“ঘর খালি। মুষলধারায় বৃষ্টির জল বয়ে যাচ্ছে ঘরের ভেতর। খড় দিয়ে কোনোরকমে ছাওয়া চালের সাধ্য কি যে সে জলের তোড় আটকায়? ভেতরে এক চিলতে এমন জায়গা নেই যেখানে সে মাথা বাঁচাতে পারে…তার মনে হল ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েগুলোকে বাড়ি নিয়ে আসা দরকার। কিন্তু, সে তাদের খাওয়াবে কী? তারা কীভাবে বাঁচবে? তাদের নিয়ে এসে সে কী করবে? যে অপার দুঃখ, আর অবিরাম জঠর দহন সে ভোগ করে আসছে তাদের কপালেও কি সে সেগুলোই লেখা থাকবে?...সে যা যা করতে চেয়েছে, একটু একটু করে গড়তে চেয়েছে, সব ধূলায় মিশে গেছে – কেন এমন হল, কেন এমন হয়?...সে তো নিয়মিত তাদের দেবতাদের কাছে বিনতি করে এসেছে, বলি দিয়ে এসেছে পায়রা, মোরগ আর পাঁঠা। হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছে তাদের থানে।…কিন্তু দেবতারা তার কথা শোনেনি, তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।...কাদা মেঝের ওপর সে কপাল ঠোকে, কান্নায় ভাঙ্গা গলায় সে দেবতাদের বলতে থাকে, ‘হে ঠাকুর, এতটুকু দয়ামায়া নেই, তোমরা এতই নিষ্ঠুর!’ নিষ্ফল তার আর্তি; তার করূণ প্রার্থনা ঢেকে দেয় বৃষ্টি আর ঝড়ের ক্রমাগত বেড়ে চলা সোঁ সোঁ আওয়াজ।”
জমিজায়গা যা ছিল, সব যায় মহাজনের দখলে। তার মেয়েরা খাটতে গেল বাইরে, নইলে খাবে কী? গোপীনাথ মহান্তি-র শুকরা জানি-র সৃষ্টি ১৯৪৫-এ, তাঁর পরজা উপন্যাসে। অথচ আজও সে কত জীবন্ত, কিম্ব বলা যায়, সে যেন আজকের দিনে আরো বেশি করে আদিবাসীদের প্রতিনিধি হইয়ে উঠেছে। ক’বছর আগে এ উপন্যাসের ভৌগোলিক এলাকাগুলো ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। ওডিশার কোরাপুট-কলাহাণ্ডি অঞ্চলে শুকরার উত্তর-প্রজন্মের অবস্থা বদলেছে ঠিকই, কিন্তু সেটা খারাপের দিকে। জমি চলে গেছে। জীবন জীবিকার সাধনে যে অরণ্য ছিল সুরক্ষার প্রতিমূর্তি, সে বনভূমি আজ নষ্টপ্রায়। শুকরাদের জমি-জায়গা, স্থাবর-অস্থাবর সংস্থানগুলো লুঠ করত মহাজন; আজ তাদের জায়গা নিয়েছে কর্পোরেট পুঁজি – কিন্তু তার প্রকৃতি আরো নিষ্ঠুর। রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে কর্পোরেট পুঁজি ঝাঁপিয়ে পড়েছে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে উগ্রতম আক্রমণে।
ভারতবর্ষ চারশোর অধিক আদিবাসীগোষ্ঠীর আবাস্থল, যাঁদের জনসংখ্যা সাড়ে আট কোটির কাছাকাছি। অন্যভাবে বলতে গেলে আদিবাসীরা মোট জনসংখ্যার ৮.২ শতাংশ। এঁদের প্রায় তিন চতুর্থাংশের বসত মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, পাশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা, গুজরাট, এবং বিহারে। অবশ্য, উত্তর-পূর্ব দিশার মিজোরাম (৯৪%), নাগাল্যাণ্ড (৮৯%), মেঘালয় (৮৬%), এবং অরুণাচল প্রদেশ (৬৪%)-এর মতো রাজ্যগুলোতে জনসংখ্যায় যে রকম আদিবাসী সংখ্যা গরিষ্ঠতা ভারতের আদিবাসীবহুল রাজ্যগুলোতে কিন্তু তা নয় – এ সব রাজ্যে আদিবাসীরা সংখ্যালঘু। সংখ্যায় তাঁরা বিরাট হলেও মোট এ রাজ্যগুলোতে জনসংখ্যা যেহেতু অনেক বেশি, তাঁদের আপেক্ষিক ঘনত্ব লঘু হয়ে যায়।
এই ব্যাপারটা ভারতে আদিবাসী প্রশ্ন নিয়ে আলো্চনায় একটা জটিলতা যোগ করেছে। এ লেখায় প্রশ্নটাকে তার পূর্ণরূপে দেখার সুযোগ নেই। আমরা প্রধানত ভারতের তথাকথিত মূল ভূখণ্ডের আদিবাসী প্রশ্ন নিয়ে কিছুটা বিশ্লেষণের চেষ্টা করব। প্রসঙ্গক্রমে, ত্রিপুরা ও আসামের আদিবাসী বিষয়েও কিছুটা দৃষ্টিপাত করতে হবে, কারণ, এ রাজ্যগুলোতে আদিবাসী সম্পর্কগুলো তথাকথিত মূল ভূখণ্ডের মতোই – দক্ষিণ ভারত নিয়েও একই কথা।
সাধারণ বঞ্চনা
দেশের বেশির ভাগ রাজ্যেই যে আদিবাসীরা ভয়ানক সামাজিক বঞ্চনা ও অর্থনীতিক আক্রমণের শিকার এটা নতুন কোনো কথা নয়। এমনকি কেরলের মতো উন্নয়নের ইতিহাস গড়া রাজ্যেও আদিবাসীদের শিক্ষাগত বঞ্চনা (সাক্ষরতার হার ৭৬%, যেখানে মোট সাক্ষরতার হার ৯৪%) তীব্রভাবে ধরা পড়ে। অন্য রাজ্যগুলোতে অবস্থা শোচনীয় – সাক্ষরতার হার ৫০%র সামান্য ওপরে।
স্বাস্থ্য, পুষ্টি ইত্যাদি উন্নয়ন-সূচকগুলোর দিকে দিয়ে দেখলে যে ছবিটা পাওয়া যায়, তা এক কথায় অসহনীয়। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে, ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে-র মতো প্রামাণ্য সমীক্ষাগুলো বছরের পর বছর ধরে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের একপ্রকার নীরব হামলার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
আর্থনীতিক ক্ষেত্রটাতে আবার আদিবাসীরাই হচ্ছেন দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতর – তাঁদের প্রায় পুরোটাই জীবিকার জন্য দিনমজুরি বা সমপ্রকার কঠিন দৈহিক শ্রমের উপর নির্ভরশীল। মূল ভুখণ্ডের রাজ্যগুলোতে আদিবাসীদের ৮৪ শতাংশই হয় ক্ষেত মজুর বা স্ব-ঘোষিত চাষি। “স্ব-ঘোষিত” কথাটা ব্যাখ্যা দাবি করেঃ পশ্চিমবাংলা থেকে ছত্তিশগড়, ওডিশা থেকে মহারষ্ট্র – আদিবাসীরা নিজেদের কৃষক পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন। এক কালে তাঁরা এমন এক স্বয়ম্ভর অর্থনীতির অংশ ছিলেন, যেখানে তাঁদের অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হত না। কিন্তু, জমি বে-দখল হতে হতে, এবং লাগাতার দেশি-বিদেশি শাসক-শোষকদের অত্যাচারে, এক সময়কার আত্মনির্ভর আদিবাসী পরিণত হল দেহ-শ্রম বিক্রি করে জীবিকা অর্জন করা মজুরে। কিন্তু, এই মজুর সত্ত্বার বাস্তবতা ও অতীতের স্মৃতি যা আজ বদলে যাওয়া অবাস্তব- দুটোই আদিবাসী মনে বেঁচে থাকে। বস্তুত তার সাংস্কৃতিক জীবনের বেশির ভাগ জুড়েই সেই অতীতের কৃষি-কেন্দ্রিক স্বনির্ভর আর্থনীতিক সঞ্চলনের ছায়া। সেই একদা বাস্তবের জাগ্রত স্মৃতিতে আদিবাসী এখনো নিজের পরিচয় দেয় – আমি চাষি, তা সে যতই কেননা তার সংসার চালাতে তাকে বছরের ন’মাস ক্ষেতমজুরি করতে হোক।
বঞ্চনা ও শ্রেণি-সংযোগ
কেন এমনটা হচ্ছে? আদিবাসীদের দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাসের একটা বড় যোগ আছে ঔপনিবেশিক শাসনের সংগে; কিন্তু সে শাসনের অবসানের পর এতদিন কেটে গেলেও ভারতের আদিবাসী-সম্পর্কটাতে কোনো পরিবর্তন হলনা কেন? শোষণমূলক এই সম্পর্কের নৃগোষ্ঠীগত, ভৌগোলিক, ইত্যাদি নানান সংযোগ আছে। কিন্তু, এর একটা প্রধান যোগসূত্র হচ্ছে শ্রেণি, যা আবার অন্যান্য উপাদানগুলোর সংগে অত্যন্ত জটিলভাবে ক্রিয়াশীল।
ভূমিবিচ্ছিন্নতা
আদিবাসীদের বঞ্চনা শুরু হচ্ছে তাঁদের ভূমিহীনে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে, যার সূচনা ঔপনিবেশিক শাসনে, ১৭৯৩-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে। পুঁথিগত প্রমাণ থেকেই আমরা দেখতে পাই কীভাবে লক্ষ লক্ষ আদিবাসী ঔপনিবেশিক প্রভুদের দেশীয় সেবকদের কাছে তাঁদের জমি হারিয়েছেন। বিদেশি শাসকরা আদিবাসীদের মধ্যে খুঁজে পেল সস্তা শ্রমের বিরাট মজুদ, আর দেশী শোষকরা, শাসকীয় মদতে কেড়ে নিল তাদের জমি।
যে গ্রামে আমার জন্ম ও বড়ো হওয়া তার ৯০% লোক ই আদিবাসী – সাঁওতাল ও মুন্ডা। সাঁওতালরা এ গ্রামের পত্তন করেন। মুণ্ডারা অন্য এক গ্রামে অ- আদিবাসী প্রবঞ্চকদের কাছে সর্বস্ব হারিয়ে এ গ্রামে বন কেটে বসত গড়েন। কিন্তু, গ্রাম পত্তনের কিছুদিনের মধ্যেই অ-আদিবাসী - আদিবাসীদের ভাষায় দিকু-দের আগমন। গ্রামের পুরনো নথি ও মৌখিক ইতিহাস থেকে জানতে পারি সেখানকার সব জমিই ছিল আদিবাসীদের, কিন্তু আজ তার ৭৫% ই বেহাত। বর্তমান ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগ্ণার এক গ্রামে টানা এক বছর থাকার সুযোগ ঘটেছিল। সেখানেও এক ই কাহিনি – জমি তৈরি করেছিলেন সাঁওতালরা, কিন্তু ভোগ করছে দিকুরা – বীরভূম থেকে যাওয়া এক ব্রাহ্মণ পরিবারের হাতে সে গ্রামের উর্বর জমিগুলোর প্রায় পুরোটাই। ওডিশার রায়গড়া জেলার কাশিপুর থানায় দেখলাম এক ব্রাহ্মণের হাতে এক হাজার একরেরও বেশি জমি – পুরোটাই পরজা ও খণ্ড আদিবাসীদের কাছ থেকে ঠকিয়ে নেওয়া। যে তিন জায়গার কথা বল্লাম, সব ক’টাতেই একশো বছরের ব্যবধানে স্ব-নির্ভর আদিবাসী রা হয়ে উঠেছেন মজুরি-শ্রমের উপর নির্ভরশীল, জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত। অবশ্য, এগুলো জানবার জন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই – হাজার হাজার সরকারি নথি থেকেই এগুলো ভালভাবে জানা যায়।
জনবিন্যাসগত পরিবর্তন
ভূমিহীনতার একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে জনবিন্যাসের ওপর। আদিবাসীদের স্ব-ভূমি ছেড়ে দূর বিভূঁইয়ে গিয়ে ঠিকানা নিতে হইয়েছে। সাঁওতাল পরগনা, ছোটনাগপুরের লক্ষ লক্ষ আদিবাসীকে গ্রাম-জংগল-ঝর্ণা ছেড়ে চলে যেতে হল আসামে, উত্তরবঙ্গে। আবার জমির মালিকানা বদলের মধ্য দিয়ে আদিবাসী এলাকাগুলোতে এসে জড়ো হতে লাগল অ-আদিবাসীরা। ১৮৫৬ সনে কলাহাণ্ডির জনসংখ্যায় আদিবাসীরা ছিলেন ৬৩ ভাগ; আজ সেটা বদলে দাঁড়িয়েছে ৩৩-এ। ছোটনাগপুর-সাঁওতাল পরগণা-মেদিনীপুর-পুরুলিয়া-ময়ুরভঞ্জ সর্বত্র আদিবাসীদের নির্মম প্রান্তিকীকরণের অসহনীয় অভিজ্ঞান।
উচ্ছেদ
এর পর আসলো উন্নয়নের নাম করে সর্বনাশা উচ্ছেদ। ওয়াল্টার ফার্নান্ডেজ সহ অনেকেরই গবেষণায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কীভাবে লক্ষ লক্ষ আদিবাসীকে তাঁদের বসত ভূমি থেকে জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে – কোথাও বাঁধ, কোথাও খনি, কোথাও বা পর্যটন বিলাসের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের ছদ্মবেশে লুন্ঠনের মহা আয়োজন। এ উন্নইয়নের যাঁতাকলে সব চেয়ে বেশি যাঁরা পিষ্ট হচ্ছেন, তাঁরা হচ্ছেন আদিবাসীরা। একটা সমীক্ষার হিসেবে, উন্নয়নের নামে উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের ৪০% ই হচ্ছেন আদিবাসী – অথচ মোট জনসংখ্যায় তাঁদের অংশ মাত্র ৮ ভাগ!
১৯৫৬ সনে তৈরি হল ময়ুরাক্ষী নদীর ওপর বাঁধ – সাঁওতাল পরগনার ১৪৪ সুফলা মৌজাকে জল্মগ্ন করে। সে সব গ্রামের আদিবাসীরা বাধ্য হয়ে বসত গড়লেন বীরভূম-দুমকা সীমান্তের ঊষর ভূভাগে। সম্বৎসর যাঁরা চাষের ধানে ভাত খেতেন তাঁরা রাতারাতি পরিণত হলেন অনাহারী, অর্ধাহারী দিনমজুরে। একই নিষ্পেষণের গাথা শুনতে পাওয়া যায়, কলাহান্ডির ইন্দ্রাবতী বাঁধের তলায় চাপা পড়া আদিবাসীদের স্বয়ম্ভর অর্থনীতির স্মৃতি-রোমন্থনেঃ “নুন আর কাপড় ছাড়া আমাদের কিছুই প্রায় কিনতে হতনা। ধান, ছোলা, মুগ, সব্জী-র অঢেল সম্ভার ছিল। আর ছিল গরু, শুয়োর, মুর্গীর পাল। আর আজ আমরা ভিখারি, ক্ষোভ উগ্রে দিচ্ছিলেন পাডেপাদরের শ্যাম ঝডিয়া।
উন্নয়ন শুধু তাঁদের স্ব-গৃহ থেকে উৎখাতই করেনি; কেড়ে নিয়েছে তাঁদের অরণ্য, নদী, বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। “জমি গেল, জংগলও গেল, মান-সম্মান গেল” শ্যামের আক্ষেপ শুধু পাডেপাদর নয়, শোনা যাবে ভারতের আদিবাসী কুটীরগুলোর প্রতিটি কোণে। কর্পোরেট লোভের কাছে তাঁদের বিসর্জন দিতে হইয়েছে জৈবিক নিরাপত্তা, মানবিক সম্মান।
ত্রিপুরার উদাহরণ দেখা যাকঃ একদা রাজ্যের জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ আদিবাসীরা আজ সেখানে সংখ্যালঘু; সেই সংগে তাঁরা হারিয়েছেন তাঁদের জমি ও সুফলা প্রকৃতি। আদিবাসীদের হারানো জমির পরিমাণ তিন লক্ষ একর।
আদিবাসীদের মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া অপরত্বের আর এক নমুনা দেখা গেল পশ্চিমবাংলার বক্সাদুয়ারেঃ ১৯৯২ সালের এক ভোরে তাঁদের জীবনে অকস্মাত নেমে এল ঘোর অমানিশাঃ বনবিভাগের আদেশে পাহাড়ের সব কমলাবাগান কেটে ফেলা হল। কমলাবাগান থেকে পাওয়া আর্থিক স্বনির্ভরতা হারিয়ে ডুকপা আদিবাসীরা পরিণত হলেন মজুরে। কেন কাটা হল কমলাবাগান? এক ডুকপা-র কথায়ঃ “সরকার আমাদের বলছিল নিচে নেমে এসে সবাইকে এক জায়গায় থাকতে। কিন্তু, তা কী করে হয়? আমরা জন্ম জন্ম ধরে এ-পাহাড়ে অ-পাহাড়ে বাস করে আসছি, আজ যদি বলা হয় তোমাদের রহন-সহন বদলে ফেলতে হবে, তা আমরা কী করে করব, কেনইবা করব? কিন্তু সরকার সর্বশক্তিমান – জোর খাটিয়ে আমাদের বাগে আনতে চাইল।”
দেশান্তরের চলমান ইতিহাস
এ সবের সংগে চলছে দেশান্তরের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ। দলে দলে আদিবাসী স্ব-গ্রাম, স্ব-গৃহ ছেড়ে কেবল ভাতের নিশ্চয়তার জন্য পাড়ি দেন দূর দেশের শষ্যক্ষেত্রে বা অন্যান্য কাজের জায়গায়। কঠিন সে যাত্রা, ভীড় বাসের ভিতর পিষ্ট হতে হতে কাজের জায়গায় পৌছোনো। বাসের মধ্যে আদিবাসীদের নারীদের নির্যাতনের এবং নির্যাতন সয়ে যাওয়ার সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, কার্মক্ষেত্রেও একই উৎপীড়ন। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেইঃ যে কোনো ধান রোয়া-কাটার মরসুমে বর্ধমান-হুগলি-র গ্রামগুলোতে, সে গ্রামে যাবার বাস-ট্রেন অন্যান্য যানবাহনগুলোতে দেখা যাবে মানুষী মর্যাদার অবমাননার ভয়ংকর ছবি।
মৌলিক অধিকার হনন
এর সংগে আছে মৌলিক অধিকার হনন। সারা দেশ জুড়ে আদিবাসীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মনিয়োজনের অধিকাগুলো থেকে বঞ্চিততো হনই। এর চেয়ে বড়ো অধিকার হনন ঘটে তাঁদের সাংবিধানিক মর্যাদার বঞ্চনায়। যেমন আসামেঃ এখানকার চা-বাগান, এখানকার শস্যক্ষেত্র, এবং আর্থনীতিক সমৃদ্ধিতে ঝাড়খণ্ড সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রা থেকে আসা আদিবাসীদের অবদান বিপুল। অথচ, এ রাজ্যে তাঁরা তফসিলি জনজাতি (এস-টি) মর্যাদা পাননা। কারণটা শ্রেণিগত – এ মর্যাদা পেলে সাংবিধানিক রক্ষা কবচগুলো ব্যবহার করে অন্তত একটা অংশের আদিবাসী নিজেদের জীবনযাত্রার মান বাড়াবার সুযোগ পাবেন, কিন্তু সেটা পেলে অবিশ্বাস্য সস্তা মজুরিতে চা-বাগানে কাজ করবে কে? সরকার, স্পষ্টত, অসমিয়া শাসকশ্রেণির পক্ষে, বা তাদেরই প্রতিভু। এর উপর আছে কথায় কথায় ঝাড়খণ্ডী আদিবাসীদের উপর সরকারি মদতে আসামেরই বোডোদের মতো কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর অকল্পনীয় হিংসা – গত শতাব্দীর ভারতে আসামের কোকরাঝাড় জেলায় লক্ষ লক্ষ সাঁওতাল বোডো জঙ্গীদের হাতে প্রাণ হারান, গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে লোকেরা পালাতে বাধ্য হন শরণার্থী শিবিরে।
কী ভাবে দেখব
আদিবাসী প্রশ্নটাকে কীভাবে দেখব? সাধারণত আদিবাসী প্রশ্নটাকে যেভাবে দেখা হয়ে থাকে তাতে শোষণের বিরোধিতার কথা বললেও আসলে তা শাসকীয় অবস্থানটাকেই দৃঢ় করে। যেমন, অ-আদিবাসী বিদ্বান বা রাজনীতিক মহলে প্রায়ই আদিবাসীদের উন্নতির জন্য খুবই জোর দেওয়া হয়ে থাকে। সমস্যাটা হল, আদিবাসীদের উন্নতির কথাটা ভাবা হয়, তাঁদের প্রতি এক কৃপাবর্ষী মনোভাব থেকেঃ “ওদের জন্য কিছু করতে হবে”- এই অপরত্বের প্রভাব একদিকে যেমন দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে, তেমনি অন্যদিকে আদিবাসীদের সঙ্গে অন্যদের ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা দূরত্বটাকে বাড়িয়ে তোলে। আদিবাসীরাতো অন্যদের সহ-নাগরিক; আধুনিক শিক্ষা, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য-পরিচর্যা, ইত্যাদি নানা ব্যাপারে তাঁরা যে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে আছেন তার কারণটা সুযোগবঞ্চনা – তাঁরা সেই সুযোগ পাননি। সে সুযোগের জন্য একযোগে- সহ-নাগরিকত্বের বোধে – লড়াই করাটা যেমন একটা কাজ, তেমনি আবার আদিবাসী বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা নানান সাংস্কৃতিক-দার্শনিক সমৃদ্ধি থেকে ভারতবর্ষ যে স্বেচ্ছায় বঞ্চিত হয়ে রয়েছে, সেই আচ্ছন্ন-দৃষ্টি বঞ্চনা থেকে নিজেদের মুক্ত করাটাও একটা প্রধান কর্তব্য। মুণ্ডারি ভাষায় আছে ১৪ খণ্ডের এন্সিক্লোপেডিয়া, সাঁওতালি ভাষার অভিধান সংকলিত করে লেগেছে ৫টা খণ্ড, এ সব সমাজে গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা সুউচ্চ দার্শনিক ভাবনা ও অনুশীলনের প্রতিফলন। আমরা শুধু তাঁদের দেব, নেবনা কিছুই এতে যেমন অশ্রদ্ধা আছে তেমনি আছে মূঢ় আত্ম-প্রবঞ্চনা। পারস্পরিকতার অনুশীলন ছাড়া আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অবিচার-অত্যাচারগুলো যেমন দূর করা যাবেনা, তেমনি ভারতবর্ষকেও প্রকৃতপক্ষে মুক্ত-স্বাধীন এক দেশে উত্তীর্ণ করা যাবেনা। শুকরা জানি-র দেবতার তার প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটাতো আসলে ভারতবর্ষের এক মহাসংকটের চিহ্নঃ সমানুভূতির অনস্তিত্ব। সে অনস্তিত্বে শুকরা জানি যতটা দুর্ভাগ্যের শিকার দেশের দুর্ভাগ্যও ঠিক ততটাই।