'আজকালকার ছাউছানারা মনে রাখ –পদবি ভক্তা হলে গোত্র হবে চিরকা আলু, মল্লিক মকর, কোটালদের চাঁদ আর কাছিম, নায়েক হলে শালমাছ, আড়িদের চাঁদামাছ, ভুঁইয়াদের শোলমাছ। মাছ আছে, পাখি আছে, বাঘ- হরিণ ইঁদুরও আছে –'
কারা তারা?
লোধা, যার সারাজীবন 'ঘর ঘর করে বটে, তবে ওই ঘরই খুঁজে মরে আজীবন '। ঘর বলতে ঝুগগি, ঝোপড়ি, বনের ফাঁকে ফাঁকে। সারাদিন তো ঘরের বাইরে, বনে বনে ঘোরা। কেবল রাতটুকু ঘরে। আবার যখন বন থেকে বেরোল তখন, সারাদিন মাঠে মাঠে, পরের ধান কাটে – কেবল রাতটুকু গিরিহা-গেরস্থের গোয়াল ঘরে, বা খালের পাশে এখানে ওখানে ঝুপড়িতে রাত কাটে।
এই লোধাদের নিয়েই নলিনী বেরার মহাকাব্যিক শবর চরিত । দীর্ঘ এক দশক ধরে লেখা এই উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে ২০০৫ সালে – লেখা শুরু ১৯৯৬-তে। এই কাজের একটা সরকারি স্বীকৃতিও এসেছে, ২০০৮ সালের বঙ্কিম পুরস্কারের মধ্য দিয়ে। একথা ঠিক যে কোনও কৃতিকে তার পুরস্কারের মূল্য দিয়ে বিচার করা চলে না- সে কৃতির বিচার হয় পাঠকের কাছে তার আবেদনের মধ্য দিয়ে – যে পাঠক শুধু আজকেরই নয়, ভাবীকালেরও। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্য জগতে নলিনী বেরার মতো একজন অপাঙক্তেয় লেখকের পুরস্কার পাওয়াটা একটা বিশেষ ঘটনা –এই ভূভাগে সাধারণত ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ বৃত্তের বাইরে যে কেউ সাহিত্যরচনা করতে পারেন, শাসকীয় পশ্চিমবঙ্গ সেটা বড় একটা ভেবে উঠতে পারে না। যেমন এখানকার সামাজিক-অর্থনৈতিক সংরচনা, তেমনই তার রাজনীতি ও মননচর্চা, সর্বত্র ব্রাহ্মণ্য একাধিকার।
প্রথমত শাসিত পশ্চিমবঙ্গের কাছে সাধারণ রাষ্ট্রীয় সুযোগগুলি বড় কম যে, এক-তৃতীয়াংশ মানুষ অক্ষরের অধিকার থেকে বঞ্চিত তার প্রায় পুরোটাই এই শাসিতদের ও সবচেয়ে নীচের তলার – জাতিতে নীচু,গায়ে গতরে উদয়াস্ত খেটেও অনিশ্চিত জীবিকা। এই শাসিতদের মধ্যে যেমন পড়েন বাউড়ি, বাগদি, ডোম, সাঁওতাল, মুসলমানদের বড় এক অংশ, আবার এর মধ্যে পড়েন এঁদের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা এগিয়ে থাকা কুমোর, জেলে, তাঁতিরাও; সামাজিক সুবিধার দিক দিয়ে তাঁদের অবস্থা উচ্চবর্ণীয়দের অনেক পিছনে। তেমনই এক সমাজ থেকে আসা নলিনী, বহু সংগ্রামে শিক্ষার সুযোগ অর্জন করে নিয়েছেন। পারিবারিক দারিদ্র্যই শুধু নয়, পশ্চিমবাংলার প্রান্তীয় যে কোনোও জনসমুদায়ের জন্যই, সবচেয়ে বড় বাধা স্কুলে পৌঁছাতে পারা। সেখানে পৌঁছে একটা বিজাতীয় ভাষা ও পদ্ধতিতে দেওয়া শিক্ষা আহরণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। নলিনীর মাতৃভাষা বাংলা নয় – এ ভাষা পশ্চিমবাংলার দক্ষিণ-পশ্চিমের সুবর্ণরেখা তীরবর্তী নয়াগ্রাম, সাঁকরাইল,কেশিয়াড়ি, গোপীবল্লভপুর এলাকার ভাষা – যার আবার নানান রূপ, নানা শব্দ, যাতে নানা ভঙ্গির সমাহার। নলিনীর উপন্যাসের প্রতি ছত্রে এই সমাহার জায়গা করে দিয়েছে এক বহুত্বময় শব্দ ভান্ডারে গড়ে ওঠা ভাষা সৌন্দর্যকে।
সব মিলিয়ে দেখলে নলিনীর কৃতিত্ব একদিকে যেমন বিরুদ্ধতার স্রোত ভেঙে এপার ওপার করা, তেমনি – এবং বোধহয় তার চেয়ে বড় অবদান – বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ করা। শাসকীয় পশ্চিমবঙ্গের কাছে এটা একটা শিক্ষা হতে পারে, বৃহত্তর জনসমুদায়কে সুযোগের বাইরে রেখে দিয়ে সে তো আসলে ক্ষতি করে চলেছে বাংলার। আজ যে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির দৈন্য নিয়ে এত অভিযোগ, তার একটা বড় কারণই তো এই যে, তা বাংলার বৃহত্তর সমাজ থেকে রস সংগ্রহ করতে ব্যর্থ। নগরকেন্দ্রিক উচ্চবর্ণীয়দের হাত ধরে, ফলে তা মাল-মশলা হয়েই থেকে গেছে – সাহিত্যের প্রাণরস হয়ে ওঠেনি। নলিনী লিখেছেন তার বেড়ে ওঠা ভূ- খন্ডের লোকদের কথা, যাঁরা তাঁর নিজেরই লোক – গ্রাম সম্পর্কে আত্মীয়। স্থানিক সামাজিক-অর্থনৈতিক সংরচনায় নলিনীর বংশগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য লোধাদের সম্পর্ক মিত্রতার নয় – বরং শত্রুতার। কিন্তু বৃহত্তর পশ্চিমবাংলার প্রেক্ষিতে এই শত্রুতা অবলুপ্ত হয় – সেখানে কুমোর, জেলে, মাহাত, সাঁওতাল, লোধা মিলে গড়ে ওঠে এক পরিচয়, যার কোনো নাম নেই, কিন্তু অস্তিত্ব আছে। সে পরিচিতি গড়ে ওঠে ভাষায়, উৎসবে, সংস্কৃতিতে- সর্বোপরি শ্রমের পারস্পরিক নির্ভরতায়। সেই নির্ভরতায় অরণ্যবাসী লোধাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয় কাঠ মহাজন বঙ্কা মাহাত-র।সেই নির্ভরতায় আবার শত্রুতা ও দূরত্ব মুছে লোধা মেয়ে সাবিত্রীর প্রেমে পড়ে কুম্ভারের বেটা সন্তোষ – সমস্ত সামাজিক বিভেদ দূর করে তাঁদের বিয়ে হয়। নলিনী এই ভিতরকার সংশ্লেষ তুলে আনেন পরম যত্নে: শ্রমজীবী সকল মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, মানব -মানবীর ঐতিহাসিকতার প্রতি পরম মমত্ববোধে তিনি জীবন্ত করে তোলেন এক একটি চরিত্র – লোধানী ফুলটুসি, শিশুবালা, সাবিত্রী, চাঁমেলী; লোধা রাইবু, গুড়গুড়িয়া, শতুরা, গুরভা; বঙ্কা মাহাত, গোবরা সাঁওতাল, কুম্ভার ব্রহ্মকুমার, বসন্ত কামিল্যা অথবা- যেখানে লোধারা খাটতে গেল, ঘরদোর ছেড়ে, সেই নামালের জমি মালিক অদ্বৈত পৈড়্যা, গিরহিনী নীলিমা। আর লোধাকুলে প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট ও পুরুষ মহিলা মিলিয়ে দ্বিতীয় গ্র্যাজুয়েট, উচ্চবর্ণীয় শিক্ষকের নিগ্রহে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী থাকাকালীন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হওয়া চুনী কোটালের আদলে পিতৃস্নেহে গড়ে তোলা নুকু – লক্ষ্মীরানী মল্লিককে।
পশ্চিমবঙ্গে লোধাদের জন সংখ্যা খুব বেশি নয় – ২০০১ সালের জনগণনায় ৮৬,৯৬৬। কিন্তু শবরদেরকে এই হিসাবে রাখা হয়নি। লোধারা নিজেদেরকে লোধা শবর বলে থাকেন। আবার শবর বলে পরিচিত জাতিটি নিজেদের খেড়িয়া-শবর বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। পরিচিতিটি গোলমেলে- কিভাবে লোধা-শবর, খেড়িয়া-শবর ভাগাভাগি হল- কেনই বা আবার লোধা - শ্রেণীতে খেড়িয়া/খাড়িয়াদের ঢোকানো হলো, যখন নাকি শবররা নিজেদের খেড়িয়া শবর বলে থাকেন, এসবের যুক্তি পাওয়া কঠিন। কারণ এইসব ভাগাভাগি সরকারি খাতাপত্রে। যাইহোক সেই হিসাবে শবরদের জনসংখ্যা ২০০১ সালে ৪৩,৫৯৯ জন। এবার লোধাদের বেশিরভাগটাই থাকে মেদিনীপুর (৪৩শতাংশ) ও পুরুলিয়া (১৬ শতাংশ) জেলায়। নলিনীর উপন্যাসে উঠে আসা লোধারা পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম থানার; এই এলাকার নয়াগ্রাম ও গোপীবল্লভপুর সীমানায় লোধাদের বড় বড় বসত আছে। যাই হোক, লোধা/শবরের ভাগাভাগিতে লোধাদের মতামতের কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি – যে জাতি-গোষ্ঠীতে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ নিরক্ষর, সেই জাতির আত্ম-নির্দেশের হক সরকারি খাতায় যে স্বীকৃতি পায় না সেটা অজানা নয় – বিশেষত অক্ষরের অধিকার ক্ষমতা-নির্দেশক। লোধারা প্রধানত অরণ্যচারী জাতি। কিন্তু জঙ্গল ফাঁকা হতে শুরু হওয়ায় এঁদের বাধ্য হয়ে সমতলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। এই সুযোগ নিয়ে সমতলের শোষকরা তাঁদের অপরাধমূলক নানা কাজে যুক্ত হতে বাধ্য করে - এবং শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসকরা এঁদের 'অপহরণপ্রবণ জাতি' হিসেবে চিহ্নিত করে। একদিকে তাঁদের নাড়ির যোগ কেটে দেওয়া, অন্যদিকে বিকল্প ব্যবস্থা না করা – এমন এক ইঁদুরকলের মধ্যে পড়ে যান লোধারা। কেবলমাত্র দুর্জয় প্রাণশক্তি সম্বল করে তাঁদের বেঁচে থাকা। নলিনীর উপন্যাসে সেই প্রাণশক্তির জয়গান।
উপন্যাসের শুরুতেই আমরা দেখি, রাইবু ও তার সহযোগী গুড়গুড়িয়া জঙ্গলের কাঠ কেটে নিয়ে গেছেন মনা সাউয়ের কাছে। এটা তাঁরা করতে বাধ্য, জঙ্গল থেকে বেঁচে থাকার রসদ – আলু, কঁদ, ফলমূল – কমে গেছে। শুধু তাই নয়, কথায় কথায় জঙ্গল থেকে তাঁদের ধরে নিয়ে চালান করে দেয় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট – যার প্রতীক নরসিঙ্গা গাড়; ফরেস্ট গার্ড নরসিংহ যে মাঝে মাঝে এসে ভেঙ্গে দিয়ে যায় তাঁদের ঘরবাড়ি। অপরদিকে চাষবাসের জমি তাঁদের নেই; চাষের সঙ্গে সম্পর্কও তাই গড়ে ওঠে নি তাঁদের। তার উপর আছে কথায় কথায় স্থানীয় শোষকদের অত্যাচার -কিছু একটা হলেই দোষ চাপে লোধাদের উপর, তাঁদের মেরে কেটে সাফ করে দেওয়া হয়। এমনকি অজ্ঞাত পরিচয় শত্রুর আঘাতে মৃতপ্রায় নরসিংহকে মানবিক মমত্বে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া রাইবু ও গুড়গুড়িয়াকে দোষী ঠাওরায় পুলিশ – তাঁদের চালান করে দেয় জেলে।
লোধা মেয়েরা বার বার শিকার হয় যৌন শোষণের – ফুলটুসি বাধ্য হয় বঙকা মাহাতোর জাঁকা-মাড়ার সঙ্গী হতে, সোমবারী হারিয়ে যায় – ভন্ড সাধুবাবার ছলনায় ভুলে জীবনে প্রথমবার বাইরে বেরিয়ে; নামাল দেশে মজুর খাটতে গিয়ে-ধর্ষিতা হয়ে নিহত হয় চাঁদবদনী। সবে বোস ওঠা বালিকা পুনই-র একমাত্র জামার বগলের কাছে ছেঁড়া: ‘তার ভেতর দিয়ে মাস্টারের ছাতরানা (বেতের) ডগাটা জামার ফুটোর ভেতর দিয়ে বগলের আশপাশে শরীরের হেথা-হোথা হেঁটে চলে বেড়ায়। ছড়ি হাতে মাস্টারের চোখ দুটো বোজা…চোখ বুজেই মাস্টার বলল, এটা ইসকুল, মহুল-কচড়া কুড়াবার জঙ্গল নয় যে যা খুশি পরে আসবি, ছেঁড়া-খোঁড়া! বলেই বেতের ডগাল দিয়ে ছেঁড়া জামাটায় আরেকটু টান, আরেকটু ফর ফর। তাই দেখে কি হাসি হাটুয়া ছুয়াদের।...মাস্টারের গোঁফের তলায়ও হাসি।'
এই এলাকার প্রতি কণা মৃত্তিকার সঙ্গে আজন্ম পরিচিত নলিনী, বালিকা হৃদয় থেকে তুলে আনেন তার কিছু কল্পনা, যার সাহায্য নিয়ে, 'পুনোই চেষ্টা করে যাচ্ছিল ইস্কুল ঘরের ভিতর থেকে বাইরে তার যা যা পছন্দের জায়গাকে' সেই সব বন বাদাড় গাছপালা, খাল-নালা, ডোবা গুগলি মাছ, পাখী, হাটুয়া ছুয়া, আখের রস, মহুল রস, 'মনে মনে ঢুঁড়ে বেড়িয়ে গোটা ইস্কুল ঘরটাকেই ভুলে থাকতে।' কিন্তু অসম এই লড়াইতে সে হেরে গেল। 'গিরগিতির হাসি চাপতে গিয়ে সে একেবারে নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ল।' তার ছেঁড়া জামার নিচে পেন্টুল ভিজিয়ে ডান পায়ের, হ্যাঁ ডান পায়েরই গা দিয়ে দর দর করে নামতে থাকল ঈষদোষ্ণ জলের ধারা।' ইস্কুলের ত্রিসীমানা ছাড়িয়ে সে দৌড়ে ফিরে চলল লোধা পাড়ায়।
শিক্ষা জগতের এই বিরুদ্ধতা, অনাত্মীয়তার মধ্য দিয়ে পুনোই শুধু নয়, তার মতো কত মেয়ে, কত ছেলেকে স্কুল শিক্ষার বাইরে ঠেলে দেয় তথাকথিত সভ্য সমাজ। তার মধ্যেই লড়াই করে উঠে আসে নুকু – লক্ষ্মীরানী মল্লিক যে হোস্টেলে থেকে স্কুল ও কলেজে পা দেয়; কবিতা লেখে; লোধা সমাজকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখে। আর উঠে আসে নীলু – নীলাম্বর। পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েও সামান্য প্রথাগত শিক্ষার আত্মবিশ্বাসের জোরে সে একদিকে যেমন লোধাদের দেশান্তরি মজুর হওয়ার সর্দার হয়ে ওঠে, তেমনি আবার প্রতিবাদীও হয়ে ওঠে।
নলিনী উপন্যাস জুড়ে এরকম অসংখ্য চরিত্র- মানুষের যন্ত্রণা, হাসি, আনন্দ, দুঃখ, বেদনা, সর্বোপরি মানবীয় দ্বন্দ্ব, স্ব-বিরোধিতা নিয়ে জীবন্ত উঠে আসে। চরিত্রগুলোকে দেখা যায়, ছোঁয়া যায়, তাদের সঙ্গে কথা বলা যায়। সাতশো চল্লিশ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি হয়ে ওঠে একটি যাত্রা যেখানে পাঠক হয়ে ওঠেন লোধা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জনসমুদায়গুলির নানান বহুত্বময়তার সঙ্গী। বন-নির্ভরতা থেকে ধীরে ধীরে কৃষি মজুরে পরিণত হওয়া, তার ভিতরকার জটিল রাষ্ট্রীয় ও দলীয় রাজনীতি, পঞ্চায়েত, পুলিশ, পার্টি, কাঠ-ব্যবসা,সব মিলিয়ে যে সমাজ পরিবর্তন তার ফাঁকে ফাঁকে নলিনী আবিষ্কার করেন ঐতিহাসিকতা – -সংহিতা থেকে নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব, ভূগোল থেকে লোকসাহিত্য, নানা ভান্ডার থেকে উপাদান সংগ্রহ করে উপন্যাসের পরিধিকে বিস্তৃত করেন সেই অসীমে যেখানে পৌঁছাতে পারে শুধু চলমান মানবিকতা। মাটি, কাঁকর, কাদা; ভুড়রু, কেঁদ, মহুয়া; সাপ, পাখি,গুগলি; চুরি, সুদখোরী, ভালবাসা; দয়া, নিষ্ঠুরতা, পাপ; সব মিলেমিশে গড়ে ওঠে এক বহমান ইতিহাস, যার কেন্দ্রে থাকে মানুষ, যার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে প্রকৃতি – শত আঘাতেও যে মানুষ বেঁচে থাকে, এগিয়ে যায়, শত আক্রমণেও যে প্রকৃতি ডালপালা মেলে জড়িয়ে ধরে তার আদরের মানুষকে।
একটা কথা বলা ভাল; উপন্যাসটা বাঙালিদের পক্ষে পড়ে ওঠা একটু কঠিন। প্রায় প্রতি শব্দে স্থানীয় শব্দের ছড়াছড়ি, গোটা এলাকা জুড়ে বহুবিধ মানুষ ও বহুত্বময় ভাষা। তা একে অন্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থেকে সৃষ্টি করেছে এক নতুন গদ্য, যার সঙ্গে পরিচিত হতে একটু সময় লাগবে। সে শব্দ ভান্ডার 'বাঙালি'র অজানা অচেনা - কেননা শিক্ষিত বাঙালি তাকে জানতে চায়নি, চিনতে চায়নি। জানতে চায়নি নানা লোক-প্রবাদ, অসংখ্য ছড়া,হেঁয়ালি, স্থানীয় যাত্রাপালার গান, যা নলিনীর কলমে উঠে এসেছে বিনা আয়াসে। বাঙালি পাঠক যদি একটু মনোযোগ দেন এই জগতটাকে চিনতে খুব অসুবিধা হবে না। মনোযোগ দেওয়ার জন্য দরকার সহমর্মিতার; আর এই বোধ যে এও বাংলারই অংশ – বিপুলা বাংলার যে অংশটিকে বাদ দিয়ে, যাকে বাইরে ফেলে রেখে বাংলা আসলে রিক্ত হচ্ছে। উপন্যাস নিয়ে আলোচনার অবকাশ নিশ্চয়ই আছে; কিন্তু তার আগে দরকার এর একটি দ্রুত ও গভীর পাঠ – -যে কোনোও বাংলাভাষীর কাছে যা অপরিহার্য। বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরানো এই সৃষ্টির প্রকৃত রসাস্বাদন পরিশ্রম দাবি করে - ভালোবাসার জিনিস শ্রম ছাড়া পাওয়া যায় না।
ডার্করুম পত্রিকায় ২০১১ সালে প্রথম প্রকাশিত
২০১২ সালে আনন্দ থেকে প্রকাশিত আধিপত্য ও লোকপ্রজ্ঞা সংকলন-এর অন্তর্ভুক্ত।