এক ছিল বউ। সে একটা গল্প জানত, আর জানত একটা গান। কিন্তু, সে তাদের নিজের মনের ভেতরেই রেখে দিয়েছিল, বাইরে বেরোতে দিত না। কিন্তু, তারা থাকবে কেন? একদিন যখন বউটি ঘুমিয়েছে, গল্প আর গান তার ভেতর থেকে বেরোল। বেরিয়ে একজন নিল জুতোর রূপ, আর একজন জামার। জুতো পড়ে রইল দুয়ারের মুখে, জামা ঝুলে রইল চালের বাতায়। সেই বউ-এর বর এসে দেখল, জুতো পড়ে আছে, জামা ঝুলে আছে। সে তখন বউকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, কে এসেছে? কার জুতো, কার জামা? বউ বলল, জানি না তো। বরের সন্দেহ হল। সে বউর সঙ্গে ঝগড়া করে মন্দিরে শুতে চলে গেল। এদিকে রোজ রাত নিশুত হলে, গাঁয়ের সব গেরস্তরা যখন নিজেদের বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লে, সেই বাতিগুলো এসে মন্দিরে জড়ো হত আর নিজেদের মধ্যে গল্প করত। তা সেই রাত্রে বউ-এর বাড়ির বাতিরা আস্তে দেরি করল। সবাই জিজ্ঞাসা করল, কেনরে, তোদের দেরি হল কীসে? তখন তারা বলল, গল্প আর গানের কথা, তাদের চটি আর জামা হয়ে বাইরে বেরোবার কথা, আর তাদের নিয়ে বর-বউর ঝগড়ার কথা। মন্দিরে শুয়ে থাকা বর তাদের এই কথা শুনে সব বুঝতে পারল, আর বাড়ি ফিরে গেল।
এটি একটি কন্নড় লোককথা। একটি। কাহিনি নিয়ে, সঙ্গীত নিয়ে, মানুষের ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশ নিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে এমন অসংখ্য লোককথা শোনা যায়। মানুষ বলতে চায়। মানুষ শুনতে চায়। সে যা দেখে, যা শোনে, যা অনুভব করে, সেগুলোকে প্রকাশ করতে চায়। অবশ্যই নানা লোকের ঝোঁক নানা দিকে। ঝরনার জল বয়ে যেতে দেখে কারো মনে আনন্দ হতে পারে, কারো বা বিস্ময়, আবার কেউ বা অপার কৌতুহলে ঝরনার উৎপত্তি কোথায় বা কোথায় গিয়ে সে পড়েছে, সে সবের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। কারো মনে প্রশ্ন আরো গভীর: ঝরনা কেন? কী কারণে এর উৎপত্তি? এ কি নিছক প্রকৃতির খেলা, না কি এর সৃষ্টির পিছনে প্রকৃতির বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে? কেন এর গতি পূর্ব-পশ্চিমে না হয়ে উত্তর-দক্ষিণে হয়েছে, ইত্যাদি? আবার এমনও কেউ কেউ থাকেন, যিনি একই সঙ্গে আনন্দিত, বিস্মিত, কৌতূহলী, এবং প্রশ্নমগ্ন।
এঁরাই স্রষ্টা। এঁদের মুখ থেকে আমরা শুনতে পাই আমাদের কথা, শুনতে শুনতে আমরা কখন যেন এই কথকের অংশ হয়ে উঠি, শ্রোতা বা পাঠক হয়ে ওঠে কথক ও লেখক। এঁরা স্রষ্টা, কারণ, এঁরা নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকেন, শিকড় চারিয়ে দেন গভীর থেকে গভীরতর মৃত্তিকায়, আর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দেন উর্ধ্বে, বিপুল আকাশের পানে। এঁরা একইসঙ্গে স্থানিক, আবার বৈশ্বিক। এঁদের দেহ বাস করে মৃত্তিকা কুটিরে, আর মনের নিবাস ছড়িয়ে থাকে ভুবনময়। তাই স্রষ্টা এই মুহূর্তে স্বতন্ত্র, আবার পরমুহূর্তে সাধারণের একজন। লোকের ভাষা তিনি এত ভাল জানেন বলে লোকান্তরের ভাষাও তাঁর অধীত – সে ভাষা কখনো পরম আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, আবার কখনো মগজের ভেতর হাতুড়ির ঘা মারে। তিনি এই ভাষা আয়ত্ত করেন কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে, যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বোধের আগুনে নিজেকে শুদ্ধ করে, মানুষ নামক পরম সৃষ্টির কাছে নিজেকে উতসর্গ করে দিয়ে। মেধা নয়, সহজাত দক্ষতা নয়, সৃষ্টির শর্তই হল অনুশীলন।
কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর এমনই এক অনুশীলক বলেই তাঁর হাতে জন্ম নেয় “উজানতলির উপকথা”-র মতো আদি-অন্তের সীমানা ছাড়ানো এক আশ্চর্য সৃষ্টি। দুই খণ্ডের এই উপন্যাসের প্রধান বিশেষত্ব হল এর বহুস্তরীয় প্রেক্ষাপট। দেশভাগের পরিণতিতে বাংলার দ্বিখণ্ডীকরণ যেমন এর এক প্রেক্ষাপট, তেমনি আবার অবিভক্ত বাংলায় – এবং ভাঙ্গা বাংলায়ও বটে – বাঙালি জনসম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত বৈষম্য এর অন্য এক প্রেক্ষাপট, আবার জাতি ও ধর্মীয় বিভাজনের সঙ্গে আর্থিক শ্রেণিবিভাজনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এ কাহিনির তৃতীয়, এবং জটিলতর পৃষ্ঠভূমি। প্রেক্ষাপটের বিভিন্নতার বিপরীতে আছে সেই বিভিন্নতাগুলো নিয়ে নির্মিত ও এগিয়ে চলা এক বৃহত্তর মানব সংহতির উপাখ্যান। বস্তুত, কপিলকৃষ্ণর কথনে এই দ্বিমুখী টান থেকে জন্ম নেয় এমন এক উচ্চতর মানবিক সংবেদনা যা কাহিনির ভৌগোলিক ভূমি উজানতলীকে উত্তীর্ণ করে বিশ্বমানবের আবাসভূমিতে। আর বিশ্বপৃথিবীকে মিশিয়ে দেয় উজানতলীর সমাজে।
উজানতলী গ্রামের সুখদুঃখ, আনন্দ, পালা-পার্বণ, খাল-নালা-বিল, পাখ-পাখালিকে বিদায় জানিয়ে কাজল নামক বালককে চলে আসতে হয়, এপার বাংলায়, যে ভুঁই তার কাছে বিদেশ। স্বদেশ উজানতলীতে যেমন সুখের ঝরণা ঝরত, তেমনি আবার সেখানে ছিল জাতপাতের পূতিগন্ধ। নমশুদ্ররা নিচুজাত, হিন্দু উঁচুজাতের লোকেদের কাছে অস্পৃশ্য। যে বাদাবন ভেঙ্গে, বহু শ্রমে-ঘামে তারা তৈরি করেছিল যে আবাদি জমি তার মালিকানা উঁচু জাতের লোকেদের হাতে। যে মুসলমানদের সঙ্গে তাদের ধর্মীয় প্রভেদ, তাদের সঙ্গেই তাদের সম্মিলন ঘটায় ভূমিসম্পর্ক, উৎপাদন সম্পর্ক। আবার ঔপনিবেশিক শাসক ও তার এদেশি মিত্রবাহিনীর ষড়যন্ত্রে ঘটে যাওয়া দেশভাগের নিষ্ঠুর নিয়তি সেই মেহনতি সম্পর্ককে পুঁতে দেয় সাম্প্রদায়িকতার পাঁকে। সন্ধ্যায় যা ছিল মানুষী সম্পর্কে উচ্ছল এক দেশ, নিশিভোরে তাই ওঠে ছিন্নভিন্ন, নির্জীব, এক অবয়ব, এতই অচেনা, যেন কোনো জন্মে তার অস্তিত্বই ছিল না। সে দেশে জন্ম নেওয়া, সে দেশের জলে হাওয়ায় গড়ে ওঠা দেহ মনের মানুষগুলোর ওখানে যাবার হক নেই, হুকুম নিয়ে তবে যেতে হবে। যে পাখির ডাকে তার ঘুম ভাঙত, যে নদীর জলে তার দেহ-মন শীতল হত, যে বৃক্ষতলে দু দণ্ড বসে সে সঙ্গীদের সঙ্গে পূর্বকথা-উত্তরকথা আলোচনা করত, যে কুটিরে সে ভাত ফোটাত, যে বিলে সে মাছ ধরত, সে-সব আরা তার নয়, অন্য কারো। সে আজ নিতান্ত বিদেশি।
তবু পথ চলা। ভাঙ্গা পথের ওপর দিয়ে, পথহীন প্রান্তরের ওপর দিয়ে পথ করে নিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে, নদী পেরিয়ে, বিল পেরিয়ে, অন্য এক ভুঁইতে এসে দেশ গড়া। সেও এক কঠিন ইতিহাস। স্বজনহারানোর বেদনা, স্বদেশ হারানোর হাহাকার নিয়ে নতুন স্বদেশ চিনে নেওয়া। গড়তে গড়তে অনেক কিছু ভাঙ্গা, অনেক কিছু ত্যাগ করা, অনেক সম্পর্কের নবায়ন, অনেক সম্পর্কের মৃত্যু।
এ কথা বড় সরল নয়। সহজ নয় একদিকে প্রচণ্ড গতিবান এক সমাজ এবং অন্যদিকে প্রস্তরীভূত অ-মর্যাদাকে শব্দের রূপ দেওয়া। এর পরতে পরতে সুক্ষ্ম সূক্ষ্ম পরত। বাংলার পূর্বভাগে হিন্দু সমাজের মধ্যে নানা সম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতা, হিন্দু মুসলমানের মৈত্রী ও সংঘাত, হিন্দুর নানা ধাপের সঙ্গে মুসলমানের নানা ধাপের যোগ ও যোগবিচ্ছিন্নতা, নারী-পুরুষের বিরহ-মিলন, গৃহাভ্যন্তরে নানা জনের সঙ্গে নানা জনের মিল-অমিল, রক্তসম্পর্ক ছাড়াই কেবল গ্রামসম্পর্কের ভিত্তিতে আত্মীয়তা – খুড়ি, জেঠি, পিসি, কাকা। কাহিনিতে এত পরত এই জন্যই যে, সমাজটাও তাই – তার সারা অবয়ব যেন বেতের বোনা চাটাই। কোনটা যে কার সঙ্গে লেগে আছে, খালি চোখে দেখার উপায় নেই। তাকে দেখতে হয় তার সম্পূর্ণ অবয়বে, কিন্তু ভেতরের জড়িয়ে থাকা দেহাংশগুলো, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাঁকফোকরগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে নয়, অতি যত্নে সেগুলোকে পুংখানুপুংখ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। তার জন্য চোখ চাই, মন চাই, এবং চাই যে দৈহিক পরিশ্রমের অভ্যাস ও ক্ষমতা।
এগুলো আয়ত্ত করা সহজতো নয়ই। অনেকের কাছে অসম্ভবও বটে। বলতে দ্বিধা নেই, বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত মূলস্রোত – বাংলার নবজাগরণের মধ্য দিয়ে উঠে আসা উচ্চবর্ণ হিন্দু লেখক লেখিকাদের কাছ থেকে আমরা যে কথনের এই বহু-কেন্দ্রিক বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক পাইনি তার কারণ তাঁদের কাছে সমাজের পরতগুলোকে এভাবে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখা দেয়নি। দেয়নি, কারণ দিতে পারে না। এই পরতগুলোকে চিনতে হলে সেগুলোর সঙ্গে যেভাবে পরিচিত হতে হয়, অহর্নিশি আত্মমর্যাদার রক্তপাত, আপন মানুষদের মর্যাদার নিধন দেখতে দেখতে যেভাবে তার বয়ঃপ্রাপ্তি ঘটে তা এঁদের জীবনে ঘটে না। ঘটার সুযোগ হয় না। দলিত-নিপীড়িত মানুষদের সুযোগবঞ্চিত রাখার সহস্র বছরের অভ্যাস এঁদের রক্তকণিকায়, মস্তিষ্কের কোষে। বস্তুত, অভ্যাসের দাসে পরিণত হওয়া এঁদের বুদ্ধি এই ফা্রাকটাও করতে পারে না যে, কোনটা প্রকৃত সুযোগ, আর কোনটা বঞ্চনা। ফলে বাঙালি পাঠকও বঞ্চিত থেকেছে সাহিত্যসৃষ্টির এক উচ্চতর ভুবনদর্শন থেকে।
উজানতলী এমনি এমনি রচিত হয়নি। এর রচিত হওয়াটা দরকার ছিল। সামাজিক তাগিদেই এর সৃষ্টি। এই কথন একদিকে যেমন দলিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে এগোবার ছটফটানি অন্যদিকে তেমনি সাহিত্যের বিস্তৃত পরিসরে সমাজকে তার পূর্ণরূপে উপস্থাপন।
বড় যন্ত্রণায় লেখা এই উপন্যাস। যুগযুগ ধরে ঘটে আসা লাঞ্ছনা, অপমান, মানুষী মর্যাদার হনন থেকে জন্ম নেওয়া বিষ উঠে আসতে চেয়েছে কলমে আর মানুষী মর্যাদার তাগিদেই কপিলকৃষ্ণকে নিষ্ঠুরভাবে সেই বিষকে পুনরায় পুরে ফেলতে হয়েছে নিজের গলায়। তার জন্য তাঁকে ক্ষতিও মেনে নিতে হয়েছে – ছাড়তে হয়েছে সহজ জনপ্রিয়তা লাভের সুযোগ। কিন্তু, যে কথক মানুষের চিরন্তনতায় বিশ্বাসী, সকল মানুষের স্বাধিকারে পূর্ণমানব হয়ে ওঠায় বিশ্বাসী, সে কী করে তাৎক্ষণিক লাভের আশায় নিজের মর্যাদা বিসর্জন দেবে? কথক জানেন, বিষ প্রাণঘাতী, আর অমৃত অধরা, অস্তিত্বহীন। তাই গরল বা অমৃত নয়, রূপান্তরের সংগ্রামটাকেই তিনি জীবন হিসেবে স্বীকার করেছেন। সজীব বর্ণনা, ভাষায় উঠে আসা মাটির গন্ধ, ফুলের সুবাস, পাখির কাকলি যেমন এর একটি শক্তি, তেমনি এর দ্বিতীয় পারঙ্গমতা হচ্ছে এর সংযম। রূপান্তরের জন্য যত টুকু চাই থিক ততটুকু, কমও না বেশি ও না। লেখার শুরুতে কন্নড় লোককথায় গল্প আর গানের যে রূপান্তরের সংগ্রাম লক্ষ্য করেছি, উজানতলী সেই সংগ্রামের এক উত্তরণের কাহিনি। মানুষের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগমনের উপকথা।
ভালো লাগলো। সমালোচনা পড়ে বইটা পড়ার ইচ্ছে জাগলো।
লেখাটা ভাল।
এ বইটা বেশ কিছুদিন লিস্টে আছে। এবার কিনে ফেলতে হবে।