের সংহতির ইতিহাসকে মিলিয়ে দিয়ে আক্রমণের এক নতুন ইতিহাসের সূচনা করল: সারা পৃথিবী জুড়ে বনভূমি, পাহাড়, শস্যক্ষেত্র, নদী, সমুদ্র ও জীবজগতের বিন্যাসটাকেই বদলে দিল। আর এই বদলের ক্রমে তারা যখন ইউরোপের বাইরের পৃথিবীর মানব সমাজগুলোর ওপর প্রাণঘাতী অত্যাচার নামিয়ে নামল, বহু নৃগোষ্ঠীকে অবলুপ্ত করল, তখন তারা সেই কাজের নৈতিক সমর্থন জোগাড় করল, তৎকালীন ইউরোপের অগ্রগণ্য পণ্ডিতদের কাছ থেকে । যেমন, ফ্রান্সিস বেকনের মত ছিল, সভ্য এবং পুলিশী বন্দোবস্তের মধ্যে আছে, এমন যে কোনো সুশাসিত দেশের পরম অধিকার আছে, অন্য “অধঃপতিত” অথবা “প্রকৃতি ও জাতির নিয়ম উল্লঙ্ঘন করে এমন” দেশ দখল করার। সেই দখলের পরিণতি কী তা আমরা জানি। আজ আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে যাদের প্রভুত্ব তাদের এই অবস্থানটি এসেছে লক্ষ লক্ষ মানুষের, এবং বিপুল প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যকে ধ্বংস করে। এককথায় ঐতিহাসিকভাবে পূর্ণতা পাওয়া একটা সংহতিকে নষ্ট করা হল। যখন প্রয়োজন ছিল সংহতির মূল্যের দিকটাতে নজর দেবার, তখন বেকনের মতো পণ্ডিতরা মানবজাতিকে তথাকথিত সভ্য ও অসভ্য ভাগে ভাগ করে শুধু মানব সভ্যতারই না, সম্পূর্ণ পৃথিবীরই বিপুল ক্ষতি করে গেছেন। এবং, সেই ক্ষতির ধারা আজও বহমান।

    অষ্টাদশ শতাব্দীতে মার্কিন মুলুকে যখন বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল কেটে সভ্যতার বিকাশ ঘটানো হচ্ছিল, তখন কোনো কোনো বিজ্ঞানী এর প্রতিকূল প্রভাবের কথা বলে প্রায় একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন। তথাকথিত উন্নয়নের যুক্তিতে বিশ্বপ্রকৃতির ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেই চলেছে, এবং অনেকটাই নির্বিরোধে। কারণ, এই তথাকথিত উন্নয়নের বিরোধিতাটা আসছে, প্রধানত সেইসব মানুষদের কাছ থেকে যাঁরা এর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার। তাঁরা জীবিকা হারিয়ে, স্বভূমি হারিয়ে, প্রকৃতির সঙ্গে, এবং নিজেদের সঙ্গে, মিলেমিশে বেঁচে থাকার সংস্কৃতি থেকে উচ্ছেদ হয়ে অনিশ্চয় এক ভবিষ্যতের মুখে। তাঁরা দার্শনিকভাবে যতটা সমৃদ্ধিশালী আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকার সক্ষমতার দিকে দিয়ে ততটাই দুর্বল – শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজ, শাসকীয় পরিসরে উপস্থিতির অভ্যাস, সব কিছুই এঁদের অধরা। তাই এঁদের প্রতিবাদের রূপ প্রধানত প্রত্যক্ষ বিরোধ। এই বিরোধকে আধুনিক বিশ্বের শাসনব্যবস্থার মুখোমুখি হবার জন্য আরো কিছু দরকার, যেমন জনপরিসরে যুক্তিগুলোকে নানা ভাষায় তুলে ধরা। সংবাদপত্রের ভাষা, বিদ্যাচর্চার ভাষা, আইনের ভাষা, ইত্যাদির সাহায্য নিয়ে একটা ব্যাপক জন-সংহতির ভাষা গড়ে তোলার প্রয়াস, বস্তুত, সভ্যতার একটা শর্ত। কিন্তু যাঁদের পক্ষে এই প্রয়াসটা করা সব থেকে জরুরি ছিল, সেই শিক্ষা ও অন্যান্য সামাজিক সুযোগ পাওয়া সম্প্রদায় প্রায়শই নীরব থেকেছে। কারণ, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানুষগুলোকে যে অব্যবহিত পরিণতি মুখোমুখি হতে হচ্ছে তার কণামাত্রও সুবিধাভোগীদের অভিজ্ঞতায় নেই। অষ্টাদশ শতাব্দীর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো এখন আর অরণ্য ধ্বংসের পরিণতি নিয়ে লোকে সন্দিহান নয় ঠিক। তারা জানে, বন না থাকলে উষ্ণায়ন হবে, বন্যা হবে, কিন্তু, তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য তাৎক্ষণিক সুরক্ষার বন্দোবস্ত, যথা এয়ার কন্ডিশনার, বৈদ্যুতিক উপকরণ, অন্যান্য যান্ত্রিক উপকরণ তাদের জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ফলে, প্রকৃতির ওপর অত্যাচার যেমন জারি থাকে, তেমনি প্রকৃতির প্রত্যাঘাতও জোরালো হতে থাকে। কিন্তু, আগেই যেমন বলেছি, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনযাপনে সংহতির অভাবের কারণে এই মুহূর্তে ক্ষতিটা সমাজের সবচেয়ে অসহায় মানুষদের হলেও, শেষ পর্যন্ত তা সমগ্র মানবসমাজকেই বিনাশের দিকে ঠেলে দেয়। এক কথায়, আমার চারপাশে যারা আছে, যা আছে, তাদের সঙ্গে একটা সংহতি গড়ে তুলতে না পারলে, তাতক্ষণিকভাবে আমি নিজেকে যতটা সুরক্ষিত ও লাভবান মনে করি না কেন, প্রকৃতির প্রতিশোধ একদিন আমার অস্তিত্বেও আঘাত করবে।


    তিন


    আমাদের বাস্তব অবস্থানের কারণে, ব্যাপকতার দিক দিয়ে দেখা ওপরের উদাহরণটি একটু জটিল এবং দুর্গত বলে মনে হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের এ নিয়ে ভাবতেই হবে। বস্তুত, সংহতির এই ব্যাপক রূপ ও দায়দায়িত্বের সঙ্গে আমাদের প্রাত্যহিক, আপাত-সংকীর্ণ, বাস্তবতাগুলোর বিরোধ নেই। বরং, আমাদের রোজকার কাজকর্মের মধ্যে দিয়েই আমরা এক ব্যাপকতর সংহতির দিকে এগোই। আজকের আলোচনার পরের অংশটুকুতে আমরা এই সংযোগ নিয়ে কিছুটা চিন্তাভাবনা করতে পারব। আজকের সভায় যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাঁরা একটি বিশেষ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী। নিয়োগকর্তার সঙ্গে সম্পর্কের চরিত্রের কারণেই কর্মীদের নিজেদের মধ্যে একটা সংহতির প্রয়োজন পড়ে। প্রধানত এই প্রয়োজন থেকেই কর্মী ইউনিয়নের সৃষ্টি। কর্মীদের চাকরির শর্ত, তাঁদের প্রতিদিনের জীবনের সুবিধা-অসুবিধা, তাঁদের পরপ্রজন্মের জন্য চিন্তা, ইত্যাদি নানা দিক নিয়ে তাঁদের ভাবতে হয়, নিয়োগকর্তার সঙ্গে দর-কষাকষি করে শর্তগুলিকে যতখানি সম্ভব কর্মীদের স্বার্থসুরক্ষার পক্ষে নিয়ে আসতে হয়। আবার কর্মী ইউনিয়নের আর একটা দিক হল, নিজেদের মধ্যে সহযোগিতামূলক নানা উদ্যোগ নেওয়া। এইরকম উদ্যোগের উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কর্মী সমবায়, স্পোর্টস ক্লাব, কর্মী পাঠাগার, ক্যান্টিন, ইত্যাদির কথা। অর্থাৎ, কর্মী সংগঠনের একটি দিক হল সংঘর্ষমূলক – নিয়োগকর্তার সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে দর-কষাকষি। আর একটি দিক হল গঠনমূলক, পারস্পরিক সহযোগিতা যার ভিত্তি। কেবল কর্মী ইউনিয়ন বলেই নয়, যে-কোনো ইউনিয়নের মধ্যেই নিজেদের মধ্যে সংহতির এই দ্বিমুখী প্রাসঙ্গিকতা ও রূপ খুবই দেখা যায়।

    আবার, সংহতির দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি গড়ে ওঠে বিভিন্ন কর্মী ইউনিয়নের মধ্যে। রাষ্ট্রীয় নীতি, বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর নীতি, অর্থনীতিক গতিপ্রকৃতি, ইত্যাদি নানা কারণে সৃষ্ট কিছু অবস্থা সমস্ত ক্ষেত্রের কর্মীদেরই স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করে। এর একটা উদাহরণ ছিল, গতবছর, অর্থাৎ, ২০২২ সালের ২৮-২৯ মার্চ দেশজুড়ে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা ধর্মঘট, যাতে বিভিন্ন মজদুর, ব্যাংক কর্মচারী, সরকারি কর্মচারী, বিদ্যুৎ পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মচারীরা যোগ দেন। কৃষকদের সংগঠনগুলো এই আন্দোলনে সংহতি জানায়। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও অন্যান্য অনেক সংগঠন সমর্থন জ্ঞাপন করে। পৃথিবীর বহু দেশেই ইউনিয়ন আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি এখন অনেক বেশি ব্যাপকতার দিকে যাচ্ছে। স্পেন, ব্রাজিল, মেক্সিকো, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ড, এমনকি পুঁজিতন্ত্রের রাজধানী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এইরকম বৃহৎ সংহতি গড়ে ওঠার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, হচ্ছেও। (দ্রষ্টব্য, পল হ্যাম্পটন, ওয়ার্কার্স অ্যান্ড ট্রেড ইউনিয়নস ফর ক্লাইমেট সলিডারিটি: ট্যাক্লিং ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন আ নেওলিবেরাল ওয়ার্ল্ড, রাউটলেজ, ২০১৫)


    চার


    সারা পৃথিবী জুড়েই শ্রমিক ও কর্মীদের ইউনিয়নগুলো বিরাট সংকটের মুখোমুখি। সংগঠিত ক্ষেত্রটি ছোট হতে হতে প্রায় দৃষ্টির অগোচর হওয়ার যোগাড়। আবার যেটুকুও আছে তাতে একদিকে কর্মী সংকোচন এবং অন্যদিকে নানাবিধ আইনি ও প্রশাসনিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ইউনিয়নগুলোর সংখ্যাগত শক্তিকে নিঃশেষ করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি তাদের কাজের ও অধিকারের পরিধিটিকে সংকীর্ণ করে তোলা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে, ব্যাংক ও বহু কর্পোরেট অফিসের কর্মীদের দিনে আট ঘণ্টার অনেক বেশি সময় অফিসের কাজ করাটাকে “স্বাভাবিক” করে তোলা হয়েছে। আর এটা করাটা সহজ হয়েছে জনমানসে এমন একটা বিশ্বাস প্রচারিত করে। এতে সাধারণ লোকে প্রায় মেনেই নিয়েছে যে ইউনিয়নগুলো হচ্ছে যত সর্বনাশের মূল। (দ্রষ্টব্য, ক্যারোল ফ্রেগ ও জন কেলে সম্পাদিত ভ্যারাইটিজ অব ইউনিয়নিজম: রিভাইটালাইজেশন ইন আ গ্লোবালাইজিং ইকনমি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪) সামাজিক পরিসরে, বিশেষত বিদ্যাচর্চায়, সংগঠিত শ্রমিকদের বিষয়ে যে-কোনও আলোচনাকেই দেখা হয় ‘সুবিধাভোগী’র স্বার্থরক্ষা হিসেবে। চালু ধারণা হল, সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা শুধু সংখ্যায় নগণ্য নন, তাঁরা যেহেতু নির্দিষ্ট আর্থিক ও অন্যান্য আইনি সুবিধা পেয়ে থাকেন, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগ নেই। এ-ধারণাও বলশালী যে মালিকপক্ষের সঙ্গে দর-কষাকষিতে যে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ভূমিকা ছিল জোরালো তাদের জঙ্গি আন্দোলনের কারণে শিল্পের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে পড়ে, যার ফলে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন মার খায়।

    যে কোনও জটিল জিনিস সহজ ছকে ফেলে দিয়ে সবচেয়ে লাভ হয় ক্ষমতাবানের। যেমন, ‘ইউনিয়নের আন্দোলনের কারণে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিল্প উঠে গেল’, এই প্রচার এত জোরালো যে, মনে হয় শ্রমিকশ্রেণির লোকেরাও এটা বিশ্বাস করে বসেছেন। যেমন, প্রামাণ্য গবেষণার ভিত্তিতে লেখা অচিন চক্রবর্তী ও সহযোগীদের লেখা একটি সাম্প্রতিক বইতে দেখানো হয়েছে কী ভাবে শ্রমিকরা আশঙ্কা করছেন, দাবি তুললে কারখানা উঠে যাবে। অথচ, গবেষকরা দেখাচ্ছেন, এ-রাজ্যে কারখানা উঠে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে ধর্মঘট বা অন্যান্য শ্রমিক অসন্তোষের ভূমিকা মাত্র ১ শতাংশ, ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই এর কারণ হচ্ছে লকআউট। আবার অভিযোগ করা হয়, নতুন কারখানা না হওয়ার কারণ হল জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনের ভয়। কিন্তু, গবেষকরা দেখাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গে শিল্প কমে যাওয়ার পিছনে ভারত সরকারের নানা নীতির প্রভাবই বড় কারণ: প্রাক-উদারীকরণ যুগে শিল্প-লাইসেন্স না দেওয়া থেকে পণ্য পরিবহণ মাশুলে সমতার মতো নানা সিদ্ধান্ত রাজ্যের শিল্পসম্ভাবনার প্রভূত ক্ষতি করেছে। দাবি করা হয়, শ্রমিকদরদি বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকায় মালিকপক্ষের ক্ষতি হয়েছে। অথচ, গবেষকরা প্রমাণ দেখাচ্ছেন, এ-রাজ্যে শ্রমিকদের স্বার্থে নানা আইন হলেও তাদের রূপায়ণ থেকেছে খুবই দুর্বল। যেমন কারখানা পরিদর্শন, বিবাদ নিষ্পত্তি, ইত্যাদি নানা দিক দিয়েই শ্রমিকদের স্বার্থ বিঘ্নিত হতে হতে এখন এমন এক অবস্থা যেখানে, “কোনও সংগঠিত ইউনিয়ন নেই... আমরা মিটিংয়ের পর মিটিংয়ে যাই, কিন্তু মালিকপক্ষ সবাই মিলে সই করা চুক্তিটা ভাঙতেই থাকে... স্থায়ী মজুরদের প্রাপ্য আদায় করতে আমরা ব্যর্থ হই, চাইলেই তারা কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়।” অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২০০৪-০৫ ও ২০১১-১২’র মধ্যে রাজ্যে শিল্পশ্রমিকের সংখ্যা ২৩ লক্ষ ৭২ হাজার বেড়েছে, কিন্তু শিল্প চলছে প্রধানত ক্যাজুয়ালদের নিয়ে, যাঁদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ আসেনি। (অচিন চক্রবর্তী ও সহযোগীবৃন্দ, লিমিটস অব বারগেনিং: ক্যাপিটাল, লেবার অ্যান্ড দ্য স্টেত ইন কন্টেমপোরারি ইন্ডিয়া (ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৯))

    অর্থাৎ কাহিনীটা যত সরল ভাবে পরিবেশন করা হয় তা সে রকম নয়, এর পরতে পরতে জটিলতা। পুঁজি ও শ্রমের সম্পর্কে যে পুনর্নির্মাণ ঘটে চলেছে সেখানে পুঁজির প্রতি রাষ্ট্রের নির্ভেজাল পক্ষপাত। যে ভারতে একদা দেশের বিকাশে শ্রমিক আন্দোলনের ভূমিকা নিয়ে সরকারি ভাবে আলোচনাসভা ডাকা হত, সেখানে আট ঘণ্টার মজুরি দিয়ে বারো ঘণ্টা খাটানোর বিধি চালু হয়ে গেল কয়েকটি রাজ্যে, অন্যত্রও হল বলে। পুঁজির দাপটে সংগঠিত শ্রমক্ষেত্র সঙ্কুচিত, অসংগঠিত ক্ষেত্রে মজুরদের জোর প্রায় শেষ। সময়টা আরো কঠিন হয়েছে সংগঠিত ও অসংগঠিত কর্মী ও মজদুরদের মধ্যে উত্তরোত্তর বাড়িয়ে তোলা বিভাজনের কারণে। এমন এক অবস্থায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রের কর্মীদের মধ্যে সংহতি গড়ে তোলা ছাড়া তাঁদের স্বার্থরক্ষার কাজটা সম্ভব হবে বলে মনে করা কঠিন।


    পাঁচ


    কিন্তু তার সঙ্গে প্রয়োজন একটা বৃহত্তর, ব্যাপক সংহতি নিয়ে চিন্তা করা। একটু নিবিষ্ট ভাবে দেখলে যে কোনো পর্যবেক্ষকেরই চোখে পড়বে, একদিকে যখন একাংশের মানুষ, বিশেষত শহুরে মধ্যবিত্তের সামনে জীবনের মান উন্নীত করে তোলার নানা সুযোগ খুলে গেছে, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সুযোগ, চাকরি-বাকরি সহ সামাজিক-রাজনৈতিক-আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা কেন্দ্রগুলোতে অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ, বিশ্বায়িত পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ তুলনামূলকভাবে প্রসারিত হয়ে চলেছে, তখন চিরাচরিতভাবে সুযোগবঞ্চিত মানুষদের অবস্থা প্রায় অপরিবর্তিত থেকেছে। এই সুযোগবঞ্চিত মানুষেরা কারা? প্রধানত, দলিত, আদিবাসী, এবং মুসলমান, যাঁরা এ রাজ্যের মোট শ্রমজীবী মানুষের অধিকাংশ। আবার উল্টোদিকে রাজ্যের মোট নিরক্ষরের প্রায় পুরোটাই হচ্ছেন, এই তিন গোষ্ঠীর লোকেরা। কায়িক শ্রমের ওপর একান্ত নির্ভরতা যেমন তাঁদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মানকে নীচে টেনে ধরে, তেমনি আবার শিক্ষাগত বঞ্চনা তাঁদের আয় ও জীবনকুশলতার অন্যান্য দিকগুলোকে সংকুচিত করে রাখে। এই দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে তাঁদের আর্থিকভাবে দুর্বল ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জীবন কাটিয়ে যেতে হয়।

    অস্বস্তিকর হলেও মানতেই হচ্ছে যে, দূরত্ব কমার বদলে বৃদ্ধি পেয়েছে। চোখ-কান খোলা রাখলে বাংলার যে কোনও প্রান্তেই – শহরে এবং গ্রামে – দেখা যাবে গভীর বৈষম্য। এবং তা নানা স্তরে। প্রথমত নগরের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিজেকে বাংলার নবজাগরণের উত্তরসূরি মনে করে এসেছে। বাংলা সাহিত্য, শিল্প, বিদ্যাচর্চা – সর্বক্ষেত্রে এই অংশটির আধিপত্য। সেই ধারায় বিশ্বের শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতির সঙ্গে এর যোগ। এ অংশটি প্রধানত কলকাতা-কেন্দ্রিক, বড়জোর তার কিছু প্রভাব গিয়ে পড়ে জেলা বা মফস্বলের শহরগুলোতে। রাজনৈতিক বুদ্ধিচর্চার ধারায় যে গণ শিল্প সাহিত্য গড়ে ওঠার প্রয়াস পেয়েছিল, সেটাও, পথ হারাল নগর-কেন্দ্রিকতার চোরা গলিতে। আবার, নগর-কেন্দ্রিকতা মানে যে সকল নগরবাসী এই আলোকিত পৃথিবীর দেখা পেলেন, তা নয়। বরং, গ্রামাঞ্চলের মতোই এই কলকাতা শহরের মধ্যেও নিজের মতো করে বাস করতে লাগল এক বিপুল জনসমষ্টি যার ভাষা আলোকায়িত বাংলা জানে না, আর আলোকায়িত বাংলার ভাষা যে গোষ্ঠীর কাছে দুর্বোধ্য সাংকেতিক শব্দচিহ্ন। এটা একটা বড় কারণ যে, দশকের পর দশক ধরে আমরা জাতীয় সংহতির নামসংকীর্তন করে এসেছি, জাতীয় সংহতির দাবিতে দেওয়াল ভরিয়ে ফেলেছি, কিন্তু সংহতি আড়ালেই থেকে গেছে। সংহতি কোনো বায়বীয় ব্যাপার নয়, রক্তমাংসের মানুষকে বাদ দিয়ে, তাঁদের সামর্থ্য, সক্ষমতা, সুরক্ষা- ইত্যাদির জন্য সংহতির চিন্তা না করে কেবল জাতি নামক একটা কল্পনাকে ঘিরে সংহতি অর্জিত হয় না – বরং তা আরো অধরা হয়ে পড়ে।

    সংহতির সবচেয়ে বড় শত্রু হল পরিজনের সঙ্গে পরিজনের দূরত্ব। মানুষের অন্তর্বস্তুর ওপর জোর না দিয়ে গৌণ বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর নির্ভর করে তৈরি করা কৃত্রিম ব্যবধান। এই ব্যবধান সমাজের সমস্ত প্রতিষ্ঠানে তার প্রভাব ফেলে। কর্মী ইউনিয়নও এর বাইরে থাকতে পারে না। যে মানুষ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না, অনাহার-অপুষ্টি-অচিকিৎসার দুষ্টচক্র যার আয়ুষ্কালকে দেশের গড় আয়ুষ্কালের অর্ধেকে নামিয়ে দেয়, অনিশ্চয়তা ও কম মজুরিই যার কাজের একমাত্র শর্ত, তাদের সঙ্গে সংগঠিত কর্মী ইউনিয়নের সদস্যদের বিস্তর ফারাক। কারণ, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে এই যে, দেহশ্রমজীবীদের জীবনের ঘোর অনিশ্চয়তাটিকেই সংগঠিত কর্মী ইউনিয়নের সদস্যরা নিজেদের উন্নতির সোপান বলে ধরে নেন – প্রায়শই অজ্ঞাতে, প্রকাশ্য সচেতনতার বাইরে। তাঁরা যে নির্দয়, মমতাবর্জিত শোষক, এ-কথা কেউ বলতে পারবে না। বরং উল্টোটা। এঁদের মধ্যেই আছেন বহু পরোপকারী, নানা সদগুণের অধিকারী মানুষজন। কিন্তু, সমস্যাটা নিহিত আছে চিন্তার চরিত্রে। যেমন, এই রাজ্যেরই হাজার হাজার মানুষ কাজের সন্ধানে দেশান্তরী হন বীরভূম-বর্ধমানের পাথর খাদানে, আর তার প্রায় নিশ্চিত পরিণতি হিসেবেই তাঁরা ঘরে ফেরেন সিলিকোসিস নিয়ে। অতঃপর কয়েকদিন অক্সিজেন সিলিন্ডার ঝুলিয়ে বাঁচা, এবং আক্ষরিক অর্থেই মৃত্যুকে অনুভব করতে করতে, তার ডাক শুনতে শুনতে তার গহ্বরে ঝাঁপ দেওয়া। এমন কোনো মজুরের খবর যখন কোনো সংগঠিত ইউনিয়ন বা তার কোনো সদস্যের কাছে পৌঁছোয়, তাঁরা অকুণ্ঠ সাহায্য করেন মানুষটিকে বাঁচিয়ে তোলার। অথবা, যখন কোনো রিক্সাওলার ছেলে, বা কাজের দিদির মেয়ে টাকার অভাবে পড়তে পারে না, তখনও ইউনিয়নগত ভাবে, এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রভূত সহায়তার নিদর্শন দেখা যায়। কিন্তু, এই পরোপকারিতার মধ্যে যতটা দাক্ষিণ্য আছে, ততখানি সংহতির উপাদান নেই। কারণ, কেন একটি মানুষকে এমন বিপজ্জনক কাজে যেতেই হবে, বা কেন একজন লোক তার ছেলেমেয়েকে পড়াতে পারবে না, বা কেন কোনো রোগী স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে স্বাভাবিক চিকিৎসা পাবে না, সংগঠিত ইউনিয়ন, সাধারণভাবে বলছি, এই প্রশ্ন তোলে নি। কয়েকদিন আগে, জুন মাসের গোড়ায়, ওডিশার বালাসোরের কাছে যে ভয়াবহ ট্রেন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল, তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হল যে কামরাগুলো, সেগুলো ছিল মজুরভর্তি – অসংরক্ষিত কামরা। আমাদের রাজ্যের এবং ওডিশার হাজারে হাজারে মানুষ দক্ষিণে কাজের খোঁজে যেতে বাধ্য হন। তাঁদের যে-ভাবে যেতে হয়, সেই অবস্থাটা বর্ণনা করা কঠিন। যে কামরায় নব্বুই জন লোকের বসার জায়গা থাকে, যেই কামরায় চারশো-পাঁচশ মানুষ – একজনের ওপর আর একজন বসে, দাঁড়িয়ে। আর এই অবস্থায় তাঁদের থাকতে হয় চল্লিশ ঘণ্টা। দুর্ঘটনার শিকার মজুরদের বা তাঁদের পরিবারের সাহায্যার্থে চাঁদা তোলা, তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি নানা ব্যাপারে সংগঠিত ইউনিয়নগুলোর ভূমিকা সহজেই দেখা যায়। কিন্তু, যেটা দেখতে পাওয়া কঠিন তা হল, কেন এমনটা হবে, কেন একজন কাজ খুঁজতে যাওয়া মানুষ, দেশের নাগরিককে এই অমানুষিক কষ্ট সহ্য করতেই হবে –এই প্রশ্নটা তোলা। তেমনি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা জাতিগত সংঘর্ষের শিকার মানুষদের, বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত লোকেদের পাশে দাঁড়িয়ে আর্থিক বা অন্যান্য বস্তুগত সাহায্য করার উদ্যোগ সংগঠিত ইউনিয়নের কাজের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু, সেটাই যথেষ্ট নয় – সেটা বড় জোর বৃহত্তর কোনো অপারগতার গ্লানি মোচনের উপায় হতে পারে। যেটা দরকার সেটা হল, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত বিদ্বেষ, ঘৃণার রাজনীতি, বৈচিত্র্যকে নষ্ট করে একটা একরূপী সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা, এবং পাহাড়-অরণ্য-নদী ধ্বংস করে তথাকথিত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে আমন্ত্রণ জানানোর সর্বনাশা রাজনীতি ও অর্থনীতির বিরুদ্ধে একটি প্রশ্নবাচী সামাজিক সংহতি গড়ে তোলা।

    কেন এমন হবে, এই প্রশ্ন তোলাটা কেবল মানবিকতার ব্যাপার নয়, এটা তোলা দরকার নিজেদের স্বার্থেই। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, কীভাবে সংগঠিত ক্ষেত্রেও কর্মীদের আট ঘণ্টা কাজের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তাঁদের কাজের শর্ত লঙ্ঘিত হচ্ছে, চাকরির নিরাপত্তা, সঞ্চয়ের নিরাপত্তা, ইত্যাদি খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। এমনকি সংগঠিত হবার এবং ধর্মঘট বা প্রতিবাদ করার, বি আর আম্বেদকর বর্ণিত জন্মসিদ্ধ অধিকার বিপন্নতার মুখোমুখি। আজ পৃথিবী জুড়ে সংগঠিত ইউনিয়নগুলোর ওপর যে বিকট আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে, চেহারায় বিপুল ও প্রকৃতিতে নিষ্ঠুরতার প্রতিমূর্তি সেই আক্রমণের প্রতিরোধ করতে গেলে, কর্মীদের পাশে পেতে হবে বিপুল শ্রমজীবী মানুষের সমর্থন। বাস্তব রূপে সেই সমর্থন পাওয়ার একমাত্র নিশ্চয়তা হচ্ছে সংহতি। এটাকে বলব, সংহতির তৃতীয় স্তর। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, মজদুর ও কর্মী ইউনিয়নগুলির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে খুবই সরব। তিনি যে দিকটার ওপর জোর দিয়ে থাকেন, তার একটা হল, ব্যাংক বা স্কুল, হাসপাতাল বা ফ্যাক্টরি, কর্পোরেট অফিস বা সরকারি দপ্তর, - ইত্যাদির পরিচালনাগত ব্যবস্থাপনায় ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও সামগ্রিক উন্নতি – দুদিক দিয়েই এর গুরুত্ব খুব বেশি। আর দ্বিতীয়, এবং সম্ভবত অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ দিকটা হল, কর্মী ও জনসাধারণের, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক সংহতি গড়ে তোলা। উদাহরণ হিসেবে তিনি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রের ইউনিয়নগুলির কথা তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্য, নিজেদের জীবনকুশলতা নিশ্চয়ই একটা দরকারি ব্যাপার, কিন্তু পাশাপাশি, যাঁরা আমাদের চেয়ে কম সুযোগসুবিধার মধ্যে জীবন কাটান তাঁদের অভাবগুলো পূরণ করার দিকে আমাদের অনেক বেশি দৃষ্টিপাত করা উচিৎ। এটা এই কারণেই যে, যাঁরা তুলনামূলকভাবে বেশি – প্রায়শই অনেক বেশি – পারিশ্রমিকের কাজ করেন, তাঁরা শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সমাজে প্রভাব সৃষ্টিকারী কণ্ঠস্বরের অধিকারী। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতার বিপক্ষে একটা পালটা জোট গড়ে তোলা সহজ হয়। (প্রতীচী ট্রাস্ট ও ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা, মানব উন্নয়নের পথে: প্রাথমিক শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের রূপায়ণে কর্মী সংগঠনগুলির ভূমিকা, আলোচনা সভার প্রতিবেদন, ২০০৬) এমন একটি জোট ছাড়া, সংগঠিত বা অসংগঠিত, বেশি আয়ের বা কম মজুরির, যে-কোনো কর্মী গোষ্ঠীর পক্ষেই নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা অসম্ভব।

    বস্তুত, আজ পৃথিবী জুড়েই মানুষের ওপর অমানুষিকতার ক্রমবর্ধমান আক্রমণ এই জোটের দিকটাকে অধিকতর প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। একইরকম প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে এই সংহতিকে বিস্তৃত করতে করতে প্রান্তদেশ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। এ লেখার শুরুতে আমরা যে প্রকৃতির পক্ষে ও প্রকৃতির সঙ্গে সংহতির উল্লেখ করেছি সেটার অপরিহার্যতাও এখানেই: পড়শি যদি না বাঁচে, অরণ্যনির্ভর জনগোষ্ঠী যদি না বাঁচে, নদীনির্ভর জনগোষ্ঠী যদি না বাঁচে, মৃত্তিকানির্ভর জনগোষ্ঠী যদি না বাঁচে, পুঁজির আগ্রাসনে যদি পৃথিবীটাই উৎখাত হয়ে যায়, তাহলে আজ নিজেকে সুরক্ষিত মনে করা একক, ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ গোষ্ঠীগুলোই বা কীভাবে বাঁচবে? তাই নিজেদের সংহতিকে শক্তিশালী করে তোলার পাশাপাশি বৃহত্তর মানব সংহতি গড়ে না তোলার মতো বিলাসিতা দেখানোর সুযোগ নেই।

    পথটা কঠিন। সংহতির নির্মাণ প্রচণ্ড বাস্তব প্রতিকূলতা ও তত্ত্বগত সঙ্কট, দুই সমস্যার মুখোমুখি। কিন্তু এগুলোর মোকাবিলা করে এগোনোর পথ গড়ার ব্যাপারে কর্মী সংগঠনের ভূমিকাটি শুধু সদর্থক বললে কম বলা হবে। এটি আবশ্যিক।



    ১০ জুলাই ২০২৩, টাটা এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের ৭৭তম প্রতিষ্ঠা দিবসে দেওয়া বক্তৃতা। এর একটি প্রাথমিক খসড়া পড়ে মূল্যবান পরামর্শ দেওয়ার জন্য শ্রী অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৫ আগস্ট ২০২৩ | ১২৩৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ০৫ আগস্ট ২০২৩ ১২:৫১522119
  • ভালো লাগল, খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে কিছু বদল হবে, সে আশা বড়ই ক্ষীণ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন